আপনার জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

সকল মাসায়েল একত্রে দেখুন

ইমাম বুখারী রহিমাহুল্লাহ এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

প্রশ্নঃ ১০০৯২১. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহির নাম উপাধি জন্মস্থান জানতে চাই,

২৭ এপ্রিল, ২০২৫

আত্রাই

উত্তর

و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم


ইমাম বুখারী (রহ)

নাম মুহাম্মদ ইবন ইসমাঈল। কুনিয়াত আবূ আবদুল্লাহ। লকব : শায়খুল ইসলাম ও আমীরুল মু'মিনীন ফীল হাদীস।

বংশ পরিচয় : মুহাম্মদ ইবন ইসমাঈল ইবন ইবরাহীম ইবন মুগীরা ইবন বারদিয়বাহ, আল জুফী আল বুখারী। ইমাম বুখারী (র)-এর ঊর্ধ্বতন পুরুষ বারদিয়বাহ ছিলেন অগ্নিপূজক। 'বারদিযবাহ' শব্দটি ফারসী। এর অর্থ কৃষক। তাঁর পুত্র মুগীরা বুখারার গভর্নর ইয়ামান আল-জু'ফী-এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন। এজন্য ইমাম বুখারীকে আল-জু'ফী আর বুখারার অধিবাসী হিসেবে বুখারী বলা হয়।

ইমাম বুখারীর প্রপিতামহ মুগীরা এবং পিতামহ ইবরাহীম সম্বন্ধে ইতিহাসে বিশেষ কোন তথ্য পাওয়া যায় না। অবশ্য জানা যায় যে, তাঁর পিতা ইসমাঈল (র) একজন মুহাদ্দিস ও বুযুর্গ ব্যক্তি ছিলেন। ইমাম মালিক, হাম্মাদ ইবন যায়দ ও আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক (র) প্রমুখ প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসের কাছে তিনি হাদীস শিক্ষা লাভ করেন। তিনি জীবনে কখনও হারাম বা সন্দেহজনক অর্থ উপার্জন করেন নি। তাঁর জীবিকা নির্বাহের উপায় ছিল ব্যবসাবাণিজ্য। তাঁর আর্থিক অবস্থা ছিল সচ্ছল।

জন্ম ও মৃত্যু : ইমাম বুখারী ১৯৪ হিজরীর ১৩ই শাওয়াল জুমু'আর দিন জুমু'আর সালাতের কিছু পরে বুধারায় জন্ম গ্রহণ করেন। এবং ২৫৬ হিজরীর ১লা শাওয়াল শনিবার ঈদের রাতে ইশার সালাতের সময় সমরকন্দের নিকটে খারতাংগ নামক পল্লীতে ইনতিকাল করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ১৩ দিন কম ৬২ বছর। খারতাংগ পল্লীতেই তাঁকে দাফন করা হয়।

ইমাম বুখারী (র)-এর শিশু কালেই পিতা ইসমাঈল (র) ইনতিকাল করেন। তাঁর মাতা ছিলেন পরহেযগার ও বুদ্ধিমতী। স্বামীর রেখে যাওয়া বিরাট ধনসম্পত্তির দ্বারা তিনি তাঁর দুই পুত্র আহমদ ও মুহাম্মদকে লালন পালন করতে থাকেন। শৈশবে রোগে আক্রান্ত হলে মুহাম্মদের চোখ নষ্ট হয়ে যায়, অনেক চিকিৎসা করেও যখন তাঁর চোখের দৃষ্টিশক্তি কিছুতেই ফিরে এল না, তখন তাঁর মা আল্লাহর দরবারে খুব কান্নাকাটি ও দু'আ করতে থাকেন। এক রাতে তিনি স্বপ্নে দেখেন যে, এক বুযুর্গ ব্যক্তি তাঁকে এই বলে সান্ত্বনা দিচ্ছেন যে, তোমার কান্নাকাটির ফলে আল্লাহ তা'আলা তোমার ছেলের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছেন। স্বপ্নেই তিনি জানতে পারলেন যে, এই বুযুর্গ হযরত ইবরাহীম (আ)। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতে পেলেন যে, সত্যই তাঁর পুত্রের চোখের দৃষ্টিশক্তি ফিরে এসেছে। বিষয় ও আনন্দে তিনি আল্লাহর দরবারে দু'রাকআত শোকরানা সালাত আদায় করেন।

পাঁচ বছর বয়সেই মুহাম্মদকে বুখারার এক প্রাথমিক মাদরাসায় ভর্তি করে দেওয়া হয়। মুহাম্মদ বাল্যকাল থেকেই প্রখর স্মৃতিশক্তি ও মেধার অধিকারী ছিলেন। মাত্র ছয় বছর বয়সেই তিনি কুরআন মজীদ হিফজ করে ফেলেন এবং দশ বছর বয়সে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। দশ বছর বয়সে তিনি হাদীসশস্ত্র অধ্যয়নের জন্য বুঝারার শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ইমাম দাখিলী (র)-এর হাদীস শিক্ষা কেন্দ্রে প্রবেশ করেন। সে যুগের নিয়মানুসারে তাঁর সহপাঠীরা খাতা-কলম নিয়ে উস্তাদ থেকে শ্রুত হাদীস লিখে নিতেন, কিন্তু ইমাম বুখারী (র) সাধারণত খাতা-কলম কিছুই সঙ্গে নিতেন না। তিনি মনোযোগের সাথে উস্তাদের বর্ণিত হাদীস শুনতেন। ইমাম বুখারী (র) বয়সে সকলের ছেয়ে ছোট্ট ছিলেন। সহপাঠীরা তাকে প্রতিদিন এই বলে ভর্ৎসনা করত যে, খাতা-কলম ছাড়া তুমি অনর্থক কেন এসে বস? একদিন বিরক্ত হয়ে তিনি বললেন : তোমাদের লিখিত খাতা নিয়ে এস। এতদিন তোমরা যা লিখেছ তা আমি মুখস্থ শুনিয়ে নেই। কথামত তারা খাতা নিয়ে বসল আর এত দিন শ্রুত কয়েক হাযার হাদীস ইমাম বুখারী (র) হুবহু ধারাবাহিক শুনিয়ে দিলেন। কোথাও কোন ভুল করলেন না। বরং তাদের লেখায় ভুল-ত্রুটি হয়েছিল, তারা তা শুনে সংশোধন করে নিল। বিস্ময়ে তারা হতবাক হয়ে গেল। এই ঘটনার পর ইমাম বুখারী (র)-এর প্রখর স্মৃতিশক্তির কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।

ষোল বছর বয়সে ইমাম বুখারী (র) বুখারা ও তার আশেপাশের শহরের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসগণ থেকে বর্ণিত প্রায় সকল হাদীস মুখস্থ করে নেন। সেই সঙ্গে মুসলিম বিশ্বের খ্যাতিমান মুহাদ্দিস আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক ও ওয়াকী ইবনুল জাররাহ (র)-এর সংকলিত হাদীস গ্রন্থসমূহ মুখস্থ করে ফেলেন। এরপর তিনি মা ও বড় তাই আহমদের সঙ্গে হজ্জে গমন করেন। হজ্জ শেষে বড় ভাই ও মা ফিরে আসেন। ইমাম বুখারী (র) মক্কা মুকাররমা ও মদীনা তাইয়্যেবায় কয়েক বছর অবস্থান করে উভয় স্থানের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসগণের নিকট থেকে হাদীস শিক্ষা লাভ করতে থাকেন। এই সময়ে তিনি 'কাযায়াস-সাহাবা ওয়াত-তাবিঈন' শীর্ষক তাঁর প্রথম গ্রন্থ রচনা করেন। এরপর মদীনায় অবস্থানকালে চাঁদের আলোতে 'ভারীখে কবীর' লিখেন।

ইমাম বুখারী (র) হাদীস সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের বিখ্যাত জ্ঞানকেন্দ্র কুফা, বসরা, বাগদাদ, সিরিয়া, মিসর, খুরাসান প্রভৃতি শহরে বার বার সফর করেন। সেই সকল স্থানের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসদের থেকে তিনি হাদীস শিক্ষালাভ করেন। আর অন্যদের তিনি হাদীস শিক্ষাদান করতে থাকেন এবং সঙ্গে সঙ্গে গ্রন্থ রচনায়ও ব্যাপৃত থাকেন। তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি 'জামি' সহীহ বুখারী শরীফ সর্বপ্রথম মক্কা মুকাররমায় মসজিদে হারামে প্রণয়ন শুরু করেন এবং দীর্ঘ ষোল বছর সময়ে এই বিরাট বিশুদ্ধ গ্রন্থ রচনা সমাপ্ত করেন। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইমাম বুখারী (র) অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন। তিনি নিজেই বলেছেন যে, একলাখ সহীহ ও দুই লাখ গায়ের সহীহ হাদীস তাঁর মুখস্থ ছিল। তাঁর এই অস্বাভাবিক ও বিস্ময়কর স্মৃতিশক্তির খ্যাতি সারা মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিভিন্ন শহরের মুহাদ্দিসগণ বিভিন্নভাবে তাঁর এই স্মৃতিশক্তির পরীক্ষা করে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছেন এবং সকলেই স্বীকার করেছেন যে, হাদীসশাস্ত্রে তিনি আমীরুল মুমিনীন। এ সম্পর্কে তাঁর জীবনী গ্রন্থে বহু চমকপ্রদ ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। মাত্র এগার বছর বয়সে বুখারার বিখ্যাত মুহাদ্দিস 'দাখিলী'র হাদীস বর্ণনা কালে যে ভুল সংশোধন করে দেন, হাদীস বিশারদগণের কাছে তা সত্যিই বিস্ময়কর।

ইমাম বুখারী (র) এক হাজারেরও বেশী সংখ্যক মুহাদ্দিস থেকে হাদীস শিক্ষা লাভ করেছেন। তাঁদের মধ্যে মক্কী ইবন ইবরাহীম, আবূ আসিম, ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল, আলী ইবনুল মাদানী, ইসহাক ইবন রাহওয়াসহ, হুমায়দী, ইয়াহ্ইয়া, উবায়দুল্লাহ ইবন মুসা, মুহাম্মদ ইবন সালাম আল বায়কান্দী ও মুহাম্মদ ইবন ইউসুফ আল ফারইয়াবী (র) প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর উস্তাদদের অনেকেই তাবিঈদের থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। আবার তিনি তাঁর বয়ঃকনিষ্ঠদের থেকেও হাদীস বর্ণনা করেছেন।

ইমাম বুখারী (র) থেকে বুখারী শরীফ শ্রবণকারীর সংখ্যা নব্বই হাজারেরও অধিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়াও তাঁর ছাত্রসংখ্যা বিপুল। তাঁদের মধ্যে ইমাম মুসলিম, ইমাম তিরমিযী, আবূ হাতিম আর রাখী (র) প্রমুখ প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিসের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।

ইমাম বুখারী (র) মহৎ চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। দান-খয়রাত করা তাঁর স্বভাবে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। উত্তরাধিকারসূত্রে তিনি পিতার বিরাট ধন-সম্পত্তির অধিকারী হয়েছিলেন কিন্তু তিনি তাঁর সবই গরীব দুঃখী ও হাদীস শিক্ষার্থীদের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছেন। তিনি নিজে অতি সামান্য আহার করতেন। কখনও কখনও মাত্র দুই তিনটি বাদাম খেয়ে সারাদিন কাটিয়ে দিয়েছেন। বহু বছর তরকারী ছাড়া রুটি খাওয়ার ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।

ইমাম বুখারী (র)-এর সততা জনশ্রুতিতে পরিণত হয়েছিল। প্রসঙ্গত এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। আবূ হাফস (র) একবার তাঁর কাছে বহু মূল্যবান পণ্যদ্রব্য পাঠান। এক ব্যবসায়ী তা পাঁচ হাজার দিরহাম মুনাফা দিয়ে খরিদ করতে চাইলে তিনি বললেনঃ তুমি আজ চলে যাও, আমি চিন্তা করে দেখি। পরের দিন সকালে আরেক দল ব্যবসায়ী এসে দশ হাযার দিরহাম মুনাফা দিতে চাইলে তিনি বললেনঃ গতরাতে আমি একদল ব্যবসায়ীকে দিবার নিয়্যাত করে ফেলেছি; কাজেই আমি আমার নিয়্যাতের খেলাফ করতে চাই না। পরে তিনি তা পূর্বোক্ত ব্যবসায়ীকে পাঁচ হাযার দিরহামের মুনাফায়ই দিয়ে দিলেন। নিয়্যাত বা মনের সংকল্প রক্ষা করার জন্য পাঁচ হাযার দিরহাম মুনাফা ছেড়ে দিতে তিনি দ্বিধাবোধ করেন নি। ইমাম বুখারী (র) বলেনঃ আমি জীবনে কোন দিন কারো গীবত শিকায়াত করিনি। তিনি রামাযান মাসে পুরো তারাবীতে এক খতম, প্রতিদিন দিবাভাগে এক খতম এবং প্রতি তিন রাতে এক খতম কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করতেন। একবার নফল সালাত আদায় কালে তাঁকে এক বিচ্ছু ষোল সতেরো বার দংশন করে, কিন্তু তিনি যে সূরা পাঠ করছিলেন তা সমাপ্ত না করে সালাত শেষ করেন নি। এভাবে তাকওয়া-পরহেযগারী, ইবাদত-বন্দেগী দান-খয়রাতের বহু ঘটনা তাঁর জীবনীকারগণ বর্ণনা করেছেন, যা অসাধারণ ও বিস্ময়কর।

ইমাম বুখারী (র)-কে জীবনে বহু বিপদ ও কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছে। হিংসুকদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে তিনি অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেন। বুখারার গভর্নর তাঁর দুই পুত্রকে প্রাসাদে গিয়ে বিশেষভাবে হাদীস শিক্ষাদানের আদেশ করেন। এতে হাদীসের অবমাননা মনে করে ইমাম বুখারী (র) তা প্রত্যাখ্যান করেন। এ সুযোগে দরবারের কিছু সংখ্যক হিংসুকের চক্রান্তে তাঁকে শেষ বয়সে জন্মভূমি বুখারা ত্যাগ করতে হয়েছিল। এ সময় তিনি সমরকন্দবাসীর আহবানে সেখানে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। পরিমধ্যে খারতাংগ পল্লীতে তাঁর এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে উঠলেন। সেখানে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং পয়লা শাওয়াল শনিবার ২৫৬ হিজরীতে ইন্তিকাল করেন। দাফনের পর তাঁর কবর থেকে সুগন্ধি বিচ্ছুরিত হতে থাকে। লোকে দলে দলে তাঁর কবরের মাটি নিতে থাকে। কোনভাবে তা নিবৃত্ত করতে না পেরে পরে কাঁটা দিয়ে ঘিরে তাঁর কবর রক্ষা করা হয়। পরে জনৈক ওলীআল্লাহ মানুষের আকীদা নষ্ট হওয়ার আশংকায় সে সুঘ্রাণ বন্ধ হওয়ার জন্য দু'আ করেন এবং তার পর তা বন্ধ হয়ে যায়।

والله اعلم بالصواب

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী নাঈম সিদ্দীকী বিন আব্দুস সাত্তার
শিক্ষক, হাদীস ও ফিকহ বিভাগ
মারকাযুশ শরীয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা

প্রসঙ্গসমূহ:

মন্তব্য ()

কোনো মন্তব্য নেই।

এ সম্পর্কিত আরও জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

৩৮৩৬৫

মাওলানা মওদুদী এবং তাফহিমুল কুরআনের অসঙ্গতি


২০ আগস্ট, ২০২৩

West Bengal ৭৪২০০০

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুসলিম বাংলা ইফতা বিভাগ

৮১৬২

হযরত থানবী রহ. এর ফতোয়া কি গ্রহনযোগ্য


২৯ জানুয়ারী, ২০২৫

পুরাতন বান্দুরা

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মোহাম্মদ আমীর হোসাইন, মুফতি ও মুহাদ্দীস,

Logoমুসলিম বাংলা
play storeapp store
TopOfStack Software © 2025 All rights reserved. Privacy Policy