প্রবন্ধ

রমাযানে আকাবিরের তারাবীহ, তাহাজ্জুদ ও কুরআন তিলাওয়াত

লেখক:মাওলানা মুহাম্মদ আবূ সাইম
৮ আগস্ট, ২০১৫
৯৩১৬ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

রমাযানুল মুবারক অত্যাসন্ন। এ মাসটি মুমিনের জন্য পরকালীন ফসল সংগ্রহের এক সুবর্ণ সুযোগ। কোন কাঙ্ক্ষিত বিষয় আমলে আনার জন্য নমুনা সামনে রাখা স্বতঃসিদ্ধ এক কার্যকর পন্থা। নমুনা মানুষকে কঠিন থেকে কঠিনতর কাজেও সাহস যোগায়। কুরআন-সুন্নাহয় রমাযানের ফযীলত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামের রমাযানের আমলসমূহ সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে। যে ব্যক্তি নিজের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষার লাগাম আল্লাহর হাতে সপে দিয়েছে, অনুকরণের জন্য কুরআন-সুন্নাহর রমাযান বিষয়ক বর্ণনাগুলোই তার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু সময়ের পালাবদলে আমাদের মধ্যে এক অদ্ভূত হীনমন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। রমাযান মাসে নবীজীর উপমাহীন পরকাল সাধনা সাহাবায়ে কেরামের সীমাহীন মেহনত-মুজাহাদার বিবরণ শোনে আমরা ভাবি, এগুলো তো বহু শতাব্দী আগের কাহিনী; সে যুগের শক্তিশালী মানুষের জন্যই তা উপযোগী ছিল; আমাদের দ্বারা তো আর এমনতর মেহনত করা সম্ভব নয়! এই অমার্জনীয় হীনমন্যতা দূর করার উদ্দেশ্যেই আমরা নিকট অতীতের (গত এক থেকে সোয়া শতাব্দির) আকাবির উলামায়ে কেরামের রমাযানের কিছু আমল এখানে তুলে ধরার প্রয়াস পাচ্ছি। যেন অহেতুক ওযর আপত্তি ঝেড়ে ফেলে আমাদেরও আমলের ময়দানে কদম বাড়ানোর হিম্মত হয়। এখানে আকাবিরদের যেসব আমলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা তাদের রমাযান কেন্দ্রিক মেহনত মুজাহাদার পূর্ণ চিত্রায়ন নয়; নমুনা মাত্র। আর নমুনা তো ক্ষেত্র বিশেষে মূলের ছায়া হয়ে থাকে।

হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা কাসেম নানুতাবী রহ. (প্রতিষ্ঠাতা, দারুল উলূম দেওবন্দ) প্রসিদ্ধ বর্ণনা অনুযায়ী ১২৭৭ হিজরীর রমাযান মাসে হেজাযের সফরে তিনি পূর্ণ কুরআন মাজীদ হিফয করেন। কিন্তু হযরত ইয়াকুব নানুতাবী রহ. সাওয়ানেহে কাসেমীতে লিখেছেন, তারাবীহ নামাযে কুরআন খতমের পর হযরত কাসেম নানুতাবী রহ. বলেছেন, মাত্র দুটি রমাযানে আমি কুরআনুল কারীম হিফয করেছি। যে দিন হিফয করতাম পৌনে এক পারা বা তার চেয়ে বেশি করে মুখস্ত করতাম। হিফয সম্পন্ন করার পর অত্যধিক পরিমাণে তিলাওয়াত করতাম। মনে পড়ে, একবার এক রাকাআতে সাতাশ পারা তিলাওয়াত করেছিলাম।

সাইয়িদুত তায়েফা হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মাক্কী রহ. একবার হাজী সাহেব তার শিষ্যদের লক্ষ্য করে বলেন, অহঙ্কার বশত নয়; তোমাদের শিক্ষার জন্য বলছি, এ অধম যৌবনে অধিকাংশ রাতেই ঘুমায়নি। বিশেষত রমাযান মাসে মাগরিবের পর দুজন হাফেয সাহেব আমাকে ইশা পর্যন্ত সোয়া সোয়া পারা করে তিলাওয়াত শোনাতো। ইশার পর তারাবীহতে আরও দুজন হাফেযের তিলাওয়াত শোনতাম। তারাবীহর পর একজন হাফেয সাহেব অর্ধ রাত পর্যন্ত এবং অতঃপর তাহাজ্জুদের নামাযে আরও দুজন হাফেয তিলাওয়াত শোনাতো। মোটকথা পুরো রাত এভাবেই কেটে যেতো।

কুতবুল ইরশাদ হযরত গঙ্গুহী রহ. রমাযানুল মুবারকে তার ইবাদত বন্দেগী দেখলে দর্শকের মনও তার জন্য দরদী হয়ে উঠতো। বৃদ্ধ বয়সেও সারাদিনের রোযা রাখার পর মাগরিব বাদ ছয় রাকাআতের স্থলে বিশ রাকাআত আউয়াবীন পড়তেন। এই বিশ রাকাআতে কমপক্ষে দুই পারা কুরআন তিলাওয়াত করা হতো। সেই সঙ্গে এত দীর্ঘ রুকু সিজদা আদায় করতেন যে, দর্শকের মনে হতো তিনি বোধহয় ভুল করছেন। আউয়াবীন শেষে ঘরে ফেরা এবং খানা খাওয়ার জন্য ঘরে অবস্থান করার সীমিত সময়ের মধ্যেই কয়েক পারা তিলাওয়াত করে নিতেন। তারপর ইশা ও তারাবীহতে কমপক্ষে সোয়া ঘণ্টা ব্যয়িত হতো। তারাবীহ শেষে সাড়ে দশটা এগারোটার দিকে ঘুমাতে যেতেন। তারপর একটা থেকে আড়াইটার মধ্যে জাগ্রত হয়ে তাহাজ্জুদে দাঁড়িয়ে যেতেন। টানা আড়াই/তিন ঘণ্টা তাহাজ্জুদ পড়তেন। ফতোয়া লেখা, মুরীদদের সংশোধনমূলক চিঠির জবাব প্রদানসহ বহু দীনী ব্যস্ততা সত্ত্বেও যোহরের পর খানকাহর দরজা বন্ধ হয়ে যেতো। এ সময় তিনি নির্জনে আসর পর্যন্ত কুরআন তিলাওয়াতে মশগুল থাকতেন। উপরোক্ত আমলগুলো তার বৃদ্ধ বয়সের। এ সময় অসুস্থতার কারণে মাত্র ১৫/১৬ গজ দূরত্বের ইস্তিঞ্জাখানায় যেতেও বিশ্রাম নেয়া লাগতো। কিন্তু ফরয তো ফরয কোন নফল নামাযও কোনদিন তিনি বসে পড়েননি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কষ্ট করে নামাযে দাঁড়িয়ে থাকতেন। এমনিতেই রমাযানুল মুবারকে তার সমস্ত ইবাদত বেড়ে যেতো। কালামুল্লাহ শরীফের তিলাওয়াতের ব্যস্ততা এ পরিমাণে বৃদ্ধি পেতো যে, বাড়িতে আসা-যাওয়ার সময় পথ চলতেও কোন কথা বলতেন না। নামাযে এবং নামাযের বাইরে দৈনিক আধা খতম কুরআন তিলাওয়াত করতেন।

আ'লা হযরত শাহ আব্দুর রহীম রায়পুরী রহ. তাযকেরাতুল খলীলে বর্ণিত আছে, হযরত আব্দুর রহীম রায়পুরী রহ. কুরআনুল কারীম শিক্ষাদানের প্রতি অত্যন্ত অনুরাগী ছিলেন। দেরাদুনের পার্শ্ববর্তী গ্রামে তিনি বিশটি মক্তব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অনুরূপভাবে নিজেও কুরআন তিলাওয়াতের আশেক ছিলেন। প্রায় সারাদিনই তিলাওয়াত করতেন। দিন-রাতে সর্বসাকুল্যে এক ঘণ্টার বেশি ঘুমাতেন না। রমাযানে তারাবীহ নামায নিজেই পড়াতেন। রাত দুটো আড়াইটায় তারাবীহ শেষ হতো। রমাযানে দিন-রাতের বেশির ভাগ সময় তিনি তিলাওয়াতেই কাটিয়ে দিতেন। এজন্য খানকায় আগত মেহমানদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়া হতো।

হযরত শাইখুল হিন্দ রহ. তিনি নিজে হাফেয ছিলেন না, কিন্তু রমাযান মাসে রাতের অধিকাংশ সময় বরং সারা রাত হাফেযদের থেকে কুরআন তিলাওয়াত শোনে কাটিয়ে দিতেন। এ কাজে কয়েকজন হাফেয সাহেবকে নিয়োগ দেয়া হতো। এসব হাফেয সাহেবান স্থানীয় না হলে তিনি নিজেই তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। তারাবীহ থেকে অবসর হয়ে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত উপস্থিতিদেরকে ইলমী বিষয়াদী এবং আকাবিরদের ঘটনাবলী শুনিয়ে উপকৃত করতেন। তারপর সুযোগ হলে সামান্য আরাম করতেন। অতঃপর শুরু হতো নফল পড়া। একজন হাফেয দু চার পারা শুনিয়ে আরাম করতো, কিন্তু হযরত আগের মতই প্রস্তুত থাকতেন। তারপর আরেকজন হাফেয শোনানো শুরু করতো। এভাবে পালাক্রমে কয়েকজন হাফেয কয়েক পারা করে তিলাওয়াত করতো। পরিবর্তন হতে তিলাওয়াতকারীদের পরিবর্তন থাকতো কিন্তু হযরত শাইখুল হিন্দ রহ. কখনও দু তিনটা পর্যন্ত আবার কখনও সাহরী পর্যন্ত তেমনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সকলের তিলাওয়াত শোনতেন। কোন কোন রমাযানে মসজিদে ফরয পড়ে ঘরে চলে আসতেন এবং উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ ও খাদেমদেরকে নিয়ে তারাবীহর জামাআত করতেন। এই তারাবীহতে চার চার, ছয় ছয় এবং কখনও কখনও দশ দশ পারা করে তিলাওয়াত করা হতো। তারাবীহ শেষ হলে আরেকজন হাফেয নফল শুরু করে দিতো। এভাবেই চলতো কালামে মাজীদ তিলাওয়াত ও শ্রবণের স্বাদ আস্বাদন। এভাবে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার ফলে যখন পা ফুলে যেতো আর আপনজনেরা এ ব্যাপারে মেহনত কম করার পরামর্শ দিতো, তিনি অত্যন্ত আনন্দচিত্তে বলতেন, এবার তাহলে রাহমাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামাযে দাঁড়িয়ে পা ফুলিয়ে ফেলার সুন্নাত আদায়ের তাওফীক হল!

হাকীমুল উম্মত হযরত থানবী রহ. মামুলাতে আশরাফিয়া কিতাবে আছে, হযরত থানবী রহ. তারাবীহ নামাযে নিজেই কুরআন মাজীদ শোনাতেন। কোন অপারগতা ছাড়া কখনও কুরআন শোনানো ছাড়েন নি। কুরআনের অর্ধেক পর্যন্ত দৈনিক সোয়া পারা করে, তারপর থেকে এক এক পারা করে তিলাওয়াত করতেন। সাতাশ রমাযানে খতম সম্পূর্ণ হতো। হযরতের তিলাওয়াতের দিলকাশ সৌন্দর্য শুধু শ্রবণের দ্বারাই অনুভবযোগ্য; বলে বোঝানোর নয়। তারাবীহতেও সাধারণ সময়ের মতো তারতীলের সঙ্গে ধীরে ধীরে তিলাওয়াত করতেন। কখনও দ্রুত পড়লেও হরফ উচ্চারণের মাত্রা ধীরলয়ে পড়ার মতোই থাকতো। ইযহার ও ইখফার প্রতিও লক্ষ্য রাখতেন। তবে ওয়াকফ ও লাহজার ক্ষেত্রে সাধারণ সময়ের চেয়ে কিছুটা কম রেয়ায়েত করা হতো। কানপুর অবস্থানকালে তারাবীহর জামাতে এত সংখ্যক লোক জমায়েত হতো যে, মাগরিবের পর দ্রুত খাওয়া- দাওয়া সেরে মসজিদে আসলেই কেবল জায়গা পাওয়া যেতো। অন্যথায় বঞ্চিত হতে হতো। তারাবীহ অত্যন্ত ধীর- স্থিরতার সঙ্গে আদায় করতেন। প্রতি চার রাকাআতের পর মাসনূন যিকির করতেন। সময় কিছুটা হালকা আওয়াজে পঁচিশ বার দুরূদ শরীফ পড়তেন। কেউ এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে বলেছিলেন, তারাবীহর প্রতি চার রাকাআতের পর পড়ার জন্য শরীয়তে নির্দিষ্ট কোন দুআ নেই। তবে আমার কাছে দুরূদ পড়াটা উত্তম মনে হয়। আর পশিচ বার এজন্য পড়ি যে, কেউ ইচ্ছা করলে যেন এসময় পানি পান করা বা উযুর প্রয়োজন সেরে নিতে পারে। তারাবীহ নামাযে তার রুকু সিজদ অন্যান্য নামাজের মতোই হতো, কোনরূপ তাড়াহুড়া করা হতো না। মসজিদ থেকে তারাবীহ শেষ করে বাড়িতে গিয়ে ঘরের মহিলাদেরকেও চার রাকাআত নামাযে কুরআন মাজীদ শোনাতেন। তারাবীহর খতমের দিন মসজিদে অন্যান্য দিনের মতোই বাতি জ্বলতো, অতিরিক্ত বাতির ব্যবস্থা করা হতো না এবং কোনরূপ মিষ্টি-মিঠাইও বিতরণ করা হতো না। তার ইয়াদ এতোটাই উৎকৃষ্ট ছিল যে, প্যাঁচ লাগাটা ছিল বিরল। কুরআনুল কারীমের সঙ্গে তার অত্যন্ত গভীর একটা সহজাত সম্পর্ক ছিল। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গোটা কুরআন যেন তার চোখে ভাসতো। কোন শব্দ বা আয়াতের ব্যাপারে কোথায় আছে প্রশ্ন করা হলে চিন্তা-ভাবনা ছাড়া তাৎক্ষণিক বলে দিতে পারতেন। তাহাজ্জুদের নামাযে কিরাআত অধিকাংশ সময় নিচুস্বরে পড়তেন। কখনও উচ্চস্বরেও পড়তেন। অনেক সময় তাহাজ্জুদ নামাযে দু চারজন ভক্তবৃন্দ তার পেছনে এসে দাঁড়িয়ে যেতেন। হযরত তাদেরকে নিষেধও করতেন না, উদ্বুদ্ধও করতেন না।

শাইখুল ইসলাম মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ. সিলেটে অবস্থানকালে হযরত রহ. নিজেই তারাবীহর ইমামতি করতেন। তার পেছনে তারাবীহ পড়ার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ আগমন করতো। আযানের পর আর মসজিদে জায়গা পাওয়া যেতো না। এ সকল লোক তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ পড়ে ঘরে ফিরতো। তারাবীহ নামাযে দৈনিক আড়াই পারা তিলাওয়াত করা হতো। প্রথম চার রাকাআতে মৌলবী জলীল সাহেব সোয়া পারা পড়তেন। তারপর হযরত রহ. বাকী ষোল রাকাআতে সেই সোয়া পারাই আবার তিলাওয়াত করতেন। প্রতি চার রাকাআতের পর দীর্ঘ বিরতি দিতেন। তারাবীহতে তিলাওয়াতকালে কোন কোন সময় হযরত রহ. এর মধ্যে জোশ সৃষ্টি হতো। সে সময়ের তিলাওয়াতের মজা না শোনলে অনুভব করা সম্ভব নয়। তারাবীহ শেষে দীর্ঘ সময় ধরে মুনাজাত করতেন। মুসল্লীদের কান্নায় মসজিদে রোল পড়ে যেতো। তারাবীহর পর ওয়াজ নসীহত শুরু হতো। রাত দেড়টায় মজমা শেষ হওয়ার পর তিনি স্বীয় কামরায় তাশরীফ নিয়ে যেতেন। সেখানেও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে কিছু সময় পরামর্শ হতো। অতঃপর তিনি আধা ঘণ্টা আরাম করতেন। আধা ঘণ্টা পর নিজে নিজেই তার চোখ খুলে যেতো। এবার উযু-ইস্তিঞ্জা থেকে ফারেগ হয়ে তাহাজ্জুদের উদ্দেশ্যে মসজিদে গমন করতেন। এসময় তিনি অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতেন যেন শব্দ ইত্যাদির কারণে কারও ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে। দেখা যেতো তারপরও বহু লোক তার সঙ্গে তাহাজ্জুদে শরীক হওয়ার জন্য সাগ্রহে জেগে থাকতো। তাহাজ্জুদের একাংশে হযরত রহ. নিজেই তিলাওয়াত করতেন আর অপর অংশে মাওলানা জলীল সাহেব। ফজরের পর সামান্য সময় ঘুমিয়েই শয্যা ত্যাগ করতেন। তারপর উযু-ইস্তিঞ্জা সেরে কুরআন তিলাওয়াতে মশগুল হয়ে যেতেন। সকাল দশটায় সাধারণ সাক্ষাতের জন্য বরাদ্দ সময়ের আগ পর্যন্ত তিলাওয়াত করতেন। এ ছাড়াও সারা দিনে যখনই কিছুটা সময় পেতেন তিলাওয়াতে লেগে যেতেন। শাইখুল হাদীস যাকারিয়া রহ লিখেছেন, হযরতঞ্জী ইলয়াস সাহেব রহ. এর ইন্তেকাল পরবর্তী সান্ত্বনা প্রদানের উদ্দেশ্যে হযরত মাদানী রহ. ১৩৬৩ হিজরীর রমাযান মাসে নিযামুদ্দীন আগমন করেন। বহু পীড়াপীড়ির পর সকলের আবেদনের প্রেক্ষিতে হযরত মাদানী সেদিন নিযামুদ্দীনে তারাবীহর ইমামতি করেন। এদিন তিনি ২০ রাকাআত নামাযে ১৪তম পারার শেষ অর্ধেক থেকে নিয়ে পনেরতম পারার সূরা বনী ইসরাইলের শেষ পর্যন্ত তিলাওয়াত করেন। এমন ধীর-স্থিরতা ও প্রশান্তির সাথে তিলাওয়াত করছিলেন যে, দারুন স্বাদ অনুভব করেছিলাম। 

হযরতজী মাওলানা ইলিয়াস রহ. (তাবলীগ জামাতের প্রথম মুরুব্বী) মাগরিবের নামায আদায় করে ইশার আযান পর্যন্ত নফল নামাযে মশগুল থাকতেন। তারপর মসজিদেই কিছুক্ষণ আরাম করতেন। প্রায় আধা ঘণ্টা পর উঠে ইশা ও তারাবীহ আদায় করতেন। তারাবীহ নিজেই পড়াতেন। তারাবীহর পর সাথে সাথেই শুয়ে পড়তেন। রাত বারোটায় জাগ্রত হতেন। উযু ইস্তিঞ্জা থেকে ফারেগ হয়ে দুটো সিদ্ধ গরম ডিম খেয়ে তাহাজ্জুদে দাঁড়িয়ে যেতেন। সাহরীর শেষ সময়ে সালাম ফিরিয়ে সাহরী গ্রহণ করতেন।

হযরত মাওলানা ইয়াহইয়া রহ. (হযরতজী ইলিয়াস রহ. এর আপন ভাই) মাওলানা আশেকে ইলাহী সাহেব রহ, তাযকেরাতুল খলীল নামক কিতাবে লিখেছেন, আমার আবেদনের প্রেক্ষিতে একবার রমাযান মাসে কুরআন শোনানের জন্য মাওলানা ইয়াহইয়া সাহেব মীরাঠ আগমন করেন। আমি লক্ষ্য করলাম সারাদিন চলাফেরার মধ্যেই তিনি এক খতম কুরআনে কারীম তিলাওয়াত করে নেন। ইফতারের সময় তার মুখে সূরা নাস তিলাওয়াতের আওয়াজ শোনা যায়। ট্রেন থেকে নামতেই সেদিন ইশার ওয়াক্ত হয়ে গিয়েছিল। সর্বদা উযু অবস্থায় থাকার অভ্যাস ছিল তার। এ জন্য মসজিদে প্রবেশ করেই জায়নামাযে দাঁড়িয়ে গেলেন। তারপর টানা তিন ঘণ্টায় দশ দশটি পারা এমন পরিষ্কার ও সাবলীলভাবে তিলাওয়াত করলেন যে, না কোথাও আটকে গেলেন আর না কোথাও প্যাঁচ লাগল। যেন কুরআন শরীফটি তার সামনে খোলা রয়েছে আর তিনি নিশ্চিন্তে তা থেকে পাঠ করছেন। এভাবে তিনদিনে কুরআন খতম করে বিদায় নিলেন; না দাওরের দরকার হল আর না সামে'র প্রয়োজন পড়ল। তিনি বন্ধু-বান্ধবদের আবেদনে তাদের ওখানে গিয়ে দু তিনদিনে কুরআনের খতম শুনিয়ে আসতেন। মসজিদে হলে সাধারণত তিন দিনে খতম হতো আর বাসা-বাড়িতে হলে দুদিনেই খতম শেষ। একবার কোন সফর থেকে ফিরে এক বন্ধুর ওখানে বিশ্রাম করছিলেন। ইমাম সাহেব চৌদ্দতম পারা তিলাওয়াত করছিলেন। তার বার বার ভুল হচ্ছিল আর পেছন থেকে অন্য হাফেয সাহেব লুকমা দিয়ে চলছিলেন। ইমাম সাহেব সালাম ফেরাতেই হযরত ইয়াহইয়া রহ মসজিদে তাশরীফ নিয়ে যান এবং ইমাম সাহেবকে জায়নামায থেকে সরিয়ে নিজেই ইমাম বনে যান। তারপর বাকি ষোল পারা ষোল রাকাআতে পড়ে খতম শেষ করে দেন। মুসল্লিদের সেদিন কষ্ট হয়েছিল বটে কিন্তু রমাযানের বারোতম রাতেই কুরআন খতমের আনন্দে সে কষ্ট চাপা পড়ে গিয়েছিল। তিনি নিজেই বলেছেন, যৌবনের রমাযানে নফল নামাযে সারা রাত কুরআন তিলাওয়াত করে কাটিয়েছি। বন্ধুদের আবদারে জীবনের শেষদিকে তাঁর নানী উম্মি বি-র বাড়িতে মহিলাদেরকে এক খতম কুরআন শোনাতে যেতেন। সে সময় সারা রাত ধরে তারাবীহ চলতো। মসজিদ থেকে ফরয পড়ে ঘরে তাশরীফ নিতেন এবং সাহরীর সময় পর্যন্ত ১৪/১৫ পারা পড়া হয়ে যেতো।

হযরত মাওলানা রউফুল হাসান রহ. (হযরতজী ইলিয়াস সাহেব রহ. এর মামা) তিনি রমাযানের শেষতারাবীহর প্রথম রাকাআতে আলিফ-লাম-মীম থেকে শুরু করে সূরা ফালাক শেষ করতেন আর দ্বিতীয় রাকাআতে সূরা নাস পড়ে সাহরীর সময় নামায শেষ করতেন। তারপর তার মাতা উম্মি বি- কে বলতেন, আমি দু রাকাআত পড়িয়ে দিলাম বাকি আঠারো রাকাআত একা একা পড়ে নিন। উম্মি বি রহ.ও সারা রাত ধরে পুত্রের পেছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই দীর্ঘ সময় তারাবীহর পড়তেন ও তিলাওয়াত শোনতেন।

মহিলাদের কুরআন তিলাওয়াত ও শ্রবণের প্রতি অনুরাগ 

হযরত শাইখুল হাদীস যাকারিয়া রহ.লিখেছেন, আমি গর্বস্বরূপ নয় বরং নেয়ামতের প্রকাশ ও শোকরিয়া স্বরূপ বলছি, নিজের অযোগ্যতার কারণে যদিও কিছু করতে পারি না কিন্তু আমার ঘরের মহিলাদের অবস্থা দেখে আনন্দিত হই যে, তাদের অধিকাংশই তিলাওয়াতের ব্যাপারে একে অপরের তুলনায় আগে বেড়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। ঘরের কাজকর্ম সত্ত্বেও দৈনিক ১৫/২০ পারা সহজেই পড়ে নেয়। হযরত শাইখুল হিন্দ রহ. এর ওখানে মহিলারাও তারাবীহ নামাযে কুরআন তিলাওয়াত শ্রবণ করতো। হযরতের পুত্র তাদেরকে কুরআন শোনাতেন। পর্দার আড়ালে ঘরের মহিলারা এবং বাইরেরও কতিপয় মহিলা জামাতে শরীক হতো। একদিন হযরতের পুত্র অসুস্থ হয়ে পড়ায় অন্য একজন হাফেয সাহেবকে এ কাজে নিয়োজিত করা হয়। হাফেয সাহেব তারাবীহ নামাযে চার পারা তিলাওয়াত করেই প্রস্থান করেন। সাহরীর সময় হযরত ঘরে আসলে মহিলারা অত্যন্ত নারায হয়ে অভিযোগ করেন যে, হযরত! আজ আপনি কোত্থেকে এক হাফেয সাহেব পাঠিয়েছেন, সে তো আমাদের তারাবীহটাই বরবাদ করে দিয়েছে! তিনি বললেন, কেন কি হয়েছে? মহিলারা বলল, জানা নেই তার এত কিসের তাড়া ছিল; মাত্র চার পারা তিলাওয়াত করেই চম্পট দিয়েছে। পরে জানা গেল, হযরতের ঘরের মহিলারা তারাবীহ নামাযে সাত খতম তিলাওয়াত শোনতো। সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ তা'আলা এ সকল মহান ব্যক্তিবর্গের অনুসরণে আমাদেরকেও রমাযানের হক আদায়ে যত্নবান হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন


তথ্যসূত্র : শাইখুল হাদীস যাকারিয়া রহ.

প্রণীত আকাবির কা রমাযান, আপ বীতী, ফাযায়েলে আমাল; পীর যুলফিকার আলী নকশবন্দী দা.বা.-এর বয়ান সংকলন খুতুবাতে যুলফিকার ইত্যাদি।

মন্তব্য (...)

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →

বিবিধ

মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ দাঃ

শাইখ মুহাম্মাদ আওয়ামা

মাওলানা ইমদাদুল হক

আল্লামা সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ.

মাওলানা মুহাম্মদ গিয়াসুদ্দীন হুসামী

আল্লামা মনযুর নোমানী রহঃ

মাওলানা শিব্বীর আহমদ

মাওলানা মাহমুদ বিন ইমরান

আল্লামা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম দাঃ

মাওলানা ইনআমুল হাসান রহ.

মাওলানা যাইনুল আবিদীন

আবদুল্লাহ আল মাসউদ

শাইখুল ইসলাম আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ.

মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

আল্লামা ইকবাল

হযরত মাওলানা মুহিউদ্দীন খান

মাওলানা আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী

শাইখ আলী তানতাভী

মাওলানা আতাউল কারীম মাকসুদ