প্রবন্ধ
ঈমানের মেহনত : পরিচয় ও পদ্ধতি
[প্রদত্ত বয়ান থেকে সংগৃহীত]
হামদ ও সালাতের পর..
মুহতারাম হাযেরীন!
আল্লাহ তা'আলা বান্দাদের জন্য চারটি জগত সৃষ্টি করেছেন-
এক. আলমে আরওয়াহ তথা রূহের জগত। এখানে কিয়ামত পর্যন্ত আনেওয়ালা সমস্ত রূহকে একত্র করা হয়েছিলো। তাদের সামনে স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজের রবুবিয়াত ও বড়ত্ব বয়ান করেছিলেন। নিজের বড়ত্ব বয়ান করার পর আল্লাহ তা'আলা সমস্ত রূহকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমি কি তোমাদের রব নই? তখন প্রতিটি রূহ একথা স্বীকার করেছিল যে, কেন হবেন না, অবশ্যই আপনি আমাদের রব। স্বীকারোক্তির এ বিষয়টি আল্লাহ তা'আলা কুরআনে কারীমের সূরা আ'রাফে এভাবে উল্লেখ করেছেন-
وَإِذْ أَخَذَ رَبُّكَ مِنْ بَنِي آدَمَ مِنْ ظُهُورِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَأَشْهَدَهُمْ عَلَى أَنْفُسِهِمْ أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ قَالُوا بَلَى شَهِدْنَا أَنْ تَقُولُوا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِنَّا كُنَّا عَنْ هَذَا غَافِلِينَ
এবং (হে রাসূল! মানুষকে সেই সময়ের কথা স্মরণ করিয়ে দাও) যখন তোমার প্রতিপালক আদম সন্তানদের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের সন্তানদেরকে বের করেছিলেন এবং তাদেরকে তাদের নিজেদের সম্পর্কে সাক্ষী বানিয়েছিলেন (আর জিজ্ঞেস করেছিলেন যে,) আমি কি তোমাদের রব নই? সকলে উত্তর দিয়েছিল, কেন নয়, অবশ্যই আপনি আমাদের রব! আমরা সকলে (এ বিষয়ে) সাক্ষ্য দিচ্ছি। (এ স্বীকারোক্তি আমি এজন্য নিয়েছিলাম) যাতে কিয়ামতের দিন তোমরা বলতে না পার যে, আমরা তো এ বিষয়ে অনবহিত ছিলাম। (সূরা আ'রাফ-১৭২)
এ আয়াত ছাড়াও মুসনাদে আহমাদের ২৪৫৫ ও ২১২৩২ নং হাদীসে এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।
এই যে আমরা আল্লাহর কাছে রূহের জগতে তার রবুবিয়তের কথা স্বীকার করে এসেছিলাম, দুনিয়াতে এসে তা বিস্মৃত হয়েছি, ভুলে গিয়েছি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে পুনরায় সেকথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য আসমান থেকে কিতাব নাযিল করেছেন, আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামকে প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ তা'আলার বড়ত্ব আর রবুবিয়াতের ঐ কথাগুলোই আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম যুগে যুগে মানবজাতিকে শুনিয়েছেন। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমন ও প্রস্থানের মাধ্যমে আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামদের আগমনের ধারাবাহিকতা শেষ হয়েছে। নবীদের অবর্তমানে আল্লাহর বড়ত্ব আর রবুবিয়াতের ঐ কথাগুলো এখন নায়েবে রাসূল, ওয়ারিসে আম্বিয়া উলামায়ে কেরাম আমাদেরকে শোনাচ্ছেন। উলামায়ে কেরাম নায়েবে রাসূল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে মেহরাবে নামায পড়াতেন, তিনি যে মিম্বরে বসে হেদায়াতের কথা বলতেন, কীভাবে জান্নাত পাওয়া যাবে, কীভাবে জাহান্নাম থেকে বাঁচা যাবে তার তরীকা বাতলে দিতেন, উলামায়ে কেরাম সেই মেহরাব ও মিম্বরে বসে নবীজীর সেই কথাগুলোই আমাদেরকে শোনাচ্ছেন। যাই হোক, বলছিলাম এক হলো আলমে আরওয়াহ বা রূহের জগত।
দুই. দ্বিতীয় জগত হলো দুনিয়া। রূহের জগত থেকে আমরা মায়ের পেট হয়ে আরেকটা জগতে এসেছি। সেটা হলো দুনিয়ার জগত। অর্থাৎ আমরা বর্তমানে যেখানে আছি সেই জগত। দুনিয়া মূলত পরীক্ষার জগত। কিন্তু একটা সময় আসবে যখন আমরা এই জগতে থাকবো না। হাদীসে এসেছে, একদিন রাতের বেলা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে বিশেষভাবে তাকীদ দিয়ে বললেন- فإن رأس مائة سنة منها، لا يبقى ممن هو على ظهر الأرض أحد অর্থ: তোমরা যারা আজকে এখানে আছো, একশত বছর পর তোমরা কেউ দুনিয়াতে থাকবে না। (সহীহ বুখারী; হা.নং ১১৬, মুসনাদে আহমাদ; হা.নং ৫৬১৭)
নবীজী এই কথাটি দশম হিজরীতে বলেছিলেন। ঠিক তা-ই হয়েছে। একশত দশ হিজরীর পর কোন সাহাবী দুনিয়াতে ছিলেন না। একশত দশ হিজরীতে সর্বশেষ ইন্তিকালকারী সাহাবী হলেন আবূ তোফায়েল আমের ইবনে ওয়াসিলা কিনানী রাযি.। (আল- ইস্তিআব লি-ইবনে আব্দিল বার ২/৭৯৮)
তিন. তৃতীয় জগত হলো বারযাখ। দুনিয়ার জগতের পরে আরেকটি জগত আসবে। সেটা হলো বারযাখের জগত। এটা দুনিয়া ও আখেরাতের মধ্যবর্তী জগত। অনেক উলামায়ে কেরাম এই জগতকে ওয়েটিং রুম বা প্রতীক্ষা কামরা বলেছেন। আপনি যদি ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাসের টিকেট কিনে থাকেন তাহলে আপনার ওয়েটিং রুমটিও ফার্স্ট ক্লাস হবে। আর যদি সেকেন্ড ক্লাসের টিকেট কিনে থাকেন তাহলে আপনার ওয়েটিং রুমটিও সেকেন্ড ক্লাস হবে। বারযাখের জগতটির এক দিক দুনিয়ার সাথে মিলানো আর আরেক দিক আখেরাতের সাথে মিলানো। দুনিয়ার সাথে মিলানো এর প্রমাণ হলো, আমার কোন পরিচিতি ব্যক্তি যিনি বারযাখের জগতে চলে গেছেন, আমি তার কবরে গিয়ে সালাম করলে সে শুনতে পাবে। আমি তার জন্য তিনবার সূরা ইখলাস পড়লে আল্লাহ পাক তার কাছে এর সাওয়াব পৌঁছে দিবেন। সাওয়াব পেয়ে সে আমাকে চিনতে পারবে।
চার. চতুর্থ জগত হলো আখেরাত। বারযাখের জগত শেষ হলে আরেকটি জগত আসবে। সেই জগতের নাম আখেরাত। আখেরাতের জগত ফল ভোগ করার জগত। দুনিয়া পরীক্ষার জগত, কবর ওয়েটিং রুম আর আখেরাত হলো ফল ভোগ করার জগত। আমরা দুনিয়ার জগতে যে পরীক্ষা দিচ্ছি আখেরাতের জগতে তার ফলাফল ও প্রতিদান দেয়া হবে। কিয়ামতের ময়দানে এই ফলাফল ঘোষণা করা হবে। কুরআনে কারীমের সূরা শূরার ৭ নং আয়াতে আল্লাহ তা'আলা বলেন-
﴿وكَذَلِكَ أوْحَيْنا إلَيْكَ قُرْءانًا عَرَبِيًّا لِتُنْذِرَ أُمَّ القُرى ومَن حَوْلَها وتُنْذِرَ يَوْمَ الجَمْعِ لا رَيْبَ فِيهِ فَرِيقٌ في الجَنَّةِ وفَرِيقٌ في السَّعِيرِ﴾
এভাবেই আমি তোমার উপর নাযিল করেছি আরবী কুরআন, যাতে তুমি সতর্ক কর কেন্দ্রীয় জনপদ (মক্কা) ও তার আশপাশের মানুষকে এবং সতর্ক কর সেই দিন সম্পর্কে, যে দিন সকলকে একত্র করা হবে, যে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। একদল যাবে জান্নাতে এবং একদল প্রজ্বলিত আগুনে।
যাই হোক, উলামায়ে কেরামের জবানে, হায়াতের এই চার স্তরের কথা আমরা বারবার শুনেছি। এটা বিশ্বাস করা জরুরী। এটা ঈমানের জরুরী অংশ। এর কোন একটা জগতকে অবিশ্বাস বা অস্বীকার করলে ঈমান থাকবে না। মুমিন হওয়ার জন্য ঈমানের সবগুলো কথা মানা এবং বিশ্বাস করা জরুরী। কিন্তু ঈমানহারা হওয়ার জন্য সবগুলো কথা অবিশ্বাস করা জরুরী নয়; কোন একটি কথা বা বিষয় অবিশ্বাস করলে বা সন্দেহ করলেই ঈমানহারা হয়ে যাবে, কাফেরের কাতারে চলে যাবে এবং ইসলামের সঙ্গে তার কোন সংশ্লিষ্টতা থাকবে না। আল্লাহ তা'আলা রূহের জগত থেকে সরাসরি মানুষকে জান্নাত বা জাহান্নামে পাঠাতে পারতেন কিন্তু তিনি তা করেননি। কারণ আল্লাহ তা'আলা চান আমাদেরকে দিয়ে সরেজমিনে কাজ করিয়ে তারপর যার যার কাজ অনুযায়ী জান্নাত বা জাহান্নামে পাঠাবেন। এর হিকমত হলো, যদি আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কাউকে সরাসরি জান্নাতে বা জাহান্নামে পাঠিয়ে দিতেন তাহলে কাফেরদের আপত্তি করার একটা সুযোগ মিলে যেতো। তারা হয়তো বলতে পারতো, হে আল্লাহ! আপনি যদি আমাদেরকে একবার দুনিয়াতে পাঠাতেন তাহলে আমরা ঈমান এনে অনেক বেশী দীনের কাজ করতাম। কিন্তু আপনি তো আমাদেরকে রূহের জগত থেকে সরাসরি জাহান্নামে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমাদের কোন সুযোগই দেননি! আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কাফের-মুশরিকদের এজাতীয় আপত্তি তোলার সুযোগ না রাখার জন্য সকলকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। ফলে এখন আর কেউ ঈমান না এনে, ঈমান-আমলের মেহনত না করে জাহান্নামী হলে আপত্তি করতে পারবে না। এ প্রসঙ্গে কুরআনে কারীমের সূরা বনী ইসরাঈলের ১৪ নং আয়াতে আল্লাহ তা'আলা বলেন- اقْرَأْ كِتَابَكَ كَفَى بِنَفْسِكَ الْيَوْمَ عَلَيْكَ حَسِيبًا অর্থ: (বলা হবে,) তুমি নিজ আমলনামা পড়। আজ তুমি নিজেই নিজের হিসাব নেওয়ার জন্য যথেষ্ট। (সূরা বনী ইসরাঈল-১৪)
অর্থাৎ, কেমন যেন আল্লাহ তা'আলা বান্দার বিচার করার আগে তাকে বলবেন, বান্দা! তুমি নিজেই নিজের বিচার করো আর দেখো, তুমি কোন প্রতিদানের উপযুক্ত, জান্নাতের না জাহান্নামের? আমলনামা দেখে বান্দা নিজেই বুঝতে পারবে যে, সে আসলে কিসের উপযুক্ত।
মুহতারাম হায়েরীন! এজন্য সব সময় একথা খেয়াল রাখতে হবে যে, আল্লাহ তা'আলা দুনিয়ার এ জগতে আমাদেরকে পরীক্ষা নেয়ার জন্য পাঠিয়েছেন। পরীক্ষার ক্ষেত্রে আল্লাহ তা'আলা আমাদের জন্য দু'টি পথ সৃষ্টি করেছেন। একটি হলো শোকরগুজারীর পথ অর্থাৎ জান্নাতের পথ। আরেকটি হলো না-শোকরির পথ অর্থাৎ জাহান্নামের পথ। কুরআনে কারীমে আল্লাহ তা'আলা বলেন-إِنَّا هَدَيْنَاهُ السَّبِيلَ إِمَّا شَاكِرًا وَإِمَّا كَفُورًا আমি তাকে (মানুষকে) পথ দেখিয়েছি, হয় সে কৃতজ্ঞ হবে অথবা হবে অকৃতজ্ঞ। (সূরা দাহর-৩)
মানুষ জন্মের পর থেকে অনেক কিছু দেখে। এই দেখার কারণে তার কলবের মধ্যে ইয়াকীন পয়দা হয়। কলব হলো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের রাজা। আর বাকী অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হলো কলবের প্রজা। কলবের মধ্যে যে কথার ইয়াকীন পয়দা হয় ঐ কথার উপর আমল করার জন্য কলব (রাজা) বাকী অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে (প্রজাদেরকে) হুকুম দেয়। উদাহরণত মানুষ দেখে, জমিন থেকে ফসল হয়। বড় চাকরিওয়ালা ২/৩ লাখ টাকা বেতন পায়। মিল-ফ্যাক্টরির মালিকগণ দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ায়। বেশি মালওয়ালা হলে বেশি সম্মান পাওয়া যায়, ইত্যাদি। তো এই দেখার উপর বিশ্বাস করেই মানুষ উদয়াস্ত কাজ-কর্ম করে, মেহনত করে করে ঘাম ঝরায়। কুরআনে কারীমের সূরা আলে ইমরানের ১৯৬ নং আয়াতে আল্লাহ তা'আলা মুমিন বান্দাদেরকে এই দেখা জিনিসের উপর ইয়াকীন করা থেকে সাবধান করেছেন যে, কাফেররা যে সারা দুনিয়া চষে বেড়াচ্ছে তা দেখে ধোঁকা খেয়ো না। কারণ এর মধ্যে কোন কামিয়াবী নেই। আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন- لا يَغُرَّنَّكَ تَقَلُّبُ الَّذِينَ كَفَرُوا فِي الْبِلادِ (অর্থ:) যারা কুফর অবলম্বন করেছে, দেশে দেশে তাদের (সাচ্ছন্দ্যপূর্ণ) বিচরণ যেন তোমাকে কিছুতেই ধোঁকায় না ফেলে। (সূরা আলে ইমরান-১৯৬)
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষের কলবের ইয়াকীনকে সহীহ করার জন্য লক্ষাধিক নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। আমাদের উচিত, আমাদের কলবের মধ্যে দেখা জিনিসের যে ইয়াকীন আছে, আল্লাহ তা'আলার হেদায়াত ও নবীদের দাওয়াত অনুযায়ী তা দূর করে আল্লাহ তা'আলা থেকে হওয়ার ইয়াকীন পয়দা করা।
কলব দ্বারা করণীয় বিষয়কে বলে ঈমান আর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা করণীয় বিষয়কে বলে আমল। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কলবের অনুগত। রাজা ঠিক হয়ে গেলে প্রজা সহজেই ঠিক হয়ে যায়। এজন্যই নবীয়ে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
ألا إن في الجسد مضغة إذا صلحت صلح الجسد كله، وإذا فسدت فسد الجسد كله. ألا وهي القلب
অর্থাৎ তোমার শরীরে একটি গোশতের টুকরো আছে। এটি ঠিক হয়ে গেলে তোমার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ঠিক হয়ে যাবে। মনে রেখো, ঐ গোশতের টুকরোটি হল কলব বা অন্তর। (আসসুনানুল কুবরা লিল-বাইহাকী; হা.নং ১০৪০০)
সুতরাং কলব ঠিক করার জন্য মেহনত করতে হবে। কলব ঠিক হয়ে গেলে কঠিন থেকে কঠিন কাজ এমনকি সারা জীবনের অভ্যাসও সহজে ছেড়ে দেয়া যায়। উদাহরণত ইসলামে হুট করে প্রথমবারেই মদ নিষেধ করা হয়নি। এটা করা হয়েছে ২/৩ ধাপে। প্রথম ধাপগুলো ছিল কলবের প্রস্তুতিমূলক। অতঃপর যখন কলব ঠিক হয়ে গেলো তো 'নিষেধ' বলার সাথে সাথেই সাহাবায়ে কেরাম তা ছেড়ে দিয়েছেন। (মুয়াত্তায়ে ইমাম মালেক; হা.নং ৭১৫, মুসনাদে আহমাদ; হা.নং ১৩৩৭৬)
সুতরাং আমাদেরকে কলবের পেছনে মেহনত করে এই ইয়াকীন মজবুত করতে হবে যে, আমরা যা দেখি তা গলদ, ধোঁকা। আমাদের দেখা জিনিসের পেছনে একটা শক্তি কাজ করছে। সেই শক্তির নাম হলো, খালিক, মালিক, রব্ব, আল্লাহ। আল্লাহ রব্বুল আলামীন বিভিন্ন আসবাবের মাধ্যমে নিজের শক্তিকে প্রকাশ করছেন মাত্র। আসল শক্তি তো একমাত্র আল্লাহর। যেমন আমি দেখি, পিয়ন আমাকে টাকা এনে দিচ্ছে। কিন্তু এই দেখাটাই কি আসল সত্য, না আমার প্রবাসী ছেলে পিয়নের মাধ্যমে আমাকে টাকা পাঠাচ্ছে? ঠিক তেমনি চাকরী, ব্যবসা, জমি-জিরাত এগুলো আল্লাহর পিয়ন। আল্লাহ রব্বুল ইজ্জত এই পিয়নদের মাধ্যমে আমাদের রিযিক পৌঁছাচ্ছেন। চাকরি চলে গেলে, ব্যবসা নষ্ট হয়ে গেলে আমরা হতাশায় মুষড়ে পড়ি। না, হতাশ হওয়ার দরকার নেই; এক পিয়ন চলে গেছে তো কি হয়েছে, আল্লাহ রব্বুল আলামীনের নিয়োজিত এমন হাজারো পিয়ন এখনো রয়ে গেছে; আল্লাহ অন্য পিয়নের মাধ্যমে আমার রিযিক পৌঁছাবেন, ইনশাআল্লাহ। হাদীসে এসেছে, আমাদের মৃত্যু আমাদেরকে যে পরিমাণ তালাশ করে, আমাদের রিযিক আমাদেরকে তার চেয়ে বেশী পরিমাণে তালাশ করে। (শুআবুল ঈমান লিল- বাইহাকী; হা.নং ১১৪৭)
এখন জানার বিষয় হলো, কলবের ইয়াকীন সহীহ করার তরীকা বা পদ্ধতি কী?
আল্লাহ পাক প্রতিটি জিনিস হাসিল করার একটা নেযাম বা তরীকা রেখেছেন। কেউ যদি চায় তার সন্তান নেককার হোক তাহলে তাকে নেককার মহিলা বিয়ে করতে হবে, নিজে নেককার হতে হবে। কেউ নিজে নেককার না হয়ে, নেককার মহিলা বিয়ে না করে নেক সন্তান আশা করলে এটা হবে মিথ্যে আশা। সব কাজেরই নিয়ম-নেযাম আছে। এক নেযাম দিয়ে আরেক কাজ নেয়া যায় না। ভাত বানানোর নেযাম দিয়ে মুড়ি বানানো যায় না। ঠিক তেমনি আল্লাহর পাক যাত থেকে হওয়ার ইয়াকীন সহীহ করার জন্য আল্লাহ একটা নেযাম রেখেছেন। সেটা হলো কলবের উপর মেহনত। আমরা যে দাওয়াত ও তাবলীগের নামে মেহনত করছি, এটাও কলবের উপর মেহনত। আমরা এই মেহনত বাহ্যিকভাবে তো করবো আরেকজনের উপর কিন্তু নিয়ত থাকবে প্রথমে যেন নিজের কলব ঠিক হয়ে যায়, নিজের ঈমান-ইয়াকীন মজবুত হয়ে যায়। এরপর দ্বিতীয় নিয়ত থাকবে, যে ভাইয়ের পেছনে মেহনত করা হচ্ছে তার কলবও যেন ঠিক হয়ে যায়।
আমাদেরকে গোটা উম্মতে মুহাম্মাদিয়াকে সামনে রেখে মেহনত করতে হবে। সকলের হেদায়াতের জন্য মেহনত করতে হবে। নবীয়ে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিলের তামান্না ছিল, তাঁর সকল উম্মত যেন জাহান্নাম থেকে বেঁচে জান্নাতের উপযুক্ত হয়ে যায়। কুরআনে কারীমে আল্লাহ তা'আলা মুনাফিকদের ব্যাপারে আয়াত নাযিল করলেন- (অর্থ:) 'আপনি যদি ৭০ বারও তাদের জন্য মাগফিরাত কামনা করেন, আমি (আল্লাহ) তাদেরকে মাফ করবো না।' হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে বললেন, আয়াতে বর্ণিত ৭০ যদি ৭০ সংখ্যা বোঝাতো, অর্থাৎ, ৭১ বার মাফ চাইলে আল্লাহ মুনাফিকদেরকে মাফ করে দিতেন, তাহলে তাদের নাজাতের জন্য আমি ৭১তম বারও আল্লাহর কাছে মাফ চাইতাম। কিন্তু এই ৭০ তো সংখ্যা বোঝাচ্ছে না, বোঝাচ্ছে আধিক্য। অর্থাৎ ৭০ কেন, যত হাজার বারই মাফ চাওয়া হোক, তাদেরকে মাফ করা হবে না। (মুসনাদে আহমাদ; হা.নং ৯৫, সহীহ বুখারী; হা.নং ১৩৬৬)
বোঝা গেল, উম্মতের ব্যাপারে নবীজীর মনের আবেগ এই ছিল যে, হোক সে মুনাফিক-সর্দার, কিন্তু শেষতক আমারই তো উম্মত! সে জান্নাতে গেলে আমার ক্ষতি কী! মোটকথা, মুমিন, কাফের, মুনাফিক, মুশরিক সবাই রাসূলের উম্মত। এজন্য বিধর্মীদের হেদায়াতের ব্যাপারে আমাদেরকে ফিকির করতে হবে, যেন তারাও জান্নাতে যেতে পারে। তবে তাদের ব্যাপারে ফিকির করার দায়িত্ব দ্বিতীয় স্তরে। প্রথম স্তরে ফিকির করতে হবে নিজের ও অপরাপর মুসলমানের ব্যাপারে। আমার ঈমান কীভাবে শিরকমুক্ত হয়, আমার কলবের ইয়াকীন কীভাবে ঠিক হয়ে যায়-এই নিয়তে অন্যের পেছনে মেহনত করতে হবে। ফুটবল দেয়ালে ছুঁড়ে মারলে যেমন ছুঁড়ে দেয়া ব্যক্তির কাছে ফিরে আসে ঠিক তেমনি আমরা অন্য ভাইয়ের কলবের পেছনে মেহনত করতে থাকবো, আর আল্লাহ আমার কলব ঠিক করে দিবেন। যার পেছনে মেহনত করছি সে হেদায়াত পাক না পাক, আল্লাহ আমাকে হেদায়াত দান করবেন, ইনশাআল্লাহ। হেদায়াত দানের দায়িত্ব একমাত্র আল্লাহর হাতে। কোন নবী রাসূলের হাতে হেদায়াতের দায়িত্ব দেয়া হয়নি। যদি হতো তাহলে নূহ আলাইহিস সালামের ছেলে, লূত আলাইহিস সালামের স্ত্রী, ইবরাহীম আলাইহিস সালামের পিতা, আমাদের নবীজীর চাচা হেদায়াতবিমুখ হতেন না, গোমরাহ হতেন না। হ্যাঁ, নবী- রাসূলগণের যিম্মাদারী হেদায়াতের দিকে ডাকা, সত্যের প্রতি আহ্বান করা। কে সেই ডাকে সাড়া দিবে আর কে হক কবুল করবে এই ফায়সালা একমাত্র আল্লাহর যিম্মায়।
দাওয়াতের লাইনে মেহনত করলে ঈমান মজবুত হয়। এমন মজবুত হয় যে, বিভিন্ন বালা-মুসীবতেও তার ঈমান নষ্ট হয় না। আমাদের কারো কারো ঈমান তো কচুপাতায় রাখা পানির মতো নড়বড়ে। একটু ব্যতিক্রম পরিস্থিতি হলেই ঈমান নড়বড়ে হয়ে যায়। এক শ্রেণীর শয়তান আছে যাদের কাজই হলো মুমিনের ঈমান বিনষ্ট করা। সুতরাং শয়তানের ধোঁকা ও প্রতারণা থেকে খুব সাবধান থাকতে হবে।
আল্লাহ তা'আলা সময় সময় আমাদের ঈমানের পরীক্ষা নেবেন। সামান্য একটা মাটির হাড়িও আমরা ১০ বার পরীক্ষা করে ক্রয় করি। একটা কাপড় কিনতে গেলে কত যাচাই বাছাই করতে থাকি। আর আল্লাহ আমাদেরকে তার পেয়ারা ও আপন করার আগে একটু দেখে নিবেন না, একটু বাজিয়ে দেখবেন না? অবশ্যই করবেন এবং এটাই স্বাভাবিক। এসব পরীক্ষার মাধ্যমে আল্লাহ দেখবেন, আমরা বিপদে পড়ে তাঁরই পথে থাকি, নাকি অন্য দিকে চলে যাই। দুনিয়াদাররা বিপদে পড়লে মন্ত্রীর কাছে ধর্ণা দেয়, ডাক্তারের কাছে দৌড়ায়। আর মুমিন কোন বিপদে পড়লে আল্লাহর দিকে দৌড়ায়। কুরআনে কারীমে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন-
وَلَقَدۡ فَتَنَّا ٱلَّذِینَ مِن قَبۡلِهِمۡۖ فَلَیَعۡلَمَنَّ ٱللَّهُ ٱلَّذِینَ صَدَقُوا۟ وَلَیَعۡلَمَنَّ ٱلۡكَـٰذِبِینَ
(অর্থ:) অথচ তাদের পূর্বে যারা গত হয়েছে তাদেরকেও আমি পরীক্ষা করেছি। সুতরাং আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন, কারা সত্যনিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছে এবং তিনি অবশ্যই জেনে নেবেন, কারা মিথ্যাবাদী। (সূরা আনকাবুত-৩)
মোটকথা, আল্লাহ আমাদের ঈমানের পরীক্ষা নেবেন। ঈমানের এই পরীক্ষায় পাশ করতে হলে দাওয়াতের লাইনে মেহনত করতে হবে। ঈমান বাড়ানোর যে মেহনত তা হলো দাওয়াতের লাইনে মেহনত। এর জন্য এটাই নেযাম। যত বড় আলেম হোক তাকেও ঈমানের মেহনত করতে হবে,
আবার গরীব মজদুরকেও ঈমানের মেহনত করতে হবে। একজন শাইখুল হাদীস সাহেবও যদি ঈমানী মেহনত না করে তাহলে তার ঈমানী মৃত্যুর নিশ্চয়তা নেই। আবার অশিক্ষিত, গরীব দিনমজুর যদি ঈমানের মেহনত করে, তার ঈমান নিয়ে দুনিয়া থেকে যাওয়ার নিশ্চয়তা আছে। নিজ নিজ সীমানা ও গণ্ডিতে সামর্থ্য অনুযায়ী এই মেহনতকে ফরযে আইন করা হয়েছে। আর সারা দুনিয়াবাসীর প্রতি দীনের দাওয়াত পৌঁছানো ফরযে কিফায়া করা হয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম রাযি. রাসূলের আনীত দীনকে সারা দুনিয়ার সকল মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য অনেক কুরবানী করেছেন। এই মেহনতের একটা অন্যতম দাবী হলো কুরবানী পেশ করা। আমাদেরকেও এই মেহনতকে সামনে রেখে কুরবানী পেশ করতে হবে। সাহাবীদের তুলনায় আমাদের কুরবানী তো কিছুই না। সাহাবায়ে কেরাম তো বিবি-বাচ্চা, ঘর- বাড়ি সব কিছুর কুরবানী করেছেন। পক্ষান্তরে আমাদেরকে তো সবকিছু ঠিক রেখে দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনতে মাত্র চল্লিশ দিন, ৩ চিল্লা লাগাতে বলা হচ্ছে। আমাদেরকে নিজ নিজ ব্যবসা-বাণিজ্য ঠিক রেখে এই মেহনত করতে বলা হচ্ছে। সুতরাং এর জন্য আমরা সবাই খুশি খুশি তৈরী হই। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তার দীনের মেহনতের জন্য ভরপুর কবুল করুন, আমীন।
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
মহিলাদের দীনী শিক্ষার গুরুত্ব ও পদ্ধতি
আল্লাহ তা'আলা মানুষকে ঈমান ও আমলের দায়িত্ব দিয়েছেন। ঈমান ও আমল বিষয়ে জানতে হলে ইলমে দীন হাসিল করা...
আলোকময় কুরআন
আজ জুমু'আর দিন। এ দিনে সূরা কাহাফ তিলাওয়াতের বিশেষ ফযীলত রয়েছে। এটা পনের পারায় শুরু হয়ে ষোল পারায় শে...
শরয়ী বিধানে প্রাণীর ছবি (পর্ব দুই)
ইমাম নববী রহ.বলেন, قال الزهري: النهي في الصورة على العموم وكذلك استعمال ما هي فيه ইমাম যুহরী রহ. বলে...
সরল পথ ও বাঁকা পথ
ক. আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন, واعْتَصِمُوا يحبل الله جَمِيعًا এবং তোমরা ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রশিকে ধর...