প্রবন্ধ
আলেমদের প্রতি আস্থাহীনতা গোমরাহীর প্রথম সোপান
কুরআন-সুন্নাহর আলোকে আলেমগণের মর্যাদা
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পবিত্র ঘোষনা,
এক.
إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ
অর্থঃ আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে আলেমগণই আল্লাহকে ভয় করে। (সূরা ফাতির- ২৮ )
দুই.
يُؤْتِي الْحِكْمَةَ مَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُؤْتَ الْحِكْمَةَ فَقَدْ أُوتِيَ خَيْرًا كَثِيرًا
অর্থঃ আল্লাহ যাকে চান হিকমত দান করেন। আর যে হিকমত প্রাপ্ত হল সে প্রচুর কল্যাণ পেয়ে গেল। (সূরা বাকারা- ২৪৯)
উল্লেখ্য, উম্মতের সর্বসম্মতিক্রমে এখানে হিকমত দ্বারা উদ্দেশ্য ইলমে দীন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র ঘোষণা,
এক
فضل العالم على العابد كفضلي على أدناكم
অর্থঃ আবেদের তুলনায় আলেমের শ্রেষ্ঠত্ব এমন, যেমন তোমাদের সর্বনিম্ন ব্যক্তির তুলনায় আমার শ্রেষ্ঠত্ব। (সুনানে তিরমিযী; হা. নং ২৬৮৫)
দুই.
خيركم من تعلم القرآن وعلمه
অর্থঃ তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সেই, যে কুরআন শেখে ও শেখায়। (সহীহ বুখারী; হা. নং ৫০২৭)
তিন.
إن العلماء ورثة الأنبياء
অর্থঃ আলেমগণ সকল নবীর ওয়ারিস। (সুনানে তিরমিযী; হা. নং ২৬৮২)
চার.
فقيه واحد أشد على الشيطان من ألف عابد
অর্থঃ একজন ফকীহ শয়তানের বিপক্ষে একহাজার আবেদের তুলনায় অধিক শক্তিশালী।
(সুনানে ইবনে মাজাহ; হা. নং ২২২)
পাঁচ.
كن عالما أو متعلما أو محبا أو متبعا , ولا تكن الخامس فتهلك
অর্থ : তুমি আলেম হও অথবা তালিবে ইলম হও কিংবা আলেমকে ভালোবাসো নতুবা আলেমকে মেনে চলো; পঞ্চম হয়ো না তাহলে ধ্বংস হয়ে যাবে।(আল-মাদখাল ইলাস সুনানিল কুবরা লিল-বাইহাকী; হা. নং ২৮৭)
প্রিয় পাঠক! আলেমের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে আরো বহু আয়াত ও হাদীস রয়েছে। নমুনা স্বরূপ মাত্র কয়েকটি উল্লেখ করা হলো। বলাবাহুল্য, এ সকল বাণী ঐ আলেম সম্পর্কে প্রযোজ্য, যে হকপন্থী ও বিশুদ্ধ ইলমের অধিকারী হবে। অসৎ আলেম ও নামকাওয়াস্তে শুধু সনদধারী আলেম সম্পর্কে কখনোই প্রযোজ্য নয়। মনে রাখতে হবে, যে আবেদের তুলনায় আলেমকে হাজার গুণে শ্রেষ্ঠ বলা হচ্ছে সে ঐ আবেদ, যে জরুরী ইলম শিখার পর ঠিক সঠিকভাবে ইবাদত আঞ্জাম দেয়। মূর্খ ও বদদীন আবেদ মোটেও উদ্দেশ্য নয়। মূর্খ ও বদদীনের তো আলেমের সঙ্গে কোন তুলনাই চলবে না। আর ইসলাম যেহেতু সার্বজনীন ও সর্বকালীন ধর্ম কাজেই কিয়ামতের আগ পর্যন্ত ইলম থাকবে, আলেমে দীনও থাকবে। তবে সাধারণ উম্মতের মান যেমন ক্রমান্বয়ে কমতে থাকবে, আলেমের মানও সমানতালে কমতে থাকবে। শুধু আলেমের মান কমবে, আর সাধারণ উম্মতেরা সোনালী যুগের উম্মতের মতই থাকবে এমনটা ভাবার কোন যুক্তি নেই। উম্মতের গুণগত মান ও আলেমের গুণগত মান সর্বযুগে সমপর্যায়ের ছিল, এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও একই রকম থাকবে। এর ব্যতিক্রম নেই, হবেও না। আজ অধিকাংশ লোক আলেমদেরকে পূর্ববর্তী আলেমদের ওজনে পরিমাপ করে; কিন্তু নিজেদেরকে পূর্ববর্তী উম্মতের পাল্লায় মাপে না। এটা যে খাঁটি মানের বেওকুফী, তাও তারা জানে না।
এটাও সত্য যে, সাহাবীদের সময়ে যেমন সাহাবী বেশধারী মুনাফিক লোকও ছিল, তেমনিভাবে পরবর্তী সকল যুগেই আলেমদের পাশাপাশি আলেমের লেবাসধারী ও মুখোশধারী অনেক অসৎ আলেমও থাকবে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও পূর্ববর্তী কোন যুগে দীনের চাকা যেমন আলেমবিহীন চলেনি; ভবিষ্যতেও কখনো ঘুরবে না। সত্যসন্ধানী লোকেরা খাটি আলেম খুঁজে নিবেই। ফলে সঠিক পথে চলতে তাদের কোন অসুবিধা হবে না। তাদের কাছে হক্কানী আলেমের কখনো আকাল পড়বে না।
আলেমদের উদাহরণ
আলেমরা হলেন দীনের পাওয়ার হাউজ।যেহেতু দীনের ভিত্তি হল, কুরআন- সুন্নাহ; কাজেই কুরআন-সুন্নাহ'য় যারা পারদর্শী তারাই সর্বযুগে দীনের কেন্দ্রস্থল হবে- এটা একদম স্বাভাবিক। কুরআন- সুন্নাহর ইলমধারী আলেমদের তুলনায় কুরআন-সুন্নাহর ইলমে ব-কলম লোকেরা দীন বেশি বুঝবে, সুস্থ বিবেক এটা মানতে পারে না। সুতরাং কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী চলতে চাইলে সাধারণ মানুষকে আলেমদের কাছে আসতেই হবে। এক্ষেত্রে আলেমরা হলেন দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন আর সাধারণ মানুষ হল অন্ধ। অন্ধরা নিরাপদে পথ চলতে চাইলে যেমন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোন দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন লোকের সহায়তা নিতে হয়, তেমনি সাধারণ মুসলমানদের দীনের উপর চলার ইচ্ছা থাকলে সরাসরি বা কারো মাধ্যমে আলেমের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে হবে। মধ্যকার সংযোগ যতই দীর্ঘ হোক, পাওয়ার হাউজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলে বাতি জ্বলবে, মোটর ঘুরবে কিন্তু পাওয়ার হাউজের কাছাকাছি অবস্থান করেও সংযোগ- বিচ্ছিন্ন হলে যেমন বাতি জ্বলে না, অন্ধকারই বহাল থাকে, তেমনি প্রত্যেক ঈমানদারকে যে কোনভাবে কোন আলেমের সঙ্গে সংযুক্ত না থাকলে তার অন্তরঘরে আলো জ্বলবে না; সেটা অন্ধকারই থেকে যাবে। মোটকথা, সাধারণ উম্মত যদি সঠিক দীনের উপর থাকতে চায় তাহলে আলেমকে রাহবার বানাবে অথবা আলেমের রাহবারীতে চলে এমন ব্যক্তিকে রাহবার বানাবে। অন্যথায় এক অন্ধের পিঠে হাত রেখে আরেক অন্ধের পথ চলার মত হবে। এরা সমতল রাস্তায় কিছুক্ষণ চলতে পারলেও উঁচু-নিচু ও এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় দিশারী ও অনুসারী উভয়েই হোঁচট খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়বে।
আলেমদের আরেকটি তুলনা হয় সমুদ্রের সঙ্গে। সমুদ্র নিজেকে জীবন্ত রাখার পাশাপাশি খাল-বিল, নদী-নালাকেও জীবন্ত রাখে। অপরদিকে বিচ্ছিন্ন ও বিস্তীর্ণ স্থলভূমিকেও মেঘের আকারে পানি পৌঁছে দিয়ে সজীব রাখে। ঠিক তেমনি পৃথিবীতে আলেমগণ আছেন বলেই দীন আছে। আলেমগণের কাছ থেকেই মানুষ দীন শেখে। কখনো আলেমের কাছে এসে শেখে, কখনো আলেমের কাছ থেকে শিখে নেয়া ব্যক্তির মাধ্যমে শেখে। যে আলেম না বা আলেমের শিষ্যও না, সে তো নিজেই রিক্তহস্ত; অন্যকে কী দিবে? কতক অবুঝ লোক মাদরাসা-মসজিদ ও খানকায় দীনের খিদমতে রত আলেমদেরকে তুলনা করে কূপের সঙ্গে। তাদের চিন্তা-জগতে সাগরের অস্তিত্বই নেই। অন্যথায় সাগরের সঙ্গে তারা কাদেরকে তুলনা করবে? আলেমগণের দায়িত্ব আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন,
(ক)
وَإِذْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ لَتُبَيِّنُنَّهُ لِلنَّاسِ وَلَا تَكْتُمُونَهُ
অর্থঃ স্মরণ করো ঐ সময়কে যখন আল্লাহ তা'আলা কিতাবপ্রাপ্তদের কাছ থেকে পাকা ওয়াদা নিয়েছিলেন যে, তোমরা অবশ্যই একে সুস্পষ্টাকারে বর্ণনা করবে এবং এর কোন বিষয়কে গোপন করবে না...। (সূরা আলে ইমরান- ১৮৭)
(খ)
هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ
অর্থঃ তিনিই নিরক্ষর লোকদের মাঝে তাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসুল পাঠিয়েছেন যিনি তাদেরকে আল্লাহর কালাম পড়ে শোনান। তাদের অন্তরাত্মা পবিত্র করেন এবং তাদেরকে কুরআন- সুন্নাহ শিক্ষা দান করেন...। (সূরা জুমু'আ-২)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
يحمل هذا العلم من خلف عدوله ينفون عنه تحريف الغالين وانتحال المبطلين وتأويل الجاهلين.
অর্থঃ প্রত্যেক প্রজন্মের সৎ ও যোগ্য লোকেরা এ ইলমের ধারক হবে। এরা এ ইলম থেকে সীমালঙ্ঘনকারীদের বিকৃতি, বাতিলপন্থীদের ষড়যন্ত্র ও মূর্খদের অপব্যাখ্যাকে প্রতিহত করবে। (আল- মাদখাল লিল-বাইহাকী)
উপর্যুক্ত আয়াত ও হাদীসের আলোকে নবীজীর ওয়ারিস আলেমগণের মৌলিক দায়িত্ব হল-
(এক) তারা আল্লাহ প্রদত্ত ইলম অন্যদেরকে শিক্ষা দিবে। (দুই) জনসাধারণের ঈমান, আমল ও আখলাক ঠিক করতে চেষ্টা করবে।
(তিন) ইলমে দীনের পাহারাদারী করবে। ভণ্ড, মূর্খ ও স্বার্থান্বেষীরা যেন দীনের নামে দীনের কোন ক্ষতি করতে না পারে সেদিকে চৌকান্না থাকবে। তাদের সকল অপতৎপরতাকে রুখে দিবে।
এ সকল দায়িত্ব বিবেচনা করলে বোঝা যাবে যে, আল্লাহ তা'আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলেমদেরকে সাধারণ উম্মতের পরিচালক ও নিয়ন্ত্রক হিসেবে নিয়োজিত করেছেন। অর্থাৎ শরীয়ত যেন একটি বাহন। সাধারণ উম্মত সে বাহনের যাত্রী। আর আলেমগণ হলেন চালক। যারা আলেমদেরকে চালকের আসনেই স্থান দিবে আর নিজেরা যাত্রীর আসনে থাকবে তারা কোনদিন পথ হারাবে না, দুর্ঘটনার শিকার হবে না। পক্ষান্তরে যারা আলেম না হয়েও চালকের আসনে বসবে আর আলেমদেরকে যাত্রীর আসনে ঠেলে দিবে তারা পথ হারাবে, দুর্ঘটনার শিকারও হবে। সুতরাং যাদেরকে আল্লাহ তা'আলা ইলম দান করেছেন তারা যেমন ইচ্ছা করে ড্রাইভিং সিট ছাড়বে না তেমনি যারা আলেম হননি, তারা কখনো ড্রাইভিং সিটে বসবে না। হ্যাঁ, সাধারণ জনগণ রেলওয়ের বগির কাজ আঞ্জাম দিতে পারে। তথা তারা জনগণকে কোন সূত্রে জড়ো করে ইঞ্জিন তথা আলেমদের সঙ্গে জুড়ে দিবে। ফলে সে যেমন গন্তব্যস্থলে পৌঁছবে, তার মাধ্যমে আরো বহু লোক গন্তব্যে পৌছতে সক্ষম হবে। এর মাধ্যমে তার যিম্মায় অর্পিত আয়াত كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ (অর্থ তোমরা শ্রেষ্ঠ উম্মত, তোমাদেরকে মানুষের (কল্যাণের) জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা সৎকাজের আদেশ করবে, অন্যায় কাজে বাধা দিবে। সূরা আলে ইমরান- ১১০)-এ বর্ণিত দায়িত্ব পালন করা হয়ে যাবে।
আলেমদের প্রতি সাধারণ মানুষের করণীয়
আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন, أطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الأمْرِ مِنكُمْ. অর্থ : তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহ তা'আলা ও তাঁর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যকার দায়িত্বশীলদের। (সূরা নিসা-৫৯)
দায়িত্বশীল বলতে উলামা ও ন্যায়পরায়ণ শাসকবর্গ উদ্দেশ্য। যখন ন্যায়পরায়ণ শাসক থাকবে না, তখন এ আয়াত দ্বারা শুধু আলেমগণই উদ্দেশ্য হবে।
বর্তমানে আলেমগণের আনুগত্যকে উপেক্ষা করার জন্য কত ধরনের গোমরাহীর আশ্রয় নেয়া হয়। একশ্রেণীর লোকেরা বলে, আলেম মানে জ্ঞানী সুতরাং যে জানে সে-ই আলেম। বেচারারা এতটুকু চিন্তা করে না যে, কিছু জ্ঞান তো আবেদেরও থাকতে হবে। এখন এটুকু জেনে আবেদ সাহেবও যদি আলেম হয়ে যান তাহলে হাজার আবেদের তুলনায় একজন আলেমের শ্রেষ্ঠত্বের কী অর্থ থাকে? তাছাড়া জ্ঞানী তো অমুসলিমও হতে পারে। তাকে কি কেউ আলেম বলবে? বস্তুত 'আলেম' কথাটি যে নিছক শব্দ নয় বরং একটি সুস্পষ্ট পরিভাষা, অন্তর-কানা না হলে তো এ ব্যাপারে কারও অস্পষ্টতার শিকার হওয়ার কথা নয়। কুরআন- হাদীসের ভাষাজ্ঞান তো দূরের কথা, সহীহ-শুদ্ধ উচ্চারণটুকুও জানে না, এমন লোকও নাকি আলেম?! এমনটাই যদি হয়, তাহলে তো আর কেউ কারো অনুসারী হওয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ মানুষ মাত্রই তো আলেম! যেহেতু সে কিছু না কিছু জানে। জানি না, এদেরকে কে বোঝাতে সক্ষম হবে! আরেক শ্রেণীর লোক কিছু আলেমকে যে কোন কায়দায় নিজেদের পোষ্য বানিয়ে নেয়। অতঃপর বলে, আমাদের কাছেও তো আলেম আছে; আমরা আবার অন্য আলেমদেরকে মানব কেন? অথচ পোষ্যদের দিয়ে কোনদিন পরিচালকের কাজ নেয়া যায় না। এসব পোষ্যদেরকে তো তারা বহু পূর্বেই যাত্রীর আসনে বসিয়ে দিয়েছে। যার ফলে এরা গাড়ি চালানো ভুলেই গেছে। এখন বিকৃতি, ষড়যন্ত্র অপব্যাখ্যার ক্ষেত্রে সহযোগিতা ছাড়া বিরোধিতার কোন যোগ্যতাই এদের মধ্যে অবশিষ্ট নেই। বর্তমানে আলেমদের ব্যাপারে সাধারণ মুসলমানদের অনেক ভুল ধারণার জন্মদাতা এ সকল পোষ্য আলেমরাই। এরাই জনগণকে শিখিয়েছে যে, “আলেমরা হলেন কূপের মত যেখানে গিয়ে পানি আনতে হয়। আর দাঈরা হল মেঘের ন্যায় যে সর্বত্র গিয়ে বারি বর্ষণ করে। আলেমরা কুরআন-সুন্নাহর তা'লীম দিয়ে বেতন নেয়, চাকরি করে, দীনের কাজ করে না।আলেমরা কুরআন-হাদীস বোঝে; দীনের কাজ বোঝে না। কাজেই দীনের কাজে তারা অনুসরণীয় নয়' ইত্যাদি, ইত্যাদি। অথচ আলেমগণ বাস্তবে কূপ নন; বরং সকল পানির মূল উৎস- সাগর। আলেমগণ পয়সার জন্য মাদরাসা বা মসজিদের মধ্যে জমে বসে থাকে না; বরং কুরআন-হাদীসের স্বার্থে, জনগণের বৃহৎ স্বার্থেই তারা দীনী প্রতিষ্ঠানে জমে- বসে থাকেন। আলেমদের মসজিদ-মাদরাসায় জমে বসে থাকা তাদের দাবী অনুযায়ী যদি পয়সার জন্যই হয় তাহলে মাদরাসা-মসজিদ কেন, দোকানদারী, ব্যবসা-বাণিজ্যই তো করা যায়। আলেমরা ব্যবসা করতে চাইলে তাদের সঙ্গে কেউ কুলাতে পারবে না। তারা তো পানিতে ফুঁক দিয়ে আর কালো সুতা বিতরণ করেও বহু পয়সা কামাই করতে পারে। এর পরেও কেন এত অল্প পয়সায় মাদরাসা-মসজিদের খিদমত? তাছাড়া শুরু থেকেই তো ডাল-ভর্তা খেয়ে কষ্ট করে আলেম না হয়ে কোন রকম চেষ্টা করে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বিবিএ, এমবিএ কিছু একটা সনদ গ্রহ করতো। পরে বড় বেতনে চাকরি করতো আর ফাঁকে ফাঁকে বিনা বেতনে দীনের খিদমত করতো? আসলে আলেম হতে হলে যে কত ত্যাগ স্বীকার করতে হয় এবং মাদরাসা-মসজিদের খিদমত যে কত জটিল ও কষ্টকর, এ সম্পর্কে আলোচ্য শ্রেণীর লোকদের কোন ধারণাই নেই। তাছাড়া আলেমগণ যে কত দীনী কাজ বিনা বেতনে করেন তার সঠিক ধারণাও জনগণের কাছে নেই।
আর যে কোন পন্থায় দীনের কাজ যদি কুরআন-সুন্নাহ থেকে নিঃসৃত হয় তাহলে তার সঠিক জ্ঞান ও সঠিক পন্থা কুরআন- সুন্নাহ বিশেষজ্ঞ আলেমদেরই থাকবে এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং দীনের সকল কর্মপন্থা সম্পর্কে আলেমগণই বেশি অবগত। যে দীনের কাজে আলেমগণ অনভিজ্ঞ তা কোনভাবেই দীনের কাজ নয়, ঠিক যেমন কুরআন-সুন্নাহ বাদ দিয়ে কোন জিনিস দীন নয়। সুতরাং 'আলেমগণ দীনী কাজ কম বোঝেন' এ মন্তব্য যারা করে তারা নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারার কাজ করে। অনেকে আলেমদের থেকে গা বাঁচানোর জন্য আলেমগণের আপোষের ইখতিলাফ-মতবিরোধকে অজুহাত বানায়। তারা বলে, 'আলেমদেরই তো কত দল! একদল অন্য দলকে দেখতে পারে না। একসঙ্গে একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে আবার এরাই দু'দলে বিভক্ত হয়ে নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে। এক পীর আরেক পীরকে সহ্য করে না। তো আমরা কার কথা মানবো আর কাকে ছাড়বো? এরচে' ভালো সবার থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকা।'
মনে রাখতে হবে, এটাও একটা শয়তানী কুমন্ত্রণা। কারণ আলেমদের মতবিরোধ সাধারণত ব্যবস্থাপনা বিষয়কেন্দ্রিক। এমন মতবিরোধ ইসলামের স্বর্ণযুগেও ছিল। সাধারণ মানুষের দীনের বিষয়ে আমেলগণের এ জাতীয় মতবিরোধের কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া নেই। এ মতবিরোধ অনেকটা কোন বেকারীর দুই মালিকের মতবিরোধের মত, যার পরিণতিতে এক বেকারী দুই বেকারীতে পরিণত হয়; কিন্তু তাতে ভোক্তাদের কোন সমস্যা নেই। উভয় বেকারীর রুটি-বিস্কুট একই মানের। বরং দুই মালিকের প্রতিযোগিতার ফলে এখন তাদের পণ্যের গুণগত মান আগের চেয়েও ভালো।
বস্তুতঃ আলেমগণের মতবিরোধ যদি দীনের খাতিরেই হয় তাহলে তাতে দীনের কাজে গতি আসে, ব্যাপকতা লাভ হয় এবং মানুষের জন্য দীন পাওয়া আরো সহজ হয়। এই মতবিরোধের ব্যাপারেই বলা হয়েছে,
اختلاف العلماء رحمة
অর্থ : আলেমগণের ইখতিলাফ জনগণের জন্য রহমত। আপত্তিকারী শ্রেণীর লোকেরা কি লক্ষ্য করে না যে, আলেমরা ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়সমূহে ইখতিলাফ সত্ত্বেও উম্মতের মৌলিক দীনী বিষয়সমূহে সবসময় একমত। ভণ্ড নবীর বিপক্ষে, নাস্তিক-মুরতাদদের বিপক্ষে, অপসংস্কৃতি ও অপরাজনীতির বিপক্ষে যখনই প্রয়োজন হয় কালবিলম্ব না করে তারা একমঞ্চে একত্রিত হয়ে যায়; যার যার অবস্থান থেকে একই ধরনের কর্মসূচী হাতে নেয়। আলেমরা পরস্পরে পৃথক হওয়ার ফলে কোন পক্ষ জনগণকে ভুল পথে চলতে উৎসাহ প্রদান করেছে এর কি উল্লেখযোগ্য কোন দৃষ্টান্ত আছে? হ্যাঁ, যে ইখতিলাফের মূলে রয়েছে শুধুই ব্যক্তিপূজা বা দলপূজা- তা অবশ্যই ঘৃণ্য ও বর্জনীয় হবে। কিন্তু আল্লাহ তা'আলা যেহেতু ইলমে দীনকে হেফাযত করার দায়িত্ব নিজ যিম্মায় রেখেছেন সেহেতু এ ধরনের ইখতিলাফে লিপ্ত ব্যক্তিরা একসময় কালের স্রোতে বিলীন হয়ে যায়। এ নিয়ে সাধারণ জনগণের দুশ্চিন্তায় থাকার প্রয়োজন নেই। এরা মূলত ‘উলামায়ে সূ' (অসৎ আলেম), এরা আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। জনগণের আরো কিছু দায়িত্ব আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন,
يا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ
অর্থ : হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় করো এবং সাদিকীনদের সঙ্গে থাকো। (সূরা তাওবা- ১১৯ )
অন্যত্র ইরশাদ করেন,
يَاأَيَّتُهَا النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ ‘ ارْجِعِي إِلَى رَبِّكِ رَاضِيَةً مَرْضِيَّةً ‘ فَادْخُلِي فِي عِبَادِي ‘ وَادْخُلِي جَنَّتِي
অর্থ : হে প্ৰশান্ত অন্তর। সন্তুষ্টচিত্তে ও সন্তোষভাজন হয়ে নিজ প্রভুর দিকে ফিরে যাও। অতঃপর আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হও ও আমার জান্নাতে প্রবেশ করে। (সূরা ফাজর- ২৭-৩০)
প্রত্যেক যুগের আলেমগণ হলেন, সাদিকীন ও আল্লাহর নেক বান্দাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। সত্যিকারের আলেমগণ নিজ ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে অধঃপতনের যে স্তরে নামতে পারবেন সাধারণ জনগণের জন্য ব্যক্তিগত মেহনত মুজাহাদা করে সেই স্তরে পৌঁছাও কঠিন হবে।
কাজেই দীনের উপর দৃঢ়ভাবে থাকার স্বার্থে ও পরকালে সহজে জান্নাত লাভের আশায় হক্কানী আলেমগণের সংস্পর্শে থাকতে হবে। ভক্তি-শ্রদ্ধা ও বিনয়ের সাথে আলেমগণের সঙ্গে ওঠাবসার সুযোগ নিতে হবে। কোন বিষয়ে অধিকাংশ আলেম এক পক্ষে আর সাধারণ জনগণ অপর পক্ষ হলে নিঃশর্তভাবে আলেমগণের পক্ষাবলম্বন করতে হবে। বিরোধের কারণ সুস্পষ্টভাবে বোধগম্য না হলেও আলেম পক্ষকে সঠিক মনে করতে হবে। অধিকাংশ আলেম যে বিষয়ে একমত সেটা ভুল হওয়ার আশঙ্কা নিতান্তই কম। পক্ষান্তরে যেদিকে জনসাধারণের সংখ্যা বেশি সেদিকে দু-চারজন আলেম থাকলেও তা সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
আজকাল এমন অনেক ব্যক্তিও আলেমগণের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে যাদের এ সম্পর্ক তাদের দীনী কোন উপকারে আসে না। এর মূল কারণ হলো, আলেমদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ের অভাব। একটি মধুভর্তি বোতল থেকে আরেকটি বোতলে মধু নিতে হলে যেমন কয়েকটি বিষয়ের প্রয়োজন- (ক) বোতলটি খালি ও পরিচ্ছন্ন হওয়া, (খ) খালি বোতলটি মধুভর্তি বোতলের সান্নিধ্যে আসা, (গ) খালি বোতলটি ভরা বোতলের নিচে থাকা। অনুরূপ খোলা ও পরিচ্ছন্ন অন্তর নিয়ে আলেমদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হবে। সম্পর্কটা নিবিড় হতে হবে এবং বিনয়ের সাথে থাকতে হবে। খোঁজ নিয়ে দেখুন, আলেমগণের সাথে ওঠাবসার সুযোগ পেয়েও যাদের জীবনে পরিবর্তন আসে না, তাদের মধ্যে এ উপর্যুক্ত কোন বিষয়ের ঘাটতি অবশ্যই আছে। একদিন একটি ফার্মেসীতে ওষুধ কিনতে গেলাম। এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক সালাম দিয়ে মুসাফাহা করে বললেন, আপনি অমুক মসজিদের খতীব না? আমি তো আপনাকে চিনি। প্রতিউত্তরে আমি একটু হাসলাম। এরপর কোন সৌজন্য কথা ও কোন রকম ভূমিকা ছাড়াই তিনি তর্কের সুরে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা! আপনারা জুম'আর দিনের এই বাংলা বয়ান কোথায় পেলেন? শরীয়তে নির্ধারিত আছে দুই খুতবা, আপনারা দিচ্ছেন তিন খুতবা! বললাম, খুতবার পূর্বে বয়ানের বৈধতা তো শরীয়তে আছে। তিনি বললেন, আমি খুঁজে দেখেছি, কোথাও নেই; বরং এটা একটা বিদ'আত চালু করেছেন আপনারা। আমি বললাম, এ বৈধতার ব্যাপারে তো সকল আলেম একমত। এমন একটি বিষয়ও কি বিদ'আত হতে পারে? তিনি খুব উত্তেজিত হয়ে বললেন, সব আলেমরা কী জানে? আমরা কি পড়াশোনা করি না? আমি বললাম, সুস্থ বিবেকসম্পন্ন লোকের পক্ষে আপনার সঙ্গে তর্ক করা সম্ভব নয়। এরপর বিলম্ব না করে সেখান থেকে সটকে পড়লাম। এবং বেশ অবাক হলাম যে, এমন লোকও আজকাল পাগলা গারদের বাইরে বসবাস করে! বস্তুত আলেমগণ কেউ ভুলের ঊর্ধ্বে নন। কম-বেশি ভুল সকলের মধ্যেই আছে। কিন্তু সাধারণ জনগণের মধ্যে তো সাধারণত ভুলের সংখ্যাই বেশি। আলেমগণের দু'-চারটা ভুলের অজুহাতে গোটা আলেম সমাজকে একহাত নেয়া মূলত চালনী কর্তৃক সুইয়ের একটি ছিদ্র নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা। ফুকাহায়ে কেরামের মতে আলেম সমাজকে নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা ঈমান পরিপন্থী কাজ। কারণ আলেমগণ হলেন হিদায়াতের পাইপ লাইন। তাদেরকে অবজ্ঞা করার অর্থ হলো, হিদায়াতের সূত্র থেকে ছিটকে পড়া। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
عن أبي أمامة، عن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: " ثلاثة لا يستخف بحقهم إلا منافق: ذو الشيبة في الإسلام، وذو العلم، وإمام مقسط
অর্থ : তিন ধরনের মানুষকে একমাত্র মুনাফিক ছাড়া আর কেউ অবজ্ঞা করতে পারে না। (এক) বৃদ্ধ মুসলমান, (দুই) আলেমে দীন এবং (তিন) ন্যায় পরায়ণ শাসনকর্তা। (মু'জামুল কাবীর লিত-তাবারানী; হা.নং ২০২) সুতরাং নিজ ঈমান রক্ষার স্বার্থে আলেম সম্প্রদায়ের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন থেকে বিরত থাকতে হবে।
হ্যাঁ, নির্দিষ্ট কোন আলেমের সঙ্গে জমি- জমা, আত্মীয়তা বা এ জাতীয় কোন ব্যক্তিস্বার্থ নিয়ে ব্যক্তিগত বিরোধ হলে তার হুকুম ভিন্ন হবে। পক্ষান্তরে পাইকারিভাবে আলেমগণের প্রতি অনাস্থা নিশ্চয় অন্তর্গত কঠিন রোগের লক্ষণ । এমন রোগ নিয়ে দু'-চারজন আলেমের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখলেও গোমরাহী থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। হাকীমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানবী রহ. বলেন, পূর্ব-সম্পর্কের কারণে দু'-চারজন আলেমকে শ্রদ্ধা করা আসলে আলেমে দীনকে শ্রদ্ধা করা নয়। আলেমকে শ্রদ্ধা করার অর্থ হলো, ইলমে দীনের কারণে আলেমকে শ্রদ্ধা করা; তার সঙ্গে পরিচয় থাক বা না থাক এবং তার সঙ্গে কোন স্বার্থের সম্পর্ক থাক বা না থাক। আলেম হিসেবে জানতে পারলেই শ্রদ্ধা করলে এবং সম্মান প্রদর্শন করলে বোঝা যাবে যে, সে আসলেই আলেমকে ভক্তি করে এবং ইলমে দীনকে ভালোবাসে। বর্তমানে এমন নিঃশর্ত শ্রদ্ধা ভালোবাসা কিন্তু অনেকের মধ্যেই নেই। এটা সত্যিই আতঙ্কের কথা। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে বোঝার তাওফীক দান করুন। আমীন।
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
পর্দা নারীর আভিজাত্য ও মর্যাদার প্রতীক
দু'টি চিত্র লক্ষ্য করুন। প্রথমটি ইসলামের স্বর্ণযুগের। আর দ্বিতীয়টি তথাকথিত প্রগতি-যুগের। চিত্র-১ খলী...
বালা-মুসীবতের কারণ ও প্রতিকার
মহান রব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন- وَمَا أَصَابَكُمْ مِنْ مُصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَع...
মহিলাদের দীনী শিক্ষার গুরুত্ব ও পদ্ধতি
আল্লাহ তা'আলা মানুষকে ঈমান ও আমলের দায়িত্ব দিয়েছেন। ঈমান ও আমল বিষয়ে জানতে হলে ইলমে দীন হাসিল করা...
তিনটি বড় গুনাহ- বদযবানী, বদনেগাহী, বদগুমানী
মুরাদাবাদ। একটি প্রসিদ্ধ শহর। ভারতের উত্তর প্রদেশের একটি জেলা। এ শহরেই অবস্থিত প্রসিদ্ধ একটি মাদরাসা...