প্রবন্ধ

তালাকের শরঈ রূপরেখা সমাজে প্রচলিত ত্রুটি-বিচ্যুতি

লেখক:মুফতী শাব্বীর আহমাদ
২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
২৫০৯ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

আমাদের সমাজে দাম্পত্যজীবনের কলহ-বিবাদ ইদানীং খুব বেড়ে গেছে। এ কলহ-বিবাদের জেরে সংসার ভাঙার ঘটনাও দিন দিন বেড়েই চলছে। অতি সামান্য ও সাধারণ বিষয়েই তালাক ও ডিভোর্স দেওয়া হচ্ছে। এসবের মৌলিক একটি কারণ হলো, সংসার ও দাম্পত্য বিষয়ে ইসলামের নির্দেশনা সম্পর্কে অজ্ঞতা। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, নিকট অতীতেও যেসব বিষয় সমাজের সাধারণ মানুষ জানত, এখন তা সমাজের শিক্ষিত শ্রেণিও জানে না।


তালাকের ব্যাপারে সংশোধনযোগ্য প্রথম বিষয়


তালাকের ব্যাপারে প্রথম যে বিষয়টি সংশোধনযোগ্য তা হলো, সমাজের বহু মানুষ তালাককে রাগ প্রশমনের উপায় মনে করে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিলে আর পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ক্রোধের পর্যায়ে পৌছলে, সাথে সাথে স্বামী মহোদয় 'তালাকে'র শব্দ উচ্চারণ করেন। অথচ তালাক কোনো গালি নয় যে তা রাগের সময় উচ্চারণ করবে, যা কারো রাগ প্রশমণে ভূমিকা পালন করবে। 

তালাক মূলত বৈবাহিক সম্পর্ক বিলুপ্ত ঘোষণার সর্বশেষ ও চূড়ান্ত রূপ। বাস্তব জীবনে যার ফলাফল বড় কঠিন। এর দ্বারা শুধু বৈবাহিক সম্পর্কই ছিন্ন হয় না; বরং পারিবারিক জীবনের অনেক সমস্যাও এর দ্বারা সৃষ্টি হয়। স্বামী- স্ত্রী একে অপরের জন্য পর হয়ে যায়। সন্তানেরা এক্ষেত্রে চরম পরিস্থিতির শিকার হয়। তাদের জীবনটাই এলোমেলো হয়ে যায়। উভয়ের মালিকানাধীন সম্পদ বণ্টনে জটিলতা সৃষ্টি হয়। মোহর, ভরণ-পোষণ ও ইদ্দতের উপর এর প্রভাব পড়ে। সর্বোপরি শুধু স্বামী-স্ত্রী কিংবা সন্তানই নয়; বরং বৃহত্তর পরিবার ও সমাজ বহুবিধ ক্ষতির সম্মুখীন হয়।


ইসলামী শরীয়তে তালাক


প্রথম কথা হলো, ইসলাম তালাকের অনুমতি প্রদান করলেও একে 'আবগাযুল মুবাহাত' তথ্য নিকৃষ্টতম জায়েয কাজ বলে ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ আল্লাহর কাছে সবচেয়ে অপছন্দনীয় জায়েয কর্ম হলো, তালাক। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিষ্কার ভাষায় ঘোষণা করেছেন, তালাক আল্লাহর কাছে সবচেয়ে অপছন্দনীয় বৈধ কর্ম।


দ্বিতীয়ত, স্বামী-স্ত্রীকে কোরআনুল কারীম ও হাদীস এমন সব দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে যেগুলোর উপর আমল করা হলে তালাক প্রদানের মতো জটিল পরিস্থিতি খুব কমই সৃষ্টি হবে। 


তৃতীয়ত, যদি তালাক প্রদানের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েই যায় তাহলে তার এমন পন্থা ইসলামী শরীয়তে বলে দেওয়া হয়েছে যাতে ক্ষতির দিক একেবারেই নগন্য। বর্তমান সমাজেও যদি মানুষ সেসব দিকনির্দেশনা মেনে চলে তাহলে বহু পারিবারিক দ্বন্দ্ব-কলহ ও সমস্যা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সমাধা হয়ে যাবে।


তালাকের ব্যাপারে কোরআন ও হাদীসের দিক-নির্দেশনা 


সমাজে যেন তালাকের ব্যাপকতা না ঘটে সেজন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সকল নির্দেশনা প্রদান করেছেন তার প্রথমটি হলো, 'স্বামীর কাছে যদি স্ত্রীর কোনো বিষয় অপছন্দ হয়, তাহলে সে স্ত্রীর ভালো গুণগুলোর প্রতি দৃষ্টিপাত করবে।' পৃথিবীতে কোনো মানুষই দোষ-ত্রুটিমুক্ত নয়। যদি কারও মাঝে একটি মন্দ দিক থাকে তাহলে তা সত্ত্বেও তার মাঝে ১০ টি ভালো দিকও থাকতে পারে। শুধু একটি দোষের দিকে দৃষ্টি আটকে রাখা আর ১০ টি উত্তম গুণ থেকে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া কোনো ন্যায়ানুগ মানুষের কাজ হতে পারে না। আর এভাবে কোনো সমস্যার সমাধানও হতে পারে না। বরং কোরআনুল করীম তো আরেক ধাপ অগ্রসর হয়ে পরিষ্কার ঘোষণা করেছে,

وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ فَإِنْ كَرِهْتُمُوهُنَّ فَعَسى أَن تَكْرَهُوا شَيْئًا وَيَجْعَلَ اللهُ فِيهِ خَيْرًا كَثِيرًا

অর্থাৎ স্ত্রীদের সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত সম্ভাব বজায় রেখে জীবনযাপন করো। অতঃপর যদি তোমরা তাদেরকে অপছন্দ কর, তবে হয়তো তোমরা এমন এক জিনিস অপছন্দ করছ যাতে আল্লাহ প্রচুর কল্যাণ রেখেছেন।-সূরা নিসা, ০৪: ১৯


অবাধ্য স্ত্রীদের সংশোধনের শরঈ রূপরেখা


পবিত্র কোরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

فَالصَّالِحَاتُ قَانِتَاتٌ حَافِظَاتٌ لِلْغَيْبِ بما حفظ اللَّهُ وَاللَّاتِي تَخَافُونَ نُشُوزهُنَّ فعظوهُنَّ وَاهْجُرُوهُنَّ فِي المضاجع وَاضْرِبُوهُنَّ فَإِنْ أَطَعْنَكُمْ فَلَا تَبْغُوا عَلَيْهِنَّ سَبِيلًا إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيًّا كَبِيرًا، وَإِنْ خفْتُمْ شِفَاقَ بينهما فَابْعَثُوا حَكَما مِنْ أَهْلِهِ وَحَكَما مِنْ أَهْلِهَا إِن يُرِيدًا إِصْلَاحًا يُوقِقِ اللَّهُ بينهما إن الله كان عليما خبيرًا،

অর্থাৎ নেককার নারীগণ অনুগত হয় এবং আল্লাহ যা হেফাজতযোগ্য করে দিয়েছেন। লোকচক্ষুর অন্তরালেও তার হেফাজত করে। আর যাদের অবাধ্যতার আশংকা কর তাদের সদুপদেশ দাও। তাদের শয্যা ত্যাগ করো এবং প্রহার করো। যদি তাতে তারা বাধ্য হয়ে যায়, তবে আর তাদের জন্য অন্য কোনো পথ অনুসন্ধান করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা সবার উপর ক্ষমতাবান শ্রেষ্ঠ। 

যদি তাদের মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদ হওয়ার মতো পরিস্থিতির আশংকা করো তবে স্বামীর পরিবার থেকে একজন এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন সালিস নিযুক্ত করো। তারা উভয়ে মীমাংসা চাইলে আল্লাহ তাদের তাওফীক দান করবেন। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছু অবহিত।-সূরা নিসা, ০৪ ৩৪-৩৫


সংশোধনের প্রাথমিক তিনটি উপায়


উপরোক্ত আয়াতদ্বয়ে নেককার নারীদের পরিচয় দেওয়ার পর যারা স্বামীদের আনুগত্য করে না কিংবা যারা এ ব্যাপারে শৈথিল্য প্রদর্শন করে কোরআনুল কারীম তাদের সংশোধনের জন্য পুরুষদের যথাক্রমে তিনটি উপায় বাতলে দিয়েছে। যার দ্বারা ঘরের বিষয় প্রয়ে ঘরের ভেতরই সংশোধিত হয়ে যাবে। করতে স্বামী-স্ত্রীর বিবাদ তাদের দুজনের মধ্যেই মীমাংসা হয়ে যাবে।

এতে পুরুষদের লক্ষ্য করে বলা হয়েছে যে, তোমরা যদি নারীদের অবাধ্যতা কিংবা আনুগত্যে কিছু অভাব অনুভব কর, স্তর তাহলে সর্বাগ্রে বুঝিয়ে-শুনিয়ে তাদের মানসিক সংশোধন করো। এতেই যদি ফল হয় তাহলে বিষয়টি এখানেই মিটে গেল। এতে সংশ্লিষ্ট স্ত্রী লোকটি সব সময়ের জন্য পাপ থেকে বেঁচে গেল। আর পুরুষও মানসিক যাতনা থেকে রেহাই পেল। এভাবে উভয়ে দুঃখ-বেদনার কবল থেকে বেঁচে যাবে। পক্ষান্তরে যদি বুঝিয়ে-শুনিয়ে কাজ না হয় তখন দ্বিতীয় পর্যায়ে তাদের সতর্ক করার জন্য এবং নিজের অসন্তুষ্টি প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে নিজে পৃথক বিছানায় শোবে। এটা একটা মামুলি শাস্তি এবং উত্তম সতর্কীকরণ। এতে স্ত্রী সতর্ক হয়ে গেলে বিদাদটিও এখানেই শেষ হয়ে গেল। এ ভদ্রোচিত শাস্তির পরেও স্বীয় অবাধ্যতা ও দুষ্কর্ম থেকে ফিরে না আসলে তৃতীয় পর্যায়ে সাধারণভাবে মারধর করার অনুমতি আছে। মারধরের সীমা হলো, শরীরে যেন মারের দাগ কিংবা জখম না হয়। মুখমন্ডলের উপর আঘাত করা যাবে না। এক সাহাবী বলেন,

قلت يا رسول الله ما حق زوجة أحدنا عليه؟ قال «أن تطعمها إذا طعمت وتكسوها إِذا اكتسيت أو اكتسبت ولا تضرب الوجه، ولا تقبح، ولا تهجر إلا في البيت.

আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের উপর স্ত্রীর কী হক?

তিনি বললেন, তুমি যখন খাবে তাকেও খাওয়াবে। তুমি যা পরবে তাকেও পরাবে। তার মুখমণ্ডলে আঘাত করবে না। তাকে অশ্লীল গালি দেবে না। প্রয়োজনে তার শুধু বিছানাই পৃথক করবে। ঘর থেকে বের করে দেবে না। সুনানে আবু দাউদ: ২১৪২


ভালো মানুষ স্ত্রীদের প্রহার করে না  


উপরোক্ত তিনটি স্তরের প্রাথমিক দুই স্তর ভদ্রোচিত। এ জন্য নেককার ও নবীদের থেকেও তা প্রমাণিত আছে। কিন্তু তৃতীয় স্তর অর্থাৎ শারীরিক শাস্তি-মারধর যদিও অনন্যোপায় হলে বিশেষ পন্থায় অনুমোদন রয়েছে। তবে রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা অপছন্দ করতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

ولن يضرب خياركم

অর্থাৎ ভাল্যে লোক স্ত্রীদের মারধর করে না।-সুনানে কুবরা বাইহাকী। ১৪৭৭৬ 

এ জন্যেই কোনো নবী থেকেও তা প্রমাণিত নেই।

যা হোক, যদি এ সাধারণ মারধরের মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়, তবুও উদ্দেশ্য হাসিল হয়ে গেল।


পুরুষদের বাড়াবাড়িও শাস্তিযোগ্য অপরাধ


উপরোক্ত আয়াতে যেমন স্ত্রীদের সংশোধনের জন্য পুরুষদের তিনটি অধিকার দেওয়া হয়েছে তেমনি আয়াতের শেষে এ কথাও বলা হয়েছে,

فإن أطعنكُمْ فَلا تَبْغُوا عَلَيْهِنَّ سَبِيلًا [النساء : ٤٣]

অর্থাৎ যদি এ তিনটি ব্যবস্থার ফলে তারা তোমাদের কথা মানতে আরম্ভ করে তবে তোমরা আর বাড়াবাড়ি করো না এবং দোষানুসন্ধানও করতে যেও না। কথায় কথায় তাদের দোষ ধরো না। অহেতুক বাড়াবাড়ি করো না। বরং সহনশীলতা অবলম্বন করো এবং ক্ষমা-সুন্দর দৃষ্টিতে দেখো। জেনে রাখো, আল্লাহ তাআলা স্ত্রীদের উপর তোমাদের কর্তৃত্ব দান করেছেন কিন্তু আল্লাহ তাআলার কর্তৃত্ব তোমাদের উপর রয়েছে। তোমরা যদি বাড়াবাড়ি কর তাহলে তার শাস্তি অবশ্যই তোমাদের ভোগ করতে হবে।


সংশোধনের চতুর্থ উপায়


উপরোক্ত তিনটি স্তরের দ্বারা ঘরের বিবাদ ঘরেই মীমাংসা হয়ে যাবে। কিন্তু অনেক সময় মনোমালিন্য ও বিবাদ দীর্ঘায়িত হয়। স্ত্রীর স্বভাবে তিক্ততা বা অবাধ্যতার কারণেই হোক বা স্বামীর ত্রুটি কিংবা অহেতুক বাড়াবাড়ির কারণে হোক ঘরের বিষয় আর ঘরে সীমিত থাকে না। একে অপরকে মন্দ বলা ও পারস্পরিক অপবাদারোপ, পারিবারিক বিসংবাদের রূপ নেয়। ঘরের বিষয় আর ঘরে সীমিত থাকে না। তখন কোরআনুল কারীম উভয় পক্ষের মুরব্বী অভিভাবক ও মুসলমানদেকে তাদের মধ্যে আপোষ করে দেওয়ার জন্য দুজন সালিস নির্ধারণের কথা বলেছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

فابعثوا حكما مِنْ أَهْلِهِ وَحَكَما مِنْ أَهلهَا.

তোমরা স্বামীর পরিবার থেকে একজন আর স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন সালিস নিযুক্ত করো। -সূরা নিসা ৪ : ৩৫


এতে করে বিষয়টি উভয় পরিবারের মাঝেই সীমিত থাকবে। আদালত পর্যন্ত গড়াবে না। মামলা-মোকাদ্দমা রুজু না করার বিষয়টি হাটে-ঘাটে বিস্তার লাভ করবে না।


বলা বাহুল্য যে সালিসদ্বয় প্রয়োজনীয় গুণবৈশিষ্ট্যের অধিকারী হতে হবে এবং বিশ্বস্ত ও দীনদার হতে হবে। বর্ণনা শেষে কোরআনুল কারীমে বলা হয়েছে,

 إن يُريدا إصلاحًا يُوفق الله بَيْنَهُمَا [النساء : ٥٣]

অর্থাৎ আপোষ মীমাংসাকারী সালিসদ্বয়ের নিয়ত যদি সৎ হয় এবং সত্যিকার অর্থেই যদি তারা স্বামী-স্ত্রীর সমঝোতা কামনা করে তাহলে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে গায়েবী সাহায্য হবে। ফলে তারা নিজেদের উদ্দেশ্যে কৃতকার্য হবেন। তাদের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা স্বামী-স্ত্রীর মাঝে সম্প্রীতি ও মহব্বত সৃষ্টি করে দেবেন।-তাফসীরে মাআরিফুল কোরআন


সর্বশেষে তালাক


আর যদি উপরোক্ত সকল স্তরের চেষ্টাই ব্যর্থ হয় এবং বৈবাহিক সম্পর্কের কাঙ্ক্ষিত ফল লাভের স্থলে উভয়ের একত্রে মিলেমিশে থাকা আযাবে পরিণত হয়। তখন এ সম্পর্ক ছিন্ন করাই উভয় পক্ষের জন্য শান্তি ও নিরাপত্তার পথ। তাই ইসলাম তালাক ও বিবাহ বিচ্ছেদের ব্যবস্থা রেখেছে। কিন্তু বলে দিয়েছে, তালাক হলো নিকৃষ্টতম হালাল। যাতে করে তা ব্যাপক হারে সংঘটিত না হয় সে জন্য তালাকের অধিকার পুরুষকে দেওয়া হয়েছে। কেননা চিন্তা শক্তি ও ধৈর্যের সামর্থ্য স্ত্রীলোক অপেক্ষা পুরুষদের মধ্যে অনেক বেশি থাকে। এতে করে সামাজিক ও সাধারণ বিরক্তির প্রভাবে ব্যাপক হারে তালাক সংঘটিত হবে না। তবে স্ত্রী জাতিকে এ অধিকার থেকে একেবারে বঞ্চিত করা হয়নি। স্বামীর জুলুম অত্যাচার থেকে আত্মরক্ষায় তাদের জন্য রয়েছে 'তাফয়ীজুত তালাকে'র বিধান। প্রয়োজনে বিয়ের সময়ই স্বামী থেকে তাফয়ীযের মাধ্যমে তালাক গ্রহণের ক্ষমতা নেওয়া যেতে পারে।


তালাক ও আমাদের সমাজ 


আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

الطلاق مَرْتَانِ فَإِمْسَاكَ بِمَعْرُوفٍ أَوْ تَسْرِيحُ ..... فإن طَلَّقَهَا فَلَا تَحِلُّ لَهُ مِنْ بَعْدُ حَتَّى تَنْكِحَ زَوْجًا غَيْرَهُ فَإِنْ طَلَّقَهَا فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا أَنْ يَتَرَاجَعَا إِنْ ظنا أَنْ يُقِيَما حُدُودَ اللَّهِ وَتِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ يُبَيِّنهَا لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ ، 

তালাক (রাজঈ) হলো, দুই বার পর্যন্ত, তার পর হয় নিয়মানুযায়ী রাখবে, না হয় সহৃদয়তার সঙ্গে বর্জন করবে।… … তার পর যদি সে স্ত্রীকে (তৃতীয় বার) তালাক দেওয়া হয়, তবে সে স্ত্রী যে পর্যন্ত তাকে ছাড়া অপর কোনো স্বামীর সাথে বিয়ে করে না নেবে তার জন্য হালাল হবে না। অতঃপর যদি দ্বিতীয় স্বামী তালাক দিয়ে দেয় তাহলে তাদের উভয়ের জন্যই পরস্পরকে পুনরায় বিয়ে করতে কোনো পাপ নেই, যদি আল্লাহর হুকুম বজায় রাখার ইচ্ছা থাকে। আর এ হলো, আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা।


যারা উপলব্ধি করে তাদের জন্য তা বর্ণনা করা হয়।-সূরা বাকারা, ২ : ২২৯, ২৩০ তালাক সংক্রান্ত আলোচনা কোরআনুল কারীমের অনেক আয়াতেই এসেছে, তবে উপরোক্ত আয়াতদ্বয়ে তালাক সংক্রান্ত নিয়মকানুন সম্পর্কে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তালাক হলো দুই বার এর পর হয়তো শরীয়তের নিয়মানুযায়ী তালাক প্রত্যাহার করা হবে বা সুন্দর ও স্বাভাবিকভাবে তার ইদ্দত শেষ হতে দেওয়া হবে। যাতে স্ত্রী মুক্তি পেতে পারে। এরপরও যদি তৃতীয় তালাক দেওয়া হয় তাহলে এ স্ত্রী আর তার জন্য হালাল থাকে না।


তালাকের ব্যাপারে আমাদের সমাজে প্রচলিত ভুল-ভ্রান্তি


কিন্তু আমাদের সমাজে বিভিন্ন বিষয়েই বহু ভুল-ভ্রান্তি বিস্তার করে আছে। নিত্য নতুন ভ্রান্তির উদ্ভবও হচ্ছে। তালাকের ব্যাপারে যে ভ্রান্তিগুলো আমাদের সমাজে বিরাজমান তা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর। এসব ভ্রান্তির কারণে মানুষ কত যে অন্যায় অবৈধ কাজে জড়িয়ে পড়ে তার সীমা-পরিসীমা নেই। মানুষ তালাককে রাগ প্রশমনের হাতিয়ার মনে করে। যখন তখন সামান্য ঝগড়ার কারণে তালাক দিয়ে ফেলে। আবার কেউ কেউ বোঝানোর চেষ্টা করে, রাগের অবস্থায় তালাক দিলে তালাক হয় না। একাকি তালাক দিলে তালাক হয় না। শুধু লিখিত দিলে, মৌখিকভাবে না বললে তালাক হয় না। সাক্ষীর উপস্থিতি না থাকলে তালাক হয় না। স্ত্রী না জানলে তালাক হয় না। তালাকনামা স্ত্রী গ্রহণ না করলে তালাক হয় না ইত্যকার সব গর্হিত কথাবার্তা যার স্বপক্ষে না আছে কোনো গ্রহণযোগ্য দলীল-প্রমাণ আর না আছে শরীয়ত স্বীকৃত কোনো যুক্তি। এ ব্যাপারে সবচেয়ে বড় ভ্রান্তি হলো, মানুষ তিন তালাকের কম এক-দুই তালাককে তালাকই মনে করে না। তালাক দিলে তিন তালাকই দিতে হবে। আমাদের সমাজ এমনটিই মনে করে। এজন্যে সাধারণত তিন তালাকের কম কেউ তালাক দেয় না। পক্ষান্তরে এর চেয়ে বেশি দেওয়া হয়। মূর্খ, শিক্ষিত, ধনী, গরিব সকলেই এই ভ্রান্তির শিকার। তালাক লিখিত আকারে দেওয়া হোক বা মৌখিক, স্ত্রী এক সাথে তিন তালাক দিয়ে ফেলে। এ অধিকন্তু স্বামী যদি এক তালাক দেয় তাহলে তাকে আরো উত্তেজিত করে এ তোলা হয়। বিভিন্ন কটু কথা বলে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়, যাতে সে তিন তালাক দিতে বাধ্য হয়। মোটকথা, যে পর্যন্ত স্বামী তিন তালাক না দেবে, স্বামীর রাগ দমন হবে না, স্ত্রীর রাগও কমবে না। পরিবার-পরিজনদের ক্রোধেও ভাটা পড়বে না। তখন বাচ্চাদের কথাও স্মরণ হবে না। ঘর বিরান হওয়ার কথা মনে পড়বে না। যখন স্বামী তালাকের তিনো গুলি ছুঁড়ে মারবে, তখন সবার রাগ ঠাণ্ডা হয়ে যায়। সকলের হুঁশ ফিরে আসে। 

তালাকের পর যখন ঘর সংসার বিরান হয়ে যায়। ছোট ছোট বাচ্চাদের করুণ চেহারা স্মৃতিপটে ভেসে উঠে। তখন সমস্ত ভুল বুঝে আসে, লজ্জিত হয়। কান্নাকাটি শুরু করে। কিন্তু তখন আর এ অনুশোচনা, কান্নাকাটি কাজে আসে না। তিন তালাক হয়ে গেছে। বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে। তালাকের অবৈধ প্রয়োগের ফলাফল এখন স্বামী-স্ত্রী পৃথক হয়ে যাওয়া। উপরন্তু যদি কোনো শরয়ী কারণ ছাড়া তালাক দেওয়া হয় তাহলে এ জুলুমের গোনাহ তো আছেই।


তখন মুফতীয়ানে কেরামের শরণাপন্ন হয়। তাদের হৃদয় বিদারক দাস্তান শোনানো হয়। বাচ্চাদের করুণ পরিস্থিতির কথা বলা হয়। কোনো ভাবে সুযোগ বের করার মিনতি জানানো হয়। কিন্তু তারা কী করবেন? তারা তো শরয়ী বিধানের নিকট সম্পূর্ণ দায়বদ্ধ।


যখন স্বামী শরীয়তের দেওয়া সব সুযোগ, সব পন্থা একেবারেই শেষ করে ফেলেছে, তখন কারও করার কিছু নেই। নিজের কর্মের দায়ভার নিজেকে ভোগ করতেই হবে।


তালাকের শরঈ রূপরেখা


যদি দাম্পত্য মীমাংসার পর্যায়ক্রমিক সব চেষ্টাই সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয় এবং তালাক প্রদানের সিদ্ধান্তই গৃহিত হয়, তাহলে পবিত্র কোরআন নির্দেশ দিয়েছে স্বামীকে উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করতে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপযুক্ত সময়ের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তা হলো, মাসিক ঋতুস্রাব থেকে মুক্ত হওয়া এমন পবিত্রতা, যে পবিত্রতায় স্বামী-স্ত্রী সহবাস হয়নি। এমন পবিত্রতার সময়ে স্ত্রীকে তালাক দিতে হবে। মাসিক চলাকালে তালাক প্রদান শরীয়তের দৃষ্টিতে গোনাহের কাজ। তেমনি যে পবিত্রতায় স্বামী-স্ত্রীর দৈহিক মিলন হয়েছে তাতেও তালাক দেওয়া বৈধ নয়। এমতাবস্থায় তালাক প্রদানের জন্য স্বামীকে পরবর্তী মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।


শরঈ পদ্ধতি অবলম্বনের ফায়দা


শরীয়তের বাতলানো এ পদ্ধতিতে বহু কল্যাণ নিহিত রয়েছে। এর অন্যতম একটি হলো, এ পদ্ধতি অবলম্বনে তালাক সাময়িক মনোমালিন্য বা তাৎক্ষণিক ঝগড়া-ফাসাদের ফলাফল হবে না। স্বামীকে উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা এজন্যই করতে বলা হয়েছে যে, এ সময়ে সে যাবতীয় পরিস্থিতি ভালোভাবে ভেবে দেখতে পারবে। যেভাবে ভেবেচিন্তে বিবাহ করেছিল, এরূপ ভেবেচিন্তেই তালাক প্রদান করবে। প্রতীক্ষার কারণে উভয়ের মতামতের পরিবর্তন ঘটারও প্রবল সম্ভাবনা থাকবে। অবস্থার উন্নতি ঘটলে তা আর তালাকের পর্যায় পর্যন্ত গড়াবে না।

তবুও উপযুক্ত সময় আসার পরও যদি তালাকের সিদ্ধান্ত অপরিবর্তিত থাকে, তাহলে শরীয়ত তালাক প্রদানের সঠিক পদ্ধতি এমন বর্ণনা করেছে যে, স্বামী শুধু এক তালাক দেবে। এতে করে এক তালাকে রজঈ পতিত হবে। ফলে ইদ্দত অতিবাহিত হলে বৈবাহিক সম্পর্ক নিজে নিজেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং উভয় নিজ ভবিষ্যতের ব্যাপারে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে। যদি তালাক দেওয়ার পর স্বামী নিজের ভুল বুঝতে পারে, ভবিষ্যত অবস্থা ভালো হবে বলে মনে করে, তাহলে ইদ্দত চলাকালে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারবে। ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য কেবল মুখে এটুকু বলাই যথেষ্ট, 'আমি তোমাকে ফিরিয়ে নিলাম।' এতে করে বৈবাহিক সম্পর্ক পুনর্বহাল হয়ে যাবে। যদি ইদ্দত অতিবাহিত হয়ে যায় এবং স্বামী-স্ত্রী মনে করে তাদের শিক্ষা হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে তারা ভদ্রভাবে জীবন অতিবাহিত করতে পারবে, তাহলে পারস্পরিক সম্মতিতে নতুন করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। যার জন্য নতুন করে ইজাব- কবুল, সাক্ষী ও মোহর নির্ধারণ উপরোক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করে যদি স্বামী-স্ত্রী পুনরায় বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং পরবর্তীতে কোনো কারণে তাদের মধ্যে পুনরায় কলহ দেখা দেয়, তাহলে দ্বিতীয়বারও তালাক প্রদানের ব্যাপারে তাড়াহুড়া করা উচিত নয়। বরং উপরোক্ত সকল নির্দেশনা অনুযায়ী আমল করে তালাকের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। এবারও এক তালাকই দেওয়া উচিত। এবার তালাক দিলে সর্বমোট দুই তালাক হয়ে যাবে। কিন্তু তারপরও বিষয়টি স্বামী-স্ত্রীর আয়ত্বে থাকবে। অর্থাৎ ইদ্দত চলা অবস্থায় স্বামী পুনরায় স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারবে। আর ইদ্দত অতিবাহিত হয়ে গেলে পারস্পরিক সম্মতিতে তৃতীয়বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। এই হলো কোরআন হাদীসে বর্ণিত তালাকের সঠিক পদ্ধতি এর দ্বারা সহজেই অনুমান করা যায়, কোরআন হাদীসে বৈবাহিক সম্পর্ক বহাল রাখতে ও তা ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা করতে পর্যায়ক্রমকে কী পরিমাণ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি স্তরে তা পুনর্বহালের সুযোগ রাখা হয়েছে। তবে হ্যাঁ, কোনো ব্যক্তিি যদি এ সকল স্তর অতিক্রম করে যায় তাহলে স্মরণ রাখতে হবে বিয়ে-তালাক কোনো খেল-তামাশা নয় যে, স্বামী কথায় কথায় তালাক দেবে আর তা প্রত্যাহার করে নিবে। এভাবে এ সম্পর্ক অনন্তকাল পর্যন্ত বাকি রাখবে। তাই কেউ যদি তৃতীয় তালাকও দিয়ে ফেলে তাহলে শরীয়তের স্পষ্ট বিধান হলো, এখন আর এ বিবাহ পুনর্বহাল করা যাবে না। স্বামী স্ত্রীকে আর ফিরিয়ে আনতে পারবে না। পারস্পরিক সম্মতিক্রমেও নতুন করে বিবাহ হতে পারবে না। এখন উভয়কে পৃথক হতেই হবে।


তালাকের ব্যাপারে সমাজের জঘন্যতম ভ্রান্তি


তালাকের ব্যাপার আমাদের সমাজে জঘন্যতম যে ভ্রান্তিটি বিস্তার লাভ করে আছে তা হলো, তিন তালাকের কম হলে মানুষ সাধারণত তালাকই মনে করে না। এজন্যই যখন তালাকের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তখন তিন তালাকের কমে ক্ষান্ত হয় না। ন্যূনতম তিন তালাক দিতেই হবে। এজন্য তিন তালাকই দিয়ে ফেলে। এক সাথে তিন তালাক দেওয়া শরীয়তের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ ও মারাত্মক গোনাহের কাজ। যে গোনাহের প্রাথমিক শাস্তি হলো, পারস্পরিক বৈবাহিক সম্পর্ক পুনর্বহালের সুযাগ শেষ হয়ে যাওয়া। হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী, হাম্বলী চার মাযহাবই এ ব্যাপারে একমত। এজন্য তিন তালাক দেওয়ার পর মানুষ কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হয়। বিধায় তালাকের ব্যাপারে প্রথম এ ভ্রান্ত ধারণাটি আমাদের সমাজ থেকে দূর করা প্রয়োজন। সাথে সাথে তালাক প্রদানের 

সঠিক ও উত্তম পন্থাও ব্যাপক হারে প্রচার করা উচিত। তালাক কেবল একবার প্রয়োগ করা। একের অধিক তালাক না দেওয়া। আর যদি কেউ ইদ্দত চলাকালে স্বামীর ফিরিয়ে নেওয়ার অধিকার বহাল রাখতে না চায়, তাহলে এক তালাকে বায়েন প্রয়োগ করা। এতে করে স্বামী এককভাবে ফিরিয়ে নেওয়ার অধিকার হারাবে। অবশ্য পারস্পরিক সম্মতিতে পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া যাবে। তালাক প্রদানের এ উত্তম পন্থা, যা সমগ্র উম্মতের সর্বসম্মত মতামত। এতে কারও কোনো দ্বিমত নেই। জনসাধারণের মাঝে ব্যাপক প্রচার উচিত। প্রচার মাধ্যম দ্বারাও তালাকের এ বিধান জনসাধারণের নিকট পৌছানো উচিত। সর্বোপরি উলামায়ে কেরামের এ বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া উচিত।


তিন তালাকের পরবর্তী শরঈ বিধান 


তিন তালাক দেওয়ার পর শুধু এ পথটি বাকি থাকে, স্ত্রী ইদ্দত পালন শেষে অন্যত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে। তার সাথে ঘর সংসার হবে। দৈহিক মিলন হবে। এর পর সে স্বেচ্ছায় তালাক দিলে ইদ্দত পালন শেষে স্ত্রী প্রথম স্বামীর সাথে পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। দ্বিতীয় বিয়েতে এ শর্ত আরোপ করা যে, দ্বিতীয় স্বামীকে তালাক দিতেই হবে শরীয়তের দৃষ্টিতে নাজায়েয ও লানতযোগ্য কাজ।


হাদীস শরীফে এমন শর্তকারী ও শর্তকৃত ব্যক্তি উভয়ের উপর লানত করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

لَعَنَ اللهُ الْمُحَلِّلَ وَالْمُحَلَّلَ لَهُ

যে হিলা করে এবং যার জন্য হিলা করে-উভয়কে আল্লাহ তায়ালা অভিশাপ দিয়েছেন।-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২০৭৬; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৯৩৬


কখনো আবার দ্বিতীয় স্বামী সহবাস ছাড়াই তালাক দিয়ে দেয়। এর জন্য চেষ্টাও করা হয় কিন্তু সহবাসের পূর্বে তালাক দেওয়া হলে প্রথম স্বামীর জন্য হালালই হবে না। কেননা প্রথম স্বামীর সাথে পুনরায় বিবাহ শুদ্ধ হওয়ার জন্য দ্বিতীয় স্বামীর দৈহিক মিলন শরীয়তের দৃষ্টিতে পূর্বশর্ত। যেমন : হাদীসে এসেছে-

جاءت امرأة رفاعة القرظي النبي صلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَتْ: كُنْتُ عند رفاعة، فطلقني، فأبت طلاقي، فتزوجت عَبْدَ الرَّحْمَنِ بْنَ الزَّبِيرِ إِنَّمَا مَعَهُ مِثْلُ هُدَبةِ الثَّوْبِ،

فقال، أترِيدِينَ أَنْ تَرْجِعِي إِلَى رِفاعة؟ لا، حَتَّى تَذُوقي عُسَيْلَتَهُ وَيَذُوق عسيلتك.

রিফায়া কুরাযীর স্ত্রী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে বললেন, আমি রিফায়ার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিলাম। সে আমাকে তালাক দিয়েছে। তিন তালাক। অতঃপর আমি আব্দুর রহমান ইবনে যাবীরের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। কিন্তু আমি তাকে পুরুষত্বহীন পেয়েছি।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি কি রিফায়ার নিকট ফিরে যেতে চাও? অর্থাৎ তার সাথে পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাও? আমি বললাম, জি হ্যাঁ।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি তা পারবে না, যে পর্যন্ত তুমি তার সহবাসের স্বাদ আস্বাদন করবে আর সে তোমার সহবাসের স্বাদ গ্রহণ না করবে।-সহীহ বুখারী, হাদীস ২৬৩৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১১


তালাক দেওয়ার পর অস্বীকার করা


শরীয়তের অনুসরণ না করে যখন কেউ এমন জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়, তখন কেউ কেউ তিন তালাক দেওয়ার পরও অস্বীকার করে। জেনে-বুঝে পরিষ্কার মিথ্যার আশ্রয় নেয়। এক তালাক বা দুই তালাক দিয়েছে বলে সমাজে প্রকাশ করে। যেন সমাজে লাঞ্চিত না হতে হয়। আখেরাতের শাস্তিকে ভয় না করে পূর্বের ন্যায় ঘর-সংসার করতে থাকে। এভাবে সারা জীবন ব্যভিচারের মতো মহাপাপে লিপ্ত থাকে। আর নিজের আখেরাতকে একেবারেই ধ্বংস করে দেয়।


অনিচ্ছাকৃত তালাক


প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তালাক কেউ ইচ্ছাকৃত দিক বা অনিচ্ছায় কিংবা হাসি তামাশাচ্ছলে সর্বাবস্থায় তা পতিত হয়ে যাবে। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,

ثلاث جِدهُنَّ جِدٌ، وَهَرْلُهُنَّ جِد النكاح، والطلاق، والرجعة

তিনটি বিষয় এমন রয়েছে যেগুলো ইচ্ছাকৃত বলা আর হাসি তামাশাচ্ছলে বলা একই সমান:

এক. বিবাহ।

দুই. তালাক।

তিন. রাজয়াত বা তালাক প্রত্যাহার।- সুনানে তিরমিযী, হাদীস ১১৮৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২১৯৪


এ তিনটি বিষয়ে শরীয়তের বিধান হচ্ছে, যদি দুজন নারী-পুরুষ বিয়ের ইচ্ছা ব্যতীতও সাক্ষীর সামনে হাসতে হাসতে বিয়ের ইজাব কবুল করে নেয়, তবুও বিয়ে হয়ে যাবে। তেমনি কেউ যদি হাসতে হাসতেও অনিচ্ছাসত্ত্বেও তালাক দেয় তাতেও তালাক হয়ে যাবে। 


লেখক: সিনিয়র মুহাদ্দিস ও মুশরিফ, ফাতওয়া বিভাগ, মাদরাসা বাইতুল উলূম ঢালকানগর, গেণ্ডারিয়া, ঢাকা-১২০৪


প্রসঙ্গসমূহ:

মন্তব্য (...)

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →

মুফতী আবুল হাসান শামসাবাদী

শাইখুল ইসলাম আল্লামা যাহেদ কাউছারী রহঃ

মুফতী আব্দুল হান্নান হাবীব

মুফতী সালমান মানসুরপুরী

শাইখুল হাদীস আল্লামা আব্দুল কুদ্দুস দাঃ

আল্লামা আহমাদ মায়মূন

মাওলানা আতাউল্লাহ আব্দুল জলীল

আল্লামা রফী উসমানী রহঃ

মুফতী রশীদ আহমদ লুধিয়ানভী রহ.

মাওলানা নূর আলম খলীল আমিনী

হযরত মাওলানা আবদুল হাই পাহাড়পুরী রহঃ

হযরতজী মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভি রহঃ

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রহমান

মাওলানা মুহাম্মাদ ইমরান হুসাইন

মাওলানা শাহাদাত সাকিব

আল্লামা ইসহাক ওবায়দী রহঃ

মাওলানা ওমর পালনপুরী

মুফতী আবুল কাসেম নোমানী

হাকীমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানভী (রহ)

আল্লামা মানাযির আহসান গিলানী রহঃ