প্রবন্ধ

যাকাত প্রদানে দায়িত্বশীল হোন

লেখক:মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ
২১ মার্চ, ২০২৪
২১৭৪ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

রহমত ও বরকতের পায়গাম নিয়ে রমযানুল মুবারক আমাদের কাছে এসে চলেও গেছে। আল্লাহ তাআলা আমাদের জীবনে রমযানুল মুবারকের ফয়েজ ও বরকত জারি রাখুন।

রমযানে মুমিন-মুসলমানগণআল্লাহর  প্রিয় বান্দাগণ যেভাবে নিজেদের জীবন বদলে দিতে চেষ্টা করেনইবাদত-বন্দেগীতে বেশি মনোযোগ দেনত্যাগ-তিতিক্ষাসবরদানশীলতাআল্লাহমুখী হওয়াতাহাজ্জুদ আদায়ভোররাতে নির্জনে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটির মতো মুবারক আমলগুলোর মাধ্যমে মাসটি সজিব রাখেনরমযানের পর বছরব্যাপী যেন এই মুবারক আমলগুলো কিছু কিছু হলেও আমাদের জীবনে চালু থাকে। আল্লাহ তাআলা আলকাউসারের সকল পাঠক এবং সকল মুমিন-মুসলমানকে সে তাওফীক দান করুন।

আজ যে বিষয়ে মূল আলোচনার চিন্তা করা হয়েছে তা হচ্ছে যাকাত প্রদানে দায়িত্বশীলতা। যাকাত ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের অন্যতম। কুরআনুল কারীমে অনেক জায়গায় নামাযের সাথে যাকাতের কথা এসেছে। ইসলামের প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. যাকাত দিতে অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করেছেন এবং বলেছেন-

وَاللهِ لَأُقَاتِلَنَّ مَنْ فَرَّقَ بَيْنَ الصَّلاَةِ وَالزَّكَاةِ.

আল্লাহর কসম আমি ঐসকল লোকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবযারা নামায ও যাকাতের মাঝে পার্থক্য করতে চায়। -সহীহ বুখারীহাদীস ৭২৮৪

অর্থাৎ ইসলামে সালাত যেমন ফরয ও গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতযাকাতও তেমনি ফরয ও গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। সালাত মানুষের দৈহিক ইবাদত আর যাকাত হচ্ছে আর্থিক ইবাদত।

ইসলামে যাকাতের এতই গুরুত্ব যেযাকাতের জন্যযাকাত অস্বীকার করার অপরাধেইসলামের একেবারে শুরু যুগেইপ্রথম খলীফার আমলেই যুদ্ধ পর্যন্ত করা হয়েছে।

যাকাতের বিধিবিধান অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত। আমরা তো এককথায় এতটুকু জানি যেযাকাত আড়াই পার্সেন্ট দিতে হয়। বর্তমানে একটা ফ্যাশন বের হয়েছেবিভিন্ন আর্থিক সংস্থাবিভিন্ন ইসলামী অ্যাপওয়ালা বা ইসলামী সংস্থা যাকাত ক্যালকুলেটর দিয়ে দিচ্ছে। মনে হয় যেন এটা ব্যাংকের ইএমআই হিসাব করার মতো একটা ক্যালকুলেটর-ব্যবস্থা- ব্যাংক থেকে আপনি কত টাকা ঋণ নিলেনকত কিস্তিতে আদায় করবেনকত পার্সেন্ট সুদ- সব আপনি ইনপুট দিলেন আর ক্লিক করলেনব্যসহিসাব বের হয়ে গেল। যাকাতকেও এখন ক্যালকুলেটর বসিয়ে এরকম করে দেওয়া হয়েছে।

খুব ভালোভাবে জেনে রাখা দরকারযাকাতের মাসআলাগুলো এত সহজ নয়। বিশেষত মানুষের বদলে যাওয়া জীবনাচার ও ব্যাবসায়িক ব্যবস্থায়। একটা উদাহরণ দিয়ে বলা যেতে পারে- সাধারণত কিতাবাদিতে লেখা থাকেযদি আপনার ঋণ থাকেতাহলে যাকাতের হিসাব থেকে ঋণ বাদ যাবে। যদি কেউ কিতাবের একথা ভালোভাবে না বুঝে থাকেতাহলে সে ধামাকা ফতোয়া দিয়ে দিতে পারবে। তার ফতোয়াতে দেশের যে সেরা সেরা ধনী ও বড় বড় কোম্পানি রয়েছেকর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে- এদের মালিকদের উপর কোনো যাকাত আসবে নাযারা শত কোটিহাজার কোটি টাকার মালিক। কারণ তারা যত কোটি টাকার মালিক তত কোটি টাকা বা তার চেয়ে কম-বেশি এদের অনেকেরই ব্যাংক-ঋণ থাকে। তারা এক একটা ফ্যাক্টরি স্থাপন করেএকেকটা প্রজেক্ট চালু করেসেখানে তাদের হাজার কোটি টাকা ঋণ থাকে। এখন যাকাতের হিসাব থেকে ওই ঋণ বাদ দিয়ে দিলে কী ফল দাঁড়াবেদেখা যাবেহয়তো তার ব্যবসায় খাটছে ১০০০ কোটি টাকা। এদিকে তার লোন আছে ১০০০ কোটি টাকা কিংবা তার চেয়েও বেশি- এখন স্বাভাবিক হিসেবে তো তার অনেক ঋণ। জানি না কেউ আবার বলে দেয় কি না যেতিনি যাকাত খেতেও পারবেন!

সম্প্রতি একজন ডাক্তার সাহেব মাসআলা জিজ্ঞাসা করলেন। ঢাকা শহরে তার বাড়ি আছে। বুঝতে অসুবিধা হয় না যেতিনি মোটামুটি সচ্ছল জীবন যাপন করেন। দীর্ঘদিন থেকে যাকাত দিয়ে আসছেন। এবারও তিনি অগ্রিম যাকাত দিয়েছেন। কিন্তু বছরের মাঝে তিনি দোকান কিনেছেন। দোকান কিনতে গিয়ে ঋণী হয়ে গেছেন। তাকে নাকি কেউ বলে দিয়েছেআপনি তো যাকাত খেতেই পারবেন!

এমন কথা বলা লোকের এসময়ে অভাব হয় না। বিভিন্ন সংস্থা যে যাকাত নিতে চায়তারাও হয়তো এরকম লোকদের বসিয়ে থাকে সাইনবোর্ড হিসেবেযারা তাদের অনুকূলে মাসআলা বা ফতোয়া দিতে সহযোগিতা করে।

আগেই বলা হয়েছেযাকাতের মাসআলা এত সহজ নয়। বর্তমানে ঋণ বহু প্রকারের হয়। কিছু ঋণ আছেযেগুলো যাকাতের হিসাবের ক্ষেত্রে বিয়োগ হবে। কিছু ঋণ আছেযেগুলো বিয়োগ হবে না। এগুলো ভালো করে জানতে হবে। একটা ক্যালকুলেটর এসবকিছুর হিসাব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যথাযথ পন্থায় অনেক ক্ষেত্রেই করতে পারবে না। সুতরাং কেবল ক্যালকুলেটর বসিয়ে যাকাতের হিসাব করা কোনোক্রমেই নিরাপদ নয় অনেকের ক্ষেত্রেই। বিশেষত ব্যবসায়ী সমাজের ক্ষেত্রে।

হাঁযাদের একেবারেই সিম্পল আয়যাদের একমুখী আয়তেমন কোনো ঝামেলা নেইবিভিন্ন রকমের ঋণ-করয নেইউন্নয়নমূলক ঋণ নেইতার ব্যাপার ভিন্নসে সম্পদের হিসাব করল আর আড়াই পার্সেন্ট যাকাত দিয়ে দিল। কিন্তু অন্যান্যদের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি।

যাকাতের হিসাব করতে বিজ্ঞদক্ষ ও নির্ভরযোগ্য আলেমের সহযোগিতা নিতে হবে। বিশেষত ব্যবসায়ী সমাজকে। মনে রাখতে হবেঅনুমান করে কিছু দিয়ে দিলাম- যাকাত এমন বিষয় নয়বরং পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব করে আড়াই পার্সেন্ট দেওয়া ফরয। আমাকে কমপক্ষে আড়াই পার্সেন্ট আদায় করতেই হবে।

দুর্ভাগ্যবশত রাষ্ট্রগুলোতে ইসলামী বিধিবিধান কার্যকর না থাকায়ইসলামী অর্থনীতি কার্যকর না থাকায় যেমনিভাবে আমরা প্রতিনিয়ত দুনিয়াবী দিক থেকে আর্থিকভাবে ধ্বংসের মুখে পতিত হচ্ছিআমাদের রাষ্ট্র ঋণাত্মক হচ্ছেতেমনিভাবে দ্বীনীভাবেও মুসলমানরা অধঃপতনের শিকার হচ্ছে।

ইসলামী রাষ্ট্রেরইসলামী অর্থনীতির এবং মুসলিম গণমানুষের আর্থিক নিরাপত্তার অন্যতম রক্ষাকবচ হচ্ছে যাকাত। রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলামী বিধি-বিধান না থাকায় সে যাকাত প্রদান করার পুরোপুরি দায়িত্ব এখন মুসলমান নাগরিকের নিজের উপর। যদিও বিভিন্ন ইসলামী রাষ্ট্রেআমাদের দেশসহ বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রও যাকাতবোর্ড বানিয়ে থাকেযাকাত নিয়ে থাকে। জানা কথাএটা ধর্মীয় বিধি-বিধান পালন করা বা করানোর উদ্দেশ্যে নয়বরং রাষ্ট্র অন্যান্যভাবে যেমন নাগরিকদের থেকে কর নেয় এবং বিভিন্ন সময় ত্রাণ নেয়এটাও রাষ্ট্র তার একটা আয় হিসেবে নিয়ে থাকে। এবং যে রাষ্ট্রগুলো ধর্মীয় বিধি-বিধান অনুযায়ী পরিচালিত হয় নাএ রাষ্ট্রগুলো অন্যান্য ক্ষেত্রে যেভাবে ধর্মীয় বা ইসলামের বিধি-বিধানআইন-কানুন ইত্যাদি বিষয়ে উদাসীন থাকেজানা কথা- এসব ক্ষেত্রেও তেমনই। রাষ্ট্র যাকাতের খুঁটিনাটি বিষয়াদিমাসআলা-মাসায়েল এগুলো পালনে সাধারণত উদ্যোগী হয় না। সেক্ষেত্রে মুসলমানদের একটি ফরয দায়িত্ব আদায় আরো ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।

এটি তো ছিল এতদিন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের সরকারি যাকাত-ব্যবস্থাপনার দশা। কিন্তু এর সাথে আরেকটি বিষয় হচ্ছেযাকাত গ্রহণের জন্য বর্তমানে দেশ-বিদেশে এমন বহু সংস্থাএমন বহু গোষ্ঠীএমন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান হাত বাড়াচ্ছেযাদের সাধারণত অন্য কোনো কর্মকাণ্ড ধর্মীয় বা ধর্মের অনুকলে বা ইসলামের পক্ষে তেমন দেখা যায় না। এমনকি অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা বিধর্মীও বটে। অনেক প্রতিষ্ঠান কাজও করে বিধর্মীদেরকে নিয়ে (হয়তোবা কোনো সময় মুসলমানদেরকে নিয়েও করে)তারাও দেখা যাচ্ছে এখন যাকাত চাচ্ছে। এই বিষয়টা আমাদের দেশে চলতি বছরে এসে বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। আমাদেরকে বিভিন্নজনআলকাউসারের পাঠক ও সচেতন মুসলমান কর্তৃক বারবার জিজ্ঞাসা করা হচ্ছেঅমুক প্রতিষ্ঠান যাকাত চাচ্ছেতমুক সংস্থা যাকাত চাচ্ছেমানুষের কাছে যাকাত আহ্বান করছেঅনেকে তাদেরকে যাকাত দিচ্ছেনও- আমাদের করণীয় কী?

আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখলাম ঘটনাটা খুবই উদ্বেগজনক। এখানে এমন এমন প্রতিষ্ঠানও মানুষের কাছ থেকে যাকাত নিচ্ছেপুরোদস্তুর প্রচার-প্রচারণা করেঅনলাইনে বিজ্ঞাপন দিয়েবিভিন্ন ব্যাংকবিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অ্যাপেডোনেশন বিভাগে তাদের নাম দিয়েতাদের অ্যাকাউন্ট দিয়ে তারা টাকা চাচ্ছেযাকাতের টাকা নিচ্ছে। এতে মুসলমানদের একটা বড় ফরয ইবাদত আদায় হওয়ার ব্যাপারে খুব বেশি উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিষয়টা এজন্য বেশি প্রাসঙ্গিক যেইসলাম শুধু যাকাত ফরয করেই ক্ষান্ত হয়নিবরং যাকাতদাতার উপর কিছু দায়-দায়িত্বও আরোপ করেছে। তেমনিভাবে যাকাতগ্রহীতার উপরও কিছু দায়-দায়িত্ব অর্পণ করেছে।

যাকাতগ্রহীতার দায়িত্ব হলসে আগে নিজে যাচাই করে নেবে- সে নিজে যাকাত নিতে পারে কি নাসে যেন প্রশ্নকারী সেই ডাক্তার সাহেবের মতো না হয়ে যায়! অথবা এরকম সাধারণ লোকের মতো না হয়ে যায়যার বাড়িতে মোটামুটি চলার ব্যবস্থা আছেহয়তো এক-দুই লক্ষ টাকা ব্যাংক-ব্যালেন্সও আছেকিন্তু সে বর্তমান সময়ে সাধারণ দরিদ্র, (এখন তো এক-দুই লাখ টাকাও অনেক বেশি টাকা নয়) ফলে তার চলতে কষ্ট হয়- সে যাকাত নিয়ে যাচ্ছে। এরকম যেনো না হয়। বাস্তবেই সে যাকাত গ্রহণের যোগ্য কি না- এটা যাচাই করে নেবে।

তার চেয়ে বড় দায়িত্ব হল যাকাতদাতার। যাকাতদাতার এটুকু বলে ক্ষান্ত হয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই যেআমি একটা সংস্থাকে দিয়ে দিয়েছি। আসলে প্রথম দায়িত্ব হলযাকাত উপযুক্ত ব্যক্তির হাতে পৌঁছে দেওয়া।

উপযুক্ত ব্যক্তিদের কথা কুরআন কারীমে সূরা বারাআত-এর ৬০ নম্বর আয়াতে উল্লেখ আছে। এর বিস্তারিত বিবরণ ও বিধান বিভিন্ন হাদীস ও ফিকহে ইসলামীতে বর্ণনা করা আছে। প্রথম কাজ হল বাছাই করা। সাধারণত কুরআনে বর্ণিত সেই শ্রেণীগুলোর মধ্যে দরিদ্র শ্রেণীকেই বেশি বাছাই করা হয় এবং এটা বেশি প্রাসঙ্গিকও। সুতরাং যাকাত দেওয়ার জন্য দরিদ্র শ্রেণীকে বাছাই করে যাকাত দেওয়া যাকাতদাতার দায়িত্ব। কাকে যাকাত দিতে পারবেকাকে পারবে নাকোন্ আত্মীয়কে দিতে পারবেকোন্ আত্মীয়কে দিতে পারবে নাশুধু মুসলিমকেই দিতে হবে- এই সবগুলো বিষয়ের সাথে যাকাতের আরও বিভিন্ন বিধি-বিধান রয়েছে।

যাকাতের ক্ষেত্রে সম্পদের নিরঙ্কুশ মালিক বানিয়ে দেওয়ার বিষয় আছে। এমন হতে পারে না যেযাকাতের টাকা দিয়ে আপনি একটা হোটেল বা ঘর ভাড়া করলেন। সেখানে দরিদ্র লোকদের থাকার ব্যবস্থা করলেন। আজকে একজন দরিদ্রকে থাকতে দিলেন আরেকদিন আরেকজন দরিদ্রকে থাকতে দিলেন। আপনি হোটেলটা বানিয়েছেনকিন্তু কোনো দরিদ্রকে সেটার মালিক বানিয়ে দেননি। আপনি যাকাতের টাকা দিয়ে একটা বাস ভাড়া করলেনসেটা দিয়ে দরিদ্রদের পরিবহনের ব্যবস্থা করবেনকিন্তু কোনো দরিদ্র এটার মালিক নাসে শুধু মাঝে মাঝে এটার সেবা ভোগ করে। এটা তো আপনি একটা ভালো সেবামূলক কাজ করছেনকিন্তু এটা আপনাকে সাধারণ দানের টাকা দিয়ে করতে হবে। এটা আপনি যাকাতের টাকা দিয়ে করতে পারবেন না। যাকাতের টাকা যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত ব্যক্তিকে মালিক বানিয়ে দিতে হবে। তো শুধু এমন একটি বিধানই নয়যাকাতের সাথে আরো অনেক বিধি-বিধান জড়িত।

দুঃখের সাথে বলতে হয়যাকাত ম্যানেজমেন্ট তথা যাকাত ব্যবস্থাপনার দায়িত্বও আজকাল এমন অনেক লোক নেয়যারা যাকাতের মাসআলা-মাসায়েল সম্পর্কে সম্যক অবগত নন। কেউ আছে হয়তো লেবাসধারীকেউ আছে নামধারী। আমরা কাউকে খাটো করতে চাই না।

মনে পড়ছে দুই-এক বছর আগে মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকার দারুল ইফতায় একটি বড় ব্যবসায়ী শিল্পগোষ্ঠীর যাকাত সংক্রান্ত মাসআলা এসেছিল। সেখানে দেখা গিয়েছিলসে শিল্পগোষ্ঠী বছরের পর বছর একটা কমিটির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা যাকাত আদায় করেছেন। সেখানে একটা আজব কথা প্রথমেই দেখা গেলযে কমিটি এটার ব্যবস্থাপনায় ছিলেন তারা প্রথমেই ওই টাকার আট ভাগের এক ভাগ নিয়ে নিত এবং তারা ঘোষণা করেছেতারা কুরআনে বর্ণিত আমেল। অর্থাৎ তারা যাকাত নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিযাকাত উসূলকারী। আশ্চর্য ব্যাপার হলতারা কোনো উসূলকারীই নয়। একে তো আমেল বা উসূলকারী হলযারা ইসলামী রাষ্ট্র কর্তৃক যাকাত উসূলের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত। এটা ফিকহের কিতাবাদিতে এবং আসারে সাহাবাতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। এ ছাড়াও আমরা ধরলামআপনি একটা কমিটি বানিয়েছেন। সেখানে কেউ আপনাকে টাকা দিয়েছে। এখানে আপনি কীভাবে উসূলকারী হলেনআপনি তো জায়গায় বসে ঘোষণা দিচ্ছেন আর আপনাকে দিয়ে দিচ্ছে।

এভাবে তারা দরিদ্রের হক আট ভাগের এক ভাগ নিজেরা নিয়ে নিচ্ছে। যেমন তাদের কাছে যদি আট কোটি টাকা যাকাত বিতরণ করতে দেওয়া হয় তাহলে প্রথমেই নিজেদের আমেল দাবি করে তারা রেখে দিচ্ছে এক কোটি টাকা। শুধু তাই নয়তাদের যাকাত বণ্টনের ব্যবস্থাপনায় শরীয়ত পরিপন্থী আরো বিভিন্ন বিষয় ছিল। ওই গোষ্ঠীকে পুনরায় বহু টাকা যাকাত আদায় করতে বলা হয়েছে।

তাদেরকে বলা হয়েছে যেআপনাদের এই এই যাকাতগুলো সঠিকভাবে আদায় হয়নি। এগুলো আদায় করতে হবে। এজন্যেই আমরা বারবার আরয করেছিযাকাতের বিষয়টা নাযুকযাকাতের মাসআলাগুলো অনেক ক্ষেত্রেই সূক্ষ এবং ভালোভাবে বোঝার দাবি রাখে।

এই বিষয়গুলোর কারণেই এই দেশে যে সরকারি যাকাত বোর্ড আছে এবং অন্যান্য মুসলিম দেশেযেসমস্ত দেশের সরকারগুলো ইসলামী বিধি-বিধান পালনে অঙ্গীকারাবদ্ধ নাতাদের রাষ্ট্র পরিচালিত হয়রাষ্ট্রের অর্থনীতিরাজনীতি ও বিচারব্যবস্থা- সবকিছুই পরিচালিত হয় তাদের নিজস্ব নিয়মেইসলামী নিয়মে নয়তাদের মাধ্যমে যাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে বরাবরই আলেম-উলামার অনীহা ও আপত্তি এবং মুত্তাকী মুসলমানদের অনীহাআপত্তি ও অনাস্থা পরিলক্ষিত হয়েছে। এটা প্রাসঙ্গিক কারণেই যেআমার যাকাত তারা যথাযথভাবে আদায় করবে কি না?

কিন্তু খুবই আফসোসের বিষয়বর্তমানে মনে হচ্ছে সেসব কথা এই প্রজন্মের লোকেরা ভুলেই যাচ্ছে বা তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে কম। যাকাতের বিষয়টা এমন নয় যেকোনো একটা ঘটনা ঘটে গেলআমি কিছু দান-সদকা করে দিলামব্যস হয়ে গেল। খুবই দুঃখজনক এবং আফসোসের ঘটনা ঘটেছেএকটা মার্কেটে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছেসেখানেও শোনা যাচ্ছেকেউ কেউ তাদের জন্য যাকাত আদায় করছে!

ব্যবসায়ী ভাইয়েরা কি যাকাত চেয়েছেতারা কি বলেছেআমরা যাকাত নেওয়ার যোগ্যএটা কি যাচাই করার প্রয়োজন নেই?

তারা কতজন একেবারেই মাঠে বসে গেছে যেযার আর কোনো আয় নেইআর কোনো ব্যালেন্স নেইকোনো ব্যবস্থা নেইএই যে যারা হুজুগে এই কাজগুলো করছেতাদের এসব বিষয় চিন্তা করা দরকার।

তার চেয়ে বেশি চিন্তা করা দরকারআমি যখন আমার যাকাত এমন লোকদের হাতে তুলে দিচ্ছিযাদের বা যে সংস্থার কর্ণধারদেরসংস্থার পরিচালনার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের দ্বীনের সাথেইসলামের বিধি-বিধানের সাথে বাহ্যিক কোনো সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়নি। বছরের কোনো সময়ই শরীয়তের অন্যান্য আমল ও বিশ্বাসগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠতা পরিলক্ষিত হয় না। তাদের হাতে যদি আমার গুরুত্বপূর্ণ ফরজ বিধানের টাকা তুলে দেই একারণে যেসে বলছেযাকাত দেনআমি আপনার পক্ষ থেকে ব্যয় করব।

আমি বাহ্যিকভাবে দেখছিসে একজনকে খাইয়ে দিচ্ছেরাস্তায় খাওয়াচ্ছেএক টাকায় খাওয়াচ্ছে অথবা বিনা পয়সায় খাওয়াচ্ছে। অথবা কেউ গণমানুষের বিশেষ একটি শ্রেণী  নিয়ে কাজ করছে। আমরা প্রত্যেকের যেকোনো ভালো কাজজনহিতকর কাজসেবামূলক কাজকে মোবারকবাদের দৃষ্টিতে দেখতে চাইযদি সেখানে কোনো খারাপ মতলব না থাকে। সেগুলোও ইসলামের অন্যতম শিক্ষা ও বৈশিষ্ট্য। কিন্তু মনে রাখতে হবেযাকাত সকল ক্ষেত্রে দেওয়ার বিষয় নয়। বিভিন্ন ফাউন্ডেশনের ব্যপারেও আমরা আগে শুনেছিকুরবানীর ক্ষেত্রেও আমরা শুনিকুরবানীর টাকা অমুক ফাউন্ডেশনকে দিয়ে দেওয়া হচ্ছেতমুক গোষ্ঠীকে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অমুক গোষ্ঠী বলছেআমাকে তোমার কুরবানীর টাকা দাওআমি তা অমুক খাতে ব্যয় করব। এখন যাকাতের ক্ষেত্রেও এরকম কথা শোনা যাচ্ছেবিভিন্ন গোষ্ঠী বা বিভিন্ন সংস্থা যাকাত চাচ্ছে। আমাদের কথা এটা নয় যেকোনো সংস্থার মাধ্যমেই যাকাত আদায় করা যাবে নাবরং আমাদের কথা হলযাকাত দিতে হলে আগে আস্থার সম্পর্ক থাকতে হবে। বুঝতে হবে যেতার দ্বীনী বুঝ কতটুকু। তারা যাকাতের মাসআলা কতটুকু জানেন। তারা যাকাতের প্রয়োগ যথাযথভাবে করবেন কি নাযথাস্থানে তা আদায় করবেন কি নাইসলামে যাকাতের যে বিধি-বিধান রয়েছে- কোথায় যাকাত আদায় করতে হয়কীভাবে ব্যয় করতে হয়কীভাবে ব্যয় করলে যাকাত আদায় হয়কীভাবে করলে যাকাত আদায় হয় না- এই বিষয়গুলো তারা জানেন কি নাসেটা জানার জন্য তাদের দক্ষতা কতটুকুএবং ইসলামের ব্যাপারে বাস্তব জীবনে তাদের বিশ্বাসআস্থাতাদের অনুশীলন কতটুকু- এগুলো অবশ্যই দেখার প্রয়োজন আছে। কারণ কোনো সংস্থার কাছে কোটি কোটি টাকা যাকাত জমা হলে সেগুলো যথানিয়মে ও যথাস্থানে ব্যয় করতেসেগুলোর হকদার খোঁজ করতে এবং তাদের হাতে যথানিয়মে পৌঁছে দিতে কম কসরত করতে হয় না। আর অন্য মানুষের একটি বড় ইবাদত যথানিয়মে আদায়ের এই কসরতগুলো একমাত্র মুত্তাকী তথা ঈমানদার ও আল্লাহকে ভয়কারী লোকদের দ্বারাই সম্ভব।  

এই কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য হলআমাদের প্রিয় দ্বীন ইসলামের অন্যতম একটা স্তম্ভ যাকাত। মুসলমানদের সেই যাকাত যেন যথাযথভাবে আদায় হয়। আমরা যাকাতও আদায় করলামটাকাও নিজ থেকে বের করে দিলাম আবার ফরজ দায়িত্বও আমার কাঁধে রয়ে গেল। বিষয়টা এমন যেআমি নামায পড়ে এলামপরে দেখা গেলআমার নামাযটা আদায়ই হয়নি! এটা বেশি দুঃখজনক যেআমি নামায আদায় করলামসময় ব্যয় করলামশারীরিক কসরতও হলমসজিদেও গেলামকিন্তু দেখা গেল- আমি তা আদায় করিনিঠিকমতো করতে পারিনি!

যাকাতের ক্ষেত্রেও যেন এমন না হয়- আমি টাকা দিয়ে দিলামকিন্তু আমার ফরয দায়িত্ব আদায় হল না।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে আমাদের দ্বীনী দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে আদায় করার তাওফীক দান করুনআমাদেরকে দ্বীনের সঠিক বুঝ নসীব করুন। আমরা মুসলমানরা যেন প্রতারিত না হই। নিজেদের ইবাদত-বন্দেগীগুলো আদায় করার ক্ষেত্রে যেন ঠকে না যাই।

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

দ্বীনরক্ষা ও প্রতিষ্ঠার জন্য শক্তি ব্যয় করা

...

আল্লামা মনযুর নোমানী রহঃ
১০ নভেম্বর, ২০২৪
৫৪৭৭ বার দেখা হয়েছে

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →