আপনার জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

সকল মাসায়েল একত্রে দেখুন

ওহাবী কাকে বলে এবং এই শব্দের ইতিহাস

প্রশ্নঃ ৮৩৪৬. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, ১) মানুষ যে একজন আরেকজন কে ওয়াহাবী বলে, এক্ষেত্রে আব্দুল ওয়াহাব নজদীর (ব্যক্তি এবং আকিদার) ব্যাপার সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিলাম। উনি কেমন ছিলেন, তার সম্পর্কে কেউ কিছু বললে নিজেকে কি ছোট মনে করার কোনো কারণ আছে? ২) আমল এর ক্ষেত্রে এতো পার্থক্য, এক্ষেত্রে হাদিস অনুযায়ী সঠিক টা মানলে কোনো সমস্যা আছে কি? যদি তা হানাফি মাযহাব এর ব্যতিক্রম হয়,আর সকল সহিহ হাদিস ই ইমাম আবু হানিফা রহঃ এর মাযহাব এই হিসেবে। ৩) বাংলাদেশের আহলে হাদিস এর আলেমগন এর দল টা কি অনেকটা বিশ্বাসযোগ্য?৪) আপনাদের মুসলিম এপ এর শায়খরা কি দেওবন্দী আকিদার, তাই না?,

১৮ অক্টোবর, ২০২৩

গোদনাইল

উত্তর

و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم


আপনার প্রশ্নটি দীর্ঘ আলোচনার দাবী রাখে।
এখানে আমি উস্তাযে মুহতারাম হযরতুল আল্লাম মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক ছাহেব দাঃ বাঃ এর একটি প্রবন্ধ রেডী করে দিচ্ছি।
প্রবন্ধটি কিছুটা সবিস্তারে লিখা হলেও আশা করছি আপনার জন্য উপকারী হবে।

প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয়

এ প্রবন্ধে নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ আলোচিত হয়েছে :

১. আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের পরিচয় ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।

২. ‘আহলুল বিদআত ওয়াল ফুরকাত’-এর পরিচয় ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন।

৩. ‘ওহাবী’ কাকে বলে এবং এই শব্দের ইতিহাস।

৪. উম্মাহর যেসকল আকাবির আলিমকে এ পুস্তিকায় কাফের আখ্যা দেওয়া হয়েছে তাদের বাস্তব অবস্থান ও মর্যাদা এবং কাফির আখ্যাদান -কর্মের স্বরূপ।

‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’

পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য

এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, উম্মাহর সকল দলের মধ্যে সিরাতে মুসতাকীমের উপর অবিচল দলটি হল ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’। এবং একমাত্র এই দলটিই ‘ফিরকায়ে নাজিয়াহ’ (মুক্তিপ্রাপ্ত দল) ও ‘ত্বায়েফায়ে মানসুরাহ’ (সাহায্যপ্রাপ্ত জামাত) যাদের সম্পর্কে হাদীস শরীফে আছে মুক্তির অঙ্গিকার এবং কিয়ামত পর্যন্ত খোদায়ী মদদ ও নুসরত শামেলে হাল হওয়ার সুসংবাদ। এজন্য সিরাতে মুসতাকীম থেকে বিচ্যুত দলগুলোকেও দেখা যায় ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’ নামে নিজের পরিচয় দিতে। আর এ বিষয়ে হিন্দুস্তানের বেরলভী বা রেজভী ফের্কা অন্যান্য গোমরাহ ফের্কার চেয়ে অধিক তৎপর। এরা বাস্তবে ‘আহলুল বিদআত ওয়াল ফুরকাত’ (বিদআতী দল) হওয়া সত্ত্বেও নিজেদেরকে ‘সুন্নী’ ও আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত’ নামে পরিচয় দিয়ে থাকে। আর প্রকৃত আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ্র লোকদেরকে ‘ওহাবী’ নামে আখ্যায়িত করে।

অথচ ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’ নামটিতেই রয়েছে এ নামে অভিহিত হওয়ার মানদ-, যার ভিত্তিতে আসল-নকলের পার্থক্য নিরূপণ করা অতি সহজ। এ কারণে যে বা যারা উপযুক্ততা ছাড়া এই নাম ব্যবহার করবে তাকে প্রকাশ্যে লজ্জিত হতে হবে। কারণ, নাম ও কর্মের পার্থক্যের মধ্য দিয়েই তার স্বরূপ প্রকাশিত হয়ে পড়বে।

এই নামের উৎস

নাজাতপ্রাপ্ত দলের এই নাম মূলত নিম্নোক্ত হাদীসসমূহ থেকে গৃহীত-

এক.

أَلَا إِنَّ مَنْ قَبْلَكُمْ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ افْتَرَقُوا عَلَى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِينَ مِلَّةً، وَإِنَّ هَذِهِ الْمِلَّةَ سَتَفْتَرِقُ عَلَى ثَلَاثٍ وَسَبْعِينَ: ثِنْتَانِ وَسَبْعُونَ فِي النَّارِ، وَوَاحِدَةٌ فِي الْجَنَّةِ، وَهِيَ الْجَمَاعَةُ .

জেনে রেখো, তোমাদের পূর্ববর্তী আহলে কিতাব বায়াত্তর দলে বিভক্ত হয়েছে । আর এ উম্মত বিভক্ত হবে তিয়াত্তর দলে। বায়াত্তর দল জাহান্নামী হবে আর একটি দল জান্নাতী হবে। সেই দলটি হচ্ছে ‘আলজামাআহ’। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৫৯৬; মুসনাদে আহমদ, হাদীস ১৬৯৩৭, হাদীসটির সনদ সহীহ।

দুই.

إِنَّ بني إسرائيل تَفَرَّقَتْ عَلَى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِينَ مِلَّةً، وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِي عَلَى ثَلاَثٍ وَسَبْعِينَ مِلَّةً، كُلُّهُمْ فِي النَّارِ إِلاَّ مِلَّةً وَاحِدَةً، قَالُوا: وَمَنْ هِيَ يَا رَسُولَ اللهِ؟ قَالَ: مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِي.

قال الترمذي: هَذَا حَدِيثٌ مُفَسَّرٌ غَرِيبٌ، لاَ نَعْرِفُهُ مِثْلَ هَذَا إِلاَّ مِنْ هَذَا الْوَجْهِ.

বনী ইসরাঈল বায়াত্তর দলে বিভক্ত হয়েছে আর আমার উম্মত তিয়াত্তর দলে বিভক্ত হবে। একটি দল ছাড়া আর সবাই জাহান্নামী হবে। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তারা কারা? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, যারা আমার ও আমার সাহাবীগণের পথে অবিচল থাকবে।’ -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৬৪১, কিতাবুল ঈমান

তিন.

إِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِي فَسَيَرى اخْتِلَافًا كَثِيرًا، فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ، تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ، وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ، فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ، وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ.

তোমাদের যারা আমার পরে বেঁচে থাকবে তারা অবশ্যই বহু মতভেদ দেখবে। তখন আমার সুন্নাহ ও আমার পরের খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ অবলম্বন করো। তা মজবুতভাবে ধারণ করো এবং মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে রেখো। আর নবআবিষ্কৃত বিষয়াদি থেকে অবশ্যই বেঁচে থেকো। কারণ (দ্বীনের নামে আবিষ্কৃত) সকল নতুন বিষয় বিদআত আর সকল বিদআত গোমরাহী। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৬৬৯২; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৬০৭; জামে তিরমিযী, হাদীস ২৬৭৬ হাদীসটির সনদ সহীহ।

এই হাদীসগুলো থেকে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, যখন উম্মতের মধ্যে বহু মত ও পথের উদ্ভব ঘটবে তখন সিরাতে মুসতাকীমের উপর দৃঢ়পদ থাকার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ ও খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করতে হবে। সেই নাযুক মুহূর্তে তারাই হবে নাজাতপ্রাপ্ত যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের সুন্নাহর উপর অটল থাকবে এবং একই সাথে নিজেকে ‘আল জামাআহ’-এর অন্তর্ভুক্ত রাখবে। বিচ্ছিন্নতা অবলম্বন করবে না।

যেহেতু নাজাতপ্রাপ্তদের মূল বৈশিষ্ট্য হল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের সুন্নাহর উপর অবিচলতা ও ‘আল জামাআহ’ থেকে বিচ্ছিন্ন না হওয়া, এজন্য তাদেরকে ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’ অর্থাৎ ‘সুন্নাহ ও জামাআহ ধারণকারী’ নামে চিহ্নিত করা হয়েছে।

এর বিপরীতে যারা সুন্নাহ ত্যাগ করে বিদআত অবলম্বন করে এবং মুসলমানদের জামাআত থেকে বিচ্ছিন্নতা অবলম্বন করে উম্মাহর মাঝে বিভেদ ও অনৈক্য সৃষ্টি করে তাদের নাম ‘আহলুল বিদআতি ওয়াল ফুরকাত’ অর্থাৎ বিদআত ও বিচ্ছন্নতা অবলম্বনকারী।

সূরা আলে ইমরান ১০৬ ও ১০৭ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা আখেরাতের প্রসঙ্গে বলেছেন, যেদিন এক দলের চেহারা উজ্জ্বল হবে আর অপর দলের চেহারা কালো হবে।’ এর তাফসীরে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত,

يَعْنِي: يَوْمَ الْقِيَامَةِ، حِينَ تَبْيَضُّ وُجُوهُ أَهْلِ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ، وَتَسْوَدُّ وُجُوهُ أَهْلِ البِدْعَة وَالْفُرْقَةِ.

অর্থাৎ ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের’ চেহারা উজ্জ্বল হবে আর ‘আহলুল বিদআত ওয়াল ফুরকাতের’ চেহারা কালো হবে। -তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/৪১৯; আদদুররুল মানসূর ফিত তাফসীরি বিল মা’সূর, সুয়ূতী ৪/৬৩; শরহু উসূলি ইতিকাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামাআহ, লালিকায়ী ১/৭৯ প্যারা নং ৭৪

‘আস্সুন্নাহ’ ও ‘আলজামাআহ’-এর অর্থ

আমরা জেনেছি যে, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর বৈশিষ্ট্যই হল, সুন্নাহর অনুসরণ ও ‘আল জামাআহ’-য় শামিল থাকা। তা থেকে বিচ্ছিন্ন না হওয়া। এখন আমাদেরকে এই দুই শব্দের মর্ম বুঝতে হবে।

কুআন হাদীসের আলোকে আলিমগণ ‘সুন্নাহ’র অর্থ বর্ণনা করেছেন,

وَالسُّنَّةُ: هِيَ الطَّرِيقَةُ الْمَسْلُوكَةُ، فَيَشْمَلُ ذَلِكَ التَّمَسُّكَ بِمَا كَانَ عَلَيْهِ هُوَ وَخُلَفَاؤُهُ الرَّاشِدُونَ مِنَ الِاعْتِقَادَاتِ وَالْأَعْمَالِ وَالْأَقْوَالِ.

অর্থাৎ দ্বীনের যে পথ ও পন্থার উপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও খোলাফায়ে রাশেদীন ছিলেন, আকীদা-বিশ্বাস, আমল ও কর্ম তথা দ্বীনের সকল বিষয়ে তাদের ঐ পথ ও পন্থাই হচ্ছে ‘সুন্নাহ’। -জামিউল উলূমি ওয়াল হিকাম, ইবনে রজব পৃ. ৪৯৫; আস সুন্নাতুন নাবাবিয়্যাহ ওয়া মাদলূলুহাশ শরয়ী, আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ

‘আল জামাআহ’-তে রয়েছে চারটি বিষয় :

১. আমীরুল মুমিনীন বা সুলতানের কর্তৃত্ব স্বীকারকারীদের থেকে বিচ্ছিন্ন না হওয়া এবং শরীয়তসম্মত বিষয়ে তার আনুগত্য বর্জন না করা। (দ্রষ্টব্য : ফাতহুল বারী ১৩/৩৭, হাদীস ৭০৮৪-এর আলোচনায়)

২. শরীয়তের আহকাম ও বিধানের ক্ষেত্রে উম্মাহর আমলে মুতাওয়ারাছ তথা সাহাবা-তায়েয়ীন যুগ থেকে চলে আসা কর্মধারা এবং উম্মাহর সকল আলিম বা অধিকাংশ আলিমের ইজমা ও ঐক্যের বিরোধিতা না করা। (দ্রষ্টব্য : উসূলের কিতাবসমূহের ইজমা অধ্যায়)

৩. হাদীস-সুন্নাহ এবং ফিকহের ইলম রাখেন এমন উলামা-মাশাইখের সাথে নিজেকে যুক্ত রাখা। ইমাম তিরমিযী রাহ. আহলে ইলম থেকে আলজামাআর যে ব্যাখ্যা বর্ণনা করেছেন তা এই-

أهل الفقه والعلم والحديث

অর্থাৎ জামাআ হচ্ছে ফিকহ ও হাদীসের ধারক আলিম সম্প্রদায়। (কিতাবুল ফিতান, বাবু লুযুমিল জামাআ, হাদীস ২১৬৭-এর আলোচনায়)

৪. মুসলিম শাসনকর্তার অধীনস্ত মুসলমানদের জামাত। -আল ইতিসাম, শাতিবী, শরহু উসূলি ইতিকাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামাআহ

সুতরাং কেউ আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অর্থ, সে দ্বীনের প্রতিটি বিভাগে :

১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতের উপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকবে। আকাইদ, ইবাদত, ইত্যাদি কোনো ক্ষেত্রেই নিজের জন্য নতুন কোনো পথ নির্বাচন করবে না। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শেখানো আকাইদ ও ইবাদতই গ্রহণ ও অনুসরণ করবে, যা গ্রহণ ও অনুসরণ করেছিলেন খোলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবায়ে কেরাম। সকল প্রকারের বিদআত ও রুসুম-রেওয়াজ থেকে দূরে থাকবে। লেনদেন, সামাজিকতা, আচার-ব্যবহার অর্থাৎ দ্বীন-দুনিয়ার সকল ক্ষেত্রে সুন্নাহর শিক্ষাকেই অন্য সব কিছুর উপর প্রাধান্য দিবে।

২. কোনো বিষয়ে সাহাবায়ে কেরাম, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন ও উলামায়ে হক্বের ইজমা ও ঐকমত্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত ও অবস্থানের বিরোধিতা করবে না। ইজমার বিরুদ্ধাচরণ করে এই হাদীসের অন্তর্ভুক্ত হবে না- مَنْ شَذَّ شَذَّ في النار

যে দলছুট হল সে দলছুট হয়ে জাহান্নামে পতিত হবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২১৬৭

৩. কোনো ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহর অনুসৃত পথ থেকে বিচ্যুত হবে না। আল্লাহ তাআলার ইরশাদ-

وَ مَنْ یُّشَاقِقِ الرَّسُوْلَ مِنْۢ بَعْدِ مَا تَبَیَّنَ لَهُ الْهُدٰی وَ یَتَّبِعْ غَیْرَ سَبِیْلِ الْمُؤْمِنِیْنَ نُوَلِّهٖ مَا تَوَلّٰی وَ نُصْلِهٖ جَهَنَّمَ ؕ وَ سَآءَتْ مَصِیْرًا۠.

কারো নিকট সুপথ প্রকাশিত হওয়ার পর সে যদি রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনদের পথ ব্যতিত অন্য পথ অনুসরণ করে তবে যা সে গ্রহণ করেছে তাতে তাকে ছেড়ে দেব এবং তাকে জাহান্নামে দগ্ধ করব। আর তা কতই না মন্দ আবাস। -সূরা নিসা (৪) : ১১৫

৪. মুসলমানদের অধিকাংশ আহলুর রায় (أهل الحل والعقد) কোনো আমীরের আনুগত্যের ব্যাপারে একমত হলে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা অভিযান পরিচালনা থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকবে।

একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য

উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ ছাড়াও আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ্র এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য এও যে, তারা কোনো ‘মুসলমান’কে ‘কাফের’ আখ্যা দেয় না। ‘কাফের’ শব্দটিকে একটি গালি হিসেবে ব্যবহার করা বা অন্যের উপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে তাকে কাফের আখ্যা দেওয়া তো দূরের কথা, গুনাহে কবীরায় লিপ্ত হওয়ার কারণে বা এমন কোনো কারণে যা ‘কুফরী’ হওয়া স্পষ্ট নয়- কোনো মুসলমানকে কাফের বলে না। কিন্তু বিদআতী লোকদের বিশেষ পরিচয়ই হল, এরা ‘মুসলমান’দের ‘কাফের’ আখ্যা দিয়ে থাকে। কারো উপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে অর্থাৎ তার নামে কুফরী কথাবার্তা বানিয়ে বা তার কোনো সঠিক কথাকে বিকৃত করে কুফরী কথার রূপ দিয়ে তাকে ‘কাফের’ সাব্যস্ত করা এদের পক্ষে অতি সহজ। কোনো কোনো বিদআতী সম্প্রদায় এমনও ছিল যারা কবীরা গুনাহের কারণে মুসলমানদের কাফের আখ্যা দিত। আবার কতক বিদআতী এমনও ছিল যারা নিজেদের দলের লোক ছাড়া অন্য সকলকে কাফের বলত। এই নীতি ও কর্মের বিদআতী যে শুধু অতীতেই ছিল তা নয়, এখনও আছে।

আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের এ বৈশিষ্ট্যও এসেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের ‘সুন্নাহ’র অনুসরণ থেকে। কারণ তাঁরা আহলে ক্বিবলা (পারিভাষিক অর্থে)-কে কাফের বলতে নিষেধ করেছেন এবং ‘আলজামাআত’-এর মাঝে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করতে নিষেধ করেছেন। আর সত্য কথা হল, কেউ আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ্র অন্তর্ভুক্ত হবে আবার মুসলমানদের কাফেরও বলবে এটা কখনো হতে পারে না।

সালাফে সালেহীন আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ্র বৈশিষ্ট্যসমূহের আলোচনায় এ বৈশিষ্ট্যও অতি গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেছেন। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ্র পরিচয় দিয়ে ইমাম আবু হানিফা রাহ.-এর এ বাণী তো অতি প্রসিদ্ধ। তিনি বলেছেন,

الْجَمَاعَة ان تفضل أَبَا بَكْرٍ وَعُمَرَ وَعَلِيًّا وَعُثْمَانَ وَلا تَنْتَقِصَ أَحَدًا مِنْ أَصْحَابِ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عَلَيْهِ وَسلم وَلا تُكَفِّرَ النَّاسَ بِالذُّنُوبِ وَتُصَلِّيَ على من يَقُول لَا إِلَهَ إِلا اللَّهُ، وَخَلْفَ مَنْ قَالَ لَا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَتَمْسَحَ عَلى الْخُفَّيْنِ وَتُفَوِّضَ الأَمْرَ إِلَى اللَّهِ وَتَدَعَ النُّطْق فِي اللَّهِ جَلَّ جَلالُهُ.

‘আবু বকর, উমর, আলী ও উসমান রা.-কে শ্রেষ্ঠ মনে করবে এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো সাহাবীর অসম্মান করবে না, গোনাহের কারণে মানুষকে কাফের আখ্যা দিবে না, যে কালিমা পাঠ করে তার মৃত্যুতে জানাযার নামায পড়বে। কালেমা পাঠকারীর ইমামতিতে নামায পড়তে অসম্মত হবে না। চামড়ার মোজার উপর মাস্হ করবে। সব কিছুকে আল্লাহর উপর ন্যস্ত করবে আর আল্লাহ তাআলার সত্তার বিষয়ে মুখ খুলবে না।’ -আলইনতিকা, ইবনে আব্দুল বার পৃ. ৩১৪-৩১৫

ফিকহে হানাফীর প্রসিদ্ধ কিতাব ‘আল বাহরুর রাইক’ (তাকমিলাহ)-এ ফিকহের প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য কিতাব ‘আলহাভী’ থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে যে,

أَهْلُ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ مَنْ فِيهِ عَشَرَةُ أَشْيَاءَ: الْأَوَّلُ أَنْ لَا يَقُولَ شَيْئًا فِي اللَّهِ تَعَالَى لَا يَلِيقُ بِصِفَاتِهِ. وَالثَّانِي: يُقِرُّ بِأَنَّ الْقُرْآنَ كَلَامُ اللَّهِ تَعَالَى وَلَيْسَ بِمَخْلُوقٍ. الثَّالِثُ: يَرَى الْجُمُعَةَ وَالْعِيدَيْنِ خَلْفَ كُلِّ بَرٍّ وَفَاجِرٍ. وَالرَّابِعُ: يَرَى الْقَدَرَ خَيْرَهُ وَشَرَّهُ مِنْ اللَّهِ تَعَالَى. وَالْخَامِسُ: يَرَى الْمَسْحَ عَلَى الْخُفَّيْنِ جَائِزًا. وَالسَّادِسُ: لَا يَخْرُجُ عَلَى الْأَمِيرِ بِالسَّيْفِ. وَالسَّابِعُ: يُفَضِّلُ أَبَا بَكْرٍ وَعُمَرَ وَعُثْمَانَ وَعَلِيًّا عَلَى سَائِرِ الصَّحَابَةِ. وَالثَّامِنُ: لَا يُكَفِّرُ أَحَدًا مِنْ أَهْلِ الْقِبْلَةِ بِذَنْبٍ. وَالتَّاسِعُ: يُصَلِّي عَلَى مَنْ مَاتَ مِنْ أَهْلِ الْقِبْلَةِ. وَالْعَاشِرُ: يَرَى الْجَمَاعَةَ رَحْمَةً وَالْفُرْقَةَ عَذَابًا.

‘আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের অন্তর্ভুক্ত সে, যার মধ্যে দশটি বৈশিষ্ট্য থাকবে :

১. আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে এমন কিছু না বলা যা তাঁর গুণাবলীর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

২. স্বীকার করা যে, কুরআন আল্লাহর কালাম, তা মাখলূক বা তাঁর সৃষ্টি নয়।

৩. নেককার গোনাহগার উভয় শ্রেণির মানুষের পিছনেই জুমা ও দুই ঈদের নামায পড়াকে জায়েয মনে করা।

৪. তাকদীরের ভালো-মন্দ আল্লাহর পক্ষ থেকে হওয়ার বিশ্বাস রাখা।

৫. চামড়ার মোজার উপর মাস্হ করাকে জায়েয মনে করা।

৬. আমীরের বিরুদ্ধে তরবারী উত্তোলন করা থেকে বিরত থাকা।

৭. আবু বকর, উমর, উসমান ও আলী রা.-কে অন্য সকল সাহাবী থেকে শ্রেষ্ঠ বিশ্বাস করা।

৮. গুনাহের কারণে কোনো আহলে কিবলাকে কাফের আখ্যা না দেওয়া।

৯. আহলে কিবলার অন্তর্ভুক্ত কেউ মৃত্যুবরণ করলে তার জানাযার নামায আদায় করা।

১০. মুসলমানদের মধ্যকার ঐক্যকে রহমত ও অনৈক্যকে আযাব মনে করা। -আল বাহরুর রাইক, তাকমিলাহ, খ- ৮, পৃ. ১৮২ কিতাবুল কারাহিয়্যাত

قال صاحب الكشاف : في هذا الفصل شروط وزيادات لأصحابنا يجب أن تراعى.

কাশশাফ গ্রন্থকার বলেন, এ প্রসঙ্গে আমাদের আলিমগণের আরো কিছু বিষয়াদি রয়েছে, যার প্রতি লক্ষ্য রাখাও অপরিহার্য। -প্রাগুক্ত

এ আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, যারা হক্কানী আলিমগণের পিছনে নামায পড়া তো দূরের কথা, তাদের কেউ ওদের মসজিদে নামায পড়তে গেলে ওরা সেই মসজিদ ধৌত করা ছাড়া তাতে নামায পড়ে না বা নামায পড়াকে জায়েয মনে করে না ওরা কখনো ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতে’র অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না।

এই উপমহাদেশে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত

আলহামদু লিল্লাহ সর্বদাই আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের মুহাক্কিক আলিমগণ সচেতন ছিলেন। যখনই কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’ থেকে বিচ্যুত হয়েছে তখনই হক্কানী আলিমগণ তাদের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন এবং তাদের মতামতের অসারতা দলীল-প্রমাণের আলোকে স্পষ্ট করে দিয়েছেন।

ইংরেজ আমলে যখন হিন্দুস্তানের বিভিন্ন এলাকার বিদআতী আলিমরা বিশেষ করে বেরেলীর জনাব আহমদ রেযা খান ও তাঁর সমমনা বিদআতী আলিমরা সাধারণ্যে প্রচলিত ভ্রান্ত রসম-রেওয়াজ এবং শিরকী ও বিদআতী কর্মকা-ের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতাদানে সর্বশক্তি ব্যয় করল তখন ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতে’র মুখপাত্ররূপে শিরক-বিদআতের মূলোৎপাটনে যারা সবচেয়ে অগ্রগামী ছিলেন তারা হলেন দারুল উলূম দেওবন্দের সন্তানগণ এবং এর আকাবির ও মাশাইখ। অপরদিকে বিদআতের প্রতিষ্ঠা ও পৃষ্ঠপোষকতায় সবচেয়ে অগ্রগামী ছিলেন বেরেলীর জনাব আহমদ রেযা খান। ফলে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত ও আহলে বিদআতের এই ইখতিলাফ সাধারণের ভাষায় দেওবন্দী-বেরলভী ইখতিলাফ নামেই প্রসিদ্ধ হয়ে যায়। অথচ তা মূলত ছিল তাওহীদ ও র্শিক, সুন্নত ও বিদআত এবং সত্য ও মিথ্যার ইখতিলাফ।

তাওহীদ, সুন্নত ও হক্বের পতাকাবাহী ছিলেন দারুল উলূম দেওবন্দের সন্তানগণ, এর আকাবির ও মাশাইখ। যার জাজ্বল্যমান প্রমাণরূপে আজও রয়েছে তাদের অজ¯্র রচনা, পত্রাবলী ও বক্তৃতা সংকলন। লাখো শিষ্য, মুরীদ ও ভক্ত, হাজারো মাদরাসা, মসজিদ ও খানকাহ।

অপর দিকে শিরকী কর্মকা-; বিদআত, রসম ও রেওয়াজ ইত্যাদির পৃষ্ঠপোষকতাদানকারী জনাব আহমদ রেযা খান ও তার সমমনা আলিমদের রচিত বই পুস্তক, কর্মকা- এবং এদের প্রতিষ্ঠিত দ্বীনী প্রতিষ্ঠানসমূহ এদের অবস্থানের সাক্ষ্য দিচ্ছে।

কিন্তু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির ধারায় দেখা যাচ্ছে অতীতের বিদআতী সম্প্রদায়গুলোর মত এরাও হক্বপন্থীদের নাম আত্মসাৎ করে নিজেদেরকে ‘সুন্নী জামাত’ ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত’ বলে জোরে শোরে প্রচার করছে। আর হক্বপন্থী আলিমগণকে আখ্যায়িত করছে ‘ওহাবী’ নামে, যা সম্পূর্ণ অবাস্তব ও ভিত্তিহীন।

আহলুল বিদআত ওয়াল ফুরকাত-এর

পরিচয় ও নিদর্শন

উপরোক্ত আলোচনা থেকে ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ্’-এর পাশাপাশি ‘আহলুল বিদআতি ওয়াল ফুরকাহ’-এর পরিচয়ও স্পষ্ট হয়ে গেছে। সংক্ষেপে বলা যায়, যারা সুন্নত পরিত্যাগ করে বিদআত আবিষ্কার করে এবং উম্মাহর মাঝে নানা দলের সৃষ্টি করে, উপযুক্ত কারণ ছাড়া মুসলমানদেরকে কাফের আখ্যা দিয়ে মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে- এরাই হল ‘আহলুল বিদআত ওয়াল ফুরকাত’।

শরীয়তের পরিভাষায় বিদআত বলে, যে আক্বীদা, কর্ম বা মতকে কোনো শরয়ী প্রমাণ ছাড়াই শরীয়তের অংশ বানিয়ে নেওয়া হয়েছে। অন্য শব্দে- যে আক্বীদা, আমল, আমলের নিয়ম, চিন্তা ও মতকে শরীয়তের অংশ মনে করা হয় অথচ এর পক্ষে না সুন্নতে রাসূল রয়েছে, না সুন্নতে খোলাফায়ে রাশেদীন, না সুন্নতে সাহাবা। এরপর বিষয়টি যদি শরীয়তের কোনো দলীলের বিরোধী হয় তবে তা দুই কারণে হারাম হবে; বিদআত হওয়ার কারণে এবং শরীয়তের বিরোধী হওয়ার কারণে।

‘আল ফুরকাত’ শব্দে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো রয়েছে :

১. সাহাবায়ে কেরামের ‘ইজমা’র বিরোধিতা।

২. মুজতাহিদ ইমাম ও হক্কানী উলামায়ে কিরামের ইজমার বিরোধিতা।

৩. মুসলিম উম্মাহর অভিন্ন পথ ও কর্মের বিরোধিতা।

এখানে যে বিষয়টি বিশেষভাবে বোঝা উচিত তা এই যে, মুসলিম উম্মাহর অভিন্ন পথ আর সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত রসম-রেওয়াজ এই দুইটি এক বিষয় নয়। প্রথমটিতে সাধারণ মুসলমান, হক্কানী উলামা এবং দ্বীনের হক্কানী দায়ীগণ সবাই একমত থাকেন। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় বিষয়টি কতক সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত থাকলেও হক্কানী উলামা ও দ্বীনদার ব্যক্তিবর্গ এর বিরোধিতা করেন এবং সুন্নতের প্রতি মানুষকে পথনির্দেশ করেন।

৪. মুসলমানদের সর্বজনস্বীকৃত আমীরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা।

৫. শরীয়তের দৃষ্টিতে উপযুক্ত কারণ ছাড়া কোনো মুসলিমকে কাফের আখ্যা দেওয়া।

৬. হকপন্থীদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা বা কোনো বিষয়ে বিচ্ছিন্ন কোনো মত প্রকাশ করে মানুষের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা। -আল ইতিসাম শাতিবী খ. ১, পৃ. ১৭-১৪১, ১৮৭-১৯৩, ৩৬৭-৫১৪; খ. ২, পৃ. ৬৬৯-৬৯০, ৭১১-৭১২, ৭৩২-৭৪২, ৭৬৭-৭৭৮

আশা করি, উপরের আলোচনা থেকে আহলে বিদআতের পুরো পরিচয় স্পষ্ট হয়েছে এবং এ-ও স্পষ্ট হয়েছে যে, যারা আকীদা, ইবাদাতের মধ্যে নতুন নতুন বিষয়ের সংযোজন করে এবং রসম-রেওয়াজকে নিজের দ্বীন বানিয়ে নেয় এরপর তা প্রমাণ করার জন্য কুরআন-হাদীসে তাহরীফ বা অপব্যাখ্যা করে এইসকল গর্হিত কাজে তাদের সমর্থন না করার কারণে বা তাদের বিরোধিতা করার কারণে আহলে হককে তিরস্কার করে বা কাফের আখ্যা দেয়- এরা হাজার বার নিজের নামের সাতে ‘সুন্নী’ শব্দ ব্যবহার করলেও কখনো আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না।

দুইটি গুরুত্বপূর্ণ আলামত

প্রতি যুগের বিদআতপন্থীদের এক গুরুত্বপূর্ণ আলামত হল, এরা খুব আকর্ষণীয় নামে নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকে। কিন্তু তা হয় বাস্তবের সম্পূর্ণ বিপরীত। এরা আহলে হকের নাম কিংবা বিশেষ কোনো বৈশিষ্ট্যের শুধু শিরোনামটি আত্মসাৎ করে নিজেদের জন্য ব্যবহার করে। আর আহলে হকের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচারে লিপ্ত হয় এবং তাদেরকে মন্দ নামে অভিহিত করে। -আল ইতিসাম, শাতিবী ১/৩৪-৩৯, শরহু উসুলি ই‘তিকাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামাআহ, লালেকায়ী, ২/২০০-২০১, ২০৪

যেমন হাদীস অস্বীকারকারী লোকেরা নিজেদেরকে ‘আহলে কুরআন’ নামে পরিচয় দিয়ে থাকে। অথচ তাদের নাম হওয়া উচিত হাদীস অস্বীকারকারী। মু‘তাযিলাহ ফেরকা নিজেদের অভিহিত করে ‘আহলুল আদ্ল ওয়াত তাওহীদ’ নামে। অথচ তাদের ভ্রান্ত মতবাদের ভিত্তি হল তাওহীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের অস্বীকারের উপর। একইভাবে বর্তমানের বিদআতীরা নিজেদের অভিহিত করে ‘আশেকে রাসূল’, ‘সুন্নী’ নামে আর নিজেদের ফেরকাকে পরিচিত করে ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত’ নামে। অপরদিকে প্রকৃত ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত’-কে ওহাবী বলে এবং তাদেরকে রাসূলের শানে বে-আদবীর অভিযোগে অভিযুক্ত করে। অথচ তারাই তাওহীদ ও সুন্নতকে জীবিত করা এবং বিদআত ও র্শিককে নির্মূল করার মহান ব্রতে নিজেদের পূর্ণ জীবন ওয়াকফ করেছিলেন। সুন্নতের অনুসরণ এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুহাব্বত ছিল যাদের বৈশিষ্ট্য এবং যারা ছিলেন এর জন্য ফিদা ও কুরবান।

আহলে বিদআতের দ্বিতীয় বড় আলামতটি হল, এরা কথায় কথায় মুসলমানদের কাফের আখ্যা দেয়। অন্যকে ‘ফাসেক’ ‘গোমরাহ’ বলা তো এদের সাধারণ চরিত্র। এদের গোঁড়া লোকেরা শুধু ফাসেক বা গোমরাহ আখ্যা দিয়ে নয়, একেবারে ‘কাফের’ আখ্যা দিয়ে তবেই ক্ষান্ত হয়।

শরীয়তে কোনো ব্যক্তিকে কাফের ঘোষণা করার নীতিমালা নির্ধারিত। একজন কালিমা পাঠকারী মুসলমান, যে বাইতুল্লাহকে কিবলা মানে, মুসলমানদের মত নামায পড়ে, মুসলমানদের জবাইকৃত পশু হালাল মনে করে- তাকে কখন এবং কিসের ভিত্তিতে কাফের ঘোষণা করা যায় এর নীতিমালা শরীয়তে নির্ধারিত। আহলে বিদআত এসব নীতির অনুসরণ তো দূরের কথা, নিজেরা কুফরী কথাবার্তা রচনা করে তা অন্যের উপর আরোপ করতে এবং এর ভিত্তিতে কাফের আখ্যা দিতে এরা সিদ্ধহস্ত।

এসব কাজই জনাব আহমদ রেযা খান বড় বড় আলেমদের ব্যাপারে করেছেন এবং তারই অন্ধ অনুসরণ করেছেন জনাব আবেদ শাহ সাহেব।

‘আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআত’ এবং ‘আহলুল বিদআতি ওয়াল ফুরক্বাতে’র এই সংক্ষিপ্ত পরিচিতির পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া কঠিন নয় যে, বাংলা-পাক-ভারতের রেজভী জামাত, যারা নিজেদেরকে সুন্নী বলে পরিচয় দেয়, আসলেই কি এরা সুন্নী না বিদআতী।

‘রেজভী’রা যেসব ‘আকীদা’ ও ‘আমল’কে নিজেদের ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য বলে বিশ্বাস করে, যেসব বিষয়ে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ্র আলেমদের সাথে তাদের বিরোধ- যদি ‘সুন্নাহ’ বা ‘ইজমা’য় সেসব আক্বীদা ও আমলের ভিত্তি থেকে থাকে তাহলে তারা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মধ্যে শামিল। অন্যথায় নিঃসন্দেহে আহলুল বিদআতি ওয়াল ফুরকাতের অন্তর্ভুক্ত।

কিন্তু কোনো সত্যানুসারী ব্যক্তির কাছে অস্পষ্ট নয় যে, এদের বিশেষ আকাইদ ও আমলসমূহের কোনো ভিত্তি ‘সুন্নাহ’ ও ‘ইজমা’ তে থাকা তো দূরের কথা, ‘সুন্নাহ’ ও ‘ইজমা’য় বরং এর বিপরীত দলীল বিদ্যমান। আলকাউসার যিলকদ ১৪৩৭ হি. সংখ্যায় ‘বেরলভী মতবাদ : ভিত্তিহীন আকীদা ও ভ্রান্ত ধ্যানধারণা’ শিরোনামে উদাহরণস্বরূপ তাদের বিদআতী ও শিরকী আকীদা ও আমলসমূহের মধ্যে সামান্য কয়েকটি উল্লেখ করা হয়েছে। সুন্নত ও ইজমা-এ যার কোনো দলীলই নেই। বরং যা সরাসরি শরীয়তের দলীলসমূহের পরিপন্থী। 

‘ওহাবী’ : পরিচয় ও ইতিহাস

[এই আলোচনাটি এ প্রবন্ধের দ্বিতীয় অংশ। যা আজ থেকে বারো বছর আগে বান্দা তার আব্বাজান -মুদ্দা যিল্লুহুম-এর হুকুমে লিখেছিলো। যার প্রথম কিস্তি গত সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। পুরো প্রবন্ধটি সেই সময়ই আযীযে মুহতারাম মাওলানা যাকারিয়া আবদুল্লাহ অত্যন্ত যত্নের সাথে তরজমা করে রেখেছিলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা অমুদ্রিতই রয়ে গেছে।

প্রবন্ধের এ কিস্তির শিরোনাম : ‘ওহাবী: পরিচয় ও ইতিহাস’ এ দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ যে, বহু মানুষ এই শব্দটি শোনে, এমনকি মুখে উচ্চারণও করে কিন্তু এর বাস্তবতা ও উৎপত্তির ইতিহাস সম্পর্কে তাদের জানা নেই। আশা করি, এ আলোচনা তাদেরকে পরিভাষাটির হাকীকত ও বাস্তবতা বুঝতে এবং এর ব্যবহার শুরুর ইতিহাস সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা অর্জনে সহায়তা করবে। তবে এ বিষয়ে এখানে খুব বিস্তারিত আলোচনা করা হয়নি। সংক্ষেপে যা লেখা হয়েছে তার সারমর্ম -কিছু অতিরিক্ত ব্যাখ্যাসহ- নিম্নরূপ:

১. ‘ওহাবী’ শব্দটি মূলত শায়েখ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব নজদী রাহ. (১১১৫ হি.- ১২০৬ হি.)-এর দিকে সম্বন্ধিত।

২. শায়খ মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব-এর মতাদর্শের জন্য ‘ওয়াহহাবিয়া’ এবং তার অনুসারীদের জন্য ‘ওহাবী’ শব্দটি এক সময় প্রসিদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু যারা শায়েখের এই মতাদর্শের জন্য এই নাম ব্যবহার করেছেন তারা সাধারণত তাঁর মতাদর্শকে সঠিকভাবে বোঝেননি বা ঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারেননি। যেমন হিন্দুস্তানে বাদায়ূনী এবং রেযাখানী ঘরানার লোকেরা শায়েখের অনুসারীদেরকে তাদের তাফাররুদাত (ভিন্ন মতসমূহ) বা তাদের কতেকের বাড়াবাড়ি ও কট্টরতার কারণে তাদেরকে ওহাবী বলে না; বরং এ জন্য বলে যে, মাজারীদের মাঝে প্রচলিত শিরক-বিদআতের উপর আপত্তি তোলাই তাদের পছন্দ নয়। যদি তারা কট্টরপন্থীদের বাড়াবাড়ির জন্যে তাদেরকে ওহাবী বলতো তাহলে তো শাহ ইসমাঈল শহীদ ও আকাবিরে দেওবন্দকে তারা ওয়াবী বলতো না। কেননা আলহামদুলিল্লাহ এ ধরনের বাড়াবাড়ি তাদের মধ্যে কিছুমাত্রও ছিল না।

৩. শাহ ইসমাঈল শহীদ রাহ. এবং আকাবিরে দেওবন্দকে ওয়াহাবী বলা বাস্তবতা বিরুদ্ধ। তার কারণ :

(ক) শায়েখ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব ও তার শিষ্যদের সাথে এদের কোনো দেখা-সাক্ষাৎ ছিলো না এবং এদের বিস্তারিত পরিচয় ও বৃত্তান্তও এঁরা জানতেন না।

(খ) শায়েখের সাথে তাদের উস্তায-শাগরিদ ধরনের সম্পর্ক কিংবা বাইআতের সম্পর্ক কিংবা বংশ ও আত্মীয়তার সম্পর্ক- কোনোটাই ছিলো না।

(গ) এঁরা ছিলেন ফিকহে হানাফীর অনুসারী আর শায়েখ ছিলেন হাম্বলী ফিকহের অনুসারী। তদুপরি শায়েখের যে সব ‘তাফাররুদাত’ বা ‘একক ভিন্নমত’ ছিলো তার সঙ্গে তারা একমত ছিলেন না। তদ্রূপ তার মতাবলম্বনকারীদের অনেকের মাঝে যে বাড়াবাড়ি ও কট্টরতা পাওয়া যায় তা তাদের মধ্যে ছিলো না। মোটকথা অনেক বিষয়ে শায়খ ও তার অনুসারীদের সাথে তাদের মতপার্থক্য ছিলো। যার কিছু মাওলানা মুহাম্মদ মনযূর নোমানী রহ. তার ‘শায়েখ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব ও হিন্দুস্তান কে উলামায়ে হক’ শীর্ষক পুস্তিকায় উল্লেখ করেছেন। এই পুস্তিকাটি হিন্দুস্তান থেকে ‘শায়েখ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব কে খেলাফ প্রপাগান্ডে আউর হিন্দুস্তানকে উলামায়ে হক পার উসকে আছারাত’ নামে ছেপেছে। এর আরবী তরজমা دعايات مكثفة ضد الشيخ محمد بن عبد الوهاب নামে ছেপেছে। (আরো দেখুন : হযরত তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুমের ‘নুকুশে রফতে গাঁ’য় হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ মনযূর নোমানী রাহ.-এর আলোচনা)

৪. শায়েখ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব রাহ.-এর চিন্তাধারার লোকদের ওয়াহাবী বলার রেওয়াজ আলহামদুলিল্লাহ এখন অনেকটা কমে গেছে। এখন বলা হয় ‘সালাফী’ । কিন্তু সালাফীদের মধ্যে যারা বেশি কট্টর তারা কেবল ‘ভিন্ন মত’ নয় বরং ‘বিচ্ছিন্নতার’ শিকার। সে কারণে তারা যেমন বেরেলভীদের বিপক্ষে তেমনি আকাবিরে দেওবন্দেরও বিরোধী। আকাবিরে দেওবন্দের মত-পথ যেহেতু ভারসাম্যপূর্ণ এবং প্রকৃত অর্থে পুরোপুরি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর অনুগামী, সে জন্য একদিকে তাদের বেরেলভীদের গালি শুনতে হয় অন্যদিকে আবার কট্টর সালাফীদের নিন্দা-সমালোচনা হজম করতে হয়।

আকাবােির দেওবন্দের সাথে যাদের তালীম-তরবিয়াতের সম্পর্ক, আল্লাহ তাআলা তাদেরকে নিজ আকাবিরের মত ও পথ (যা মূলত খায়রুল কুরূনের সালাফে সালেহীনেরই মতাদর্শ) নির্ভুলভাবে বোঝার এবং সঠিকভাবে তা গ্রহণ করার তাওফীক দান করুন। সালাফী ভাইদের মধ্যে খাইরুল কুরূনের সালাফের বোধ ও উপলব্ধি এবং ভারসাম্যপূর্ণ নীতি দান করুন। আর বেরেলভী ভাইদের মধ্যে (যারা নিজেদের নাম রেখেছেন সুন্নী) সুন্নতের মহব্বত এবং বিদআতের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করে দিন। আমীন ইয়া রাব্বাল আলামীন।

-আবদুল মালেক]



শায়েখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব নজদী রাহ.-এর সাথে সন্বন্ধ করে তাঁর আন্দোলন ও আন্দোলনের সাথে জড়িত লোকদের ‘ওহাবী’ বলা হত।

শায়েখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব নজদী রাহ. ১১১৫ হিজরী মোতাবেক ১৭০৩ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১২০৬ হিজরী মোতাবেক ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যু হয় নজদের ‘দারইয়্যাহ’ নামক স্থানে। তাঁর আন্দোলনের সূচনা ১১৪৩ হিজরী মোতাবেক ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দে।

আলে সাউদ (যারা তাঁর সমর্থক ও তাঁর আন্দোলনের সাথে একমত ছিলেন) হারামাইন শরীফাইনের কর্তৃত্ব লাভ করেন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাবের মৃত্যুর অনেক পরে ১২১৮ হিজরী বা ১২২০ হিজরী সনে। তার কর্তৃত্ব ১২২৭ হিজরী পর্যন্ত কায়েম ছিল। ১২২৭ হিজরীতে তুরস্কের উসমানী খেলাফত নির্দেশে তাদেরকে হটিয়ে দেওয়া হয়। এর একশ বছরেরও অধিককাল পরে ১৩৪২ হিজরী বা ১৩৪৩ হিজরী মোতাবেক ১৯২৪ বা ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে আলে সাউদের তৎকালীন ব্যক্তিত্ব বাদশাহ আব্দুল আযীয বিন সাউদ নিজ বাহিনীর মাধ্যমে হেজাযে মুকাদ্দাসের তৎকালীন শাসক শরীফ হুসাইনকে হটিয়ে নিজের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেন। আর এভাবে দ্বিতীয়বার হারামাইন শরীফাইনে তাদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।

দ্র. খাইরুদ্দীন যিরিকলী, আল আ‘লাম, খ. ৬ পৃ. ২৫৭; মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব খ. ৩ পৃ. ৯০; সাউদ বিন আব্দুল আযীয খ. ৪ পৃ. ১৯-২০; ইবনে সাউদ; মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান আল হাজাভী, আল ফিকরুস সামী খ. ২, পৃ. ৪৪৮-৪৪৫; ফযলে রাসূল বাদায়ূনী, সাইফুল জাব্বার পৃ. ১৩-১৭; মাওলানা মুহাম্মাদ মনযুর নোমানী, শায়েখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব আওর হিন্দুস্তানকে উলামায়ে হক পৃ. ১৪-১৫, ৪০, ৮৭-৯০

শায়েখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব রাহ.-এর আন্দোলন ছিল মূলত তাওহীদ প্রচার, সুন্নতের প্রতিষ্ঠা এবং শিরক-বিদআতের মূলোৎপাটনের উদ্দেশ্যে। তবে কিছু শাখাগত বিষয়ে অন্যান্য আহলে ইলমের সাথে তাঁর মতানৈক্য ছিল। অন্যদিকে তাঁর আন্দোলনে নতুন যোগদানকারী কিছু লোকের মাধ্যমে কিছু বাড়াবাড়িও শুরু হয়েছিল। একে ছুতো বানিয়ে শিরক-বিদআত এবং রসম রেওয়াজের পৃষ্ঠপোষকরা বিশেষত কবর পূজা, তাজিয়া পূজার মতো শিরকী কর্মকাণ্ডের সমর্থক লোকেরা তাঁর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রোপাগাণ্ডা করতে থাকে যে, এরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শানে বেআদবী করে থাকে, এরা ওলী আওলিয়ার দুশমন, নিজেরা ছাড়া অন্য সকলকে কাফের ও হত্যাযোগ্য মনে করে, শাফাআতকে অস্বীকার করে এবং এরা সুন্নী না, ওহাবী। কেউ বলে, তাদের আন্দোলন কোনো দ্বীনী আন্দোলন নয় ওহাবী আন্দোলন, ইত্যাদি ইত্যাদি।

পার্শ্ববর্তী যেসকল রাজা বা গোত্রপতি শায়েখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাবের এই আন্দোলনে রাজনৈতিকভাবে ভীত ছিল; তারাও এইসব প্রোপাগাণ্ডায় মদদ দিতে থাকে এবং নিজস্ব উপায়-উপকরণ নিয়ে এই প্রোপাগাণ্ডায় শরীক হতে থাকে।

অতপর ১২২৭ হিজরীতে যখন আলে সাউদকে, যারা ছিল শায়েখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাবের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক, হিজায থেকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় তখন বিশেষভাবে এই হিজায ভূমিই শায়েখ ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে প্রোপাগাণ্ডার কেন্দ্রে পরিণত হয় এবং ওখান থেকে তাঁদের সম্পর্কে এমন সব কথাবার্তা প্রচার করা হয় যার প্রভাবে সাধারণ মুসলমান তাদের সম্পর্কে বিদ্বিষ্ট ও বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। হিজাযের তৎকালীন বাসিন্দারা তো তাদের সম্পর্কে এমনই বিদ্বিষ্ট হয়ে পড়েন, যা ইহুদী-নাসারার প্রতিও তাদের মনে ছিল না। অগ্নিপূজারী ও মূর্তিপূজারীদের প্রতিও ছিল না।

যেহেতু হজ্বের উদ্দেশ্যে নানা দেশের হাজ্বী ছাহেবান হিজাযে একত্র হন তাই ঐ সময় হিজাযে তাদের বিরুদ্ধে মৌখিকভাবে বা লিখিত আকারে যা কিছু প্রসিদ্ধ ও প্রচারিত ছিল তা হাজ্বী সাহেবদের মাধ্যমে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এবং এসবের সাথে প্রত্যেক অঞ্চলের মাযারী ও ভিত্তিহীন রসম-রেওয়াজের অনুসারীদের তরফ থেকে নানা টিকা-টিপ্পনীও যোগ হতে থাকে।

এই ব্যাপক প্রচারণার ফলে গোটা পৃথিবীতে শায়েখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাবের আন্দোলন ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে একধরনের মারমুখী মানসিকতা বিরাজ করছিল। লোকমুখে তার আন্দোলন ‘ওয়াহাবিয়্যাত’ বা ‘ওয়াহাবী আন্দোলন’ নামে প্রসিদ্ধ হয়ে যায়। এই নামকরণের পেছনে বিরোধীদের উদ্দেশ্য ছিল এই অনুভূতি দেয়া, যেন তা এক নতুন ধর্ম বা নতুন শরীয়ত, ইসলামের সাথে যার কোনো সম্পর্ক নেই। এই ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা বরং শত্রুতামুখর পরিবেশের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছে ইংরেজরা এবং প্রত্যেক অঞ্চলের, বিশেষত ভারত উপমহাদেশের বিদআতের পৃষ্ঠপোষক লোকজনেরা। ইসলামী বিশ্বের কোথাও কোনো দ্বীনী -ইসলাহী আন্দোলন শুরু হলে বিশেষত তাতে যদি রাজনীতি বা জিহাদের প্রসঙ্গ থাকে তবে তা ইংরেজদের চোখের বালি হয়ে দাঁড়ায় এবং তা সর্বদা তাদের বিদ্বিষ্ট মানসিকতার লক্ষ্যবস্তু হয়ে থাকে। এরা যেসব আলিম বা যে দ্বীনী হালকাকে নিজেদের বৈশ্বিক রাজনীতির পক্ষে হুমকি মনে করেছে তাদেরকেই ‘ওহাবী’ নামে মশহুর করে দিয়েছে।

শিরক-বিদআতের সমর্থক মৌলভী ও সাধারণ বিদআতীরা তাওহীদ ও সুন্নতের প্রচার এবং শিরক-বিদআত প্রতিরোধে পরিচালিত যে কোনো কর্মতৎপরতাকে ‘ওহাবী মতবাদ’ নামে এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরকে ‘ওহাবী’ নামে পরিচিত করে এবং তাদের ‘কাফের’ আখ্যা দিয়ে থাকে। এর উদ্দেশ্য, তাওহীদপন্থীরা যেন কবর পূজা, তাজিয়া পূজা, রসম-রেওয়াজ, অলীক কল্প-কাহিনী ইত্যাদি খ-নের পরিবর্তে এই আরোপিত অপবাদ খণ্ডনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন আর এই সুযোগে শিরক ও বিদআতপন্থীরা তাদের উদ্দেশ্য হাসিলে সমর্থ হয়। শাহ ইসমাঈল শহীদ রাহ. ও শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে দেওবন্দের বিষয়ে ওহাবী হওয়ার অপবাদ ইংরেজ ও বিদআতীদের পক্ষ থেকেই আরোপিত হয়েছে।

‘ওহাবী’ নামের এ ইতিহাস আরো বিস্তারিত জানার জন্য নিম্নোক্ত কিতাবসমূহ অধ্যয়ন করা যেতে পারে।

১. মাওলানা মুহাম্মাদ মনযুর নোমানী রাহ. রচিত ‘শায়েখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব আওর হিন্দুস্তান কে উলামায়ে হক’ পৃ. ৯-২৩, ৩০-৬৫

২. মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী রাহ. রচিত ‘তাহকীক ও ইনসাফ কি আদালত মে এক মযলুম মুসলিহ (সাইয়েদ আহমদ শহীদ) কা মুকাদ্দামা।

৩. মাওলানা মাসউদ আলী নদভী কৃত ‘মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব এক মযলুম ও বদনাম মুসলিহ’।

৪. শাইখুল ইসলাম মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী কৃত ‘আশ-শিহাবুস ছাকিব’ ও ‘নকশে হায়াত’। শেষের কিতাব তিনটি অধ্যয়ন করতে হবে প্রথমোক্ত কিতাবটির আলোকে।

৫. মাওলানা সরফরায খান ছফদর কৃত ‘ইবারাতে আকাবির’ পৃ. ৪৬-৬১

৬. ড. আল্লামা খালেদ মাহমুদ রচিত ‘শাহ ইসমাইল শহীদ রাহ.’ পৃ. ৫৩-৫৫

৭. হাদিয়ে বাঙ্গাল হযরত মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী কৃত ‘মুকাশাফাতে রহমত’ পৃ. ১৫-২১ (যখীরায়ে কারামাত)

হযরত সাইয়েদ আহমদ শহীদ ও শাহ ইসমাঈল শহীদ রাহ.-এর অনুসারী মুজাহিদগণের সহযোগী ছাদেকপুরের উলামা ও তাদের মুজাহিদ সঙ্গীদের বিরুদ্ধে আজ থেকে অন্তত দেড়শ বছর আগে ইংরেজ হুকুমতের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রদ্রোহের যে মামলা হয়েছিল তা ‘ওহাবীদের মামলা’ নামেই প্রসিদ্ধি লাভ করে। ইংরেজ হুকুমত ও ইংরেজ লেখকরা এই জানবায মুজাহিদ এবং তাওহীদ ও সুন্নতের ঝাণ্ডাবাহী ব্যক্তিবর্গকে ‘ওহাবী’ নামেই উল্লেখ করে থাকে। -মাওলানা মুহাম্মাদ মনযুর নোমানী রাহ. কৃত ‘শায়েখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব নজদী’ পৃ. ৭৮, মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ. কৃত ‘তাহকীক ও ইনসাফ কি আদালত মে ...’ পৃ. ৩৯

ভারতবর্ষে বিদআতের বিস্তার ও পৃষ্ঠপোষকতার এক অগ্রনায়ক জনাব ফযলে রাসূল বাদায়ুনী (জন্ম ১২১৩ হি. মৃত্যু ১২৮৯ হি.) ‘সাইফুল জাব্বার’ নামে শাহ ইসমাঈল শহীদ রাহ.-এর অনন্য কিতাব ‘তাকবিয়াতুল ঈমান’ (যা কুরআন হাদীসের স্পষ্ট নস ও বক্তব্যের ভিত্তিতে শিরকের নানা প্রকারের পরিচয় ও ভয়াবহতা বিষয়ে রচিত এক উত্তম রচনা) সম্পর্কে যে সমালোচনা লিখেছে তাতে শাহ শহীদ রাহ.-কে হিন্দুস্তানে ওহাবী মতবাদের মুখপাত্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং ‘তাকবিয়াতুল ঈমান’কে বলা হয়েছে শায়েখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব রচিত ‘কিতাবুত তাওহীদের’ অনুবাদ ও ব্যাখ্যাগ্রন্থ। -ফযলে রাসূল বাদায়ুনী, সাইফুল জাব্বার পৃ. ৪৮

অথচ এই উভয় কথাই নির্জলা মিথ্যা। যে সময় বাদায়ুনী ঐ কথা লিখেছেন তখন যদি হিন্দুস্তানে কিতাবুত তাওহীদের কোনো কপি পৌঁছেও থাকে তবু তা যে অতি দুষ্প্রাপ্য ছিল এতে কোনোই সন্দেহ নেই। খোদ বাদায়ুনী সাহেবও হয়ত কিতাবটি স্বচক্ষে দেখেননি শুধু এর নামই শুনেছেন। নতুবা এই নির্জলা মিথ্যা তিনি কীভাবে বলতে পারেন? যাইহোক ঐ যুগে হয়তো এই মিথ্যাচার গোপন থাকা সম্ভব ছিল কিন্তু এখন যোগাযোগের এই উন্নতির যুগে, শুধু বাংলাদেশেই কিতাবুত তাওহীদের শত শত কপি বিদ্যমান রয়েছে। এখন তো যে কারো পক্ষেই এক হাতে তাকবিয়াতুল ঈমান ও অন্য হাতে কিতাবুত তাওহীদ নিয়ে তুলনা করে দেখা মোটেও কঠিন নয়। যে কেউ সরাসরি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন যে, উভয় রচনার বিষয়বস্তু এক হওয়া স্বত্ত্বেও রচনাশৈলী, আলোচ্য বিষয়াদী, দলীল -প্রমাণ ও প্রমাণ গ্রহণের প্রণালী ইত্যাদি বিষয়ে স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। এ ছাড়া শিরকের পরিচয় ও প্রকারভেদ বিষয়ে তাকবিয়াতুল ঈমানের যে মৌলিক আলোচনা- তা শায়েখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাবের ‘কিতাবুত তাওহীদে’ নেই। এর পরও ‘তাকবিয়াতুল ঈমান’কে ‘কিতাবুত তাওহীদে’র অনুবাদ বা ব্যাখ্যাগ্রন্থ আখ্যা দেওয়া একদিকে ব্যক্তির নিজের জন্যও আত্মঘাতী দায়িত্বহীনতা, অন্যদিকে বাস্তবতার বিকৃতি ও মিথ্যাচার।

জনাব ফযলে রসূল বাদায়ূনীর পর ভারতবর্ষে বিদআতের বিস্তার ও পৃষ্ঠপোষকতায় এবং দ্বীন ও শরীয়তের নামে ভিত্তিহীন কথা-কাজের প্রচারে বড় ভূমিকা ছিল জনাব আহমদ রেযা খান ও তার সমমনা কিছু লোকদের। ঐ সময় তাওহীদ ও সুন্নত প্রতিষ্ঠা এবং শিরক ও বিদআতের খ-নে নিয়োজিত উলামায়ে দেওবন্দের ব্যাপারে তাদের পলিসি ছিল, সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ বিরোধিতা ও শিরক-বিদআতের খণ্ডনের অপরাধে তাদেরকে ‘ওহাবী’ নামে পরিচিত করে দেওয়া। এরা নানা উপায়ে সরলমনা মুসলিমদের মনে সম্পূর্ণ অবাস্তব এই বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত করতে অনেকাংশে সফল হয়ে যায়।

শাহ শহীদ ও আকাবিরে দেওবন্দ সম্পর্কে ওহাবী হওয়ার অভিযোগ একটি মিথ্যা অপবাদ

এ পর্যন্ত ‘ওহাবী’ নামটির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আলোচিত হয়েছে। এ থেকে স্পষ্ট হয়েছে যে, এই নামের সম্পর্ক শায়েখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব নজীদ রাহ. (জন্ম ১১১৫ হি.=১৭০৭ খৃ. মৃত্যু ১২০৬ হি.=১৭৯২খৃ.)-এর সাথে। আরো আলোচনা হয়েছে, শাহ ইসমাইল শহীদ রাহ. ও দেওবন্দের শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কেরামকে ঐ নামে আখ্যায়িত করা ইংরেজ ও বিদআতীদের এক নির্জলা মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছুই নয়। আমরা এখন বিষয়টি প্রমাণ করতে চাই।

প্রথমে শাহ শহীদ রাহ. সম্পর্কে পরিচিতিমূলক দু’চারটি কথা।

তিনি ১২ রবিউস সানী ১১৯৩ হিজরীতে দিল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং এখানেই বড় হন। তাঁর শিক্ষা-দীক্ষাও এখানেই তার খান্দানের উলামা অর্থাৎ তার চাচাদের কাছে সম্পন্ন হয়। তিনি ছিলেন শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহ.-এর নাতী। শাহ সাহেবের সন্তান (শাহ আব্দুল কাদের দেহলভী রাহ. শাহ আব্দুল আযীয দেহলভী রাহ., শাহ রফীউদ্দীন দেহলভী রাহ.) তার উস্তায ছিলেন। তাঁর শায়খে তরীকত ছিলেন সাইয়েদ আহমদ শহীদ রাহ. (যাকে ইংরেজরা ‘ওহাবী’ বললেও বিদআতীরা ‘ওহাবী’ বলে না) সাইয়েদ আহমদ শহীদ রাহ.-এর শিক্ষা-দীক্ষাও সম্পন্ন হয়েছিল শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলভী রাহ.-এর খান্দানের বুযুর্গ-আলিমগণের হাতেই। শাহ আব্দুল কাদের দেহলভী ও শাহ আব্দুল আযীয দেহলভী রাহ. তাঁর উস্তায ও মুরুব্বী ছিলেন। শাহ শহীদ রাহ. বয়সে তার চেয়ে কিছুটা বড় ছিলেন। কোনো এক সময় সাইয়েদ সাহেব তার নিকটে কিছু দরসও গ্রহণ করেছিলেন।

উপরোক্ত ব্যক্তিবর্গের কারও কোনো সম্পর্ক শায়েখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাবের সাথে ছিল না। না উস্তায-শাগরিদির, না পীর-মুরীদীর, না আত্মীয়তার, না অন্য কোনো সম্পর্ক। কোনো সম্পর্কই ইতিহাসে প্রমাণিত নয়। তদ্রূপ শায়েখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব রাহ. বা তার আন্দোলনের কর্মী -সমর্থক আলেমগণের কোনো রচনাও এঁদের অধ্যয়নে এসেছিল এমন কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণও কারো পক্ষে পেশ করা সম্ভব হবে না।

শায়েখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাবের আন্দোলন ছিল মূলত একটি সংস্কার আন্দোলন- এতে কোনো সন্দেহ নেই; তেমনি এ-ও বাস্তব সত্য যে, এই আন্দোলনের সাথে বা এই আন্দোলনের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের সাথে উপরোক্ত মনীষীদের কোনো সম্পর্ক ছিল না।

শাহ শহীদ রাহ. যখন সাইয়েদ আহমদ শহীদ রাহ.-এর সাথে হজ্বের উদ্দেশ্যে হিজাযে সফর করেন তখন হিজায ভূমিতে নজদীদের বা তাদের দাওয়াতের কোনোরূপ প্রভাব ছিল না। তারা হজ্ব করেছিলেন ১২৩৭ হিজরী মোতাবেক ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে। -মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী, সীরাতে সাইয়েদ আহমদ শহীদ ১/৩৬৩; ড. আল্লামা খালেদ মাহমুদ, শাহ ইসমাইল শহীদ রাহ. পৃ. ১৮২২

অথচ এর বহু আগে ১২২৭ হিজরীতে নজদীরা হিজাযের কর্তৃত্ব হারায়। আর শায়েখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাবের ইন্তিকাল তো এরও বহু আগে (১২০৬ হিজরীতে) হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া গোটা হিজাযের পরিবেশ ছিল নজদীদের বিপক্ষে। খোদ ফযলে রাসূল বাদায়ুনী ‘সাইফুল জাব্বারে’ (পৃ. ১৭) লিখেছেন, ‘মুহাম্মাদ আলী পাশা ইবরাহীম পাশাকে হিজাযে প্রেরণ করেন। সে এসে এমন ব্যবস্থা নেয় যে, নজদীদের নাম নিশানা পর্যন্ত মুছে যায় এবং সে নির্বিচারে হত্যা করে।’

এ ছাড়া হজ্বের বছর শাহ শহীদের বয়স ছিল আনুমানিক ৪৪ বছর। এ বয়সে তো তিনি ছিলেন এক পরিপক্ক মুহাক্কিক, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও ফক্বীহ। ইতিমধ্যে অনেক কিতাব রচনা করেছিলেন। ‘সীরাতে মুসতাকীম’ ও ‘তাকবিয়াতুল ঈমান’ দুটোই তাঁর হজ্বের সফরের আগে রচিত। -শাহ আমীর খান ছাহেব, আমীরুর রিওয়ায়াহ পৃ. ৮৩, হিকায়েত ৫৯; (আরওয়াহে ছালাছাহ) মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী, সীরাতে সাইয়েদ আহমদ শহীদ ১/৩৬৬, ২/৫৫৫

এইসব ব্যক্তিত্ব অন্য কারো প্রভাব গ্রহণ তো দূরের কথা, বাস্তব কথা হল, এই হজ্বের সফরে ওখানের আলিমগণ তাঁদের নিকট থেকে উপকৃত হয়েছেন। ‘সীরাতে মুস্তাকীম’ যা ফার্সী ভাষায় লিখিত হয়েছিল, এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানার পর তৎকালীন বড় আলেম শায়েখ হাসান আফেন্দী তা সংগ্রহ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তখন শাহ শহীদ রাহ. ও মাওলানা আব্দুল হাই রাহ. তার খাতিরে কিতাবটি আরবীতে অনুবাদ করে দিয়েছিলেন, যার কপি ঐ সময় যারা বায়আত হয়েছিলেন তারাও সংগ্রহ করেছিলেন। -সীরাতে সাইয়েদ আহমদ শহীদ খ. ১ পৃ. ৩৬৬

বায়আত যারা হয়েছিলেন তাদের মধ্যে ওখানের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরাও ছিলেন। হযরত মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী রাহ. ‘মুকাশাফাতে রহমত’ (পৃ. ২৬)-এ শায়েখ মুস্তফা মরদাদ রাহ.-এর নামও উল্লেখ করেছেন, যিনি সে সময় মসজিদে হারামের ইমাম ছিলেন। মোটকথা, শাহ শহীদ রা. ও তাঁর সহযোগীরা যে বিরুদ্ধবাদীদের আরোপিত ওহাবী অপবাদ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন তা এক স্পষ্ট বাস্তবতা। আকীদা ও মাসাইলের ক্ষেত্রে শায়েখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব নজদীর মাসলাককে তাদের মাসলাকের সাথে মিলিয়ে দেখা হলে মৌলিক মিল সত্ত্বেও অনেক বিষয়েই পার্থক্য দেখা যাবে। যেমন শায়েখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব নজদীর নিকটে (তাওয়াসসুল) ওসীলা দ্বারা দুআ জায়েয নয়। অথচ শাহ শহীদ রাহ.-এর ‘তাকবিয়াতুল ঈমানে’ তাওয়াসসুল-এর বৈধতা স্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়েছে। (তাকবিয়াতুল ঈমান পৃ. ১২৩ ফসলে খামেস, মুদ্রণ : লখনৌ।) তেমনি শায়েখ নজদী হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন আর শাহ শহীদ রাহ. ছিলেন হানাফী ইত্যাদি। -হযরত মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী, মুকাশাফাতে রহমত ১৫-২১; মাওলানা আখলাক হুসাইন কাসেমী, শাহ ইসমাইল শহীদ আওর উনকে নাকেদ পৃ. ৯-১৩, (মুকাদ্দামা) ১২০-১২২; মাওলানা খালেদ মাহমুদ, শাহ ইসমাইল শহীদ পৃ. ২৭-৩০; মাওলানা আমীন ছফদর, মজমুআ রাসায়েল খ. ১, মুকাদ্দামাহ

সারকথা, শাহ শহীদ রাহ. ও শায়েখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব নজদী রাহ.-এর মাঝে না উস্তায শাগরিদের সম্পর্ক, না পীর-মুরীদির, না মাযহাব-মাসলাকের। শায়েখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাবের সাথে তাঁর সাক্ষাতের তো প্রশ্নই আসে না। তার কোনো শীষ্য বা মুরীদের সাথেও তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল- ইতিহাসে এরও কোনো প্রমাণ নেই। তার কোনো কিতাব তিনি অধ্যয়ন করেছেন এমন প্রমাণও কোথাও পাওয়া যায় না। অতএব কেউ যদি শাহ শহীদ রাহ. ও তাঁর সংস্কার কার্যক্রমকে শায়েখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাবের সাথে সম্পৃক্ত করে তাকে ওহাবী আখ্যা দেয়, তার সামনে কুরআনের আয়াত-

فلعنة الله على الكاذبين

তিলাওয়াত করা ছাড়া আর কী করার আছে? সামনে অগ্রসর হওয়ার আগে হাদিয়ে বাঙ্গাল হযরত মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী রাহ.-এর বক্তব্য পেশ করতে চাই, যিনি ছিলেন এই অপবাদের সূচনাকাল ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির একজন প্রত্যক্ষদর্শী। এবং শত্রু-মিত্র সবার কাছেই যার ব্যক্তিত্ব স্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য। হযরত জৌনপুরী রাহ. ‘মুকাশাফাতে রহমত’ (পৃ. ১৬-১৯) খালিছ তাওহীদের প্রচার, সুন্নত প্রতিষ্ঠা এবং শিরক-বিদআত উৎখাত প্রসঙ্গে হযরত সাইয়েদ আহমদ শহীদ রাহ.-এর সংস্কার কর্মের আলোচনা করতে গিয়ে লেখেন, ‘এবং সাইয়েদ সাহেব যেমন দ্বীনকে সতেজ ও সুন্নতকে জীবিত করেছেন; ঐসব লোকেরা শিরক, বিদআত ও কুফরী-রসম-রেওয়াজকে তাজা করতে আরম্ভ করেছে।’

এবার দেওবন্দের আকাবির ও শীর্ষস্থানীয় বুযুর্গগণের ব্যাপারে শুনুন। তাঁদের অনেকে তো শায়েখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব নজদী, তাঁর আন্দোলন এবং তাঁর কিতাবসমূহের ব্যাপারে অবগতই ছিলেন না, আবার অনেকে তাকে আব্দুল ওয়াহহাব (পিতার নামে) উল্লেখ করতেন। দারুল উলূমের প্রথম দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির আকাবিরের অবস্থা তো এই ছিল যে, শায়েখ ও শায়েখের আন্দোলনের বিষয়ে তাদের বিস্তারিত অবগতি ছিল না। পরের মনীষীদের যদিও তার আন্দোলন ও এতদসংক্রান্ত বইপত্র পাঠের সুযোগ হয়েছে কিন্তু তারাও এ থেকে কোনোরূপ প্রভাব গ্রহণ করেননি। শায়েখ নজদী রাহ.-এর আন্দোলনের যে বিষয়গুলো সর্বজন স্বীকৃত তাতে তো কোনো আলোচনা নেই আর যে সব বিষয়ে শায়েখ ও আমাদের পূর্ববর্তী বুযুর্গ মনীষীদের মাঝে ইখতিলাফ ছিল সেসব বিষয়ে তারা নিজেদের পূর্বসূরীদের দলীলসমৃদ্ধ মতামতই অনুসরণ করেছেন। তাদের প্রতিষ্ঠিত হাজার হাজার মাদরাসা, অসংখ্য রচনা, ওয়াজ সংকলন, পত্রাবলী এ বিষয়ে সুস্পষ্ট দলীল।

থাকল তাওহীদে খালেছের প্রচার, সুন্নত প্রতিষ্ঠা এবং শিরক-বিদআতের খ-ন। এ তো আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের বৈশিষ্ট্য; সব যুগের ও সকল অঞ্চলের সুন্নী মুসলমান এক্ষেত্রে অভিন্ন।

হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রাহ. দীর্ঘদিন পর্যন্ত শায়েখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব রাহ. ও তাঁর আন্দোলনের বিষয়ে অনবগত ছিলেন। শায়েখের ব্যাপারে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি লেখেন, ‘মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাবের আকাইদের অবস্থা আমার জানা নেই। -ফাতাওয়া রশীদিয়্যাহ পৃ. ৬২; শায়েখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব আওর হিন্দুস্তানকে উলামায়ে হক্ব পৃ. ২৯

পরবর্তীতে বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্রে তার কিছু অবস্থা জানা হলে আরেক প্রশ্নকারীর ‘ওহাবী কারা এবং মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব নজদীর আকীদা কী ও তার মাযহাব কী ছিল?- এই প্রশ্নের জবাবে লেখেন, মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব নজদীর অনুসারীদেরকে ওয়াহাবী বলা হয়। তাদের আকীদা ভালো ছিল। তারা হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী। তাদের স্বভাবে কিছুটা রুক্ষতা ছিল, কিন্তু তিনি ও তার অনুসারীরা ভালো। তবে ওদের মধ্যে যারা সীমালংঘন করেছে তাদের মধ্যে ফাসাদ এসে গেছে। -ফাতাওয়া রশীদিয়্যাহ পৃ. ২৬৬ মাকতাবায়ে মাহমুদিয়াহ, সাহারানপুর

চিন্তা করুন, তাঁরা যদি মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব-এর অনুসারীদেরই তরবিয়্যাত পেয়ে থাকবেন এবং তাদের কাছ থেকেই দ্বীন ও আকাইদের জ্ঞান অর্জন করে থাকবেন তাহলে শায়েখের ব্যাপারে তাঁদের জানা শোনা কি এত সীমাবদ্ধ হত? এবং তার আন্দোলনের ব্যাপারেও কি তাদের মতামত এরকম হত?

আকাবিরে দেওবন্দের দ্বিতীয় সারির ব্যক্তিত্বদের মাঝে হযরত মাওলানা খলীল আহমদ সাহারানপুরী রাহ. বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৩২৫ হিজরীতে, যখন এ আন্দোলন সম্পর্কে তাঁর প্রত্যক্ষ ধারণা ছিল না, ঐ সময় ‘রদ্দুল মুহতার’ কিতাবে উল্লেখিত তথ্য এবং প্রশ্নকারীর বর্ণনার ভিত্তিতে তার কিতাব ‘আততাসদীকাত’ (আলমুহান্নাদ আলাল মুফান্নাদ, পৃ. ২২৮-২৩০)-এ শায়েখ ও তাঁর সমমনা লোকদের (নাউযুবিল্লাহ) খারেজী লিখেছেন। পরে ১৩৪৪ হিজরীতে যখন হিজরত করে হিজাযে চলে যান এবং নজদীদেরকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয় তখন তাদের ব্যাপারে তাঁর ধারণার পরিবর্তন ঘটে, যা তিনি তাঁর একাধিক চিঠিতে উল্লেখ করেছেন।১ ‘ওহাবী’ পরিভাষাটির ব্যাখ্য দিতে গিয়ে তিনি তাঁর কিতাব ‘আততাসদীকাতে (পৃ. ২১৫-২১৬) লিখেছেন,

‘হিন্দুস্তানে ওহাবী শব্দের মূল ব্যবহার ওইসব লোকের ক্ষেত্রে, যারা মুজতাহিদ ইমামগণের তাকলীদ করে না। এরপর শব্দটি এত প্রশস্ত হল যে, সুন্নতের অনুসারী এবং বিদআত ও রসম-রেওয়াজ পরিত্যাগকারীদের ব্যাপারেও তা ব্যবহৃত হতে থাকল। বোম্বে ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে এ পরিভাষা প্রসিদ্ধ যে, যেসব মৌলভী ওলী-আউলিয়ার কবরে সিজদা ও তওয়াফকে নিষেধ করে তারা ওহাবী। বরং যে ‘সুদ’ হারাম হওয়ার বিষয়টি বর্ণনা করে সেও ওহাবী; সে যত বড় মুসলমানই হোক না কেন। এরপর ‘ওহাবী’ শব্দটি একটি গালিতে পরিণত হয়েছে। অতএব কোনো ভারতীয় কাউকে ‘ওহাবী’ বললে এর অর্থ এই নয় যে, তার আকিদা বিশ্বাস দুরস্ত নয়; বরং এর অর্থ হয় সে সুন্নী হানাফী, সুন্নতের অনুসারী ও বিদআত বর্জনকারী। আর সে গুনাহের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাকে ভয় করে।

‘যেহেতু আমাদের উলামা মাশায়েখ সুন্নতের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় এবং বিদআতের আগুন নির্বাপিত করার চেষ্টায় নিয়োজিত থাকায় ‘শয়তানের দল’ তাদের প্রতি ক্রুদ্ধ। এরা তাদের কথা-বার্তায় বিকৃতি ঘটিয়েছে এবং তাদের উপর নানা মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেছে। আর তাদেরকে ওহাবী নামে আখ্যায়িত করেছে কিন্তু -আল্লাহর পানাহ- তাঁরা কখনোই তা নন।’

আকাবিরে দেওবন্দের তৃতীয় সারিতে হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. ও শাইখুল ইসলাম হযরত মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ. বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। হযরত মাওলানা থানভী রাহ. তাঁর ‘মালফুযাতে’ বলেন, ‘আমি এক লোককে বলেছি, তোমরা যে আমাদেরকে ‘ওহাবী’ বল- ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব-এর সাথে আমাদের কী সম্পর্ক? নিসবত বা সম্পর্ক তিন প্রকারের হয় : এক. উস্তায-শাগরিদের সম্পর্ক, তো আমাদের ও আমাদের উস্তাযগণের সনদের সিলসিলার কোথাও তিনি নেই। দুই. পীর-মুরীদির সম্পর্ক, এটাও তার সাথে আমাদের নেই। আর তিন. বংশীয় সম্পর্ক। এটাও তো নেই। এ অবস্থায় তোমরা যে আমাদেরকে তাঁর সাথে সম্বন্ধ কর এই (মিথ্যার) জন্য কি (আল্লাহর দরবারে) তোমাদের জবাবদিহী করতে হবে না? বর্তমানে আমাদেরকে যারা ওহাবী বলে তারা ‘কর্মক্ষেত্রে অনুসরণে’র অর্থ হিসেবে বলে থাকে, অথচ এটাও একটা অপবাদ ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ আমরা তো তাঁর ইতিহাসও জানি না, আমাদের মজলিসগুলোতে তাঁর আলোচনাও আসে না, প্রশংসার প্রসঙ্গেও না, নিন্দার প্রসঙ্গেও না। -কামালাতে আশরাফিয়া পৃ. ১৫২

এরপর হযরত থানভী রাহ. এটাও বলেছেন, আসলে আমাদের আকাবির প্রচলিত রসম রেওয়াজ (যেগুলো বিদআত ও মুনকারের শামিল)-এর খ-ন করেন সে জন্যই তারা তাদেরকে ওহাবী বলে থাকে। হযরত এই দিকেও ইঙ্গিত করেছেন যে সুন্নতের ইলম থেকে বেখবর আওয়াম তো মনে করে মিলাদ কিয়াম না করা বেয়াদবী, তাই যে-ই কিয়াম করে না সেই ওহাবী। মনে করে ওহাবী মানেই বেআদব!!

হযরত মাদানী রাহ. যেহেতু ১৩১৬ হিজরী থেকে ১৩৩৩ হিজরী পর্যন্ত মদীনা মুনাওয়ারায় অবস্থান করেছেন, যেসময় ওখানে নজদীদেরকে খুব খারাপ দৃষ্টিতে দেখা হত এবং তাদের সম্পর্কে এমন সব গুজব প্রচলিত ছিল যা তাদের সম্পর্কে খুব খারাপ ধারণা সৃষ্টি করত। হযরত মাদানী রাহ. যেহেতু সরাসরি আন্দোলনটি অধ্যয়ন করেননি তাই তিনি ওখানের সাধারণ আবহাওয়ায় প্রভাবিত ছিলেন এবং ‘আশ শিহাবুস সাকিব’ গ্রন্থে ঐ সময়ের তথ্যের ভিত্তিতে নজদীদের বিরুদ্ধে অনেক কিছু লিখেছেন। পরে এই আন্দোলন ও দাওয়াতকে সরাসরি অধ্যয়ন করলে তাঁর ধারণায় পরিবর্তন আসে এবং তিনি তার পূর্বের মত পরিহার করেন। ১৭ মে ১৯২৫ ঈ. একটি পত্রিকায় তিনি এই ঘোষণা দেন যে,

‘এ ঘোষণা দিতে আমার কিছুমাত্র দ্বিধা নেই যে, আমি আহলে নজদের বিরুদ্ধে ‘রুজূমুল মাদানিয়্যীন’ ও ‘আশ শিহাবুস সাকিব’-এ যা কিছু লিখেছি তা তাদের রচনাবলীর ভিত্তিতে ছিল না; বরং শুধু জনশ্রুতি বা তাদের বিরোধীদের বক্তব্যের ভিত্তিতে ছিল। এখন তাদের নির্ভরযোগ্য রচনাবলি বলছে যে, তাদের বিরোধিতা আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের সাথে তত নয় যতটা প্রচার করা হয়েছে। বরং কিছু শাখাগত বিষয়ে এ পর্যায়ের মতপার্থক্য রয়েছে যার ভিত্তিতে তাদেরকে ফাসেক বা গোমরাহ বলা যায় না।’ -রোযনামা যমীনদার, লাহোর ১৭ মে ১৯২৫ ঈসায়ী; আকমালুল বয়ান, আযীযুদ্দিন মুরাদাবাদী পৃ. ৯; শায়েখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব আওর হিন্দুস্তান কে উলামায়ে হক্ব, মাওলানা মুহাম্মাদ মনযুর নোমানী পৃ. ৯৩

এইসব উদ্ধৃতি টানার উদ্দেশ্য হল, মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব ও তাঁর আন্দোলন সম্পর্কে যাদের সম্পর্ক ও জানাশোনার এই হাল তাদেরকে ‘ওহাবী’ বলা কি নিকৃষ্ট মিথ্যাচার নয়?

আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এখানকার বেদআতীরা তো আকাবিরে দেওবন্দকে ওহাবী বলে গালি দেয় কিন্তু ওহাবী বলে যাদের কাতারে শামিল করতে চায় সরাসরি তাদেরকেই যদি জিজ্ঞাসা করা হয় তারা জবাব দিবেন, ‘দেওবন্দের লোকেরা আমাদের দলভুক্ত নয়, তাদের ও আমাদের মাঝে অনেক বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে।’ এখন আপনি কি বিদআতীদের কথা শুনবেন, না নজদীদের কথা?

সবশেষে আকাবিরে দেওবন্দের প্রতি ওহাবী হওয়ার যে অপবাদ আরোপ করা হয়েছে সে বিষয়ে একটি ঘটনা পাঠকের সামনে পেশ করছি।

মৌলভী নযর মুহাম্মাদ খান ছিলেন ‘আভ’-এর অধিবাসী। তার বাবা একজন দ্বীনদার লোক ছিলেন। কিন্তু যেহেতু শুনেছিলেন, দেওবন্দি মাওলানারা ওহাবী তাই তিনি তাদের মুখ দেখতেও রাজি ছিলেন না। একবার হযরত মাওলানা কাসেম নানুতবী ও হযরত মাওলানা ইয়াকুব নানুতবী রাহ.-এর সাথে হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রাহ. ‘নানুতায়’ তাশরীফ আনেন। জুমার দিন ছিল। ‘আভ’ থেকেও কিছু লোক জুমা পড়ার উদ্দেশ্যে নানুতা আসেন। নযর মুহাম্মাদ ছাহেব অল্প বয়স্ক হলেও বুদ্ধিমান ছিলেন। এজন্য বাবার কাছে আবদার করেন, আমিও নানুতায় যাব। শুনেছি কয়েকজন মৌলভী সাহেব এসেছেন। বাবা নিষেধ করলেন- না এরা ওহাবী, ওহাবীদের সংশ্রব থেকে দূরে থাকা উচিত। পুত্র বলতে লাগল, আমি ওহাবী দেখতে যাব। ওহাবীদের চেহারা-সূরত কেমন হয় কখনো দেখিনি। বাবা ছেলেকে অন্যদের সাথে পাঠানো সমীচীন মনে করলেন না তাই নিজেই সাথে করে নিয়ে নানুতা উপস্থিত হন। এদিকে বাবাও কখনো ওহাবী দেখেননি তাই তার মনেও ওহাবী দেখার বাসনা জেগে উঠল।

বাপ-বেটা মসজিদে এসে পৌঁছলে সর্বপ্রথম মাওলানা ইয়াকুব নানুতবী রাহ.-এর প্রতি দৃষ্টি পড়ল। তিনি গোসল করে মসজিদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। এমনিতেই সুন্দর মানুষ ছিলেন এর উপর ঈমানী নূর। বাপ-বেটা অবাক হয়ে তাকিয়েই রইলেন। ওহাবীদের চেহারা তো শীয়াদের চেয়েও কুশ্রী হওয়া উচিত কিন্তু এ তো আপাদমস্তক নূরের টুকরা মনে হচ্ছে। ওখান থেকে মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রাহ.-এর কাছে এলেন। আল্লাহর ইচ্ছায় অন্তরের অবস্থা পরিবর্তন হয়ে গেল এবং অন্তরে তাদের প্রতি মুহাব্বত সৃষ্টি হল।

জুমার নামাযের পর ঘোষণা হল যে, মাওলানা মুহাম্মাদ কাসেম নানুতবী রাহ.-এর ওয়ায হবে। মাওলানা নানুতবী রাহ. যেহেতু গাঙ্গুহী রাহ.-কে খুব ইজ্জত করতেন তাই প্রথমে অসম্মতি প্রকাশ করলেও গাঙ্গুহী রাহ. যখন নিজেই বলতে লাগলেন যে, না মাওলানা নানুতবীই ওয়ায করবেন তখন তিনি প্রস্তুত হয়ে গেলেন।

মৌলভী নযর মুহাম্মদ বলেন, আমাদেরকে তো একথাই বলা হয়েছিল যে, এই দেওবন্দী গ্রুপ আল্লাহর রাসূলকে অস্বীকার করে এবং এরা হচ্ছে বে-আদব ওহাবী। কিন্তু মাওলানা তার ওয়াযে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামের গুণাবলীর কথাই বর্ণনা করলেন। মাওলানার ওয়ায তো এমনিতেই সুন্দর ছিল কিন্তু সেদিন তিনি তার ওয়াযে এমন সব আকর্ষণীয় বিষয় আনলেন যে, বেচারা মিলাদীরা হয়তো তা স্বপ্নেও শোনেনি।

তার আলোচনায় হৃদয়ের দুয়ার যেন ফুলের পাপড়ির মত খুলে যাচ্ছিল। একপর্যায়ে বাবাকে বললাম, ওহাবী যদি এমনই হয় তবে তো আমি ওহাবী হয়েই গেছি। বললেন হাঁ, ঠিকই বলেছ। বড় ভুলের মধ্যেই ছিলাম। যদি এরাই ওহাবী হয় তাহলে আমিও আজ থেকে ওহাবী। এদের সাহচর্য ত্যাগ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। -মাওলানা আশেক ইলাহী মিরাঠী : তাযকিরাতুর রশীদ খ. ১ পৃ. ১৩৮-১৩৯ 

বিঃদ্রঃ আপনার অন্য গুরুত্তপূর্ণ প্রশ্নগুলো আলাদাভাবে করুন।
প্রচুর প্রশ্ন আসায় আমরা একটির উত্তর দিয়েই ক্ষান্ত করছি।

والله اعلم بالصواب

উত্তর দিয়েছেনঃ মুসলিম বাংলা ইফতা বিভাগ

মন্তব্য ()

কোনো মন্তব্য নেই।

এ সম্পর্কিত আরও জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

৮২৬৯

কবরের সুওয়াল কি কুরআন সম্মত নয়!


২৬ জুন, ২০২৪

খুলনা

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুসলিম বাংলা ইফতা বিভাগ

১৪৮৩০

সম্মিলিত মুনাজাত


৩১ অক্টোবর, ২০২৩

ঢাকা ১০০০

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি

৩৮৮৭৯

নসখের সংজ্ঞা ও মানসূখ আয়াতের সংখ্যা


২৯ আগস্ট, ২০২৩

ঢাকা

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুসলিম বাংলা ইফতা বিভাগ

Logoমুসলিম বাংলা
play storeapp store
TopOfStack Software © 2025 All rights reserved. Privacy Policy