প্রবন্ধ

ঈদ উদ্যাপন : আগে ও এখন

লেখক:মাসিক আলকাউসার
২১ মার্চ, ২০২৪
৫৭৬০ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

ঈদ একটি ইসলামী পরিভাষা। এটি মুসলিম উম্মাহর বিশেষ ধর্মীয় উৎসব। ঈদ মুসলমানদের সংস্কৃতি- এ কথার আগে যুক্ত করে নিতে হবেএটি ইসলামের দেওয়া সংস্কৃতি। অতএব ইসলামী মূল্যবোধের আলোকেই একে বুঝতে হবে এবং দ্বীন ও শরীয়তের শেখানো পদ্ধতিতেই এর উদ্যাপন করতে হবেনিজেদের মনগড়া ধ্যান-ধারণার আলোকে নয়কিংবা শরীয়তের বিধিনিষেধ বিবর্জিত বস্তুবাদী ও ভোগবাদী মানসিকতা নিয়ে নয়।

ঈদ আসলে কী?

মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার পর ঈদুল ফিতরের এই দিনটি মূলত আল্লাহ দিয়েছেন তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা নিবেদনের জন্য। তিনি যে রমযানের সবকটি রোযা রাখার এবং তাঁর ইবাদতে পুরো একটি মাস কাটানোর  তাওফীক দিয়েছেন সেজন্য শোকর আদায়- এটাই ঈদের তাৎপর্য। এই মাসে রোযা রাখতে পারা এবং আল্লাহর ইবাদতের অসীম-অবারিত সুযোগ পাওয়ার যে আনন্দ মুমিন-হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়- ঈদুল ফিতর হল সেই আনন্দ প্রকাশ করার উৎসব। সে আনন্দের প্রকাশ ঘটে দলে দলে ঈদগাহে হাজির হয়ে মহান রবের কৃতজ্ঞতায় সালাত আদায়ের মধ্য দিয়ে। তাঁর মহিমা ও বড়ত্বের ঘোষণা দিয়ে তাকবীর পাঠের মাধ্যমে এবং এই সিয়ামসাধনা যেন কবুল হয় সেজন্য একে অপরের কাছে দুআ চাওয়ার মাধ্যমে।

ঈদের দিন কুশল বিনিময়ের ভাষার মধ্যেই এ বার্তা রয়েছে-

تَقَبَّلَ اللهُ مِنَّا وَمِنْكُمْ.

অর্থাৎ আল্লাহ কবুল করুন- রমযান মাসে ও আজকের দিনে করা আমাদের ও তোমাদের সমস্ত নেক আমল।

কুশল বিনিময়ের এই বাক্যটিই ইসলামের ঈদকে অন্যান্য ধর্মের উৎসব থেকে আলাদা করে দেয়। মুসলমানের ঈদ আশা ও ভয়ে মিশ্রিত এক সতর্ক ও সংযত আনন্দ উদ্যাপন। একদিকে খুশি- আলহামদু লিল্লাহরোযাগুলো রাখতে পেরেছি। অন্যদিকে শঙ্কা- কবুল হয়েছে তো! রমযান পেয়েও যদি মাগফিরাত নসীব না হয়তাহলে এর চেয়ে দুর্ভাগ্য তো কিছু নেই...। 

মাসব্যাপী ইবাদতের তাওফীক পেয়ে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন এবং সেই খুশিতে তাঁর বড়ত্ব বর্ণনা করে তাকবীর পাঠএটাই যে ঈদের মর্মকথা- নিম্নোক্ত আয়াতই তার প্রমাণ-

وَلِتُكْمِلُواْ الْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُواْ اللهَ عَلٰى مَا هَدَاكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُون.

এবং যাতে তোমরা রোযার সংখ্যা পূরণ করে নাও আর  আল্লাহ যে তোমাদের পথ দেখিয়েছেনসেজন্য আল্লাহর তাকবীর পাঠ কর ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। -সূরা বাকারা (২) : ১৮৫

আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অংশ হিসেবেই এদিন বৈধ সব উপায়ে আনন্দ করতে দেওয়া হয়েছে। একজন মুমিন শরীয়তের সীমার ভেতরে থেকে যেভাবে আনন্দ করতে পারে। ভালো খাওয়াভালো পরাআপনজন ও প্রিয়জনদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ ও খোশগল্পএকে অপরকে হাদিয়া দেওয়াআত্মীয়-স্বজনের খোঁজখবর নেওয়া ইত্যাদি।

এই আনন্দে যেন সমাজের সব শ্রেণির মানুষ শরীক হতে পারেসেজন্যই সদাকাতুল ফিতরের বিধান। শুধু নিজে ভালো খাওয়া ও ভালো থাকার যে আনন্দ- অন্যের মুখে হাসি ফোটানোর  আনন্দ তার চেয়ে বহুগুণে বেশি। এ কারণেই দান-সদকা ও যাকাত-ফিতরার প্রতি এত উৎসাহিত করেছে শরীয়ত।

ইসলাম যে তার অনুসারীদের ধর্ম-কর্ম পালনের পাশাপাশি আনন্দ উদ্যাপনেরও সুযোগ দিয়েছেঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দিনদুটি তারই এক বড় নিদর্শন। ঈদের দিন বৈধ পন্থায় আনন্দ উদ্যাপনের এই অবকাশ প্রসঙ্গেই আম্মাজান আয়েশা রা. নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস বর্ণনা করেছেন-

لَتَعْلَمُ يَهُودُ أَنَّ فِي دِينِنَا فُسْحَةً، إِنِّي أُرْسِلْتُ بِحَنِيفِيَّةٍ سَمْحَةٍ.

ইহুদীরা জানবেআমাদের ধর্মেও অবকাশ আছে। নিশ্চয়ই আমি প্রেরিত হয়েছি এমন এক শরীয়ত নিয়েযা সহজতা ও উদারতার গুণে গুণান্বিত। -মুসনাদে আহমাদহাদীস ২৪৮৫৫

সালাফের ঈদ

শরীয়তের শিক্ষা ও শরয়ী জ্ঞানের চর্চার অভাবে এবং শরীয়া প্রতিপালনে মুসলমানদের বর্ধমান উদাসীনতার কারণে ঈদের এই যে তাৎপর্য- সেটা দিন দিন দৃশ্যপটের আড়ালে চলে যাচ্ছে। তার স্থানে জায়গা করে নিচ্ছে ঈদের এমন এক সংজ্ঞা এবং চিত্র ও চরিত্রশরীয়তের মেযাজ ও রুচির সাথে যার কোনো মিল নেই।

বরং  বলা যায়যে উদ্দেশ্যে রোযা ও ঈদতার সম্পূর্ণ বিপরীত এক স্রোত গ্রাস করে নিচ্ছে মুসলমানদের ঈদভাবনা ও ঈদ-উদ্যাপন কর্মকাণ্ডকে।

ঈদের স্বরূপ ও শিক্ষা থেকে আমরা কত দূরেসেটা বুঝতে পারব আমাদের পূর্বসূরিদের সঙ্গে নিজেদেরকে একবার মিলিয়ে নিলে।

সালাফে সালেহীন ঈদকে বাধ্যবাধকতার বন্ধন থেকে মুক্তি হিসেবে দেখেননিবরং ইসলামের অন্যতম সম্মানিত দিন হিসেবে দেখেছেন। বিভিন্ন হারামে জড়িয়ে এ দিনের পবিত্রতা লঙ্ঘন করেননিকোনো কর্তব্য কাজে শিথিলতা করেননি। বরং এ দিনটিতে তারা নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন জায়েয খাবার ও পানীয় এবং পরিমিত ও পরিমার্জিত সাজসজ্জার মধ্যে এবং সেইসব কাজের মধ্যেযা মুমিন-হৃদয়ে প্রফুল্লতা আনেযেমন আল্লাহর যিকির ও তাসবীহ-তাকবীরআত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা এবং নির্দোষ হাসি-আনন্দ ও বৈধ বিনোদন। নিজের ও পরিবারের জন্য ভালো মানের খাবার ও পোশাকের ব্যবস্থা ইত্যাদি।

ওয়াকী‘ রাহ. বর্ণনা করেছেনতিনি বলেনআমরা ঈদের দিন সুফিয়ান সাওরীর সাথে বের হয়েছিলামতখন তিনি বললেনএই দিনটি আমরা প্রথম যে কাজ দিয়ে শুরু করিতা হল দৃষ্টি অবনত করা। -আলওয়ারা‘, ইবনু আবিদ দুনইয়াপৃ. ৯৬৩

তাঁদের কাছে প্রকৃত ঈদ ছিল আল্লাহর কাছে কবুলিয়ত এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ।

আলী রা. সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছেতিনি রমযানের শেষ রাত্রিতে বলতে থাকতেন-

يا لَيتَ شعريمَن هذا المَقبولُ فنُهنِّيه؟ ومن هذا المحروم فنُعزّيه.

হায়জানা নেইকে আমাদের মাঝে মাকবুলযাকে স্বাগত জানাব! আর কে আমাদের মাঝে মাহরূমযাকে সমবেদনা জানাব! -লাতাইফুল মাআরিফইবনে রজব হাম্বলীপৃ. ৩৬৯

সালাফে সালেহীন ঈদের দিন এই চিন্তাতেই বিভোর থাকতেন। তার ভেতর দিয়েই হত তাদের ঈদ উদ্যাপন। আনন্দ-বিনোদনের নামে হারাম ও গর্হিত কাজে লিপ্ত হওয়ার তো প্রশ্নই নেই। কারণবিবেকবান পরহেযগার মানুষের কাছে পাপাচারের পঙ্কিলতায় ডুবে যাওয়া কোনোভাবেই আনন্দের বিষয় হতে পারে নাআনন্দ উদ্যাপনের তরীকা হতে পারে না। হাসান বসরী রাহ. তাই বলেছেন-

كلَّ يومٍ لا تَعصِي اللهَ فيه فهو لك عيدٌ.

প্রতিটি দিনযেদিন তুমি আল্লাহর নাফরমানি কর নাসেটা তোমার জন্য ঈদ। -লাতাইফুল মাআরিফইবনে রজব হাম্বলীপৃ. ৫১২

কথাটিকে আরেকভাবে পড়ুনযেদিন আল্লাহর নাফরমানি করা হয়সেটা ঈদের দিন হলেও ঐ নাফরমান ব্যক্তির জন্য তা ঈদ বা খুশির দিন নয়বরং ওয়াঈদ ও অভিশাপ!

ঈদ ও আমরা

আজ আমাদের অনেকেরই অবস্থা এমনঈদ তাদের ইবাদতকে প্রতিফলিত করে না। রমযানজুড়ে সিয়াম সাধনার কোনো ফলাফল তাদের এই দিনটির কথা ও কাজে প্রকাশ পায় না। ঈদের জন্য তারা এমনভাবে প্রস্তুতি নেয়ঈদের আয়োজন ও ঈদ-উপভোগে তারা এমনই আত্মহারা ও লাগামহীন হয়ে পড়ে যেভাব দেখে মনে হয়তারা যেন কোনো দাসত্বের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে গেছে বা অচিরেই মুক্ত হতে চলেছে। তাই এমন বাঁধভাঙা উল্লাস ও দিশেহারা অবস্থা। কী রেখে কী করবে ঠিক নেই। অপচয় ও ঔদ্ধত্য প্রকাশে কে কাকে ছাড়িয়ে যাবেসেই প্রতিযোগিতা। চোখের লালসা এবং মনের বাসনা পূরণের যত রকম উপায় ও উপকরণ হতে পারে- তার চর্চা ও প্রসারের এক মহা ধুম! পোশাক-আশাক ও পানাহার থেকে শুরু করে চলাফেরা ও কথাবার্তাদেখাসাক্ষাৎ ও মেলামেশা এবং বিনোদনমূলক প্রোগ্রাম ও আয়োজনকোনো কিছুতেই হালাল-হারামের তোয়াক্কা নেই...।

পবিত্রতা ও সংযমে পার করা একটি মাসের বরকত তারা নষ্ট করে ফেলে সে মাস গত হওয়ার প্রথম দিনটিতেই!

শরীয়তের প্রতি অনুগত ও শরীয়া পালনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ একজন মুসলমানের অবশ্যই জানা উচিত যেআনন্দ করা শরীয়তে নিষেধ নয়। তবে তা করতে হবে শরীয়তের নির্দেশিত ও অনুমোদিত পন্থায়। বিশেষ করে যখন সে আনন্দের উপলক্ষ্যটি শরীয়ত নিজেই প্রদান করে- এক মহান লক্ষ্যেশরীয়তের এক বিরাট শিআর ও নিদর্শন হিসেবে!

সত্যিকার মুসলিম ইসলামের শেখানো পন্থায়ই তার সব কাজ করে। কী ইবাদত কী উৎসব। মন যেভাবে চায় সেভাবে নয়। কারণসে বিশ্বাস করেমনের চাহিদা পূরণের সুখটুকু তাৎক্ষণিক ও সাময়িককিন্তু তার ক্ষতি ও সাজা অসীম ও অনন্তকালীন।

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ