ব্লগ

যৌবন : খাহেশাতের শিল্প নয় নেকির সৌন্দর্য

post reference icon

মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ

২১ নভেম্বর, ২০২৩

local library icon

৭৬৭০

comment icon

মানুষের জীবনের প্রতিটি ধাপই গুরুত্বপূর্ণ। শৈশবকৈশোরযৌবনপৌঢ়ত্ব বা বার্ধক্য- জীবনের কোনো পর্যায়ই মূলত এমন নয় যেসে সময়ে জীবনকে পরিশীলিত ও সুন্দর রাখার প্রয়োজন নেইযে কোনো রকম খেয়াল খুশি ও প্রবৃত্তিজাত স্রাতের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া যায়। তবে এসবের মধ্যেও কৈশোরে-যৌবনে জীবনের শক্তিগতি ও প্রাচুর্য থাকে সবচেয়ে বেশি। এর সঙ্গে থাকে জীবন ও জগতের অনুদ্ঘাটিতএমনকি অপরিমিত আকাক্সক্ষার বিচিত্র হাতছানি। ইসলাম এজন্যই যৌবনে ইবাদত ও সুপরিচর্যার গুরুত্ব দিয়েছে অনেক বেশি। যুবকদের বিপথগামিতা থেকে রক্ষা করে সুপথে পরিচালিত করার সাহস ও প্রেরণা যুগিয়েছে। যৌবনের প্রাণশক্তিসাহস ও সময়দ্বীন ও সত্যের খেদমতে নিবেদনে উৎসাহ দিয়েছে। শুধুই ইহকালীন সাফল্য-বিবেচনা ও চাহিদা উপভোগের দিকে মনোযোগ নয়আখেরাতের কামিয়াবি ও নাজাতের গন্তব্যের দিকে চোখ রেখে তাদের পথচলায় নির্দেশনা দিয়েছেউৎসাহ যুগিয়েছে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

سَبْعَةٌ يُظِلّهُمُ اللهُ تَعَالَى فِي ظِلِّهِ يَوْمَ لاَ ظِلّ إِلّا ظِلّهُإِمَامٌ عَدْلٌ، وَشَابّ نَشَأَ فِي عِبَادَةِ اللهِ، وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلّقٌ فِي المَسَاجِدِ، وَرَجُلاَنِ تَحَابّا فِي اللهِ، اجْتَمَعَا عَلَيْهِ وَتَفَرّقَا عَلَيْهِ، وَرَجُلٌ دَعَتْهُ امْرَأَةٌ ذَاتُ مَنْصِبٍ وَجَمَالٍ فَقَالَإِنِّي أَخَافُ اللهَ، وَرَجُلٌ تَصَدّقَ بِصَدَقَةٍ فَأَخْفَاهَا حَتّى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ، وَرَجُلٌ ذَكَرَ اللهَ خَالِيًا، فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ.

সাত শ্রেণিকে আল্লাহ তাআলা (কিয়ামতের দিন) তাঁর ছায়ায় আশ্রয় দেবেনযেদিন তাঁর ছায়া ব্যতীত কোনো ছায়া থাকবে না :

১. ন্যায়পরায়ণ শাসক।

২. ঐ যুবকযে আল্লাহর ইবাদতে বেড়ে উঠেছে (তার যৌবন অতিবাহিত করেছে)।

৩. ঐ ব্যক্তিমসজিদেই পড়ে থাকে যার মন।

৪. এমন দুই ব্যক্তিযারা একে-অপরকে আল্লাহর জন্যই ভালবাসে। আল্লাহর জন্যই একত্র হয় এবং তাঁর জন্যই বিচ্ছিন্ন হয়।

৫. ঐ সুপুরুষযাকে সম্ভ্রান্ত রূপসী কোনো নারী (যিনার জন্য) আহ্বান করে তখন সে (এ থেকে বিরত থাকে এবং) বলেআমি আল্লাহকে ভয় করি।

৬. যে এত গোপনে দান করেতার বাম হাত বুঝতে পারে না- ডান হাত কী দান করল।

৭. যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করেফলে তার দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে। -সহীহ বুখারীহাদীস ১৪২৩

আল্লাহ তাআলার দ্বীনের এই নির্দেশনা ও প্রেরণার বিপরীতে যারা চলেছেযুবক ও যৌবনের প্রতি তাদের আহ্বান ও হাতছানি শুরু থেকেই ছিল অন্যরকম। সত্য থেকে বিপথগামী করা এবং জীবনের সুস্থ সৌন্দর্য থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়াই তাদের প্রধান লক্ষ্য। কী সে যুগেকী এ যুগেদ্বীন বিরোধী এবং দ্বীনের পথ থেকে বিচ্যুত গোষ্ঠীর অন্যতম প্রধান কাজ মানুষের সামনেবিশেষত যুবকদের সামনে প্রবৃত্তিশাহওয়াত-খাহেশাতের কালো জগৎকে মোহনীয় করে তোলাএবং এ প্রক্রিয়ায় আল্লাহর পথ থেকে তাদের বিচ্যুত করার চেষ্টা করা।

দুই.

প্রাচীন যুগে সব বয়সী মানুষ ও যৌবনের মানুষকে বিপথগামী করতে নানা রকম খাহেশাতের শিল্প তো উপস্থাপন করা হতোকিন্তু সেসব বিচ্যুত শিল্পের সঙ্গে এতরকম মোহনীয় যুক্তি ও গ্রহণযোগ্যতার শ্লোগান যুক্ত করা হতো না। আধুনিক সময়কালে এ-এক নতুন তামাশা ও ট্রাজেডিপ্রবৃত্তি-অশ্লীলতা ও খাহেশাতের সঙ্গে বিচিত্র যুক্তিতর্কধমকমর্যাদার ও অধিকারের ইস্যু যুক্ত করে দেওয়া হয়। মানুষ-সভ্যতার সবচেয়ে সম্ভাবনা ও গতির আধার যুবক শ্রেণির মধ্যে বয়সী মনের চপলতাকে উসকে দেওয়ার জন্য এসবের পেছনে লাগিয়ে দেওয়া হয় বুদ্ধিবৃত্তি ও ক্ষমতার প্রভাবকেও। এভাবেই জাগতিক নানামাত্রিক উন্নতি ও সুখের আপ্তবাক্যের পাশাপাশি খুলে দেওয়া হয় প্রবৃত্তির অবারিত বাজারের দরজা।

বিনোদনশিল্পখেলাধুলাজাতীয় গৌরব আর জগতায়ীত সংস্কৃতির সঙ্গে সহযাত্রার নামে মুসলিম দেশগুলোর নতুন প্রজন্মের মাথা ও দেহধর্ম ও জীবন খেয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সাম্প্রতিক কালে এই উল্টো প্রেরণা ও ধ্বংসাত্মক প্রবণতার মাত্রা অনেক বেড়ে গেছেবাড়িয়ে তোলাও হয়েছে। এতে জ্ঞান-বিজ্ঞান-উন্নতির দুনিয়াটাকে রঙিন করে তোলার আওয়াজ উঁচু করতে চাইলেও বাস্তবে দেখা যাচ্ছেআচ্ছন্ন অসুস্থ একটি নির্লিপ্ত প্রজন্ম গড়ে ওঠার নির্জীব রাস্তাটা আরো প্রশস্ত হচ্ছে। তবুও নীতির চাকার চালকদের কোনো হুঁশ হচ্ছে বলে মনে হয় না। যৌবনের যে জীবনজাতির নতুন প্রজন্মনতুন উদ্যম ও প্রাণপ্রবাহএদের প্রকৃত স্বাস্থ্যকর আত্মিক উন্নতির পরিবর্তে খাহেশাতের বাতাসেই জোর দেওয়া হচ্ছে সব দিক থেকে। অথচ এর আচ্ছন্ন বর্তমান ও বিষাদময় পরিণতির সংকটটিকে এড়ানোর কোনো সুযোগ থাকবে কি না তারা ভেবেই দেখছেন না।

এমনিতেই এক দশকে প্রায় দেশে দেশে তরুণ প্রজন্মের চোখমনমগজ বুঁদ হয়ে থাকার মতো সংযোজিত নতুন উপাদান হচ্ছে অনলাইন বারান্দার অসুখী আয়োজন। হাতে হাতে ডিভাইসহাতে হাতে অন্ধকারঅসংযত ব্যবহারে জীবনের প্রাত্যহিক সর্বনাশ। এই চলমান দুর্দশায় যৌবন ও তারুণ্যকে রক্ষা করার কর্তৃপক্ষীয় ফিকিরহীনতার মধ্যেই যুক্ত হচ্ছে বিনোদন ও সংস্কৃতিখেলাধুলাপোশাক ও জীবনযাত্রার নানামাত্রিক উদ্দাম আয়োজন। এর সঙ্গে রাজনীতিব্যবসা ও বুদ্ধিবৃত্তির প্রলেপ লাগিয়ে দিয়ে এর প্রাবল্য বিস্তারের জয়গান গাওয়া হচ্ছে। পরিস্থিতি এমন যেপ্রজন্মের প্রবীণেরা অপরাপর সুবিধা-চাহিদার পাশাপাশি প্রজন্মের নবীনদের সামনে খাহেশাত ও অশ্লীলতারযৌবনের উদ্দাম ও অসংযমী জীবনের ময়দানটাকে উৎকোচ হিসেবে পেশ করছে। কিংবা মন থেকে মেনে নিচ্ছে তাদের ভুলযাত্রা। খাহেশাতের সঙ্গে যুবক-তরুণ নতুন প্রজন্মের জীবন-যুক্ততাকে তারা আকাঙ্ক্ষা করছে শখে কিংবা সুখেই। অথচ আল্লাহ তাআলার অমোঘ ফরমান-

اِنَّ الَّذِیْنَ یُحِبُّوْنَ اَنْ تَشِیْعَ الْفَاحِشَةُ فِی الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَهُمْ عَذَابٌ اَلِیْمٌ ۙ فِی الدُّنْیَا وَ الْاٰخِرَةِ ؕ وَ اللّٰهُ یَعْلَمُ وَ اَنْتُمْ
لَا تَعْلَمُوْنَ

স্মরণ রেখযারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার হোক এটা কামনা করেতাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে আছে যন্ত্রণাময় শাস্তি এবং আল্লাহ জানেনতোমরা জান না। -সূরা আননূর (২৪) : ১৯

তিন.

এভাবে তো চলতে পারে নাপ্রবৃত্তি কেন্দ্রিক এই প্রজন্ম-বিনাশী প্রক্রিয়ার গতি নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। দ্বীনী যিন্দেগি ও আখেরাতের ফিকির সামনে নিয়ে উন্মুক্ত অবারিত খাহেশাতের এই বিস্তৃত বাজার বন্ধ করা দরকার। অথবা নতুন প্রজন্মকেআজকের যৌবনকে তার সকল প্রাণশক্তির সঙ্গেই পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন রাখার উদ্যোগ নেওয়া দরকার। বিনাশী প্রবৃত্তির উৎসাহিতকরণের পর্বগুলো বন্ধ করা দরকার। তাদের হাতে তুলে দেওয়া দরকার জীবনপবিত্রতাইবাদতনেকি ও সুস্থতার ময়দানের চাবি। তিলাওয়াতশুদ্ধপাঠআখলাকসদাচারসুস্থতাশুভ উদ্যম ও বিনয়-আদবের সৌরভে তাদের জীবনকে শুভ্র ও সজীব করে তোলার দায়িত্ব তো প্রবীণদেররাষ্ট্রের কর্তা ও অভিভাবকদেরপরিবারসমাজ ও গুরুজনদের।

যুবক-যুবতী কিংবা নতুন প্রজন্ম তো আসলে জীবন ও বয়সেরই একটি পর্ব বা পর্ব-অধিকারীএরা তো ভিন্ন কোনো গোষ্ঠী বা শ্রেণি নয়। এরা আমাদেরই অনুজ কিংবা সন্তানআমাদেরই পারিবার কিংবা সমাজএরা তো আমরাইআমাদেরই এক উত্তর কাফেলা। এদের জীবনের শুদ্ধতাজীবনের পাপাচারমুক্ততাপ্রত্যাবর্তননেকির জীবন তো আমাদেরপ্রবীণদের দায়িত্ব ও কর্মসাধনার অন্যতম লক্ষ্য ও করণীয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ইরশাদ করেছেন-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا قُوْۤا اَنْفُسَكُمْ وَ اَهْلِیْكُمْ نَارًا وَّ قُوْدُهَا النَّاسُ وَ الْحِجَارَةُ عَلَیْهَا مَلٰٓىِٕكَةٌ غِلَاظٌ شِدَادٌ لَّا یَعْصُوْنَ اللّٰهَ مَاۤ اَمَرَهُمْ وَ یَفْعَلُوْنَ مَا یُؤْمَرُوْنَ

হে মুমিনগণ! নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে রক্ষা কর সেই আগুন থেকেযার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর। তাতে নিয়োজিত আছে কঠোর-স্বভাবকঠিন-হৃদয় ফেরেশতাগণযারা আল্লাহর কোনো হুকুমে তাঁর অবাধ্যতা করে না এবং সেটাই করেযার নির্দেশ তাদেরকে দেওয়া হয়। -সূরা আততাহরীম (৬৬) : ৬

কৈশোরযৌবন ও তারুণ্যে যাদের অবস্থানসেই নতুন প্রজন্মের নিজেরও করণীয় নিজেকে রক্ষা করা এবং সৎপথেদ্বীন ও ঈমানের পথে নিজেকে পরিচালিত করার চেষ্টা করা। সমাজ ও সংস্কৃতির গড্ডালিকা প্রবাহে যদি প্রবৃত্তির বিষ ছড়িয়ে পড়েনিয়ন্ত্রকদের নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে যায়- তখন আল্লাহ তাআলার আহ্বান ও সতর্কবাণীর দিকে দৃষ্টি ফেরানো এবং আল্লাহওয়ালা পরিবেশপাঠ ও সান্নিধ্যের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করা। নিজেকে এবং নিজেদেরকে সৎপথেনেকির পথে পরিচালিত করে আল্লাহ তাআলার সাহায্য প্রার্থনা করা। সেই আসহাবে কাহফের যুবকেরা যেমন চেয়েছিলেন-

اِذْ اَوَی الْفِتْیَةُ اِلَی الْكَهْفِ فَقَالُوْا رَبَّنَاۤ اٰتِنَا مِنْ لَّدُنْكَ رَحْمَةً وَّ هَیِّئْ لَنَا مِنْ اَمْرِنَا رَشَدًا.

এটা সেই সময়ের কথাযখন যুবক দলটি গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল এবং (আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ করে) বলেছিলহে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের প্রতি আপনার কাছ থেকে বিশেষ রহমত নাযিল করুন এবং আমাদের এ পরিস্থিতিতে আমাদের জন্য কল্যাণকর পথের ব্যবস্থা করে দিন।  -সূরা কাহফ (১৭) : ১০-১৬

কৌতূহলীউদ্যমীপ্রতিষ্ঠা-সন্ধানী যুবক-যুবতী নতুন প্রজন্মের আত্মরক্ষার প্রধান দায়িত্ব তো নিজেদের। বিচ্যুতি থেকে বাঁচার এবং সামনে এগিয়ে যাওয়ার পদক্ষেপ তাদেরই নিতে হবে। আল্লাহ তাআলার সাহায্য প্রার্থনা করে পথ চলতে থাকলে প্রধানত উপকার ও সৌভাগ্য তাদেরই হবে- ইনশাআল্লাহ। 


মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ