আপনার জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

সকল মাসায়েল একত্রে দেখুন

কুরআন খতম ও চল্লিশা

প্রশ্নঃ ৪৩২২৬. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, মৃত ব্যক্তির জন্য খতম পড়ানো, তিন দিন চল্লিশা, অর্থাৎ বড় আয়োজন করে খাওয়ানো এই বিষয়টা নিয়ে আমাদের গ্রামে অনেক ঝামেলা চলছে। হযরতের কাছে আমার আবদার থাকবে যে কোরআন হাদিস দিয়ে এই সমস্যার সমাধানগুলো বলবেন। প্রতিটি কথা দলিল যোগ্য কামনা করছি।,

১৮ অক্টোবর, ২০২৩

ঢাকা

উত্তর

و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم


সম্মানিত প্রশ্নকারী!
১. চল্লিশার খানা:
ইসলামে অপরজনকে আহার করানোর গুরুত্ব অপরিসীম। বিভিন্ন হাদিসে এটাকে শ্রেষ্ঠ ইসলাম বলেও অবহিত করা হয়েছে। আবার কেউ দাওয়াত দিলে তা গ্রহন করাও রাসুলুল্লাহ সাঃ এর সুন্নাহ। এর মাধ্যমে পারস্পরিক বন্ধন সুদৃঢ় হয় এবং ইসলামের ভ্রাতৃত্বের বিকাশ ঘটে।
কাজেই কোনো মুসলিম যদি অপর মুসলিমকে দাওয়াত দিয়ে আহার করায় তাতে কোনো দোষ নেই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যখন দীনের বহির্ভূত কোনো বিষয়কে দীনের নামে চালিয়ে দেওয়া হয়,শরিয়তের পরিভাষায় যাকে বেদায়াত বলে।

মৃত ব্যক্তির জন্য তার মৃত্যুর ৪০ দিন, ৩ দিন বা ৭ দিন পর নির্দিষ্ট করে বিশেষ কোনো ফজিলত বা সাওয়াবের প্রত্যাশায়, অথবা রুসম-প্রথা হিসেবে যেই খাবারের আয়োজন করা হয় ইসলামি শরিয়তের এর কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। কাজেই সেটা বেদায়াত এবং পরিত্যাজ্য। সাধারণ মুসলমানের জন্য এজাতীয় খাবারে অংশগ্রহণ করা অনুচিত। বিশেষত সমাজে যারা অনুসৃত ব্যক্তি -এজাতীয় আয়োজন থেকে দূরে থাকা তাদের জন্য আবশ্যক। তা নাহলে তাদের উপস্থিতিকে অনুকরণীয় মনে করে মানুষ এই গর্হিত কাজে লিপ্ত হতে থাকবে।

তবে যদি এটাকে নির্দিষ্ট কোনো নিয়মনীতির আওতামুক্ত রেখে মাইয়্যেতের জন্য ইসালে সাওয়াবের অন্যান্য মাধ্যমের ন্যায় নিছক এটাও একটা মাধ্যম মনে করে মানুষকে আহার্য দান করা হয় তাহলে সেখানে অংশগ্রহণ করা এবং খাবার গ্রহন করা জায়েজ আছে।

প্রসঙ্গত, অনেকাংশে যেখানে মৃত ব্যক্তির ত্যাজ্য সম্পদ থেকে এজাতীয় আয়োজন করা হয় সেখানে সকল ওয়ারিসের স্বতঃস্ফূর্ত অনুমতি থাকে না। অনেকটা বাধ্য হয়ে কিংবা পরিস্থিতির শিকার হয়ে তারা এগুলোতে সম্মতি দিয়ে থাকেন। যা কোনোক্রমেই অনুমোদিত নয়। এছাড়াও ওয়ারিসদের মধ্যে যদি কোনো নাবালেগ থাকে তাহলে তার বালেগ হওয়ার আগ পর্যন্ত এজাতীয় জিয়াফত করা নাজায়েজ।


আবার অনেকস্থানে লোক দেখানোর জন্যও প্রতিযোগিতামূলক এই ধরণের খাবারের আয়োজন করা হয়। সেখানে শিরোনাম থাকে “না খাওয়ালে মানুষ কি বলবে?” অথবা মানুষ কৃপণ বলবে! আবার কেউ হয়তো রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকে, তো এই খাবার তার রাজনৈতিক ভাবমূর্তিরও একটা অংশ হয়ে যায়।

হদিস শরীফে এজাতীয় খাবার থেকে নিষেধ করা হয়েছে। হজরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন,
إِنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَهَى عَنْ طَعَامِ الْمُتَبَارِيَيْنِ أَنْ يُؤْكَلَ
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’ প্রতিদ্বন্দ্বি অহংকারীর খাদ্য গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন। [সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং-৩৭৫৪]

عن طلحة قال: قدم جرير على عمر فقال: هل يناح قبلكم على الميت؟ قال: لا قال: فهل تجتمع النساء عندكم على الميت ويطعم الطعام؟ قال: نعم: تلك النياحة (المصنف لابن أبى شيبة، كتاب الجنائز، ما قالوا فى الإطعام عليه النياحة-7/241، رقم-11467)

وفى البزازية: ويكره اتخاذ الطعام فى اليوم الأول والثانى والثالث بعد الأسبوع (الى قوله) واتخاذ الدعوة لقرأة القرآن الخ (رد المحتار، كتاب الصلاة، باب صلاة الجنازة، مطلب فى كراهة الضيافة من أهل الميت-3/148، البزازية على هامش الهندية-4/81، جديد-2/54)


اللَّهُمَّ أَوْصِلْ مِثْلَ ثَوَابِ مَا قَرَأْته إلَى فُلَانٍ، وَأَمَّا عِنْدَنَا فَالْوَاصِلُ إلَيْهِ نَفْسُ الثَّوَابِ. وَفِي الْبَحْرِ: مَنْ صَامَ أَوْ صَلَّى أَوْ تَصَدَّقَ وَجَعَلَ ثَوَابَهُ لِغَيْرِهِ مِنْ الْأَمْوَاتِ وَالْأَحْيَاءِ جَازَ، وَيَصِلُ ثَوَابُهَا إلَيْهِمْ عِنْدَ أَهْلِ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ كَذَا فِي الْبَدَائِعِ، (رد المحتار، كتاب الصلاة، باب صلاة الجنازة، مطلب فى القرأة للميت وإهداء ثوابها له-3/152)

وَيُكْرَهُ اتِّخَاذُ الضِّيَافَةِ مِنْ الطَّعَامِ مِنْ أَهْلِ الْمَيِّتِ لِأَنَّهُ شُرِعَ فِي السُّرُورِ لَا فِي الشُّرُورِ، وَهِيَ بِدْعَةٌ مُسْتَقْبَحَةٌ: وَرَوَى الْإِمَامُ أَحْمَدُ وَابْنُ مَاجَهْ بِإِسْنَادٍ صَحِيحٍ عَنْ جَرِيرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ قَالَ ” كُنَّا نَعُدُّ الِاجْتِمَاعَ إلَى أَهْلِ الْمَيِّتِ وَصُنْعَهُمْ الطَّعَامَ مِنْ النِّيَاحَةِ “. اهـ. وَفِي الْبَزَّازِيَّةِ: وَيُكْرَهُ اتِّخَاذُ الطَّعَامِ فِي الْيَوْمِ الْأَوَّلِ وَالثَّالِثِ وَبَعْدَ الْأُسْبُوعِ وَنَقْلُ الطَّعَامِ إلَى الْقَبْرِ فِي الْمَوَاسِمِ، وَاِتِّخَاذُ الدَّعْوَةِ لِقِرَاءَةِ الْقُرْآنِ وَجَمْعُ الصُّلَحَاءِ وَالْقُرَّاءِ لِلْخَتْمِ أَوْ لِقِرَاءَةِ سُورَةِ الْأَنْعَامِ أَوْ الْإِخْلَاصِ (رد المحتار، كتاب الصلاة، باب صلاة الجنازة، مطلب فى كراهة الضيافة من اهل الميت-3/148)
কাজেই এজাতীয় খাবার বা জিয়াফত অবশ্যই পরিত্যাজ্য।

২.বিনিময় দিয়ে কুরআন পড়ানো
ঈসালে সওয়াবের একটি মুবাহ পদ্ধতি হল কুরআন তিলাওয়াত। এ ক্ষেত্রে উত্তম হচ্ছে নিজে তিলাওয়াত করা। নিজের তিলাওয়াতের মধ্যে মাইয়িতের প্রতি যে মহব্বত ও আন্তরিকতা থাকে অন্যের তিলাওয়াতে তা সবসময় থাকা জরুরি নয় এবং নিজের তিলাওয়াতের পর দুআ করলে যে ব্যথা ও জ্বলন অনুভব হয় অন্যের তিলাওয়াতের পর তা সর্বদা থাকা অনিবার্য নয়। কিন্তু সমাজে অন্যকে দিয়ে কুরআন পড়ানোর রেওয়াজই বেশি। তা-ও আবার বিনিময় দিয়ে। অথচ কুরআন তিলাওয়াত নামায-রোযার মত ‘ইবাদতে মাকসূদা’র অন্তর্ভুক্ত। আর এধরনের ইবাদতের বিনিময় দেওয়া-নেওয়া সম্পূর্ণ নাজায়েয। হাদীসে এ বিষয়ে কঠোরভাবে সতর্ক করা হয়েছে।

দু-একটি হাদীস লক্ষ করুন-
আবদুর রহমান ইবনে শিবল রা. থেকে বর্ণিত, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তোমরা কুরআন পড় তবে তাতে বাড়াবাড়ি করো না। এর প্রতি বিরূপ হয়ো না। এর বিনিময় ভক্ষণ করো না এবং এর দ্বারা সম্পদ কামনা করো না। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৫৫২৯

ইমরান ইবনে হুসাইন রা. থেকে বর্ণিত, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তোমরা কুরআন পড় এবং আল্লাহর কাছে প্রার্থনা কর। তোমাদের পরে এমন এক জাতি আসবে যারা কুরআন পড়ে মানুষের কাছে প্রার্থনা করবে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৯৯১৭

থানবী রাহ. লেখেন, دستور ہے کہ قبر پریا گھر پر حفاظ کو بٹھلا کر کہیں دس روز کہیں چالیس روز یا کم وبیش قرآن مجید ختم کراتے ہیں، پھر ان کو کچھ اسباب کچھ نقد وغیرہ دیتے ہیں، گو لوگ اس کو کوشش کرکے درست بنانا چاہتے ہیں، مگر بات کھلی ہوئی ہے کہ جب مقصود جانبین کا اجرت دینا لینا ہے اور طاعت پر اجرت لینا جائز نہیں، اس لئے یہ فعل ہر گز درست نہیں، نہ ایسے قرآن پڑھنے کا ثواب ملے ، جب پڑھنے والےکو نہ ملا تو مردہ کو کیا پہنچے گا.

প্রচলন আছে যে, কবরের কাছে বা ঘরে হাফেযদের দিয়ে কোথাও দশদিন পর কোথাও চল্লিশদিন বা তার চেয়ে কিছু কমবেশি পর কুরআন মাজীদ খতম করানো হয়। তারপর তাদেরকে কিছু সামগ্রী, কিছু নগদ অর্থ ইত্যাদি প্রদান করা হয়। মানুষ এটাকে বৈধ বানানোর চেষ্টা করলেও বিষয়টি সম্পূর্ণ পরিষ্কার। কেননা উভয় পক্ষের উদ্দেশ্য বিনিময় দেওয়া-নেওয়া। অথচ নেক কাজের বিনিময় নেওয়া নাজায়েয। তাই এ কাজটা কিছুতেই জায়েয নয়। এরূপ কুরআন পড়ার কোনো সওয়াব হবে না। তো যদি খোদ তিলাওয়াতকারীই সওয়াব না পায় তাহলে মাইয়িত কী পাবে? -ইসলাহুর রুসূম পৃ. ১৪৬

তিনি অন্যত্র বলেন,
بعض لوگ کہتے ہیں کہ پھر ایصال ثواب کس طرح کریں؟ جواب یہ ہے جس طرح سلف صالحین کرتے تھے، بلا تقیید وتخصیص اپنی ہمت کے موافق حلال مال سے مساکین کی خفیہ مدد کریں، اور جو کچھ توفیق ہو بطور خودقرآن وغیرہ ختم کرکے اس کو پہنچادیں.

কতক মানুষ বলে, তাহলে আমরা ঈসালে সওয়াব কীভাবে করব? জবাব হল, যেভাবে সালাফে সালেহীন করতেন। বিশেষ দিনক্ষণ বা বিশেষ নিয়ম-নীতি নির্দিষ্ট না করে নিজ সামর্থ্য অনুসারে হালাল সম্পদ থেকে গোপনে গরীব-মিসকীনদের সাহায্য করুন এবং যতটুকু তাওফীক হয় কুরআন শরীফ ইত্যাদি খতম করে এর সওয়াব পৌঁছে দিন। -প্রাগুক্ত পৃ. ১৪৬

আরো দেখুন : শিফাউল আলীল ওয়া বাল্লুল গালীল ফী হুকমিল ওয়াসিয়্যাতি বিল খাতামাতি ওয়াত্তাহলীল (রাসায়েলে ইবনে আবেদীন) ১/১৫৩-১৯২; রাফিউল ইশকালাত আলা হুরমাতিল ইস্তিজার আলাত্তাআত, মুফতী ফয়যুল্লাহ রাহ. (মাজমূআয়ে রাসায়েলে ফয়যিয়্যা ৪র্থ খণ্ডের সাথে প্রকাশিত) (মাসিক আলকাউসার)

# আর বিনিময় না হয়ে হাদীয়া দেয়া হলে সেক্ষেত্রে কথা এই যে, হাদিয়ার একটি আদব হল, সব ধরনের বিনিময় ও উদ্দেশ্য থেকে মুক্ত হওয়া। তা হবে শুধু মহব্বত ও ইকরাম হিসেবে একমাত্র আল্লাহকে রাজি-খুশি করার জন্য। তবে কোরআন খতমের পর হাদিয়া প্রদান এর অর্থ এটা হয় না যে, হাদিয়াটি কোরআন খতমের বিনিময় হিসেবে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে কারো নিয়ত যদি বাস্তবেই এমন হয়ে থাকে তাহলে তা খুবই আপত্তিকর। কারণ, কোরআন খতমের কোনো বিনিময় হয় না। কোরআন পড়া খালেছ ইবাদত। তাই কোরআন খতমের বিনিময় হিসেবে কোনো কিছু নেওয়া যাবে না।

والله اعلم بالصواب

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি
উস্তাজুল ইফতা, জামিয়া ইমাম বুখারী, উত্তরা, ঢাকা।

মন্তব্য ()

কোনো মন্তব্য নেই।

এ সম্পর্কিত আরও জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

৮৮৭৩৭

মুদারাবার পদ্ধতি


১১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

খাগড়াছড়ি

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি

৮৮৫৩৫

মুসলিম বাংলা অ্যাপে আরবি তারিখ কেন দুইটি দেখায়?


১০ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

১৮২২

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি

৯০২১৪

রজব শব্দটি মুনসারিফ নাকি গায়রে মুনসারিফ?


২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

৮P৩C+GV৭

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী নাঈম সিদ্দীকী বিন আব্দুস সাত্তার

৯০২৩৩

তোমাদের সন্তানদের সন্ধ্যায় ঘরে আটকিয়ে রাখ এবং কিছু সময়ের পর ছেড়ে দিও এটা কোরান বা হাদীসের কোথাও কি আছে?


২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

ঢাকা

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী নাঈম সিদ্দীকী বিন আব্দুস সাত্তার

Logoমুসলিম বাংলা
play storeapp store
TopOfStack Software © 2025 All rights reserved. Privacy Policy