প্রবন্ধ
মহিলাদের দীনী শিক্ষার গুরুত্ব ও পদ্ধতি
আল্লাহ তা'আলা মানুষকে ঈমান ও আমলের দায়িত্ব দিয়েছেন। ঈমান ও আমল বিষয়ে জানতে হলে ইলমে দীন হাসিল করা অপরিহার্য। ইলম বলা হয় কুরআন-হাদীসের কথা এবং মাসআলা-মাসাইল সম্পর্কিত জ্ঞানকে। ইলম না থাকলে আমল করা সম্ভব হয় না। সহীহভাবে মাসআলা-মাসাইল শিক্ষা না করলে সহীহ-শুদ্ধভাবে আমল করা যায় না। আর আমল সহীহ-শুদ্ধভাবে না হলে আল্লাহর নিকট তা গ্রহণযোগ্য হয় না। এ জন্য দীনের প্রয়োজনীয় ইলম হাসিল করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরযে আইন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,طلب العلم فريضة على كل مسلم অর্থ : সকল মুসলমান নর-নারীর উপর ইলম শিক্ষা করা ফরয। (ইবনে মাজাহ; হা.নং ২২৪ )
প্রয়োজন পরিমাণ ইলম বলতে বোঝায়, একজন মানুষের দীনের উপর চলতে যতটুকু জ্ঞান দরকার তা শিক্ষা করা। যেমন ঈমান, আকীদা, নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদির জ্ঞান। সেই সাথে দৈনন্দিন জীবনে যে সব লেনদেন ও কায-কারবার করতে হয় সে সবের মাসআলা-মাসাইল ও নিয়ম-কানুন জানাও ফরয। সুতরাং ব্যবসায়ীর জন্য তার চাকুরী সংক্রান্ত মাসআলা-মাসাইল জানা ফরয। গৃহিণীর জন্য সন্তান প্রতিপালন, স্বামীর খেদমত প্রভৃতির মাসআলা- মাসাইল জানা ফরয। এভাবে প্রত্যেক পেশা ও কর্মজীবির জন্য নিজ নিজ পেশা কর্ম সম্পর্কিত মাসআলা-মাসাইল জানা ফরয। যদি কোন নর বা নারী এসব শিক্ষা না করে তাহলে তার ফরয তরক করার গুনাহ হবে।
দীনী ইলম হাসিল করার ফযীলত
ইলম যেহেতু আমলের বুনিয়াদ এবং তা শিক্ষা করতে মেহনতও হয় তাই ইলম শিক্ষা করার সওয়াবও অনেক বেশি। নফল ইবাদতের চেয়ে ইলম শিক্ষা করার ফযীলত বেশি। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. এবং হযরত আবূ হুরায়রা রাযি. হাদীস বর্ণনা করেছেন, দীনী ইলমের একটি অধ্যায় শিক্ষা করা এক হাজার রাকাআত নফল নামায পড়ার চেয়ে বেশি ফযীলত রাখে। (সুনানে ইবনে মাজাহ; হা. নং ২১৯) কুরআনে কারীমে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন,يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ অর্থ : ‘আল্লাহ তা'আলা প্রত্যেক ঈমানদার ইলমওয়ালার মর্যাদা অনেক উঁচু করে দেন। (সূরা মুজাদালাহ- ১১)
কত উঁচু করে দেন সেটা আল্লাহ তা'আলা বলেননি। হতে পারে তাদের মর্যাদা এত উঁচু করে দেন যা আমাদের কল্পনায়ও আসবে না। তাই সীমা নির্ধারণ না করে বলা হয়েছে অনেক উঁচু করে দেন। ইলমের কারণেই আলেমকে জাহান্নামের উপযুক্ত নাফরমান মুসলমানদের ব্যাপারে সুপারিশ করার ক্ষমতা দেয়া হবে। তাদের সুপারিশে আল্লাহ পাক ঐ পাপীদের নাজাতের ফয়সালা করে দিবেন।
দীনী ইলম হাসিল করার আদব
দীনী ইলম হাসিল করার পূর্বে নিয়ত ঠিক করে নিতে হবে। প্রথমত, এই নিয়ত করবে যে, আমি ইলম মোতাবেক আমল করার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্য ইলম হাসিল করছি। কারণ ইলম অনুযায়ী আমল না করলে ইলমের কোন ফযীলত থাকে না। যাদের ইলম আছে আমল নেই তাদের সম্পর্কে কুরআনে কারীমে বলা হয়েছে,كمثل الحمار يحمل أسفارا. অর্থ : তারা হল ঐ গাধার মত যার পিঠে এক বোঝা কিতাব রয়েছে। দ্বিতীয়ত, গলদ নিয়ত দিল থেকে বের করে দিতে হবে। সুতরাং তর্কে বিজয়ী হতে পারব, জ্ঞানের বড়াই দেখাতে পারব, মানুষের কাছে সম্মান পাব এসব নিয়তে ইলম হাসিল করা যাবে না। হাদীসে ইরশাদ হয়েছে,من طلب العلم ليماري به السفهاء أو ليباهي به العلماء أو ليصرف وجوه الناس إليه فهو في النار অর্থ : যে ব্যক্তি মূর্খদের সঙ্গে তর্ক করা, আলেমদের সাথে অহংকার করা কিংবা নিজের দিকে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করার নিয়তে ইলম শিক্ষা করবে সে জাহান্নামে যাবে। (সুনানে ইবনে মাজাহ; হা.নং ২৫২)
তৃতীয়ত, এই নিয়তে ইলম হাসিল করবে যে, ইলম অর্জন করে তা অপরকে শিক্ষা দিব এবং সে অনুযায়ী আমল করার জন্য অন্যকে দাওয়াত দিব।
দীনী ইলম হাসিল করার পদ্ধতি
সাধারণত তিন তরীকায় ইলম হাসিল করা যায়।
(এক) ইলম হাসিল করার সবচেয়ে উত্তম তরীকা হল, কোন উস্তাদ থেকে ইলম শিক্ষা করা। মেয়েরা বালেগা হলে কোন গাইরে মাহরাম (যার সাথে দেখা দেয়া জায়েয নয়) পুরুষের সামনে গিয়ে ইলম হাসিল করতে পারবে না। এতে ইলম হাসিল করার সওয়াবের পরিবর্তে গুনাহ হবে। বালেগা নারী কোন মাসআলা-মাসাইল শিখতে হলে ভাই, পিতা, স্বামী, পুত্র প্রমুখ মাহরাম ব্যক্তিবর্গ থেকে জেনে নিবে। তাদের জানা না থাকলে তারা কোন আলেম থেকে শিখে এসে তাদেরকে শিখাবে। কোন বিজ্ঞ আলেমা বা মহিলা আলেম পাওয়া গেলে তাদের থেকেও ইলম শিক্ষা করা যাবে।
(দুই) ইলম হাসিল করার আরেকটি পদ্ধতি হল, দীনী কিতাব-পত্র পাঠ করে ইলম হাসিল করা। কিতাব বা বই-পত্র পাঠ করার ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত কয়েকটি কথা মনে রাখতে হবে- দীনী বিষয় শিক্ষা করার উদ্দেশ্যে কোনো কিতাব পাঠ করতে হলে যে কোন কিতাব পেলেই বা যে কোন কিতাবের নাম শুনেই তা পাঠ করা যাবে না। বাজারে ধর্মীয় নামে অনেক ধরণের কিতাব পাওয়া যায়। মনে রাখতে হবে এই সব কিতাবই নির্ভরযোগ্য নয়। তাই যে কোন কিতাব পাঠ করতে হলে সর্বপ্রথম জেনে নিতে হবে সেই কিতাবের লেখক নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি কি না। তিনি হক্কানী বা জ্ঞানী লোক কি না। কোনো অভিজ্ঞ আলেমের নিকট জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে হবে সেই কিতাব সকলের পাঠযোগ্য কি না। নির্ভরযোগ্য নয় এ রকম কিতাব-পত্র পাঠ করলে হেদায়াতের পরিবর্তে গোমরাহী আসতে পারে।
দুনিয়াতে সত্য ধর্ম ইসলাম ছাড়াও বহু বাতিল ধর্ম রয়েছে। সাধারণ মানুষের জন্য সেসব ধর্মের কিতাব- পত্র পাঠ করা জায়েয নয়। যেমন ইয়াহুদীদের তাওরাত, খ্রিস্টানদের ইঞ্জিল বা বাইবেল, হিন্দুদের বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, গীতা ইত্যাদি। শাস্ত্র-বিশেষজ্ঞ না হয়ে এসব গ্রন্থ পাঠ করলে হেদায়াতের পরিবর্তে গোমরাহী আসতে পারে।
দুনিয়াতে অনেক ভ্রান্ত মতবাদে বিশ্বাসী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাদের লিখিত বই-পত্র পাঠ করাও ঠিক নয়। এতেও হিদায়াতের পরিবর্তে গোমরাহী আসতে পারে। অনেকে এসব বই পাঠ করার পক্ষে যুক্তি দিয়ে থাকেন যে, 'আমরা পড়ে পড়ে শুধু ভালোটা গ্রহণ করব আর মন্দটা পরিত্যাগ করব। এতে অসুবিধা কী?' তাদের এ যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ সাধারণ মানুষের মধ্যে দীনী বিষয়ে কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ তা সঠিকভাবে বিচার করার মতো পর্যাপ্ত জ্ঞান নেই। ফলে মন্দটাকে ভালো মনে করে গোমরাহীর শিকার হয়ে যেতে পারে। তাই বিজ্ঞ আলেমা নয় এমন সাধারণ মহিলাদের জন্য এ জাতীয় বই-পত্র পাঠ করা জায়েয নয়।
কিতাব-পত্র পাঠ করে কোনো বিষয় সন্দেহযুক্ত হলে বা অস্পষ্ট মনে হলে কিংবা ভালোভাবে বুঝতে না পারলে বার বার পড়ে সেটা পরিষ্কার করে নিতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো বিষয় পরিষ্কারভাবে বুঝে না আসে ততক্ষণ পর্যন্ত বার বার সেটা পড়তে থাকতে হবে। উস্তাদ থাকলে উস্তাদকে জিজ্ঞেস করে স্পষ্ট করে নিতে হবে। তারপরও বুঝে না আসলে দীনী ইলম সম্বন্ধে বিজ্ঞ আলেম বা আলেমা থেকে বুঝে নিতে হবে। ভালোভাবে না বুঝে সেটা বর্ণনা করা যাবে না।
অনেক মহিলা অশ্লীল উপন্যাস, নভেল, নাটক, পেশাদার অপরাধীদের কাহিনী অথবা অশ্লীল কবিতা পাঠে অভ্যস্ত। এ জাতীয় বই-পত্র পাঠ করা নিষেধ। এসব পাঠ করলে আল্লাহর দেয়া মূল্যবান সময় অপচয় করার গুনাহ হয়। উপরন্তু এতে চরিত্র নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
কারও যদি এসব বই পড়ার নেশা হয়ে থাকে তাহলে যত কষ্টকরই হোক, আল্লাহ তা'আলার ভয়ে মনের চাহিদার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে কিছুদিন তা থেকে বিরত থাকতে হবে। এ জাতীয় বই-পত্রের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে সম্পর্কচ্ছেদ করতে হবে। এগুলো নিজের আশেপাশেও রাখবে না। একেবারে দূরে সরিয়ে দিবে বা পুড়িয়ে ফেলবে। চেষ্টা করে কিছুদিন এভাবে বিরত থাকতে পারলেই মন থেকে এসব পাঠ করার চাহিদা দূর হয়ে যাবে।
পার্থিব জ্ঞান-বিজ্ঞান যেমন: চিকিৎসা বিজ্ঞান, প্রকৌশল বিজ্ঞান, অর্থ বিজ্ঞান, রাষ্ট্র বিজ্ঞান, কৃষি বিজ্ঞান ইত্যাদি শিক্ষা করার বৈধতা-অবৈধতা নিয়তের উপর নির্ভর করে। এগুলো যদি দীনের সহযোগিতা, মানুষের কল্যাণ ও সৃষ্টিজীবের সেবার উদ্দেশ্যে শিক্ষা করা হয় তাহলে তা বৈধ। আর যদি অসৎ পন্থা অবলম্বন ও শোষণ- জুলুমের মাধ্যমে অর্থ হাতানো উদ্দেশ্য হয় তাহলে কুরআন-হাদীসের মূলনীতির আলোকে তা হারাম হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।
উল্লেখ্য, বর্তমানে প্রচলিত সহশিক্ষা ব্যবস্থায় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি হতে হলে মেয়েদের পক্ষে পরপুরুষের সঙ্গে পর্দাহীনভাবে ওঠাবসা ছাড়া সম্ভব হয় না। অথচ পর্দা রক্ষা করা ফরয। পর্দার বিধান রক্ষা না করে এগুলো তো দূরের কথা, শরীয়তে দীনী শিক্ষা অর্জন করারও অনুমতি নেই।
(তিন) ইলম হাসিল করার তৃতীয় পদ্ধতি হল, ওয়ায-নসীহত বা দীনী আলোচনা শুনে ইলম হাসিল করা। তবে কোনো ওয়ায মাহফিলে বা তা'লীমের মজলিসে শরীক হতে গিয়ে পর্দার ব্যাঘাত ঘটলে বা কোনো রকম ফেতনার আশঙ্কা থাকলে সেরূপ ওয়াযের মাহফিলে বা তা'লীমের মজলিসে যাওয়া জায়েয হবে না। মেয়েদের দীনী শিক্ষার জন্য বিভিন্ন স্থানে সৎ, জ্ঞানী, গুণী, নেককার ও পরহেযগার মহিলার মাধ্যমে মহিলা- তা'লীমের মজলিস পরিচালিত হয়ে থাকে। পর্দা রক্ষা করে এরূপ মজলিসে তা'লীম গ্রহণ করতে পারলে অনেক উত্তম। তা'লীম দাতা মহিলা জ্ঞানী না হলে সেখানে না যাওয়া উচিৎ।
ওয়ায়-নসীহতের মজলিস এবং তা'লীমের মজলিস দীনী মজলিস। তাই এরূপ মজলিসে গেলে মজলিসের আদবও রক্ষা করতে হবে।
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
পর্দা নারীর আভিজাত্য ও মর্যাদার প্রতীক
দু'টি চিত্র লক্ষ্য করুন। প্রথমটি ইসলামের স্বর্ণযুগের। আর দ্বিতীয়টি তথাকথিত প্রগতি-যুগের। চিত্র-১ খলী...
আমাদের পরিবারগুলো যেন হয়ে ওঠে নারী-অধিকার ও নারী-মর্যাদা রক্ষার আদর্শ অঙ্গন (একটি সাক্ষাতকার)
...
ফিতনা ফাসাদ থেকে বাঁচতে নারীদের দায়িত্ব-কর্তব্য
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন: (তরজমা) নারী পুরুষের যে কেউ ঈমান অবস্থায় নেক আমল করবে আমি অবশ্যই তাকে শান্...
পুরুষ ও মহিলার নামায পদ্ধতি এক নয়, চার মাজহাবের দলীলসহ পার্থক্য বিস্তারিত আলোচনা
ভূমিকা নারী পুরুষের শারীরিক গঠন, সক্ষমতা, নিরাপত্তা ইত্যাদী নানা বিষয়ে যেমন পার্থক্য রয়েছে, তেমনি পা...