আপনার জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

সকল মাসায়েল একত্রে দেখুন

ইমানের ব্যাপারে ওয়াসওয়াসা

প্রশ্নঃ ১০৭৯৩. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, আমি সন্দেহজনক রোগে আক্রান্ত,আজকে যখন ফজরের সলাত আদায় করছিলাম তখন আমার সামনে একটি টুল ছিল আমি সলাত এর দ্বিতীয় রাকাআত এ গিয়ে সন্দেহ হলো যে আমি ওই টুল টাকে সেজদাহ করছি নাউজুবিল্লাহ, আমি এসব কখনোই কল্পনা করতে পারি না আমি এর জন্য খুবই হতাশা গ্রস্ত। আর,কিছু দিন যাবত আমার ইমান আছে নাকি তা নিয়েও সন্দেহ হচ্ছে।আমি এসব সন্দেহজনক সকল কিছু থেকে বেরিয়ে শান্তি পূর্ণ জিবন জাপন করতে চাই প্লিজ আমাকে আল্লাহ্ এর জন্য সাহায্য করুন। আমি উওর পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি। অল্লাহ্ আপনাদের দাওয়াত কবুল করুক আমিন।,

৯ জুন, ২০২৪

Dhaka, Bangladesh

উত্তর

و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم


ওয়াসওয়াসা থেকে কেউ নিরাপদ না:

হজরত থানবি (রহ.) ওয়াসওয়াসার চিকিৎসা পদ্ধতি বাতলে দিয়েছেন। মানুষের মনে বিভিন্ন সময় ওয়াসওয়াসা ও মন্দচিন্তা আসে। কখনো কখনো এমন এমন চিন্তা মনে উদয় হয় যে, ঈমানের ব্যাপারে সন্দেহ সৃষ্টি হয়ে যায়। সম্ভবত এমন কোনো মানুষ নেই, যার মনে এই ধরনের চিন্তা কখনোই আসে না। সবার মনেই আসে। এর কারণে মানুষ পেরেশান হয়ে পড়ে। বিশেষত যে ব্যক্তি দীনের পথে চলার ইচ্ছা করে এবং চলতে আরম্ভ করেছে তার মনে এজাতীয় চিন্তা খুব বেশি আসে।

দীনদার মানুষের মনে ওয়াসওয়াসা বেশি আসে:

দীনদারির প্রতি যার কোনো মনোযোগ ও ভ্রুক্ষেপ নেই। সারাদিন দুনিয়াবি কাজকর্মে মগ্ন থাকে। গুনাহর কাজে লিপ্ত থাকে। এমন লোকের মনে এই সব চিন্তা আসে না। এগুলো তাদের মনেই আসে, যারা আল্লাহ তায়ালার রাস্তায় চলতে শুরু করেছে। কোনো কোনো চিন্তা তো এতই ভয়াবহ যে, মানুষ তার ঈমানের ব্যাপারেও আশঙ্কায় পড়ে যায়। কখনো আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে ওয়াসওয়াসা ও দ্বিধা-সংশয় সৃষ্টি হয়। কখনো সংশয় সৃষ্টি হয় রাসূল সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম সম্পর্কে। কখনো কোরআন মজিদ ও হাদিস শরিফ সম্পর্কে। শরিয়তের বিধি-বিধান সম্পর্কে। এ সময় কঠিন নির্দেশনা না পেলে গোমরাহিতে পড়ে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা থাকে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে হেফাজত করুন।

সেদিকে মনোযোগ দিবে না:

ওয়াসওয়াসার চিকিৎসা সম্পর্কে হজরত থানবি (রহ.) বলেন, এ সমস্যার সমাধান হলো অমনোযোগিতা। মন্দ চিন্তা আসলে আসুক। সেদিকে মনোযোগ দেয়ার প্রয়োজন নেই। এই চিন্তাই মাথায় আনবে না যে, কী সব বাজে চিন্তা মথায় আসছে!

ওয়াসওয়াসা ঈমানের আলামত:

মনে রাখবেন, এই ওয়াসওয়াসা ও কুচিন্তাও ঈমানের আলামত। হাদিস শরিফে এসেছে, এক সাহাবি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, হে আলাহর রাসূল, অনেক সময় আমার মনে এমন বাজে চিন্তা উদয় হয়, যা মুখে উচ্চারণ করার চেয়ে আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়াও আমার কাছে অধিক প্রিয় ও পছন্দনীয়। এই অবস্থায় আমি কী করতে পারি? নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জবাব দিলেন,

ذلك صريح الإيمان

এটা খাঁটি ঈমানের আলামত। (মুসলিম, আবুদাউদ)।

মনে এই সব ওয়াসওয়াসা ও বাজে চিন্তা খাঁটি ও নির্ভেজাল ঈমানের আলামত। কেননা এসব চিন্তা কেবল একজন মুমিনের মনেই আসে। গুনাহগার, কাফের ফাসেক ফুজ্জারের মনে এইজাতীয় চিন্তা কখনোই আসবে না।

চোর ওই ঘরেই সিঁদ কাটে যাতে সম্পদ আছে:

হজরত হাজি ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কি (রহ.) এই হাদিসেরই ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, চোর এমন গৃহস্থের বাড়িতেই যায়, যার ঘরে অর্থ-সম্পদ আছে। যে ঘরে কিছু নেই, চোর সেখানে কেন যাবে? কিন্তু এই (শয়তান) চোর ওই অন্তরেই কুমন্ত্রণা দেয় যার ভেতরে ঈমানের দৌলত আছে। অন্তরে যদি আল্লাহ তায়ালা ও তার রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ঈমান না থাকত তা হলে শয়তান সেখানে গিয়ে কুমন্ত্রণা দেয়ার প্রয়োজন মনে করত না। তাই যখন মনে কোনো ওয়াসওয়াসা ও বাজে চিন্তা আসে তখন প্রথম কর্তব্য হলো আল্লাহ তায়ালার শোকর আদায় করা। আলহামদুলিল্লাহ, আমার অন্তরে ঈমান আছে। তা না হলে এই সব চিন্তা আমার মনে সৃষ্টি হত না।

মন্দ চিন্তায় উদ্বিগ্ন হওয়া ঈমানের আলামত:

যখন আপনার মনে এই সব চিন্তা আসে তখন আপনি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। এগুলো আপনার কাছে খারাপ মনে হয়। অন্তরে যদি ঈমান না থাকত তা হলে আপনি উদ্বিগ্নও হতেন না। একে মন্দও মনে করতেন না। বোঝা গেল অন্তরে ঈমানের দৌলত আছে।

ওয়াসওয়াসা কেন আসে?

কোরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা মুমিনদেরকে সান্তনা দিয়ে ইরশাদ করেছেন,

إنما النجوى من الشيطان ليحزن الذين آمنوا و ليس بضارهم شيئا إلا بإذن الله

‘শয়তানের পক্ষ থেকে যেসব মন্দ ভাবনা সৃষ্টি হয় এগুলো প্রকৃতপক্ষে শয়তানের কুমন্ত্রণা। এভাবে সে মুমিনদেরকে পেরেশানিতে ফেলতে চায়। এরপর আল্লাহ তায়ালা বলেন, এই কুমন্ত্রণা মুমিনদেরকে চুল পরিমাণ ক্ষতি করতে পারে না, আল্লাহ তায়ালার হুকুম ছাড়া।’ (সূরা: মুজাদালা, আয়াত: ১০)।

এই জন্য ওয়াসওয়াসা যখন আপনাকে বিরক্ত করে তুলবে তখন মনে করুন, এটা ঈমানের আলামত। শয়তান তার উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা করছে। তাকে বলে দিন, ঠিক আছে, তুমি তোমার মতো চেষ্টা কর। আমিও আমার মত চেষ্টা করছি। এরপর কাজে মগ্ন হয়ে যান। অন্যদিকে এই সব ওয়াসওয়াসা নিয়ে গুরুত্ব দিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা কীভাবে এটা দূর করা যায়, এই চিন্তায় পড়ে গেলে আপনি এখানেই আটকে যাবেন। সামনে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হবে না। এভাবে শয়তানের উদ্দেশ্য পূরণ হয়ে যাবে।

ওয়াসওয়াসার দৃষ্টান্ত:

হজরত থানবি (রহ.) একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টা বুঝিয়েছেন। তিনি বলেন, ধর কারো কাছে বাদশার পক্ষ থেকে আমন্ত্রণপত্র এসেছে, অমুক সময় দরবারে উপস্থিত হবে। তার সঙ্গে তোমাকে সাক্ষাতের সুযোগ দেয়া হবে। তোমাকে পুরস্কৃত করা হবে। আমন্ত্রিত ব্যক্তি প্রস্তুত হয়ে দরবারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। পথিমধ্যে দুইটা কুকুর রাস্তার দুইপাশে দাঁড়িয়ে ঘেউ ঘেউ করতে লাগল। এই মুহূর্তে তার কী করা উচিত? এই ব্যক্তি কী যথাসময়ে দরবারে পৌঁছার জন্য কোনো দিকে না তাকিয়ে দ্রুত পথ চলবে নাকি কুকুরের চিৎকার বন্ধ করার চেষ্টায় লেগে যাবে? বুদ্ধিমানের কাজ কী হবে? যদি সে কুকুর তাড়ানোর পিছনে ছুটতে থাকে তা হলে সময়মত দরবারে পৌঁছা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। তাই বুদ্ধিমানে কাজ হলো, কুকুর চিৎকার করতে থাকুক, তুমি যেখানে যেতে চাচ্ছ সেখানে কীভাবে দ্রুত পৌঁছা যায় সেই চিন্তা কর। তুমি যদি কুকুর তাড়ানোর চিন্তায় পড়ে যাও তা হলে দরবারে পৌঁছার সুযোগ তোমার হাতছাড়া হয়ে যাবে।

এমনিভাবে তোমরা যেই ইবাদত করছ এটা হলো আল্লাহ তায়ালার দরবারে উপস্থিতি। এই সৌভাগ্যের মুহূর্তে যেসব বিক্ষিপ্ত চিন্তা তোমার অন্তরে সৃষ্টি হচ্ছে এগুলো হলো কুকুরের ঘেউ ঘেউ। যদি তোমরা সেদিকে মনোযোগ দাও, সেগুলো দূর করার চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড় তা হলে শয়তানের উদ্দেশ্য হাসিল হবে। আর তোমরা সাক্ষাতের সৌভাগ্য থেকে বি ত হবে।

ওয়াসওয়াসার সময় নিজের কাজে মশগুল থাকুন:

এই জন্য এই সব বিক্ষিপ্ত চিন্তা-ভাবনার সমাধান হলো, সেইদিকে একদম মনোযোগ না দেয়া। কোন চিন্তা এল আর কোন চিন্তা গেল, কোন প্রশ্ন এল আর কোন গেল, এই চিন্তায় না পড়ে নিজের কাজে ব্যস্ত থাকুন। যেমন, এখন নামাজ পড়ার সময়। আপনার মনে যে ভাবনাই আসুক আপনি নামাজে মশগুল হয়ে যান। এখন তেলাওয়াতের সময়। মনে যত চিন্তা আসুক আপনি তেলাওয়াতে মশগুল হয়ে যান। এভাবে কাজের সময় হয়ে থাকলে, কাজে লেগে পড়ুন। মোটকথা, এইসব ওয়াসওয়াসা ও চিন্তা-ভাবনাকে আপনার নির্ধারিত কাজে প্রতিবন্ধক হওয়ার সুযোগ দেবেন না। ওয়াসওয়াসা দূর করার এটাই সমাধান।

ওয়াসওয়াসা দূর করার আরেকটি পদ্ধতি:

মুফতি মুহাম্মদ শফি (রহ.) বলতেন, যদি কোথাও অন্ধকার হয়ে আসে তবে তার সমাধান এই না যে, তুমি লাঠি নিয়ে অন্ধকার তাড়াতে নেমে পড়বে। কেননা এভাবে অন্ধকার দূর করা যায় না। অন্ধকার দূর করার পন্থা এই যে, তুমি একটি বাতি জ্বালিয়ে দাও। বাতির আলো যেই পর্যন্ত পৌঁছবে অন্ধকার সেখান থেকে বিদায় নেবে। মানুষের মনে যেসব ওয়াসওয়াসা ও কুচিন্তা, দ্বিধা-সংশয় সৃষ্টি হয় সেগুলোও এক ধরনের অন্ধকার। একে তাড়ানোর চেষ্টায় লেগে যাওয়া এর সমাধান না। বরং তোমার মনে আল্লাহ তায়ালার স্মরণের বাতি জ্বালাও। বন্দেগি ও আনুগত্যের চেরাগ জ্বালাও। দেখবে আঁধার দূর হয়ে গেছে।

অন্য চিন্তায় মগ্ন হয়ে যাও:

এ ধরনের চিন্তা যদি বেশি আসে তা হলে হজরত থানবি (রহ.) এভাবে এর সমাধান দিয়েছেন যে, এ ক্ষেত্রেও তা দূর করার চিন্তা করা ঠিক না। কেননা দূর করার যতই চেষ্টা করবে ততই তা জোড়ালো হবে। এ জন্য এসময় অন্য কাজে মনোনিবেশ করবে কিংবা অন্য চিন্তায় মশগুল হয়ে পড়বে।
দর্শনশাস্ত্রে আছে-

النفس لا تتوجه إلى شيئين في آن واحد

মানুষের চিন্তা একই সময়ে দুই বিষয়ে নিবদ্ধ হয় না। এ জন্য তুমি যদি নিজেকে কাজে বা বিষয়ে ব্যস্ত কর তা হলে প্রথম চিন্তা এমনিতেই দূর হয়ে যাবে।

والله اعلم بالصواب

উত্তর দিয়েছেনঃ মুসলিম বাংলা ফাতওয়া বিভাগ

মন্তব্য ()

কোনো মন্তব্য নেই।

এ সম্পর্কিত আরও জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

৫০০৫১

ইবনে জুরাইজ এর ঘটনা


২৮ ডিসেম্বর, ২০২৩

বাজিতপুর

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি

৪৪৬০৮

মুখের জড়তা দূর করার উপায়


২ নভেম্বর, ২০২৩

ঢাকা ১২০৫

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি

৫৫৮০৬

তারাবি নামাযের বিধান


১৩ মার্চ, ২০২৪

Chattogram

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী মুহাম্মাদ রাশেদুল ইসলাম

৪৫৫৪২

বিবাহের মৌলিক শর্ত


১২ নভেম্বর, ২০২৩

ঢাকা

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি

Logoমুসলিম বাংলা
play storeapp store
TopOfStack Software © 2025 All rights reserved. Privacy Policy