ব্যবসার সুন্নত গুলো কি কি?
প্রশ্নঃ ১১২০৫২. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, ব্যবসার সুন্নাহ পদ্ধতি জানতে চাই।
২৮ জুলাই, ২০২৫
আমিশা পাড়া
উত্তর
و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ব্যবসায়িক জীবন ও ইসলামে ব্যবসার গুরুত্ব:
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মুসলমানদের জন্য ব্যবসাকে পছন্দ করেছেন এবং স্বয়ং তিনি নিজেও ব্যবসায়িক সফর করেছেন। একবার, যখন তিনি (ﷺ) বয়স ছিল বারো বছর, তখন আপন চাচা আবু তালিবের সাথে সিরিয়ার উদ্দেশ্যে সফর করেন। তবে কিছু বর্ণনা থেকে জানা যায়, এই সফর পূর্ণভাবে সিরিয়া পর্যন্ত হয়নি, বরং কিছু কারণে তিনি 'তাইমা' নামক স্থান থেকে ফিরে এসেছিলেন।
পরবর্তী ব্যবসায়িক সফরটি ছিল তখন, যখন তিনার বয়স হয়েছিল প্রায় ২৩ বা ২৪ বছর। তখন খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ (যিনি পরে নবীজির পবিত্রা স্ত্রী হন) তাঁর দাসকে সঙ্গে দিয়ে নবীজিকে একটি ব্যবসায়িক দলের সাথে সিরিয়ায় পাঠান। এই সফরে নবীজি মালপত্র বহন করে নিয়ে গিয়েছিলেন—এটি প্রমাণিত, আবার সেখান থেকে পণ্য কিনে ফিরিয়ে আনা হয়েছে—এটিও প্রমাণিত। তবে এর বাইরে নবীজি (ﷺ) কখনো এই কাজকে পেশা বা স্থায়ী ব্যবসা হিসেবে গ্রহণ করেননি, কারণ আল্লাহ তাআলা তিনাকে সৃষ্টিকে হেদায়াত দেওয়ার জন্য প্রেরণ করেছিলেন, আর এই মহান দায়িত্ব তিনার ওপর অর্পিত হয়েছিল।
নবীজি (ﷺ) মানুষকে ব্যবসার মধ্যে মিথ্যা, প্রতারণা, ভেজাল, বিশ্বাসভঙ্গ ইত্যাদি ঘৃণিত কাজ থেকে বাঁচার নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন—"সত্যবাদী ও আমানতদার ব্যবসায়ীর হাশর হবে নবী, সিদ্দীক এবং শহীদদের সঙ্গে।"
এছাড়াও তিনি আরও নির্দেশ দিয়েছেন—ব্যবসায় যেন সত্য গোপন করে লেনদেন না করা হয়, বাড়িয়ে বাড়িয়ে পণ্যের প্রশংসা না করা হয়, এবং যখন কেউ দামাদামি করছে, তখন তার কথায় বাঁধা দিয়ে কেউ যেন নিজে দামাদামি শুরু না করে; বরং অপেক্ষা করা উচিত, তাদের লেনদেন শেষ হলে পরে নিজের দর-দাম করা উচিত। এগুলোও ব্যবসার কিছু সুন্নত।
ব্যবসার কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত:
১. ব্যবসায় সত্যবাদিতা অবলম্বন করা:
النَّاجِرُ الصَّدُوقُ الْأَمِينُ مَعَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ
“সৎ ও বিশ্বাসযোগ্য ব্যবসায়ীর হাশর হবে নবী, সিদ্দীক এবং শহীদদের সঙ্গে।” (তিরমিজি: ১২০৯)
https://muslimbangla.com/hadith/30849
২. মাপে বা ওজনে কম না দেওয়া:
مَن غَشَّ فَلَيْسَ مِنَّا
“যে প্রতারণা করে, সে আমার উম্মত নয়।”
(তিরমিজি: ১৩১৫)
উল্লেখ্য, প্রতারণার মধ্যে ওজনে কম দেওয়া, পণ্যের দোষ গোপন করা, মিথ্যা প্রশংসা ইত্যাদি সবই অন্তর্ভুক্ত।
https://muslimbangla.com/hadith/30955
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَأَوْفُوا الْكَيْلَ وَالْمِيزَانَ بِالْقِسْطِ
“পরিমাপ ও ওজন ন্যায়ের সাথে পূর্ণ করে দাও।”
(সূরা আনআম: ১৫২)
৩. পণ্যের দোষ-ত্রুটি স্পষ্টভাবে জানানো
হাদীস:
البيعانِ بالخيار ما لم يتفرقا، فإن صدقا وبيّنا بورك لهما في بيعهما، وإن كتما وكذبا مُحقت بركة بيعهما
“ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে বিচ্ছেদ না হওয়া পর্যন্ত উভয়ের মধ্যে পছন্দ-অপছন্দের অধিকার থাকে। তারা যদি সত্য বলেন এবং (পণ্যের দোষ) স্পষ্ট করে দেন, তাহলে তাদের লেনদেনে বরকত হয়। আর যদি গোপন করেন ও মিথ্যা বলেন, তবে তাদের লেনদেনের বরকত উঠে যায়।”
(সহীহ বুখারী: হাদীস নং: ২১১০)
https://muslimbangla.com/hadith/1980
৪. পণ্যে অতিরিক্ত প্রশংসা বা ভুল তথ্য না দেওয়া :
إِيَّاكُمْ وَالْحَلِفَ فِي الْبَيْعِ، فَإِنَّهُ يُنَفِّقُ، ثُمَّ يَمْحَقُ
“বিক্রির সময় শপথ (অতিরিক্ত প্রশংসা) করা থেকে বেঁচে থাকো। কেননা তা পণ্য বিক্রি করিয়ে দেয়, কিন্তু বরকত নষ্ট করে দেয়।”
(সহীহ মুসলীম: হাদীস নং: ৩৯৮১)
https://muslimbangla.com/hadith/11030
৫. লেনদেনে নম্রতা ও সহজতা অবলম্বন করা:
رَحِمَ اللَّهُ رَجُلًا سَمْحًا إِذَا بَاعَ، وَإِذَا اشْتَرَى، وَإِذَا اقْتَضَى
“আল্লাহ সেই ব্যক্তির প্রতি রহম করুন, যে বিক্রয় করে সহজভাবে, ক্রয় করে সহজভাবে, এবং পাওনা আদায়ে নম্রতা অবলম্বন করে।”
(সহীহ বুখারী: হাদীস নং: ১৯৪৬)
https://muslimbangla.com/hadith/1946
৬. চলমান দর-করের মাঝে ঝাঁপিয়ে না পড়া:
وَلَا يَبِعْ عَلَى بَيْعِ أَخِيهِ
“তোমাদের কেউ যেন তার ভাইয়ের দর-করের ওপর বিক্রয় না করে।”
(সহীহ মুসলীম, হাদীস নং: ১৫১৫-৩)
অর্থাৎ, কেউ যখন কারো সঙ্গে দরদাম করছে, তখন তার কথার মাঝখানে হস্তক্ষেপ করে যেন কেউ নিজে পণ্য বিক্রি না করে।
https://muslimbangla.com/hadith/10722
৭. সুদ থেকে সম্পূর্ণরূপে বেঁচে থাকা:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَأْكُلُوا الرِّبَا أَضْعَافًا مُضَاعَفَةً
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা সুদ খেয়ো না বহু গুণে বর্ধিত অবস্থায়।”
(সূরা আলে ইমরান: ১৩০)
ব্যবসার নামে সুদী লেনদেন করা সম্পূর্ণ হারাম।
https://muslimbangla.com/hadith/10996
৮. দামের বিষয়ে পরিপূর্ণ স্বচ্ছতা রাখা:
لاَ يَحِلُّ لِرَجُلٍ أَنْ يَبِيعَ سِلْعَةً وَهُوَ يَعْلَمُ أَنَّ بِهَا عَيْبًا إِلَّا أَنْ يُبَيِّنَهُ
“কোনো ব্যক্তি কোনো পণ্য বিক্রি করবে অথচ সে জানে যে এতে দোষ আছে—এ অবস্থায় তা বিক্রি করা হালাল নয়, যতক্ষণ না সে তা (দোষ) স্পষ্ট করে দেয়।”
(সুনান ইবন মাজাহ: 2246)
https://muslimbangla.com/hadith/27537
৯. বাজারে কৃত্রিমভাবে দাম বাড়ানোর উদ্দেশ্যে দরদাম করা নিষেধ:
لَا يَتَنَاجَشْ
“(রাসূল ﷺ বলেন) কেউ যেন ‘নাজশ’ না করে।”
নাজশ মানে: এমন লোক দরদাম করে যে কিনতে চায় না, শুধু দাম বাড়াতে চায়।
(সহীহ মুসলীম, হাদীস নং: ১৪১৩-২)
https://muslimbangla.com/hadith/10378
১১. ব্যবসার ক্ষেত্রে সময়ের প্রতি যত্নবান হওয়া:
ফজরের সময় ব্যবসা শুরু করা বরকতের মাধ্যম
اللَّهُمَّ بَارِكْ لأُمَّتِي فِي بُكُورِهَا
“হে আল্লাহ! আমার উম্মতের প্রভাতকে বরকতময় করে দিন।”
ফজরের পর ব্যবসা শুরু করলে বরকত হয়।
https://muslimbangla.com/hadith/30852
আবশ্যকীয় কিছু বিষয়:
১. নামাজে কখনো গাফলতী না করা/ মনে মনে যবানে আল্লাহকে স্মরণ করা:
وَمَنْ أَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَى
এবং যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জীবিকা সংকীর্ণ হবে এবং আমি তাকে কেয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করব। (সূরা ত্বহা, আয়াত : ১২৪)
https://muslimbangla.com/article/155
২. সর্বদা ইস্তেগফার পাঠ করার চেষ্টা করা:
فَقُلۡتُ اسۡتَغۡفِرُوۡا رَبَّکُمۡ ؕ اِنَّہٗ کَانَ غَفَّارًا ۙ
یُّرۡسِلِ السَّمَآءَ عَلَیۡکُمۡ مِّدۡرَارًا ۙ
وَّیُمۡدِدۡکُمۡ بِاَمۡوَالٍ وَّبَنِیۡنَ وَیَجۡعَلۡ لَّکُمۡ جَنّٰتٍ وَّیَجۡعَلۡ لَّکُمۡ اَنۡہٰرًا ؕ
আমি তাদেরকে বলেছি, নিজ প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই তিনি অতিশয় ক্ষমাশীল।
তিনি আকাশ থেকে তোমাদের উপর প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন।
এবং তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে উন্নতি দান করবেন এবং তোমাদের জন্য সৃষ্টি করবেন উদ্যান আর তোমাদের জন্য নদ-নদীর ব্যবস্থা করে দিবেন।
(সূরা নূহ, আয়াত ১০-১২)
https://muslimbangla.com/article/888
৩. সবদা দরূদ পড়ার চেষ্টা করা:
أَنَسُ بْنُ مَالِكٍ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " مَنْ صَلَّى عَلَىَّ صَلاَةً وَاحِدَةً صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ عَشْرَ صَلَوَاتٍ وَحُطَّتْ عَنْهُ عَشْرُ خَطِيئَاتٍ وَرُفِعَتْ لَهُ عَشْرُ دَرَجَاتٍ " .
আনাস ইবনে মালিক (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরুদ পাঠ করবে আল্লাহ তাআলা তার উপর দশবার রহমত নাযিল করবেন, তার দশটি গুনাহ মিটিয়ে দেওয়া হবে এবং তাঁর জন্য দশটি মর্যাদা উন্নীত করা হবে।
সুনানে নাসায়ী, আন্তর্জাতিক নং: ১২৯৭
দরূদ পাঠের দ্বারা গুনাহ মাফ হয়। গুনাহ রিজিকের প্রতিবন্ধক।
https://muslimbangla.com/hadith/32102
https://muslimbangla.com/article/147
والله اعلم بالصواب
শাহাদাত হুসাইন ফরায়েজী
মুফতী, ফাতাওয়া বিভাগ, মুসলিম বাংলা
লেখক ও গবেষক, হাদীস বিভাগ, মুসলিম বাংলা
খতীব, রৌশন আলী মুন্সীবাড়ী জামে মসজিদ, ফেনী
মন্তব্য (0)
কোনো মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্য করুন!
মন্তব্য করতে লগইন করুন
এ সম্পর্কিত আরও জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর
মাসায়েল-এর বিষয়াদি
আল কুরআনুল কারীম
৪
হাদীস ও সুন্নাহ
৬
তাসাউফ-আত্মশুদ্ধি । ইসলাহী পরামর্শ
৩
শরীআত সম্পর্কিত
১৪
ফিতনাসমুহ; বিবরণ - করণীয়
২
আখিরাত - মৃত্যুর পরে
৩
ঈমান বিধ্বংসী কথা ও কাজ
৬
ফিরাকে বাতিলা - ভ্রান্ত দল ও মত
২
পবিত্রতা অর্জন
৮
নামাযের অধ্যায়
১৯
যাকাত - সদাকাহ
৫
রোযার অধ্যায়
৬
হজ্ব - ওমরাহ
২
কাফন দাফন - জানাযা
৫
কসম - মান্নত
১
কুরবানী - যবেহ - আকীকা
৪
বিবাহ শাদী
৮
মীরাছ-উত্তরাধিকার
২
লেনদেন - ব্যবসা - চাকুরী
৯
আধুনিক মাসায়েল
৬
দন্ড বিধি
২
দাওয়াত ও জিহাদ
৩
ইতিহাস ও ঐতিহ্য
৬
সীরাতুন নবী সাঃ । নবীজীর জীবনচরিত
৩
সাহাবা ও তাবেঈন
৩
ফাযায়েল ও মানাকেব
৩
কিতাব - পত্রিকা ও লেখক
৩
পরিবার - সামাজিকতা
৭
মহিলা অঙ্গন
২
আখলাক-চরিত্র
২
আদব- শিষ্টাচার
১২
রোগ-ব্যধি। চিকিৎসা
২
দোয়া - জিকির
২
নাম। শব্দ জ্ঞান
৩
নির্বাচিত
২
সাম্প্রতিক
১
বিবিধ মাসআলা
১