প্রবন্ধ
শরীয়তে পীর মুরিদীর প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব
রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াতী দায়িত্ব বর্ণনায় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআন মাজীদের একাধিক আয়াতে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি কুরআন তিলাওয়াত করে শোনান, কুরআন মাজীদের (অর্থ, ভাবার্থের) শিক্ষাদান করেন, (নবুওয়াতী দায়িত্ব পালনে হিকমাত বা প্রজ্ঞার দ্বারা তাঁর জ্ঞান-ভাণ্ডারকে পরিপূর্ণ করে দেয়া হয়েছে, সঠিক মর্ম ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে তিনি সেই) হিকমাহ,-এর তা'লীম দান করেন (পরিভাষায় যাকে সুন্নাহ বা হাদীস নামে অভিহিত করা হয়) এবং (আল্লাহ প্রদত্ত রূহানী শক্তির মাধ্যমে) তিনি তাদের তাযকিয়া বা মানব প্রকৃতিতে বিরাজিত কলুষ-কালিমা ধুয়ে মুছে পাক-সাফ, পূত-পবিত্র করে দেন।
উলূমে নবুওয়াত বা ওহীর ইলম হল প্রকৃত ইলম বা জ্ঞান। এ ইলমের মাধ্যমে মানুষ তার জীবনের লক্ষ্য- উদ্দেশ্যের পরিচয় লাভে সামর্থ হয়। সে তার স্রষ্টা প্রতিপালক আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নৈকট্য ও সান্নিধ্য লাভে কামিয়াবী অর্জন করে। তার মা'বূদ বা ইলাহের সঠিক ইবাদত বন্দেগী করে সন্তুষ্টি অর্জনে সক্ষম হয়। ফলে মানুষের মাঝে আখলাকে হাসানা বা অনুপম চরিত্র-মাধুর্যের বিকাশ ঘটে। মানবীয় সদগুণরাজির উন্মেষ সাধিত হতে থাকে। সে তখন প্রকৃত মানুষে পরিণত হয়, আশরাফুল মাখলূকাত তথা খলীফাতুল্লাহর মহান আসনে সমাসীন হতে পারে।
আল্লাহ তা'আলার সৃষ্টি-রহস্য আমাদের বোধগম্যের ঊর্ধ্বে; সৃষ্টির সেরা জীব মানুষকে তিনি পরস্পর বিরোধী, দ্বন্দ্বমুখর দু'টি স্বভাবের সমন্বয়ে সৃষ্টি করেছেন; মানুষের জড় দেহের চাহিদায় তার স্বভাবের মাঝে কাম-ক্রোধ, লোভ- লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা, হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, অহংকার-অহমিকা ইত্যাদি পশু-প্রবৃত্তি নিহিত রয়েছে। আবার এই মানব দেহের মাঝে আলমে আমর বা নূরের জগত হতে রূহে ইনসানী বা মানবাত্মার পরম সম্পদ আমানতস্বরূপ দান করা হয়েছে। এই মানবাত্মাই তার হৃদয় জগতকে আলোকিত করে। এই মানবাত্মা বা পরমাত্মার চাহিদায় তার স্বভাবের মাঝে তাকওয়া-পরহেযগারী, সততা-সত্যবাদিতা, উদারতা, মহানুভবতা, বিনয়-নম্রতা, প্রেম-ভালোবাসা, ভ্রাতৃত্ব- সৌহার্দ, দয়া-মায়া ইত্যাদি সদগুণরাজির স্ফুরণ ঘটতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে মানুষ বলতে এই মানবাত্মাকেই বুঝায়। কারণ, এই আত্মার কারণে মানুষের সকল অঙ্গ- প্রত্যঙ্গ সচল ও সক্রিয়। আত্মার অভাবে সব কিছু নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পঁচে গলে দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে। গোটা দেহের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আর কোন মূল্য থাকে না।
জ্ঞানী বা বুদ্ধিমান সেই, যে আত্মার চাহিদায় দেহের প্রতি যত্নবান হয়। আত্মাকে উপেক্ষা করে জড় দেহের চাহিদা পূরণে মত্ত মানুষ পশু; বরং পশু অপেক্ষা নিকৃষ্ট ও হিংস্র জীবে পরিণত হয়। কুরআনুল কারীমে ও হাদীসে নববীতে এ সম্পর্কে মানুষকে বহুভাবে সজাগ-সতর্ক করা হয়েছে।
মানুষের জড় দেহের যেমন খোরাকের প্রয়োজন অনস্বীকার্য, তেমনি মানবাত্মার খোরাকের প্রয়োজনীয়তাও অপরিহার্য। জড় দেহের খোরাক আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানব জন্মের পূর্বেই পৃথিবী বক্ষে বরং জলে-স্থলে সর্বত্র প্রয়োজনানুপাতে সৃষ্টি করে রেখেছেন। মানুষের স্বভাবের মাঝে সে সবের আকর্ষণ সৃষ্টি করেছেন এবং বস্তু নিচয়কে মানুষের এই প্রয়োজন মিটানোর বাধ্যতামূলক নির্দেশও দিয়ে রেখেছেন। মানুষ তার প্রয়োজনের তাগিদে এসব কিছুকেই নিত্য নতুনভাবে ভোগ করছে। কিন্তু মানবাত্মা যেহেতু এই বস্তুজগতের ঊর্ধ্বের বহু ঊর্ধ্বের অমূল্য সম্পদ, অতুলনীয়-অনির্বচনীয় অনুপম সৌন্দর্যের আধার এক দুয়ে শক্তি, যার খোরাক ও পরিপুষ্টির জ্ঞান, পথ ও পন্থা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অফুরন্ত রহমত দয়ায় মানুষের মাঝ হতে কিছু সংখ্যক মহান পুরুষকে বেছে নিয়ে তাদের মাধ্যমে মানুষকে দান করেছেন। এই মহান পুরুষগণ আল্লাহ তা'আলার মনোনীত মা'সূম বা নিষ্পাপ বান্দা হাযারাত আম্বিয়ায়ে কেরাম আলাইহিমুস সালাম। মানুষের উচিত ঐ সব মহামনীষীদের মাধ্যমে লব্ধ জ্ঞানকে মহাদান মনে করে বিনম্রভাবে কৃতজ্ঞ চিত্তে করপুটে গ্রহণ করা। হাযারাত সাহাবায়ে কেরাম রাযি. সেভাবেই সব কিছু ত্যাগ করে এই জ্ঞানালোকে নিজেদেরকে আলোকিত করার পথ বেছে নিয়েছিলেন। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র সাহচর্য ও তাযকিয়ার ফলে তারা আল্লাহ তা'আলার নৈকট্য ও সান্নিধ্য লাভে এত উচ্চ মার্গে পৌঁছে গিয়েছিলেন যে, একমাত্র মা'সূম আম্বিয়ায়ে কেরাম আ. ছাড়া আর কোন মানুষ আধ্যাত্মিকতার এত উচ্চস্তরে পৌঁছতে সামর্থ হয়নি।
যেহেতু আল্লাহ তা'আলা সকল সদগুণের আধার ও উৎসস্থল, কাজেই যে মানুষ আল্লাহ তা'আলার যত নৈকট্য লাভ করবে তার মাঝে তত বেশি সদগুণরাজির স্ফুরণ ঘটতে থাকবে। মানবেতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, হাযারাত সাহাবায়ে কেরাম রাযি. এর যুগে কোন ভূখণ্ডে কোন সমাজ ব্যবস্থায় এরূপ মহৎ চরিত্রের অধিকারী একটি আদম সন্তানের আবির্ভাব ঘটেনি, আর ঘটবেও না । আল্লাহ তা'আলা কুরআন মাজীদের একাধিক আয়াতে তাদের এ অনুপম চরিত্রের উচ্চ প্রশংসা করে তাদের উপর নিজের সন্তুষ্টি প্রকাশের ঘোষণা প্রদান করেছেন। তাদের সম্পর্কে ইরশাদ করেন,
رِجَالٌ لَا تُلْهِيهِمْ تِجَارَةٌ وَلَا بَيْعٌ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ وَإِقَامِ الصَّلَاةِ وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ يَخَافُونَ يَوْمًا تَتَقَلَّبُ فِيهِ الْقُلُوبُ وَالْأَبْصَارُ
অর্থ : (এরা) সেসব লোক, যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ হতে, নামায কায়েম ও যাকাত আদায় হতে গাফিল করে না। তারা তো সে দিনের ভয় করে, যে দিন মানুষের অন্তর-চক্ষু বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। (সূরা নূর-৩৭)
আল্লাহ তা'আলার যিকির হল মানবাত্মার খোরাক। সর্বাপেক্ষা বড় যিকির হল নামায। নামায খুশু-খুযু তথা একাগ্রতার সাথে তন্ময়ভাবে আদায় করতে সক্ষম হলে নামায সমাপনান্তে জাগতিক কাজ-কর্মে, যুদ্ধের ময়দানে, দাঁড়িয়ে, বসে, শয়নাবস্থায়ও যিকরুল্লাহ হতে গাফিল হবে না। সাহাবায়ে কেরাম রাযি. এর অবস্থা এই পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। পরবর্তীতে নবীয়ে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ হতে মানুষ যত দূরে সরে যেতে থাকে, তত বেশি তাদের মাঝে যিকরুল্লাহর শক্তির অভাব ঘটতে থাকে। খাইরুল কুরূনের যুগেই অর্থাৎ আইম্মায়ে তাবেয়ীগণ এ অধঃমুখী গতিরোধে সার্বক্ষণিক যিকরুল্লাহ জারী রাখার উদ্দেশ্যে যে ইজতিহাদী পন্থা আবিষ্কার করেন, তাই হল সুলুক ও তরীকত।
রোগাক্রান্ত হলে বুদ্ধিমান রোগী নিজে নিজে ওষুধ ব্যবহার ও পথ্যাপথ্যের বাছ- বিচার করে হয়ত আরোগ্য লাভ করতে পারে; কিন্তু ওষুধের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞানের অভাবে নিরাময়ের পরিবর্তে রোগ বৃদ্ধির প্রবল আশঙ্কা থেকে যায়। সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে এরূপ পন্থা গ্রহণ প্রাণনাশের আশঙ্কায় পরিণত হয়। তাই আমরা রোগাক্রান্ত হলে অভিজ্ঞ, সৎচিকিৎসকের শরণাপন্ন হই এবং এটাই বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক। পৃথিবীতে মানুষ সব বিষয়ে অভিজ্ঞ উস্তাদের কাছে হাতে-কলমে শিক্ষালাভের মুখাপেক্ষী হয়। সর্ববিষয়ে বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ লাভের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য সত্য।
রূহে ইনসানী বা মানবাত্মা, যার সম্পর্কে আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, এ জড় জগতের ঊর্ধ্বে বহু ঊর্ধ্বের এক দুয়ে মহামূল্য সম্পদ। সেই রূহে ইনসানী মানুষের প্রবৃত্তির দাসত্বের ফলে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়লে তার চিকিৎসা কঠিন হতে কঠিনতর হয়ে পড়ে। দেশের পর দেশ জয় করা, গ্রন্থের পর গ্রন্থ রচনা করা, ছন্দের পর নব নব ছন্দে কাব্য রচনা, দার্শনিক যুক্তি-তর্কের অবতারণা খুবই সহজ। কিন্তু মানব মনের গতি- প্রকৃতি নির্ণয়, প্রবৃত্তির উদ্দাম গতির মুখে লাগাম দিয়ে রোধ করা বড় দুঃসাধ্য। সুললিত কণ্ঠে ওয়ায করা, নীতি-বাক্যের ফুলঝুরি সাজানো সহজ, কিন্তু মনকে বশে আনা কঠিন ও দুষ্কর কার্য। মানবাত্মা যদি কোন কারণে উপরে বর্ণিত রোগসমূহ দ্বারা আক্রান্ত হয় তাহলে তার নিরাময়ের পথ ও পন্থা কি? হাদীসে নববীতে বর্ণিত হয়েছে,
لكل شئ صقلة وصقلة القلوب ذكر الله
অর্থ : প্রত্যেক বস্তুর জং ও মরিচা দূর করার উপায় বা পদ্ধতি আছে, অন্তরে (গুনাহের কারণে প্রবৃত্তির দাসত্বের ফলে) যে মরিচা পড়ে তা দূরীকরণের রেঁদা হল আল্লাহ তা'আলার যিকির। আল্লাহ তা'আলা কুরআন মাজীদে ইরশাদ করেন,
أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ
অর্থ : অবাধ্য অশান্ত মানব মনে আল্লাহর যিকিরই প্রশান্তি আনয়নে সক্ষম। (সূরা রাদ-২৮)
বস্তুর যেমন গুণাগুণ, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আমরা সুস্পষ্টভাবে অনুভব করতে সক্ষম, আল্লাহ তা'আলার আসমায়ে হুসনা বা গুণবাচক নামসমূহের ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়া তদপেক্ষা সহস্র কোটি গুণ বেশি, কিন্তু প্রবৃত্তির দাস আমরা তা অনুভব করতে অক্ষম। অথচ আমার রোগাক্রান্ত হৃদয়ের একমাত্র ওষুধ হচ্ছে এই আসমায়ে হুসনার যিকির, আল্লাহ তা'আলার সানা সিফাত বা প্রশংসা-স্তুতির যিকির। তাই দৈহিক রোগে ওষুধ ব্যবহারে যেমন আমরা অভিজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হই, তেমনি আত্মার রোগের নিরাময়ে, সুস্থতা আনয়নে আমাকে এ বিষয়ে দক্ষ, অভিজ্ঞ ও সৎচিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। নিজের সকল ইচ্ছা-অনিচ্ছা সবকিছুই সেই অভিজ্ঞ চিকিৎসকের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। উপরে উল্লেখ করেছি যে, মানবাত্মার এই রোগসমূহের চিকিৎসার জন্যই আইম্মায়ে তাবেয়ীগণ কুরআন মাজীদ ও হাদীসে নববীর আলোকে যিকরুল্লাহর বিভিন্ন পথ পন্থা আবিষ্কার করেছেন। যিকরুল্লাহ হচ্ছে কুরআনুল কারীম ও হাদীসে নববীর অনুসৃত পথের একমাত্র ওষুধ। অন্য আর কোন ওষুধ নেই। রোগীর ও রোগের স্বভাব-প্রকৃতি ভেদে ব্যবহার বিধিতে বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্য এসেছে মাত্র। কিন্তু ওষুধে কোন তারতম্য হয়নি।
মানবাত্মার এসব চিকিৎসকগণ হাযারাত সাহাবায়ে কেরাম রাযি. হতে প্রত্যক্ষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। যেমনভাবে হাযারাত সাহাবায়ে কেরাম রাযি. রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তাযকিয়ার মাধ্যমে সকল আবিলতা ও কলুষতা হতে পূত-পবিত্র হয়ে গিয়েছিলেন, এসব আইম্মায়ে তাবেয়ীনও সাহাবায়ে কেরাম রাযি. এর প্রশিক্ষণ ও দিকনির্দেশনায় নিজেদেরকে পাক-সাফ করে নিতে সমর্থ হয়েছিলেন। অবশ্য রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনন্য ও অতুলনীয় রূহানী শক্তির কারণে তাঁর এক নেকদৃষ্টি লাভে ও স্বল্পক্ষণের সাহচর্যে এসে সাহাবায়ে কেরাম রাযি. আধ্যাত্মিকতার যে উচ্চস্তরে আরোহণ করার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন,পরবর্তী তাবেয়ীগণ সেই অতুলনীয় রূহানী শক্তির সৌভাগ্য পরশ হতে বঞ্চিত হবার ফলে তাদেরকে আধ্যাত্মিকতার উচ্চস্তরে আরোহণ করতে অধিক সময় শ্রম সাধনা-সংগ্রাম করতে হয়েছে। অপর দিকে সাহাবায়ে কেরাম রাযি, এর অধিকাংশকে যে প্রতিকূল পরিবেশের মোকাবিলায় ঈমান আনয়ন ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নের পথে অগ্রসর হতে হয়েছে, পরবর্তীগণ সেরূপ প্রতিকূল পরিবেশের সম্মুখীন হননি। অনুরূপভাবে দীনে ইসলামের জন্য তারা যে ত্যাগ ও কুরবানী করেছেন, জিহাদ ও সংগ্রামের সম্মুখীন হয়েছেন, পরবর্তীদের বেলায় তা অনেক সহজ ও সহনীয় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল।
রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন সময়ে সাহাবায়ে কেরাম রাযি. হতে বাইয়াত গ্রহণ করেছেন; হুদাইবিয়ার সন্ধির প্রাক্কালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরাম রাযি. হতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। আল্লাহ তা'আলা প্রশংসনীয়ভাবে সে বাইয়াতের উল্লেখ করে নিজের সন্তুষ্টির ঘোষণা প্রদান করেন। ইসলামের ইতিহাসে তাই একে 'বাই' আতুর রিযওয়ান' নামে উল্লেখ করা হয়েছে। (সূরা ফাতহ- ১০, ১৮) সূরা মুমতাহিনার ১০নং আয়াতে আল্লাহ তা'আলা মক্কা মুকাররমা হতে মদীনা তাইয়িবায় আগমনকারিণী মুসলিম রমণীগণকে বাইয়াত করে নেয়ার আদেশ প্রদান করেছেন। সহীহ বুখারীর ঈমান অধ্যায়ে হিজরতের পূর্বে মদীনার খাযরাজ ও আউস গোত্র থেকে বাইয়াত গ্রহণের উল্লেখ রয়েছে এবং উক্ত হাদীসে ও সূরা মুমতাহিনার আয়াতে যেসব শব্দে বাইয়াত গ্রহণের উল্লেখ রয়েছে, মাশাইখে কেরাম রহ. সেসব শব্দেই মুরিদগণ হতে বাইয়াত গ্রহণ করে থাকেন। সহীহ বুখারীর ঈমান অধ্যায়ে হযরত জারীর ইবন আব্দুল্লাহ বাজালী রাযি. হতে বাইয়াত গ্রহণের কথা স্বয়ং হযরত জারীর রাযি. বর্ণনা করেছেন। অনুরূপভাবে মক্কা বিজয়ের পরের দিন হাজার হাজার লোক হতে বাই'আত গ্রহণের উল্লেখ হাদীস ও সীরাত গ্রন্থসমূহে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে। সহীহ বুখারীর ঈমান অধ্যায়ে হযরত উবাদা ইবনে সামেত রাযি, বর্ণিত বাই'আতে আকাবার হাদীসের بايعوني (তোমরা আমার নিকট বাই'আত কর) শব্দের ব্যাখ্যায় গাইরে মুকাল্লিদ আলেম মাওলানা নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান ভূপালী রহ তার ভাষাগ্রন্থ আউনুল বারীতে দলীল-প্রমাণসহ মাশাইখে কেরামের বাই'আত গ্রহণকে সুন্নাত বলে ঘোষণা দিয়েছেন। শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা যাকারিয়া রহ. তার আল আবওয়াব ওয়াত্তারাজিম গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডের ৪৩নং পৃষ্ঠায় নওয়াব সাহেবের বক্তব্যের উদ্ধৃতি পেশ করেছেন। কাজেই কুরআন মাজীদ ও হাদীসে নববীর অর্থ ও মর্ম হতে অজ্ঞ সালাফী নামের চুনোপুটিদের বাইয়াত করাকে বিদ'আত বলে অভিহিত করা হাস্যম্পদ ছাড়া আর কিছুই নয়; বরং কুরআন মাজীদ ও হাদীসে নববী হতে প্রমাণিত সুন্নাতে মুতাহ্হারাকে বিদ'আত বলে অভিহিত করা চরম ধৃষ্টতা ও অমার্জনীয় অপরাধ নিঃসন্দেহে।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, নামায-রোযা ইত্যাদি আল্লাহ তা'আলার যিকির; বরং বড় যিকির, যা আমরা পূর্বেও একবার উল্লেখ করেছি। সহীহ বুখারীর হাদীসে আছে, নামাযীকে বলা হচ্ছে,
كأنما تناجى ربك
অর্থ : তুমি এমনভাবে নামায আদায় কর, যেন তুমি তোমার রবের সঙ্গে কানাকানি করছ, গোপন প্রেমালাপ করছ। হাদীসে জিবরাঈলে আছে,
أن تعبد الله كأنك تراه فإن لم تكن تراه فإنه يراك
অর্থ : এমনভাবে ইবাদত করবে যেন তুমি তোমার রবকে দেখতে পাচ্ছ, যদি এত উচ্চস্তরে ওঠতে সমর্থ না হও তবে এ কথা তো নিশ্চিত যে, তিনি সর্বক্ষণ তোমাকে প্রত্যক্ষ করছেন।
তুমি যখন (একমাত্র তোমারই ইবাদত করছি, অন্য আর কারো ইবাদত করি না, তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করছি, অন্য আর কারো সাহায্য কামনা করি না) উচ্চারণ করছ, তখন কি তুমি সত্যিই তাঁরই সঙ্গে বাক্যালাপ করছ? না সমগ্র পৃথিবী একবার পরিভ্রমণ করে আসছ? বুকে হাত দিয়ে সত্য কথা বল। ইমাম গাযালী রহ ইহইয়াউ উলুমিদ্দীন কিভাবে লিখেছেন যে, আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন,
لَا تَقْرَبُوا الصَّلَاةَ وَأَنْتُمْ سُكَارَى حَتَّى تَعْلَمُوا مَا تَقُولُونَ
অর্থঃ পানোন্মত্ত অবস্থায় তোমরা নামাযের নিকটবর্তী হয়ো না, যতক্ষণ না তোমরা যা মুখে উচ্চরণ কর তা জানতে সক্ষম হও। (সূরা নিসা-৪৩)
এর উপর ভিত্তি করে আমরা (ইমাম গাযালী রহ.) বলতে পারি যে, পার্থিব মোহ-মদে উন্মত্ত ব্যক্তি, যে নামাযে কী উচ্চারণ করছে তা হতে সম্পূর্ণ গাফিল, কিছুই খবর রাখে না, সেও তো এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় এসে যাবে। (আল্লাহ তা'আলা গফুরুর রহীম ক্ষমা করুন!)
ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন গ্রন্থের সারসংক্ষেপ আইনুল ইলম গ্রন্থে উল্লেখ আছে,
الخشوع هو حقيقة الصلاة فهو فرض عين وإن أنكره الفقهاء
একাগ্রতা, নিবিষ্টতাই হল নামাযের প্রাণ, কাজেই তা ফরযে আইন। যদিও ফকীহগণ তা অস্বীকার করেছেন। প্রকৃতপক্ষে ফকীহগণ তা অস্বীকার করেননি, তারা নিজেরা এই খুশুর সাথেই নামায আদায় করেছেন, তারা আমার মত নামাযীকে ফরয আদায়ের দায়মুক্ত করার উদ্দেশ্যে খুশু কে নামাযের ফরযে আইন নির্ধারণ না করে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। কারণ আমি এবং এসব চুনোপুটি সালাফীরা তো যে নামায আদায় করি, তা কবির ভাষায় বলতে গেলে-
جو میں سر بسجدہ ہوا کبھی تو زمیں سے آنے لگی صدا+ تیرا دل تو ہے صنم آشنا،تُجھے کیا ملے گا نماز میں
অর্থ : যদিও কখনো সিজদায় মাটিতে রেখেছি মাথা, মৃত্তিকা হতে আসিছে প্রতিধ্বনি, হৃদয় তোমার প্রতিমাসক্ত, এ নামাযে শূন্য রহিবে তব হৃদয়ের অঞ্চলখানি।
পথিপার্শ্বের ডোবায় বর্ষার পানিতে লম্প-ঝম্প প্রদানকারী সালাফী নামের টাকি মাছেরা কুরআন-হাদীসের অতলান্ত সাগরের কী খবর রাখবে? তারা তো আমাদের জাতীয় কবির ভাষায়- 'ফল বহিয়াছ, পাওনিকো রস, হায়রে ফলের ঝুড়ি!
লক্ষ বছর ঝর্ণায় ডুবে রস পায় নাকো নুড়ি।'
এতো হল সর্বপ্রধান ইবাদত নামাযের অবস্থা,দ্বিতীয় ইবাদত রোযার সম্পর্কে হাদীসে কুদসিতে আল্লাহ তা'আলা বলেন,
كل عمل ابن آدم له إلا الصيام فإنه لي وأنا أجزي به والصيام جنة، وإذا كان يوم صوم أحدكم فلا يرفث يومئذ، ولا يصخب فإن سابه أحد، أو قاتله فليقل إني امرؤ صائم
অর্থ : আদম সন্তানের প্রত্যেক আমলের প্রতিদান সে পাবে (অন্য হাদীসের বর্ণনানুযায়ী ১০ গুণ হতে ৭০০ গুণ পর্যন্ত) কিন্তু রোযা, এতো শুধুমাত্র আমারই জন্য। কাজেই আমি স্বহস্তে এর প্রতিদান দিব (অথবা আমি নিজেই এর প্রতিদান হয়ে যাব! সুবহানাল্লাহ)। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, রোযা পাপ কর্ম হতে ঢাল বা বর্মস্বরূপ (অন্য হাদীসে আছে, যতক্ষণ পাপ কর্ম করে তা ছিদ্র না করে ফেলে)। যখন তোমাদের কেউ দিনে রোযা রাখবে, তখন সে যেন অশ্লীল বাক্য উচ্চারণ না করে, ঝগড়াঝাঁটি না করে, যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সাথে মারামারি করতে উদ্যত হয়, তখন যেন সে বলে দেয়, ভাই আমি রোযাদার। (সহীহ বুখারী; হা. নং হিন্দুস্তানী নুসখা ১/২৫৫) অথচ রোযা রেখে আমরা অবলীলাক্রমে সর্বপ্রকার পাপ ও অন্যায় কার্যে লিপ্ত হয়ে পড়ি। যোহরের পর হতে আমাদের মেযাজ তো এরূপ গরম হয়ে ওঠে যে, তপ্ত কড়াইয়ে তেলের ছিটা দিলে যেমন ছ্যাত ছ্যাত করে ওঠে। তাই তো আমাদের রোযার যোগফল হাদীসের ভাষায় كم من صائم ليس له إلا الجوع বহু রোযাদারের থলিতে সারাদিনের রোযার ফসল ক্ষুৎপিপাসার কষ্ট করা ছাড়া আর কিছুই পড়ে না। রোযা তো আমাকে বর্জনকারী বানাবে, মুত্তাকী-সংযমী, বর্জনকারী খাদ্য-পানীয় হতে ক্রমে ক্রমে সবকিছু পরিহার করে আমি একমাত্র আল্লাহর স্মরণ ও প্রেমে বিভোর হয়ে যাব। সারাজীবন রোযা রেখে কি আমি এ পথে এক পদও অগ্রসর হতে পেরেছি? যাকাত তো যাকাতদাতার অন্তর হতে অর্থ- সম্পদের লোভ-লালসা দূর করে আল্লাহ তা'আলার নিয়ামতের শুকরিয়া আদায়ে তার মন-মস্তিষ্কে আল্লাহ তা'আলার সন্তুষ্টি অর্জনের চিন্তা ছাড়া অন্য কোনকিছুর চিন্তাই স্থান পাবে না। অথচ আমাদের যাকাতদাতাগণের মাঝে শতকরা ক'জনকে আপনি এরূপ পাবেন? হজ্জ তো হজ্জ আদায়কারীকে সদ্যপ্রসূত সন্তানের মত নিষ্পাপ করে দেয়, জান্নাত ছাড়া হচ্ছে মাবরূর (মাকবুল হজ্জ) এর আর কোন প্রতিদান নেই। হজ্জ তো আল্লাহ প্রেমিকদের প্রেমের লীলাখেলার ক্ষেত্রে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ করে দেয়ারই এক লীলাখেলা। অথচ হজ্জ করতে গিয়ে আমরা সেই পুণ্যভূমিতে ইয়াহুদী-নাসারাদের পণ্যে ভরা মার্কেটিংয়ের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়া ছাড়া আর কী করে থাকি?
প্রশ্ন হল, আমার আধ্যাত্মিক জীবনের এই পুষ্টিকারক উপাদেয় খাদ্য কেন আমার আধ্যাত্মিক শক্তিকে সবল করার পরিবর্তে দুর্বল করে ফেলছে? যখন কোন ব্যক্তির শরীরে পুষ্টিকারক খাদ্য পুষ্টি ও বল বৃদ্ধি করতে ব্যর্থ হয়, তখন তার পরিপাকের সহায়ক ওষুধ ব্যবহার করাই কি বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয়? তাই উপরে বর্ণিত আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনের পুষ্টিকারক খাদ্য ইবাদত-বন্দেগীকে আমাদের জন্য পুষ্টিকর বানানোর জন্য সুফিয়ায়ে কেরাম যিকরুল্লাহর ওষুধের নানাবিধ ব্যবহারের পথ-পন্থা উদ্ভাবন করেছেন মাত্র, যা ইবাদত বন্দেগীকে সত্যিকারের ইবাদত-বন্দেগীতে রূপান্তরের উপায় মাত্র। ইবাদত যখন সত্যিকারের ইবাদতে পরিণত হবে, তখন তার অনিবার্য ফলস্বরূপ আখলাকে হাসানা বা চরিত্র মাধুর্য ফুটে উঠবে। এজন্য তরীকতপন্থী শাইখের জন্য আমলদার আলেম, সুন্নাতে মুতাহ্হারার পূর্ণ অনুসরণকারী, সকল প্রকার অন্যায়, পাপকর্ম এমনকি সন্দেহজনক কর্মসমূহ সযত্নে পরিহারকারী, সর্বদা আল্লাহ তা'আলার যিকিরে রসনা সিক্ত, শ্বাস- প্রশ্বাস যিকরুল্লাহর সুগন্ধে আমোদিত, হৃদয়-মন আল্লাহ তা'আলার ইশক- মুহাব্বত, প্রেম-ভালোবাসায় পরিপূর্ণ, সর্বোপরি অবিচ্ছিন্ন সূত্র পরম্পরায় রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত মাশাইখে কামেলীনের ধারাবাহিকতা বর্তমান থাকা জরুরী ও অপরিহার্য।
আলহামদুলিল্লাহ! আমাদের সুলুক-তরীকতপন্থী মাশাইখে কেরাম একদিকে নিজেদের জীবনে উপরে বর্ণিত গুণাবলীর অধিকারী, অপরদিকে তারা গোটা উম্মতের হিদায়াত ও ইসলামের জন্য নিজেদের আরাম-আয়েশ, বিরাম-বিশ্রাম কুরবানী করে গেছেন। রাতের আঁধারে নিজের গোটা উম্মতের কল্যাণ কামনায় আল্লাহ তা'আলার দরবারে কেঁদে বুক ভাসিয়ে দিয়েছেন। দিনের বেলায় শিরক বিদ'আতের মূলোৎপাটনে, জুলুম-সংগ্রাম অত্যাচারের প্রতিরোধে দুর্জয় সাহসে অগ্রসর হয়েছেন। সকল প্রকার বাতিল ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম করে গেছেন। কোন রাজশক্তির নির্যাতন-নিপীড়ন তাদেরকে এ জিহাদ হতে মুহূর্তের জন্যে বিরত রাখতে সমর্থ হয়নি। এরাই সত্যের পতাকাবাহী সেই অকুতোভয় সেনাদল, যাদের সম্পর্কে হাদীসে নববীতে সুসংবাদ দান করা হয়েছে-
لا تزال طائفة من أمتي ظاهرين على الحق لا يضرهم من خالفهم
অর্থ : আমার উম্মতের মাঝে এমন একদল সদা-সর্বদা হক ও সত্যের উপর অটল-অবিচল থাকবে, কারো বিরোধিতা, জুলুম-নিপীড়ন তাদেরকে সত্যপথ হতে বিন্দুমাত্র টলাতে পারবে না। আকাবিরে দেওবন্দ (রহ.) এই সত্যের পতাকাবাহীদের অবিচ্ছিন্ন পরপম্পরার সার্থক উত্তরসূরী। এরা যেমন কুরআন মাজীদ, হাদীসে নববী, তরীকায়ে সাহাবায়ে কেরাম, আইম্মায়ে তাবেয়ীন, ফুকাহায়ে মুজতাহিদীনের অধিকারী ছিলেন, তেমনি জ্ঞানের অধিকারী জীবনের প্রতিক্ষেত্রে সে জ্ঞানের অনুসরণকারী ছিলেন। এতদসঙ্গে তারা সুলূক-তরীকতের উপর নিজেদের জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। মুসলিম জনগণকেও এর শিক্ষাদান করেছেন। এদের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ সুন্নাতে নববীর অনুসরণে দৃঢ় ছিল। সঙ্গে সঙ্গে শিরক বিদ'আত, কুসংস্কার ও সামাজিক অনাচারের মূলোৎপাটনে সর্বদাই অগ্রণী থেকে জাতি ও সমাজকে সঠিক পথের দিক নির্দেশনা প্রদান করে গেছেন। পরাক্রমশালী তাগুতী শক্তির বিরুদ্ধে তাদের জিহাদ ও সংগ্রামের কাহিনী ইতিহাসের পৃষ্ঠায় স্বর্ণাক্ষরে জ্বলজ্বল করছে। বাকশক্তির মাধ্যমে ওয়ায-নসীহত, লেখনী শক্তির মাধ্যমে অমর ও অমূল্য গ্রন্থাবলী রচনা, দীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জাল বিছিয়ে দেয়া, বছরের পর বছর কুরআন- হাদীসের অধ্যাপনা, মুসলিম সমাজে উদ্ভূত সমস্যাবলীর সমাধানে ফতওয়া প্রদান, প্রবন্ধ রচনা, দীনে ইসলামের উপর আক্রমণকারী শক্তির মুকাবিলায় মুনাযারা তর্কযুদ্ধ, সশস্ত্র সংগ্রাম, জেল-জুলুম কবুল করা, ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে সত্যের জয়গান গাওয়া, এক কথায় মানবীয় সকল প্রকার শক্তি কলা-কৌশল, পথ ও পন্থা অবলম্বনে মুহূর্তের তরে কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, ভয়-ভীতি তাদের কেশাগ্রও স্পর্শ করতে সক্ষম হয়নি। সেই সঙ্গে খানকায় বসে আল্লাহ তা'আলার লাখো লাখো বিপথগামী, দিশেহারা বান্দাকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নৈকট্য ও সান্নিধ্য লাভের দিশা প্রদান করে গেছেন। এদের খানকাহী পদ্ধতি বা তাসাওউফ-তরীকত অবিচ্ছিন্ন সূত্র পরম্পরায় চিশতিয়া, কাদেরিয়া, নকশবন্দীয়া সোহরাওয়ারদিয়া তরীকায় তাবেয়ীকুল শিরোমণি, হাদীস ও ফিকহের ইমাম, হযরত খাযা হাসান বসরী রহ. এর মাধ্যমে মদীনাতুল ইলম হযরত আলী রাযি. হয়ে আকায়ে নামদার, সরওয়ারে কায়েনাত, সাইয়িদুল আউয়ালীন ওয়ালআখিরীন, খাতামুন্নাবিয়্যীন ওয়ালমুরসালীন মুহাম্মাদ মুস্তফা, আহমাদ মুজতবা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কদম মুবারকে গিয়ে পৌছে গেছে। সম্ভবত শেষ জীবনে ইরাকে অবস্থানের ফলে এ নবুওয়াতী তাযকিয়া ও তাওহীদের সিলসিলা মুসলিম বিশ্বের পূর্বাঞ্চলে হযরত আলী রাযি এর মাধ্যমে বিস্তার লাভ করেছে। সাইয়িদুনা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. ফারুকে আযম উমর রাযি. উসমান গণী রাযি. প্রমুখ সাহাবায়ে কেরামের রূহানী সিলসিলা সৌদি আরব, মিশর, সুদান, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, লিবিয়া, মরক্কো হয়ে আন্দালুস বা মুসলিম স্পেন ও অন্যান্য মুসলিম দেশে পৌঁছে গেছে। এক কথায় রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তিলাওয়াতে কিতাব, তা'লীমে কিতাব ও হিকমাহ (হাদীস ও তাফসীর) এর ফারায়েযে মানসাবে রিসালাতের ন্যায় তাযকিয়ার ফরীযাও সাহাবায়ে কেরামের মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র পৌঁছে গেছে, যা ঐতিহাসিক সত্য। আল্লাহ তা'আলার ঘোষণা, তানযীলুয যিকর ও তার হিফাযত-সংরক্ষণ যেমন অক্ষরে অক্ষরে সত্যে পরিণত হয়েছে, তেমনি এ শাজারায়ে তাইয়িবা পত্র-পল্লবে, ফুলে-ফলে সুশোভিত হয়ে চৌদ্দশত বছর যাবত বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে মানবাত্মার খোরাক যুগিয়েছে এবং ইনশাআল্লাহ কিয়ামত পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে। বাইয়াত ও তাসাওউফ সম্পর্কে আমার মত অজ্ঞ-মূর্খ- যে কিনা এ জগৎ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অপরিচিত- কী লিখব? তাবেয়ীন ও তাবে-তাবেয়ীনের যুগ হতে আইম্মায়ে দীন কুরআন মাজীদ ও হাদীসে নববীর আলোকে বৃহৎ কলেবরের গ্রন্থসমূহে এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন।
কুতুবুল আলম হযরত মাদানী রহ. এর একটি মূল্যবান ওয়ায 'ইহসান ও সুলুক' নামে স্বতন্ত্র পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হয়েছে। চার খণ্ডের হাজার পৃষ্ঠার ঊর্ধ্বে মাকতুবাতে শাইখুল ইসলাম গ্রন্থে বিভিন্ন ব্যক্তির পত্রের উত্তরে হযরত মাদানী রহ.-বহু পত্র লিখেছেন, সুলুক ও তরীকাত শিরোনামে, ঐসব পত্র স্বতন্ত্র খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ. এর কয়েকটি মূল্যবান গ্রন্থে ও মাওয়ায়েযে এতদসম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। হযরত হাজী সাহেব রহ. এর যিয়াউল কুলূব ও হযরত গাঙ্গুহী রহ. এর ইমদাদুস সুলুক গ্ৰন্থ দু'খানা অত্যন্ত মূল্যবান। হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানী রহ. এর মাকতুবাত 'মাকতুবাতে ইমামে রাব্বানী' নামে বাংলা ভাষায়ও অনূদিত হয়েছে। তাসাওউফ ও তরীকত সম্পর্কে অতি উচ্চাঙ্গের আলোচনা রয়েছে এসব গ্রন্থে। ইমামুল হিন্দ হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ. এর আলকউলুল জামীল এতদসম্পৰ্কীয় অতি মূল্যবান গ্রন্থ।
ইমাম গাযালী রহ. ও হযরত আব্দুল কাদের জিলানী রহ. এর গ্রন্থাবলী সারা মুসলিম বিশ্বে সমাদৃত। এসব গ্রন্থের বাংলা অনুবাদও প্রকাশিত হয়েছে। ফলকথা চৌদ্দশত বছর যাবত আহলে সুন্নাত ওয়ালজামাআতের সকলেই তাসাওউফ ও সুলূকের উপর গুরুত্বারোপ করে আসছেন। তাই তাসাওউফ ও সুলুকের এ সর্বজনবিদিত প্রবাহমান অবিচ্ছিন্ন ধারার প্রকৃত সত্যকে অস্বীকার করা ঈমানহারা হওয়ার নামান্তর। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সকলকে সীরাতে মুস্তাকীমের উপর অবিচল থাকার তাওফীক দান করুন। আ-মীন।
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
আলোকময় কুরআন
আজ জুমু'আর দিন। এ দিনে সূরা কাহাফ তিলাওয়াতের বিশেষ ফযীলত রয়েছে। এটা পনের পারায় শুরু হয়ে ষোল পারায় শে...
ইয়াহুদী-খ্রিস্টানদের বহুমুখী ষড়যন্ত্র মুসলিম উম্মাহর করণীয়
কুরআন-হাদীসে ইয়াহুদী-খ্রিস্টানের পরিচয় ইয়াহুদী জাতি পৃথিবীর প্রাচীনতম জাতি। আল্লাহ তা'আলা হযরত নূহ আ...
পরীক্ষায় সফলতা লাভের উপায়
ইলমে দীন শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যর্থতা বলতে কিছু নেই। ইলমে দীন অর্জনে চেষ্টা করতে পারাই অনেক বড় সফলতা।...
মাযহাবের মহান ইমামগণের উপর আরোপিত অপবাদের অপনোদন
মূল আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহ. কুরআন হাদীসের জটিল ও দ্বিমুখী অর্থবহ বিষয়াদির সুষ্ঠু ও সুন্দর সমাধান ...