প্রবন্ধ
সংঘাতময় পরিস্থিতি: উপেক্ষিত নববী আদর্শ
দিনে দিনে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে পৃথিবী। সমতালে এর অধিবাসীরাও 'গরম' হয়ে উঠছে দিনকে দিন। সেই তাপ ও উত্তাপ বিকিরিত হচ্ছে তাদের প্রতিদিনের যাপিত জীবনে। ব্যক্তি কী পরিবার, সমাজ কী রাষ্ট্র-জীবনের সকল অঙ্গনে এর নিদারুণ প্রতিক্রিয়া দৃশ্যমান। চারদিকে কেবল গরমাগর্মি'র নির্লজ্জ মহড়া। বিনয়, নম্রতা, ক্ষমা ও সহনশীলতা আজ অভিধানের শোভা; জীবনের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা নেই। অপরকে সম্মান দেয়া, পরমতকে সহ্য করা, জাতীয় স্বার্থে ব্যক্তিস্বার্থ উপেক্ষা করা যেন ডুমুরের ফুল; নাম আছে, অস্তিত্ব নেই। খুন-গুম, হত্যা-লুণ্ঠন তো জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; না ঘটলে অবাক লাগে। সৃষ্টিকুলে আজ মানুষের মূল্যই বোধ হয় সবচেয়ে কম। নর্দমায় ভাসছে মানুষের লাশ। ভাগাড়ে মিলছে নরকঙ্কাল। গলিত শবের দুর্গন্ধে বাতাস ভারি। প্রকাশ্যে দিবালোকে উধাও হয়ে যাচ্ছে বনি আদম, বছর গড়িয়েও মিলছে না খবর; না লাশের, না হাড়গোড়ের। এক জগদ্দল পাশবতা চেপে বসেছে সময়ের কাঁধে। গোটা শব্দ-ভাণ্ডারও আদমজাতের হিংস্রতা প্রকাশে অপ্রতুল। অনাচার ব্যভিচারে বাধা পেয়ে পিতা-মাতাকে হত্যা করে যে সন্তান, তাকে ব্যক্ত করে কোন অভিধান! হাত দুয়েক ভূমির দখল নিতে যে ছুরি বসায় ভাইয়ের কলিজায় তাকে প্রকাশ করে কোন শব্দভাণ্ডার! কোন সে ভাষাজ্ঞান ঈমানের দাবীতে বুলেটবিদ্ধ ঝাঁঝরা পাঁজরের অভিশাপ তুলে ধরে! কাকে দোষারোপ করি? অভিযোগের লক্ষ্য তো পর কেউ নয়, একান্ত আপনজন। ইসলামের আলো ও হেদায়েতের নূর-বঞ্চিত লোকদের কথা ভিন্ন। ওরা তো নিজেদের বানরের বংশধর পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কিন্তু ইসলামের পরিচয়ে পরিচিত আদম সন্তান কীভাবে গোত্র-বংশ ও ভাষা-বর্ণের ভিত্তিতে জান-কবুল হানাহানিতে লিপ্ত হয়। কালিমার গণ্ডিতে একীভূত মুসলমান কিভাবে গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের নামে খণ্ডিত দণ্ডিত হয়। উম্মাহ আজ নিজেরাই নিজেদেরকে খুবলে খাচ্ছে। উম্মাহর রাহবার ঠিকই বলেছেন, শেষ যুগে আদমের বেটারা খুনোখুনি করে মরবে।
হতভাগা জানবে না কেন সে নিহত হলো। আর দুর্ভাগাও বলতে পারবে না কেন সে ভাইয়ের খুনে হাত রাঙ্গালো। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এর মূলে সুনির্দিষ্ট কিছু কারণ রয়েছে। যথা- ঈমান ও ইসলামের হাকীকত সম্পর্কে অজ্ঞতা: ঈমানের কালিমা হলো لا اله الا الله محمد رسول الله কালিমা তার অনুসারীদেরকে আল্লাহর একত্ববাদ ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তরীকার উপর একত্র হওয়ার ও জমে থাকার নির্দেশ দেয়। আল্লাহ, রাসূল ও আখেরাতে বিশ্বাসী দু'জন মানুষ কখনোই পরস্পরের জান- মাল, ইজ্জত-আব্রুর হুমকি হতে পারে না। আল্লাহর ভয়, রাসূলের অসন্তুষ্টি এবং পরকালীন জবাবদিহিতা অবশ্যই তার পথ আগলে দাঁড়াবে। ঈমানই তাকে সকল দুষ্কর্মের অশুভ ও ভয়াবহ পরিণতি বাতলে দিবে। সে বুঝতে পারবে, মুমিন হতে হলে বিবাদ- বিসম্বাদ ও তার বিচারভারসহ পার্থিব জীবনের যাবতীয় কাজকর্মে তাকে কালিমার দাবীর অধীন হতে হবে। তার হাত ও মুখ থেকে তখন জগতের সকল মানুষ লাভ করবে নিরাপত্তা। সে যখন জানবে, দুনিয়ার সকল মুমিন পরস্পরে ভাই ভাই তখন মুমিনের বিপদাপদে সহমর্মিতায় তার মন হু হু করে কেঁদে উঠবে। হামলা, মামলা, গোষ্ঠি উদ্ধার তো অনেক পরের কথা।
মুমিনের মর্যাদা সম্পর্কে অজ্ঞতা:
সংঘর্ষ-সংঘাতের অন্যতম কারণ হল, মুমিনের সত্যিকার মর্যাদা সম্পর্কে অজ্ঞতা। মুমিন যদি নিজের ও অপরাপর মুমিনের মর্যাদা সত্যিকারভাবে উপলব্ধি করতে পারে তাহলে বহু কলহ-বিবাদ সূচনাতেই মিটে যাবে। মুমিনের মর্যাদা সম্পর্কে নবীজীর ইরশাদ- لا تقوم الساعة على احد يقول الله الله 'আল্লাহকে আল্লাহ স্বীকার করে এমন মানুষ বিদ্যমান থাকা অবস্থায় কিয়ামত কায়েম হবে না'। এটা কোন সহজ কথা নয়। শুনেছে কেউ, মালিকের দয়ায় খেয়ে-পরেও যে কারখানার একজন ছাড়া সকল কর্মচারী মালিকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এমন কারখানা কেউ চালু রেখেছে কোনদিন?
কিংবা দেখেছে কেউ, একজন মাত্র যাত্রীর জন্য চালু রয়েছে দশ বগির কোন রেলগাড়ী? কিন্তু মুমিনের রব আল্লাহ তা'আলা পৃথিবীর চেয়ে তেরো লক্ষ গুণ বড়, প্রতিদিন লক্ষ কোটি ট্রিলিয়ন জ্বালানী ধ্বংসকারী আতিকায় এক সূর্য এবং সূর্যের অনুরূপ অসংখ্য গ্রহ, নক্ষত্র, নীহারিকা ও ছায়াপথ বিশিষ্ট মহাকাশ, এসবের ঘূর্ণন এবং দিন-রাতের আবর্তনসহ বিশ্ব জগতের কল্পনাতীত ব্যয়বহুল সকল ব্যবস্থাপনা শুধুমাত্র একজন মুমিনের খাতিরে বহাল রাখবেন। আল্লাহু আকবার! মুমিনের এই মর্যাদা যে হৃদয়ে জাগ্রত থাকে তার পক্ষে কোন মুমিনের ক্ষতি সাধন করা কিছুতেই সম্ভব নয়।
উম্মাহর বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী সম্পর্কে অজ্ঞতা: মুসলিম উম্মাহ আর দশটা জাতির মতো নয়। এই উম্মাহর সকল সদস্য এক 'অভিন্ন সত্তা' তুল্য। উম্মাহর প্রতি আসমানী নির্দেশ, তারা যেন আল্লাহর রশি ইসলামকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরে এবং সকল বিভেদ বিচ্ছেদ পরিহার করে পরস্পরে এক ও অবিচ্ছিন্ন থাকে। নইলে পরিণতি কী হবে তাও জানিয়ে দেয়া হয়েছে সুস্পষ্ট ভাষায়- 'তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করবে এবং পরস্পরে কলহ করবে না। অন্যথায় তোমরা দুর্বল হয়ে পড়বে এবং তোমাদের প্রভাব বিলুপ্ত হবে।' উম্মাহর এ বৈশিষ্ট্য যে কোন মূল্যে সংরক্ষণ করা অপরিহার্য। 'অভিন্ন সত্তা' খণ্ডিত হয় এমন যে কোন কর্মকাণ্ড ও প্রয়াস উম্মাহকে সযত্নে এড়িয়ে চলতে হয়, চাই তা ব্যক্তি পর্যায়ে যতই ফলপ্রসূ মনে করা হোক। এ বৈশিষ্ট্য বিস্মৃত হওয়ায় উম্মাহ আজ শতধা বিভক্ত। উম্মাহ যেন দস্তরখানে পরিবেশিত লোভনীয় লোকমা যাকে সহজেই উদরে চালান করে দেয়া যায়।
কুরআন-সুন্নাহ সম্পর্কে অজ্ঞতা ও উপেক্ষা:
যে জাতির জীবন বিধানের প্রথম শব্দ হল 'পড়', সে জাতি কীভাবে কুরআন-সুন্নাহ সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে এবং নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদে কুরআন- সুন্নাহর নির্দেশ উপেক্ষা করে তা এক বিস্ময় বটে। কুরআন-সুন্নাহর প্রয়োজনীয় জ্ঞান থাকলে এবং কুরআন- সুন্নাহর অপরিহার্যতা সম্পর্কে অবগত থাকলে উম্মাহ জানতে পারতো বিবদমান দু'পক্ষের করণীয় কী আর যারা বিবাদে জড়িত নয় তাদেরই বা করণীয় কী।
অনিয়ন্ত্রিত ক্রোধ ও অহংকার:
সিংহভাগ সংঘাতের সূত্রপাত আত্মগর্ব ও অহমিকা থেকে সৃষ্ট। পরিণতি যাই হোক অহংকারী তার ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরে আসে না। তার অহম তাকে আসতে দেয় না। অহংকারীর অভিধানে ক্ষমা, বিনয় ও নম্রতার স্থান নেই। জনপদ থেকে জনপদ ভগ্ন হয়ে যাক তার কোন মাথা ব্যথা নেই। আর অহমিকার সঙ্গে ক্রোধের সংযোগ ঘটলে তো ধ্বংসের ষোলআনা পূর্ণ হয়। 'হামবড়া' অন্যকে তো ক্ষয় করেই নিজেও জ্বলে পুড়ে মরে তবুও নিবৃত হয় না।
নিজেকে ভুলের ঊর্ধ্বে মনে করা:
আত্মগর্বের ভিত্তিতে মানুষ নিজের মত ও সিদ্ধান্তকে ভুলের ঊর্ধ্বে মনে করে। অন্যমত বা ভিন্নমত তার কাছে অসহ্য লাগে। নিজের মতও ভুল হতে পারে কিংবা ভিন্নমতও সঠিক হতে পারে এমন ধারণা তার কাছে বিষতুল্য। সে সাথে সিদ্ধান্ত প্রয়োগের দণ্ডটিও যদি তার হাতে থাকে এবং আরেকজন আত্মগর্বী তার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায় তখন সংঘাত হয়ে ওঠে অনিবার্য। অসহায় জনতা তখন উন্মাদ দুই হায়ওয়ানের তাণ্ডবলীলা প্রত্যক্ষ করে এবং বরবাদী তার সকল অনুষঙ্গসহ ষোলকলায় পূর্ণ হয়।
নিজেই নিজের মূল্য নির্ধারণ করা:
কেউ যখন নিজেই নিজের মূল্য নির্ধারণ করে তখন স্বাভাবিকভাবেই সে ভুলের শিকার হয়। নিজের জন্য সে একটি মূল্য নির্ধারণ করে এবং সবার কাছ থেকে তা উসুল করতে চায়। কোন বিষয়ে পারদর্শী না হয়ে এমনকি কিচ্ছুটি না জেনেও সবখানে সে মাতব্বরী ফলাতে চায়। কিন্তু যে মূল্য পাঁচজনে নির্ধারণ করেনি লোকে তাকে তা দিতে যাবে কেন? এবং দশজনে যাকে মুরুব্বী বানায়নি লোকে তাকে মানতে যাবে কেন? আজকের দিনে সব মহলেই ছড়িয়ে পড়েছে এ প্রাণঘাতী ব্যাধি। এ ব্যাধির প্রাদুর্ভাব যত বড় পরিসরে দেখা দেয় তার মাশুলও হয় ততো চড়া। জাতীয় পর্যায়ে হলে কথাই নেই; গোটা জাতি সেই সর্বনাশা মুরুব্বিয়ানার খেসারত দিতে থাকে।
হিংসা-বিদ্বেষ:
মুমিন মাত্রই একথা জানে যে, প্রজ্ঞার আধার আল্লাহ তা'আলাই মানুষের হায়াত-মউত, রিযিক-দৌলত ও ইজ্জত-হাশমতের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণকারী। তিনি যাকে যে পরিমাণে ইচ্ছা এসব দান করে থাকেন। নিজের জন্য কামনা করা ছাড়া এ নিয়ে কোনরূপ বিরূপ ধারণা পোষণ করাও অন্যায়; হিংসা-বিদ্বেষ তো পরের কথা। বিদ্বেষ পোষণকারী প্রতিপক্ষের ন্যায়ানুগ কাজকর্মেও বিরোধিতা করে। প্রতিপক্ষের ছায়া দেখলেও সে তেড়ে আসে। এতে সে ইনসাফের দৌলত থেকে বঞ্চিত হয়। এটা কোন মুমিনের স্বভাব হতে পারে না। মুমিন তো কাফিরের সাথেও ইনসাফের আচরণ করবে আর ইয়াযিদকেও শোধ করবে প্রাপ্য অধিকার।
গোষ্ঠি ও দলপূজা:
মানবজীবনে দলবদ্ধতার প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না। জীবনে শান্তি, স্বস্তি ও সমৃদ্ধি অর্জনে দলবদ্ধতার ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। পারস্পরিক উদারতা, সহযোগিতা ও সহমর্মিতা মরুভূমিতেও উদ্যান রচনা করতে পারে এবং বরফরাজ্যেও ছোটাতে পারে উষ্ণ প্রস্রবণ। কিন্তু দল যখন 'ভাল হ' না বলে কলহ বিস্তার করে, আন্দোলনের নামে কোন্দল বাধিয়ে দেয়, গলাগলির পরিবর্তে বেছে নেয় গোলাগুলির পথ- দল তখন মল-মূত্রের মতই পরিতাজ্য হয়ে ওঠে। সত্যের সাথে কুস্তি বাধালেও দলের সাথে দোস্তি রাখতে হবে, শোষণ-পেষণের প্রতীক হওয়া সত্ত্বেও দলকে পোষণ-তোষণ করে যেতে হবে, দীন-ধর্ম, দেশ-জনতাকে নিলামে ওঠালেও 'তথাস্তু' বলে চেঁচিয়ে উঠতে হবে- এ কেমন বিবেচনাবোধ ও অন্ধপনা মানুষের? একে পূজা-অর্চনা ছাড়া আর কী নামে অভিহিত করা যায়? এ অগ্নিগর্ভ সময়ে দলাদলির ভয়াবহ পরিণতি বোঝাতে উদাহরণ টানার প্রয়োজন নেই; ঘরের কোণে মাথা গুঁজেও তা আঁচ করা যায়।
সম্পদের মোহ ও পদলিপ্সা:
দ্বন্দ্ব- সংঘাতের অন্যতম একটি কারণ সম্পদের মোহ ও পদলিপ্সা। আজ পৃথিবীতে যত বড় বড় সংঘাত দৃষ্টিগোচর হচ্ছে তার প্রায় সবগুলোই এ থেকে সৃষ্ট। হাদীসে এসেছে, 'লোভীর উদর কেবল কবরের মাটিই পূর্ণ করতে পারে। সে এক পৃথিবী সম্পদ পেয়েও আরেক পৃথিবীর খোঁজে লেগে যায়।' ধরে মেরে যে পথেই হোক সম্পদ তার চাই-ই চাই। দু' টাকার জন্য সে প্রাণীর কাতারেও নেমে আসতে পারে। স্বার্থের খাতিরে তার পদলেহী হতেও অরুচী নেই। এদিকে পদলিপ্স কোনদিন ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। ক্ষমতাকে সে মনে করে মৌরুসি সম্পত্তি। সকল মানুষের প্রাণের বিনিময়ে হলেও কুরসীর কাঙ্গাল আপন ক্ষমতা বহাল রাখতে চায়। কিন্তু প্রতিপক্ষ তাকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। সে-ও আরেক পদলিপ্স বটে! ফলে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে সীমাহীন নৈরাজ্য। বনি আদমের খুনে পিচ্ছিল হয় পিচঢালা রাজপথ, শহর-নগর-জনপদ। কিন্তু একজন মুমিন জানে, আল্লাহই সার্বভৌমত্বের মালিক। তিনি যাকে ইচ্ছা রাজত্ব দান করেন, যার থেকে ইচ্ছা রাজত্ব ছিনিয়ে নেন। জোর করে ক্ষমতায় থাকা যায় না; যাওয়াও যায় না। তিনি কাউকে ফকিরির আসনেও ইজ্জত দান করেন আবার কাউকে রাজ-আসনেও করেন লাঞ্চিত। দ্বন্দ্ব-সংঘাতকালিন সর্বত্রই দু'টি শ্রেণী লক্ষ্য করা যায়।
এক. সরাসরি সংঘাতে লিপ্ত দু'দল।
দুই. তৃতীয় পক্ষ, যারা সরাসরি সংঘাতে জড়িত নয়।
'জড়িত নয়' এর সঙ্গে 'সরাসরি' বিশেষণ যুক্ত করার কারণ হল, যে ব্যক্তি নিজেকে মুসলিম উম্মাহর অংশ মনে করে তার জন্য মুসলমানদের দ্বন্দ্ব- সংঘাতে 'নির্দলীয়', 'নিরপেক্ষ' সেজে নিচেষ্ট থাকার সুযোগ নেই। নির্ণয় করা গেলে সত্য ও ন্যায়কে তার সঙ্গ দিতেই হবে এবং অন্যায় ও অসত্যের প্রতিকারে সাধ্যানুপাতে ব্যবস্থা নিতে হবে। নির্ণয় না করা গেলে তখন সত্য নির্ণয়ের চেষ্টা-ফিকির করা তার অবশ্য কর্তব্য। কী গজবের কথা! দু'দল মুসলমান লড়াই-ঝগড়া করে ধ্বংস হবে আর সে নিরপেক্ষ সেজে হাত গুটিয়ে থাকবে, সাধ্যানুযায়ী সহযোগিতা বা প্রতিবিধানের চেষ্টা করবে না এমন 'ক্লীব' মুসলমান ইসলামের প্রয়োজন নেই।
সরাসরি লিপ্ত কিংবা সরাসরি লিপ্ত নয় বিবাদ-বিসম্বাদে মীমাংসা পেতে হলে উভয় দলকেই একটি নির্বিকল্প মাপকাঠি অনুসরণ করতে হবে; এমন একটি মাপকাঠি, যা সকল সমস্যার সমাধান পেশ করতে সক্ষম। মুমিনমাত্রই জানে, নববী আদর্শই হলো সে মাপকাঠি। দ্বন্দ্ব-সংঘাত মুখর এ অস্থির সময়ে এর কোন বিকল্প নেই। 'নববী আদর্শ শব্দবন্ধ দ্বারা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামের আদর্শ বোঝানো উদ্দেশ্য। সংঘর্ষ- সংঘাতের কঠিন সময়ে এ মাপকাঠি দ্বারা ব্যক্তি মুমিন ও মুসলিম উম্মাহ নিজেদের দাবী, কর্মপন্থা ও মতাদর্শ মেপে দেখলে এবং সে অনুযায়ী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করলে উম্মাহর জীবনে শান্তি, সাফল্য ও নিরাপত্তা শতভাগ নিশ্চিত।
কল্যাণযুগের ইমাম, মালিক ইবনে আনাস রহ.-এর কালজয়ী বাণীটি- 'উম্মাহর শেষভাগ কিছুতেই সংশোধিত হবে না যতক্ষণ না তারা প্রথমভাগকে সংশোধনকারী কর্মপন্থা হিসেবে গ্রহণ করবে' আজ শহর-নগর-বন্দরে, জনপদ ও অলিগলির দেয়ালে দেয়ালে মোটা মোটা লাল হরফে সেঁটে রাখা দরকার, যেন উম্মাহ বিপর্যয়কালীন কর্মপন্থা নির্ধারণে ভুল-ভ্রান্তির শিকার না হয়।
উম্মাহর প্রথম অংশ নিজেদের সকল কর্মকাণ্ড কুরআন-সুন্নাহর নিক্তিতে মেপে দেখতেন। প্রতিটি কাজে-কর্মে নবী ও আসহাবুন নবীর কষ্টি পাথরে নিজেদেরকে পরখ করে নিতেন। কুরআন-সুন্নাহ এবং এ দুটোর রৌশনি ছিল তাদের পথের মশাল, জীবনের আলো। চাইলে আজকের 'গুমরাহা'দেরও এ পথেই খুঁজতে হবে সমাধান।
সংঘাতকালীন উম্মাহর করণীয়:
সংঘর্ষ- সংঘাতের মৌলিক কারণগুলো উপরে বিবৃত হয়েছে। তার মধ্যে আত্মার সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যাপারগুলো যথা- অহংকার- ক্রোধ, আমিত্ব, হিংসা-বিদ্বেষ, সম্পদ ও পদলিপ্সা ইত্যাদির ইহ-পরকালীন ক্ষয়-ক্ষতি উপলব্ধির জন্য কুরআন- হাদীস থেকে এ সংশি-ষ্ট অধ্যায়গুলো অধ্যয়ন করতে হবে। তারপর হক্কানী পীর-মাশায়েখ ও উলামায়ে কেরামের সাহচর্য গ্রহণ করে নিয়মতান্ত্রিক অধ্যাবসায়ের মাধ্যমের সেগুলো দূর করার ফিকির করতে হবে। আর অন্যান্য কারণগুলো দূর করতে দাওয়াত, তাবলীগ ও দাওয়াতুল হকের সাথে সংশি- ষ্ট হয়ে চিল্লা, তিন চিল্লা সময় লাগিয়ে ঈমান-আমল মেরামতের আন্দোলনে জোরদারভাবে আত্মনিয়োগ করতে হবে। নির্বাচিত কিতাবাদী থেকে লেনদেন ও সামাজিক আচার-ব্যবহারের শরীয়তের বিধি-বিধান জেনে সে অনুযায়ী সকল সৃষ্টিজীবের অধিকার আদায়ে সচেতন হতে হবে। এক্ষেত্রে নিজ অধিকার আদায়ের চেয়ে পরের প্রাপ্য পরিশোধকে অগ্রগণ্য রাখতে হবে। হায়াতুস সাহাবা কিতাব থেকে সাহাবায়ে কেরামের স্বার্থত্যাগ বিষয়ক ঘটনাবলী পড়ে পড়ে ব্যক্তিস্বার্থকে উপেক্ষা করার অনুশীলন করতে হবে। সর্বোপরি বিভেদ-বিচ্ছেদের ভয়াবহ পরিণতির ব্যাপারে সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে। এভাবে ধীরে ধীরে আত্মসমালোচনা ও আত্মসংশোধনের মাধ্যমে সংযত হয়ে ভাই-ভাই সুলভ সমাজ গঠন করতে হবে। সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের পরও যদি দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে যায় তখন নিম্নোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
১. নিজের মতামত ও দাবী-দাওয়াকে কুরআন-সুন্নাহ ও ফিকহে ইসলামীর সোপর্দ করে দিতে হবে। অর্থাৎ, কুরআন-সুন্নাহকে বিচারের মানদণ্ড মানতে হবে। লক্ষ্য করুন বিবদমান দু'দলের উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা'আলার ইরশাদ,
يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا
অর্থ: হে মুমিনগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহ, তাঁর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা এখতিয়ারধারী তাদেরও। অতঃপর তোমাদের মধ্যে যদি কোন বিষয়ে বিরোধ দেখা দেয় তবে তোমরা আল্লাহ ও পরকালে সত্যিকারের বিশ্বাসী হয়ে থাকলে সে বিষয়কে আল্লাহ ও রাসূলের উপর ন্যস্ত কর। এটাই উৎকৃষ্টতর পন্থা এবং এর পরিণামও সর্বাপেক্ষা শুভ। (সূরা নিসা: ৫৯)
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ
অর্থ- না (হে নবী!) তোমার প্রতিপালকের শপথ! তারা ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না নিজেদের পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদের ক্ষেত্রে তোমাকে বিচারক মানে। (সূরা নিসা: ৬৫)
এক্ষেত্রে নিজের খেয়াল-খুশি ও তাগুত-রচিত ভ্রান্ত নির্দেশনা সর্বতোভাবে পরিহার করতে হবে। আল্লাহ তা'আলা বলেন,
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آمَنُوا بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَنْ يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوا أَنْ يَكْفُرُوا بِهِ وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُضِلَّهُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا
অর্থ- (হে নবী!) তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যারা দাবী করে, তারা তোমার প্রতি যে কালাম নাযিল করা হয়েছে তাতেও ঈমান এনেছে এবং তোমার পূর্বে যা নাযিল করা হয়েছিল তাতেও। (কিন্তু) তাদের অবস্থা এই যে, তারা ফয়সালার জন্য তাগুতের (কাফির লিডার) কাছে নিজেদের মুকাদ্দমা নিয়ে যেতে চায়? অথচ তাদেরকে আদেশ করা হয়েছিল যেন সুস্পষ্টভাবে তাগুতকে অস্বীকার করে। বস্তুত শয়তান তাদেরকে ধোঁকা দিয়ে চরমভাবে গোমরাহ করতে চায়। (সূরা নিসা : ৬০)
أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ حُكْمًا لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ
অর্থ- তবে কি তারা জাহেলী যুগের ফয়সালা লাভ করতে চায়? যারা নিশ্চিত বিশ্বাস রাখে, তাদের জন্য আল্লাহ অপেক্ষা উত্তম ফয়সালা দানকারী কে হতে পারে? (সূরা মায়িদা: ৫০)
২. কুরআন-সুন্নাহ ও ফিকহে ইসলামী থেকে প্রাপ্ত সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনা দ্বীধাহীন চিত্তে মেনে নিতে হবে। চাই তা যতই অসহ্য ও দুঃসহ মনে হোক না কেন। এক্ষেত্রে পরিবার, দল ও সমাজের তথাকথিত 'স্ট্যাটাস' ও মান-মর্যাদা উপেক্ষা করতে হবে। আল্লাহ তা'আলা বলেন,
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
অর্থ- না (হে নবী!) তোমার প্রতিপালকের শপথ! তারা ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না নিজেদের পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদের ক্ষেত্রে তোমাকে বিচারক মানে। তারপর তুমি যে রায় দাও, সে ব্যাপারে নিজেদের অন্তরে কোনরূপ কুণ্ঠাবোধ না করে এবং অবনত মস্তকে তা গ্রহণ করে নেয়। (সূরা নিসা: ৬৫)
সংঘাতকালীন তৃতীয় পক্ষের করণীয়:
আল্লাহ তা'আলা বলেন,
وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا فَإِنْ بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَى فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّى تَفِيءَ إِلَى أَمْرِ اللَّهِ فَإِنْ فَاءَتْ فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا بِالْعَدْلِ وَأَقْسِطُوا إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ
অর্থ- মুমিনদের দু'টি দল আত্মকলহে লিপ্ত হলে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিও। অতঃপর তাদের একটি দল যদি অন্য দলের উপর বাড়াবাড়ি করে, তবে যে দল বাড়াবাড়ি করেছে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, যাবৎ না সে আল্লাহর হুকুমের দিকে ফিরে আসে। সুতরাং যদি ফিরে আসে তবে তাদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে মীমাংসা করে দিও এবং (প্রতিটি বিষয়ে) ইনসাফ করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফকারীদের ভালবাসেন। (সূরা হুজুরাত: ৯)
إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ
অর্থ- প্রকৃতপক্ষে সমস্ত মুসলিম ভাই- ভাই। সুতরাং তোমরা তোমাদের দু' ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করে দাও, এবং (মীমাংসা কাজে) আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমাদের প্রতি রহমতের আচরণ করা হয়। (সূরা হুজুরাত : ১০)
নবীজীর ইরশাদ,
عن عرفجة قال سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول إنه ستكون هنات وهنات فمن أراد أن يفرق امر هذه الأمة وهي جميع فاضربوه بالسيف كائنا من كان
অর্থ- হযরত আরফাজা (রা.) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, অচিরেই বিভিন্ন ধরণের নতুন নতুন বিশৃঙ্খলা ও কলহ-বিবাদের সৃষ্টি হবে। সুতরাং যে ব্যক্তি এই উম্মতের ঐক্য ও সংহতির মধ্যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করতে চায় এবং তাদের ঐক্যের মধ্যে ফাটল ধরাতে চেষ্টা করে, তলোয়ার দ্বারা তোমরা তাকে শায়েস্তা কর। চাই সে যে কেউই হোক না কেন। (মুসলিম: ২২)
عن حميد بن عبد الرحمن عن أمه أم كلثوم بنت عقبة قالت سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول ليس بالكاذب من أصلح بين الناس فقال خيرا أو نمى خيرا
অর্থ- উম্মে কুলছুম বিনতে উকবা (রা.) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি (বিবদমান) মানুষের মধ্যে মধ্যস্থতা করে দেয় এবং এ কাজে প্রয়োজনে কম-বেশি কিছু বলে তাহলে সে মিথ্যাবাদী নয়। (তিরমিযী: ১৯৩৮)
বিচারক ও মধ্যস্থতাকারীর মৌলিক সতর্কতা:
(ক) কুরআন-সুন্নাহ ও এর আলোকে ফয়সালা করা।
وَأَنِ احْكُمْ بَيْنَهُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ
অর্থ- এবং (আমি আদেশ করছি যে,) তুমি মানুষের মধ্যে সেই বিধান অনুসারে বিচার করবে যা আল্লাহ নাযিল করেছেন। (সূরা মায়িদা: ৪৯)
عن معاذ بن جبل أن رسول الله صلى الله عليه وسلم لما أراد أن يبعث معاذا إلى اليمن قال كيف تقضي إذا عرض لك قضاء؟ قال أقضي بكتاب الله قال فإن لم تجد في كتاب الله؟ قال فبسنة رسول الله صلى الله عليه وسلم قال فإن لم تجد في سنة رسول الله صلى الله عليه وسلم ولا في كتاب الله؟ قال أجتهد رأيي ولا آلو لا أقصر في الاجتهاد فضرب رسول الله صلى الله عليه وسلم صدره وقال الحمد لله الذي وفق رسول رسول الله لما يرضي رسول الله
অর্থ- হযরত মু'আয ইবনে জাবাল (রা.) হতে বর্ণিত, যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে (গভর্ণর পদে নিযুক্ত করে) ইয়ামানে পাঠালেন, তখন তিনি তাঁকে (মু'আযকে) জিজ্ঞাসা করলেন, (আচ্ছা বল তো দেখি!) যখন তোমার কাছে কোন মামলা-মুকাদ্দমা পেশ করা হবে, তখন তুমি কিভাবে ফয়সালা করবে? উত্তরে মু'আয বললেন, আমি আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী ফয়সালা করব। এবার হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা, আল্লাহর কিতাবের মধ্যে যদি এর কোন সমাধান না মিলে, তখন কি করবে? উত্তরে মু'আয বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত (অর্থাৎ হাদীসে রাসূল) অনুযায়ী ফয়সালা করব। হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুনরায় তৃতীয়বার জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা, যদি রাসূলুল্লাহর সুন্নাতের মধ্যেও তার সমাধান না পাওয়া যায় তখন কী করবে? উত্তরে মু'আয বললেন, তখন আমি আমার বিবেক দ্বারা ইজতেহাদ করব এবং এই কাজে সামান্য পরিমাণ ত্রুটি করব না। মু'আয (রা.) বলেন, আমার এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার বুকে হাত মেরে বললেন, সমস্ত প্রশংসা একমাত্র সেই আল্লাহর জন্য, যিনি আল্লাহর রাসূলের প্রতিনিধিকে সেই কাজটি করার তৌফিক দান করেছেন যে কাজে আল্লাহর রাসূলের সন্তুষ্টি রয়েছে। (আবু দাউদ: ৩৫৯২)
(খ) সত্য নির্ধারণের লক্ষ্যে সর্বোচ্চ চেষ্টা-ফিকির করা।
عن بريدة عن أبيه عن النبي صلى الله عليه وسلم قال: القضاة ثلاثة واحد في الجنة واثنان في النار فأما الذي في الجنة فرجل عرف الحق فقضى به ورجل عرف الحق فجار في الحكم فهو في النار ورجل قضى للناس على جهل فهو في النار
অর্থ- হযরত বুরাইদা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বিচারক তিন প্রকার হয়ে থাকে, তার মধ্যে এক প্রকারের জন্য জান্নাত এবং দুই প্রকারের জন্য জাহান্নাম অবধারিত। সে বিচারক জান্নাতে প্রবেশ করবে যে সত্যটি উপলব্ধি করেছে এবং সে অনুযায়ী বিচার করেছে। আর যে বিচারক সত্য উপলব্ধি করেও বিচারের মধ্যে অন্যায় (জুলুম) করল, সে বিচারক জাহান্নামী। অনুরূপভাবে সে বিচারকও দোযখে প্রবেশ করবে, যে অজ্ঞতার সাথে মানুষের মধ্যে বিচার করল (এবং ভুল ফয়সালা দিল)। (আবূ দাউদ: ৩৫৭৩)
عن على قال : بعثني رسول الله صلى الله عليه وسلم إلى اليمن قاضيا فقلت: يا رسول الله ترسلني وأنا حديث السن ولا علم لي بالقضاء؟ فقال: إن الله سيهدي قلبك ويثبت لسانك، فإذا جلس بين يديك الخصمان فلا تقضين حتى تسمع من الآخر كما سمعت من الأول فإنه أحرى أن يتبين لك القضاء قال: فما زلت قاضيا، أو ما شككت في قضاء بعد
অর্থ- হযরত আলী (রা.) বলেন, (যখন) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ইয়ামানের শাসক নিযুক্ত করে পাঠালেন, তখন আমি আরয করলাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি আমাকে প্রেরণ করেছেন, অথচ আমি একজন যুবক, বিচার বা শাসন সম্পর্কে আমি অজ্ঞ। উত্তরে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহ তা'আলা তোমার অন্তরকে অচিরেই সৎপথ প্রদর্শন করবেন এবং তোমার যবানকেও সঠিক রাখবেন। অতঃপর তিনি বললেন, যখন দুই ব্যক্তি (বাদী ও বিবাদী) কোন ব্যাপার নিয়ে তোমার কাছে উপস্থিত হয়, তখন প্রতিপক্ষের কথাবার্তা না শোনা পর্যন্ত বাদীর পক্ষে (ডিক্রি) রায় প্রদান করো না। কেননা, প্রতিপক্ষের বর্ণনা হতে মুকাদ্দমার রায় প্রদানে তোমার সাহায্য মিলবে। হযরত আলী (রা.) বলেন, (হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দু'আর পর) আমি আর কোন মুকাদ্দমায় সন্দেহে পতিত হইনি। (আবূ দাউদ: ৩৫৮২)
(গ) রাগ-অনুরাগ ও পরিবেশ- পরিস্থিতির উর্ধ্বে থাকা-
عن أبي بكرة قال سمعت النبي صلى الله عليه وسلم يقول لا يقضين حكم بين اثنين وهو غضبان
অর্থ- হযরত আবু বাকরা (রা.) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, কোন বিচারক যেন রাগান্বিত অবস্থায় দুই পক্ষের মধ্যে বিচার-ফয়সালা না করে। (বুখারী: ৭১৫৮)
(ঘ) পক্ষপাত থেকে বেঁচে থাকা ও ন্যায়পরায়ণতা অবলম্বন করা।
আল্লাহ তা'আলা বলেন,
يَادَاوُودُ إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِي الْأَرْضِ فَاحْكُمْ بَيْنَ النَّاسِ بِالْحَقِّ وَلَا تَتَّبِعِ الْهَوَى فَيُضِلَّكَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ إِنَّ الَّذِينَ يَضِلُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ لَهُمْ عَذَابٌ شَدِيدٌ بِمَا نَسُوا يَوْمَ الْحِسَابِ
অর্থ- হে দাউদ! আমি পৃথিবীতে তোমাকে খলীফা বানিয়েছি। সুতরাং তুমি মানুষের মধ্যে ন্যায় বিচার কর এবং খেয়াল-খুশির অনুগামী হয়ো না। অন্যথায় তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। নিশ্চিতভাবে জেনে রেখো, যারা আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয় তাদের জন্য আছে কঠিন শান্তি, যেহেতু তারা হিসাব দিবসকে বিস্মৃত হয়েছিল। (সূরা ছোয়াদ: ২৬)
وَأَنِ احْكُمْ بَيْنَهُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَلَا تَتَّبِعْ أَهْوَاءَهُمْ وَاحْذَرْهُمْ أَنْ يَفْتِنُوكَ عَنْ بَعْضِ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ إِلَيْكَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَاعْلَمْ أَنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ أَنْ يُصِيبَهُمْ بِبَعْضِ ذُنُوبِهِمْ وَإِنَّ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ لَفَاسِقُونَ
অর্থ- এবং (আমি আদেশ করছি যে,) তুমি মানুষের মধ্যে সেই বিধান অনুসারে বিচার করবে যা আল্লাহ নাযিল করেছেন এবং তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করো না। তাদের ব্যাপারে সাবধান থেকো; পাছে তারা তোমাকে ফিতনায় ফেলে এমন কোন বিধান থেকে বিচ্যুত করে, যা আল্লাহ তোমার প্রতি নাযিল করেছেন। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে জেনে রেখো, আল্লাহ তাদের কোন কোন পাপের কারণে তাদেরকে বিপদাপন্ন করার ইচ্ছা করেছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই ফাসিক। (সূরা মায়িদা: ৪৯)
নবীজীর ইরশাদ,
عن معاوية قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم يا معاوية إن وليت أمرا فاتق الله واعدل
অর্থ- হযরত মু'আবিয়া (রা.) বলেন,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, হে মু'আবিয়া! তোমাকে শাসন-ক্ষমতা দেয়া হলে আল্লাহকে ভয় করো এবং ন্যায়পরায়ণতা অবলম্বন করো। (মুসনাদে আবূ ইয়া'লা: ৭৩৮০)
(ঙ) আখেরাতের জবাবদিহিতা স্মরণ রাখা।
عن أبي هريرة قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: من ولى القضاء، أو جعل قاضيا بين الناس، فقد ذبح بغير سكين
অর্থ- হযরত আবূ হুরাইরা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যাকে মানুষের মধ্যে কাযী (বিচারক) হিসেবে নিয়োগ দেয়া হল, তাকে যেন ছুরি ছাড়াই জবাই করা হল। (তিরমিযী: ১৩৪০)
عن عبد الله بن عمر رضي الله عنهما أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال ألا كلكم راع وكلكم مسئول عن رعيته
অর্থ- হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, জেনে রেখো, তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল আর প্রত্যেকে নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। (বুখারী: ৭১৩৮)
কলহ বিবাদ ও দ্বন্দ্ব সংঘাতে উপর্যুক্ত দিক নির্দেশনা অনুসরণ করলে আগুনে পানি ঢালার মতই মুহূর্তে নিভে যাবে উম্মাহর যত জ্বালা-যন্ত্রণা। কিন্তু কথা হল, আর কবে আমরা এদিকে মনোযোগী হবো? সময় সুযোগ হাতে থাকতে, নাকি সবকিছু খোয়ানোর পর!? আল্লাহই মানুষের কলব ও হৃদয়ের মালিক। তাঁর কাছেই সকল আবদার-অনুযোগ।
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
সীরাতুন্নবী-মীলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)
[প্রদত্ত বয়ান থেকে সংগৃহীত] দু'টি শব্দের সমন্বয়ে সীরাতুন্নবী শব্দটি গঠিত। একটি হল 'সীরাত' অপরটি 'আন...
নবীজীর ভালোবাসা ও সুন্নাতী যিন্দেগী
হযরত সালমান মনসুরপুরী রহ. বলেন, নবীজীর মুহাব্বত হৃদয়ের শক্তি, রূহের খোরাক, চোখের শীতলতা, দেহের সজীবত...
সুন্নাতে খাতনা : করণীয়-বর্জনীয়
একটি হাদীসে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, পাঁচটি বিষয় ইসলামের স্বভাবজাত বৈ...