প্রবন্ধ

চারিত্রিক অবক্ষয়ের শিকার তরুণ প্রজন্ম : সুরক্ষায় করণীয়

লেখক:মুফতী আব্দুল হান্নান হাবীব
২২ জানুয়ারী, ২০২২
৩৬০২ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, প্রতিটি শিশু স্বভাবজাত সুন্দর মানসিকতা তথা ইসলামী আদর্শের ওপর জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু পরে তার পিতা-মাতা তাকে খ্রিস্টান বানায় বা অগ্নিপূজক বানায় বা ইয়াহুদী বানায়। (সহীহ মুসলিম; হা.নং ২৬৫৮)

হাদীসের মর্ম অনুযায়ী বলা যায়, আমাদের আজকের তরুণ-যুবকেরাও ইসলামী স্বভাব ও সুন্দর মন-মানসিকতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিল। তাদের হৃদয়ও ছিল নিষ্কলুষ-পবিত্র। তাদের মধ্যেও ছিল ঈমান, সততা, আমানতদারী ও বিশ্বস্ততা। তারাও নিজ নিজ মানসে ধারণ করতো বিনয়, ন¤্রতা, ভদ্রতা ও শালীনতার গুণ। আত্মত্যাগ, পরোপকার, উন্নত নৈতিকতা, মানবকল্যাণ, ও দেশপ্রেমসহ সকল সৎ গুণাবলী তাদেরও কাক্সিক্ষত ছিল। কিন্তু আজ গোটা পৃথিবী জুড়ে তারুণ্যের সঙ্কট প্রচÐ উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজ, সংসার, মানবিকতা বড় কঠিন হয়ে পড়েছে। চারিদিকে কপটতা, মিথ্যা, হীনতা ও প্রবঞ্চনা। প্রতিনিয়ত ক্রমবর্ধমান হতাশা ও অস্থিরতার শিকার পুরো তরুণ সমাজ। মদ, গাঁজা, হেরোইন, ফেন্সিডিল, আফিম, পেথিড্রিন ও মরণনেশা ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য গ্রহণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে তারা। ফলে সমাজে খুন, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, রাহজানি, আত্মসাৎ, বেহায়াপনা, অশ্লীলতার সয়লাব বয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে দিন যতই যাচ্ছে ততই নৈতিকতার অবক্ষয়ের মাত্রা বেড়েই চলছে আর তরুণ যুবসমাজও তিলে তিলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। শুধু অভাব, দারিদ্র বা বেকারত্বই নয়; প্রাচুর্যের মধ্যে থেকেও তরুণদের মনে সৃষ্টি হচ্ছে অতৃপ্তি ও চরম শূন্যতা। মোটকথা, তারুণ্যের নৈতিক অবক্ষয়, পদস্খলন ও অধঃপতন জাতীয় ঐতিহ্য, মূল্যবোধ ও নৈতিকতার এ বিপর্যয় দেশের আবহমান সামাজিক, সংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধকেও সর্বগ্রাসী অবক্ষয়ের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে। যা নিয়ে গোটা দেশ ও জাতি অস্থির, চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন।

তরুণ ও যুব সমাজের অবক্ষয়, পদস্খলন ও এ অধপতনের কারণ অনেক। সবগুলোর আলোচনা এ ছোট্ট নিবন্ধে একত্র করাও অসম্ভব। তবে নি¤েœ মারাত্মক কিছু অবক্ষয়ের কারণ ও তার পরিণতির কথা উল্লেখ করবো।

ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী না হয়ে ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদ ও নাস্তিক্যবাদে বিশ্বাসী হওয়া

ধর্ম নিরপেক্ষতা বলতে যদিও বুঝানো হয় কিছু নির্দিষ্ট প্রথা বা প্রতিষ্ঠানকে ধর্ম বা ধর্মীয় রীতিনীতির বাইরে রেখে পরিচালনা করা। কিন্তু উপমহাদেশে ধর্ম নিরপেক্ষ মতবাদ মূলত ইসলাম ধর্মে নেই এমন ত্রæটি বের করে মানুষকে ইসলাম বিমুখ করার প্রচেষ্টাকেই বুঝায়। এ মতবাদ অনুযায়ী ‘সরকার কোনরূপ ধর্মীয় হস্তক্ষেপ করবে না, কোন ধর্মীয় বিশ্বাসে বিশ্বাসী হবে না এবং কোন ধর্মকেই বিশেষ কোন মর্যাদা বা সুবিধা প্রদান করবে না’ বলা হলেও সর্বদাই দেখা যায় রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশেষ একটি মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায়ে মানুষকে ইসলামী অনুশাসন পালনে নিরুৎসাহিত করা হয়। বিধি বিধান পালনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী ও ইসলামী অনুশাসন যারা মানতে চায় তাদেরকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করে কোণঠাসা করে রাখা হয়। বিশেষ করে ধর্মহীন শিক্ষা কারিকুলাম প্রণয়ন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও চাকুরীর ক্ষেত্রে আইনী বাঁধার সৃষ্টি করে তাদের অধিকার খর্ব করা হয়। যার ফলে রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধার লোভে একশ্রেণীর অসাধু সমাজপতি বুদ্ধিজীবি, শিক্ষিত পÐিতরা নিজ পরিমÐলে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, ছাত্র ও তরুণ সমাজে ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীনতা ও নাস্তিক্যবাদ প্রতিষ্ঠার জন্যে জীবনকে শেষ করে দিচ্ছে। আর ছাত্র ও তরুণ সমাজ খোদাভীতি, ধর্মীয় শিক্ষা, নৈতিক ও চারিত্রিক প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়ে রিপু আর প্রবৃত্তির অসৎ চাহিদাগুলো পূরণ করাই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য মনে করছে। এটাই স্বাভাবিক যারা পাপ-পূণ্য, ইহকালীন-পরকালীন জবাবদিহিতার চিন্তা থেকে মুক্ত দুনিয়ার জীবনকেই একমাত্র জীবন বলে বিশ্বাস করে তাদের দ্বারা সমাজের অবক্ষয় ও অধপতন অনিবার্য তা সহজেই অনুমেয়। যার দরুণ আমাদের এ তরুণ সমাজ আজ অধপতন ও অবক্ষয়ের নির্মম শিকার। তাই শিশু-কিশোরদের বর্তমান যান্ত্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে আবদ্ধ না রেখে ঐশী তথা ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করা প্রয়োজন। তাদের মাঝে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের প্রসার ঘটাতে না পারলে এই অধপতন ও অবক্ষয় থেকে রক্ষা পাওয়া অসম্ভব।

সর্বনাশা মাদক ও নেশার সয়লাব

তরুণ ও যুব সমাজের সংকট-সমস্যার অন্যতম কারণ মাদক ও নেশার সয়লাব। ইসলামে সর্বপ্রকার মাদক নিষিদ্ধ হলেও ধর্মীয় মূল্যবোধ হারিয়ে যুব সমাজ মাদকের মরণ নেশায় মেতে উঠছে। বর্তমান সময়ে অধিকাংশ যুবক মাদকাসক্ত হয়ে অবলীলায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। মাদক এতো ভয়ানক আকার ধারণ করছে যার ভয়ানক প্রভাব ও বিস্তার লক্ষ্য করা যায় আমাদের মানুষ গড়ার আঙ্গিনা শিক্ষাঙ্গনগুলোতেও। যা যুব সমাজের জন্য এক ভয়ানক পরিণতি ও অশনি সংকেত।

কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা ও মানবাধিকার সংগঠনের জরিপে দেখা গেছে বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত শিশুদের শতকরা নব্বই জনই মাদকসেবী। ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইন ও ইয়াবার মতো মরণ নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে তারা। প্রতিনিয়ত শিশু, মহিলা, কিশোরীরাও মাদক বহন, সেবন করে জড়িয়ে পড়ছে অনৈতিক কার্যকলাপে। অর্থ ও রোমাঞ্চের মোহে প্রতিদিন ১০/১২ বছরের শিশু-কিশোর, সমাজের দরিদ্র শ্রেণীর মেয়েরা লেখা-পড়া বাদ দিয়ে সম্পৃক্ত হচ্ছে ইয়াবা, ফেনসিডিল ইত্যাদি জীবন ধ্বংসকারী মাদক বহন এবং সেবনের সাথে। পত্রিকায় এসেছে, অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, ঢাকা নগরীতে প্রতিদিন ১৪ লাখ ইয়াবার চাহিদা, চট্টগ্রাম মহানগরতীতে ৮ লাখ আর কক্সবাজারে ৪ লাখ ইয়াবার চাহিদা। কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যানুযায়ী প্রতি ওয়ার্ডে ২০০ এর বেশি ইয়াবা ব্যবসায়ী রয়েছে। (তথ্য : স.ংড়সবযিবৎবরহনষড়ম.হবঃ)

দৈনিক ঢাকা রিপোর্টের তথ্যানুযায়ী শুধুমাত্র ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে যেখানে ১,২৯,৬৪৪টি ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করে ৩৫০জন আসামীর বিরুদ্ধে ২৩৩টি মামলা হয়েছিল। সেখানে ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে ২৮,২১,৫২৮টি ট্যাবলেট উদ্ধার করে ২,২৫৯জন আসামীর বিরুদ্ধে ১,৬৫৪টি মামলা হয়েছে। ২০১০, ২০১১ ও ২০১২ খ্রিস্টাব্দে যথাক্রমে ৮১২৭১৬, ১০৭৬১২৫ ও ২১৩৪৩৯৫টি ট্যাবলেট উদ্ধার করে ৯৫১, ২৩৯৪ ও ২৯৫৮জন আসামীর বিরুদ্ধে ৬২৯, ১৬৪৪ ও ২০৫৩টি মামলা দায়ের করা হয়। এ পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় সহজেই বুঝা যায় যে, আমাদের দেশে মাদকের কি সয়লাব বয়ে যাচ্ছে। আর এ কারণেই আমাদের সোনালী ভবিষ্যত তরুণ প্রজন্ম মাদকের এ সয়লাবে বানের পানির মত ভেসে যাচ্ছে। ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে পরিবেশ পরিস্থিতি। মাদকাসক্ত ভাই খুন করছে ভাইকে, নিরাপদ নয় ভাইয়ের হাতে বোন, স্বামীর হাতে খুন হচ্ছে নিরাপরাধ স্ত্রী, কন্যা জবাই করছে মা-বাবাকে। ভেঙ্গে পড়ছে সামাজিক শৃঙ্খলা, প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক স্থিতিশীলতার উপর। শ্লথ হয়ে আসছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন। তো এ পরিস্থিতির উত্তরণের জন্য এক কথায় ইসলামী মূল্যবোধ ও ইসলামী অনুশাসন মেনে চলার কোনই বিকল্প নেই।

অনিয়ন্ত্রিত ইন্টারনেট, ফেসবুক ও টুইটারের অপব্যবহার

ইন্টারনেট মানেই অনলাইন। সভ্যতার এ যাত্রাকে আমরা ‘ডিজিটাল বাংলা’ বলে চিত্রিত করেছি। সরকারী ঘোষণা অনুযায়ী হয়তো ২০২১ খ্রিস্টাব্দে এর পূর্ণতা পাবে।

নিউজ বিডির তথ্যানুসারে ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসের হিসেব মতে তখন পৃথিবীর ২৪০ কোটি ৫৫ লাখ ১৮ হাজার ৩৭৬ জন মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করতো। এর শতকরা ৪৪ ভাগই এশিয়ার। বাংলাদেশের অবস্থাও দুনিয়ার অন্যান্য দেশ হতে ভিন্ন নয়। এ দেশে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রæয়ারী মাসে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৬১ লাখ ২৮ হাজার ৫৯২, যার সিংহভাগই তরুণ-তরুণী। আর ইন্টারনেট ব্যবহারকারী প্রতিটি মানুষই প্রায় কমবেশি অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে থাকে। বিশ্বে সবচেয়ে বড় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে অন্যতম আলোচিত বিষয় এখন ফেসবুক। যাকে সময়ের যাদুকরী প্রযুক্তিরূপে আখ্যায়িত করা হয়। ফেসবুক ব্যবহার প্রথম দিকে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে তা শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে নির্বিশেষে সব বয়সের নারী-পুরুষের মধ্যে দ্রæত বিস্তার লাভ করছে। ফেসবুক কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুসারে ২০১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শুধুমাত্র বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ২ লাখ। বর্তমানে ২ কোটি ছাড়িয়ে।

জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত হলেও বর্তমানে ফেসবুক সমাজ বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত। তরুণ প্রজন্মের কাজে ফেসবুক আজ ইয়াবা আর আফিমের স্থান দখল করে নিয়েছে। সমাজের সর্বস্তরে ক্রমেই বাড়ছে এ নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। ইন্টারনেট, কম্পিউটার, ল্যাপটপ সুবিধা আছে কিন্তু ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই এমনটা এখন বিরল। তরুণ-তরুণী এবং শিক্ষার্থীদের নিয়ে দুশ্চিন্তার-উৎকণ্ঠায় রয়েছেন অভিভাবকগণ।

পৃথিবীজুড়ে অসংখ্য শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণী এর মাধ্যমে অবৈধ সম্পর্ক গড়ছে এবং মিথ্যার রাজত্ব কায়েম করছে। বন্ধুত্বের নামে অবাধ মেলামেশার পরিবেশ সৃষ্টি, প্রেম, পরকীয়া, বহুগামিতা, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে অবিশ্বাস-সন্দেহ সৃষ্টি ও ফাটল ধরানো এবং পারিবারিক বন্ধন ভাঙনের পেছনে বিজ্ঞজন এ ফেসবুককে দায়ী করছেন। এমনকি ছাত্র-ছাত্রীরা বিয়ের আগেই জড়িয়ে পড়ছে একাধিক অবৈধ সম্পর্কে। কখনো স্বামী কখনো স্ত্রী কখনো বা দুজনেই একসাথে একাধিক সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া বর্তমানে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ছে পর্নোগ্রাফি। পর্নোছবি, ভিডিও এবং অশ্লীল লেখা সমন্বয়ে অসংখ্য অ্যাকাউন্ট এবং পেজ খোলা হচ্ছে। অনেকে নামে বেনামে বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট খুলে অনবরত অশ্লীল ভিডিও এবং ছবি পোস্ট করে যাচ্ছে যা ফেসবুক ব্যবহারকারী সকলের ওয়ালে চলে আসছে। যা থেকে বেঁচে থাকা অসম্ভব। বিষয়টি এখন রীতিমত বিশ্বের সকলের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। খোদ ফেসবুকের জনক উন্নত বিশ্বেও ফেসবুকের ভয়ঙ্কর এসব প্রভাব নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে একাধিক সমীক্ষা ও প্রতিবেদন। যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, কিছু সাধারণ মানুষের হৃদয় জয় করলেও মনের অগোচরেই ব্যবহারকারীদের ক্রমেই নেশাগ্রস্থ করে তুলছে সামাজিক নেটওয়ার্ক ফেসবুক, টুইটার এবং গুগলের মতো অনলাইন মাধ্যমগুলো। প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ রয়েছে, অনলাইন সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে ফেসবুক, টুইটার এবং গুগলের মতো সাইট পরিদর্শকদের মধ্যে গড়ে ৫৩জন বিচলিত হয়ে পড়ে। একই কারণে একাকিত্ব যাতনায় ভোগে শতকরা ৪০জন। ব্রিটিশ আইনি সংস্থা ‘ডিভোর্স অনলাইন’ গত বছর পাঁচ হাজার বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পেয়েছে, বিয়ে বিচ্ছেদের অন্যতম ভূমিকা পালন করছে ফেসবুক। আমেরিকান একাডেমি অব ম্যান্টিমোনিয়াল ল ইয়ার্স তাদের তথ্যে উল্লেখ করেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ৮০ শতাংশ বিয়ে বিচ্ছেদের জন্য ফেসবুকই দায়ী। ফেব্রæয়ারী ’১৫ইং জাতীয় দৈনিক নয়া দিগন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারী থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত শুধুমাত্র ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের তথ্য মতে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে ৭১৫৩টি। যাতে পুরুষের তুলনায় নারীরাই বেশি আগ্রহী। প্রাসঙ্গিক এক জরিপে দেখা যায়, ৮৭ শতাংশ নারীই দাম্পত্য জটিলতা সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ব্যবহারের ফলে নিজেরাই দায়ী।

তাছাড়া সুইডেন ভিত্তিক আরেক গবেষণায় দেখা যায়, বেশি সময় যারা ফেসবুক ব্যবহার করেন তাদের প্রায় অধিকাংশই ব্যক্তিগত ও দাম্পত্য জীবনে অসুখী। এ গবেষণা বলছে, ব্যবহারকারী অধিকাংশ মেয়ের স্বামী নেই, যাদের আছে তারা হয় প্রবাসী নয়তো নিজেরাই একে অপর থেকে পৃথক বসবাস করেন। দেশ বিদেশ অনলাইন পত্রিকা তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ইন্টারনেট ভিত্তিক সামাজিক চ্যানেলগুলো বিশেষ করে ফেসবুক অনেক সমস্যা সৃষ্টি করছে। নিউইয়র্ক সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চেলসি বিয়ান এক গবেষণার পর জানিয়েছেন, মাত্রাতিরিক্ত ফেসবুকের ব্যবহার মানুষের মধ্যে জটিল মানসিকতা সৃষ্টি করে। এর ফলে দেখা যায় বিভিন্ন ধরনের মানসিক অপরিপক্কতা। যেমন অসামাজিক আচরণ, তীব্র টেনশন বা উত্তেজনা সৃষ্টি, কিশোর ও কিশোরীদের সহিংস আচরণ প্রভৃতি। গবেষণায় দেখা গেছে, শিশু ও বয়স্কসহ ফেসবুকের বহু গ্রাহক মানসিক রোগের শিকার হয়েছে এবং হচ্ছে, কেউ কেউ আত্মহত্যাও করছে।

তাছাড়া তরুণ সমাজে খুবই দ্রæত বিস্তৃত হচ্ছে গার্লফ্রেন্ড, বয়ফ্রেন্ড ও দোস্ত কালচার। পর্নোগ্রাফীর বিস্তার ও সংস্পর্শে আসার কারণে লজ্জা এবং নৈতিকতার বাঁধন ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে যাচ্ছে। বিপরীতে ছড়িয়ে পড়ছে লজ্জাহীনতা, খোলামেলা ও অবাধ মেলামেশার পরিবেশ। এক সময় মা-বাবার উদ্বেগ ছিল ছেলে-মেয়েদের মোবাইলে কথা বলা এবং এসএমএস বিনিময়ে সময় ব্যয় করা নিয়ে। কিন্তু এখন ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম স্কাইপ, ওয়েবক্যামের কারণে পারস্পরিক সম্পর্ক সৃষ্টি এবং কাছাকাছি হওয়ার সুযোগ অনেক বেশি অবারিত হয়েছে। এসবের সয়লাবে এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও শিক্ষার্থীদের মধ্যে অবাধ মেলামেশার পরিবেশ চালু হয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্বেগজনক চিত্রের কথা জানিয়েছেন অভিভাবক ও শিক্ষকেরা। শিক্ষার্থীদের নিষিদ্ধ পল্লিতে যাতায়াতের খবরও বের হচ্ছে। গত ৭ সেপ্টেম্বর দৌলতদিয়া নিষিদ্ধ পল্লিতে খুন হয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ বছরের এক শিক্ষার্থী। রাজধানীর পুরান ঢাকায় পর্নো ভিডিওতে অভিনয়ের সময় ধরা পড়ে দেশের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী। রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলের কয়েকজন শিক্ষকের সাথে আলাপকালে তারা জানান, অনেক সময় ক্লাস ফাকি দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা রেস্টুরেন্ট বা অন্য কোথাও গিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। কোন কোন এলাকার রেস্টুরেন্ট ঘুরলে যে চিত্র এখন দেখা যায় তা কয়েক বছর আগে চিন্তা করতেও পারতেন না অভিভাবকরা। এসব নিয়ে উদ্বিগ্ন অনেক অভিভাবক। কোন কোন অভিভাবক আবার অন্য অভিভাবকদের দায়ী করে বলছেন, অনেক পরিবার রয়েছে যেখানে ছেলে-মেয়েদের অবাধ মেলামেশার বিষয়ে কোন বাধা-নিষেধ আরোপ করে না এবং এটা তাদের কোন দুশ্চিন্তারও কারণ মনে হয় না। এদের সংস্পর্শে এসে প্রভাবিত হচ্ছে অন্যরাও। যার মূলে ছিল মূলত ফেসবুক, টুইটার এ জাতীয় যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর অন্যায় ব্যবহার।

মোটকথা, কেমন যেন আজ তরুণ প্রজন্মের কাছে এসব অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যমগুলো আফিমের চেয়েও মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এসব বিপর্যয়ের দরুণ ফেসবুকের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রেই ইতোমধ্যে ফেসবুক ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপের জোর প্রচেষ্টা চলছে। আরব বিশ্বসহ অন্যান্য রাষ্ট্রের বিজ্ঞ সচেতন মুফতীয়ানে কেরাম, ফাতাওয়া বোর্ডও ফেসবুক ব্যবহার নাজায়েয প্রসঙ্গে ফাতাওয়া প্রদান করেছেন।

সম্প্রতি ‘রাবেতা’ ৪র্থ সংখ্যায় ঐতিহ্যবাহী দীনী বিদ্যাপীঠ জামি‘আ রাহমানিয়া আরাবিয়া সাতমসজিদ মাদরাসার প্রধান মুফতী কর্তৃক প্রকাশিত ফতওয়ায়ও চলমান ফেসবুক ব্যবহার হারাম ঘোষণা এসেছে। তাই এ জাতীয় ঈমান বিধ্বংসী সামাজিক বিপর্যয়ের যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ভয়াবহতা থেকে এখনই আমাদের এ তরুণ ও যুব সমাজকে রক্ষা করার যাবতীয় প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন।


প্রসঙ্গসমূহ:

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

দ্বীনরক্ষা ও প্রতিষ্ঠার জন্য শক্তি ব্যয় করা

...

আল্লামা মনযুর নোমানী রহঃ
১০ নভেম্বর, ২০২৪
৫৪৬২ বার দেখা হয়েছে

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →