আপনার জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

সকল মাসায়েল একত্রে দেখুন

মাহফিলে নারীদের প্যান্ডেল

প্রশ্নঃ ১৩২. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, আমাদের মাদরাসায় প্রতি বছর বার্ষিক ওয়ায মাহফিল করা হয়, মাহফিলে পুরুষদের প্যান্ডেলের পাশাপাশি মহিলাদের জন্যও ভিন্ন প্যান্ডেলের ব্যাবস্থা করা হয়। মহিলা সমাগমও প্রচুর পরিমাণে হয়। মহিলারা প্রজেক্টরের মাধ্যমে সরাসরি বক্তার ওয়ায দেখে দেখে শুনতে ইচ্ছুক। এখন হযরতের নিকট প্রশ্ন হচ্ছে, এভাবে প্রজেক্টরের মাধ্যমে মহিলাদের ওয়ায শোনার ব্যবস্থা করা এবং তাদের জন্য মাহফিলে এসে এভাবে প্রজেক্টরের মাধ্যমে শোনা জায়েয হবে কি? দলীলসহ বিস্তারিত জানালে খুবই উপকৃত হতাম। আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।,

২৪ ডিসেম্বর, ২০২৪

উত্তর

و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم


মহিলাদেরকে মাঠে-ময়দানে ডেকে এনে ওয়ায শোনানোর আয়োজনটাই শরীয়তসম্মত নয়। কেননা মহিলাদের ক্ষেত্রে শরীয়তের নির্দেশনা হল, ইবাদত-বন্দেগী থেকে শুরু করে তাদের সকল কাজ পুরুষদের থেকে আলাদা হবে। তাদের অবয়ব ও চলাফেরা পুরুষদের দৃষ্টির আড়ালে থাকবে। পুরুষের জন্য যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামায মসজিদে এসে জামাতের সাথে আদায় করা শরীয়তের গুরুত্বপূর্ণ হুকুম। সেখানে নারীদেরকে গৃহাভ্যন্তরে নামায আদায় করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। মসজিদে নববীতে যেখানে এক রাকাত নামাযের ফযীলত এক হাজার রাকাত সমান। এর সাথে আবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মত ইমামের পেছনে নামায পড়ার সৌভাগ্য তো রয়েছেই। তা সত্ত্বেও সে সময় নারী সাহাবীদেরকে তাদের গৃহাভ্যন্তরের সর্বাধিক নির্জন স্থানে নামায পড়াকে উত্তম বলা হয়েছে। এর উল্টো এমন একটি হাদীসও নেই, যাতে মহিলাদেরকে সম্বোধন করে মসজিদে এসে জামাতের সাথে নামায পড়তে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বা এর দিকে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে।

মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত আছে-

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ سُوَيْدٍ الْأَنْصَارِيِّ، عَنْ عَمّتِهِ أُمِّ حُمَيْدٍ امْرَأَةِ أَبِي حُمَيْدٍ السّاعِدِيِّ، أَنّهَا جَاءَتِ النّبِيّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَتْ: يَا رَسُولَ اللهِ، إِنِّي أُحِبّ الصّلَاةَ مَعَكَ، قَالَ: قَدْ عَلِمْتُ أَنّكِ تُحِبِّينَ الصّلَاةَ مَعِي، وَصَلَاتُكِ فِي بَيْتِكِ خَيْرٌ لَكِ مِنْ صَلَاتِكِ فِي حُجْرَتِكِ، وَصَلَاتُكِ فِي حُجْرَتِكِ خَيْرٌ مِنْ صَلَاتِكِ فِي دَارِكِ، وَصَلَاتُكِ فِي دَارِكِ خَيْرٌ لَكِ مِنْ صَلَاتِكِ فِي مَسْجِدِ قَوْمِكِ، وَصَلَاتُكِ فِي مَسْجِدِ قَوْمِكِ خَيْرٌ لَكِ مِنْ صَلَاتِكِ فِي مَسْجِدِي، قَالَ: فَأَمَرَتْ فَبُنِيَ لَهَا مَسْجِدٌ فِي أَقْصَى شَيْءٍ مِنْ بَيْتِهَا وَأَظْلَمِهِ، فَكَانَتْ تُصَلِّي فِيهِ حَتّى لَقِيَتِ اللهَ عَزّ وَجَلّ.

উম্মে হুমাইদ রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আপনার সাথে নামায পড়তে খুব পছন্দ করি। তিনি বললেন, আমি জানি তুমি আমার সাথে নামায পড়তে পছন্দ কর। কিন্তু জেনে রাখ, তোমার ঘরের ভেতরের নামায বাহিরের

কামরার নামাযের চেয়ে উত্তম। বারান্দার নামায চৌহদ্দির ভেতরের নামাযের চেয়ে উত্তম। চৌহদ্দির ভেতরের নামায তোমার এলাকার মসজিদে নামাযের চেয়ে উত্তম এবং তোমার এলাকার মসজিদের নামায আমার মসজিদের নামাযের চেয়ে উত্তম।

বর্ণনাকারী বলেন, তখন উম্মে হুমাইদ রা.-এর নির্দেশে ঘরের সবচেয়ে নিভৃতে এবং অধিক আড়ালে তার জন্য নামাযের স্থান বানানো হয়। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি সেখানেই নামায আদায় করছেন। (মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৭০৯০)

সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেছেন-

إِنّمَا النِّسَاءُ عَوْرَةٌ، وَإِنّ الْمَرْأَةَ لَتَخْرُجُ مِنْ بَيْتِهَا وَمَا بِهَا مِنْ بَأْسٍ، فَيَسْتَشْرِفُ لَهَا الشّيْطَانُ، فَيَقُولُ: إِنّكِ لَا تَمُرِّينَ بِأَحَدٍ إِلّا أَعْجَبْتِهِ، وَإِنَّ الْمَرْأَةَ لَتَلْبَسُ ثِيَابَهَا، فَيُقَالُ: أَيْنَ تُرِيدِينَ؟ فَتَقُولُ: أَعُودُ مَرِيضًا، أَوْ أَشْهَدُ جِنَازَةً، أَوْ أُصَلِّي فِي مَسْجِدٍ، وَمَا عَبَدَتِ امْرَأَةٌ رَبّهَا مِثْلَ أَنْ تَعْبُدَهُ فِي بَيْتِهَا .

নারীগণ আবরণীয়। কোনো নারী যখন নিজ ঘর থেকে বের হয় অথচ তার কোনো সমস্যা নেই; তখন শয়তান তার পিছু নেয় এবং বলতে থাকে, তুমি যার সম্মুখ দিয়ে যাবে তোমাকে তার ভালো লাগবে। আর কোনো মহিলা যখন কাপড় পরিধান করে তখন ঘরের লোকজন জিজ্ঞাসা করে তুমি কোথায় যাও? সে বলে যে, অমুক অসুস্থকে দেখতে যাই বা কারো জানাযা পড়তে যাই, অথবা বলে, মসজিদে নামাযে যাই। অথচ মহিলাদের কোনো ইবাদতই এর চেয়ে উত্তম নয়, যা সে নিজ গৃহে আদায় করে। (আলমুজামুল কাবীর তাবারানী, হাদীস ৮৯১৪; মাজমাউয যাওয়াইদ, বর্ণনা ২১১৮)

এ বর্ণনাগুলো থেকে স্পষ্ট যে, মহিলাগণ শরীয়তসম্মত প্রয়োজন ছাড়া কোনো ইবাদত-বন্দেগির জন্যও ঘর থেকে বের হয়ে অন্য কোথাও যাবে না।

তাছাড়া স্পষ্টত নবীযুগের নারীরা পরবর্তী যে কোনো যুগের নারী অপেক্ষা দ্বীন শেখার প্রতি অধিক আগ্রহী ছিলেন। তারা যে পন্থায় দ্বীন শিখেছেন মূলত সেটাই আমাদের অনুসরণীয়। সহীহ বুখারী ও সহীহ ইবনে হিব্বানে বর্ণিত হয়েছে যে, একবার কিছুসংখ্যক নারী সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার মজলিসে পুরুষদের সাথে আমাদের জন্য আসা সম্ভব হয় না। আমাদের জন্য একটি দিন ধার্য করুন, যাতে সেদিনটিতে আমরা আপনার নিকট আসতে পারি। তিনি বললেন- مَوْعِدُكُنّ بَيْتُ فُلَانَةَ অর্থাৎ নির্ধারিত দিন অমুক মহিলার ঘরে জমায়েত হও। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে তাদেরকে ওয়ায নসীহত করলেন। (সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ২৯৪১; সহীহ বুখারী, হাদীস ১০১)

লক্ষ করার বিষয়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহিলাদের ওয়ায-নসীহত করার জন্য পুরুষদের দৃষ্টির আড়ালে বাড়ির ভেতর নির্জন স্থান নির্বাচন করেছেন। তাদের আবদারের প্রেক্ষিতে প্রকাশ্য স্থান যেমন মসজিদে নববী, ঈদগাহ বা ঘরের আঙ্গীনার কথা বলেননি। তিনি তাদেরকে বলেছেন- مَوْعِدُكُنّ بَيْتُ فُلَانَةَ ‘অমুক মহিলার ঘরে একত্রিত হও’।

উপরন্তু শরীয়ত অনুমোদিত প্রয়োজন ছাড়া বোরকা পরেও নারীদের জন্য পুরুষদের সমাগম স্থলে যাওয়া থেকে বিরত থাকার কথা বলা হয়েছে, যেখানে আসা যাওয়ার পথে ও অনুষ্ঠান স্থলে পরপুরুষের সাথে মেলা-মেশার আশঙ্কা থাকে।

দ্বিতীয়ত শরীয়তের বিধান হল, স্বাভাবিক অবস্থায় মহিলাগণ পরপুরুষের দিকে তাকাবে না। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

وَقُلْ لِّلْمُؤْمِنٰتِ یَغْضُضْنَ مِنْ اَبْصَارِهِنَّ.

আর মুমিন নারীদেরও বলে দিন, তারা যেন (পরপুরুষ থেকে) তাদের দৃষ্টিকে অবনত রাখে। [সূরা আননূর (২৪) : ৩১]

হাদীস শরীফে এসেছে, উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালামা রা. বর্ণনা করেন যে, একবার তিনি ও মাইমুনা রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট ছিলেন। তিনি বলেন, তখন সেখানে (অন্ধ সাহাবী) আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূম রা. আসলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন আমাদেরকে বললেন, তোমরা তার থেকে আড়াল হয়ে যাও। মাইমুনা রা. তখন বললেন, তিনি তো অন্ধ; আমাদেরকে দেখছেন না এবং চেনেনও না। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-

أَفَعَمْيَاوَانِ أَنْتُمَا؟ أَلَسْتُمَا تُبْصِرَانِهِ؟

তোমরা দু’জনও কি অন্ধ? তোমরা কি তাকে দেখছ না? (জামে তিরমিযী, হাদীস ২৭৭৮)

প্রজেক্টরের মাধ্যমে মহিলাদের জন্য পুরুষ বক্তাকে দেখানোর আয়োজন কুরআন-হাদীসের এই বিধানগুলোরও খেলাফ।

প্রজেক্টরের মাধ্যমে ওয়ায দেখানোর ক্ষেত্রে বেগানা পুরুষকে দেখার বিষয়টি ছাড়াও আরো ফেতনার আশংঙ্কা রয়েছে। জানা কথা যে, বর্তমানে কোনো কোনো বক্তা নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করেন, যার কারণে তাকে সরাসরি দেখে কোনো যুবতী-নারী ফেতনায় পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

অতএব প্রশ্নোক্ত ক্ষেত্রে মাহফিল কমিটির কর্তব্য হবে, মহিলাদের জন্য মাহফিলে অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করা থেকেই বিরত থাকা। কেননা এর দ্বারা মহিলাদের ব্যাপারে শরীয়তের অনেকগুলো বিধান ও নির্দেশনার লঙ্ঘণ হয় এবং ক্ষেত্রবিশেষে তা পুরেপুরি নাজায়েযের আওতায় চলে যেতে পারে। তাই নিজেদের আবেগ ও চাহিদা অনুযায়ী আমল না করে শরীয়ত নির্দেশিত পন্থায় এবং শরীয়তের চাহিদা অনুযায়ী আমল করাই মুসলমানদের করণীয়।

প্রকাশ থাকে যে, দ্বীনের জরুরি ইলম শিক্ষা করা নারীদের উপরও ফরয। তাদেরকে সঠিক ঈমান-আকীদা শিক্ষা দেওয়া, তালীম-তরবিয়ত করা খুবই দরকার। তবে এর পদ্ধতি হতে হবে অবশ্যই শরীয়তসম্মত। আর তা হল ঘরের পুরুষরা দ্বীন শিখে তাদের নারীদেরকে শেখাবে। এমনিভাবে বাড়িতে বাড়িতে ঘরোয়া দ্বীনী মাহফিল এবং ঘরোয়া দ্বীনী তালীমের আয়োজন করা। আর ঘর/বাসার কাছে অনাবাসিক তালীমুল বানাতের ব্যবস্থা থাকলে সেখানে গিয়ে দ্বীন শিখে আসতে পারে। এতে প্রত্যেক ঘরেই দ্বীনী তালীমের চর্চা হবে এবং ঘরে ঘরে দ্বীনী পরিবেশ কায়েম হবে- ইনশাআল্লাহ।


والله اعلم بالصواب

উত্তর দিয়েছেনঃ মাসিক আলকাউসার

প্রসঙ্গসমূহ:

মন্তব্য ()

কোনো মন্তব্য নেই।

এ সম্পর্কিত আরও জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

৩০০২৫

তিন তাকবির দিয়ে জানাজা পড়ে মাইয়্যেত দাফন করলে করণীয় কি?


৪ মার্চ, ২০২৩

সীতাকুন্ড

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি

২৯৫৪৯

জানাযার নামাজে ইমামের পিছনে মুক্তাদী কি করবে?


২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

টঙ্গী

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী মাহমুদুল হাসান

Logoমুসলিম বাংলা
play storeapp store
TopOfStack Software © 2025 All rights reserved. Privacy Policy