প্রবন্ধ

তাফবীযে তালাক স্ত্রীর তালাক গ্রহণ প্রসঙ্গ

লেখক:মুফতী শাব্বীর আহমাদ
৭ অক্টোবর, ২০২৪
১৩১৫৭ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

তালাক আবগাযুল মুবাহাত তথা নিকৃষ্টতম বৈধ কাজ। অতএব এর ব্যবহার একেবারেই নিয়ন্ত্রিত হওয়া জরুরি। আর এজন্যই তালাকের অধিকার পুরুষকে দেওয়া হয়েছে। কেননা চিন্তাশক্তি ও ধৈর্যের সামর্থ্য স্ত্রী লোক অপেক্ষা পুরুষের মধ্যে অনেক বেশি। এতে করে সাধারণ বিরক্তির প্রভাবে ব্যাপক হারে তালাক সংঘটিত হবে না। তবে কোনো দম্পত্তির বৈবাহিক সম্পর্ক যদি উভয়ের জন্য অকল্যাণকর প্রমাণিত হয়। তখন ওই কষ্টের বেড়াজাল থেকে বের হওয়ার জন্য শরীয়ত তালাকের বিধান রেখেছে। কিন্তু কোনো স্বামী যেন এমন পরিস্থিতিতে তালাকের পথ অবলম্বন না করে স্ত্রীকে আটকে রেখে তার উপর জুলুম-নির্যাতন করতে না পারে সেজন্য শরীয়ত 'তাফবীযে তালাক'-এর প্রবর্তন করেছে।


স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে তালাক গ্রহণের পূর্ব ক্ষমতা অর্পণকে শরীয়তের পরিভাষায় তাফবীয বলে। এ ক্ষমতা বলে স্ত্রী নিজের উপর তালাক গ্রহণের অধিকার লাভ করে। এ তাফবীয বা তালাক গ্রহণের ক্ষমতা প্রদান বিয়ে পরবর্তী যে কোনো সময় হতে পারে। বিয়ের সময় উভয় পক্ষের সমঝোতার মাধ্যমে স্বামী থেকে এ অধিকার নেওয়ার সুযোগও আছে। কাবিননামার ১৮ নং ধারাটি মূলত এ উদ্দেশ্যেই রাখা হয়েছে। এ অধিকার শর্ত সাপেক্ষেও হতে পারে আবার বিনা শর্তেও হতে পারে। যদি শর্ত সাপেক্ষে হয় তাহলে সে শর্ত পাওয়া গেলেই কেবল স্ত্রী এ অধিকার লাভ করবে এবং নিজের উপর তালাক গ্রহণ করতে পারবে, অন্যথায় নয়।


স্ত্রী তালাক গ্রহণ করবে, প্রদান করবে না


প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যেহেতু শরীয়তের দৃষ্টিতে সর্বাবস্থায় তালাকদাতা স্বামী আর স্ত্রী তালাকের পাত্র, তাই স্বামী প্রদত্ত ক্ষমতা বলে স্ত্রী নিজের উপর তালাক গ্রহণ করবে। তাফবীযের ক্ষমতা বলে স্ত্রী স্বামীকে তালাক দিচ্ছে, বিষয়টি এমন নয়। অথচ আমাদের সমাজে এ তাফবীযের ক্ষমতা বলে 'স্ত্রী স্বামীকে তালাক (ডিভোর্স) দিয়েছে' বলতে শোনা যায়। কোথাও কোথাও তালাকনামায় স্ত্রীকে এ কথা লিখতে দেখা যায় যে, 'স্বামী কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতা বলে স্বামীকে তালাক দিলাম'। অথচ তা সঠিক নয়। স্বামীকে তালাক দেওয়া যায় না। এ ক্ষমতা বলে স্বামী থেকে তালাক গ্রহণ করা যায়। তাই কোনো স্ত্রী উপরোক্ত পদ্ধতিতে লিখলে বা বললে তার উপর কোনো তালাক পতিত হবে না। সে যথারীতি সে স্বামীর স্ত্রী থেকে যাবে। তাই এভাবে এক লিখা বাঞ্ছনীয়- 'আমি কাবিননামার ১৮নং ধারায় স্বামী কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতা বলে নিজের উপর তালাক গ্রহণ করলাম।'


আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী রহ. বলেন,

 إذا قَالَ أَنَا مِنْكَ طَالِقٌ يَلْغُو اهـ……. وَأَيْضًا فَإِنَّ قَوْلَهُ أَنَا منك طالق فيه وصف الرَّجُل بالطلاق صَرِيحًا فَلا يقع لأن الطلاق صفة للمرأة (رد المحتار) (٣/ ٢٥٤)


নিকাহনামা পূরণে বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি 


আমাদের দেশে বিয়ে রেজিস্ট্রেশনের যে সরকারি নিয়ম চালু আছে, বিয়ে সংঘটিত হওয়ার জন্য তা জরুরি নয়। কিন্তু যেহেতু তা বিবাহের লিখিত রূপ এবং স্বীকৃত প্রমাণ তাই তাতে শরীয়তের দৃষ্টিতে দোষেরও কিছু নেই; বরং তা প্রশংসনীয়। কিন্তু এ নিকাহনামা (যাকে অনেকেই কাবিননামা বলে থাকে) পূরণে অনেক সময়ই বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হয়। তাই এ নিকাহনামা পূরণের শরঈ রূপরেখা এখানে পেশ করা হলো। প্রথমে হুবহু নিকাহনামা তুলে ধরা হলো।


বাংলাদেশ ফরম নং ১৬০১

সত্যায়িত প্রতিলিপি

কনের জন্য / বরের জন্য

নিকাহনামা 

১। ওয়ার্ড, শহর, ইউনিয়ন, তহসিল, থানা ও জেলার নাম যেখানে বিবাহকার্য নিষ্পন্ন হইয়াছে:......................

২। নিজ নিজ বাসস্থানসহ বর ও তাহার পিতা এবং মাতার নামঃ......................

৩। বরের বয়স ..........................

৪। নিজ নিজ বাসস্থানসহ কন্যা ও তাহার পিতা এবং মাতার নামঃ

৫। কন্যা কুমারী, বিধবা অথবা তালাকপ্রাপ্তা নারী কি না?

৬। কন্যার বয়স

৭। কন্যা কর্তৃক উকিল নিযুক্ত হইলে ঐ উকিলের নাম এবং তাহার পিতা ও মাতার নামসহ বাসস্থানের ঠিকানা:...........

৮। পিতার নাম, বাসস্থান ও কন্যার সহিত সম্পর্কের বর্ণনাসহ কন্যার উকিল নিয়োগে সাক্ষীদের নামঃ (১)...... (২)........

৯। বর কর্তৃক উকিল নিযুক্ত হইলে ঐ উকিলের নাম এবং তাহার পিতা ও মাতার নামসহ বাসস্থানের ঠিকানা 

১০। পিতা এবং মাতার নাম ও বাসস্থানসহ বরের উকিল নিয়োগের ব্যাপারে সাক্ষীদের নামঃ (১).......... (২).............

১১। বিবাহের সাক্ষীদের নাম, তাহাদের পিতা এবং মাতার নাম ও বাসস্থানের ঠিকানা: (১)......... (২)............

১২। যে তারিখে বিবাহের কথাবার্তা ঠিক হইয়াছিল সেই তারিখ:

১৩। দেনমোহরের পরিমাণ......................

১৪। দোনমোহরের কি পরিমাণ মু'য়াজ্জাল এবং কি পরিমাণ মু'অজ্জল

১৫। বিবাহের সময় দেনমোহরের কোন অংশ পরিশোধ করা হইয়াছে কিনা? যদি হইয়া থাকে তবে উহার পরিমাণ কত?......

১৬। বিশেষ বিবরণ ও পক্ষগণের মধ্যে চুক্তিসূত্রে নির্ণীয় মূল্যসহ কোন সম্পত্তি সম্পূর্ণ দেনমোহর বা উহার অংশ বিশেষের পরিবর্তে প্রদত্ত হইয়াছে কিনা?......................

১৭। বিশেষ শর্তাদি থাকিলে তাহা: ......................

১৮। স্বামী স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা প্রদান করিয়াছে কি না? করিয়া থাকিলে কি কি শর্তে......................

১৯। স্বামীর তালাক প্রদানের অধিকার কোন প্রকারে খর্ব হইয়াছে কিনা?......................

২০। বিবাহের সময় দেনমোহর, খোরপোষ ইত্যাদি সম্পর্কে কোন দলিল করা হইয়াছে কিনা? যদি হইয়া থাকে তবে উহার সংক্ষিপ্ত বিবরণ......................

২১। বরের কোন স্ত্রী বর্তমানে আছে কিনা এবং থাকিলে অদ্য বিবাহে আবদ্ধ হইবার জন্য বর ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ মোতাবেক সালিসী কাউন্সিলের অনুমতি লইয়াছে কিনা?.......................

২২। অন্য বিবাহে আবদ্ধ হইবার জন্য সালিসী কাউন্সিলের নিকট হইতে বরের নিকট প্রেরিত অনুমতিপত্রের নম্বর ও তারিখ :......................

২৩। যে ব্যক্তির দ্বারা বিবাহ পড়ানো হইয়াছে তাহার নাম ও তাহার পিতা এবং মাতার নাম:.........................

২৪। বিবাহ রেজিস্ট্রি করার তারিখ:........................

২৫। পরিশোধিত রেজিস্ট্রি ফিস:......................

এরপর বর, কনে, উভয় পক্ষের উকিল, সাক্ষী এবং যিনি পড়িয়েছেন তার স্বাক্ষর ও সীলের ঘর থাকে।


বিয়ের পূর্বে কাবিননামা পূরণ করা


আমাদের দেশের কোনো কোনো এলাকায় উক্ত নিকাহনামা বা কাবিননামাটি বিবাহের দু-একদিন আগেই আনুষ্ঠানিকভাবে পূরণ করে নেওয়া হয়। যাকে সমাজে কাবিন করে নেওয়া বলা হয়। আবার কোথাও তা বিবাহের সময়ই পূরণ করা হয়। কিন্তু অধিকাংশ সময় দেখা যায় শরঈ নিয়মে বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার পূর্বেই কাজি সাহেব তা পূরণ করে বর-কনে ও সাক্ষীদের সাক্ষর নিয়ে নেয়। পরে ইজাব-কবুলের মাধ্যমে বিবাহ পড়ানো হয়। আবার কোথাও কাজি সাহেব বিবাহের পূর্বে কাবিননামা পূরণ করা ছাড়াই সবার দস্তখত নিয়ে নেয়। পরে নিজ ইচ্ছামতো তা পূরণ করে। সমাজে প্রচলিত এ সকল পদ্ধতি শরীয়তের দৃষ্টিয়ে নিতান্তই ভুল।


বাংলাদেশ সরকারের নিকাহনামা ফরম যা কাবিননামা বলে পরিচিত, এটি বিবাহের পরে পূর্ণ করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত সরকারি আইনও একথা বলে যে, বিবাহের পরেই ফরমটি পূরণ করতঃ সংঘটিত বিবাহকে সরকারি রেজিস্ট্রারভুক্ত করা হবে। সুতরাং বিবাহের পূর্বে ফরম পূর্ণ করা একেতো আইনসিদ্ধ নয়। দ্বিতীয়ত, বিবাহের আগে পূরণ করলে অনেক ক্ষেত্রেই মিথ্যা লিখতে হয়।


যেমন: ফরমটির ১ম অনুচ্ছেদে আছে, ওয়ার্ড, শহর, ইউনিয়ন, তহসিল, থানা ও জেলার নাম যেখানে বিবাহকার্য নিষ্পন্ন হইয়াছে। যেহেতু এখনো বিয়ের কাজ সম্পন্ন হয়নি তাই তা পূরণ মানে মিথ্যা লিখা। তদ্রূপ অন্যান্য অনুচ্ছেদেও মিথ্যা লিখতে হবে। তৃতীয়ত, বিবাহের পূর্বে ফরমটি পূরণ করে ফেললে আরেকটি জটিল সমস্যা সৃষ্টি হয়, আর তা হলো কাবিননামার ১৮ নং ধারাটি বিবাহের পর স্ত্রীর তালাক গ্রহণ সংক্রান্ত ধারা। আর স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক গ্রহণের ক্ষমতা তখনই দিতে পারবে যখন তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যাবে। তাই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পূর্বে কোনো পাত্র যদি পাত্রীকে তালাক গ্রহণের অনুমতি প্রদান করে তাহলে শরীয়তের দৃষ্টিতে তা ধর্তব্য হবে না। কারণ, বিয়ের আগে পাত্র নিজেই তালাক প্রয়োগের ক্ষমতা রাখে না, সুতরাং সে অন্যকে কীভাবে অধিকার প্রদান করবে? তাই বিয়ের আগে পাত্র বললেও বা অনুমতিপত্রে স্বাক্ষর করলেও পাত্রী বিবাহের পর এ অধিকার লাভ করবে না। বিয়ের আগে ফরমটি পূরণ করে পাত্র যদি তাতে স্বাক্ষরও করে দেয় তবুও এর দ্বারা বিবাহের পর পাত্রী তালাক গ্রহণের অধিকার প্রাপ্ত হবে না।


অধিকন্তু ফরম পূরণ না করে স্বাক্ষর করিয়ে নেওয়া আরও আপত্তিকর। অথচ সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী ওই আগে পূরণ করা ফরমের ভিত্তিতেই স্ত্রী ডিভোর্স নিয়ে নেয় এবং অন্যত্র বিবাহও করে ফেলে অথচ তার ডিভোর্স গ্রহণ কার্যকর হয়নি এবং অন্যত্র বিবাহবন্ধনও বৈধ হয়নি। এক্ষেত্রে ডিভোর্স নেওয়ার পরও সে পূর্বের স্বামীর স্ত্রী থেকে যায়।


অতএব এই ফরম ইজাব-কবুলের মাধ্যমে বিয়ের কাজ সম্পন্ন হওয়ার পরই পূরণ করা আবশ্যক। কখনো যদি বিয়ের আগে পূরণ করা হয় তবে বিয়ের পর অন্তত ১৮ নং ধারাটি পূরণ সম্পর্কে পাত্রকে অবগত করে তার স্বাক্ষর নেওয়া জরুরি। তদ্রূপ বিয়ের পরও নিকাহনামা পূরণ না করে স্বামী-স্ত্রী থেকে স্বাক্ষর নিয়ে নেওয়া এবং পরে কাজি সাহেব নিজের মতো করে তা পূরণ করাও শরীয়তের দৃষ্টিতে আপত্তিকর। বিশেষ করে ১৮ নং ধারাটি। এ ব্যাপারে আমাদের সকলের সতর্ক হওয়া জরুরি।

অবশ্য কেউ যদি বিয়ের আগেই কাবিননামা পূরণ করে নেয় আর তাতে এভাবে লেখে 'যদি আমি অমুকের কন্যা অমুককে বিবাহ করি তাহলে সে তালাকের অধিকার পাবে', সেক্ষেত্রে তাফবীযের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।


কাবিননামার ১৮ নং ধারা পূরণের পদ্ধতি 


আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি, বৈধ কাজসমূহের মধ্যে তালাক হলো নিকৃষ্টতর। তাই এর প্রয়োগে খুবই সতর্ক হওয়া জরুরি। একেবারে নিরুপায় পরিস্থিতি ছাড়া এর প্রয়োগ শরীয়তে কাম্য নয়। তবে যে পরিস্থিতিতে শরীয়তের দৃষ্টিতে তালাক ছাড়া কোনো উপায় থাকে না, তখনও যদি অবিবেচক স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক না দিয়ে আটকে রাখতে চায় তখন সে জুলুম থেকে মুক্তির পথ হিসাবে শরীয়ত 'তাফবীযে তালাকে'র ব্যবস্থা রেখেছে। সুতরাং কাবিননামার ১৮ নং ধারাটি (স্বামী স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা অর্পণ করিয়াছে কি না? করিয়া থাকিলে কি কি শর্তে) শরীয়ত পরিপন্থী নয়। তবে বিষয়টি যেন শরীয়তের রূপরেখা অনুযায়ী সঠিক পদ্ধতিতে সংঘটিত হয় সেজন্য অভিভাবকদের সতর্ক থাকা কাম্য। বিশেষ করে বর্তমান সময়ে তা আরও বেশি জরুরি। কেননা দীন থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণে দাম্পত্য কলহ দিন দিন বেড়েই চলছে। তাই তালাক ও তাফবীযে তালাকের কোনোটিই যেন অপাত্রে ব্যবহৃত না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা জরুরি।


১৮ নং ধারাটি প্রয়োগে আমাদের সমাজে বিভিন্ন ধরনের ভুল ও শরীয়া পরিপন্থী কাজ সংঘটিত হয়ে থাকে। এখন এর কিছু উদাহরণ তুলে ধরা হলো।


এক. বিবাহ রেজিস্ট্রাররা অনেক ক্ষেত্রেই এধারাতে 'তিন তালাক গ্রহণের ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে' লিখে দেয়। অথচ এক তালাকে বায়েনের ক্ষমতা অর্পণ করা হলেই এ উদ্দেশ্য পরিপূর্ণরূপে হাসিল হয়ে যায়। কিন্তু বিবাহ রেজিস্ট্রাররা এসব দিক বিবেচনা না করেই নিজ থেকে তিন তালাকের অনুমতি লিখে ফেলে। ফলে এ ক্ষমতা বলে যখন স্ত্রী সামান্য কারণেই তিন তালাক গ্রহণ করে নেয় এবং এরপর আবার ওই স্বামীর ঘর করতে চায়, তখন আর কিছুই করার থাকে না। অথচ এক তালাকে বায়েন গ্রহণের ক্ষমতা অর্পণ করা হলে দু-দিকেরই সুযোগ থাকে। স্ত্রী চাইলে ইদ্দতের পর অন্যত্র বিয়ে বসতে পারে। আবার তারা দুজন নতুনভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে একত্রে থাকতেও পারে। সুতরাং তিন তালাকের অধিকার না দিয়ে এক তালাকে বায়েনের অধিকার যুক্তিযুক্ত এবং এটিই এ সম্পর্কিত শরঈ নির্দেশনার সঙ্গে অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ।


দুই. যে সকল শর্ত সাপেক্ষে স্ত্রীকে তালাকের ক্ষমতা প্রদান করা হয়ে থাকে সাধারণত ঐগুলো কাজিরা গৎবাঁধা কিছু লিখে থাকে। ছেলে কিংবা মেয়ে পক্ষের মতামত নেওয়া বা এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সুচিন্তিতভাবে লেখার প্রয়োজন মনে করা হয় না। এধারায় সাধারণত যে শর্তগুলো লেখা হয় তার মধ্যে একটি হলো, 'বনিবনা না হলে স্ত্রী তালাক গ্রহণ করতে পারবে।' 


এক্ষেত্রে একটু চিন্তা করলেই বুঝে আসবে, এটি কোনো শর্তই নয়। কারণ সব দম্পত্তিরই যে কোনো কারণে মনোমালিন্য হতে পারে। যখনই মনোমালিন্য হয় তখনই তো বনিবনা না হওয়ার শর্তটি পাওয়া যায় এবং তালাক গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয়। ফলে এটা অনেকটা বিনা শর্তে তালাকের অধিকার প্রদান করার মতোই হচ্ছে। আবার কোনো কোনো কাজি সাহেব লিখেন, 'বনিবনা না হলে, মনের মিল না হলে, যখন ইচ্ছা…..’।


শর্তগুলো এভাবে না লিখে সুচিন্তিতভাবে লেখা উচিত। যেন স্বামী-স্ত্রী উভয়ের অধিকারে ভারসাম্য থাকে। যেন মহিলা সামান্য রাগ হলেই তালাক গ্রহণ করতে না পারে, আবার স্বামী যেন তাকে জুলুম-অত্যাচার করে আটকে রাখতে না পারে। 


আর যেহেতু স্ত্রী একাকি তালাকের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে তাতে তাড়াহুড়া বা বাড়াবাড়ির প্রবল আশঙ্কা থাকে তাই তালাক গ্রহণের ক্ষমতাকে নিম্নোক্ত শর্ত বা এধরনের কোনো শর্তের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া বাঞ্ছনীয়। যেমন: এ ধারাটি এভাবে লেখা যেতে পারে যে, 'পাত্র পাত্রীর উভয় পক্ষের অন্তত একজন করে অভিভাবক যদি এব্যাপারে একমত হন যে, এ দম্পতির একত্রে থাকার চেয়ে বিচ্ছেদই উত্তম তাহলে স্ত্রী নিজে এক তালাকে বায়েন গ্রহণ করতে পারবে।'


তিন. অনেক সময় এধারাটি লিখার আগেই স্বাক্ষর নিয়ে নেওয়া হয়, যেমনটি পূর্বে আলোচিত হয়েছে। আবার কখনো আগে লিখা হলেও তা পাত্রকে শোনানো ছাড়াই অজ্ঞাতসারে তার থেকে স্বাক্ষর নেওয়া হয়। এতে ওই কাবিননামায় পাত্রের স্বাক্ষর করা সত্ত্বেও স্ত্রীকে তালাক গ্রহণের ক্ষমতা অর্পণের বিষয়টি শরীয়তের অথচ দৃষ্টিতে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। তাই বিবাহের আকদ সম্পন্ন হওয়ার পর এ ধারার শর্ত ও স্ত্রীকে তালাক প্রয়োগের ক্ষমতা অর্পণের বিষয়টি পাত্রকে অবহিত করে পাত্রের স্বাক্ষর নেওয়া আবশ্যক। অবশ্যই কাবিননামা পূরণ ও স্ত্রীর তালাক গ্রহণের অধিকারের বিষয়ে সকলের, বিশেষ করে অভিভাবকদের সতর্ক থাকা জরুরি। বিষয়টি শরীয়া অনুযায়ী সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলে পরবর্তী সময়ে কোনো ঝামেলা পোহাতে হবে না। কেবল বিয়ের সময় প্রকরই এ বিষয়টির প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করার কারণেই সমাজে বহু নারী জুলুমের স্বীকার হয়ে থাকেন। অপর দিকে বহু স্বামীও স্ত্রী কর্তৃক হয়ে অবিচারের স্বীকার হন।


প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, স্বামী যদি স্ত্রীর শরঈ ও মানবিক হক আদায়ে অক্ষম হয় বা অবহেলা করে কিংবা শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করে এবং এ বিষয়টি দুই জন স্বীকৃত মুফতী সাহেব প্রদান সত্যায়ন করেন তাহলে সত্যায়নের পর থেকে ছয় মাস পর্যন্ত কিন্তু স্ত্রীর জন্য এক তালাকে বায়েন গ্রহণ করার অধিকার থাকবে। যতবার শর্ত পাওয়া যাবে ততবার ব্যাখ্যা সাপেক্ষে স্ত্রী অধিকার লাভ করবে।


লেখক: সিনিয়র মুহাদ্দিস ও মুশরিফ, ফাতওয়া বিভাগ, মাদরাসা বাইতুল উলূম ঢালকানগর, গেণ্ডারিয়া, ঢাকা-১২০৪

মন্তব্য (...)

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →