শাইখুল ইসলাম আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ.

Blog Writer Image

শাইখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ  রহ. জীবন ও কর্ম 

[ছফাহাত মিন ছবরিল উলামার বঙ্গানুবাদ থেকে সংকলিত] 

মূলঃ  

শায়খ সালমান আবু গুদ্দাহ 

শায়খ আবদুল ফাত্তাহ রহ. এর যোগ্য উত্তরসূরি ও পুত্র 

নাম ও বংশ-পরিচয় :

তার নাম আবদুল ফাত্তাহ। পিতার নাম মুহাম্মদ। পিতামহের নাম  বশীর। প্রপিতামহের নাম হাসান বিন আবু গুদ্দাহ। উপনাম : আবু  যাহেদ, আবুল ফুতুহ। বংশ-পরম্পরায় তার খান্দান কুরাইশের  শাখাগোত্র বনী মাখযুমের সাথে গিয়ে মিলিত হয়। বংশানুক্রমে তিনি  হযরত খালিদ বিন ওয়ালীদ রাযি. এর বংশের এক গর্বিত সন্তান।

জন্ম :  

তাঁর মায়ের বর্ণনামতে তিনি ১৯১৭ ইংরেজি মোতাবেক ১৩৩৬  হিজরীর রজব মাসের মাঝামাঝি সময়ে হালব শহরে জন্মগ্রহণ করেন।  

পারিবারিক অবস্থান : 

তার পরিবারটি মধ্যবিত্ত হলেও নিজস্ব পরিম-লে এ পরিবারের একটি  সুনাম-সুখ্যাতি ছিল। তার পিতা ও পিতামহ কাপড়ের ব্যবসায়  করতেন। নিজেদের হাতেই তারা ‘সায়াত’ নামক একধরনের  উন্নতমানের কাপড় বুনতেন এবং সেগুলো বাজারে বিক্রি করতেন। এ  কাপড়ে কখনো নিরেট সুতা, কখনো-বা রেশমি সুতা ব্যবহার করা  হতো। বাজারে এর চাহিদাও ছিল প্রচুর। এ কাপড় বুননে চমৎকার,  ব্যবহারে আরামদায়ক ও টেকসই হওয়ার কারণে দেশের গ-ি পেরিয়ে  বাইরেও এর একটি বাজার তৈরি হয়েছিল। সে সময় তুর্কিস্তানের— এশিয়া মাইনর যার আরেক নাম—আনাতুলিয়ায় বাণিজ্যিকভাবে এ  কাপড় রপ্তানি হতো। সেখানকার নারী-পুরুষ উভয়েই এ কাপড়ের  পোশাক পরিধান করত। কয়েক পুরুষ থেকে তাদের পরিবার এ  তাঁতশিল্পের সাথে জড়িত ছিলেন। আর্থিকভাবে একদম সচ্ছল না  হলেও মোটামুটি মধ্যম সারির সচ্ছল ছিলেন। তবে মার্জিত আচার আচরণ, পরিশীলিত জীবনবোধ ছিল তাদের পারিবারিক ঐতিহ্য।  ধার্মিক পরিবার হিসেবেও এই পরিবারের একটি সুখ্যাতি ছিল।  নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকার ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা, সন্তানদের ইসলামী ঐতিহ্যের ওপর লালন-পালন  করা ছিল এ পরিবারের আদর্শ। আল্লাহ তাআলা তাদের সন্তানদের  পক্ষ থেকে তাদের উত্তম বিনিময় দান করুন। আমীন।  ব্যবসার হালাল রুজি থেকেই এ পরিবারের খরচ মিটত। দীর্ঘদিন  তারা যে কাপড়ের ব্যবসায় জড়িত ছিলেন একসময় সে কাপড়ের  ব্যবসা মন্দার শিকার হলো। তুর্কিদের পোশাকে ইংরেজদের পোশাক প্রভাব বিস্তার করল। এতে তুর্কিস্তানে ‘সায়াত’ কাপড়ের বাজারে ধস  নামল। ফলে বাধ্য হয়ে তার পিতা হালবের বানকুসা সড়কে অবস্থিত  যাহরা মার্কেটে একটি দোকান ক্রয় করেন। সেখানে তিনি বিভিন্ন  ধরনের তৈরি-পোশাক বিক্রি করতেন। হালবের গ্রাম্য লোকজন ছিল  সে পোশাকের ক্রেতা।  

তার পরিবারের মূল বসতভিটা ছিল জুবাইলা গ্রামে। সেখানে একখ-  জমির ওপর সাধারণ একটি বাড়ি ছিল। এটি মূলত গুদ্দাহ পরিবার ও  তার কিছু নিকটাত্মীয় উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তার  পিতামহ বশীর ছিলেন একজন বিচক্ষণ, জ্ঞানী, স্পষ্টভাষী সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। তিনি তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে জমিটিতে যাদের মালিকানা রয়েছে  তাদের কাছ থেকে জমিটি কিনে নেন। কিনে নেয়ার প্রক্রিয়াটি ছিল  বিস্ময়কর। শরীয়া আদালত থেকে তিনি একজন কেরানি নিয়ে  আসলেন। তারপর সমাজের সম্ভ্রান্ত ও মান্যবর কিছু ব্যক্তির  উপস্থিতিতে সেই জমির মালিকদের ডাকলেন এবং প্রত্যেকের দাবি  মিটিয়ে জমিটি নিজের অধিকারে নিয়ে নেন। এরপর পুরাতন ভবন  ভেঙে নতুন একটি ভবন নির্মাণ করেন। নতুন ভবনটি যেমন ছিল  দৃষ্টিনন্দন তেমনি এর স্থাপত্যশৈলীও ছিল চমৎকার। এতে সাতটি কক্ষ  ছিল। কক্ষগুলো বেশ প্রশস্ত ও সুন্দরভাবে সাজানো-গোছানো ছিল।  যার কারণে অনেকেই এটিকে বিবাহের হল হিসেবে ব্যবহার করত।  আবদুল ফাত্তাহ রহ. যখন এ বাড়ির মালিকানা লাভ করেন তখন তার  বয়স ছয় থেকে আটের মধ্যে ছিল। তিনি তার পিতামহ বশীর সম্পর্কে  বলতেন, তিনি তার পুত্র মুহাম্মদের তুলনায় অনেক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন  ছিলেন। তার পিতামহ প্রায় ৮৫ বছর জীবন লাভ করেছিলেন।  পিতামহের মৃত্যুর সময় তিনি ছিলেন বিশ বছরের টগবগে যুবক।  তিনি পিতামহের খুবই অনুগত ছিলেন। শেষ-বয়সে তার দাদা যখন  ঘর-বসা হয়ে গিয়েছিলেন তখন তিনিই ছিলেন দাদার ভরসা। তিনি  যেদিকে যেতেন সাথে করে নাতিকে নিয়ে যেতেন। নাতিই ছিল তার হাতের লাঠি। তার দাদা যখন মৃত্যুবরণ করেন তখন তিনি সবে  পড়ালেখা শুরু করেছেন। তার লেখাপড়া শুরু করতে বেশ দেরি  হয়েছিল। যখন তিনি শিক্ষাজীবন শুরু করেন, ততদিনে তার জীবন  থেকে উনিশটি বসন্ত অতিবাহিত হয়ে গেছে। তার বয়স যখন পঁচিশে  উপনীত হয়, তখন তার পিতা ইন্তিকাল করেন। ঘটনাটি ১৩৬১  হিজরী মোতাবেক ১৯৪২ সালের। তিনি তখন খসরুইয়াহ মাদরাসার  ছাত্র। আল আযহারে যাওয়ার তখনো দু-বছর বাকি ছিল। পরীক্ষার  আগের রাতে তার পিতার মৃত্যু হয়।  

তিন পুত্র, দুই কন্যাসন্তান নিয়ে ছিল পিতা মুহাম্মদের সাজানো  সংসার। বড় ছেলে আবদুল করীম, যিনি ফরাসিদের বিরুদ্ধে লড়াই  করেন এবং তাদের নাস্তানাবুদ করেন। তার এক পুত্র হলেন আবদুস  সাত্তার, যার অনেক গ্রন্থ রয়েছে এবং উলূমে শরীয়ায় তার অনবদ্য  অংশগ্রহণও রয়েছে। বিশেষ করে লেনদেন ও ইসলামী ব্যাংকের  নীতিমালা-সংক্রান্ত তার গ্রন্থগুলো সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।  

মেজো ছেলে আবদুল গনী, তার পুত্র হলেন ড. হাসান, যিনি  ইসলামের দৃষ্টিতে জেলখানার বিধান ও বন্দীদের সাথে আচরণ নামক  গ্রন্থের রচয়িতা। এটি এ বিষয়ে রচিত সর্বপ্রথম গ্রন্থ। এ ছাড়াও তার  আরও বহু গ্রন্থ রয়েছে।  

তৃতীয় সন্তান হলেন গ্রন্থকার শাইখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ.।  কন্যাদের মধ্যে একজনের নাম শরীফাহ। তার স্বামীর নাম আলহাজ  মুহাম্মদ সালেম বীরকদর রহ.। অপরজনের নাম নাঈমাহ। তার  স্বামীর নাম আলহাজ আলী খাইয়াতাহ। আল্লাহ তাদের সুস্থ সুন্দর  জীবন দান করুন।  

ইলমী মর্যাদা ও উলামায়ে কিরামের প্রশংসা 

সমুন্নত রুচিবোধ, আমল ও সততার পাশাপাশি বিভিন্ন শাস্ত্রে তার  দক্ষতা, ইলমের সেবায় তার অসামান্য অবদান তাঁকে সমসাময়িক  যুগের উলামায়ে কিরামের মাঝে একটি সুউচ্চ মর্যাদার আসন তৈরি  করে দিয়েছিল। তার দোস্তরা যেমন এ মর্যাদার স্বীকৃতি দিয়েছেন,  তেমনি যারা তার মতাদর্শের বিরোধী ছিলেন তারাও এর স্বীকৃতি দিতে  বাধ্য হয়েছেন।  

এখানে তাঁর ব্যাপারে উলামায়ে কিরামের কিছু প্রশংসাবাণী  পাঠকবর্গের সামনে উপস্থাপন করা হলো : 

এক. 

মিসরের প্রধান মুফতী, বিশিষ্ট আলিম ও মুহাক্কিক, অগণিত বিষয়ে  বরেণ্য প-িত জনাব হাসনাইন মাখলুফ রহ. রিসালাতুল মুসতারশিদীন গ্রন্থের প্রথম সংস্করণে নিজের অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে লেখেন, 

গ্রন্থকার হলেন বিশিষ্ট আলিম, প্রাজ্ঞ মুহাক্কিক ও উসতায... ।  অতঃপর আমি আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করছি, তার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। যেহেতু তিনি আপনাকে ইমাম মুহাসিবীর রচিত  ‘রিসালাতুল মুসতারশিদীন’ গ্রন্থটি অমূল্য তাহকীকসহ প্রকাশের তাওফীক দিয়েছেন। আপনি গ্রন্থটিতে এমন-সব বিষয়ে  আলোকপাত করেছেন, যা আপনার অগাধ পা-িত্য, সূক্ষ্ম  গবেষণার প্রমাণ বহন করে। যা এই গ্রন্থের শ্রী বৃদ্ধি করেছে।  গ্রন্থটিকে কল্যাণ ও উপকারিতায় আরও সমৃদ্ধ করেছে।  

এ ছাড়া ৪ জুমাদাল উলা ১৩৮৯ হিজরীতে শাইখ আবদুল ফাত্তাহ  আবু গুদ্দাহ রহ. এর কাছে লিখিত এক পত্রে শাইখের প্রশংসা করে  লিখেছেন : তিনি সচেতন ও নেকদিল আলিমদের অন্যতম। 

দুই. 

বিশিষ্ট মুহাক্কিক আলিম ও মুহাদ্দিস আল্লামা হাবিবুর রহমান আজমী  তার এক চিঠিতে তাকে <يرْرِّحِّ ْالن اَّلَمة َالع) <বিদগ্ধ মহান আলিম)  বলে সম্বোধন করেছেন। এবং তার প্রশংসায় কবিতার দুটি পঙ্ক্তি  রচনা করেছেন : 

اًبَْحرَِ وم ِنََك اهلَِمْدَقِْالً ِبأهال َّشامَِامَا إمَبْال َّشهَِاِلَعََي 

শাহবার হে মহান আলিম, সিরিয়ার হে মহান ইমাম! আপনার শুভাগমনে আপনাকে স্বাগতম ও অভিনন্দন। َشاواآلََثِرِْهقِالفَلْمِو عََِْيْي ِلَِ ذَاك ال َّشامْدعََك ب ِعْمٌَّ َكجيِم হাদীস ও ফিকাহশাস্ত্রকে ওই শামীর পর শামের আর কেউ আপনার ন্যায় সংকলন করেনি। 

এখানে ‘শামী’ বলতে আল্লামা ইবনে আবেদীনকে বোঝানো হয়েছে।  যার রচিত ফিকহের গ্রন্থ ভারতীয় উপমহাদেশের লোকদের নিকট  ফতোয়ায়ে শামী নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এবং গ্রন্থকারকে সবাই  এক বাক্যে আল্লামা শামী হিসেবেই চেনে।  

একবার তিনি শাইখকে লক্ষ্য করে বললেন, হে শাইখ, আমি  আপনাকে আমার মাশায়িখদের মতোই সম্মান করি। আল্লাহ তাদের 

সকলের প্রতি তার রহমতকে অবারিত করে দিন। তাদের জান্নাতের  অভ্যাগতদের কাতারে শামিল করুন।  

তিন. 

শাইখ ফকীহ মুহাম্মদ আবু যুহরা তার পত্রে শাইখকে সম্বোধন করে  লেখেন : 

পর সমাচার.. আপনার একান্ত পুণ্যময় সান্নিধ্যে আমি আমার  জীবনের যে মুহূর্তগুলো কাটিয়েছি সেগুলোই ছিল আমার  জীবনের সৌভাগ্যময় সময়। যে সময়গুলোতে আমি আপনার  মাঝে মুত্তাকীদের ইখলাস, মুমিনদের বিচক্ষণতা, ওলী আউলিয়াদের রিয়াযত-মুজাহাদায় মুরিদদের যে ধৈর্য ও  সহনশীলতা প্রদর্শিত হয় তা প্রত্যক্ষ করেছি।  

ওই সময়গুলোতে আপনার কাছ থেকে যে নিষ্কলুষ আচরণ,  ভালোবাসা, স্নেহ, ও উত্তম সাহচর্য লাভ করেছি আজ সেগুলো  আর কোথাও খুঁজে পাই না।  

চার. 

মহান আলিম, মুহাদ্দিস আবদুল্লাহ ইবনেস সিদ্দিক গামারী রহ.  তার কাছে লিখিত এক পত্রে তার কোনো এক গবেষণা ও  বিশ্লেষণের প্রশংসা করেন। ইবনে আবি হাতেম আল জারহু ওয়াত  তা’দিল গ্রন্থে যাদের আলোচনা করেছেন এবং যাদের আলোচনা  থেকে বিরত থেকেছেন এ বিষয়ের ওপর একটি গবেষণা ও  বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা করেন। তার এ আলোচনার প্রশংসা করে  তিনি শাইখকে আল্লামা ও মুহাদ্দিস বলে উল্লেখ করার পাশাপাশি  বলেন, আপনি এতে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার বিচ্ছুরণ ঘটিয়েছেন। 

পাঁচ. 

মহান ও শ্রেষ্ঠ আলিম, ফকীহ, গবেষক, সুসাহিত্যিক, সম্পাদক,  অগণিত গ্রন্থের রচয়িতা ও মুহাক্কিক শাইখ মুস্তফা যারকা রহ.  ছিলেন শাইখের পুরানো বন্ধু। সফাহাতুম মিন সাবরিল উলামা গ্রন্থটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে শাইখের প্রশংসা করে বলেন : 

আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. আমার প্রাণপ্রতিম বন্ধু।  আমার হৃদয়ের চেয়েও বেশি যাকে ভালোবাসি, ছোট হওয়ার  পরও যাকে আমি সম্মান করি। আল্লাহ তাঁকে হেফাজত করুন,  ইলম-আমল, ইখলাস-তাকওয়া, সম্মান-মহানুভবতায় তাঁকে  ভরপুর করুন। 

হাদীস ও উলূমে হাদীসে ব্রুনাইয়ের সুলতান হাসান বালকিয়ার  আন্তর্জাতিক পুরস্কারের জন্য মুস্তফা যারকা রহ. যখন ব্যক্তি বাছাই  করছিলেন, তখন তিনি শাইখকে এ পুরস্কারের জন্য বাছাই করলেন।  এবং তাঁকে এ পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করার কারণ হিসেবে উল্লেখ  করেন, আমি যাদের চিনি, যাদের সম্পর্কে জানি, যাদের এ পুরস্কারের  জন্য নির্বাচিত করা যেতে পারে, তাদের মধ্যে আমি একটি  তুলনামূলক পর্যালোচনা করে দেখেছি। আমার পর্যালোচনায় যাকে  সবেচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি বলে মনে হয়েছে, যার সূক্ষ্ম গবেষণার পর্যায়ে  এখনো কেউ পৌঁছতে পারেনি, তিনি হলেন বিশিষ্ট আলিম, মুহাক্কিক,  ফযিলাতুশ শাইখ, দৃঢ়চেতা গবেষক, নির্ভরযোগ্য বিশ্লেষক উস্তায  আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ। তার ইলমী যোগ্যতা ও জ্ঞানগত  পারদর্শিতার পাশাপাশি তিনি উত্তম চরিত্র ও উন্নত ইসলামী আদর্শের  ধারক। সম্মানীত আসনের অধিকারী। তার ব্যক্তিত্বের মাঝে উলামায়ে  কিরামের বিনয়, দীন ও শরীয়তের ওপর অবিচলতা ও অনমনীয়তার  সমাহার ঘটেছে। 

শাইখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. এর ইন্তেকালের পর শাইখ  মুস্তফা যারকা যখন শাইখের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন  করেছিলেন, তখন বলেছিলেন, বর্তমান যুগে শাইখের মতো আর  কেউ নেই।  

ছয়.  

বিশিষ্ট মুহাক্কিক আলিম শাইখ সায়্যিদ আহমদ সকর রহ. বলেন,  আখলাক-চরিত্রকে যদি বলা হয় আকৃতি ধারণ করো, তবে দেখা যাবে  সে আবদুল ফাত্তাহের আকৃতিতে দ-ায়মান।

সাত.  

শাইখ আল্লামা মুহাম্মদ শাজিলী আন নাইফির রহ. শাইখের ইন্তেকালে  সমবেদনা জ্ঞাপন করে এক পত্রে লেখেন, মহান আলিম, মরহুম  ইমাম, সম্মানিত ব্যক্তিত্ব শাইখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. এর  মৃত্যুসংবাদ আমাদের ওপর বজ্রপাতের মতো মনে হলো। এর কারণ হলো, তার দীনদারী, সম্মান ও অগাধ পা-িত্য। তিনি ছিলেন ওই  সকল ব্যক্তিদের অন্যতম, যুগের ইতিহাস যাদের নিয়ে গর্ব করে।  

আট. 

বিশিষ্ট ফকীহ ও মুহাক্কিক আলিম, উস্তায মুহাম্মদ হাবীব ইবনুল  খাওজাহ শাইখের কাছে লিখিত এক পত্রে লেখেন, “মহান ব্যক্তিত্ব,  বিজ্ঞজন, মহান আলিম ও সুন্নাহর সংরক্ষণকারী।” 

তার মৃত্যুতে তিনি যে শোকবার্তা প্রেরণ করেন সেখানে লেখেন,  মহান ব্যক্তি, ফকীহ ও মুহাদ্দিস আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. এর  মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত ও মর্মাহত। 

নয়. 

বিশিষ্ট দাঈ ইলাল্লাহ, আল্লাহওয়ালা বিজ্ঞ আলিম শাইখ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. সফাহাতুম মিন সবরিল উলামা গ্রন্থের দ্বিতীয়  সংস্করণে গ্রন্থটি সম্পর্কে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, উচ্চমার্গের চিন্তা-চেতনা, দৃষ্টিভঙ্গির গভীরতা ও বিশালতায়, জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পদচারণায় ও পা-িত্যে যিনি আকাবিরে  উম্মতের প্রকৃত ওয়ারিস, ফযিলাতুশ শাইখ আবদুল ফাত্তাহ আবু  গুদ্দাহ রহ. এর সফাহাতুম মিন সবরিল উলামা গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণে,  এ কিতাব সম্পর্কে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশের এ সুযোগটিকে নিজের  জন্য খুবই সৌভাগ্যের বলে মনে করছি। কারণ, আমি এমন এক  নূরানী সূত্রে নিজের কথাগুলো সংযোজন করতে চলছি, স্মরণকালের  ইতিহাস যার কল্যাণময়তার সাক্ষ্য দিয়ে চলেছে। প্রাচ্য থেকে প্রতীচ্যে  সর্বত্র।  

তিনি তার কোনো এক ছাত্রকে শাইখের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে  গিয়ে তাকে সম্বোধন করে বলেছিলেন, একটা সময় এমন আসবে  যখন তুমি ওই সকল উলামায়ে কিরামের আলোচনা করবে যাদের  সাথে তোমার সাক্ষাৎ হয়েছে এবং এ সাক্ষাৎকে তুমি তোমার জন্য  সম্মান ও ইয্যতের কারণ মনে করবে। সেদিন তুমি গর্বের সাথে  বলবে, আমি শাইখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহর সাক্ষাৎ পেয়েছি।  

দশ. 

বিশিষ্ট আলিম ও মুহাদ্দিস, ফকীহ আবদুর রশিদ নুমানী রহ. শাইখের  কাছে লিখিত এক পত্রে নি¤েœর বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ করে তাঁকে  সম্বোধন করেন, মহান ব্যক্তিত্বের অধিকারী, বিশিষ্ট হাদীস  সমালোচক, গবেষক, অগাধ জ্ঞানের অধিকারী হালবের সৌন্দর্য ও  শোভা। 

এগারো.  

মহান ব্যক্তিত্বের অধিকারী সুদক্ষ ক্বারী, বুযুর্গ ফকীহ, প্রখ্যাত হাফিয  আল্লামা আবদুল ওয়াহাব দামেস্কী রহ. বলেন, যদি পরীক্ষার মাধ্যমে  মুফতী নির্বাচন করা হতো, তবে শাইখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ  রহ. হবেন ফতোয়া প্রদানের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি।  

বারো.  

বিশিষ্ট কারী ও শাইখ কারীম সায়ীদ রাজেহ হাফিজাহুল্লাহ হলেন  দামেস্কের কারীদের উস্তায। তিনি তার শোকবার্তায় আবদুল ফাত্তাহ  আবু গুদ্দাহ রহ.-কে ‘আল্লামাহ’ বলে উল্লেখ করেছেন।  

তেরো.  

দামেস্কের মহান আলিম শাইখ আহমদ নসীব মাহামিদী রহ. তার  শোকবার্তায় তাকে আল্লামাহ, গবেষক, নির্ভরযোগ্য, বিশ্লেষক  অভিধায় উল্লেখ করেছেন, 

তিনি ছিলেন মহান হাদীস-বিশারদ, উসূলবিদ ও সাহিত্যিকদের  অন্যতম। একাধারে আলিম, শিক্ষার্থী ও শিক্ষক। তার মাঝে ইবনুল  মুবারকের চরিত্রমাধুর্যের স্ফুরণ ঘটেছিল, যার বৈশিষ্ট্য ছিল কবর পর্যন্ত  শিক্ষা অর্জন করা।  

চৌদ্দ. 

মরক্কোর মহান আলিম ও মুহাদ্দিস আবদুল্লাহ বিন আবদুল কাদির  তালিদী বলেন, তিনি ছিলেন অগাধ পা-িত্যের অধিকারী, মুহাদ্দিস,  মুহাক্কিক, গবেষক, ও বিজ্ঞ আলিম। জ্ঞানে ও পা-িত্যে, ইলমী  সাধনায় ও গবেষণায়, সম্মান ও মর্যাদায় তিনি যুগের দুর্লভ ব্যক্তি।  সময়ের সুসন্তান ও অনন্য ব্যক্তিত্ব।  

পনেরো. 

বিশিষ্ট উসূলবিদ ও ফকীহ, শাইখ ড. আবদুল ওয়াহাব বিন ইবরাহীম  আবু সুলাইমান মাক্কী। সৌদির হাইআতু কিবারিল উলামার অন্যতম  সদস্য। তিনি বলেন, শাইখ ছিলেন, অগাধ জ্ঞানের অধিকারী  মুহাদ্দিস ও ফকীহ। তিনি ছিলেন ওই সকল মহান আলিমদের  অন্যতম, যাদের মাঝে হাদীসশাস্ত্রের বর্ণনা ও জ্ঞান-সাধনার,  ফিকহশাস্ত্রের মৌলিকতা ও শাখা-প্রশাখার অগাধ জ্ঞানের সমাহার  ঘটেছিল।  

ষোলো.

শাইখ ও ফকীহ আবদুল ফাত্তাহ বিন হুসাইন রাওয়াহ আল মাক্কী রহ.  শাইখ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, তিনি ছিলেন এমন বিজ্ঞ  মুহাদ্দিস, যার ইলম ও আমল, আদব ও বিনয়, বর্ণনা ও গবেষণা,  তাহকীক ও নির্ভরতা, আদর্শ ও মতাদর্শ দেখে বিস্ময়ে হতবাক হতে  হয়।  

শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রতিভা বিকাশের কার্যকারণ 

১. ধার্মিক পরিবার।  

২. সততা, তাকওয়া ও অবিচলতা।  

৩. স্বভাবজাত মেধা।  

৪. স্বভাবজাত রুচিবোধ।  

৫. স্বভাবজাত শিষ্টাচার। 

৬. বিচক্ষণতা ও প্রতুৎপন্নতা 

৭. উত্তম চরিত্র।  

৮. অসাধারণ বিনয়।  

৯. বুদ্ধিমত্তা, প্রজ্ঞা ও উদারনীতি।  

১০. ইলমের প্রতি ভালোবাসা ও জ্ঞানার্জনের প্রতি আসক্তি।  ১১. সুদৃঢ় মনোবল। 

১২. সমকালীন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উলামায়ে কিরামের  সাক্ষাৎ লাভ।  

১৩. উলামায়ে কিরামের নিকট থেকে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ বিষয়গুলো  অর্জন।  

১৪. বিভিন্ন উদ্দেশ্যে অসংখ্য সফর।  

১৫. রচনা ও সংকলনে নিরত থাকা।  

১৬. দরস ও তাদরীসে লিপ্ত থাকা।  

১৭. দাওয়াত ও তাবলীগে ব্যস্ত থাকা, যা তাঁকে স্বদেশ ও  আন্তর্জাতিক পরিম-লে খ্যাতি দান করেছে।  

১৮. তার সুন্দর ও মায়াবী গঠন।  

ব্যক্তিত্ব বিকাশের রহস্য  

১. তাকওয়া ও সততা।  

২. সুন্দরকে গ্রহণ করার রুচিবোধ। 

৩. পূর্ণতা ও পরিপূর্ণতার প্রতি অদম্য আগ্রহ।  

৪. রুচিবোধ।  

৫. শিষ্টাচার ও সুন্দর চরিত্র।  

৬. সময়ের প্রতি যতœশীলতা।  

৭. রচনা, সংকলন ও অধ্যয়নের মাধ্যমে ইলমের প্রচ- পিপাসা।  

৮. তুখোড় মেধা। 

৯. বিস্ময়কর স্মৃতিশক্তি।  

১০. শরীয়তের আলোয় দীপ্তিমান বিবেক।  

১১. প্রখর অনুভূতি-শক্তি।  

ইন্তিকাল 

শাইখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. ৯ শাওয়াল ১৪১৭ হিজরী  রবিবার ভোরে রিয়াদ শহরে মহান রব্বে কারীমের ডাকে সাড়া দেন।  মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ছয়দিন কম একাশি বছর তিন মাস।  আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন। তার আত্মাকে পবিত্র করুন। তার  কবরকে আলোকিত করুন। তার সমাধিকে প্রশান্তিময় করুন।  সমাধিস্থলকে সুরভিত করুন। 

সোমবার যোহর নামাযের পর রিয়াদের রাজেহী মসজিদে তার  জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর বিমানযোগে তাকে মদীনাতুল  মুনাওয়ারায় নিয়ে যাওয়া হয়। ইশার নামাজের পর মসজিদে নববীতে 

তার দ্বিতীয় জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর জান্নাতুল বাকীতে তাকে  দাফন করা হয়। তার জানাযাটি ছিল দেখার মতো। লোকে  লোকারণ্য। সেদিন এত জনসমাগম হয়েছিল যে জান্নাতুল বাকীতে  তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। আগত প্রতিটি মানুষের মুখেই ছিল  শাইখের প্রশংসা ও স্তুতি। শাইখের জন্য দু’আ ও মুনাজাত। সকলের  চোখ ছিল অশ্রুসিক্ত।  

তুর্কিস্তান, হিন্দুস্তান, কাতার ও মরক্কোর বিভিন্ন মসজিদে তার  গায়েবানা জানাযাও অনুষ্ঠিত হয়েছে।  

বিস্তারিত দেখুনঃ https://cutt.ly/L1EjOyb

শাইখুল ইসলাম আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ.-এর বয়ানসমূহ