নসখের সংজ্ঞা ও মানসূখ আয়াতের সংখ্যা
প্রশ্নঃ ৩৮৮৭৯. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, অনেকে বলে থাকেন, কুরআনে নাসেখ - মানসুখ আয়াত সংখ্যা ৫,১৯,২০০,৫০০ ইত্যাদি। আবার অনেকে বলেন, কুরআনে কোনো নাসেখ - মানসুখ নেই। আমি জানতে চাচ্ছি সহিহ মতের আলোকে কুরআনে কি নাসেখ - মানসুখ করা হয়েছে এবং হলে কয়টি করা হয়েছে???,
২৯ আগস্ট, ২০২৩
ঢাকা
উত্তর
و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
জ্বী, কুরআনে নসখ মানসূখ হয়েছে এবং মানসূখ আয়াত সংখ্যা নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। আল্লামা সুয়ুতী মাত্র উনিশ -বিশটি আয়াতকে মনসূখ প্রতিপন্ন করেছেন। তারপর হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ (র) এগুলোর মধ্যেও সামঞ্জস্য বর্ণনা করে মাত্র পাঁচটি আয়াতকে মনসূখ বলেছেন।
মুহতারাম, নসখের সংজ্ঞা ও মানসূখ আয়াতের সংখ্যা বিষয়ে জানতে নিম্নোক্ত আয়াত তাফসীরসহ অধ্যয়ন করুন।
সূরা বাকারা ( আয়াত নং - ১০৬ )
مَا نَنۡسَخۡ مِنۡ اٰیَۃٍ اَوۡ نُنۡسِہَا نَاۡتِ بِخَیۡرٍ مِّنۡہَاۤ اَوۡ مِثۡلِہَا ؕ اَلَمۡ تَعۡلَمۡ اَنَّ اللّٰہَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ
অর্থঃ
আমি যখনই কোনও আয়াত মানসূখ (রহিত) করি বা তা ভুলিয়ে দেই, তখন তার চেয়ে উত্তম বা সে রকম (আয়াত) আনয়ন* করি। তোমরা কি জান না, আল্লাহ সকল বিষয়ে ক্ষমতা রাখেন?
তাফসীরে মুফতি তাকি উসমানীঃ
৭৭. এটা আল্লাহ তাআলার শাশ্বত রীতি যে, তিনি প্রত্যেক যুগে সেই যুগের পরিস্থিতি অনুসারে শাখাগত বিধানাবলীতে রদ-বদল করে থাকেন। যদিও তাওহীদ, রিসালাত, আখিরাত ইত্যাদি দীনের মৌলিক আকীদাসমূহ সকল যুগে একই রকম থেকেছে, কিন্তু বাস্তব আমল ও কর্মগত যে সকল বিধান হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে দেওয়া হয়েছিল, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের সময়ে তার কতককে পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছে। হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আমলে তার মধ্যে আরও বেশি রদ-বদল করা হয়েছে। এমনিভাবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রথমে যখন নবুওয়াত দান করা হয়, তখন তাঁর দাওয়াতী কার্যক্রমের সামনে অনেকগুলো ধাপ ছিল, যা অতিক্রম করা ছাড়া সামনে অগ্রসর হওয়া সম্ভব ছিল না। সেই সঙ্গে মুসলিমদের সম্মুখেও নানা রকমের সঙ্কট বিদ্যমান ছিল। তাই আল্লাহ তাআলা বিধি-বিধান দানের ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমিক পন্থা অবলম্বন করেন। কখনও কোনও ক্ষেত্রে একটি বিধান দিয়েছেন। পরে আবার সেখানে অন্য বিধান এসে গেছে, যেমন কিবলার বিধানের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। সামনে ১১৫নং আয়াতে এর কিছুটা বিবরণ আসবে। শাখাগত বিধানাবলীতে এ জাতীয় তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তনকে পরিভাষায় ‘নাসখ’ বলা হয় (যে বিধানকে পরিবর্তন করা হয় তাকে ‘মানসূখ’ এবং পরিবর্তে যা দেওয়া হয় তাকে ‘নাসিখ’ বলা হয়)। কাফিরগণ, বিশেষত ইয়াহুদীরা প্রশ্ন তুলেছিল যে, সকল বিধানই যখন আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে তখন তার মধ্যে এসব রদ-বদল কেন? এ আয়াত তাদের সে প্রশ্নের উত্তরে নাযিল হয়েছে। উত্তরের সারমর্ম এই যে, আল্লাহ তাআলা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে স্বীয় হিকমত ও প্রজ্ঞা অনুযায়ী এসব রদ-বদল করে থাকেন। আর যে বিধানই মানসূখ বা রহিত করা হয় তদস্থলে এমন বিধান দেওয়া হয়, যা পরিবর্তিত পরিস্থিতির পক্ষে বেশি উপযোগী ও অধিকতর ভালো। অন্ততপক্ষে তা পূর্ববর্তী বিধানের সমান ভালো তো অবশ্যই হয়।
আরো বিস্তারিত দেখুন তাফসীরে মারেফুল কুরআন থেকেঃ
106---107 নাম্বার আয়াতের জ্ঞাতব্য
مَا نَنْسَخْ مِنْ آيَةٍ أَوْ نُنْسِهَا
-এই আয়াতে কোরআনী আয়াত রহিত হওয়ার সম্ভাব্য সকল প্রকারই সন্নিবেশিত রয়েছে। অভিধানে ’নসখ’ শব্দের অর্থ দূর করা, লেখা। সমস্ত মুসলিম টীকাকার এ বিষয়ে একমত যে, আয়াতে ’নসখ’ শব্দ দ্বারা বিধি-বিধান দূর করা অর্থাৎ রহিত করা বোঝানো হয়েছে। এ কারণেই হাদীস ও কোরআনের পরিভাষায় এক বিধানের স্কুলে অন্য বিধান প্রবর্তন করাকে ’নসখ’ বলা হয়। অন্য বিধানটি’ কোন বিধানের বিলুপ্ত ঘোষণাও হতে পারে, আবার এক বিধানের পরিবর্তে অপর বিধান বলে দেওয়াও হতে পারে।
আল্লাহর বিধানে নখের স্বরূপঃ জগতের রাষ্ট্র ও আইন-আদালতে এক নির্দেশকে রহিত করে অন্য নির্দেশ জারি করার ব্যাপারটি সর্বজনবিদিত। রচিত আইনে ’নসখ’ বিভিন্ন কারণে হয়ে থাকে। (১) ভুল ধারণার উপর নির্ভর করে প্রথমে যদি কোন আইন প্রবর্তন করা হয়, তবে পরে বিষয়টির প্রকৃত স্বরূপ উদঘটিত হলে পূর্বেকার আইন পরিবর্তন করা হয়। (২) ভবিষ্যৎ অবস্থার গতি-প্রকৃতি জানা না থাকার কারণে কোন কোন সাময়িক আইন জারি করা হয়। পরে অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে সে আইনও পরিবর্তন করা হয়। কিন্তু এ ধরনের নসখ আল্লাহর আইন হতে পারে বলে ধারণা করা যায় না।
তৃতীয় প্রকার ’নসখ’ এরূপঃ আইন-রচয়িতা আগেই জানে যে, অবস্থার পরিবর্তন হবে এবং তখন এই আইন আর উপযোগী থাকবে না; অন্য আইন জারি করতে হবে। এরূপ জানার পর সাময়িকভাবে এই আইন জারি করে দেন, পরে পূর্বজ্ঞান অনুযায়ী যখন অবস্থার পরিবর্তন ঘটে, তখন পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী আইনও পরিবর্তন করেন। উদাহরণত রোগীর বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্র দেন। তিনি জানেন যে, এই ওষুধ দু’দিন সেবন করার পর রোগীর অবস্থার পরিবর্তন হবে এবং তখন অন্য ব্যবস্থাপত্র দিতে হবে। অবস্থার এহেন পরিবর্তন জানার ফলেই চিকিৎসক প্রথম দিন এক ওষুধ এবং পরে অন্য ওষুধ দেন।
অভিজ্ঞ চিকিৎসক প্রথম দিনেই পরিবর্তনসহ চিকিৎসার পূর্ণ প্রোগ্রাম কাগজে লিখে দিতে পারে যে, দু’দিন এই ওষুধ, তিন দিন অন্য ওষুধ এবং এক সপ্তাহ পর অমুক ওষুধ সেব্য। কিন্তু এরূপ করা হলে রোগীর পক্ষে জটিলতার সম্মুখীন হওয়ার আশংকা থাকে এবং এতেও ভুল বোঝাবুঝির কারণে ত্রুটিরও আশংকা থাকে। তাই ডাক্তার প্রথম দিনেই পূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করেন না।
আল্লাহর আইনে এবং আসমানী গ্রন্থসমূহে শুধু তৃতীয় প্রকার নসখই হতে পারে এবং হয়ে থাকে । প্রতিটি নবুয়ত ও প্রতিটি আসমানী গ্রন্থ পূর্ববর্তী নবুয়ত ও আসমানী গ্রন্থের বিধান নসখ তথা রহিত করে নতুন বিধান জারি করেছে। এমনিভাবে একই নবুয়ত ও শরীয়তে এমন রয়েছে যে, এক বিধান কিছু দিন প্রচলিত থাকার পর খোদায়ী হেকমত অনুযায়ী সেটি পরিবর্তন করে তদস্থলে অন্য বিধান প্রবর্তন করা হয়েছে। সহীহ্ মুসলিমের হাদীসে আছেঃ
لَمْ تَكُنْ نُبُوَّةٌ قَطُّ إِلَّا تَنَاسَخَتْ
অর্থাৎ এমন নবুয়ত কখনও ছিল না, যাতে নখ ও পরিবর্তন করা হয়নি।—(কুরতুবী)
মূর্খজনোচিত আপত্তিঃ কিছুসংখ্যক মূর্খ ইহুদী অজ্ঞতাবশত খোদায়ী বিধানে নসখকে সঠিক অর্থে বুঝতে পারেনি। তারা খোদায়ী নসখকে জাগতিক আইনের প্রথম ও দ্বিতীয় প্রকার নসখের অনুরূপ ধরে নিয়ে নবী করীম (সা)-এর প্রতি ভর্ৎসনার বাণ নিক্ষেপ করতে থাকে। এর উত্তরেই আলোচ্য আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছে। (ইবনে কাসীর)
মুসলমানদের মধ্যে মু’তাযিলা সম্প্রদায়ের কিছুসংখ্যক আলেম সম্ভবত উপরোক্ত বিরোধীদের ভর্ৎসনা থেকে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যেই বলেছেন যে, খোদায়ী বিধানে নসখের সম্ভাবনা অবশ্যই আছে- এতে কোন প্রতিবন্ধকতা নেই, কিন্তু সমগ্র কোরআনে বাস্তবে কোন নসখ হয়নি। কোন আয়াত নাসেখও নয়, মনসূখও নয়। আবু মুসলিম ইস্পাহানীকে এই মতবাদের প্রবক্তা বলা হয় । আলেম সম্প্রদায় যুগে যুগে তাঁর মতবাদ খণ্ডন করেছেন। তফসীরে রূহুল-মা’আনীতে বলা হয়েছেঃ
واتفقت أهل الشرائع على جواز النسخ ووقوعه و خالفت اليهود غير العيسوية في جوازه وقـالـوا يمتنع عقلا وابو مسلم الأصفهاني في وقوعه فقال أنه وإن جاز عقلا لكنه لم يقع
(নসখের সম্ভাব্যতা ও বাস্তবতা সম্পর্কে সকল ধর্মাবলম্বীই একমত। তবে খৃস্টান সম্প্রদায় বর্তীত সকল ইহুদী এর সম্ভাব্যতাকে অস্বীকার করেছে। আবূ মুসলিম ইস্পাহানী এর বাস্তবতা অস্বীকার করে বলেছেন যে, খোদায়ী বিধানে নখ সম্ভব; কিন্তু বাস্তবে কোথাও নখ হয়নি) ইমাম কুরতুবী স্বীয় তফসীরে বলেনঃ
مَعْرِفَةُ هَذَا الْبَابِ أَكِيدَةٌ وَفَائِدَتُهُ عَظِيمَةٌ، لَا يَسْتَغْنِي عَنْ مَعْرِفَتِهِ الْعُلَمَاءُ، وَلَا يُنْكِرُهُ إِلَّا الْجَهَلَةُ الْأَغْبِيَاءُ
(নসখ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা খুবই জরুরী এবং এর উপকারিতা অনেক। আলিমগণ একে উপেক্ষা করতে পারেন না। একমাত্র মূর্খ ও নির্বোধ ছাড়া কেউ নস্থ অস্বীকার করতে পারে না।)
কুরতুবী এ প্রসঙ্গে হযরত আলী (রা)-এর একটি ঘটনা উদ্ধৃত করেছেন। একবার তিনি মসজিদে এসে এক ব্যক্তিকে ওয়াজে রত দেখতে পেলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, লোকটি কি করছে ? উত্তর হলো, সে ওয়াজ-নসীহত করছে। হযরত আলী (রা) বললেন- না, সে ওয়াজ করছে না, বরং সে বলতে চায় যে, আমি অমুকের পুত্র অমুক। আমাকে চিনে নাও। অতঃপর লোকটিকে ডেকে তিনি বললেন, তুমি কি কোরআন ও হাদীসের নাসেখ ও মনসূখ বিধানসমূহ জান ? লোকটি বলল, না আমার জানা নেই। হযরত আলী (রা) বললেন, তাহলে আমাদের মসজিদ থেকে বেরিয়ে যাও। ভবিষ্যতে এখানে আর ওয়াজ করো না।
কোরআন ও হাদীসে নসখের অস্তিত্ব ও বাস্তবতা সম্পর্কে সাহাবী ও তাবেয়ীগণের উক্তি এত বেশি যে, সেগুলো উদ্ধৃত করা সহজ নয়। তফসীরে ইবনে কাসীর, ইবনে জরীর, দুররে-মনসূর প্রভৃতি গ্রন্থে এ ব্যাপারে বিশুদ্ধ সনদ সহকারে বহু রেওয়ায়েত বর্ণিত রয়েছে দুর্বল রেওয়ায়েতের তো গণনাই নেই।
এ কারণেই প্রশ্নটি ইজমায়ী তথা সর্বসম্মত। শুধু আবূ মুসলিম ইস্পাহানী ও কতিপয় মু’তাযিলী এ প্রসঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন। তফসীরে-কবীর গ্রন্থে ইমাম রাযী পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তাদের মতামত খণ্ডন করেছেন।
নখের অর্থে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী পরিভাষায় পার্থক্যঃ নসখের পারিভাষিক অর্থ বিধান পরিবর্তন করা। এ পরিবর্তন একটি বিধানকে সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করে তদস্থলে অন্য বিধান রাখার মাধ্যমেও হতে পারে। যেমন বায়তুল মুকাদ্দাসের পরিবর্তে কা’বা শরীফকে কেবলা বানিয়ে দেওয়া। এমনিভাবে কোন শর্তহীন ও ব্যাপক বিধানে কোন শর্ত যুক্ত করে দেওয়াও এক প্রকার পরিবর্তন। পূর্ববর্তী আলেম সম্প্রদায় নসখকে এই ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। তাঁদের মতে কোন বিধানের সম্পূর্ণ পরিবর্তন, আংশিক পরিবর্তন, শর্ত যুক্তকরণ অথবা ব্যতিক্রম বর্ণনা ইত্যাদি সবই নসখের অন্তর্ভুক্ত। এ কারণেই তাঁদের মতে কোরআনে মনসূখ আয়াতের সংখ্যা পাঁচশ যেখানে পরিবর্তনের পূর্বের বিধান ও পরের বিধানের মধ্যে সামঞ্জস্য বর্ণনা করা কিছুতেই সম্ভব হয় না, পরবর্তী আলেমগণ শুধু সেখানেই নসখ হয়েছে বলে মত প্রকাশ করেন। এই অভিমত মেনে নিলে স্বভাবতই মনসূখ আয়াতের সংখ্যা বিপুল হারে হ্রাস পাবে। এরই অনিবার্য পরিণতিস্বরূপ আলেমদের বর্ণিত পাঁচ শ মনসূখ আয়াতের স্থলে পরবর্তী আলেম আল্লামা সুয়ুতী মাত্র বিশটি আয়াতকে মনসূখ প্রতিপন্ন করেছেন। তারপর হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ (র) এগুলোর মধ্যেও সামঞ্জস্য বর্ণনা করে মাত্র পাঁচটি আয়াতকে মনসূখ বলেছেন। এ প্রচেষ্টা এদিক দিয়ে সঙ্গত যে, পরিবর্তন না হওয়াই বিধানের পক্ষে স্বাভাবিক। কাজেই যেখানে আয়াতকে কার্যকরী রাখার পক্ষে কোন ব্যাখ্যা সম্ভব হয়, সেখানে বিনা প্রয়োজনে নসখ স্বীকার করা ঠিক নয়।
কিন্তু এই সংখ্যা হ্রাসের অর্থ এই নয় যে, নসখের ব্যাপারটি ইসলাম অথবা কোরআনের মধ্যে একটা ত্রুটিপূর্ণ বিষয় হিসাবে বিদ্যমান ছিল- যা মোচনের চেষ্টা চৌদ্দ শ’ বছর যাবত চলছে। অবশেষে শাহ্ ওয়ালীউল্লাহর প্রচেষ্টায় সে দোষ হ্রাস পেতে পেতে পাঁচ-এ এসে দাঁড়িয়েছে। এরপরও কোন আধুনিক চিন্তাবিদের অপেক্ষা করা হচ্ছে-যিনি এসে এই পঁচটিকেও বিলুপ্ত করে একেবারে শূন্যের কোটায় পৌঁছে দেবেন।
নসখ প্রশ্নের গবেষণায় এই পথ অবলম্বন করা ইসলাম ও কোরআনের সঠিক খেদমত নয় । এই পথ অবলম্বন করে সাহাবী, তাবেয়ী তথা চৌদ্দশ’ বছরের (পূর্ববর্তী ও পরবর্তী) আলেমগণের রচনা ও গবেষণাকে ধুয়েমুছে ফেলা সম্ভব নয়। এতে করে বিরোধীদের সমালোচনা বন্ধ হবে না। লাভের মধ্যে শুধু আধুনিক যুগের ধর্মদ্রোহীদের হাতে একটি অস্ত্র তুলে দেওয়া হবে। তারা একথা বলার সুযোগ পাবে যে, চৌদ্দ শ’ বছর যাবত আলেমরা যা বলছেন, পরিশেষে তা মিথ্যা প্রমাণিত হতে পারে –(মা’আযাল্লাহ্)। এ পথ উন্মুক্ত হয়ে গেলে কোরআন ও শরীয়তের উপর থেকে আস্থা উঠে যাবে। কারণ আজকের গবেষণা যে আগামীকাল ভ্রান্ত প্রমাণিত হবে না, এরই বা নিশ্চয়তা কোথায় ?
আমি বর্তমান যুগের কোন কোন আলেমের লেখা পাঠ করেছি। তারা مَا نَنْسَخْ আয়াতটিকে متضمن معنى شرط হওয়ার কারণে قضيه فرضيه সাব্যস্ত করেছেন । যেমন, لَوْ كَانَ فِيهِمَا آلِهَةٌ এবং لَوْ كَانَ لِلرَّحْمَنِ وَلَدٌ অতঃপর আয়াত দ্বারা তারা শুধু নসখের সম্ভাবনা প্রমাণিত করার প্রয়াস পেয়েছেন এবং নসখের বাস্তবতাকে অস্বীকার করেছেন। অথচ متضمن معنى شرط এবং قضيه شرطيه بخرف لو এতদুভয়ের মধ্যে পার্থক্য অনেক। বলা বাহুল্য, এটা আবূ মুসলিম ইস্পাহানী এবং মু’তাযিলা সম্প্রদায়েরই যুক্তি।
অথচ সাহাবী ও তাবেয়ীগণের তফসীর এবং সমগ্র মুসলিম সমাজের অনুবাদ দেখার পর উপরোক্ত ব্যাখ্যা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সাহাবায়ে কেরাম উপরোক্ত আয়াত দ্বারা নসখের বাস্তবতা প্রমাণ করে এ সম্পর্কিত একাধিক ঘটনা উল্লেখ করেছেন। (ইবনে কাসীর, ইবনে জরীর প্রভৃতি)
এ কারণেই পূর্ববর্তী মুসলিম মনীষিগণের মধ্যে কেউ নসখের বাস্তবতাকে শর্তহীনভাবে অস্বীকার করেন নি। স্বয়ং হযরত শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ্ (র) সামঞ্জস্য বর্ণনা করে সংখ্যা হ্রাস করেছেন বটে ; কিন্তু নসখের বাস্তবতাকে শর্তহীনভাবে অস্বীকার করেন নি। তাঁর পরবর্তী যমানায়ও দেওবন্দের প্রখ্যাত আলেমগণের সবাই একবাক্যে নসখের বাস্তবতা স্বীকার করেছেন। তাঁদের কারও কারও সম্পূর্ণ অথবা আংশিক তফসীরও বিদ্যমান রয়েছে الله سبحانه وتعالى أعلم
أَوْ نُنْسِهَا
প্রসিদ্ধ কেরাআত অনুযায়ী এর উৎপত্তি اِنْسَاءٌ ও نِسْيَانٌ ধাতু থেকে । উদ্দেশ্য এই যে, কখনও রসূলুল্লাহ (সা) ও সমস্ত সাহাবীর মন থেকে সম্পূর্ণ বিস্মৃত করিয়ে নসখ করা হয়। এর সমর্থনে টীকাকারগণ একাধিক ঘটনা উল্লেখ করেছেন। ভবিষ্যতে যাতে আয়াতটির উপর আমল করা না হয়, সে উদ্দেশ্যেই এরূপ বিস্মৃত করিয়ে দেওয়া হয়েছে। নসখের অবশিষ্ট বিধান উসূলে ফেকাহ্ গ্রন্থসমূহে দেখা যেতে পারে।
https://muslimbangla.com/sura/2/tafsir/106
নসখের ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী উলামায়ে কিরামের পরিভাষাগত পার্থক্যঃ
'নসখ' শব্দটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী উলামায়ে কিরামের মাঝে পরিভাষাগত কিছু পার্থক্য রয়েছে। এগুলো জেনে রাখা উচিত।
পূর্ববর্তী উলামায়ে কিরামের পরিভাষায় 'নসখ' ছিল সুপ্রশস্ত অর্থবহনকারী একটি শব্দ। এতে এমন কতগুলো বিষয়ও ছিল, পরবর্তী উলামায়ে কিরাম যেগুলোকে "নসখ" বলে অভিহিত করেন না। যেমন, পূর্ববর্তীদের নিকট ব্যাপকের বিশেষত্ব এবং সাধারণের নির্ধারণও নসখের অর্থের মাঝে শামিল ছিল। যদি কোন এক আয়াতে ব্যাপকত্ব শব্দের প্রয়োগ থাকে আর অন্য আয়াতে এটাকে বিশেষ কোন প্রক্রিয়ায় বিশেষত্ব দান করা হয়, তাহলে পূর্ববর্তী উলামায়ে কিরাম প্রথমটিকে মানসূখ এবং দ্বিতীয়টিকে নাসিখ হিসাবে আখ্যায়িত করতেন। এর উদ্দেশ্য এটা ছিল না যে, প্রথম হুকুমটি সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। বরং উদ্দেশ্য এটা ছিল যে, প্রথম আয়াতের ব্যাপকত্বকে দ্বিতীয় আয়াত দ্বারা বিলুপ্ত করা হয়েছে । যেমন, কুরআনে কারীমের ইরশাদ হয়েছে :
لا تنكِحُوا الْمُشْرِكَاتِ حَتَّى يُؤْمِنَّ.
“মুশরিক নারীকে বিবাহ করো না, যতক্ষণ না সে ঈমান গ্রহণ করে।” এ আয়াতে 'মুশরিক নারী' একটি ব্যাপক শব্দ। বাহ্যিক দৃষ্টিতে এর দ্বারা বুঝে আসে যে, যেকোন মুশরিক নারীকেই বিবাহ করা হারাম। চাই সে মূর্তি পূজারী হোক, কিংবা আহলে কিতাব হোক। কিন্তু অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে
والْمُحْصَتُ مِنَ الَّذِينَ أوتُوا الْكِتَابِ .
“নির্ভেজাল সতী-সাধ্বী আহলে কিতাব নারীগন তোমাদের জন্য হালাল "
এর দ্বারা জানা যায়, প্রথম আয়াতে ব্যবহৃত মুশরিক নারী' শব্দটি দ্বারা ঐসব মুশরিক নারীদের বুঝানো হয়েছিল, যারা আহলে কিতাব নয়। সুতরাং দ্বিতীয় আয়াতটি প্রথম আয়াতের ব্যাপকত্বের মাঝে বিশেষত্ব সৃষ্টি করেছে এবং বাতলে দিয়েছে যে, এ শব্দ দ্বারা বিশেষ ধরনের মুশরিক নারীকে বুঝানো হয়েছে। পূর্ববর্তী উলামায়ে কিরামগণ এটাকেও নসখ বলতেন, প্রথম আয়াতকে মানসূখ এবং দ্বিতীয় আয়াতকে নাসিখ হিসাবে আখ্যায়িত করতেন।
পক্ষান্তরে পরবর্তী উলামায়ে কিরামের নিকট নসখের অর্থ এত ব্যাপক নয়। এতে শুধু ঐ ক্ষেত্রে নসখ সাব্যস্ত করা হয়, যার মাঝে প্রথম হুকুমকে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়েছে। শুধু ব্যাপকত্বের বিশেষত্ব ও সাধারণের নির্ধারণ সৃষ্টি হওয়াকেই নসখ বলা হয় না। উপরোল্লেখিত উদাহরণে পরবর্তী উলামায়ে কিরাম বলেনঃ এতে নসখ হয়নি। কেননা, বিধি মোতাবেক মূল হুকুম (মুশরিক নারীকে বিবাহ করা) এখনো বাকী আছে । পার্থক্য শুধু এতটুকু হলঃ দ্বিতীয় আয়াত দ্বারা এ কথা প্রতিভাত হল যে, প্রথম আয়াতের তার এত ব্যাপক ছিল না যে, এর মাঝে আহলে কিতাব নারীও শামিল আছে বরং সেটা আহলে কিতাব ছাড়া অন্যান্যদের সাথেও বিশেষিত ছিল।
পরিভাষায় এ পার্থক্যের কারণে পূর্ববর্তী উলামায়ে কিরামের নিকট কুরআনে কারীমের মানসুখ আয়াতের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। সাধারণ একটি পার্থক্যের কারণে তারা এক আয়াতকে মানসূখ আর অন্য আয়াতকে নাসিখ আখ্যায়িত করতেন। কিন্তু পরবর্তী উলামায়ে কিরামের পরিভাষা অনুযায়ী মানসুখ আয়াতের সংখ্যা খুবই কম।
কুরআনে কারীমে নসখের আলোচনা
এ ব্যাপারে উম্মতের মাঝে কোন মতানৈক্য আছে বলে আমাদের জানা নেই যে, পূর্ববর্তী উম্মতের সময় থেকে শরয়ী আহকামের মাঝে নসখের ধারাবাহিকতা চলে আসছে এবং উম্মতে মুহাম্মদিয়ার মাঝে অনেক হুকুম মানসূখ হয়েছে। যেমন, প্রথমত এ নির্দেশ ছিল যে, বাইতুল মোকাদ্দাসের দিকে মুখ করে নামায পড়তে হবে। পরবর্তীতে এ নির্দেশ মানসূখ করে কা'বা শরীফের দিকে মুখ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে মুসলমানদের মাঝে কোন মতবিরোধ নেই।
কিন্তু কুরআনে কারীমে নসখ হয়েছে কি-না এ ক্ষেত্রে কিছু মতপার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। অন্য শব্দে এ মাসআলাটির আলোচনা এভাবে করা হয়েছে যে, কুরআনে কারীমে এমন কোন আয়াত বিদ্যমান আছে, যার হুকুম মানসুখ হয়ে গেছে, আর তিলাওয়াত এখনও বাকী আছে? সমস্ত আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের রায় হচ্ছে- কুরআনে কারীমে এমন আয়াত বিদ্যমান আছে, যার হুকুম মানসূখ হয়ে গেছে। কিন্তু মু'তাযিলা সম্প্রদায়ের অন্যতম ইমাম আবূ মুসলিম ইস্পাহানীর বক্তব্য হচ্ছেঃ কুরআনে কারীমের কোন আয়াত মানসূখ হয়নি। বরং কখনো সমস্ত আয়াতের উপর আমল করা ওয়াজিব। আবূ মুসলিম ইস্পাহানীর অনুসরণ করে অন্যান্য ব্যক্তিবর্গও এ রায় প্রকাশ করেছেন। আমাদের যুগের অনেক সংস্কারপ্রিয় ব্যক্তিবর্গ এ রায়েরই প্রবক্তা।
এ সমস্ত ব্যক্তিবর্গ নসখ বিশিষ্ট আয়াতে এমন ব্যাখ্যা করেন, যাতে নসখ স্বীকার করতে না হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে এগুলো দুর্বল এবং এগুলো গ্রহণ করার পর কোন কোন আয়াতের তাফসীরের ক্ষেত্রে এমন টানাটানির প্রয়োজন পড়ে, যা তাফসীরের মূলনীতির পরিপন্থী।
কুরআনে কারীমে নসখের অস্তিত্বকে যারা স্বীকার করে না, প্রকৃতপক্ষে তাদের অন্তরে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, নসখ একটি দোষের বিষয়, যা থেকে কুরআনে কারীম মুক্ত হওয়া উচিত। অথচ ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি যে, নসখকে দোষ হিসাবে ধারণা করা কত বড় দুর্বল চিন্তার পরিচায়ক। তারপর আশ্চর্যের ব্যাপার হল, আবূ মুসলিম ইস্পাহানী ও তার অনুসারীরা সাধারণত ইহুদী নাসারাদের মত অস্বীকার করে না যে, আল্লাহ্ তা'আলার অনেক আহকামের মাঝে নসখ হয়েছে। বরং তারা শুধু এটাই বলে যে, কুরআনে কারীমে নসখ নেই। নসখ যদি দোষের বিষয়ই হয়ে থাকে, তাহলে কুরআন বহির্ভূত আহকামের ক্ষেত্রে কিভাবে এ দোষের সৃষ্টি হল? যখন এটাও আল্লাহরই আহকাম এবং তাতে কোন দোষের বিষয় না হয় তাহলে যেটা কুরআন বহির্ভূত আহকামে দোষ ছিল না, সেটাকে কুরআনী আহকামের ক্ষেত্রে কিভাবে দোষ হিসাবে সাব্যস্ত করা যায়? বলা হয়, এটা হিকমতে ইলাহীর বিপরীত মনে হয় যে, কুরআনে কারীমে কোন আয়াত শুধু বরকতের উদ্দেশ্যে তিলাওয়াতের জন্য বাকী রাখা হয়েছে আর এর আমলের ধারাবাহিকতা বিলুপ্ত করা হয়েছে।
কিন্তু এ বিষয়কে হিকমতে ইলাহীর বিপরীত কেন সাব্যস্ত করা হল? অথচ 'হুকুম মানসূখ ও তিলাওয়াত বাকী' বিশিষ্ট আয়াতের মাঝে অনেক কল্যাণও রয়েছে। যেমন, এর দ্বারা শরয়ী আহকামের মাঝে পর্যায়ক্রমিক অবতীর্ণ হওয়ার রহস্য উদঘাটিত হয় এবং আল্লাহ তা'আলা মানুষকে স্বীয় আহকামের অনুসারী করার ক্ষেত্রে যে প্রজ্ঞাপূর্ণ পদ্ধতি অবলম্বন করেন, তা জানা যায়। এর দ্বারা শরয়ী আহকামের ইতিহাস সম্পর্কেও অবগত হওয়া যায় এবং একথা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, মুসলমানদের উপর কখন কি হুকুম জারি করা হয়েছিল? স্বয়ং আল্লাহ তা'আলা কুরআনে কারীমের মাঝে অনেক স্থানে পূর্ববর্তী উম্মতদের ঐ সমস্ত আহকাম উল্লেখ করেছেন, যা উম্মতে মুহাম্মদিয়ার মাঝেও মানসূখ করা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছেঃ
وعلى الذين هادوا حرمنا كُلَّ ذِي ظُفر وَمِنَ الْبَقَرِ وَالْغنمِ حَرَّمْنَا عَلَيْهِمْ شحومهما الا ما حَمَلَت ظهورهما أو الْحَوَايَا أَوْ مَا اخْتَلَطَ بِعَظم - (أنعام (١٤٦).
"ইহুদিদের জন্য আমি প্রত্যেক নখবিশিষ্ট জন্তু হারাম করেছিলাম এবং ছাগল ও গরু থেকে এতদুভয়ের চর্বি আমি তাদের জন্যে হারাম করেছিলাম, কিন্তু ঐ চর্বি যা পৃষ্ঠে কিংবা অন্ত্রে সংযুক্ত থাকে অথবা অস্থির সাথে মিলিত থাকে।"
প্রকাশ্য যে, দৃষ্টান্ত ও উপদেশ অর্জনের নিমিত্ত আল্লাহ্ তা'আলা এখানে একটি মানসূখ হুকুমের উল্লেখ করেছেন। যদি কুরআনে কারীমে কোন রহিত হুকুমের আয়াতের তিলওয়াত এ উদ্দেশ্যে বাকী রাখা হয়, তাহলে এখানে হেকমতে ইলাহীর বিপরীত কোন বিষয়টা আছে? অতঃপর কোন ব্যক্তি এ দাবী করতে পারে যে, সে আল্লাহর সমস্ত হিকমত সম্পর্কে অবগত আছে? কিংবা সে কি কুরআনে কারীমের প্রত্যেক আয়াতের ব্যাপারে জানে যে, তা অবতীর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে কি কি হিকমত ছিল? যদি কোন ব্যক্তির এ দাৰী সঠিক না হয়, আর বাস্তবেও তা সঠিক হবার নয়, তাহলে আবার আল্লাহ্ তা'আলার কোন কাজের দ্বারা শুধু এ ভিত্তিতে কিভাবে অস্বীকার করতে পারে যে, এ হিকমত আমাদের জানা নেই। অর্থাৎ তাঁর কাজের বাস্তবায়ন শরয়ী দলীল দ্বারা সাব্যস্ত হয়।
সুতরাং মূল ঘটনা হচ্ছে : যারা কুরআনে কারীমে নসখের অস্তিত্বকে স্বীকার করে না, তাদের বুনিয়াদী বিষয়ই ভ্রান্ত, যার উপর তাদের চিন্তাধারার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তারা কুরআনে কারীমের কোন কোন আয়াতকে দূরবর্তী অর্থ দ্বারা এজন্য সুসজ্জিত করেছেন যে, তাদের দৃষ্টিতে 'নসখ' একটি দোষ। কুরআনে কারীমকে 'নসখ' মুক্ত দেখা ও দেখানোই ছিল তাদের অভিপ্রায়। যদি তাদের নিকট এ কথা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, "নসখ" কোন দোষের বিষয় নয়, বরং হিকমতে ইলাহীর চাহিদা। তাহলে তারা এ ধরনের আয়াতের তাফসীর তাই করবে, যা সাধারণভাবে করা হয়। কেননা, এর প্রকাশ্য ও সচরাচর তাফসীর এটাই। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে :
ما ننسَخ مِنْ أَيَّةٍ أَوْ ننسهَا نأْتِ بِخَيْرِ مِنْهَا أَوْ مِثْلَها - أَلَمْ تَعْلَمُ أَنَّ اللهَ عَلَى كل شَيءٍ قدير.
"যে আয়াতকে আমি মানসুখ করে দেই কিংবা ভুলিয়ে দেই, এর চেয়ে উত্তম কিংবা তার সমমানের আয়াত অবতীর্ণ করি। তোমরা কি জান না যে, আল্লাহ্ তা'আলা সর্ববিষয়ে শক্তিমান।"
যে বাকি কোন পক্ষপাতিত্ব না করে মুক্ত মস্তিষ্কে এ আয়াতকে পড়বে, সে অবশ্যই তা থেকে এ ফলাফল বের করবে যে, কুরআনে কারীমের আয়াতের মাঝে নসখের ধারাবাহিকতা খোদ কুরআনের বর্ণনানুযায়ীই বুঝা যায়। কিন্তু আবু মুসলিম ইস্পাহানী ও তার অনুসারীরা জেনে অথবা না জেনে যে নসখকে দোষ মনে করে কুরআনের বহির্ভূত বলে সাব্যস্ত করে, উল্লেখিত আয়াতের ক্ষেত্রে তারা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ দুটি ব্যাখ্যা করে থাকেন।যেমন তারা বলে থাকেন যে, এ আঘাতে একটি কাল্পনিক বিষয়ের বর্ণনা করা হয়েছে। সারকথা হলো, কাল্পনিকভাবে যদি আমি কোন আয়াতকে মানসূখ করি, তাহলে এর চেয়ে উত্তম কিংবা সমমানের আয়াত নাযিল করি। এর দ্বারা বাস্তবিকই কোন আয়াতকে মানসুখ করা আবশ্যক হয় না। এর উপমা যেমন ইরশাদ হচ্ছে :
إِنْ كَانَ لِلرَّحْمَنِ وَلَدٌ فَأَنَا أَوَّلَ الْعَابدين. سورة الزخرف - (۸)
"যদি রহমানের কোন সন্তান থাকে, তাহলে আমিই হব সে সন্তানের প্রথম পূজারী"।
নসখ অস্বীকারকারীগণ বলেন, যেমনিভাবে এ আয়াতে একটি কাল্পনিক মেনে নেয়া হয়েছে এবং এর দ্বারা আবশ্যক নয় যে, বাস্তবে আল্লাহ্ তা'আলার কোন সন্তান আছে। এমনিভাবে পূর্বোক্ত আয়াতেও একটি কাল্পনিক দিক উল্লেখ করা হয়েছে। যা বাস্তবায়িত হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই।
কিন্তু উল্লেখিত আয়াতের এ বিশ্লেষণটি একটি মনগড়া ব্যাখ্যা বৈ আর কি? কেননা, কুরআনে কারীমের আয়াতে কখনো যদি নসখ না-ই হত, তাহলে কাল্পনিকভাবে উল্লেখ করা আল্লাহ তা'আলার কি প্রয়োজন ছিল? কুরআনে কারীমের শান কখনো এ রকম হতে পারে না যে, যা কখনো বাস্তবে উপস্থাপিত হওয়ার নয়, বিনা কারণে কাল্পনিক বাস্তবে উপস্থাপিত হওয়ার নয়, বিনা কারণে কাল্পনিকভাবে উল্লেখ করে তাতে কোন হুকুম লাগানো হবে।
"যদি রহমানের কোন সন্তান থাকত.. এ আয়াতের মাঝে এবং নসখের আয়াতের মাঝে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। আল্লাহ তা'আলার সন্তান জন্ম দেওয়া একটি অসম্ভব বিষয়। সুতরাং এ আয়াতের পাঠকমাত্রই একথা বুঝে নেয় যে, এটা শুধু একটি কাল্পনিক বিষয়। যার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, যদি আল্লাহর কোন সন্তান থাকত, তাহলে আমি তার ইবাদত করতাম। কিন্তু তাঁর যেহেতু কোন সন্তানই নেই, তাই তিনি ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত করার প্রশ্নই আসে না। পক্ষান্তরে খোদ আবু মুসলিম ইস্পাহানীর নিকট নসখের বাস্তবতা যুক্তিগ্রাহ্যভাবে অসম্ভব নয়। তাই নসখকে একটি কাল্পনিক দিক সাব্যস্ত করার কোন অর্থ নেই।
উল্লেখিত আয়াতের শানে নুযূল দ্বারা বিষয়টি আরো সুস্পষ্ট হয়। তাফসীর গ্রন্থে বর্ণিত আছে যে, কতিপয় কাফের হযরত রাসূল (সা.)-এর উপর এই অভিযোগ উত্থাপন করেছিল যে, আপনি আপনার অনুসারীদের প্রথমত এক বিষয়ের নির্দেশ দেন অতঃপর সেটা থেকে বারণ করে নতুন নির্দেশ জারী করে থাকেন কেন? এর জবাবে এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছে। এর দ্বারা সুস্পষ্ট বুঝা যায় যে, এ আয়াতে নসখকে স্বীকার করে এই হিকমাত বর্ণনা করা হয়েছে। নসখকে অস্বীকার করা হয়নি।
মানসুখ আয়াতের সংখ্যা:
আমরা পূর্বেই বলে এসেছি যে, পূর্ববর্তী উলামায়ে কিরামের পরিভাষায় নসখের ভাবার্থ খুবই ব্যাপক ছিল। তাই তারা মানসুখ আয়াতের সংখ্যা অনেক বেশি সাব্যস্ত করেছেন। কিন্তু আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী (রহ.) পরবর্তী উলামায়ে কিরামের পরিভাষানুযায়ী লিখেন, সমগ্ৰ কুরআনে মাত্র উনিশটি আয়াত মানসূখ।
তারপর শেষযুগে হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) সে উনিশটি আয়াতের মাঝে বিশদ ব্যাখ্যা করে মাত্র পাঁচটির মাঝে নসখকে স্বীকার করেছেন। আর বাকী আয়াতগুলোর ক্ষেত্রে ঐ সমস্ত তাফসীরকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন, যদ্বারা আয়াতগুলোকে মানসুখ হিসাবে মেনে নিতে না হয়। এক্ষেত্রে অধিকাংশ আয়াতের মাঝেই হযরত শাহ সাহেবের ব্যাখ্যা যুক্তি ও বিবেকগ্রাহ্য। কিন্তু কোন কোন ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে মতানৈক্যও রয়েছে। যাই হোক তাঁর স্বীকৃত মানসুখ আয়াত পাঁচটি হচ্ছে
সূরা বাকারা ( আয়াত নং - ১৮০ )
کُتِبَ عَلَیۡکُمۡ اِذَا حَضَرَ اَحَدَکُمُ الۡمَوۡتُ اِنۡ تَرَکَ خَیۡرَۨا ۚۖ الۡوَصِیَّۃُ لِلۡوَالِدَیۡنِ وَالۡاَقۡرَبِیۡنَ بِالۡمَعۡرُوۡفِ ۚ حَقًّا عَلَی الۡمُتَّقِیۡنَ ؕ
অর্থঃ
তোমাদের উপর ফরয করা হয়েছে যে, তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অর্থ-সম্পদ রেখে যায়, তবে যখন তার মৃত্যুক্ষণ উপস্থিত হবে, তখন নিজ পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের পক্ষে ন্যায়সঙ্গতভাবে ওসিয়ত করবে। ১২৬ এটা মুত্তাকীদের অবশ্য কর্তব্য।
তাফসীরে মুফতি তাকি উসমানীঃ
১২৬. মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পদে যখন ওয়ারিশদের অংশ নির্দিষ্ট ছিল না, সেই সময় এ আয়াত নাযিল হয়। তখন মায়্যিতের পুত্রই সমুদয় সম্পদ লাভ করত। এ আয়াতে বিধান দেওয়া হয়েছে যে, প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার মৃত্যুকালে পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজনের পক্ষে ওসিয়ত করে যেতে হবে এবং স্পষ্ট করে দিতে হবে, তার সম্পদে কে কতটুকু অংশ পাবে। পরবর্তীতে সূরা নিসায় (৪ : ১১-৪১) ওয়ারিশগণের তালিকা ও তাদের প্রাপ্য অংশ স্বয়ং আল্লাহ তাআলাই নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। তারপর আর এ আয়াতে যে ওসিয়তের কথা বলা হয়েছে তা ফরয থাকেনি। অবশ্য কারও যদি কোনও রকমের দেনা থাকে, তবে এখনও সে সম্পর্কে ওসিয়ত করে যাওয়া ফরয। তাছাড়া যে সকল লোক শরীয়তের বিধান অনুযায়ী ওয়ারিশ হয় না, তাদের অনুকূলে পরিত্যক্ত সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশের ভেতর ওসিয়ত করা এখনও জায়েয আছে।
https://muslimbangla.com/sura/2/tafsir/180
২য় আয়াতঃ
یٰۤاَیُّہَا النَّبِیُّ حَرِّضِ الۡمُؤۡمِنِیۡنَ عَلَی الۡقِتَالِ ؕ اِنۡ یَّکُنۡ مِّنۡکُمۡ عِشۡرُوۡنَ صٰبِرُوۡنَ یَغۡلِبُوۡا مِائَتَیۡنِ ۚ وَاِنۡ یَّکُنۡ مِّنۡکُمۡ مِّائَۃٌ یَّغۡلِبُوۡۤا اَلۡفًا مِّنَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا بِاَنَّہُمۡ قَوۡمٌ لَّا یَفۡقَہُوۡنَ
অর্থঃ
হে নবী, আপনি মুসলমানগণকে উৎসাহিত করুন জেহাদের জন্য। তোমাদের মধ্যে যদি বিশ জন দৃঢ়পদ ব্যক্তি থাকে, তবে জয়ী হবে দু’শর মোকাবেলায়। আর যদি তোমাদের মধ্যে থাকে একশ লোক, তবে জয়ী হবে হাজার কাফেরের উপর থেকে তার কারণ ওরা জ্ঞানহীন।
তাফসীরে মুফতি তাকি উসমানীঃ
৪৭. যেহেতু সঠিক বুঝ রাখে না তাই ইসলামও গ্রহণ করে না। আর ইসলাম গ্রহণ না করার কারণে আল্লাহ তাআলার গায়েবী সাহায্য থেকেও বঞ্চিত থাকে এবং নিজেদের দশগুণ বেশি শক্তি থাকা সত্ত্বেও মুসলিমদের কাছে পরাস্ত হয়। প্রসঙ্গত এ আয়াতে আদেশ করা হয়েছে যে, কাফেরদের সংখ্যা মুসলিমদের অপেক্ষা দশগুণ বেশি হলেও মুসলিমদের জন্য পিছু হটা জায়েয নয়। অবশ্য এরপরে পরবর্তী আয়াতটি দ্বারা এ হুকুম আরও সহজ করে দেওয়া হয়েছে।
https://muslimbangla.com/sura/8/tafsir/65
৩য় আয়াতঃ
সূরা মুজাদালাঃ আয়াত নং ১২-১৩
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِذَا نَاجَیۡتُمُ الرَّسُوۡلَ فَقَدِّمُوۡا بَیۡنَ یَدَیۡ نَجۡوٰىکُمۡ صَدَقَۃً ؕ ذٰلِکَ خَیۡرٌ لَّکُمۡ وَاَطۡہَرُ ؕ فَاِنۡ لَّمۡ تَجِدُوۡا فَاِنَّ اللّٰہَ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ
অর্থঃ
মুফতী তাকী উসমানী
হে মুমিনগণ! তোমরা যখন নবীর সঙ্গে নিভৃতে কোন কথা বলতে চাবে, তখন নিভৃতে কথা বলার আগে কিছু সদকা দিয়ে দেবে। ৯ এটা তোমাদের জন্য উৎকৃষ্ট ও পবিত্রতম পন্থা। তবে তোমাদের কাছে (সদকা করার মত) কিছু না থাকলে তো আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
তাফসীরে মুফতি তাকি উসমানীঃ
৯. যারা নিভৃতে কথা বলার জন্য মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে সময় চাইত, অনেক সময় তারা অহেতুকভাবে তাঁর থেকে বেশি সময় নিয়ে নিত। তাঁর নীতি ছিল, কেউ তাঁর সঙ্গে কথা বললে, তিনি নিজে থেকে তার কথা কেটে দিতেন না। কেউ কেউ এর থেকে অন্যায় সুযোগ গ্রহণ করত। কিছু মুনাফেকও এদের মধ্যে ছিল। তাই এ আয়াতে হুকুম দেওয়া হয়েছিল, কেউ মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে নিভৃতে কথা বলতে চাইলে সে যেন তার আগে গরীবদেরকে কিছু দান-খয়রাত করে আসে। সেই সঙ্গে এটাও বলে দেওয়া হয়েছিল যে, কারও দান-খয়রাত করার সামর্থ্য না থাকলে তার কথা আলাদা। সে এই হুকুমের আওতায় পড়বে না। কী পরিমাণ সদকা করতে হবে তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি। অবশ্য হযরত আলী (রাযি.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের থেকে এরূপ সময় নিলে এক দীনার সদকা করেছিলেন। এ নির্দেশের উদ্দেশ্য ছিল, যাতে কেউ অপ্রয়োজনীয় কাজে তাঁর মূল্যবান সময় নষ্ট করতে না পারে এবং যাদের সত্যিকারের প্রয়োজন থাকে, কেবল তারাই তাঁর থেকে সময় গ্রহণ করে, তবে পরবর্তীতে এ হুকুমটি রহিত করে দেওয়া হয়, যেমন সামনের টীকায় আসছে।
ءَاَشۡفَقۡتُمۡ اَنۡ تُقَدِّمُوۡا بَیۡنَ یَدَیۡ نَجۡوٰىکُمۡ صَدَقٰتٍ ؕ فَاِذۡ لَمۡ تَفۡعَلُوۡا وَتَابَ اللّٰہُ عَلَیۡکُمۡ فَاَقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ وَاٰتُوا الزَّکٰوۃَ وَاَطِیۡعُوا اللّٰہَ وَرَسُوۡلَہٗ ؕ وَاللّٰہُ خَبِیۡرٌۢ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ ٪
অর্থঃ
মুফতী তাকী উসমানী
তোমরা নিভৃতে কথা বলার আগে সদকা করতে কি ভয় পাচ্ছ? তোমরা যখন তা করতে পারনি এবং আল্লাহ তাআলাও তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন, তখন নামায কায়েম করতে থাক, যাকাত দিতে থাক এবং আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করে যাও। ১০ তোমরা যা-কিছু কর আল্লাহ সে সম্বন্ধে পরিপূর্ণ অবগত।
তাফসীরে মুফতি তাকি উসমানীঃ
১০. পূর্বের আয়াতে সদকা করার যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, এ আয়াত তা মানসুখ (রহিত) করে দিয়েছে। কেননা যে উদ্দেশ্যে এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল তা পূরণ হয়ে গিয়েছিল। লোকে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের থেকে সময় নেওয়ার ব্যাপারে সতর্ক হয়ে গিয়েছিল। মুনাফেকরাও বুঝে ফেলেছিল, এরপরও তারা আগের মত দুষ্কৃতি চালাতে থাকলে তাদের মুখোশ খুলে দেওয়া হবে। কাজেই এ আয়াত জানাচ্ছে, এখন আর সদকা করা জরুরি নয়। তবে অন্যান্য দীনী কার্যাবলী, যথা নামায, যাকাত ইত্যাদি করে যেতে থাক।
৪র্থ আয়াতঃ
সূরা মুয্যাম্মিল ( আয়াত নং - ২ )
قُمِ الَّیۡلَ اِلَّا قَلِیۡلًا ۙ
অর্থঃ
মুফতী তাকী উসমানী
রাতের কিছু অংশ ছাড়া বাকি রাত (ইবাদতের জন্য) দাঁড়িয়ে যাও।২
তাফসীরে মুফতি তাকি উসমানীঃ
২. এ আয়াতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাহাজ্জুদের নামায পড়তে হুকুম করা হয়েছে। অধিকাংশের মতে প্রথম দিকে কেবল মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপরই নয়; বরং সাহাবীগণের উপরও তাহাজ্জুদের নামায ফরয করে দেওয়া হয়েছিল এবং এর পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছিল রাতের কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ। কোন কোন বর্ণনা দ্বারা বোঝা যায় এ নির্দেশ এক বছর পর্যন্ত বলবৎ ছিল। পরবর্তীকালে এ সূরারই ২০নং আয়াত নাযিল করা হয় এবং এর মাধ্যমে তাহাজ্জুদের ‘ফরযিয়াত’ রহিত করে দেওয়া হয়, যেমন সামনে আসছে।
সূরা মুয্যাম্মিল ( আয়াত নং - ২০ )
اِنَّ رَبَّکَ یَعۡلَمُ اَنَّکَ تَقُوۡمُ اَدۡنٰی مِنۡ ثُلُثَیِ الَّیۡلِ وَنِصۡفَہٗ وَثُلُثَہٗ وَطَآئِفَۃٌ مِّنَ الَّذِیۡنَ مَعَکَ ؕ وَاللّٰہُ یُقَدِّرُ الَّیۡلَ وَالنَّہَارَ ؕ عَلِمَ اَنۡ لَّنۡ تُحۡصُوۡہُ فَتَابَ عَلَیۡکُمۡ فَاقۡرَءُوۡا مَا تَیَسَّرَ مِنَ الۡقُرۡاٰنِ ؕ عَلِمَ اَنۡ سَیَکُوۡنُ مِنۡکُمۡ مَّرۡضٰی ۙ وَاٰخَرُوۡنَ یَضۡرِبُوۡنَ فِی الۡاَرۡضِ یَبۡتَغُوۡنَ مِنۡ فَضۡلِ اللّٰہِ ۙ وَاٰخَرُوۡنَ یُقَاتِلُوۡنَ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰہِ ۫ۖ فَاقۡرَءُوۡا مَا تَیَسَّرَ مِنۡہُ ۙ وَاَقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ وَاٰتُوا الزَّکٰوۃَ وَاَقۡرِضُوا اللّٰہَ قَرۡضًا حَسَنًا ؕ وَمَا تُقَدِّمُوۡا لِاَنۡفُسِکُمۡ مِّنۡ خَیۡرٍ تَجِدُوۡہُ عِنۡدَ اللّٰہِ ہُوَ خَیۡرًا وَّاَعۡظَمَ اَجۡرًا ؕ وَاسۡتَغۡفِرُوا اللّٰہَ ؕ اِنَّ اللّٰہَ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ ٪
অর্থঃ
(হে রাসূল!) তোমার প্রতিপালক জানেন, তুমি রাতের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশে, (কখনও) অর্ধ রাতে এবং (কখনও) রাতের এক-তৃতীয়াংশে (তাহাজ্জুদের নামাযের জন্য) জাগরণ কর এবং তোমার সঙ্গীদের মধ্যেও একটি দল (এ রকম করে)। ৯ রাত ও দিনের পরিমাণ আল্লাহই নির্ধারণ করেন। তিনি জানেন, তোমরা এর যথাযথ হিসাব রাখতে পারবে না। কাজেই তিনি তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। ১০ সুতরাং কুরআনের যতটুকু (পড়া তোমাদের জন্য) সহজ হয় ততটুকুই পড়। ১১ আল্লাহ জানেন তোমাদের মধ্যে কিছু লোক অসুস্থ হয়ে পড়বে, অপর কিছু লোক এমন থাকবে, যারা আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানের জন্য পৃথিবীতে ভ্রমণ করবে ১২ এবং কিছু লোক থাকবে এমন, যারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ রত থাকবে। সুতরাং তোমরা তা (অর্থাৎ কুরআন) থেকে ততটুকুই পড়, যা সহজ হয় এবং নামায কায়েম কর, ১৩ যাকাত আদায় কর ও আল্লাহকে ঋণ দাও উত্তম ঋণ। ১৪ তোমরা নিজেদের জন্য উত্তম যাই অগ্রিম পাঠাবে, আল্লাহর কাছে গিয়ে তোমরা তা আরও উৎকৃষ্ট অবস্থায় এবং মহা পুরস্কাররূপে বিদ্যমান পাবে। আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাক। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
তাফসীরে মুফতি তাকি উসমানীঃ
৯. এ আয়াতটি পূর্বের আয়াতসমূহের অন্ততপক্ষে এক বছর পর নাযিল হয়েছে। এর মাধ্যমে তাহাজ্জুদের বিধানটি সহজ করে দেওয়া হয়, যেমন পূর্বে বলা হয়েছে। শুরুতে রাতের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ কাল তাহাজ্জুদে লিপ্ত থাকা জরুরী ছিল, কিন্তু যেহেতু ঘড়ি বা সময় নির্ধারক অন্য কিছু তখন ছিল না, তাই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবীগণ সতর্কতামূলকভাবে রাতের এক-তৃতীয়াংশ অপেক্ষা অনেক বেশি সময় তাহাজ্জুদে কাটাতেন। কখনও অর্ধরাত্রি এবং কখনও রাতের দুই-তৃতীয়াংশের কাছাকাছি।
১০. অর্থাৎ রাত ও দিনের যথাযথ পরিমাণ যেহেতু আল্লাহ তাআলা নির্ধারণ করেন, তাই তাঁর জানা আছে তোমাদের পক্ষে রাতের এক-তৃতীয়াংশের হিসাব রাখা কঠিন। ফলে তাহাজ্জুদের আমল যথাযথভাবে সম্পন্ন করাও তোমাদের জন্য কষ্টকর। তা সত্ত্বেও তোমরা দীর্ঘ একটা কাল এ কষ্ট বরদাশত করেছ আর এর মাধ্যমে তোমাদের ভেতর যে গুণ সৃষ্টি করা আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্য ছিল, তা যথেষ্ট পরিমাণে অর্জিত হয়ে গেছে। কাজেই এখন আল্লাহ তাআলা তাহাজ্জুদের ফরযিয়াতকে রহিত করে এ ইবাদতকে তোমাদের জন্য ঐচ্ছিক করে দিয়েছেন।
১১. এর দ্বারা তাহাজ্জুদের নামাযে কুরআন তেলাওয়াত করার কথা বোঝানো হয়েছে। বলা হচ্ছে যে, এখন আর তাহাজ্জুদের নামায ফরয নয় এবং তাতে বিশেষ পরিমাণ কুরআন পাঠও আবশ্যিক নয়। এখন এ বিধানটি মুস্তাহাব পর্যায়ের আর এতে যতটুকু পরিমাণ সহজে পড়া সম্ভব হয়, তাই পড়তে পার। প্রকাশ থাকে যে, যদিও তাহাজ্জুদের উত্তম তরিকা হল শোওয়ার পর শেষ রাতে উঠে পড়া, কিন্তু কারও পক্ষে যদি এটা বেশি কঠিন হয়, তবে ইশার পর যে-কোনও সময় ‘সালাতুল লাইল’ (রাতের নামায)-এর নিয়তে নামায পড়ে নিলে তাতে তাহাজ্জুদের ফযীলত লাভ হতে পারে।
১২. অর্থাৎ ব্যবসা বা আয়-উপার্জনের জন্য সফর করবে। বোঝানো উদ্দেশ্য যে, আল্লাহ তাআলা জানেন ভবিষ্যতে তোমাদের এমন অনেক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে, যখন রাতের বেলা দীর্ঘ সময় নামাযে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। সে কারণেই সে ফরয রহিত করে দেওয়া হয়েছে।
১৩. এর দ্বারা পাঁচ ওয়াক্তের ফরয নামায বোঝানো হয়েছে।
১৪. এর অর্থ সদকা করা ও অন্যান্য সৎকাজে অর্থ ব্যয় করা। একে রূপকার্থে ‘ঋণ’ বলা হয়েছে এ কারণে যে, ঋণ যেমন ফেরত দেওয়া হয়ে থাকে, তেমনি আল্লাহ তাআলাও আখেরাতে সওয়াব ও পুরস্কাররূপে এটা ফেরত দেওয়ার ওয়াদা করেছেন। উত্তম ঋণের অর্থ হল, খালেস নিয়তে কেবল আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে দান-খয়রাত করা; মানুষকে দেখানো বা সুনাম কুড়ানোর নিয়ত না থাকা।
والله اعلم بالصواب
মন্তব্য (০)
কোনো মন্তব্য নেই।
এ সম্পর্কিত আরও জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর
৯০৪৯৮
ইমামের সাথে একজন /দুইজন মুকতাদী কিভাবে দাড়াবে?
২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫
Bethua

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী শাহাদাত হুসাইন ফরায়েজী
৯০৫১৯
মেসেঞ্জারে বিবাহ করলে কি তা হয়
২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫
Gazirchat

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী শাহাদাত হুসাইন ফরায়েজী
সাম্প্রতিক প্রশ্নোত্তর
মাসায়েল-এর বিষয়াদি
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে