প্রবন্ধ
শাইখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. জীবন ও কর্ম
শাইখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. জীবন ও কর্ম
[ছফাহাত মিন ছবরিল উলামার বঙ্গানুবাদ থেকে সংকলিত]
মূলঃ
শায়খ সালমান আবু গুদ্দাহ
শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. এর যোগ্য উত্তরসূরি ও পুত্র
অনুবাদ
আবু সাঈদ মুহাম্মদ নু’মান
সাবেক প্রভাষক, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়, উত্তরা, ঢাকা খতিব, আরজতপাড়া জামে মসজিদ, মহাখালী।
শাইখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ
রহ. জীবন ও কর্ম
নাম ও বংশ-পরিচয় :
তার নাম আবদুল ফাত্তাহ। পিতার নাম মুহাম্মদ। পিতামহের নাম বশীর। প্রপিতামহের নাম হাসান বিন আবু গুদ্দাহ। উপনাম : আবু যাহেদ, আবুল ফুতুহ। বংশ-পরম্পরায় তার খান্দান কুরাইশের শাখাগোত্র বনী মাখযুমের সাথে গিয়ে মিলিত হয়। বংশানুক্রমে তিনি হযরত খালিদ বিন ওয়ালীদ রাযি. এর বংশের এক গর্বিত সন্তান।১
নামকরণের কারণ :
তার নামকরণ নিয়ে একটি মজার ঘটনা রয়েছে। তার পিতা ও পিতামহের কাপড়ের ব্যবসায় ছিল। যেদিন তিনি জন্মগ্রহণ করেন সেদিন তারা এক হাজার থান ‘সায়াত’ কাপড় বিক্রি করেছিলেন। এতে তাদের পরিবারে অভাবনীয় আনন্দ নেমে আসে। একদিকে নতুন অতিথির আগমন অপরদিকে অপ্রত্যাশিত রিযিক। তারা নবজাতকের আগমনকেই এ অপ্রত্যাশিত বরকতের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন। এ হিসেবে তার নাম রাখেন আবদুল ফাত্তাহ। অর্থাৎ ফাত্তাহ—যিনি মানুষের জন্য অভাবনীয় রিযিকের দুয়ার অবারিত করে দেন সেই মহান সত্তা আল্লাহ তাআলার বান্দা।
১. আমাদের পারিবারিক পরিচয় সংরক্ষণকারী বংশ-তালিকায় এমনটিই পেয়েছি। আমার পিতার মুখেও বহুবার এমনটিই শুনেছি। -সালমান।
জন্ম :
তাঁর মায়ের বর্ণনামতে তিনি ১৯১৭ ইংরেজি মোতাবেক ১৩৩৬ হিজরীর রজব মাসের মাঝামাঝি সময়ে হালব শহরে জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিক অবস্থান :
তার পরিবারটি মধ্যবিত্ত হলেও নিজস্ব পরিম-লে এ পরিবারের একটি সুনাম-সুখ্যাতি ছিল। তার পিতা ও পিতামহ কাপড়ের ব্যবসায় করতেন। নিজেদের হাতেই তারা ‘সায়াত’ নামক একধরনের উন্নতমানের কাপড় বুনতেন এবং সেগুলো বাজারে বিক্রি করতেন। এ কাপড়ে কখনো নিরেট সুতা, কখনো-বা রেশমি সুতা ব্যবহার করা হতো। বাজারে এর চাহিদাও ছিল প্রচুর। এ কাপড় বুননে চমৎকার, ব্যবহারে আরামদায়ক ও টেকসই হওয়ার কারণে দেশের গ-ি পেরিয়ে বাইরেও এর একটি বাজার তৈরি হয়েছিল। সে সময় তুর্কিস্তানের— এশিয়া মাইনর যার আরেক নাম—আনাতুলিয়ায় বাণিজ্যিকভাবে এ কাপড় রপ্তানি হতো। সেখানকার নারী-পুরুষ উভয়েই এ কাপড়ের পোশাক পরিধান করত। কয়েক পুরুষ থেকে তাদের পরিবার এ তাঁতশিল্পের সাথে জড়িত ছিলেন। আর্থিকভাবে একদম সচ্ছল না হলেও মোটামুটি মধ্যম সারির সচ্ছল ছিলেন। তবে মার্জিত আচার
আচরণ, পরিশীলিত জীবনবোধ ছিল তাদের পারিবারিক ঐতিহ্য। ধার্মিক পরিবার হিসেবেও এই পরিবারের একটি সুখ্যাতি ছিল। নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকার ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা, সন্তানদের ইসলামী ঐতিহ্যের ওপর লালন-পালন করা ছিল এ পরিবারের আদর্শ। আল্লাহ তাআলা তাদের সন্তানদের
পক্ষ থেকে তাদের উত্তম বিনিময় দান করুন। আমীন। ব্যবসার হালাল রুজি থেকেই এ পরিবারের খরচ মিটত। দীর্ঘদিন তারা যে কাপড়ের ব্যবসায় জড়িত ছিলেন একসময় সে কাপড়ের ব্যবসা মন্দার শিকার হলো। তুর্কিদের পোশাকে ইংরেজদের পোশাক
প্রভাব বিস্তার করল। এতে তুর্কিস্তানে ‘সায়াত’ কাপড়ের বাজারে ধস নামল। ফলে বাধ্য হয়ে তার পিতা হালবের বানকুসা সড়কে অবস্থিত যাহরা মার্কেটে একটি দোকান ক্রয় করেন। সেখানে তিনি বিভিন্ন ধরনের তৈরি-পোশাক বিক্রি করতেন। হালবের গ্রাম্য লোকজন ছিল সে পোশাকের ক্রেতা।
তার পরিবারের মূল বসতভিটা ছিল জুবাইলা গ্রামে। সেখানে একখ- জমির ওপর সাধারণ একটি বাড়ি ছিল। এটি মূলত গুদ্দাহ পরিবার ও তার কিছু নিকটাত্মীয় উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তার পিতামহ বশীর ছিলেন একজন বিচক্ষণ, জ্ঞানী, স্পষ্টভাষী সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। তিনি তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে জমিটিতে যাদের মালিকানা রয়েছে তাদের কাছ থেকে জমিটি কিনে নেন। কিনে নেয়ার প্রক্রিয়াটি ছিল বিস্ময়কর। শরীয়া আদালত থেকে তিনি একজন কেরানি নিয়ে আসলেন। তারপর সমাজের সম্ভ্রান্ত ও মান্যবর কিছু ব্যক্তির উপস্থিতিতে সেই জমির মালিকদের ডাকলেন এবং প্রত্যেকের দাবি মিটিয়ে জমিটি নিজের অধিকারে নিয়ে নেন। এরপর পুরাতন ভবন ভেঙে নতুন একটি ভবন নির্মাণ করেন। নতুন ভবনটি যেমন ছিল দৃষ্টিনন্দন তেমনি এর স্থাপত্যশৈলীও ছিল চমৎকার। এতে সাতটি কক্ষ ছিল। কক্ষগুলো বেশ প্রশস্ত ও সুন্দরভাবে সাজানো-গোছানো ছিল। যার কারণে অনেকেই এটিকে বিবাহের হল হিসেবে ব্যবহার করত। আবদুল ফাত্তাহ রহ. যখন এ বাড়ির মালিকানা লাভ করেন তখন তার বয়স ছয় থেকে আটের মধ্যে ছিল। তিনি তার পিতামহ বশীর সম্পর্কে বলতেন, তিনি তার পুত্র মুহাম্মদের তুলনায় অনেক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন। তার পিতামহ প্রায় ৮৫ বছর জীবন লাভ করেছিলেন। পিতামহের মৃত্যুর সময় তিনি ছিলেন বিশ বছরের টগবগে যুবক। তিনি পিতামহের খুবই অনুগত ছিলেন। শেষ-বয়সে তার দাদা যখন ঘর-বসা হয়ে গিয়েছিলেন তখন তিনিই ছিলেন দাদার ভরসা। তিনি যেদিকে যেতেন সাথে করে নাতিকে নিয়ে যেতেন। নাতিই ছিল তার
হাতের লাঠি। তার দাদা যখন মৃত্যুবরণ করেন তখন তিনি সবে পড়ালেখা শুরু করেছেন। তার লেখাপড়া শুরু করতে বেশ দেরি হয়েছিল। যখন তিনি শিক্ষাজীবন শুরু করেন, ততদিনে তার জীবন থেকে উনিশটি বসন্ত অতিবাহিত হয়ে গেছে। তার বয়স যখন পঁচিশে উপনীত হয়, তখন তার পিতা ইন্তিকাল করেন। ঘটনাটি ১৩৬১ হিজরী মোতাবেক ১৯৪২ সালের। তিনি তখন খসরুইয়াহ মাদরাসার ছাত্র। আল আযহারে যাওয়ার তখনো দু-বছর বাকি ছিল। পরীক্ষার আগের রাতে তার পিতার মৃত্যু হয়।
তিন পুত্র, দুই কন্যাসন্তান নিয়ে ছিল পিতা মুহাম্মদের সাজানো সংসার। বড় ছেলে আবদুল করীম, যিনি ফরাসিদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন এবং তাদের নাস্তানাবুদ করেন। তার এক পুত্র হলেন আবদুস সাত্তার, যার অনেক গ্রন্থ রয়েছে এবং উলূমে শরীয়ায় তার অনবদ্য অংশগ্রহণও রয়েছে। বিশেষ করে লেনদেন ও ইসলামী ব্যাংকের নীতিমালা-সংক্রান্ত তার গ্রন্থগুলো সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
মেজো ছেলে আবদুল গনী, তার পুত্র হলেন ড. হাসান, যিনি ইসলামের দৃষ্টিতে জেলখানার বিধান ও বন্দীদের সাথে আচরণ নামক গ্রন্থের রচয়িতা। এটি এ বিষয়ে রচিত সর্বপ্রথম গ্রন্থ। এ ছাড়াও তার আরও বহু গ্রন্থ রয়েছে।
তৃতীয় সন্তান হলেন গ্রন্থকার শাইখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ.। কন্যাদের মধ্যে একজনের নাম শরীফাহ। তার স্বামীর নাম আলহাজ মুহাম্মদ সালেম বীরকদর রহ.। অপরজনের নাম নাঈমাহ। তার স্বামীর নাম আলহাজ আলী খাইয়াতাহ। আল্লাহ তাদের সুস্থ সুন্দর জীবন দান করুন।
শৈশব ও শিক্ষাজীবন
আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. তার পিতার ক্রোড়েই লালিতপালিত হয়েছেন। তিনি এমন এক পিতার ¯েœহ ও শাসন-অনুশাসনের মাঝে
বেড়ে উঠেছেন, যিনি সর্বদা কুরআন তিলাওয়াতে মশগুল থাকতেন এবং দেখে দেখে কুরআন তিলাওয়াতের প্রতি গুরুত্ব দিতেন। উলামায়ে কিরামের প্রতি মুহাব্বত রাখতেন। তাদের কাছে যাতায়াত করতেন। তাদের দরস ও মজলিসে বসতেন। বিভিন্ন বিষয়ে তাদের থেকে পরামর্শ নিতেন। তাদের ইলম দ্বারা উপকৃত হতেন।
আট বছর বয়সে তার দাদা তাঁকে একটি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করে দেন। যেখানে বিশেষ করে আরবী ও ইসলামী বিষয়ে পাঠদান করা হতো। এ প্রতিষ্ঠানটির ব্যয়ভার ছিল প্রচুর। সেখানে ভর্তি হওয়া ছিল দুষ্কর। প্রতিষ্ঠানটির যেমন নামডাক ছিল তেমনি এর পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনাও ছিল খুবই সুশৃঙ্খল। শিক্ষা-দীক্ষার মান ছিল উন্নত। যার ফলে কেবল সমাজের উচ্চশ্রেণি ও সচ্ছল ব্যক্তিরাই তাদের সন্তানদের সেখানে ভর্তি করানোর সুযোগ পেত।
এ প্রতিষ্ঠানে তিনি প্রথম শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত বেশ সুনামের সাথে অধ্যয়ন করেন। এরই মধ্যে তিনি বিশুদ্ধরূপে পড়া ও লেখার কৌশল রপ্ত করে নিয়েছিলেন। যদিও তার হস্তাক্ষরের আরও অনেকটা পরিমার্জন প্রয়োজন ছিল।
তার এই সুন্দর ও বিশুদ্ধ পড়তে পারা তাকে বড়দের ¯েœহ ও আস্থা অর্জনে সহায়তা করেছে। সে সময় রাতের বেলা গল্পের আসর বসত। সপ্তাহে একদিন জমত এ আসর। এতে সমাজের নামি-দামি, জ্ঞানী- গুণী লোকজন জড়ো হতো। সে সকল আসরে তাদের জ্ঞানগর্ভ আলোচনার সাথে ওয়াকেদীর রচিত ফুতুহুশ শাম গ্রন্থটি বা অন্য যেকোনো গ্রন্থ থেকে পাঠ করা হতো। এ গ্রন্থটি পাঠ করার জন্য প্রায়ই তার ডাক পড়ত। তিনিও সানন্দে বড়দের মাঝে বসে পাঠ করে শোনাতেন। এতে করে মহল্লার সর্বকনিষ্ঠ হয়েও তিনি সমাজের সম্ভ্রান্ত, জ্ঞানী-গুণী ও বিশিষ্টজনদের ¯েœহাশিস লাভ করেন। তখন তার বয়স বড়জোর দশ কি এগারো হবে।
একদিকে তিনি ছিলেন ছোট অপরদিকে তার বাচনভঙ্গি, শব্দের উচ্চারণ ও পাঠ ছিল বিশুদ্ধ ও সুন্দর। অন্য একটি কারণও এতে জড়িত ছিল, যা তাকে এ ছোট্ট বয়সেই সমাজের সম্ভ্রান্ত ও জ্ঞানীদের মজলিসে স্থান করে নিতে সহায়তা করেছে, সেটি হলো তার পিতা ও পিতামহের সামাজিক অবস্থান।
ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে চলে আসার পর বিশেষভাবে তিনি হস্তাক্ষর সুন্দর করার দিকে মনোযোগী হলেন। এ উদ্দেশ্যে হালবের খতীব শাইখ মুহাম্মদ আলীর মাদরাসায় ভর্তি হলেন। এ মাদরাসাতে বিশেষ করে কুরআন, ফিকহ ও সুন্দর হস্তাক্ষর শেখানো হতো। এ মাদরাসায় ভর্তি হওয়ার পর তার হস্তাক্ষরে বেশ উন্নতি হয়। কিন্তু হস্তাক্ষর সুন্দর করার জন্য যে পরিমাণ সময় ও অধ্যবসায়ের প্রয়োজন, সে পরিমাণ অধ্যবসায় ও সময় তিনি ব্যয় করতে পারেননি। কয়েক মাস পরই তিনি সেখান থেকে চলে আসেন।
ইতিমধ্যে তার বয়সও অনেকটা বেড়েছে, শরীরের শক্তি-সামর্থ্য মজবুত হয়েছে। তার পিতা ও পিতামহ চাইলেন তাদের সন্তান যেন কোনো ‘হাতের কাজ’ শিখে রাখে। তারা বলতেন, ‘হাতের কাজ’ শিখে রাখার অর্থ হলো দরিদ্রতা থেকে মুক্তির কৌশল জেনে রাখা। যদিও সে সময় পরিবারের সচ্ছলতার কারণে তিনি অসচ্ছল ছিলেন না। তবুও তার পিতা ও পিতামহ কালের বিবর্তন থেকে গাফেল ছিলেন না। কারণ, যুগের ঘূর্ণিপাকে অনেক সম্ভ্রান্তব্যক্তিকে পথে বসতে হয়েছে বা হয়। তাই তারা চাইলেন তাদের সন্তান কোনো-না- কোনো হস্তশিল্পে পারদর্শী হয়ে উঠুক। যা তাকে অনাহূত পরিস্থিতিতে দারিদ্র্যের লাঞ্ছনা থেকে মুক্তি দেবে। তিনি হস্তচালিত বুনন-কর্ম শিখলেন। সে সময় কলের তৈরি তাঁত ছিল না। সব কাপড়ই হস্তচালিত তাঁতে তৈরি হতো। অল্প দিনেই তিনি এ পেশায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। তার দুই সহোদর আবদুল করীম ও আবদুল গনী তাকে এ তাঁত কীভাবে চালাতে হয়, কীভাবে কাপড় বুনতে হয় তা শিখিয়ে
দেন। সে সময় এটি একটি সম্মানজনক শিল্প হিসেবে পরিগণিত হতো। যারা এ কাজে পারদর্শী ছিল তারা নিজেদের এ জন্য বেশ গর্বিত মনে করত। তিনিও আনন্দের সাথে এ পেশা আয়ত্ত করে নেন এবং উছমানী আমলের কিছু স্বর্ণমুদ্রাও কামাই করতে সক্ষম হন। এ স্বর্ণমুদ্রাগুলো একান্তই তার নিজস্ব ছিল। এতে পরিবারের কোনো দাবি ছিল না। উপরন্তু তার ভরণ-পোষণ ও ব্যয়ভার তার পিতাই বহন করতেন। প্রায় দুই কি তিন বছর তিনি এ পেশায় একজন সফল ও সার্থক শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। এককথায় যাকে বলে পেশাদার শ্রমিক।
কিছুদিন পর তার পিতা ও পিতামহ তাঁকে ব্যবসায় জড়াতে চাইলেন। তারা চাইলেন তিনি যেন ব্যবসায়ও পারদর্শী হয়ে ওঠেন। এ জন্য তারা তাঁকে তাদেরই এক পরম ব্যবসায়ী বন্ধু আবদুস সালাম কুদ্দু’ এর নিকট পাঠিয়ে দিলেন। হালবের তাইবাহ বাজারে জামে মসজিদের উত্তর গেইটে তার একটি তৈরি-পোশাকের দোকান ছিল। তিনি পাইকারী ও খুচরা মূল্যে পোশাক বিক্রি করতেন। নারী-পুরুষ সকলেই তার দোকান থেকে কাপড় কিনত। ভদ্রলোক খুবই দীনদার ও আমানতদার ছিলেন। আবদুল ফাত্তাহ রহ. সেখানে কাজ শুরু করলেন। বয়সের স্বল্পতা বিবেচনায় দোকানদার তার অবস্থানকে নিজের জন্য গনীমত মনে করলেন। যেহেতু নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ তার দোকান থেকে নিজেদের পছন্দমাফিক পোশাক খরিদ করত, তাই সেখানে পোশাক চুরি হওয়ার আশঙ্কাও বেশি ছিল। তার কাজ ছিল ক্রেতাদের ওপর নজর রাখা। এভাবে সেই দোকানে প্রায় দুই বছরেরও অধিক সময় অতিবাহিত করেন।
এরপর তার পিতা ও পিতামহের আরেক ব্যবসায়ী বন্ধু ও নিকটাত্মীয় আলহাজ হাসান তাব্বানের কাছে চলে যান। ভদ্রলোক ছিলেন একজন পাইকারী ব্যবসায়ী। হালবের যে সকল বাজারে ব্যবসায়ীদের জন্য ছাউনি দেওয়া ছিল তার মধ্যে ‘জুখুল আরিদ’ ছিল অন্যতম। এখানে
তার একটি দোকান ছিল। তিনি (লেখক) এ দোকানে প্রায় তিন বছর কাজ করেন। এর মধ্য দিয়ে ব্যবসার সকল কলাকৌশল রপ্ত করে নেন। কীভাবে পাইকারদের কাছ থেকে কাপড় কিনতে হয়, কীভাবে ক্রেতাকে কাপড় দেখাতে হয়, এর সবই শিখে নিলেন।
এ দীর্ঘ সময়ে তিনি ব্যবসায় শিখে নিয়েছিলেন। অপরদিকে তার বয়সও ষোলোর কোটা অতিক্রম করেছিল। তার পিতা ও পিতামহ চাইলেন, এবার যেন তিনি নিজেই নিজের কোনো ব্যবসা সামলে নেন। তাই প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁকে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আলহাজ মুহাম্মদ দুনিয়ার সাথে শ্রমের অংশিদারত্বে ব্যবসায় শরীক করে দেন। ভদ্রলোক ছিলেন বানকূসা সড়কে অবস্থিত যাহর মার্কেটের একজন ব্যবসায়ী। তার সাথে প্রায় দুই বছর শ্রমের শরীকে ব্যবসা করেন। অর্থাৎ মূলধনে তার কোনো অংশ ছিল না, কিন্তু শ্রমের বিনিময়ে যে লাভ হতো তাতে তার অংশ থাকত। দিনের বেশির ভাগ সময় তিনি দোকানে কাটাতেন। দোকানের মাল শেষ হয়ে গেলে ‘খান কুমরুক’ সহ অন্যান্য পাইকারী বাজার থেকে কিংবা পাইকারদের থেকে মাল কেনার দায়িত্বটাও তিনি পালন করতেন। এভাবেই চলছিল তার জীবন। দেখতে দেখতে তার বয়স উনিশে উপনীত হলো। হঠাৎ তার মনে আবার লেখাপড়ার করার ইচ্ছা জাগল।
তিনি চাইলেন ব্যবসা ছেড়ে মাদরাসা খুসরুইয়্যায় এসে ভর্তি হবেন। উছমানী সা¤্রাজ্যের উযিরে আ’লা খুসরু পাশা মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু কালপরিক্রমায় মাদরাসাটি তার জৌলুশ হারিয়ে ফেলে। পরবর্তী সময়ে এটিকে ‘আছছানাওয়িয়্যাতুশ শরইয়্যাহ’ নামে নামকরণ করা হয়। কিন্তু প্রথম দিকে তার পিতা কিছুতেই রাজি হলেন না। তখন তিনি তার চেনা-জানা কয়েকজন সম্ভ্রান্তব্যক্তিকে দিয়ে পিতার কাছে সুপারিশ করালেন। তারা তার পিতাকে বোঝালেন যে, আপনার উচিত তাকে উৎসাহিত করা। ছেলে যখন নিজের থেকেই
লেখাপড়া করতে চাইছে, তখন আপনার বাধা দেওয়া উচিত নয়; বরং এ মহৎ কাজের জন্য তাঁকে অনুপ্রাণিত করাই আপনার কর্তব্য। এরপর তিনি যখন খুসরুইয়্যাহ মাদরাসায় ভর্তি হতে চাইলেন, মাদরাসা কর্তৃপক্ষ প্রথমে রাজি হলেও পরবর্তী সময়ে তারা তার বয়স দেখে আর ভর্তি করতে চাইল না। কারণ, তার বয়স তখন আঠারো পার হয়ে গিয়েছিল। তখন তার পিতা তার ভগ্নিপতি আলহাজ মুহাম্মদ সালেম বীরকদরকে বিষয়টি অবগত করলেন। সে সময় তিনি ওয়াক্ফ মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপক ছিলেন। তিনি তার কয়েকজন বন্ধুকে বিষয়টি জানালেন। তারা মাদরাসা কর্তৃপক্ষ ও ভর্তি-কমিটির সাথে এ নিয়ে আলাপ করলেন। অবশেষে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ তাকে ভর্তি করতে সম্মত হলেন। তবে তার নাম ওয়েটিং লিস্টে ঝুলিয়ে রাখলেন। সেখানে আরেকজনের নামও ছিল। তিনি হলেন শাইখ আবদুল ওয়াহ্হাব। একজনকে ভর্তি করা হলে অপরজনকে পরবর্তী বছরের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। অবশেষে আবদুল ফাত্তাহ রহ. এর ভর্তি চূড়ান্ত হলো। তবে উভয়ের মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব ছিল। শাইখ আবদুল ফাত্তাহ রহ. এর মধ্যে আরবী ভাষা ও ভাষাতত্ত্ব শেখার প্রতি প্রচ- আগ্রহ ছিল। তাই শাইখ আবদুল ওয়াহ্হাব রসিকতা করে তাঁকে ‘আসমায়ী’ বলে ডাকতেন।
মহল্লায় একজন ভদ্রলোক ছিলেন। মাহমুদ সালহাদার। তিনি প্রতিদিন নিজ গৃহে একবার পুরো কুরআন কারীম খতম করাতেন। এটিকে ‘রাবআহ’ বলা হতো। যারা তিলাওয়াত করত, ভদ্রলোক তাদের একটি করে স্বর্ণমুদ্রা দিতেন। আবদুল ফাত্তাহ রহ. খুসরুইয়্যাহ মাদরাসায় অধ্যয়নকালে কুরআন তিলাওয়াতের এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন। এ মাদরাসায় তিনি ১৯৩৬ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত মোট ছয় বছর অধ্যয়ন করেন। এ ছয় বছর পড়ালেখায় কেউ তাঁকে পেছনে ফেলতে পারেনি। সর্বদাই তিনি তার সহপাঠীদের চেয়ে অগ্রগামী ছিলেন।
এরপর ১৯৪৪ সালে সেখান থেকে মিসরের আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে শরীয়া অনুষদে ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালে শরীয়া অনুষদ থেকে ‘আলিমের সনদ’ অর্জন করেন। এরপর ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী ভাষা অনুষদে ‘তাখাস্সুসু উসূলুততাদরীস’ বিষয়ে দুই বছর অধ্যয়ন করেন। ১৯৫০ সালে মনোবিজ্ঞানের সনদসহ ওই অনুষদ থেকে লেখাপড়া সমাপ্ত করেন। এরপর নিজ দেশে ফিরে যান।
আবদুল ফাত্তাহ রহ. তার পিতার ইনতিকালের পর কঠিন আর্থিক সংকটের মুখে পতিত হন। এমনও সময় অতিবাহিত হয়েছে যে, কেবল পরিধেয় বস্ত্র ব্যতীত তার কাছে আর কিছুই ছিল না। তার কিতাব কেনার বিশেষ ঝোঁক ছিল, মিসরে আল জামেউল আযহারে অধ্যয়নকালে ফলফলাদি না কিনে তা দিয়ে কিতাব কিনে পড়তেন। ফিকহী মাযহাব :
আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. ছিলেন হানাফী মাযহাবের একনিষ্ঠ অনুসারী। এ মাযহাবের অনুশাসনের ওপরই তার জীবনের ভিত্তি রচিত হয়েছে। এ মাযহাবকেই তিনি গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছেন। এ মাযহাবকে আত্মস্থ করতে গিয়ে তিনি বহু মাশায়েখের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছেন। এ ক্ষেত্রে ফকীহ শাইখ মুস্তফা যারকা, শাইখ মুফতী আহমদ আল হাজ্জী কুরদীর নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। আহমদ আল হাজ্জি ছিলেন হালবে হানাফীদের মুফতী। এ ছাড়া তার ব্যক্তিগত পর্যায়েও হানাফী মাযহাবের গ্রন্থাবলির দীর্ঘ অধ্যয়ন ছিল। তিনি প্রতিটি গ্রন্থের গভীরে প্রবেশের চেষ্টা করতেন, তারপর সেগুলোর ওপর নিজের মন্তব্য, দৃষ্টিভঙ্গি ও টীকা সংযোজন করতেন। এ ছাড়া শাফেয়ী মাযহাবের ওপরও তার অসামান্য পা-িত্য ছিল। শাম অ লে এ দুটি মাযহাবেরই চর্চা রয়েছে।
তার অন্যতম শিষ্য শাইখ মুহাম্মদ আওয়ামাহ হাফিজাহুল্লাহ ইছনাইনিয়্যাহে২বলেন, আমি শাইখ আবদুল ফাত্তাহ রহ. এর এমন
২. ইছনাইনিয়্যাহ, ১১/৬২০। ينْنَْاإلث م وْي)ে َসামবার) এর দিকে সম্পৃক্ত করে এ গ্রন্থটি ইছনাইনিয়্যাহ বলা হয়। এটি মূলত হিজাযের মহান শায়খ আবদুল মাকসুদ বিন মুহাম্মদ সায়িদ খুজাহ প্রতি সোমবার জিদ্দাস্থ তার নিজস্ব বাসভবনে যে সংবর্ধনার আয়োজন করতেন তারই সংকলিত রূপ। এ অনুষ্ঠানে তিনি এ উম্মতের এমন-সব আলেম-উলামা, কবি-সহিত্যিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে সংবর্ধনা জানাতেন, যাদের ব্যাপারে অধিকাংশ মানুষ কেবল তখনই জানতে পারত যখন তারা পরপারে পাড়ি জমাতেন এবং তাদের নামগুলো ইতিহাসের পাতায় সংরক্ষিত হতো। শায়খ আবদুল মাকসুদ (আল্লাহ তাঁর প্রতি রহম করুন) এ দায়িত্বটি সুচারুরূপে আঞ্জাম দেন। ওই সকল আলেম-উলামা, কবি-সাহিত্যিকের যথার্থ পরিচয় জাতির সামনে তুলে ধরেন। এরপর তিনি সোমবারের সেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের বিভিন্ন ঘটনা পরিক্রমা কাগজের পাতায় সংরক্ষণ করেন, যা ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ উপাদান হয়ে কয়েক ভলিউমে প্রকাশিত হয়েছে।
সেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের রীতি ছিল—শায়খ মাকসুদ প্রথমে অভ্যাগতকে স্বাগত জানাতেন, তাকে অভিবাদন করতেন, তারপর উপস্থিত লোকদের সামনে তার পরিচয় তুলে ধরতেন। এরপর সংবর্ধিত অতিথির সাথে আগত তার বন্ধু-বান্ধবদের কয়েকজনকে স্টেজে ডেকে আনতেন। তার সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য, তার কীর্তিগাথা তুলে ধরার জন্য। সংবর্ধিত ব্যক্তির অনন্য বৈশিষ্ট্য ও গুণাগুণ সম্পর্কে যা কিছু তাদের জানা আছে উপস্থিত জনতার সামনে পেশ করার জন্য। এরপর সংবর্ধিত ব্যক্তি তার বক্তব্য পেশ করতেন। তার বক্তব্য শেষ হলে চলত প্রশ্নোত্তর পর্ব।
এরপর শায়খ আবদুল মাকসুদ অতিথির হাতে সংবর্ধনা-ক্রেস্ট তুলে দিতেন। এ সংবর্ধনা-ক্রেস্টটি ছিল কা’বা শরীফের গিলাফের একটি টুকরা। যার অপর পাশে কিছু বক্তব্য লেখা থাকত। খানায়ে কা’বার গিলাফের মাধ্যমে কাউকে সংবর্ধনা দেয়ার অর্থই হলো তাকে সর্বোচ্চ সম্মাননা প্রদান করা। আল্লাহ তাকে উত্তম বিনিময় দান করুন।
শায়খ আবদুল ফাত্তাহ রহ.-ও এ সংবর্ধনা পেয়েছিলেন ১৫/১১/১৪১৪ হিজরীতে। সেটি ছিল ১৫২তম সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। সে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে শায়খ সম্পর্কে যারা আলোচনা করেছিলেন, শাইখের গুণ ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছিলেন, তারা সকলে ছিলেন দেশের খ্যাতিমান আলেম, প্রখ্যাত কবি-সাহিত্যিক ও বিদ্যান ব্যক্তি। যাদের পুরোধায় রয়েছেন আলী তানতাবী, মুস্তফা যারকা, মুহাম্মদ আলী হাশেমী, মুহাম্মদ আওয়ামাহ, আহমদ আল বারা আল আমিরী, আমীন আবদুল্লাহ
কিছু আলোচনা সম্পর্কে জানি, যেখানে তিনি প্রশ্নকারীকে শাফেয়ী মাযহাবের বিভিন্ন গ্রন্থের প্রান্তটীকার অনেক সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম শাখা-প্রশাখাগত বিষয়ে ইঙ্গিত প্রদান করেছেন।
ইসলামী ফিকহের সকল অঙ্গনেই তার পদচারণা লক্ষ করার মতো। আহকাম-সংক্রান্ত হাদীস নিয়ে তার দীর্ঘ অধ্যাপনা তার জন্য বিষয়টিকে আরও সহজ করে দিয়েছে। এ কারণে যারা তাঁকে নিকট থেকে দেখেছেন, তারা বিধিবিধানের ক্ষেত্রে তার দৃষ্টির প্রসারতা ও উদারতা লক্ষ করেছেন। এ উদারতা ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারতা ফতোয়া প্রদান ও প্রয়োগিক ক্ষেত্রে কোনোরূপ শিথিলতা নয়। তবে কেউ কেবল সহজ বিষয়গুলোর অনুসন্ধান করবে, সেগুলোর ওপর আমল করবে, অথবা শায ও প্রত্যাখ্যাত বিষয়গুলো গ্রহণ করবে, এ বিষয়টি তিনি অপছন্দ করতেন।
তার পুত্র সালমান বলেন, আমার পিতা রহ. কেবল সহজ বিষয়গুলোর অনুসন্ধান করা, প্রত্যাখ্যাত বিষয়গুলো গ্রহণ করাকে অপছন্দ করতেন। যেমনটি শাইখ আওয়ামাহ হাফিজাহুল্লাহ বলেছেন। অনুরূপ তিনি গোঁড়া হানাফীও ছিলেন না। একতরফাভাবে হানাফী মাযহাবের পক্ষপাতিত্ব করতেন না; বরং এ-জাতীয় পক্ষপাতিত্বকে তিনি অপছন্দ করতেন। এ ক্ষেত্রে তার ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। হানাফী মাযহাবের সিদ্ধান্ত থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কিছু ঘটনা এমন রয়েছে, যা আমার ও তার মাঝে ঘটেছে। আবার কিছু ঘটনা এমনও রয়েছে, যা আমার সামনে ঘটেছে। এ বিষয়ে তিনি দুটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছেন। একটি হলো ইবনে তাইমিয়্যাহ রহ. রচিত يْ َْمِ ِْ < لسَُْ َْي املبَِةاأللْفُ অপরটি رسالة >
ফারকূরী, মুহাম্মদ যিয়া সাবূনী প্রমুখ। তার এই সংবর্ধনা-অনুষ্ঠানের বিষয়টি ইছনাইনিয়্যাহ এর ১১তম ভলিউমের ৫৯৬ নং পৃষ্ঠায় রয়েছে। দুঃখের বিষয় হলো তিনি তা ছাপার অক্ষরে দেখে যেতে পারেননি। তার মৃত্যুর পর তা ছাপা হয়েছিল।
< رس ِএ দুটি গ্রন্থ ফিকহী
হলো ইমাম ইবনে হাযম বিরচিত ة <
َامَاإلمُالَةَ
মতবিরোধ বিষয়ে রচিত।
ইছনাইনিয়্যাহর৩ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, ফিকহী মাসআলার ক্ষেত্রে সব সময়ই উলামায়ে কিরামের মধ্যে বিভিন্ন মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। চার মাযহাবের কোনো-না-কোনো একটির সাথে তারা সম্পৃক্ত। মাযহাবের গ-িতে থেকেই তারা বিষয়টির সমাধান পেশ করতে চান। মাযহাবের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে তারা বিষয়টি নিয়ে বিবেচনা করতে প্রস্তুত নন। যে কারণে ফিকহী বিষয়গুলো আরও জটিল আকার ধারণ করে। এ বিষয়ে জনাবের মতামত কী?
তখন তিনি বললেন, যারা ইজতিহাদের যোগ্যতা রাখেন না, শরীয়তের বিধিবিধান, এর উৎস-মূল এবং শাখা-প্রশাখা সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখেন না, তাদের জন্য কোনো-না-কোনো মাযহাব অনুসরণ করা আবশ্যক। এ আবশ্যকীয়তা আল কুরআনের এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
َن وُلَمْْم ََل تَعتِّ ْن ُكْنُ إِّْه َل ال ذِّ ْكرَوا ألَُأَْفاس
তোমরা যদি না জানো তবে যারা জানে তাদের জিজ্ঞাসা করো। কিন্তু শুধু একটি মাযহাবের অনুসরণ করা, শুধু সে মাযহাবের বিষয়গুলোকেই আঁকড়ে থাকা শরীয়তে অপরিহার্য নয়। তাই আমার জন্য কোনো মাসআলার সমাধান যেমন ফিকহে হাম্বলী থেকে গ্রহণের সুযোগ রয়েছে তেমনি সুযোগ রয়েছে ফিকহে শাফেয়ী থেকে গ্রহণ করার। অনুরূপভাবে কোনো মাসআলার ক্ষেত্রে যদি ফিকহে হাম্বলীতে জটিলতা পরিলক্ষিত হয় আর ফিকহে হানাফীতে সে জটিলতা না থাকে তবে আমার জন্য ফিকহে হানাফীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমল
৩. ইছনাইনিয়্যাহ, ১১/৬৩৯
করার সুযোগ রয়েছে। এ পুরো বিষয়টি হলো আল্লাহর নির্দেশ ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাহর অনুসরণ। এ ক্ষেত্রে কোনো ইমামের মধ্যে সামান্যতম মতবিরোধ নেই। প্রত্যেক ইমাম তার ইজতিহাদকে আল্লাহর কালাম ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাহর কাছাকাছি রাখতে তাদের সাধ্যের সবটুকুই ব্যয় করেছেন। তাই তো দেখা যায় যে, আজ যে সমাধান দিয়েছেন, যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমাধান দিয়েছেন, যে দলীলের আলোকে সমাধান দিয়েছেন, কাল তা পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। তিনি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ভিন্ন দলীলের আলোকে ভিন্ন সমাধান দিচ্ছেন। পূর্বের দেওয়া সমাধান থেকে রুজু করছেন। এই ফিরে আসা ও নতুন সমাধান কেবল কুরআন-সুন্নাহর কাছাকাছি থাকার প্রচেষ্টায়। তাদের নিকট এটা কোনো দোষের বিষয় ছিল না। তারা যদি কোনো মাসআলার সমাধান বের করতে না পারতেন, অকপটে বলে দিতেন যে, এর সমাধান আমার জানা নেই। কারণ, তারা মনে করতেন তাদের জীবনের তুলনায় এই দীন ও শরীয়তের মূল্য অনেক বেশি। এক ব্যক্তি ইরাক থেকে চল্লিশটি মাসআলা জানার জন্য ইমাম মালিক রহ. এর নিকট আসল। লোকটি ইমাম মালেকের সামনে মাসআলাগুলো পেশ করে সমাধান জানতে চাইল। ইমাম মালিক রহ. তার মধ্যে শুধু ছয়টি মাসআলার উত্তর দিলেন। তখন লোকটি বলল, হে আবু আবদুল্লাহ, সুদূর পথ পাড়ি দিয়ে, বহু বিজন বিয়াবান অতিক্রম করে আপনার নিকট এসেছি। যেহেতু আপনি মদীনার সবচেয়ে বড় আলিম। আমি তো এর সবগুলোর সমাধান চাই। আপনি যদি সামধান না বলে দেন তবে আমি লোকদের কাছে কী নিয়ে ফিরে যাব? আমি আমার এলাকার লোকদের কী জবাব দেব? তখন তিনি বললেন, তুমি তাদের বলবে, মালিক বলেছেন, তিনি এর সমাধান জানেন না। তার সম্পর্কে ‘তিনি জানেন না’ এ কথা বলাটা তার
মর্যাদার কোনো হানি করবে না। কারণ, দীনের জন্য লজ্জা পাওয়ার চেয়ে দীন তার কাছে অনেক মূল্যবান।
সুতরাং কোনো অজ্ঞতা ও গোঁড়ামির কারণে নির্ধারিত কোনো মাযহাব আঁকড়ে থাকা, ওই মাযহাবের বৃত্ত থেকে বাইরে না আসা মূলত ওই ব্যক্তির কমতি। কোনো ব্যক্তির জন্য এ ধারণা করা কোনোভাবেই সংগত নয় যে, যেহেতু তার পিতা হাম্বলী ছিলেন, তাই তাকেও হাম্বলী থাকতে হবে। অথবা তার পিতা শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী ছিলেন বিধায় তাকেও শাফেয়ী মাযহাবের অনুসরণ করতে হবে। ইসলাম আরও অনেক উদার। তার জন্য হানাফী, শাফেয়ী, মালিকী, হাম্বলী যেকোনো মাযহাব অনুসরণের প্রশস্ততা রয়েছে। এটি ইসলামেরই উদারতা। কারণ, যেকোনো মাযহাবের অনুসরণ কিতাব ও সুন্নাহরই অনুসরণ। কারণ, ইমামগণের সকল ইজতিহাদ হলো ধারণাপ্রসূত। অর্থাৎ তারা নিজ নিজ ধারণা অনুযায়ী কুরআন-সুন্নাহর ওপর গবেষণা করে ফলাফল বের করেছেন। সুতরাং প্রতিটি মুসলিমের জন্য যেকোনো ইমামের অনুসরণ করার সুযোগ রয়েছে। পক্ষান্তরে গোঁড়ামি করা, একগুঁয়েমি প্রকাশ করা ইসলামেরও আদর্শ নয়। ফিকহেরও আদর্শ নয়। এ কারণেই ইমাম আবু হানিফা রহ. এর শাগরিদগণ অনেক মাসআলায় তার মতের বিপরীত মত প্রকাশ করেছেন। এবং তারই জীবদ্দশায় এ মতপার্থক্যগুলো সংকলন করেছেন। কই এতে তো তার মর্যাদাহানি হয়নি। এটাকে তারা কোনো দোষ মনে করেননি। কারণ, এটি হলো আল্লাহর দীন। সুতরাং এ ক্ষেত্রে সর্বাধিক সঠিকটি বের করার চেষ্টা করাই বাঞ্ছনীয়। পক্ষান্তরে যে বিষয়টিকে গোঁড়ামি, একগুঁয়েমি ও মাযহাবী পক্ষপাতিত্ব বলে, যার বলয় থেকে মানুষ নিজেকে বের করে আনতে অক্ষম, সেটি মূলত মানুষের মনের সংকীর্ণতা। হৃদয়ের ক্ষুদ্রতা। মানসিকতার বিকার। মানুষকে অবশ্যই এ বিকার ও সংকীর্ণতার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাকে আরও প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী হতে হবে। তার দৃষ্টিভঙ্গি আরও
উদারনীতির ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। তার হৃদয় হতে হবে সমুদ্রের মতো বিশাল। প্রত্যেক ইমামকে তার জ্ঞান-গরিমা, সম্মান-মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের কারণে যথাযথ মূল্যায়ন করা উচিত। কোনো ইমামই অন্যের তুলনায় শ্রেষ্ঠ বা অধম নন। প্রত্যেকেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে সম্পৃক্ত। তার থেকেই গ্রহণ করেছেন। তার বাণী থেকেই আহরণ করেছেন। আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত।
সফরসমূহ :
আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. নিজ দেশ সিরিয়ার বিভিন্ন শহর নগর সফর করার পাশাপাশি আরও বহু দেশে-শহরে সফর করেছেন। জর্ডান, (ইহুদী-কর্তৃক অধিকৃত হওয়ার পূর্বে) ফিলিস্তিন, ইরাক, সৌদি, কুয়েত, কাতার, আরব আমিরাত, বাহরাইন, ইয়ামান,
মিসর, সুদান, সোমালিয়া, তিউনিসিয়া, জাযায়ের, মরক্কো, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইন্দোনিশিয়া, ব্রুনাই, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কিস্তান ও ইউরোপ আমেরিকার বিভিন্ন শহরে সফর করেছেন।
এ সকল দেশে তার সফর ছিল ইলমী উদ্দেশ্যে। যেমন, কোনো শাইখের সাথে সাক্ষাৎ করা। উলামায়ে কিরামের সাথে মিলিত হওয়া। ইলম অর্জন করা। কোনো প্রসিদ্ধ-সাধারণ গ্রন্থাগার কিংবা হস্তলিখিত গ্রন্থ সংরক্ষণকারী কোনো লাইব্রেরি পরিদর্শন করা ইত্যাদি।
অথবা তার এ সকল সফর ছিল দাওয়াতী উদ্দেশ্যে কোনো সম্মেলনে যোগদান করা, ভাষণ প্রদান করা, মানুষদের তাওহীদ ও রিসালাতের দিকে আহ্বান করা ইত্যাদি। তবে এ সফরগুলোর সিংহভাগই ছিল উভয় উদ্দেশ্যে অর্থাৎ ইলমী ও দাওয়াতী সফর। আল্লাহ তার প্রতি রহম করুন।
কর্মজীবন :
তার কর্মজীবন শুরু হয় শিক্ষকতা দিয়ে। ১৯৫১ সালে মিসর থেকে নিজ শহর হালবে ফিরে আসেন। ইতিমধ্যে শিক্ষামন্ত্রণালয় থেকে একটি সার্কুলার জারি হয়। তাতে শিক্ষামন্ত্রণালয়ে ধর্ম ও ইসলাম বিষয়ে একজন শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। তিনি সেখানে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং সফলতার সাথে প্রথম স্থান অধিকার করেন।
দীর্ঘ এগারো বছর হালবের বিভিন্ন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ‘আততারবিয়াতুল ইসলামিয়াহ’ বিষয়ে পাঠদান করেন। এ ছাড়াও শা’বানিয়া ও ছানুবিয়্যাহ শরইয়্যাহ (একসময় তিনি এ মাদরাসার ছাত্র ছিলেন) মাদরাসায় ইসলামী শরীয়ার বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদান করেন। পাশাপাশি তিনি প্রথমে হামাভী জামে মসজিদে পরবর্তী সময়ে ছানুবিয়্যাহ শরইয়্যাহ জামে মসজিদে খতীবের দায়িত্ব পালন করেন। জু’মার নামাযের পর প্রায় ঘণ্টাব্যাপী তার একটি দরস অনুষ্ঠিত হতো। এটিকে তিনি ‘জালসাতুত তাফাক্কুহ ফিদ্দীন’ তথা ‘দীনের প্রাজ্ঞতা অর্জনের আসর’ নাম দিয়েছিলেন। এ আসরটি মুসলিম যুবকদের হৃদয়ের স্পন্দন ছিল। অগণিত মানুষ এ দরস থেকে উপকৃত হতো। হালবের বিভিন্ন প্রান্ত ও উপকণ্ঠ থেকে লোকজন এ দরসে উপস্থিত হওয়ার জন্য ছুটে আসত। এমনকি হালব থেকে প্রায় ১৮০ কিলোমিটার দূরের লাযিকিয়্যা জেলা থেকেও লোকজন দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে এ জলসায় উপস্থিত হতো। রবিবার রাতে তার দ্বিতীয় আরেকটি দরস অনুষ্ঠিত হতো ফিকহের ওপরই। তৃতীয় দরসটি অনুষ্ঠিত হতো বৃহস্পতিবার। তাতে তিনি হাদীস এবং জীবন ও চরিত্র গঠনের ওপর দরস প্রদান করতেন। এ ছাড়াও উলুমে শরইয়্যাহ বিষয়ে অধ্যয়নরত মেধাবী ছাত্রদের উদ্দেশ্যে তার বিশেষ কিছু দরস অনুষ্ঠিত হতো। পাশাপাশি তিনি দারুল আরকামে সাধারণ অধিবেশনেও বক্তৃতা রাখতেন।
এরপর ১৯৬২ সালে সিরিয়ার সংসদীয় পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হন। রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থার মধ্য দিয়ে যতদিন সংসদীয় পরিষদ বিদ্যমান ছিল ততদিন তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। হালবের বিপুল জনসমর্থন নিয়েই তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন যদিও চতুর্দিক থেকে নানা রকম ঝড়ঝাপটা ও প্রতিপক্ষের চরম বিরোধিতা ছিল।
এরপর ওই বছরই তিনি দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীয়া অনুষদে অধ্যাপনার জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হন। তিন বছর (১৯৬২-১৯৬৪) তিনি দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীয়া অনুষদে ফিকহে হানাফী, উসূলুল ফিকহ ও আল ফিকহুল মুকারান (তুলনামূলক ফিকহ) বিষয়ে অধ্যাপনার দায়িত্ব পালন করেন।
১৩৮৫ সালে রিয়াদের শরীয়া কলেজ (পরবর্তী সময়ে যেটি ইমাম মুহাম্মদ বিন সউদ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিত হয়) এর সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। এ প্রতিষ্ঠানে ও আল মা’হাদুল আলী লিলকদা-য় অধ্যাপনার দায়িত্ব পালন করেন। এরপর একই বিশ্ববিদ্যালয়ের উসূলুদ্দীন অনুষদে ¯œাতক পর্যায়ে হাদীস ও উলূমুল হাদীস বিষয়ে দীর্ঘ দশ বছর অধ্যাপনার দায়িত্ব পালন করেন। ইমাম মুহাম্মদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে ১৪০৮ হিজরী পর্যন্ত দীর্ঘ ২৩ বছর কাজ করেন। এ সময়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে যথেষ্ট সম্মান ও মর্যাদা লাভ করেন। এরপর রিয়াদের মালিক সউদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। ¯œাতক পর্যায়ে ও শিক্ষা অনুষদে দুই বছর অধ্যাপনা করেন। ১৪১১ হিজরীতে তিনি অধ্যাপনা থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
ইমাম মুহাম্মদ বিন সউদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে পাঠদান করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৩৯৬ হিজরীতে সুদানের উম্মু দারমান ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে, ১৩৯৮ হিজরীতে ইয়ামানে, ১৩৯৯ হিজরীতে
ভারতের লখনৌ নদওয়াতুল উলামা বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে পাঠদান করেন।
তিনি ইমাম মুহাম্মদ বিন সউদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কাউন্সিল, ইরাকের শিক্ষা একাডেমি, মক্কাতুল মুর্কারামার রাবেতা আলমী ইসলামীর গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এ ছাড়াও তিনি সিরিয়া, ইরাক, ইয়ামান, কাতার, সুদান, সোমালিয়া, মরক্কো, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, তুর্কিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইউরোপ আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অগণিত সম্মেলন ও সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন।
এ ছাড়াও সিরিয়ায় দুইবার ইখওয়ানুল মুসলিমীনের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক মনোনীত হয়েছিলেন। প্রথমবার ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত। দ্বিতীয়বার ১৯৮৬ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। সে সময়টা ছিল অত্যন্ত নাজুক। এই নেতৃত্ব গ্রহণের কোনো খাহেশ তার ছিল না; এ জন্য কোনো তদবির করবেন তো দূরের কথা; বরং প্রথম দিকে তিনি এ নেতৃত্ব গ্রহণই করতে চাননি। শুভানুধ্যায়ীদের পক্ষ থেকে পীড়াপীড়ির কারণে বাধ্য হয়ে এ নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তার এই অনাগ্রহের মূল কারণ ছিল তিনি জ্ঞান ও জ্ঞানের সাধনাকে প্রাধান্য দিতেন। যেকোনো বিষয়ে গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করতেন। ইলমের আলোচনায়, ইলমী কোনো দুর্বোধ্য বিষয়ের সমাধানে অথবা কোনো মাসআলার তাহকীকে যে সময় ব্যয় হতো সে সময়টা ছিল তার নিকট সবচেয়ে প্রিয়।
শরীয়া অনুষদে তিনি যে সকল বিষয়ে পাঠদান করেছেন তার মধ্যে উসূলুল ফিকহ ছিল অন্যতম। এ বিষয়ে তার অসামান্য পা-িত্য ছিল। বিষয়টি কঠিন হওয়া সত্ত্বেও ছাত্রদের অতি সহজে বোঝানোর ক্ষেত্রে তার বিশেষ কৃতিত্ব ছিল। তার কাছে যারা বিষয়টি অধ্যয়ন করেছে তারা এর সাক্ষী।
উসূলুদ্দীন অনুষদে সাধারণ ছাত্রদের যেমন পাঠদান করেছেন তেমনি ¯œাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদেরও পাঠদান করেছেন। উলূমুল হাদীসের বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদান করতেন। যেমন মুসতলাহুল হাদীস, (হাদীসের পরিভাষা) আল হাদীসুত তাহলিলী ইত্যাদি।
বৈশিষ্ট্যাবলি : সাহিত্যিকগণ যখন কোনো ব্যক্তিকে নিয়ে গবেষণা করেন, তার জীবনচরিত রচনা করেন, তখন তারা তার ব্যক্তিত্বকে পরিমাপ করার জন্য একটি মানদ- নির্ধারণ করেন। সে মানদ-কে ঘিরে তার জীবনচরিত রচনা করেন। কারও জীবনচরিত রচনার যদি এটি মানদ- হয়, তবে আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. এর ব্যক্তিত্বের সূচনা হলো প্রতিটি বিষয়ে পূর্ণতা অর্জনের আশা, সুন্দর থেকে সুন্দরতমের প্রতি উন্নীত হওয়ার প্রত্যাশা। বিশেষ করে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-ব্যবসা, আচার-আচরণ ইত্যকার যে সকল বিষয় মুসলিম সম্প্রদায়ের উন্নতির জন্য আবশ্যক তাতে পূর্ণতা অর্জন করা। যাতে প্রতিটি বিষয়ে মুসলিমরাই প্রধান ও শ্রেষ্ঠ প্রমাণিত হয়।
আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. এর মধ্যে অগণিত গুণ ও বৈশিষ্ট্যের বিস্ময়কর সমাহার ঘটেছিল। অতিথির সেবা করা। অতিথির সেবায় সাধ্যের সবটুকু ব্যয় করা। মানুষের প্রতি সর্বোচ্চ সহনশীলতা প্রদর্শন করা। দোস্ত-দুশমন সকলের জন্য ক্ষমা ও মার্জনার ডানা মেলে দেয়া। তার আচার-আচরণ ছিল মুগ্ধকর। কাউকে বাক্যবাণে কষ্ট দিতেন না; বরং প্রশংসার সাথে নাম উচ্চারণ করতেন। সম্মানের সাথে তার আলোচনা করতেন। কারও ব্যাপারে যখন কথা বলতেন, তখন তার শব্দচয়ন ও বাক্যপ্রয়োগ হতো উন্নত পর্যায়ের।
খুবই বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ প্রকৃতির লোক ছিলেন। মেপে মেপে কথা বলতেন, যেখানে যতটুকু বলা প্রয়োজন ততটুকুই বলতেন, প্রয়োজনের বেশি কথা বলতেন না। স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা করে উপযুক্ত শব্দে ও বাক্যে কথা বলতেন। পূর্বপরিকল্পনা ও বিবেচনা ছাড়া
কোনো কাজ করতেন না। তিনি প্রায়ই তার সন্তান সালমানকে বলতেন, যে কাজই করো না কেন, আগে বিবেক-বুদ্ধি খরচ করবে। তার মধ্যে রসবোধও ছিল পরিমিত মাত্রায়। বন্ধু-বান্ধব ও শুভানুধ্যায়ীদের সাথে হাস্য-রসিকতা করতেন। সাধারণ বৈঠক হোক কিংবা ইলমী মজলিস, স্থান-উপযোগী কৌতুক করতেন। এতে গাম্ভীর্যের ভার কিছুটা হালকা হতো। তবে এই হাস্য-রসিকতায় আদব ও শিষ্টাচারের গ-ি থেকে বেরিয়ে আসতেন না। সম্মান ও আদবের বৃত্তে থেকেই এই হাস্য-কৌতুক করতেন।
খুবই রুচিশীল মানুষ ছিলেন। পোশাকে, পানাহারে ও জীবনযাপনে ছিলেন খুবই স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন রুচির মানুষ। তার গ্রন্থগুলো সাজানো থাকত। তার রচনাবলিও ছিল পরিপাটি ও মার্জিত। এমনকি তার জুতা পরিধান ও জুতা সাজিয়ে রাখার ক্ষেত্রেও রুচিশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। এভাবে জীবনের প্রতিটি কর্মে ও প্রতিটি ক্ষেত্রে তার রুচিশীলতা ও উন্নত বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়।
যবান ব্যবহারে ছিলেন খুবই সতর্ক ও যতœশীল। কাউকে কখনো মন্দ বাক্য বলতেন না। তাঁকে মন্দ বাক্য বলতে শুনেছেন এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। একান্তই যখন খুব রেগে যেতেন তখন হয়তো কোনো কড়া কথা বলতেন। তবে তার অধিকাংশ ক্রোধ ছিল আল্লাহর জন্য।
খুবই আত্মমর্যাদাশীল ছিলেন। কখনো কোনো দায়িত্বশীলের কাছে নিজের জন্য কিছু চাননি। যদি কখনো কারও কাছে কিছু চেয়েছেন, তবে তা বন্ধু-বান্ধব ও সাথি-সঙ্গীদের জন্য; নিজের জন্য নয়। অসম্ভব ধৈর্যের সাথে আল্লাহর আনুগত্যের ওপর অটল ছিলেন। আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা পরীক্ষা বিস্ময়কর সহনশীলতার সাথে হাসিমুখে বরণ করে নিতেন। নামাযের ব্যাপারে খুবই যতœশীল ছিলেন। প্রথম ওয়াক্তেই নামায আদায় করে নেয়ার চেষ্টা করতেন।
সুস্থতায়-অসুস্থতায়, সফরে-শহরে, ক্লান্তিতে-অবসাদে যে অবস্থাতেই থাকতেন, নামায ছাড়তেন না। সন্তানদের মধ্যেও এ আদর্শ প্রোথিত করেছেন। কখনো যদি ঘুমিয়ে থাকতেন কিংবা ক্লান্তিতে নুয়ে পড়তেন নামাযের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে উঠে পড়তেন। অযু করে জায়নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন। অধিকাংশ সময় উমর রাযি. এর অন্তিম মুহূর্তের ওই বাক্যটি স্বগতোক্তি করতেন- مْ < الِاإلسَّْظ يفَََل ح <ََك ال َّصالةََرت ْنَمِلে য ব্যক্তি নামায ছেড়ে দিল, ইসলামে তার কোনো অংশ নেই।
কুরআনুল কারীমের প্রতি তার আগ্রহ ছিল বিস্ময়কর। প্রতিদিন সকালে নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করতেন। একান্ত অপারগ না হলে সকালে কুরআন তিলাওয়াত ছাড়তেন না। পাশাপাশি অধিক পরিমাণে যিকির করতেন। তার সারাদিনের সময়টা বিভিন্ন কাজের জন্য ভাগ করা ছিল। কখনো লিখতেন, কখনো বিভিন্ন গ্রন্থের তাহকীক করতেন। কখনো ইলমী আলোচনা করতেন। আবার কখনো মানুষের প্রশ্নের জবাব দিতেন। ফতোয়া দিতেন। মোটকথা কোনো-না-কোনো ইলমী কাজে লিপ্ত থাকতেন। নতুবা বসে বসে তাসবীহ আদায় করতেন। জিকির ও মুরাকাবায় মশগুল থাকতেন। অনর্থক সময় ব্যয় করতেন না।
তার হৃদয়টা ছিল খুবই কোমল ও নরম। অল্পতেই তার চোখ অশ্রুসজল হয়ে যেত। কুরআনুল কারীম তিলাওয়াতকালে কিংবা জিকির করার সময় তার দু-চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ত। যখন সালাফে সালেহীনের ইতিহাস বা আধ্যাত্মিক বিষয়ের আলোচিত হতো নিজের অশ্রু সংবরণ করতে পারতেন না। মুসলিমদের দুঃখ-
দুর্দশার কথা শুনে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন না। হু-হু করে কেঁদে উঠতেন। শাইখ আদুল মাকসূদের ইছনাইনিয়্যাহ এর সংবর্ধনা
অনুষ্ঠানে যখন তার প্রশংসা করা হচ্ছিল তখন তিনি এমনভাবে ডুকরে কেঁদে ওঠেন যে পুরো অনুষ্ঠান থমকে গিয়েছিল।
এ উম্মতের দুরবস্থা ও দুর্দশা দেখে তার হৃদয় সব সময় কাঁদত। মর্মে মর্মে তিনি জ্বলতে থাকতেন। এ দহন-যন্ত্রণায় তিনি ডান কানের শ্রবণ শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। একবার এক লোক এসে তাঁকে কোনো শহরের মুসলিমদের দুর্দশার কথা শোনাল। এতে তিনি এতটাই মর্মাহত হলেন যে সারারাত বিছানায় পিঠ লাগাতে পারেননি। কেবল ছটফট করে কাটালেন। সকালবেলা দেখা গেল তার কান থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। এতে তার শ্রবণশক্তিও হারিয়ে গেছে।
মুসলিমদের অবস্থা কল্পনা করে, মুসলিমদের দুঃখ-দুর্দশার কথা চিন্তা করে কত শত রাত বিনিদ্র পার হয়েছে!!
শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলার পর আল্লাহ তাআলা তাঁকে দৃষ্টিশক্তি হ্রাস করে দেওয়ার মাধ্যমে নতুন পরীক্ষায় নিক্ষেপ করেন। ১৪১০ হিজরীতে তার চোখে সমস্যা দেখা দিল। কিন্তু এতে না তিনি কোনো অভিযোগ করেছেন, না কাউকে নিজের কষ্টের কথা জানিয়েছেন। এতে তার ইলমী গবেষণাও থেমে যায়নি; বরং বিস্ময়কর সহনশীলতার সাথে নিজের জ্ঞানচর্চা ও ইলমী সাধনায় নিরত থেকেছেন। রচনা ও সংকলন অব্যাহত রেখেছেন। নিজের হৃদয়ে যে সকল গ্রন্থ রচনার স্বপ্ন লালন করতেন সেগুলো রচনার আগেই মৃত্যু এসে যায় কি না সে আশঙ্কায় দু-হাতে লিখে গিয়েছেন।
জীবনের একদম শেষ প্রান্তে এসে ইন্তেকালের চার মাস আগে তার ডান চোখ রোটিনা রোগে আক্রান্ত হয়। এতে তার দৃষ্টিশক্তি লোপ পায়। এরপর অবশ্য সার্জারি করা হয়েছিল কিন্তু তাতে কোনো সুফল আসেনি; বরং এতে তার চোখের ও মাথার যন্ত্রণা এত বেড়ে গিয়েছিল,
যা বোঝাতে গিয়ে তিনি বলতেন কেউ যেন তার চোখে তিরের আঘাত করছে। এত তীব্র যন্ত্রণা সত্ত্বেও তার মুখ থেকে কোনো চিৎকার বের
হয়নি। উহ শব্দটিও করেননি। বেদনার তীব্রতা যখন প্রচ- আকার َ هللا! َل إله إََّل هللا! কবল তেখন করত ধারণي َবলতেন।
জ্ঞানের প্রতি তার অবাক করা আগ্রহ ছিল। অধ্যয়ন, রচনা-সংকলনে তার ধৈর্য ছিল আরও বিস্ময়কর। সুস্থতায়-অসুস্থতায়, সফরে-শহরে কখনো তার কলম থেমে থাকেনি। অনবরত লিখে গেছেন। বহু গ্রন্থ সফরেই রচনা শুরু করেছেন। সফরেই সমাপ্ত করেছেন। বিভিন্ন গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি তা উল্লেখও করেছেন। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগের দিনও (যখন তিনি তীব্র যন্ত্রণায় কাতর) তার উপভোগ্য গ্রন্থ ْ < ميِلْالتَّ عِْيفُبهْيِالَم وأسِل َعُُل املْوُ
< الرس এর মধ্যে সংযোজন করেছিলেন। হাসপাতালে ভর্তি হয়েও লিসানুল মিযান গ্রন্থটি সম্পর্কে বারবার জিজ্ঞাসা করছিলেন। ইন্তেকালের মাত্র বিশ দিন আগে এ গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছিলেন।
খুব অল্প সময় ঘুমাতেন। এ সামান্য সময়কেও অনেক মনে করতেন। যৌবনে একাধারে এক-দুই দিন না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতেন। বিষয়টি তিনি তার পুত্র সালমানকে বহুবার বলেছেন।
শেষের এ দুটি গুণ আরেকটি গুণের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে। সেটি হলো, সময়ের সংরক্ষণে তার তীব্র আগ্রহ ও ভালোবাসা। সম্পদের প্রতি যতটা না আগ্রহী ছিলেন তারচেয়ে অনেকগুণ বেশি আগ্রহী ছিলেন সময়ের সংরক্ষণের প্রতি। সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত থেকে নিজের ফায়দা লুটে নিতে আগ্রহী ছিলেন। অনুরূপ তার শেষের গুণটি ইলমের প্রতি তার তীব্র পিপাসাকেও প্রমাণ করে।
যে কাজ নিজে করতেন না কাউকে সে কাজের নির্দেশও দিতেন না। অন্যকে যে কাজ থেকে বারণ করতেন, নিজেও সে কাজ করা থেকে বিরত থাকতেন।
আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. প্রচ- ধীশক্তির অধিকারী ছিলেন। তার স্মৃতিশক্তি ও মেধা ছিল তুখোড়। সাথে সাথে তার ছিল ইলম
অনুযায়ী আমল, ইবাদাতে আত্মমগ্নতা, আল্লাহর প্রতি ভয় ও গভীর আস্থা। আলিম-উলামা ও তার শাইখদের প্রতি তার বিনয় ছিল উপমাতুল্য। এমনকি ছাত্রদের প্রতিও তার বিনয় ছিল আলোচনার বস্তু। তিনি তাদের তুলনায় নিজেকে কিছুই মনে করতেন না।
ইছনাইনিয়্যাহর৪ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কবি উসতায মুহাম্মদ যিয়াউদ্দীন সাবূনী যখন এ কবিতা দ্বারা তার প্রশংসা করলেন,
َتَُِّع الرفْه ألرَِّمتِبِِْو
لَدَْ جأي وِيفَرِْيفَفةْيِنَْ حوُأب ُمَْس
ِب ي
আমার দৃষ্টিতে ও যুক্তিতে তিনি এ সময়ের আবু হানিফা। যিনি নিজের উচ্চ হিম্মতের মাধ্যমে উচ্চ মর্যাদায় আসীন। তখন তিনি তার প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, আমার ওই সকল ভাইয়েরাও আমার দৃষ্টিতে অনুরূপ মর্যাদার অধিকারী, যারা আমার সম্পর্কে উদারচিত্তে এ-জাতীয় মন্তব্য করেছেন। তারা তো কথার দানে আমাকে সিক্ত করেছেন। কিন্তু এতে তারা যেমন উদারতা দেখিয়েছেন তেমনি আমার ওপর অসাধ্য চাপিয়ে দিয়েছেন। এমনকি তারা আমাকে আবু হানিফার সমপর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়েছেন। যেমনটি আমার ভাই কবি যিয়াউদ্দীন সাবূনী আমার সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন। আবু হানিফা রহ. এর সমপর্যায়ে পৌঁছা তো দূরের কথা আবু হানিফার রহ. এর তুলনায় আমি একটি বালুকণার সমানও নই। আরে আবু হানিফা রহ. কে? কী তার পরিচয়? আবু হানিফা তো আল্লাহর রহমতের অপার দান, যা তিনি এ উম্মতকে উপঢৌকন হিসেবে দান করেছেন। যেমন তিনি এ উম্মতকে দান করেছেন ইমাম মালিক, ইমাম আহমদ বিন হাম্বল, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম ইবনে জারিরের মতো জগদ্বিখ্যাত ইমামদের। তারাই মূলত এ উম্মতের পথিকৃৎ। আমি যদি তাদের তুলনায় একটি বালুকণাও হতে পারতাম
৪. ইছনাইনিয়্যাহ, ১১/৬৩৩-৬৩৬
তবে সেটি হতো আমার জন্য মহাসৌভাগ্য। এর শুকরিয়া আদায় করার ক্ষমতা আমার নেই। তাই আমি আমার সম্পর্কে আলোচনায় এ-জাতীয় বাক্য ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করছি। কারণ, এর ভার সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। আমার শ্রবণশক্তি এতটা শক্তিশালী নয় যে তা শ্রবণ করবে। আমার হৃদয় এতটা সাহসী নয় যে তা সহ্য করবে। যদিও কথাগুলো কোনো বন্ধুর মুখ থেকে নেক নিয়তেই বের হয়েছে। তবুও সত্যের অনুসরণ করাই শ্রেয়।
তার ব্যক্তি-নিরীক্ষণ ক্ষমতা ছিল বিস্ময়কর। তিনি কখনো যদি কারও সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেছেন, তার গুণ কিংবা দোষ বলেছেন, অনেক পরে হলেও তার মধ্যে তা পরিস্ফুটিত হয়েছে। অনুরূপ কোনো বিষয়ে যদি কোনো মন্তব্য করেছেন, ঠিক যেভাবে মন্তব্য করেছেন সেভাবেই সেটিকে পাওয়া যেত। হোক সেটি দীর্ঘ সময় পর। তার তাকওয়া ও জ্ঞান-বুদ্ধির গুণেই সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারতেন। যেমনটি ইমাম হাসানুল বান্না রহ. তার সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন।
তিনি তার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, পৌত্র পৌত্রী, পরিবার-পরিজন সকলের প্রিয় ছিলেন। তাদের সঠিক পথের দিক নির্দেশনা দিতেন। কোমলতা, সুরুচি, প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার সাথে তাদের প্রতিপালন করতেন। যেদিন তিনি তাদের ছেড়ে চলে গেলেন তাদের কাছে মনে হয়েছে তারা জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান কোনো বস্তু হারিয়ে ফেলেছেন। তারা কামনা করছিলেন নিজেদের আত্মা ও সন্তানের বিনিময়েও যদি তাকে ধরে রাখতে পারতেন!! আবাদ পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে তাকে ভালোবাসতেন এমন প্রতিটি ব্যক্তির অবস্থাই এমন হয়েছিল। তারা সন্তানহারা মায়ের মতো কেঁদেছিলেন। ِر!ْالظَّهَناكَِْ سُكمِا بَنْْطي ا ، وأعَنْي ََدَى * فدِالفُلَبْقُي ِْض لَوْطْ ِن األرََن بَّكاُأس
হে ভূ-গর্ভের বাসিন্দাবৃন্দ, যদি বিনিময় গ্রহণের ব্যবস্থা থাকত, তবে আমরা বিনিময় পেশ করতাম। তোমাদের বিনিময়ে আমরা ভূ- পৃষ্ঠবাসীকে ফিদইয়া হিসেবে পেশ করতাম।
তিনি ছিলেন গুণের আধার। তার ব্যাপারে কবির এ কবিতা যথার্থ, ْ َضةوَِر رطِْالْعةَِرْوُارَقِْيفُزَْجُوت َِق َك وْيَّحَِكأْ ِس الرِْيفُزَْجوُي َو
ُمْوُر
আতরের শিশিতে যেন বাগানের পুষ্পরাজির সমাহার ঘটেছে। শরাবের পাত্রে আঙুরের পুরো বাগানটাই যেন নিংড়ে নেয়া হয়েছে। রচনাবলি ও ইলমী কীর্তি
আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. -এর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৬৭টি। এর মধ্যে যেমন তার স্বরচিত গ্রন্থ রয়েছে তেমনি তাহকীকী গ্রন্থও রয়েছে। ছোট পুস্তিকা যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে বিশাল কলেবরে কয়েক খ-ের গ্রন্থ। স্বতন্ত্রভাবে এ গ্রন্থগুলোর পরিচয় তুলে ধরার প্রয়োজন নেই। কারণ, তালিবুল ইলম ও শাইখের শুভানুধ্যায়ীদের নিকট তা পরিচিত। শাইখ যে সকল গ্রন্থ রচনা করেছেন, প্রায় সবগুলোর শেষে তার রচিত সকল গ্রন্থের নাম ও পরিচিতি দেওয়া থাকে।
শাইখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. ১৯৫১ সাল থেকে তার পরবর্তী বছরগুলোতে যখন হালবে ধর্মবিষয়ক অধ্যাপনার দায়িত্ব পালন করেছিলেন, সে সময় তার অন্যতম অন্তরঙ্গ বন্ধু উসতায শাইখ আহমাদ ইয্যুদ্দীন ইয়াবানূনী রহ. এর সাথে যৌথভাবে মাধ্যমিক স্তরের জন্য ছয়টি পাঠ্যপুস্তক রচনা করেছিলেন।
এ ছাড়াও তারা উভয়ে যৌথভাবে আরেকটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। যেটিকে শাইখের প্রথম গ্রন্থ হিসেবে মনে করা হয়। গ্রন্থটির নাম <َِّوةُر النُّ ب ُْون ْنِ ت ماَاسَبَ ق ।<এটিও সে সময় রচিত। এ গ্রন্থটি রচনার প্রেক্ষাপট হলো, আবু শালবাইয়াহ নামক জনৈক ব্যক্তির বক্তব্যের
খ-ন। লোকটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে হঠকারিতা করতে গিয়ে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মেষের রাখাল বলে উপহাস করেছিল।
এ ছাড়াও দামেস্কের শরীয়া অনুষদে পাঠদানকালে ইবনে হাযম ُحالْمِْهقِفُمَْج
জাহেরী রচিত ূى لَ <
< مع গ্রন্থটির কাজ সমাপ্ত করেন। তার পূর্বে আরও দুজন অধ্যাপক গ্রন্থটিতে কাজ করেছিলেন। কিন্তু তারা সমাপ্ত করতে পারেননি। তিনি গ্রন্থটি যেভাবে সমাপ্ত করা দরকার ঠিক সেভাবেই সুবিন্যস্ত ও পরিপাটি করে সমাপ্ত করেন। দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের প্রকাশনা বিভাগের অধীনে গ্রন্থটিকে বড় বড় দুই ভলিউমে প্রকাশ করেছিল।
এ ছাড়াও তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠক্রম প্রণয়নে অংশগ্রহণ করেন। সিরিয়ার শিক্ষা সিলেবাস ও পাঠদান পদ্ধতি নির্ধারণ করা, আল মা’হাদুল আলী লিলকদা ও ইমাম মুহাম্মদ বিন সউদ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম প্রণয়নে অংশগ্রহণ করেন। এরপর মালিক সউদ বিশ্ববিদ্যালয়ে তারবিয়া অনুষদের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করে দেন।
শাইখ যখন মৃত্যুশয্যায় শায়িত, তখন তার বেশ কয়েকটি কিতাব ছিল ছাপাখানায়, আরও অনেকগুলো কিতাবের কাজ সমাপ্ত হয়েছিল কিন্তু তখনো ছাপাখানায় পাঠানো হয়নি। আরও কিছু কিতাব এমন ছিল যেগুলো লেখার পরিকল্পনা ছিল, শাইখের সীনায় সেগুলো সংরক্ষিত ছিল, সেগুলো ছাপার হরফে দেখে তার চক্ষু শীতল করার কামনা ছিল হায়াত ও সুস্থতা যদি তাকে সঙ্গ দিত তবে হয়তো সেগুলোও কাগজের পাতায় আমরা দেখতে পেতাম। তার চক্ষু শীতল হতো। হৃদয়ের আক্ষেপ প্রশমিত হতো। কারণ, তিনি প্রায়ই বলতেন, হৃদয়ে গ্রন্থ রচনার আক্ষেপকে চাপা না দিয়ে মৃত্যুশয্যায় শায়িত হয়েছেন এমন আলিমের সংখ্যা খুবই বিরল।
গ্রন্থ রচনা ও তাহকীকে তার শৈলী
১. শব্দ নির্বাচনে সতর্কতা অবলম্বন ও শব্দের তাহকীকে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা ব্যয় করা : অর্থাৎ শব্দ নির্বাচনে উৎকৃষ্ট ও উপযুক্ত শব্দ বাছাই করা, তাহকীকের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা ছিল তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ফলে তিনি যে সকল গ্রন্থ রচনা করেছেন কিংবা তাহকীক করেছেন সে সকল গ্রন্থে এমন কোনো জটিলতা পাওয়া যাবে না যে জটিলতার নিরসন করেননি। এমন কোনো অস্পষ্টতা পরিলক্ষিত হবে না, যা স্পষ্ট করেননি। সনদের দুর্বলতা পাওয়া যাবে না। কোনো শব্দের অর্থ গ্রহণে টীকা সংযোজন করেননি, এমনটি হয়নি।
এক-একটি শব্দের তাহকীক করতে গিয়ে বহু সময় ব্যয় করতেন। অনেক সময় ওই শব্দ নিয়ে আহলে ইলমদের সাথে আলোচনা করতেন। শব্দটি যে শাস্ত্রের ওই শাস্ত্রের লোকদের সাথেও কথা বলতেন। উদারচিত্তে, উৎফুল্ল চেহারায় এসব করতেন। এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। কারণ, তার জীবনের উদ্দেশ্যই ছিল ইলমের খিদমত করা। আহলে ইলমের সেবা করা।
০২. অধিকাংশ কিতাবে জটিল ও দুর্বোধ্য শব্দগুলোতে হরকত যুক্ত করার প্রতি গুরুত্ব প্রদান : এ ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ গ্রন্থগুলোর তুলনায় সাধারণ গ্রন্থগুলোকে গুরুত্ব দিতেন। যেমন, সফাহাতুম মিন সবরিল উলামা ও ক্বিমাতুয যামান ইনদাল উলামা ইত্যাদি গ্রন্থ। যদিও এতে তাঁকে প্রচুর শ্রম ও সময় ব্যয় করতে হতো। তিনি তার অমর গ্রন্থ সফাহাতুম মিন সবরিল উলামা এর ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন, অনেক বিশিষ্ট বক্তি মনে করেন যে, আমি শব্দের হরকত ও তাহকীক সংযুক্ত করে বিষয়টিকে ব্যাপক করে ফেলেছি। আসলে বিষয়টি আমি ইচ্ছে করেই করেছি। এতে আমি সাধারণ পাঠকদের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়ার চেষ্টা করেছি। যাতে তারা শব্দটি বিশুদ্ধ উচ্চারণে পাঠ করতে
পারে। বাক্যটি বিশুদ্ধ শৈলীতে পড়তে পারে। যাতে পাঠক দ্রুত মর্মোদ্ধারে সক্ষম হয়। তিনি বলেন, আমি মানুষের নাম, শহরের নাম, স্থানের নামের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে যে সকল নামের ক্ষেত্রে ভুল উচ্চারণ কিংবা ভুল পাঠের আশঙ্কা রয়েছে হরকত লাগানোর প্রতি বিশেষ যতœ নিয়ে থাকি। যাতে পাঠক কোনোরূপ দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই পাঠের গভীরে প্রবেশ করতে পারে। প্রথম পাঠেই তার মর্ম উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। শব্দের ভ্রান্তি থেকে পরিত্রাণের মাধ্যমে সঠিক অর্থ বুঝতে সক্ষম হয়।
০৩. প্রতিটি সংস্করণে নতুন নতুন বিষয় সংযোজন করা : তার হাতে যেকোনো গ্রন্থ প্রতিনিয়ত সংযোজন, পরিমার্জনের পুষ্টতায় সমৃদ্ধ হতে থাকত। তার এই সংযোজন ও পরিমার্জনের অব্যাহততার কারণে তার প্রতিটি সংস্করণকে স্বতন্ত্র গ্রন্থ বলে মনে হয়। জীবন-সায়াহ্নে যখন তিনি শারীরিক দুর্বলতা ও বার্ধক্যজনিত অপারগতায় আক্রান্ত হয়ে পড়লেন, অপরদিকে তার রচিত ও সংকলিত গ্রন্থের সংখ্যাও বেড়ে গেল, তখন তিনি তার অনেক গ্রন্থ (ইতিমধ্যে যেগুলোর প্রকাশিত কপি ফুরিয়ে গেছে) ফটোকপি করে প্রকাশ করতে লাগলেন, যাতে তালিবুল ইলমদের হাতে হাতে সেগুলো থাকে। এমনকি সেই ফটোকপি করা কিতাবগুলোতেও সংযোজন ও পরিমার্জনের ধারা অব্যাহত রাখতেন। তবে নতুন সংযোজনসহ কিতাবটি হয়তো ছাপানোর সুযোগ হয়নি। কারণ, যে সকল গ্রন্থ তখনো প্রকাশিত হয়নি সেগুলো প্রকাশের ব্যস্ততায় ডুবে ছিলেন। বাহ্যত যদিও ফটোকপি করে প্রকাশ করা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে সেটি পূর্বের ছাপার তুলনায় সমৃদ্ধ। আল্লাহ তার প্রতি রহম করুন।
০৪. বিরল ও দুর্লভ তথ্য সংযোজন করা : হয়তো দেখা যাবে কোনো একটি শব্দের টীকায় এক বা দুই লাইন লিখেছেন, কিন্তু এ এক লাইন
লিখতে, সেই এক লাইনের তথ্য-উপাত্ত জোগাড় করতে তার পার হয়ে গেছে বহু রাত বা সপ্তাহ। অথবা ওই একটি লাইন দীর্ঘ বহু বছরের অধ্যয়নের সারনির্যাস। যেমনটি তার উপস্থাপনা থেকেই বোঝা যায়। অনেক তথ্য তিনি এমন স্থান থেকে চয়ন করেছেন, যা ধারণার অতীত। এমন উৎস থেকে উল্লেখ করেছেন যেখানে বিষয়টি আছে বলে ধারণায়ও আসে না। এ ছাড়াও উদ্ধৃতি নির্বাচনে, উপস্থাপনায়, সংযোজনের স্থান নির্বাচনে তার রয়েছে বিশেষ রুচি ও বোধ। এ বোধ গ্রন্থের কলেবর বৃদ্ধির জন্য নয়। গ্রন্থটিকে টীকাসমৃদ্ধ করার জন্যও নয়; নয় প্রান্তটীকার শূন্যস্থান পূরণের জন্য।
০৫. বিন্দু বিন্দু করে সমুদ্র গড়ে তোলা : কোনো গ্রন্থই তিনি একবারে সংকলন করেননি; বরং কিছু কিছু সংকলন করেছেন। তার প্রতিটি গ্রন্থই এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। তার সফাহাত গ্রন্থটি তিনি বিশ বছরে সংকলন করেছেন। যখনই তিনি গ্রন্থটির বিষয় সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় পেয়েছেন, সাথে সাথে সেটি কাগজের বন্দীশালায় কলমের সহায়তায় বন্দী করে নিয়েছেন। অবশেষে এই বিন্দু বিন্দু করে সি ত ইলমী ভান্ডারই একসময় হৃদয়গ্রাহী উপভোগ্য গ্রন্থরূপে আত্মপ্রকাশ করে। কলমের সহায়তায় বিক্ষিপ্ত কাগজের ওই বন্দীদশা থেকে মুক্তি নিয়ে গ্রন্থের কলেবরে তা পাঠকের হৃদয়ে উত্তাপ ছড়ায়। ক্বিমাতুয যামান গ্রন্থটিও একই ধারায় রচিত; বরং তার রচিত ও তাহকীককৃত প্রতিটি গ্রন্থই সময়ের পুষ্টতায় পরিপুষ্ট।
০৬. সূচিপত্র ও সুন্দর উপস্থাপনা-শৈলীর প্রতি গুরুত্বারোপ : এ ক্ষেত্রে তার নীতি হলো, গ্রন্থের কলেবর এক শ পৃষ্ঠার ওপরে হতে হবে। যদি এমন হতো, তবে তিনি তাতে পাঁচটি কিংবা তারও অধিক সূচিপত্র সংযোজন করতেন। যাতে গ্রন্থটি পাঠে পাঠক দ্রুত তার কাক্সিক্ষত বিষয়টি পেয়ে যান। যারা গবেষণার জন্য গ্রন্থটি পাঠ করবেন তারা
যেন অতি সহজেই তার উদ্দিষ্ট বিষয়টি খুঁজে নিতে পারেন। যদিও এতে বহু শ্রম ও কঠিন পরিশ্রমের প্রয়োজন। আল ইনতিকা গ্রন্থের সূচিপত্রের সূচনাতে এ কষ্টের কথা কিছুটা ব্যক্ত করেছেন। সূচিপত্র তৈরির বিষয়টি একপ্রকার স্বতন্ত্র রচনা হলেও অনেক কম মানুষই তাতে নিষ্ঠার পরিচয় দেয়।
০৭. ছাপা ও কাভারে শিল্পের প্রকাশ : এ ক্ষেত্রে তার নিজস্ব রুচিবোধ ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল। তার এই রুচিবোধকে ষোলোকলায় পূর্ণ করার জন্য তার কিছু শুভানুধ্যায়ী ও রুচিশীল প্রকাশক তাকে সহায়তা করতেন। তারাই তার কিতাবগুলো ছাপাতেন। সূচিপত্র ও ছাপা শিল্পের একজন রুচিশীল ব্যক্তি হিসেবে শাইখ আবদুল ফাত্তাহ রহ. ছিলেন উপমাতুল্য। বলা যায় এ শিল্পের পথিকৃৎ। এ বিষয়ে তার তাসহিহুল কুতুব ওয়া সুনউল ফাহারিসিল মু’জামাতি গ্রন্থটি দেখা যেতে পারে।
০৮. পূর্বের সকল বিষয়ে তার রুচিবোধ : ওপরে যে সকল বিষয় আলোচিত হলো, প্রতিটি বিষয়ে তার বহু ঘটনা রয়েছে। স্থানের সংকীর্ণতা বিবেচনায় তা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
০৯. স্বতন্ত্র রচনার চেয়ে তাহকীকের প্রতি অধিক মনোনিবেশ : এটি ছিল তার বিনয় ও আত্মনিবেদনের চমৎকার উপস্থাপন। কারণ, তিনি মনে করতেন, নিজে গৃহ নির্মাণ করার চেয়ে পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া গৃহ মেরামত করা শতগুণ শ্রেয়। এ ছাড়া আমাদের ওপর পূর্বসূরিদের যে হক রয়েছে এটি তার একটি অংশ বটে। তারাই হলেন আসল আলোর দিশারি। তারা তাদের পেছনে যে সামান্য ফাটল রেখে গেছেন তা আমাদের নিকট সেটিকে ডিঙিয়ে যাওয়ার বা তাদের অমূল্য কীর্তিগাথা এড়িয়ে যাওয়ার দাবি করে না। বিষয়টি তিনি তার বিশ্লেষিত প্রথম গ্রন্থ আবদুল হাই লাখনভী রহ. বিরচিত আর রফউ
ওয়াত তাকমীল ফিল জারহি ওয়াত তা’দীল গ্রন্থের ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন। শুরু থেকেই এটি ছিল তার শৈলী ও কর্মপদ্ধতি। যদিও তিনি জানতেন যে অনেক সময় স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনার চেয়ে রচিত গ্রন্থের তাহকীক ও বিশ্লেষণ দুরূহ ও কঠিন হয়ে থাকে। এ বিষয়টিও তিনি তার ওই ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন। যেখানে তার রচিত স্বতন্ত্র গ্রন্থের সংখ্যা হলো মাত্র তেরো, সেখানে তার তাহকীককৃত গ্রন্থের সংখ্যা হলো একান্নটি। এ থেকেও আমরা বিষয়টি অনুধাবন করতে পারি। কেবল ওই সকল বিষয়ে স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনার প্রতি তিনি আগ্রহী ছিলেন যে সকল বিষয়ে পূর্বসূরিগণ কলম ধরেননি। যে বিষয়ে পূর্বসূরিদের কোনো গ্রন্থ নেই। নতুবা তিনি নিজের পক্ষ থেকে গ্রন্থ রচনার চেয়ে পূর্ববর্তীদের রচিত গ্রন্থের প্রতিই বেশি আগ্রহী ছিলেন।
বিভিন্ন শাস্ত্রে তার দক্ষতা :
আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. এর শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল উচ্চ মনোবল, প্রচ- আগ্রহ, প্রখর স্মৃতিশক্তি, তুখোড় মেধা নিয়ে। ফলে জ্ঞানের বিভিন্ন সরোবরে তিনি অবগাহন করেন। বিভিন্ন শাস্ত্রে দক্ষতা ও প্রাজ্ঞতা অর্জন করেন।
শিক্ষাজীবনের সূচনাতে প্রচ- আগ্রহ ও আকর্ষণ নিয়ে আরবী ভাষা ও ব্যাকরণ অধ্যয়ন করেন। যার ফলে তার অনেক সহপাঠী তাকে ‘আসমায়ী’ বলে ডাকত। কেউ আবার তাকে ‘বাকসম্পন্ন অভিধান’ বলে ডাকত। এ ছাড়াও ফিকহ, উসূলে ফিকহ, সীরাত ও হাদীস গুরুত্বের সাথে অধ্যয়ন করেন।
এরপর যখন তিনি মিসরের আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন, সেখানে আরও বিস্তৃত পরিসরে ফিকহ, উসূলে ফিকহ ও হাদীস শাস্ত্রসহ অন্যান্য বিষয় অধ্যয়ন করেন। ফলে একজন প্রাজ্ঞ মুহাদ্দিস, বিজ্ঞ ফকীহ, অভিজ্ঞ উসূলবিদ, দক্ষ ব্যাকরণবিদ, ঝানু ভাষাবিদ ও
বোদ্ধা ইতিহাসবিদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হন। আল্লাহ তার প্রতি রহম করুন।
আরবী ভাষাতত্ত্বে তার জ্ঞানের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো, তিনি ইবনে সাল্লাম বিরচিত ত্ববাকাতু ফুহুলিশ শুআরা গ্রন্থের ওপর আল্লামা আবু ফিহ্র মাহমুদ শাকের যে টীকা সংযোজন করেছিলেন সে টীকার ওপর কিছু ভাষাতত্ত্বগত টীকা সংযোজন করেন। মাহমুদ শাকেরকে এ যুগের ভাষাতত্ত্বের গুরু মনে করা হয়। আল্লাহ তাদের উভয়কে ক্ষমা করুন। আমীন। বিভিন্ন গ্রন্থে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তার টীকা ও তা’লিকগুলো বিভিন্ন শাস্ত্রে তার দক্ষতারই প্রমাণ বহন করে।
ইলমী মর্যাদা ও উলামায়ে কিরামের প্রশংসা
সমুন্নত রুচিবোধ, আমল ও সততার পাশাপাশি বিভিন্ন শাস্ত্রে তার দক্ষতা, ইলমের সেবায় তার অসামান্য অবদান তাঁকে সমসাময়িক যুগের উলামায়ে কিরামের মাঝে একটি সুউচ্চ মর্যাদার আসন তৈরি করে দিয়েছিল। তার দোস্তরা যেমন এ মর্যাদার স্বীকৃতি দিয়েছেন, তেমনি যারা তার মতাদর্শের বিরোধী ছিলেন তারাও এর স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছেন।
এখানে তাঁর ব্যাপারে উলামায়ে কিরামের কিছু প্রশংসাবাণী পাঠকবর্গের সামনে উপস্থাপন করা হলো :
এক.
মিসরের প্রধান মুফতী, বিশিষ্ট আলিম ও মুহাক্কিক, অগণিত বিষয়ে বরেণ্য প-িত জনাব হাসনাইন মাখলুফ রহ. রিসালাতুল মুসতারশিদীন গ্রন্থের প্রথম সংস্করণে নিজের অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে লেখেন,
গ্রন্থকার হলেন বিশিষ্ট আলিম, প্রাজ্ঞ মুহাক্কিক ও উসতায... । অতঃপর আমি আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করছি, তার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। যেহেতু তিনি আপনাকে ইমাম মুহাসিবীর রচিত ‘রিসালাতুল মুসতারশিদীন’ গ্রন্থটি অমূল্য তাহকীকসহ প্রকাশের
তাওফীক দিয়েছেন। আপনি গ্রন্থটিতে এমন-সব বিষয়ে আলোকপাত করেছেন, যা আপনার অগাধ পা-িত্য, সূক্ষ্ম গবেষণার প্রমাণ বহন করে। যা এই গ্রন্থের শ্রী বৃদ্ধি করেছে। গ্রন্থটিকে কল্যাণ ও উপকারিতায় আরও সমৃদ্ধ করেছে।
এ ছাড়া ৪ জুমাদাল উলা ১৩৮৯ হিজরীতে শাইখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. এর কাছে লিখিত এক পত্রে শাইখের প্রশংসা করে লিখেছেন : তিনি সচেতন ও নেকদিল আলিমদের অন্যতম। দুই.
বিশিষ্ট মুহাক্কিক আলিম ও মুহাদ্দিস আল্লামা হাবিবুর রহমান আজমী তার এক চিঠিতে তাকে <يرْرِّحِّ ْالن اَّلَمة َالع) <বিদগ্ধ মহান আলিম) বলে সম্বোধন করেছেন। এবং তার প্রশংসায় কবিতার দুটি পঙ্ক্তি রচনা করেছেন :
اًبَْحرَِ وم ِنََك اهلَِمْدَقِْالً ِبأهال َّشامَِامَا إمَبْال َّشهَِاِلَعََي
শাহবার হে মহান আলিম, সিরিয়ার হে মহান ইমাম! আপনার শুভাগমনে আপনাকে স্বাগতম ও অভিনন্দন। َشاواآلََثِرِْهقِالفَلْمِو عََِْيْي ِلَِ ذَاك ال َّشامْدعََك ب ِعْمٌَّ َكجيِم হাদীস ও ফিকাহশাস্ত্রকে ওই শামীর পর
শামের আর কেউ আপনার ন্যায় সংকলন করেনি।
এখানে ‘শামী’ বলতে আল্লামা ইবনে আবেদীনকে বোঝানো হয়েছে। যার রচিত ফিকহের গ্রন্থ ভারতীয় উপমহাদেশের লোকদের নিকট ফতোয়ায়ে শামী নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এবং গ্রন্থকারকে সবাই এক বাক্যে আল্লামা শামী হিসেবেই চেনে।
একবার তিনি শাইখকে লক্ষ্য করে বললেন, হে শাইখ, আমি আপনাকে আমার মাশায়িখদের মতোই সম্মান করি। আল্লাহ তাদের
সকলের প্রতি তার রহমতকে অবারিত করে দিন। তাদের জান্নাতের অভ্যাগতদের কাতারে শামিল করুন।
তিন.
শাইখ ফকীহ মুহাম্মদ আবু যুহরা তার পত্রে শাইখকে সম্বোধন করে লেখেন :
পর সমাচার.. আপনার একান্ত পুণ্যময় সান্নিধ্যে আমি আমার জীবনের যে মুহূর্তগুলো কাটিয়েছি সেগুলোই ছিল আমার জীবনের সৌভাগ্যময় সময়। যে সময়গুলোতে আমি আপনার মাঝে মুত্তাকীদের ইখলাস, মুমিনদের বিচক্ষণতা, ওলী
আউলিয়াদের রিয়াযত-মুজাহাদায় মুরিদদের যে ধৈর্য ও সহনশীলতা প্রদর্শিত হয় তা প্রত্যক্ষ করেছি।
ওই সময়গুলোতে আপনার কাছ থেকে যে নিষ্কলুষ আচরণ, ভালোবাসা, ¯েœহ, ও উত্তম সাহচর্য লাভ করেছি আজ সেগুলো আর কোথাও খুঁজে পাই না।
চার.
মহান আলিম, মুহাদ্দিস আবদুল্লাহ ইবনেস সিদ্দিক গামারী রহ. তার কাছে লিখিত এক পত্রে তার কোনো এক গবেষণা ও বিশ্লেষণের প্রশংসা করেন। ইবনে আবি হাতেম আল জারহু ওয়াত তা’দিল গ্রন্থে যাদের আলোচনা করেছেন এবং যাদের আলোচনা থেকে বিরত থেকেছেন এ বিষয়ের ওপর একটি গবেষণা ও বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা করেন। তার এ আলোচনার প্রশংসা করে তিনি শাইখকে আল্লামা ও মুহাদ্দিস বলে উল্লেখ করার পাশাপাশি বলেন, আপনি এতে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার বিচ্ছুরণ ঘটিয়েছেন।
পাঁচ.
মহান ও শ্রেষ্ঠ আলিম, ফকীহ, গবেষক, সুসাহিত্যিক, সম্পাদক, অগণিত গ্রন্থের রচয়িতা ও মুহাক্কিক শাইখ মুস্তফা যারকা রহ. ছিলেন শাইখের পুরানো বন্ধু। সফাহাতুম মিন সাবরিল উলামা গ্রন্থটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে শাইখের প্রশংসা করে বলেন :
আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. আমার প্রাণপ্রতিম বন্ধু। আমার হৃদয়ের চেয়েও বেশি যাকে ভালোবাসি, ছোট হওয়ার পরও যাকে আমি সম্মান করি। আল্লাহ তাঁকে হেফাজত করুন, ইলম-আমল, ইখলাস-তাকওয়া, সম্মান-মহানুভবতায় তাঁকে ভরপুর করুন।
হাদীস ও উলূমে হাদীসে ব্রুনাইয়ের সুলতান হাসান বালকিয়ার আন্তর্জাতিক পুরস্কারের জন্য মুস্তফা যারকা রহ. যখন ব্যক্তি বাছাই করছিলেন, তখন তিনি শাইখকে এ পুরস্কারের জন্য বাছাই করলেন। এবং তাঁকে এ পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন, আমি যাদের চিনি, যাদের সম্পর্কে জানি, যাদের এ পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করা যেতে পারে, তাদের মধ্যে আমি একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা করে দেখেছি। আমার পর্যালোচনায় যাকে সবেচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি বলে মনে হয়েছে, যার সূক্ষ্ম গবেষণার পর্যায়ে এখনো কেউ পৌঁছতে পারেনি, তিনি হলেন বিশিষ্ট আলিম, মুহাক্কিক, ফযিলাতুশ শাইখ, দৃঢ়চেতা গবেষক, নির্ভরযোগ্য বিশ্লেষক উস্তায আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ। তার ইলমী যোগ্যতা ও জ্ঞানগত পারদর্শিতার পাশাপাশি তিনি উত্তম চরিত্র ও উন্নত ইসলামী আদর্শের ধারক। সম্মানীত আসনের অধিকারী। তার ব্যক্তিত্বের মাঝে উলামায়ে কিরামের বিনয়, দীন ও শরীয়তের ওপর অবিচলতা ও অনমনীয়তার সমাহার ঘটেছে।
শাইখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. এর ইন্তেকালের পর শাইখ মুস্তফা যারকা যখন শাইখের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেছিলেন, তখন বলেছিলেন, বর্তমান যুগে শাইখের মতো আর কেউ নেই।
ছয়.
বিশিষ্ট মুহাক্কিক আলিম শাইখ সায়্যিদ আহমদ সকর রহ. বলেন, আখলাক-চরিত্রকে যদি বলা হয় আকৃতি ধারণ করো, তবে দেখা যাবে সে আবদুল ফাত্তাহের আকৃতিতে দ-ায়মান।
সাত.
শাইখ আল্লামা মুহাম্মদ শাজিলী আন নাইফির রহ. শাইখের ইন্তেকালে সমবেদনা জ্ঞাপন করে এক পত্রে লেখেন, মহান আলিম, মরহুম ইমাম, সম্মানিত ব্যক্তিত্ব শাইখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. এর মৃত্যুসংবাদ আমাদের ওপর বজ্রপাতের মতো মনে হলো। এর কারণ হলো, তার দীনদারী, সম্মান ও অগাধ পা-িত্য। তিনি ছিলেন ওই সকল ব্যক্তিদের অন্যতম, যুগের ইতিহাস যাদের নিয়ে গর্ব করে।
আট.
বিশিষ্ট ফকীহ ও মুহাক্কিক আলিম, উস্তায মুহাম্মদ হাবীব ইবনুল খাওজাহ শাইখের কাছে লিখিত এক পত্রে লেখেন, “মহান ব্যক্তিত্ব, বিজ্ঞজন, মহান আলিম ও সুন্নাহর সংরক্ষণকারী।”
তার মৃত্যুতে তিনি যে শোকবার্তা প্রেরণ করেন সেখানে লেখেন, মহান ব্যক্তি, ফকীহ ও মুহাদ্দিস আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. এর মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত ও মর্মাহত।
নয়.
বিশিষ্ট দাঈ ইলাল্লাহ, আল্লাহওয়ালা বিজ্ঞ আলিম শাইখ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. সফাহাতুম মিন সবরিল উলামা গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণে গ্রন্থটি সম্পর্কে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, উচ্চমার্গের চিন্তা-চেতনা, দৃষ্টিভঙ্গির গভীরতা ও বিশালতায়, জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পদচারণায় ও পা-িত্যে যিনি আকাবিরে উম্মতের প্রকৃত ওয়ারিস, ফযিলাতুশ শাইখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. এর সফাহাতুম মিন সবরিল উলামা গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণে, এ কিতাব সম্পর্কে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশের এ সুযোগটিকে নিজের জন্য খুবই সৌভাগ্যের বলে মনে করছি। কারণ, আমি এমন এক নূরানী সূত্রে নিজের কথাগুলো সংযোজন করতে চলছি, স্মরণকালের ইতিহাস যার কল্যাণময়তার সাক্ষ্য দিয়ে চলেছে। প্রাচ্য থেকে প্রতীচ্যে সর্বত্র।
তিনি তার কোনো এক ছাত্রকে শাইখের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে তাকে সম্বোধন করে বলেছিলেন, একটা সময় এমন আসবে যখন তুমি ওই সকল উলামায়ে কিরামের আলোচনা করবে যাদের সাথে তোমার সাক্ষাৎ হয়েছে এবং এ সাক্ষাৎকে তুমি তোমার জন্য সম্মান ও ইয্যতের কারণ মনে করবে। সেদিন তুমি গর্বের সাথে বলবে, আমি শাইখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহর সাক্ষাৎ পেয়েছি।
দশ.
বিশিষ্ট আলিম ও মুহাদ্দিস, ফকীহ আবদুর রশিদ নুমানী রহ. শাইখের কাছে লিখিত এক পত্রে নি¤েœর বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ করে তাঁকে সম্বোধন করেন, মহান ব্যক্তিত্বের অধিকারী, বিশিষ্ট হাদীস সমালোচক, গবেষক, অগাধ জ্ঞানের অধিকারী হালবের সৌন্দর্য ও শোভা।
এগারো.
মহান ব্যক্তিত্বের অধিকারী সুদক্ষ ক্বারী, বুযুর্গ ফকীহ, প্রখ্যাত হাফিয আল্লামা আবদুল ওয়াহাব দামেস্কী রহ. বলেন, যদি পরীক্ষার মাধ্যমে মুফতী নির্বাচন করা হতো, তবে শাইখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. হবেন ফতোয়া প্রদানের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি।
বারো.
বিশিষ্ট কারী ও শাইখ কারীম সায়ীদ রাজেহ হাফিজাহুল্লাহ হলেন দামেস্কের কারীদের উস্তায। তিনি তার শোকবার্তায় আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ.-কে ‘আল্লামাহ’ বলে উল্লেখ করেছেন। তেরো.
দামেস্কের মহান আলিম শাইখ আহমদ নসীব মাহামিদী রহ. তার শোকবার্তায় তাকে আল্লামাহ, গবেষক, নির্ভরযোগ্য, বিশ্লেষক অভিধায় উল্লেখ করেছেন,
তিনি ছিলেন মহান হাদীস-বিশারদ, উসূলবিদ ও সাহিত্যিকদের অন্যতম। একাধারে আলিম, শিক্ষার্থী ও শিক্ষক। তার মাঝে ইবনুল মুবারকের চরিত্রমাধুর্যের স্ফুরণ ঘটেছিল, যার বৈশিষ্ট্য ছিল কবর পর্যন্ত শিক্ষা অর্জন করা।
চৌদ্দ.
মরক্কোর মহান আলিম ও মুহাদ্দিস আবদুল্লাহ বিন আবদুল কাদির তালিদী বলেন, তিনি ছিলেন অগাধ পা-িত্যের অধিকারী, মুহাদ্দিস, মুহাক্কিক, গবেষক, ও বিজ্ঞ আলিম। জ্ঞানে ও পা-িত্যে, ইলমী সাধনায় ও গবেষণায়, সম্মান ও মর্যাদায় তিনি যুগের দুর্লভ ব্যক্তি। সময়ের সুসন্তান ও অনন্য ব্যক্তিত্ব।
পনেরো.
বিশিষ্ট উসূলবিদ ও ফকীহ, শাইখ ড. আবদুল ওয়াহাব বিন ইবরাহীম আবু সুলাইমান মাক্কী। সৌদির হাইআতু কিবারিল উলামার অন্যতম সদস্য। তিনি বলেন, শাইখ ছিলেন, অগাধ জ্ঞানের অধিকারী মুহাদ্দিস ও ফকীহ। তিনি ছিলেন ওই সকল মহান আলিমদের অন্যতম, যাদের মাঝে হাদীসশাস্ত্রের বর্ণনা ও জ্ঞান-সাধনার, ফিকহশাস্ত্রের মৌলিকতা ও শাখা-প্রশাখার অগাধ জ্ঞানের সমাহার ঘটেছিল।
ষোলো.
শাইখ ও ফকীহ আবদুল ফাত্তাহ বিন হুসাইন রাওয়াহ আল মাক্কী রহ. শাইখ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, তিনি ছিলেন এমন বিজ্ঞ মুহাদ্দিস, যার ইলম ও আমল, আদব ও বিনয়, বর্ণনা ও গবেষণা, তাহকীক ও নির্ভরতা, আদর্শ ও মতাদর্শ দেখে বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়।
শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রতিভা বিকাশের কার্যকারণ
১. ধার্মিক পরিবার।
২. সততা, তাকওয়া ও অবিচলতা।
৩. স্বভাবজাত মেধা।
৪. স্বভাবজাত রুচিবোধ।
৫. স্বভাবজাত শিষ্টাচার।
৬. বিচক্ষণতা ও প্রতুৎপন্নতা
৭. উত্তম চরিত্র।
৮. অসাধারণ বিনয়।
৯. বুদ্ধিমত্তা, প্রজ্ঞা ও উদারনীতি।
১০. ইলমের প্রতি ভালোবাসা ও জ্ঞানার্জনের প্রতি আসক্তি। ১১. সুদৃঢ় মনোবল।
১২. সমকালীন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উলামায়ে কিরামের সাক্ষাৎ লাভ।
১৩. উলামায়ে কিরামের নিকট থেকে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ বিষয়গুলো অর্জন।
১৪. বিভিন্ন উদ্দেশ্যে অসংখ্য সফর।
১৫. রচনা ও সংকলনে নিরত থাকা।
১৬. দরস ও তাদরীসে লিপ্ত থাকা।
১৭. দাওয়াত ও তাবলীগে ব্যস্ত থাকা, যা তাঁকে স্বদেশ ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে খ্যাতি দান করেছে।
১৮. তার সুন্দর ও মায়াবী গঠন।
ব্যক্তিত্ব বিকাশের রহস্য
১. তাকওয়া ও সততা।
২. সুন্দরকে গ্রহণ করার রুচিবোধ।
৩. পূর্ণতা ও পরিপূর্ণতার প্রতি অদম্য আগ্রহ।
৪. রুচিবোধ।
৫. শিষ্টাচার ও সুন্দর চরিত্র।
৬. সময়ের প্রতি যতœশীলতা।
৭. রচনা, সংকলন ও অধ্যয়নের মাধ্যমে ইলমের প্রচ- পিপাসা। ৮. তুখোড় মেধা।
৯. বিস্ময়কর স্মৃতিশক্তি।
১০. শরীয়তের আলোয় দীপ্তিমান বিবেক।
১১. প্রখর অনুভূতি-শক্তি।
তার অমিয় বাণী
< إلسْا ইসলাম হলো রুচিশীলতার নাম।
ْ < قذَوُْالَم
ُ < ُكلَّهَهأْتََرإََّل إذَا ق َُّهرْ َك سِيْطِعُُب ََل ي اَتِ < الكে কানো কিতাব তোমার সামনে তার রহস্য উন্মোচন করবে না, যতক্ষণ না তুমি পুরোটা পড়বে।
َ < لَّمسَوِهْعلَيُلى هللاَِ ص إََّل للنَِّبد َحُ ألُِكلَّهَْاخلَْيَُ هللاََجَعاَ
< م রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যতীত অন্য কারও মাঝে আল্লাহ তাআলা সকল কল্যাণের সমাহার ঘটাননি।
ِاِلَالعَُّةِزيَم ِعِْ ال َّشر لِظِْل بقََظ الْعِقْوُ
ْنأِ >
< ي আলিমের বৈশিষ্ট্য হলো শরীয়তের ছায়ায় বিবেককে জাগ্রত করা।
ْ < َعْق لَيْطَارنِقُاجَتْ م ََيلْعُِمَهْرِ ل ، ودْقَعُْطَارنِقُاجَتْ ل ََياَمُمَهْر এক د > ِ দিরহাম সম্পদের জন্য এক কিনতার বুদ্ধির প্রয়োজন কিন্তু এক দিরহাম ইলমের জন্য প্রয়োজন দুই কিনতার বুদ্ধি।
ِم<َْهابلفَُّشقَعَت ُي ُلْمِالعে বাধ ও উপলব্ধির মাধ্যমেই ইলমকে ভালোবাসা যায়।
ইন্তিকাল
শাইখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ. ৯ শাওয়াল ১৪১৭ হিজরী রবিবার ভোরে রিয়াদ শহরে মহান রব্বে কারীমের ডাকে সাড়া দেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ছয়দিন কম একাশি বছর তিন মাস। আল্লাহ তাকে ক্ষমা করুন। তার আত্মাকে পবিত্র করুন। তার কবরকে আলোকিত করুন। তার সমাধিকে প্রশান্তিময় করুন। সমাধিস্থলকে সুরভিত করুন।
সোমবার যোহর নামাযের পর রিয়াদের রাজেহী মসজিদে তার জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর বিমানযোগে তাকে মদীনাতুল মুনাওয়ারায় নিয়ে যাওয়া হয়। ইশার নামাজের পর মসজিদে নববীতে
তার দ্বিতীয় জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর জান্নাতুল বাকীতে তাকে দাফন করা হয়। তার জানাযাটি ছিল দেখার মতো। লোকে লোকারণ্য। সেদিন এত জনসমাগম হয়েছিল যে জান্নাতুল বাকীতে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। আগত প্রতিটি মানুষের মুখেই ছিল শাইখের প্রশংসা ও স্তুতি। শাইখের জন্য দু’আ ও মুনাজাত। সকলের চোখ ছিল অশ্রুসিক্ত।
তুর্কিস্তান, হিন্দুস্তান, কাতার ও মরক্কোর বিভিন্ন মসজিদে তার গায়েবানা জানাযাও অনুষ্ঠিত হয়েছে।
هِانَْكفأَْف ِيفِ د لُفََسجدََِسلى ذَاك ا ْْلَعُ هللاِةْْحََر
একটি মহান দেহ কাফনের শুভ্র বসনে আচ্ছাদিত
ওই দেহের ওপর আল্লাহর রহমত হোক অবারিত।
আয়েশা রাযি. থেকে মারফু ও সহীহ সনদে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
ِهْلَيَي عِل َُصت
ِ ت يَمْنِا مَاَل: গ্ধمَقَلَّمَسَوِهْلَيَعُلَّى هللاَِ ص ِن النَِّبََ، عَشةِائَعْ
َن
َّمةع أُ ِيهِوا فُعِ ََِّل ُشف، إُوَن لَهَُعَ ْشفيْمُهُُّكل،ًَةائُِوَن ملُغْب ََْي ي مِِلُْسالْمَن
م ্র ِ
যে ব্যক্তির জানাযায় এক শ মুসলমান অংশগ্রহণ করে এবং তাদের প্রত্যেকে তার জন্য সুপারিশ করে, তবে তার ব্যাপারে তাদের সুপারিশ কবুল করা হবে।৫
আবদুল্লাহ বিন আব্বাস রাযি. থেকে মারফু সনদে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ُ ْشِرُكوَن ِابهللًِال، ََل يَُجوَن رُعَب ْأَرِهِتَازَنَلَى جَعُُومقَي َُت، ف َُو م َيِلُْس ل مَُجرْنِا مَগ্ধم ،গ্ধِيهِفُُ هللامُهَََِّل َشَّفعا، إًئَْشي
৫. সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৯৪৭
যদি কোনো মুসলিম মৃত্যুবরণ করে এবং তার জানাযায় এমন চল্লিশ জন লোক উপস্থিত হয়, যারা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করে না, তাহলে আল্লাহ তাআলা তার ব্যাপারে তাদের সুপারিশ কবুল করে নেবেন।৬
সুসংবাদসমূহ
ইন্তিকালের চার দিন পূর্বে পেটের পীড়ার কারণে প্রায় চৈতন্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। পেটের পীড়া তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দেখা দিয়েছিল। সহীহ ইবনে হিব্বানের এক বর্ণনায়৭ নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পেটের পীড়ায় মৃত্যুবরণকারীকে শহীদ বলে উল্লেখ করেছেন। এর পূর্বে তার কিডনি ডায়ালিসিস করা হয়েছিল। তার পুত্র সালমান বলেন, ডায়ালিসিসের পর আমি যখন তার কক্ষে প্রবেশ করলাম, দেখলাম তিনি অনুচ্চস্বরে অনবরত কালিমায়ে শাহাদাত পড়ছিলেন।
এরপর তার পবিত্র আত্মা যখন আপন প্রতিপালকের সান্নিধ্যে পরওয়াজ করল, তখন তিনি কালিমায়ে তাওহীদ পাঠের মাধ্যমে এমন এক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটালেন, যে জীবন উৎসর্গিত ছিল ইসলাম ও মুসলিমদের খেদমতে। আর যার জীবনের সমাপ্তিবাক্য হবে লা
ইলাহা ইল্লাল্লাহ তার জান্নাত তো অবধারিত।
এ সময় নামাযী ব্যক্তির তাশাহ্হুদের ন্যায় তার শাহাদাত আঙুল মধ্যমার ওপর রাখা ছিল। তার গোসল ও দাফন পর্যন্ত আঙুলদ্বয় ওই অবস্থায় ছিল।
পরিশিষ্ট
৬. সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৯৪৮
৭. সহীহ ইবনু হিব্বান, হাদীস নং ৩১৯০
সারাজীবন ইলমের প্রতি যে প্রচ- আগ্রহ ও সুন্নাতে নববীর প্রতি যে আসক্তি লালন করে এসেছেন মৃত্যুর বিছানাতেও তার সে আগ্রহ ম্লান হয়ে যায়নি।
পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কয়েকদিন পূর্বের কথা। জনৈক সাহিত্যিক তাঁকে দেখতে এলেন। তখন উভয়ের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হলো। আলোচনার একপর্যায়ে ওই সাহিত্যিক বললেন, আমার কাছে উসমাহ বিন মুনকিযের ইতিবার গ্রন্থ সম্পর্কে একটি গবেষণাধর্মী আলোচনা রয়েছে। শাইখ ওই গ্রন্থটি নিয়ে কাজ করেছিলেন। তাতে টীকা সংযোজন করেছেন এবং ইলমী বিশ্লেষণ করেছিলেন। কিন্তু সেটি তখনো ছাপা হয়নি। তখন শাইখ আবদুল ফাত্তাহ রহ. তার কাছে ওই আলোচনার একটি নুসখা চাইলেন। এমন এক সময় তিনি চাইলেন যখন তিনি অসুস্থ হয়ে বিছানায় শায়িত। যখন তিনি অসুস্থতার তীব্র যন্ত্রণায় কাতর। আল্লাহ তার আত্মাকে পূতপবিত্র করুন।
তিনি যখন অসুস্থ হয়ে বিছানায় শায়িত, তার সন্তানরা তাঁকে দেখা শোনা করতেন। সব সময় সজাগ দৃষ্টি নিয়ে পিতার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতেন। এমনই একদিন তার কোনো এক কন্যা পিতার শিয়রে দাঁড়িয়ে ছিল। ইতিমধ্যে তার (কন্যার) পানির পিপাসা হলে পান করার জন্য বাম হাতে গ্লাস নিল। শাইখের রোগের তীব্রতা ক্রমান্বয়ে বাড়ছিল। দিন দিন তার অবস্থার অবনতি ঘটছিল। এ দেখে পরিবারের সকলেই খুব পেরেশান ছিল। এই পেরেশানির কারণে ডান হাতে নেয়ার কথা ভুলে গিয়েছিল। তখন শাইখ তাকে ইশারা করলেন। কিন্তু আপন পিতার এ অবস্থা দেখে তার অবস্থাও এতটাই নাজুক ছিল যে পিতার ইশারা সে বুঝতে পারেনি। তখন শাইখ কন্যার হাত ধরে নাড়া দিলেন। যেহেতু তখন তিনি তার বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন তাই হাত দিয়েই তাকে থামালেন। তখন তার কন্যা
পিতার উদ্দেশ্য বুঝতে পারলেন। এবং ডান হাতে গ্লাস নিয়ে পান করলেন। কী বিস্ময়কর ব্যাপার! মৃত্যুশয্যায়ও সুন্নাতে নববীর প্রতি এতটা সজাগ!! কন্যাকে নববী আদর্শের ওপর পরিচালনা করার এত তীব্র বাসনা!!
তার জীবনের সর্বশেষ বিস্ময়কর ঘটনা হলো। তিনি অসুস্থ হয়ে যখন চক্ষু হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। তখনো তার মাঝে ইলমের এ পিপাসা বর্তমান ছিল। নিজে পড়ার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। তাই বলে জ্ঞানার্জনের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেননি। একদিন তিনি তার পুত্র সালমানকে ইমাম যাহাবীর সিয়ারু আলামিন নুবালা থেকে পড়ে শোনানোর জন্য বললেন। তার পুত্র তখন আবদুল্লাহ বিন মুবারক রহ. এর জীবনী শুরু থেকে পড়ে শোনাতে শুরু করলেন। তিনি যখন দেখলেন যে জীবনীটি বেশ লম্বা প্রথম থেকে পড়তে বেশ সময় লাগবে। তখন শাইখ তাকে বললেন শেষের দিকে পড়ো। ইবনুল মুবারকের শোকে রচিত কয়েকটি পঙ্ক্তি পড়ে শোনানোর জন্য বললেন, তারপর নীরব হয়ে গেলেন।
এ শোকগাথায় জ্ঞানীদের জন্য অনেক শিক্ষা রয়েছে। শোকগাথাটি নি¤œরূপ :
ِقاطَِنِ بَْسلَيَْظًا وعَِن وَعَْسَأَوً فةََغْدو َكِارَِن املبْ ابَِْبقِْ ُت برَرَم يِاِرقَفَِب الَّذِي ِيف مِْابل َّشيًَّا ويِي َغناِنَِِوَِم الَّذِي ِيف جلُِْت ِابلعُْكنَ ْد قَو ِقِائَقَِل احلاَِرجْنِْت ماءَجَيِذَا هِإالًِاقَعُهِ بَن َُى ت ْكرَى ال ذِأَرْنلَكَِو
প্রভাতে আমি ইবনুল মুবারকের সমাধির পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলাম। তখন তিনি আমাকে উপদেশ দিলেন, যদিও তাতে কোনো শব্দ ছিল না।
আমি তো আমার চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ইলম ও আমার শরীরে ছড়িয়ে থাকা বার্ধক্যের কল্যাণে নিজেকে সচ্ছলই মনে করতাম।
কিন্তু আমি দেখলাম এ উপদেশগুলো উদাসীনকে সজাগ করে দেয়। বিশেষ করে তা যখন সত্য পুরুষদের পক্ষ থেকে আসে।
সত্যি উপদেশ যখন সত্য মানুষদের পক্ষ থেকে আসে তা গাফেলকে জাগিয়েই তোলে। হে প্রিয়তম, আল্লাহ আপনার প্রতি রহম করুন। আপনার মৃত্যুকে আমাদের গাফেল হৃদয়গুলোর জন্য উপদেশ বানিয়ে দিন। আপনাকে ও আমাদের ঈল্যিয়্যিনে সত্য সমুন্নত আসনে নবী
সিদ্দীকগণের সাথে একত্র করে দিন। হে আল্লাহ, আমাদের তার প্রতিদান থেকে বি ত কোরো না। তার তিরোধানের পর আমাদের পরীক্ষায় ফেলো না। আমাদেরও ক্ষমা করে দাও। তাকেও মাফ করে দাও। আমাদের চক্ষুগুলো অশ্রুপ্লাবিত। হৃদয়গুলো শোকে জর্জরিত। আমাদের রব যাতে সন্তুষ্ট, আমরা তাতেই সমর্পিত। হে আবদুল ফাত্তাহ, হে চক্ষুর শীতলতা, আমরা আপনার বিচ্ছেদে শোকাহত।
লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/AbdulFattahAbuGhuddahBN/posts/pfbid02sxPgTsiFgsN8duTwWuZi7Dusekqhya2xmEGw4rALRWkVVpDGLYvmnyV8J3rahcvCl
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
Would you advise individuals to study hadith from al-Bukhari and Muslim on their own?
Any Muslim can benefit from reading hadiths from al-Bukhari and Muslim, whether on his own or with o...
কাবলাল জুমআ চার রাকাত ; একটি দালিলিক পর্যালোচনা
একজন সম্মানিত আলিমের একটি কথা, যিনি রিয়াদ থেকে পি.এইচ.ডি করেছেন এবং এখন এদেশের একটি ইসলামী বিশ্ববিদ...
صعوبة الجمع بين الفقه والحديث:
تأليفُ الحديث وجمعه في كتاب على الأبواب الفقهية، لا ينهض به إلا فقيه يدري معاني الأحاديث، ويفقه مدار...
ফিক্বহের গুরুত্ব এবং ফক্বীহদের বৈশিষ্ট্যাবলী
...