প্রবন্ধ

বিবাহ-তালাক কিছু আদাব কিছু আহকাম

লেখক:মুফতী আবদুস সালাম
৭ অক্টোবর, ২০২৪
৫৮৯৬ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

الحمد لله نحمده و نستعينه ونستغفره ونؤمن به ونتوكل عليه ونعوذ بالله من شرور أنفسنا ومن سيئات أعمالنا من يهده الله فلا مضل له ومن يضلله فلا هادي له وأشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له وأشهد أن محمدا عبده ورسوله. صلى الله تعالى عليه وسلم تسليما أما بعد! فأعوذ بالله من الشيطان الرجيم بسم الله الرحمن الرحيم 

وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ فَإِنْ كَرِهْتُمُوهُنَّ فَعَسى أَنْ تَكْرَهُوا شَيْئًا وَيَجْعَلَ اللَّهُ فِيْهِ خَيْرًا كثيرًا [سورة النساء: ١٩ ]

يايها الناسُ اتَّقُوْا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نفس واحدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ منها رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُوْنَ بِهِ وَالْأَرْحَامُ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا. [سورة النساء ١٠ ]


ভূমিকা


নারী-পুরুষ উভয়কে আল্লাহ তাআলাই সৃষ্টি করেছেন। উভয়ের সৃষ্টির উদ্দেশ্য ভিন্ন। তাই উভয়ের আকৃতিও ভিন্ন করেছেন। যেমন: বাস-ট্রাক উভয়ের আকৃতি ভিন্ন, কাজও ভিন্ন, উদ্দেশ্যও ভিন্ন। তেমনি নারী-পুরুষ উভয়ের সৃষ্টির উদ্দেশ্য ভিন্ন, কর্মক্ষেত্রও ভিন্ন। যারা উভয়কে সমান করতে চায় তারা দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞ। আল্লাহ তাআলা স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন পুরুষের প্রশান্তির জন্য। আর পুরুষকে সৃষ্টি করেছেন নারীদের দায়িত্বশীল ও কর্তা হিসেবে। নারী-পুরুষ একজনের জীবন আরেকজন ছাড়া অপূর্ণ। তবে নেকি অর্জনের মাধ্যম এক। উভয়ে ঈমান ও তাকওয়ার উপর চলবে। নেকি অর্জন করবে। আল্লাহ তাআলার এই মহান উদ্দেশ্য অর্জিত হয় বিবাহের মাধ্যমে। 


ইসলামে বিবাহের গুরুত্ব 


বিবাহ একটি চুক্তি। সেই সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতও বটে। বিবাহ এমন একটি ইবাদত যা জান্নাতে হযরত আদম-হাওয়া আলাইহিমাস সালাম এর মাধ্যমে শুরু হয়ে এখন দুনিয়াতেও অব্যাহত রয়েছে। আবার জান্নাতে বিবিও থাকবে। বিবাহ মানবীয় বৈশিষ্ট্য। এটি এ মানবজাতির বিশেষ বৈশিষ্ট্য। আজকাল পত্র-পত্রিকায় দেখা যায়, অনেক জায়গায় পশু-পাখির বিয়ে দেয়। এটি মানব জাতির অপমানের নামান্তর।


আল্লাহ তাআলা আশরাফুল মাখলুকাত মানুষের বংশ বিস্তারের মাধ্যম বানিয়েছেন বিবাহকে। তিনি মানব জাতির বংশ বিস্তারের ক্ষেত্রে সরাসরি কুদরত না দেখিয়ে স্বাভাবিক রীতি (سنة الله) অবলম্বন করেছেন। বিবাহের মাধ্যমে বংশ বিস্তার হবে। এজন্য যেসকল মহিলা সন্তান বেশি জন্ম দেয় রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বিয়ে করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। যেমনটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

تَزَوَّجُوا الْوَدُودَ الْوَلُودَ فَإِنِّي مُكَاثِرٌ بِكُمُ الأمم.

তোমরা এমন নারীদের বিয়ে করো, তার যারা অধিক স্বামীভক্ত ও অধিক সন্তান প্রসবকারীনী। কেননা, আমি তোমাদের দ্বারা সংখ্যাধিক্যের গর্ব করব।-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২০৫০


মানববংশ বৃদ্ধি করা আল্লাহ তাআলার কাজ। তিনি তা সরাসরি না করে মানুষের মাধ্যমে করাচ্ছেন। মানুষকে এই কাজে আগ্রহী করতে বিবাহের মাঝে একটি জাগতিক সুবিধাও দিয়ে দিয়েছেন। বিয়ের মাঝে এক বিশেষ আনন্দ ও তৃপ্তি রয়েছে। বালেগ হওয়ার সাথে সাথে এই চাহিদা অনুভূত হতে থাকে। বিবাহে মানুষ স্বামী-স্ত্রীর ঘনিষ্টতার আনন্দও উপভোগ করতে থাকে, বংশও বিস্তার হতে থাকে। যাদের মধ্যে দীন-শরীয়ত প্রয়োগ হবে।


বিয়ের মাধ্যমে শরীয়তের একটি মৌলিক উদ্দেশ্য 'বংশধারা'র হেফাজত হয়


শরীয়তের মৌলিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের একটি হলো, হিফজুন নসব তথা বংশধারার সংরক্ষণ। পিতৃ পরিচয় নির্ধারিত থাকা। বিবাহের মাধ্যমেই হিফজুন নসব তথা বংশধারার হেফাজত হয়। ইউরোপ আমেরিকার লোকজন এই সম্পদ হারিয়ে ফেলেছে। জারজ সন্তান ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার ফলে তারা মায়ের পরিচয়ে পরিচিত হয়। বাবা হওয়া একটি সম্মানিত পদবি। তা একমাত্র বিবাহের মাধ্যমেই অর্জিত হয়, যিনা-ব্যভিচারের মাধ্যমে তা সম্ভব নয়। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে,

الوَلَدُ لِلْفِرَاشِ وَلِلْعَاهِرِ الحَجَرُ. 

বিছানা যার সন্তান তার, যিনাকারীর জন্য প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ড।-সহীহ বুখারী, হাদীস ২২১৮


বংশধারা সংরক্ষণের লক্ষ্যে শরীয়ত অনেক বিধান দিয়েছে। পরনারীর দিকে তাকানো থেকে যিনা পর্যন্ত সব অপকর্ম এই উদ্দেশ্যেই হারাম করেছে। কথিত কিছু বুদ্ধিজীবী পশ্চিমা রীতি আমাদের দেশে বিস্তার ঘটানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। আমাদের দেশের মানুষ বিয়ে ছাড়া সন্তান প্রসবকারি মহিলার জন্য ‘ব্যভিচারী, যিনাকারী’ ইত্যাদি নিকৃষ্ট শব্দ ব্যবহার করে। তারা বিষয়টিকে সহজ করতে এসব মহিলার ক্ষেত্রে 'কুমারী মাতা' ব্যবহার করে। শব্দ পরিবর্তন করে খারাপ বিষয়টিকে সহজ করতে চাচ্ছে।


পরিবার একটি প্রতিষ্ঠান


পরিবার একটি প্রতিষ্ঠান। দুনিয়াতে অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র। পরিবার প্রতিষ্ঠানটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এর থেকে আশরাফুল মাখলুকাত মানুষ তৈরি হয়। দুনিয়া সৃষ্টির মাকছাদ হলো মানুষ। দুনিয়ার বাকি সব জিনিস মানুষের সুবিধার্থে সৃষ্টি করা হয়েছে। পরিবার নামক প্রতিষ্ঠান অনেক বড় নেয়ামত। পশ্চিমা বিশ্ব আমাদের পারিবারিক সৌহার্দপূর্ণ অবস্থা দেখে আফসোস করে।


পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানের প্রধান ব্যক্তি স্বামী


প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের একজন প্রধান বা শীর্ষ ব্যক্তি প্রয়োজন। প্রধান ব্যক্তি না থাকলে প্রতিষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। প্রতিষ্ঠানে কোনো কারণে প্রধান না থাকলে কমপক্ষে তাঁর সহকারীগণকে কাজ চালিয়ে যেতে হয়। যেকোনো প্রতিষ্ঠান যথাযথ চলার জন্য যেমন একজন প্রধান ব্যক্তি অনেক গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি একই সময় এক প্রতিষ্ঠানে দুজন প্রধান থাকাটা বিশৃঙ্খলার কারণ হয়। একসঙ্গে দুজন প্রধান ব্যক্তি থাকলে উভয়ের মতানৈক্য হয়ে শৃঙ্খলায় বিঘ্ন ঘটে। আল্লাহ তাআলা তাঁর একত্ব বুঝাতে গিয়ে বলেন,

لَوْ كَانَ فِيهِمَا آلِهَةٌ إِلَّا اللَّهُ لَفَسَدَتا

'যদি জগতের দুইজন রব থাকত তাহলে আসমান-জমিন ধ্বংস হয়ে যেত।'-সূরা আম্বিয়া ২১: ২২ 

আল্লাহ তাআলা দয়া করে মানুষ তৈরির মতো মহান প্রতিষ্ঠান তথা পরিবারের প্রধান ব্যক্তি নিজেই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কোরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে

الرِّجَالُ قَوّٰمُوْنَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللهُ بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ وَبِمَا أَنْفَقُوا مِنْ أَمْوَالِهِمْ . 

পুরুষরা মহিলাদের উপর কর্তৃত্বশীল; কেননা আল্লাহ তাআলা পুরুষদের মহিলাদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং একারণেও যে, পুরুষরা তাদের সম্পদ ব্যয় করে।-সূরা নিসা ৪: ৩৪ 

যদিও পুরুষকে আল্লাহ তাআলা মহিলাদের উপর কর্তৃত্ব দিয়েছেন তবুও পুরুষ পারিবারিক বিষয়ে নিজ স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করবে। এখন অনেকে ইউরোপীয় জীবনপদ্ধতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে স্বামী-স্ত্রীর সমান অধিকারের কথা বলে। এটি একেবারেই অবান্তর চিন্তা। পরিবারে যদি একজন কর্তৃত্ববান না থাকেন তাহলে পারিবারিক সমস্যা তৈরি হলে সমাধান করবে কে? স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সমান অধিকারের কথা বলা মানে সংসারে ঝগড়ার বীজ বপন করা। অতএব সমান অধিকার না হয়ে ন্যায অধিকার পাবে। পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠে বিবাহের মাধ্যমে, আর ভেঙে যায় তালাকের মাধ্যমে।


বিবাহের সংজ্ঞা


ফিকহের কিতাবে বিবাহের সংজ্ঞা লেখা হয়েছে,

عقد يفيد ملك المتعة قصدا . 

স্বামী-স্ত্রীর মাঝে এমন চুক্তি যার দ্বারা স্বামী স্ত্রীর বিশেষ অঙ্গের মালিক হয়। - তানবীরুল আবছার: ৬০/৪

বিয়ে হবে নারী-পুরুষের মাঝে। পুরুষ-পুরুষ বিয়ে অথবা মহিলা-মহিলা বিয়ে চরম ঘৃণিত কাজ। পশ্চিমা বিশ্বে পুরুষ-পুরুষ, মহিলা-মহিলা বিবাহ হয় এবং এর আইনি বৈধতাও দেওয়া হয়। আমাদের দেশে কিছু বিকৃত চিন্তার মানুষ এই আওয়াজ উঠাতে চায়। ফিতনা উঠে ইউরোপ আমেরিকায়, তার ধকল পোহাতে হয় এই দেশের মুসলমানদের ও ওলামায়ে কেরামদের।


বিবাহের জন্য আবশ্যক বিষয়সমূহ


বিবাহ সহীহ হওয়ার জন্য একপক্ষ থেকে ঈজাব তথা প্রস্তাব অপরপক্ষ থেকে কবুল তথা গ্রহণ লাগবে। ঈজাব-কবুল ছাড়া বিবাহ সহীহ হয় না। এছাড়া আরও দুটি বিষয় আবশ্যক:


এক. দুইজন সাক্ষীর উপস্থিতি। সাক্ষী দুইজন পুরুষ অথবা একজন পুরুষ ও দুইজন মহিলা হতে হবে। সাক্ষীদ্বয় স্বামী-স্ত্রীর কথা বা তাদের পক্ষে ঈজাব কবুল এক মজলিসে শুনতে হবে। এমনিভাবে ঈজাব-কবুল এক মজলিসে হতে হবে। 

দুই. 'মহর'। বিবাহে মহিলার অধিকার হলো মহরে মিসিল তথা স্বীয় বংশের সমপর্যায়ের মহিলাদের সমমানের মহর। এটাকে 'খান্দানি মহরও' বলে। মেয়ের স্পষ্ট সম্মতিতে যদি মহরে ফাতেমি নির্ধারণ করা হয় তাহলে সেটা সুন্নত। মহরে ফাতেমি হলো ১৫০ ভরি রুপা বা বর্তমান বাজার হিসাবে আনুমানিক ২ লক্ষ টাকা। মহরে ফাতেমি মহরে মিসিল থেকে কম হলে মহরে ফাতেমি নির্ধারণের জন্য মহিলার স্পষ্ট অনুমতি লাগবে। কেননা মহরে মিসিল মহিলার অধিকার। মহিলার অনুমতি ব্যতীত তা থেকে কমানো নাজায়েয। মহরে মিসিল আর মহরে ফাতেমি এক হলে অনুমতি লাগবে না।


মোবাইলে বিবাহের বিধান


বর্তমানে অনেকেই মোবাইলের মাধ্যমে বিবাহ-শাদি করেন। স্বামী থাকে এক জায়গায় স্ত্রী থাকে আরেক জায়গায়। মোবাইলের মাধ্যমে একজন ইজাব তথা প্রস্তাব করে, আরেকজন অন্যত্র মোবাইলে শুনে শুনে কবুল করে। সাক্ষীদ্বয় একজনের কথা সরাসরি, আরেকজনের কথা মোবাইলের মাধ্যমে শোনে। এভাবে সাক্ষীদ্বয় উভয়জনের কথা এক মজলিসে না শোনায় এবং ইজাব-কবুল এক মজলিসে না হওয়ায় বিয়ে সহীহ হয় না।


মোবাইল ফোনে বিবাহ সহীহ হওয়ার সঠিক পদ্ধতি


স্বামী বা স্ত্রী যেখানে সাক্ষীদের উপস্থিতিতে বিবাহ সংঘটিত হবে সেখানে অনুপস্থিত ব্যক্তি কাউকে উকিল (প্রতিনিধি) বানাবে আর উকিল তার পক্ষ থেকে ইজাব বা কবুল করবে। এতে ইজাব-কবুল এক মজলিসে হবে এবং উভয় সাক্ষী তাদের কথা এক মজলিসে শুনবে। এ পদ্ধতিতে মোবাইলে বিবাহ হলেও তা সহীহ বিবাহ হবে।


বিবাহের সুন্নতসমূহ


বিবাহের কয়েকটি সুন্নত রয়েছে: 

১. বিবাহ মসজিদে হওয়া।

২. বিবাহের যথাসাধ্য এলান-ঘোষণা করা।

৩. ছেলে স্ত্রীর সাথে রাত কাটানোর পরে ওলীমা করা।


বিবাহের নিয়ামত অর্জনের শুকরিয়াস্বরূপ মানুষকে খাওয়াবে। শরীয়তে দাওয়াত খাওয়ানোর বিধান আনন্দের সময়। শোকের সময় কোনো দাওয়াত শরীয়তে বৈধ নয়। ফিকহের কিতাবে রয়েছে,

إنما شرعت الدعوة في السرور لا في الشرور.

দাওয়াত বৈধ আনন্দের সময়, দুঃখের সময় নয়।


অনেকে বাবা-মা মারা গেলে দাওয়াতের আয়োজন করে। এটা নিকৃষ্ট বিদাআত। এসব দাওয়াত খেলে অন্তরের নূর কমে যায়। ওলীমা স্বামী-স্ত্রীর সাক্ষাতের পরের দিন সুন্নত। অনেকে বিয়ের এক বছর পর ওলীমার অনুষ্ঠান করে। এটি আর ওলীমা থাকে না; বরং তখন তা আত্মীয়-স্বজন খাওয়ানো হয়। ওলীমার মাঝে শুধু ধনীদের দাওয়াত দেওয়া, গরিবদের আসার সুযোগ না রাখা গর্হিত কাজ।


মেয়ের বাড়িতে সুন্নত কোনো দাওয়াত নেই


বিবাহে সুন্নত দাওয়াত, ছেলের বাড়িতে ওলীমার আয়োজন করা। মেয়ের বাড়িতে বিয়ের সময় কোনো মাসনুন দাওয়াত নেই। মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে নিজেদের কোনো আত্মীয়-স্বজন আসলে তাদের খাওয়ানো জায়েয। অথবা বিবাহের সময় ছেলের সাথে কয়েকজন মুরব্বী এলে তাদের খাওয়ানো জায়েয। বউ উঠানোর নামে শত শত মানুষ আসার শর্ত করা গর্হিত কাজ। আমি কয়েকজনকে বলেছি, আপনাদের বউ কি এত ভারী যে, তাকে আনতে এত মানুষ লাগবে? মেয়ের বাবা যদি মন থেকে দাওয়াত না দেয় তাহলে তা মেয়ের বাবার উপর জুলুম। এটা নাজায়েয। অনেক সময় দেখা যায়, নির্দিষ্ট পরিমাণ থেকে অস্বাভাবিক বেশি মানুষ ছেলের সাথে চলে আসে, এটা স্পষ্ট হারাম। দাওয়াত ছাড়া যারা খেতে যায় হাদীসে তাদের ব্যাপারে নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

من دُعِي فَلَمْ يُجِب فَقَدْ عَصَى الله وَرَسُولَهُ، وَمَنْ دَخَلَ عَلَى غَيْرِ دَعْوَةٍ دَخَلَ سَارِقًا وَخَرَجَ مُغِيرًا.

যে যৌক্তিক উজর ছাড়া দাওয়াত কবুল করে না সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানি করল। যে দাওয়াত ছাড়া খেতে গেল সে চোর হয়ে প্রবেশ করল আর ডাকাত হয়ে বের হল।-সূনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৭৪১


মেয়ের বাবার পক্ষ থেকে স্বেচ্ছায় উপঢৌকন হালাল আর যৌতুক হারাম


অনেককে বিয়ের সময় বলতে শোনা যায়, মেয়ের বাবা কী দেবে?

আমি তাদেরকে বলব, বাবা তাঁর কলিজার টুকরা মেয়েকে দিয়ে দিচ্ছে। আর কী দিবে?

মেয়ের বাবা থেকে কিছু চেয়ে নেওয়া বা নিজে না বলে অন্য কাউকে দিয়ে বলা অথবা মুখে না বলে স্ত্রীকে নির্যাতন করা-সবই সুস্পষ্ট হারাম। হ্যাঁ। মেয়ের বাবা যদি কোনো ধরনের চাপ ব্যতীত মেয়ে ও জামাইয়ের প্রতি খুশি হয়ে নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী কিছু হাদিয়া দেয় তাহলে তা জায়েয হাদিয়া হবে।


দাম্পত্য জীবনে সুখী হওয়ার মূল চাবিকাঠি তাকওয়া


মানুষের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় দাম্পত্য জীবন। এটি এক-দুই দিনের সম্পর্ক নয়। মানুষের জীবনের বেশির ভাগ সময় জুড়ে দাম্পত্য জীবন। এই দাম্পত্য জীবন সুখী হওয়ার মূল চাবিকাঠি 'তাকওয়া-খোদাভীতি'। তাই উলামায়ে কেরাম বিবাহের খুতবার সময় তাকওয়ার আয়াতগুলো পাঠ করেন। এতে ইশারা করেন, মানুষ তৈরির এই মহান প্রতিষ্ঠান নির্ভেজাল ও সুখী হওয়ার জন্য তাঁকওয়াই মূল। যে পরিবারের লোকদের মাঝে তাকওয়া যত বেশি তারা তত বেশি সুখী হবে। 


পরিবারের প্রধান ব্যক্তি যদিও স্বামী তবুও সে পারিবারিক কাজগুলো পরিবারের লোকদের সাথে, পরামর্শ করে করবে। স্বামী পরিবারের প্রধান বলে স্ত্রীর উপর জুলুম করবে না। তাকে সম্মান করবে। তেমনিভাবে স্ত্রীও স্বামীর হক আদায়ের ক্ষেত্রে তাকওয়া অবলম্বন করবে। পারিবারিক জীবনে হুকুম-আহকাম পালন করার ক্ষেত্রে তাকওয়া অবলম্বন করবে।


বর-কনে পরস্পর সালাম বিনিময় করা


মেয়ে স্বামীর বাড়িতে গিয়ে প্রথম শাশুড়ি ও স্বামীর বোনদেরকে সালাম দেবে। আজকাল নতুন বউয়েরা এত লাজুক হয়ে যায়, তাঁরা শরমে সালাম দিতে পারে না। সালাম দিতে আবার কিসের শরম। যে বাড়িতে যাদের সাথে সারা জীবন থাকতে হবে তাদেরকেই যদি সালাম দেওয়া না হয় তাহলে খায়ের ও বরকত হবে কী করে! তাই বাবা-মা মেয়েদের বিশেষ করে নসীহত করে দেবেন, যেন স্বামীর বাড়িতে প্রবেশ করার সময় সালাম দেয়। যে বাড়িতে সালাম দিয়ে প্রবেশ করা হবে, ইনশাআল্লাহ সেখানে খায়ের ও বরকত হবে। সালাম না দিয়ে প্রবেশ করলে তাঁর সাথে শয়তানও ঢুকে পড়ে। বরও প্রথম সাক্ষাতে কনেকে সালাম দিবে। দাম্পত্য জীবনে সর্বদা একে অপরকে সালাম দিবে।


বিয়ের দিন যাতে নামায কাযা না হয় 


বিয়ের দিন অনেক কনে সাজসজ্জা নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে ওযুও করে না, নামাযও পড়ে না। ঐ সাজসজ্জা অভিশপ্ত যার কারণে নামায কাযা হয়। অনেক বরও ব্যস্ততার অজুহাতে নামায কাযা করে ফেলে। দাম্পত্য জীবনের শুরুতেই আল্লাহ তাআলার নাফরমানি হলে সেই দাম্পত্য জীবন সুখের হবে কী করে। যাদের বিয়ের দিন নামায কাযা হয়েছে তাদের অনুতপ্ত হয়ে তাওবা করা জরুরি। বিয়ের দিন আত্মীয়-স্বজন সকলকে নিজ বাড়িতে দাওয়াত করে আনে আর আল্লাহ তাআলাকে বিদায় দেয়। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়, তারা বোঝাতে চায় আজকে আমাদের আনন্দের দিন, আল্লাহ তাআলার বিধি-বিধান আজকে ছুটি। এগুলো বড় আফসোসের বিষয়!


তালাক


বিয়ে-শাদি হওয়ার পর শরীয়ত চায়, এই সম্পর্ক সারা জীবন অটুট থাকুক। বিচ্ছেদ বা তালাক হওয়া কাম্য নয়। তাই শরীয়ত প্রথম সবক শিখিয়েছে, তালাক হলো নিকৃষ্ট হালাল। যত জায়েয কাজ আছে তার মধ্যে সর্বনিকৃষ্ট হালাল তালাক। দ্বিতীয়ত, স্বামী-স্ত্রীর এমন জীবন পদ্ধতি বলে দিয়েছে যাতে তালাকের প্রয়োজনই না হয়। তৃতীয় সবক শিখিয়েছে, মাঝে মাঝে ঝগড়া হলে নিজেরা সমঝোতা করার চেষ্টা করবে। স্ত্রীর কোনো বিষয় অপছন্দ হলে তালাকের সিদ্ধান্ত না নিয়ে সমঝোতার জন্য স্বামীদের হেদায়াত করা হয়েছে স্ত্রীদের ভালো গুণ দেখতে। যেমনটি কোরআন মাজীদে এসেছে,

فَإِنْ كَرِهْتُمُوهُنَّ فَعَسى أَن تَكْرهُوا شَيْئًا وَيَجْعَلَ اللَّهُ فِيهِ خَيْرًا كَثِيرًا.

যদি তোমরা তাদের অপছন্দ কর তবে এমন হতে পারে যে, তোমরা কোনো জিনিস অপছন্দ কর, অথচ আল্লাহ তাতে বহু কল্যাণ রেখেছেন।-সূরা নিসা ৪: ১৯ 

দুনিয়াতে কোনো মানুষ দোষের ঊর্ধ্বে নয়, সবারই দোষ রয়েছে। সুতরাং স্ত্রীর কোনো বিষয় অপছন্দনীয় হলে তার আরও ১০ টি ভালো গুণ রয়েছে যা তোমার পছন্দ হবে। অতএব কিছু খারাপ বিষয় দেখে তালাকের সিদ্ধান্ত নিয়ো না। চতুর্থ স্তর, যদি সমস্যা এত জটিল হয় যে নিজেরা সমাধান করা সম্ভব নয় তাহলে প্রত্যেকে কাউকে মুরব্বী মানবে যারা তাদের মাঝে সমঝোতা করে দিবে।

وَإِنْ خِفْتُمْ شِقَاقَ بَيْنِهَا فَابْعَثُوا حَكَمًا مِنْ أَهْلِهِ وَحَكَمًا مِّنْ أَهْلِهَا إِنْ يُرِيدَا إِصْلَاحًا يُوفقِ اللَّهُ بَيْنَهُمَا إِنَّ اللهَ كَانَ عَلَيْهَا خَبِيرًا. 

আর যদি তোমরা স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিরোধের আশঙ্কা কর তাহলে স্বামীর পক্ষ থেকে একজন সালিশ ও স্ত্রীর পক্ষ থেকে একজন সালিশ নিযুক্ত করো। এদুজন সমঝোতার ইচ্ছা করলে আল্লাহ স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মিলন সৃষ্টি করে দিবেন। নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা সর্বজ্ঞ, সবিশেষ অবহিত।-সূরা নিসা ৪: ৩৫ এই স্তর পার করার পরও সমাধান না হলে তালাকের দিকে যাবে।


তালাকের জন্য করণীয় বিষয় 


এক. তালাকের সময় দেখা। মন চাইলে যেকোনো সময় তালাক দেওয়া যাবে না। তালাকের সময় দেখতে হবে। মন চাইলে যেমন নামায পড়া যায় না সময় দেখতে হয়, তেমনিভাবে তালাক দেওয়ার জন্যও তালাকের সময় দেখতে হবে। তালাকের শরীয়তসম্মত সময় হলো,

هو ظهر خال عن الجماع. 

তালাকের সময় হলো, মহিলার পবিত্র অবস্থা যেসময় স্বামী-স্ত্রী মিলন হয়নি।

হায়েজ অবস্থায় তালাক দেওয়া গোনাহ। হায়েজ অবস্থায় তালাক দিলে তালাক উড্ড করতে হবে। এমন পবিত্র অবস্থাও, তালাকের সময় না, যে পবিত্র অবস্থায় স্বামী-স্ত্রীর সহবাস হয়ে গেছে।


দুই. এক তালাকের বেশি না দেওয়া। তালাকের প্রয়োজন হলে স্ত্রীকে এক একে তালাকে রজঈ দেবে। এরপর তার এই সিদ্ধান্ত ভুল মনে হলে অথবা সন্তানদের মুখ দেখে আবার স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনতে মন চাইলে ইদ্দত (পূর্ণ তিন মাসিক) এর ভেতরে মুখে বলেই ফেরত নিতে হবে, 'আমি তাকে ফিরিয়ে আনলাম'। স্ত্রী আবার তার হয়ে যাবে। সাক্ষীরও প্রয়োজন নেই। সাক্ষী রাখা মুস্তাহাব। তালাকের পর মহিলার ইদ্দত শেষ হয়ে গেলে অথবা স্ত্রীকে তালাকে বায়েন দিয়ে দিলে একক সিদ্ধান্তে স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। বরং উভয়ে পরস্পর যৌথ সম্মতিতে নতুন করে বিয়ে করতে পারবে।


একসঙ্গে তিন তালাক দেওয়া গোনাহ


আমাদের সমাজে অনেক মানুষের মাঝে একটি ভুল ধারণা রয়েছে যে, এক তালাক দিলে তালাক হয়ই না। বরং তালাক হতে হলে তিন তালাক দিতে হয়। রাগ হলেই যত তালাক মনে আছে সব একসঙ্গে দিয়ে দেয়। একসঙ্গে তিন তালাক দেওয়া বড় গোনাহ। তবে কেউ তালাক দিলে তালাক হয়ে যাবে। তিন তালাক দেওয়ার পর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অনেকে তিন তালাক দিয়ে এসে ফতওয়া বিভাগে কান্নাকাটি শুরু করে, হুযুর! দেখেন কিছু করা যায় কি না। তিন তালাক দেওয়ার পর আর কিছুই করার থাকে না।


অনেককে বলতে শোনা যায়, মহিলার কী দোষ? এখন মহিলার কী হবে?

আমি তাদের বলব, এই পুরুষ তিন তালাক দিয়ে তার স্ত্রীর উপর জুলুম করেছে। সুতরাং সে এই স্ত্রীর যোগ্য রয়নি। মহিলার আত্মমর্যাদাবোধ আসা প্রয়োজন যে, এই জালেমের সংসার আমি করব না।


অনেক মহিলা আবার বলে, আমার ছেলে-মেয়ের কী হবে?

এর উত্তর হলো, ছেলে-মেয়ে মায়ের কাছে থাকবে বালেগ হওয়া বা ৭ বছর পর্যন্ত। বাবা তার খরচ বহন করবে।


তালাকের মাসায়েল সর্বসাধারণকে জানানোর প্রয়োজনীয়তা


ফতওয়া বিভাগে অনেকে এসে বলে, হুযুর! বিবিকে তিন তালাক দিয়ে এসেছি, তালাক কি হয়ে গেছে!? অনেকে আবার বিবিকে ১ শ তালাক, ১ হাজার তালাকও দেয়। অনেকে তিন তালাক দিয়ে তাওবা করে বিবির সঙ্গে সংসার করতে থাকে। এর থেকে বোঝা যায়, তালাকের সাধারণ বিষয়গুলোও মানুষের জানা নেই। শাইখুল ইসলাম আল্লামা তাকী উসমানী দা. বা. আলেম-উলামা ইমাম-খতিবদেরকে তালাকের মৌলিক বিষয়গুলো সাধারণ মানুষদেরকে জানানোর আবেদন করেছেন। তাই আলেমদের উচিত তালাকের মৌলিক বিষয়গুলো জনসাধারণকে জানানো। আল্লাহ তাআলা সবাইকে তাওফীক দান করুক। কবুল করুন।


[নিবন্ধটি একটি বয়ানের লিখিত রূপ। মুফতী আবদুস সালাম দা. বা. ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ঈ. জামিয়া আরাবিয়া কাসিমুল উলূম জাফরাবাদ, চাঁদপুর-এ বয়ান করেন। জাফরাবাদ মাদরাসার উস্তাদ মাওলানা মুহাম্মাদ হামীদুল্লাহ বয়ানটি অনুলিখন করেন।]

মন্তব্য (...)

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →

আল্লামা শাব্বীর আহমাদ উসমানী রহঃ

শাহ আব্দুল আযীয দেহলভী রহঃ

শাইখুল ইসলাম আল্লামা কাসেম নানুতুবী রহঃ

মাওঃ উবাইদুল্লাহ সিন্ধী রহঃ

সায়্যিদ সাবেক রহঃ

আল্লামা আব্দুল মজীদ নাদীম রহঃ

মাওলানা আসলাম শাইখুপুরী

শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমাদ মাদানী রহঃ

মাওঃ আবু আম্মার যাহেদ রাশেদী

মাওঃ নুরুল হাসান রাশেদ কান্ধলভী

মুফতী হাবীবুর রহমান খাইরাবাদী

আল্লামা আবুল কালাম আযাদ রহঃ

মাওলানা সাঈদ আহমদ

মাওলানা মুহাম্মদ হেমায়েত উদ্দীন দাঃ

হযরত মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী রহঃ

মাওলানা হাবীবুর রহমান খান

মাওলানা সাঈদ আহমাদ বিন গিয়াসুদ্দীন

মাওঃ আবু বকর সিরাজী

শায়েখ আবু মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ ইবনে উমার [রহ.]

মাওঃ এনামুল হাসান