প্রবন্ধ
ঈদ পালনের শরয়ী পদ্ধতি
আনন্দ-উৎসব মানুষের স্বভাবজাত একটি চাহিদা। আনন্দ যখন ব্যক্তি ছাড়িয়ে জনগোষ্ঠিকে স্পর্শ করে তখন তা উৎসব। আরবী ভাষায় আভিধানিক অর্থে এরই নাম ঈদ। স্বভাবধর্ম ইসলামে মানুষের উৎসব চাহিদাকে অস্বীকার করা হয়নি এবং হালকাভাবেও নেয়া হয়নি। জাহেলিয়াত-নির্ভও উদ্দেশ্যবিহীন ও বল্গাহীন উল্লাসকে ইসলাম শুধু উদ্দেশ্যমুখর করেছে এবং তাতে পদ্ধতি ও মাত্রার লাগাম এঁটে দিয়েছে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘প্রত্যেক জাতি-গোষ্ঠিরই ঈদ-উৎসব রয়েছে। আর ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা আমাদের উৎসবের দিন। জানা গেল, ইসলাম কোনও শুষ্ক ও নিরস ধর্ম নয়। এতে চিত্তবিনোদনেরও সুযোগ দেয়া হয়েছে। তবে তার ব্যবহারিক দিক ও উদযাপন পদ্ধতি মনগড়া কিংবা ইচ্ছা মাফিক নয়; উদ্দেশ্য সাপেক্ষ ও নিয়মের অধীন। হযরত আনাস রাযি. বলেন,নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় এসে দেখলেন, মদীনাবাসী বছরের দুটো দিন আনন্দ উদযাপন করে। তিনি জানতে চাইলেন,এর তাৎপর্য ও ইতিহাস কী? সাহাবায়ে কেরাম বললেন, জাহেলী যুগে এ দুটো দিনে আমরা খেলাধুলা ও আমোদ-প্রমোদে কাটাতাম। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন,আল্লাহ তা'আলা তোমাদের জন্য এ দিন দু'টিকে তার চেয়ে উত্তম দু'টি দিনে পরিবর্তন করে দিয়েছেন। তা হলো,ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। (সুতরাং এখন আর ও দু'টোর প্রয়োজন নেই)।
কার জন্য ঈদের আনন্দ, কার জন্য নয়
দুঃখের পর সুখ, বেদনান্তে আনন্দ এবং ক্লান্তি শেষে বিশ্রাম চিরকালই উপভোগ্য। সে জন্যই বোধ হয় সিয়াম সাধনার সমাপ্তিতে ঈদুল ফিতরের ব্যবস্থা। দীর্ঘ এক মাস দিন-রাত্রির মেহনত শেষে প্রাপ্তি ও পুরস্কারের ঘোষণা আনন্দেরই বটে। সিয়াম-সাধকেরা এ দিন দয়াময়ের বিশেষ ক্ষমা ও সবিশেষ করুণা লাভ করেন। তৃপ্ত ও আনন্দিত হন। হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী এবং নিয়মমাফিক এ প্রাপ্তি ও পরিতৃপ্তি রোযাদারের জন্য সংরক্ষিত। যে প্রাপ্তবয়স্ক বিনা কারণে রোযার পরিশ্রম স্বীকার করে না, আবার “নেমন্তন্ন' ছাড়াই ঈদগাহে হাজির হয় তার জন্য দিনটি عيد নয়, وعيد তথা পুরস্কার নয় তিরস্কারের। তবে বয়স আর ওযর যাদেরকে রোযা রাখা থেকে বিরত রেখেছে; আগ্রহ ও আফসোস তাদেরকেও সৌভাগ্যবানদের কাতারে শামিল রাখবে ইনশাআল্লাহ। অর্থাৎ ঈদের আনন্দে এদের জন্যও বরাদ্দ আছে; নেই শুধু হতভাগা পেট পূজারীদের। কিন্তু বিনা দাওয়াতী মেহমানের মতো ঈদ পালনে এসব ‘পেটের বান্দাদেরকেই বেশি তৎপর দেখা যায়। এদের ঈদ প্রোগ্রাম, শুভেচ্ছা বিনিময়, ঈদ কেন্দ্রিক কেনাকাটা, খাওয়া-দাওয়া, হৈ হুল্লোড় আর ব্যতিব্যস্ততা দেখে মনে হয়, ঈদটি যেন হঠাৎই ভূঁই মাটি ফুঁড়ে উঠে এসেছে; এক মাস সিয়াম সাধনার সাথে তার কোনও সম্পর্ক নেই। আল্লাহর পানাহ্।
ঈদ পালনের ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি
অন্যান্য জাতি গোষ্ঠি ও ধর্মাবলম্বীরা তাদের উৎসব-দিবসে অবাধ স্বাধীনতা লাভ করে। সাধারণ অবস্থায় নিষিদ্ধ ও লজ্জাকর কর্মকাণ্ডও এসব দিনে বৈধ মনে করা হয়। বাধা-নিষেধের দেয়াল ও আঁড়ালকে সর্বতোভাবে উপেক্ষা করা হয়। মনে হয় যেন নিয়ম ভাঙ্গাই এসব দিবসের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য। উদাহরণত হিন্দুদের পূজা-পার্বণ ও তার পালন পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত ব্যক্তি জানেন, উৎসবের বাহানায় দূর্গা পূজা ও হোলি উৎসবে তাদের নারী পুরুষেরা কতোটা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। অবাধ মেলামেশা ও এই বিষয়ক স্বেচ্ছাচারিতা কতোটা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে এবং নগ্নতাও অবস্থাদৃষ্টে কিভাবে লজ্জা পায়! আর খ্রিস্টানদের বড়দিনে তো অন্যায় অপরাধ সারা বছরের ঘাটতি পুষিয়ে নেয়। শরাব-কাবাব, সাকী-সুরাহী সব সেদিন মৌরুসি সম্পত্তি; যেভাবে খুশি যতোটা খুশি লুটে নেয়া যায়। কিন্তু ইসলাম ভদ্রতা, শালীনতা ও আনুগত্যেও ধর্ম। আখেরাতমুখী এ ধর্মে পার্থিব ভোগ- বিলাস আর আনন্দ-উৎসবে স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ নেই। ইসলাম এক সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। উৎসব পালনে ও ঈদ উদযাপনে তার আছে 'ধন্য' ভাবনা ও ‘ধনন্য' রীতি। অন্যান্য জাতি ধর্মেও আনন্দ-উৎসব ঐচ্ছিক ব্যাপার। মন চাইলে কেউ গীর্জা-মন্দিরে যেতেও পারে, নাও যেতে পারে। কিন্তু রোযাদারের জন্য ঈদ পালন ঐচ্ছিক বিষয় নয়; ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত ও সওয়াব অর্জনের মাধ্যম। ঈদের দিন হাসিখুশি থাকা ও সাধ্যানুযায়ী আনন্দ প্রকাশ করা নববী আদর্শ। অন্যান্য জাতির উৎসব-দিবসে নিয়মিত বিধি-বিধানকে শিথিল মনে করা হয়। আর ইসলামকে দেখুন, বছরের আর দিনগুলোকে বেতেরসহ ছয় ওয়াক্ত নামায বিধিবদ্ধ হলেও ঈদের দিন দায়িত্ব বাড়িয়ে দেয়া হয়। ঈদগাহে গিয়ে বিশেষ নিয়মে দু' রাকাআত নামায অতিরিক্ত আদায় করতে হয়। নামাযান্তে দু'টি খুতবা শোনতে হয়। ঈদগাহে আসা যাওয়ার পথে তাকবীর বলতে হয়। অধিক পরিমাণে দান খয়রাতে উৎসাহ দেয়া হয়। গরীব-দুঃখী, অভাবী- অনাহারীর প্রতি সহমর্মিতার তাগিদ দেয়া হয়। মোটকথা, শিথিল তো নয়ই দায়িত্ব বরং বাড়িয়ে দেয়া হয়। এটা কেবল ইসলামেরই সৌন্দর্য ও স্বাতন্ত্র্য যে, উৎসবের দিনে দায়িত্ব কমানো হয় না,বাড়ানো হয়।
ঈদের রাতের আমল
এক মাস সিয়াম সাধনার পর ঈদের চাঁদ দেখা গেলে বহু রোযাদারের সংযম ছুটে যায়। রমাযানের দিন-রাতগুলো ইবাদত বন্দেগীতে কাটালেও চাঁদ ওঠার পর সবকিছুর যেন ছুটি হয়ে যায়। অথচ ইসলাম চায় রমাযানে অর্জিত আমলের ধারাবাহিকতা সারা বছর বজায় থাকুক। আখেরাতের ফসল তোলার একটা সুযোগও বান্দার হাতছাড়া না হোক এবং একটা মুহূর্তও সে উদাসীন না থাকুক। আর এর শুরু হোক ঈদের রাত থেকেই। মূলত ব্যাপক গাফলতের সময় যে ব্যক্তি সচেতন থাকে তার মূল্যায়ন সব সময়ই বেশি হয়। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,من أحيا ليلتي العيدين لم يمت قلبه يوم تموت القلوب অর্থ : যে ব্যক্তি দুই ঈদের রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদত-বন্দেগী করবে তার অন্তর সে দিনও মরবে না যে দিন সকল অন্তর মরে যাবে। (আল আযকারুন নববিয়্যাহ ১/৩৭৫)
ঈদুল ফিতরের সুন্নাত ও মুস্তাহাবসমূহ
#নিজ মহল্লার মসজিদে ফজর নামায আদায় করা। #মিসওয়াক করা।
#গোসল করা। # খুশবু ব্যবহার করা। # সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হলে ঈদগাহের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পূর্বেই তা আদায় করা। # সাধ্যানুযায়ী উত্তম কাপড় পরিধান করা। # খুশি ও আনন্দ প্রকাশ করা। # ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে কিছু নাস্তা করা। # ঈদুল ফিতরে বেজোড় সংখ্যক খেজুর অথবা মিষ্টি জাতীয় খাদ্য দ্বারা এই নাস্তা সম্পন্ন করা। # সামর্থ্য অনুযায়ী অধিক পরিমাণে দান-খয়রাত করা। # পায়ে হেঁটে ঈদগাহে গমন করা। # ধীরস্থিরভাবে ঈদগাহে যাওয়া মুস্তাহাব। # ঈদগাহে এক পথে যাওয়া অন্য পথে প্রত্যাবর্তন করা। # ঈদের জামা'আত ঈদগাহে করা। # ঈদগাহে গমনকালে নিম্নস্বরে তাকবীরে তাশরীক বলা। اَللهُ أًكْبَرُ اَللهُ أَكْبَرُ، لاَ إِِلٰهَ إِلاَّ اللهُ وَاللهُ أَكْبَرْ، اَللهُ أَكْبَرْ وَلِلَّه اْلحَمْد
ঈদের দিনের মাকরূহ কাজ
ঈদের নামাযের পূর্বে ঈদগাহ, মসজিদ বা ঘরে নফল নামায পড়া মাকরূহ। এমনকি মহিলাদের জন্যও ঈদের নামাযের পূর্বে ইশরাক বা চাশতের নামায পড়া মাকরূহ। অনুরূপ ঈদের নামাযের পর ঈদগাহে নফল পড়াও মাকরূহ। তবে ঘরে ফিরে পড়া যাবে।
ঈদের দিনের কিছু রসম রেওয়াজ ও তার পর্যালোচনা
নতুন কাপড় পরিধান করা : শরীয়তে ঈদের দিন নতুন কাপড় পরার বাধ্য-বাধকতা নেই। মূলত নিজের ব্যবহারের সবচেয়ে ভালো, পরিচ্ছন্ন, মার্জিত ও শরীয়তসম্মত পোশাকটি পরিধান করা ঈদের সুন্নাত। আনকোরা নতুন কাপড়ই পরতে হবে; সামর্থ্য না থাকলেও ধার কর্জ করে যোগাড় করতে হবে- এটা ঠিক নয়। তবে পরিবার প্রধানের সামর্থ্য থাকলে নিজের ও অধীনস্তদের জন্য নতুন কাপড়ের ব্যবস্থা করা ভালো। এতে অপরকে খুশি করার সওয়াব পাওয়া যায়। আজকাল ঈদ উপলক্ষে সবচে' দামী, সবচে সুন্দর আধুনিকতম ডিজাইনের কাপড় সংগ্রহ করার রীতিমত প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যায়। এভাবে লোকদেখানো ও গর্ব- গৌরবের উদ্দেশ্যে কাপড় সংগ্রহ করা ও পরিধান করা বিলকুল হারাম। হ্যাঁ, আল্লাহ তা'আলার নেয়ামতের শুকরিয়া ও কৃতজ্ঞতা স্বরূপ হলে অসুবিধা নেই।
পুরুষ লোকের সিল্কের পোশাক পরিধান ঈদের দিন অনেক নামাযীকে সিল্কের (যার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ সুতা অথবা শুধু প্রস্থ সুতা সিল্কের) পাঞ্জাবী পরে ঈদগাহে হাযির হতে দেখা যায়। পুরুষের জন্য সাধারণ অবস্থায়ই এ কাপড় পরা হারাম। তাহলে ভাবা উচিত, ক্ষমা ও পুরস্কারের আশায় এ কাপড় পরে ঈদগাহে হাযির হওয়া কতোটা গর্হিত অপরাধ হবে? মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রদ্রোহীর প্রাপ্য পুরস্কার নয় তিরস্কার।
খানা পিনা ও মেহমানদারীর আয়োজন
ঈদের দিন পরিবার-পরিজন, আত্মীয়- স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের জন্য ভালো খানাপিনার আয়োজন করা হয়ে থাকে। আয়োজনকারীর শরীর-স্বাস্থ্য, সময় ও সামর্থ্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে করা হলে ভালো। এ ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি অর্থাৎ সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও আর দিনগুলোর মতো সাধারণ খাবারের ব্যবস্থা করা কিংবা ধার-কর্জ করে উন্নত খানার আয়োজন করা দু'টোর কোনটিই কাম্য নয়। লক্ষণীয় হল, ঈদের দিন সাধারণত খানা-পিনার অপচয় করা হয়; অনেক খাবার নষ্ট করা হয়। তেমনটি হলে ঈদ পালনকারীকে গুনাহের বোঝাও সামলাতে হবে। সুতরাং মধ্যপন্থা কাম্য।
মসজিদ ও ঈদগাহ লাইটিং করা, কাগজ কেটে সুসজ্জিত করা
ঈদ উপলক্ষে মসজিদ ও ঈদগাহে অপ্রয়োজনীয় আলোকসজ্জা ও শোভাবর্ধনের নামে বাড়াবাড়ি করা অপব্যয়ের অন্তর্ভুক্ত ও নিষিদ্ধ। অবশ্য নামাযে এতমিনানের স্বার্থে ঈদগাহকে প্রয়োজনীয় পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি করা এবং এ কাজে প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয় করা উক্ত নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত নয়। কোন কোন এলাকায় তরুণ-যুবকেরা ঈদগাহের 'ডেকোরেশন' এর নামে নামায শেষে মুসল্লীদের কাছ থেকে বখশিশ আদায় করে এটাও পরিতাজ্য। প্রয়োজনীয় পরিচ্ছন্নতার কাজ কেউ চাইলে স্বেচ্ছাশ্রমে করতে পারে। তবে ঈদগাহ কর্তৃপক্ষের লোক ভাড়া নিয়ে করানোই উত্তম। যাতে মুসল্লীদের অযথা বিরক্ত করতে না হয়।
মসজিদ কেন্দ্রিক ঈদের জামা'আত
ঈদের জামা'আত মসজিদ কেন্দ্রিক না হয়ে এলাকা ভিত্তিক ও ঈদগাহ কেন্দ্রিক হওয়া শরীয়তের কাম্য। যেন বেশি থেকে বেশি মুসলমান একাত্ম হয়ে ঈদের খুশি উদযাপন করতে পারে। শহর তো শহর এখন গ্রামেও মসজিদ ভিত্তিক দেড় দুইশ' লোক নিয়ে ঈদের জামা'আত করতে দেখা যায়। এতে নামায তো হয়ে যাবে কিন্তু শরীয়তের মাকসাদ ও মানশা বিনষ্ট হবে। এজন্য বিভিন্ন এলাকার দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গকে অন্ততঃ ৫/১০টি মসজিদের সমন্বয়ে ঈদের জামা'আত করার পরামর্শ দেয়া হল। এটা ইসলামের শান-শওকত ও ভাব-গাম্ভীর্য প্রকাশে অত্যন্ত সহায়ক হবে। অমুসলিমরা এর সৌন্দর্য লক্ষ্য করে প্রভাবিত হবে।
ঈদের মাঠে খতীব, ইমামদের বোনাস ও হাফেজদের‘হাদিয়া' কালেকশন
তারাবীহর ইমামের জন্য হাদিয়া কালেকশন তো মসজিদে, ঈদগাহে কোথাও জায়েয নেই। অনুরূপ খতীব, ইমামের বোনাস বা ঈদগাহের উন্নতির জন্য রুমাল নিয়ে ঘুরে ঘুরে কালেকশনও পছন্দনীয় নয়। এটা খতীব-ইমামের সম্মানহানীর কারণ। আর ঈদগাহের উন্নতির জন্য ঈদের নামাযের পরে নয়; রমাযানে বা অন্য কোন সময় কালেকশন করা উচিত। ঈদগাহকে সম্পূর্ণ কালেকশনমুক্ত রাখাই শ্রেয়। একান্ত প্রয়োজনে মিম্বরের কাছাকাছি বা ঈদগাহের প্রবেশ ও নির্গমন পথে 'মসজিদ' 'মাদরাসা' ইত্যাদি শিরোনাম লিখে বাক্স স্থাপন করা যেতে পারে এবং ঘোষণা করা যেতে পারে যে, এসব ব্যাপারে কেউ সহযোগিতা করতে চাইলে সে যেন উক্ত বাক্সে তা প্রদান করে।
ঈদের দিন যোহর ও জুমু'আর নামাযে শিথিলতা
কুরবানীর ঈদের দিন অনেক পাক্কা মুসল্লীও গোশত বানানো ও বিলি- বণ্টনের কাজে যোহরের নামায কাযা করে ফেলে। অন্তত জামা'আত তরক তো হয়েই যায়। আর জুমু'আর দিন হলে কোনমতে দৌড়ে এসে জামা'আত ধরা হয়। খুতবা শোনার তো খবরই থাকে না। শুধু কুরবানীই নয়; ঈদুল ফিতরের দিনেও এ ব্যাপারে শিথিলতা লক্ষ্য করা যায়। এটা সংশোধনযোগ্য।
ঈদ মোবারক ও সাহাবায়ে কেরামের ঈদ অভিবাদন রীতি
সাধারণতঃ ঈদের চাঁদ দেখা যাওয়ার পর থেকে ঈদের কয়েক দিন পর পর্যন্ত দেখা সাক্ষাতে ও টেলিফোনে ঈদের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করা হয়। আমাদের দেশে এক্ষেত্রে “ঈদ মোবারক” বাক্যটি বহু পরিচিত ও বহুল ব্যবহৃত। এটা অবৈধ বা দোষণীয় নয়। কিন্তু কথা হলো, কারো জন্য ঈদ বরকতময় হওয়া বা না হওয়া দু'আ-মূলক এ বাক্যটির নির্ভর করে না। ঈদ বরকতময় হয় রোযার ফরয বিধান পালন করা এবং বিনা ওযরে তা তরক না করার ভিত্তিতে। যার সিয়াম সাধনা যতো বেশি আবেগ- উদ্দীপনা ও আদব-মাসআলা সমৃদ্ধ হবে কেউ 'ঈদ মোবারক' বলুক আর না বলুক তার ঈদ মোবারক' হবেই। পক্ষান্তরে যে সুস্থ-সবল জোয়ান মানুষটি রমাযান মাসে দিনের বেলা পানাহার থেকে বিরত থাকেনি পৃথিবীর সবাই মিলে “ঈদ মোবারক” বললেও তার ঈদ বরকতশূন্যই থেকে যাবে। সাহাবায়ে কেরাম ঈদের দিন পরস্পরে এভাবে ঈদ-শুভেচ্ছা জানাতেন, تقبل الله منا ومنك (আল্লাহ তোমার ও আমার ঈদ, রোযা কবুল করুন)। "ঈদ মোবারক' সংক্ষিপ্ত ও সহজ হলেও 'তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়ামিনকা' এর অন্তর্নিহিত ভাব ও আবেদনটি তাতে অনুপস্থিত। এজন্য ধীরে ধীরে মুসলিম সমাজে বিশেষতঃ উলামায়ে কেরামের মধ্যে এর প্রচলন হওয়া উচিত। অভিবাদন যে বাক্যেই জানানো হোক দেখা সাক্ষাতে এবং টেলিফোনে সর্বপ্রথম সালাম দিতে হবে। তারপর অভিবাদন ও শুভেচ্ছা জ্ঞাপন।
মুসাফাহা ও মুআনাকার বিধান
সাধারণ সমাজে মু'আনাকার বাংলা বলা হয় 'কোলাকুলি'। কবি কাজী নজরুল ইসলাম তরজমা করেছেন 'গলাগলি'। আরবী 'মু'আনাকা' কোলাকুলির চেয়ে গলাগলিতেই বেশি ফুটে ওঠে। সাধারণতঃ মু'আনাকাকে ঈদের নামাযের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মনে করা হয়। অথচ মু'আনাকার সঙ্গে ঈদের কোনও সংশ্লিষ্টতা নেই; এটা সব সময়ের সাধারণ একটা আমল। কিছু দিনের বিরতির পর যখন দু'জন মুসলমান একত্রিত হন তখন মুআনাকা করা সুন্নাত। আর দৈনন্দিনের দেখা-সাক্ষাতে মুসাফাহা করা সুন্নাত। মুসাফাহা এক হাতে নয় দু' হাতে করতে হয়। আর মু'আনাকায় শুধু বুক নয় পরস্পরে ডানদিকে একবার গলা মিলাতে হয়। হাদীসে তিনবার মিলানোর কথা পাওয়া যায় না। শরীয়তে ঈদের নামাযের পর ঈদের দিনের আমল হিসেবে মুসাফাহা,মু'আনাকা করার প্রমাণ নেই। সুতরাং তা পরিতাজ্য।
ঈদ পালনে অনৈসলামী রীতি-নীতি অবলম্বন
পূর্বে বলা হয়েছে, শরীয়তে ঈদ পালন ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত ও সওয়াবের বিষয়। সুতরাং বলা বাহুল্য, তাতে বিজাতীয় রীতি ও পদ্ধতির সংমিশ্রণ ঘটানো চরম অপরাধ। ইসলাম স্বয়ংসম্পূর্ণ, সহজ ও ভারসাম্যপূর্ণ ধর্ম। এতে মানুষের প্রয়োজনীয় বিনোদনের যথেষ্ট বৈধ উপাদান রয়েছে। বিজাতীয় বলে সন্দেহ হয় মুসলমানদের প্রাত্যহিক জীবনে ইসলাম এমন একটি শব্দও মুসলমানদের জন্য সমীচীন মনে করে না। উদাহরণতঃ راعنا এবং انظرنا শব্দ দু'টির মর্ম হলো, হে নবী! নসীহত করার সময় আমাদের অবস্থার প্রতি দৃষ্টি রাখুন, ধীরে সুস্থে বলুন। এ মর্মে দু'টি শব্দই বিশুদ্ধ ও সাহিত্যমানে উত্তীর্ণ। কিন্তু ইহুদীরা তাদের নিজস্ব উচ্চারণভঙ্গিতে راعنا শব্দটিকে ব্যঙ্গার্থে ব্যবহার করতো বিধায় আল্লাহ তা'আলা আয়াত নাযিল করে উল্লিখিত মর্মে মুসলমানদেরকে এ শব্দটি ব্যবহার করতে বারণ করে দিয়েছেন। তো ভিনজাতির কৃষ্টির পরিচায়ক একটি শব্দ ব্যবহার-বিশুদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও যদি তা থেকে মুসলমানদের বারণ করা হয় তাহলে ঈদ পালনের ইবাদতে বিজাতীয় রীতি-নীতি অবলম্বন করা কতোটা গর্হিত হবে তা সহজেই অনুমেয়।
কবর যিয়ারত
কবর যিয়ারত সর্বকালেই দুনিয়ার চাকচিক্য ও পার্থিব মোহ থেকে মুক্তির অন্যতম উপায় হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এজন্য জরুরী মনে না করে ঈদের দিন নামাযের আগে/পরে কবরবাসী মাতা-পিতা, আত্মীয়-স্বজন ও সাধারণ মুসলমানের যিয়ারতে কোন অসুবিধা নেই। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, কারো কারো জন্য এ যিয়ারত ঈদের দিন গুনাহে লিপ্ত হওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতার কাজ দেয়।
আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সাক্ষাত
আনন্দের দিনে আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ- খবর নেয়া আত্মার দাবী। সুযোগ হলে এবং রাস্তাঘাটে বা আত্মীয়-বাড়িতে ফেতনা ও বেপর্দেগীর আশঙ্কা না থাকলে ঈদের দিন সৌজন্য সাক্ষাৎ করা ও তাদের খোঁজ-খবর নেয়া ভালো।
ঈদসেলামী, ঈদ বখশিশ
ঈদের দিন ছোটরা বড়দের কাছে ঈদ বখশিশ বায়না করে। স্থানভেদে এটাকে ঈদসেলামীও বলা হয়। সামর্থ্য থাকলে ছোটদের এ নির্দোষ দাবী পূরণ করা দোষণীয় নয়। তবে এ টাকা যাতে তারা বেহুদা কাজে ব্যয় না করে সেদিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখা চাই। তাফসীরে মা'আরেফুল কুরআন এর লেখক মুফতী মুহাম্মদ শফী রহ. তার সন্তান ও সংশ্লিষ্টদেরকে নিয়মিত ঈদ বখশিশ প্রদান করতেন। তার সন্তানেরাও (মুফতী রফী উসমানী, মুফতী তাকী উসমানী প্রমুখ) তার কাছে ফি' বছর 'বখশিশ বাজেট' বর্ধিত করার আবেদন জানাতেন। তিনিও সামর্থ্য অনুযায়ী তা বাড়িয়ে দিতেন। এ এক নির্দোষ আনন্দ বৈ কি।
আতশবাজি ও পটকা ফাটানো
ঈদের চাঁদ উঠার সাথে সাথে বরং দু' একদিন আগে থেকেই প্রায় সব অঞ্চলে আতশবাজি ও পটকা ফাটানোর ধুম পড়ে যায়। এটা হিন্দু ও বিধর্মীদের উৎসব পালনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ; ইসলামের সাথে এর দূরতম সম্পর্কও নেই। অর্থ অপচয়ের পাশাপাশি কাজে অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন দুর্ঘটনা জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এখন খোলামেলা একটি বিষয়। সুতরাং তা বিলকুল পরিতাজ্য।
সেজেগুজে রাস্তাঘাটে ঘোরাফেরা
ঈদের দিন ভালো পোশাক পরিচ্ছদের ব্যবস্থা হয়ে যাওয়া আল্লাহ পাকের একটি বড় নিয়ামত। এটা অপাত্রে ব্যবহার করা সমীচীন নয়। কাজেই ঈদের দিন সেজেগুজে অহেতুক রাস্তাঘাটে টহল দেয়া এমনকি শিশুদের জন্যও উচিত নয়। প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের জন্য তো প্রশ্নই আসে না। প্রায় বয়ঃপ্রাপ্ত মেয়েদের ক্ষেত্রেও এ ব্যাপারে অভিভাবকদের সচেতনতা জরুরী। কেননা এতে বেপর্দেগীসহ নানাবিধ ফেতনার আশঙ্কা রয়েছে।
পবিত্র ঈদ উপলক্ষে সিনেমা-নাটকের শুভ মুক্তি
উলামায়ে কেরাম লিখেছেন, কেউ যদি জেনে বুঝে গুনাহের কাজ "বিসমিল্লাহ' বলে শুরু করে সে কাফের হয়ে যায়। কারণ হারামকে বৈধ মনে করা বা হারাম কাজে আল্লাহর নিকট বরকত ও সাহায্য প্রার্থনা করা জঘন্য কুফরী। তাহলে এটা কি ধরনের জাহালাত আর ধর্মহীনতা যে, ঈদের মতো পবিত্র একটি ইবাদতকে সিনেমা-নাটকের মতো জঘন্য হারাম দ্বারা কলুষিত করা হচ্ছে! তাও আবার গর্ব-গৌরবের সাথে। এই 'শুভ' মুক্তি জীবন ও যিন্দেগীকে অভিশাপের হাতে বন্দি করা ছাড়া আর কী উপকার করবে? ঈদের সাথে এসব নোংরামীর কী সম্পর্ক? ভারবাহী প্রাণীবিশেষও সম্ভবতঃ এর অশুভ পরিণতি সম্পর্কে ওয়াকিফহাল; বেপরোয়া কেবল মানুষ নামের কিছু নির্ভার জীব।
রেডিও টিভির অনুষ্ঠান দেখে ঈদ কাটানো
ঈদের কয়েক দিন আগে থেকেই রেডিও ও টিভি চ্যানেলগুলো পত্র-পত্রিকায় ঈদ উপলক্ষে আয়োজিত তাদের অনুষ্ঠানমালা ও সময়সূচী প্রকাশ করে। নামসর্বস্ব বহু মুসলমান ওসব সময়সূচী খুঁজে ঘেঁটে 'চয়েজফুল' আরেকটি সূচী বানায়। উদ্দেশ্য, 'ভালো ভালো' অনুষ্ঠানগুলো যাতে বেহাত না হয়ে যায়। আল্লাহর পানাহ! এদের কাছে ঈদ কেমন কাটলো জানতে চাইলে উত্তর দেয়, না ভাই! কোথাও যাওয়া হয়নি, বাসায় টিভি দেখে সময় কাটিয়েছি। বন্ধুগণ! ঈদের মতো মহামূল্য সময়টি এভাবে 'কাটাতে' থাকলে সে দিন দূরে নয়, মুসলমানের খাতা থেকেই আমার নামটি 'কাটা' যাবে।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নামে গান-বাজনা ও ব্যান্ড পার্টির আয়োজন
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আনন্দ অনুষ্ঠান, ঈদ পুনর্মিলনী ইত্যাদির নামে ঈদের দিন বা পরের দিন নাচ-গান ও আমোদ-ফুর্তির আয়োজন করা হয়। এসব 'মাস্তি মৌজ' দেখে মনে হয়, সারা বছরের হারাম গান-বাজনা ঈদের দিন যেন হালাল হয়ে গেছে। বস্তুত হারাম কাজে দুঃসাহস দেখানো ও তাকে হালকা মনে করা ধ্বংস ও বরবাদীর এক মহাসংকেত।
শেষকথা
ঈদুল ফিতর আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অনেক বড় একটি নেয়ামত। এ দিন রোযাদার মুমিনকে আল্লাহ তা'আলা তাঁর মাগফিরাত ও দয়ার চাদরে ঢেকে নেন। সুতরাং শোকরিয়া ও কৃতজ্ঞতাস্বরূপ দিনটিকে গুনাহ ও নাফরমানীমুক্ত নির্মল আনন্দ ও ইবাদতের যুগপৎ আবহে পালন করা উচিত।
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
احکام رمضان المبارک و مسائل زکوٰة
رمضان المبارک کے روزے رکھنا اسلام کا تیسرا فرض ہے۔ جو اس کے فرض ہونے کا انکار کرے مسلمان نہیں رہتا ا...
ঈদের দিনের সুন্নাত কয়টি
১. দুই ঈদের রাতে গুরুত্বসহ ইবাদত করা। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, مَنْ قَامَ لَيْلَتَيِ الْعِيدَيْنِ مُحْت...
শাবান রমযান ঈদ : কিছু নিবেদন
আল্লাহ তাআলার অপার মেহেরবানী, তিনি আমাদেরকে ১৪৪৪ হিজরীর শাবান-রমযানে উপনীত করেছেন আলহামদু লিল্লাহ। আ...
তারাবীতে কুরআন তিলাওয়াত এবং হাফেয ছাত্রদের করণীয়
তারাবীর নামাযে তিলাওয়াতে কুরআন সম্পর্কে কিছু কথা বলার ইচ্ছা আছে , যেগুলো খেয়াল রাখলে ফায়দা হবে ইন...