বিবাহ সম্পর্কে কিছু নছীহাত
প্রশ্নঃ ৮২৪৩. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, বিবাহ সম্পর্কে কিছু নছীহাত ?,
১৯ জুন, ২০২৪
গৌরনদী
উত্তর
و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
কিছু মুল্যবান প্রবন্ধ উল্লেখ করছিঃ
১- বিবাহ ও দাম্পত্য জীবন : কিছু দ্বীনী মুযাকারা
বিবাহ মানুষের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষঙ্গ। স্বাভাবিক জীবনের অনিবার্য একটি প্রয়োজন। একজন মানুষ যখন শিশু হিসেবে ভূমিষ্ঠ হয় তখনই তার মাঝে খাবারের চাহিদা থাকে; বরং মাতৃগর্ভে প্রাণ সঞ্চারের পর থেকেই তার মাঝে খাবারের চাহিদা সৃষ্টি হয়। এ সময় তার মাঝে মানবজীবনের অন্য অনেক সাধারণ চাহিদা থাকে না। সে ভূমিষ্ঠ হয়ে ধীরে ধীরে যখন বড় হতে থাকে তখন পর্যায়ক্রমে তার অনেক প্রয়োজন দেখা দিতে থাকে। যখন সে আরো বড় হয়, পরিণত বয়সে উপনীত হয় তখন তার বিবাহের প্রয়োজন হয়। ব্যক্তিভেদে মানুষের জীবনে বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজন থাকতে পারে, তবে কিছু প্রয়োজন এমন রয়েছে, যা প্রায় প্রতিটি মানুষের মাঝেই বিদ্যমান। বিবাহ তারই একটি।
আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং একে মানবজাতির প্রতি অনুগ্রহ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যেহেতু সমগ্র জগৎ আল্লাহরই সৃষ্টি, জগতের নিয়ম-নীতি তিনিই তৈরি করেছেন, মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি তাঁরই সৃষ্টি, তাই প্রত্যেক সৃষ্টির মাঝে এমন উপাদান তিনি দান করেছেন, যার মাধ্যমে জগৎটা সুন্দরভাবে পরিচালিত হতে পারে। এ ব্যবস্থা তাঁরই দেয়া। তাঁরই হিকমত।
আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ مِنْ اٰیٰتِهٖۤ اَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِّنْ اَنْفُسِكُمْ اَزْوَاجًا لِّتَسْكُنُوْۤا اِلَیْهَا وَ جَعَلَ بَیْنَكُمْ مَّوَدَّةً وَّ رَحْمَةً ؕ اِنَّ فِیْ ذٰلِكَ لَاٰیٰتٍ لِّقَوْمٍ یَّتَفَكَّرُوْن.
আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্য থেকে এটি একটি যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদেরই মধ্য হতে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের সঙ্গীণীকে, যাতে তোমরা তাদের নিকট শান্তি লাভ করতে পার এবং তোমাদের (স্বামী-স্ত্রীর) পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এতে বহু নিদর্শন রয়েছে, সেইসব লোকের জন্য, যারা চিন্তা-ভাবনা করে। -সূরা রূম (৩০) : ২১
অন্যত্র আরো ইরশাদ করেন-
هُوَ الَّذِیْ خَلَقَكُمْ مِّنْ نَّفْسٍ وَّاحِدَةٍ وَّ جَعَلَ مِنْهَا زَوْجَهَا لِیَسْكُنَ اِلَیْهَا
তিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি হতে সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁর থেকেই তাঁর স্ত্রীকে বানিয়েছেন, যাতে সে তার নিকট প্রশান্তি লাভ করতে পারে। -সূরা আরাফ (৭) : ১৮৯
একসময় মানুষ ছিল না। আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করতে চাইলেন। উদ্দেশ্য, তারা তাঁর ইবাদত করবে, তাঁর হেদায়েত মত চলবে। আল্লাহ কীভাবে মানুষ সৃষ্টি করলেন? একসাথে? না, বরং প্রথমে একজন, অতপর তার থেকে তার স্ত্রী, অতপর তাদের থেকে সকল মানুষকে। কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اتَّقُوْا رَبَّكُمُ الَّذِیْ خَلَقَكُمْ مِّنْ نَّفْسٍ وَّاحِدَةٍ وَّ خَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَ بَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِیْرًا وَّ نِسَآءً.
হে মানব! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক ব্যক্তি থেকে এবং তারই থেকে তার স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন, আর তাদের থেকে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন। -সূরা নিসা (৪) : ১
মানুষের মাঝে বিবাহরীতি আল্লাহই দান করেছেন। আর আল্লাহপ্রদত্ত এ বিবাহরীতিতে শুধু জাগতিক দিকটিই মুখ্য নয়; বরং তাতে দ্বীনি বা ধর্মীয় দিকটিও সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। ইসলাম এ বিধানের হাকীকত ও উদ্দেশ্য এবং এর নীতিমালাকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে আলোচনা করেছে। এ সম্পর্কে কুরআন-হাদীসে বর্ণিত কিছু তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করব।
আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে সৃষ্টি করে এ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তাঁর ইবাদতের জন্য। তাদের মূল লক্ষ্য আখেরাতের জীবন। দুনিয়ায় সুশৃঙ্খল জীবনের সাথে সাথে আখেরাতে কীভাবে তারা সফল হবে, সেজন্য তিনি তাদের দিয়েছেন বিস্তারিত পথনির্দেশ। তাই সব কাজে আখেরাতকে স্মরণ রাখা মানুষের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। সুতরাং নিছক জাগতিক বিষয়গুলোও সে এমনভাবে সম্পাদন করবে, যা দ্বারা সে আখেরাতে সফল হবে। এটাই শরীয়তে কাম্য এবং বিবেকের দাবি।
বিবাহের প্রসঙ্গটিও এমন। বিবাহকে শরীয়ত নিতান্তই জাগতিক বিষয় বিবেচনা করে না; বরং সেটাকে স্বামী-স্ত্রী এবং তৎপরবর্তী সন্তান-সন্ততি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আখেরাতের সফলতার মাধ্যমও বিবেচনা করে।
দ্বীনদার স্বামী-স্ত্রী, দ্বীনদার পরিবার
একটি দ্বীনদার পরিবার, দ্বীনদার সন্তান-সন্ততি ও বংশধরের জন্য সর্বপ্রথম যে বিষয়টি লক্ষ্যণীয় তা হল, দ্বীনদার স্বামী-স্ত্রী। এজন্য বিবাহের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবার আগে এ বিষয়টি লক্ষ রাখতে বলেছেন। আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
أَنْكِحُوا الصّالِحِينَ وَالصّالِحَاتِ، فَمَا تَبِعَهُمْ بَعْدُ فَحَسَنٌ.
নারীদেরকে সালেহ (দ্বীনদার-নেককার) পুরুষের নিকট বিবাহ দাও, আর পুরুষদেরকে সালেহা (দ্বীনদার-নেককার) নারীর সাথে বিবাহ দাও; ফলশ্রুতিতে তাদের যে সন্তান হবে তারা হবে উওম (নেককার)। -সুনানে দারিমী, হাদীস ২২২৭
এজন্য শরীয়ত বিবাহের ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রীর দ্বীনদারীর প্রতি সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছে।
বিবাহের ক্ষেত্রে ইসতেখারা
যে কোনো বড় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে এলে শরীয়ত প্রথমে ইসতেখারা করতে বলে। বিবাহও জীবনের একটি গুরুত¦পূর্ণ বিষয়, ফলে এক্ষেত্রেও নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসতেখারা করতে বলেছেন। প্রিয় সাহাবী আবু আইয়ূব আনসারী রা.-কে তার বিবাহের বিষয়ে কীভাবে ইসতেখারা করবে তা শিখিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন- প্রথমে তোমার প্রস্তাব গোপন রাখো, অতপর উওমরূপে অযু কর এবং যে কয় রাকাত সম্ভব নামায পড়, অতপর আল্লাহর প্রশংসা করে বল-
اللّهُمّ إِنّكَ تَقْدِرُ وَلَا أَقْدِرُ، وَتَعْلَمُ وَلَا أَعْلَمُ، وَأَنْتَ عَلّامُ الْغُيُوبِ، فَإِنْ رَأَيْتَ فِيَ فُلَانَةَ - وَتُسَمِّيهَا بِاسْمِهَا - خَيْرًا لِي فِي دِينِي وَدُنْيَايَ وَآخِرَتِي فَاقْدُرْهَا لِي، وَإِنْ كَانَ غَيْرُهَا خَيْرًا لِي مِنْهَا فِي دِينِي وَدُنْيَايَ وَآخِرَتِي فَاقْضِ لِي ذَلِكَ.
হে আল্লাহ! আপনি সক্ষম আমি অক্ষম। আপনি জানেন আমি জানি না। আপনি গায়েব তথা অদৃশ্য বিষয়ে সম্যক অবগত; আপনি যদি অমুককে (পাত্রীর নাম নিবে) আমার দ্বীন-দুনিয়া এবং আখেরাতের ক্ষেত্রে কল্যাণকর মনে করেন তাহলে তাকে আমার জন্য সহজ করে দিন। আর যদি তার থেকে অন্য কেউ আমার দ্বীন-দুনিয়া ও আখেরাতের ক্ষেত্রে কল্যাণকর হয় তাহলে আমার জন্য তাই ফয়সালা করুন। -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৪০৪০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৩৫৯৬
এ বর্ণনায় দুআটি এ ভাষায়ই এসেছে। তবে প্রসিদ্ধ হল-
اللّهُمّ إِنِّي أَسْتَخِيرُكَ بِعِلْمِكَ...
যা সহীহ বুখারীসহ হাদীসের বিভিন্ন কিতাবে রয়েছে।
সামান্য ভাবলেই বুঝা যায় যে, বিবাহের ক্ষেত্রে দ্বীনদারী ও আখেরাতের কল্যাণকে কী পরিমাণ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দ্বীন-দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য সহায়ক ও মঙ্গলজনক হলে আল্লাহ তুমি সহজ কর, অন্যথায় নয়। অর্থাৎ দ্বীন-দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য সহায়ক ও মঙ্গলজনক হলে অগ্রসর হওয়া, অন্যথায় নয়। খুবই স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন নীতি ও নির্দেশনা।
পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে দ্বীনদারী ও উত্তম আখলাকের গুরুত্ব
পাত্র-পাত্রী নির্বাচন কত কঠিন বিষয়; এক দিক মেলে তো আরেক দিক মেলে না। তাই এক্ষেত্রে হাদীসের শিক্ষা হল-যখন কোনো পাত্র বা পাত্রীর মাঝে দ্বীনদারী ও উত্তম আখলাক পেয়ে যাও তো বুঝে নাও এখানে অগ্রসর হওয়া যেতে পারে। এমনকি যদি অন্যান্য বিষয় অতটা পছন্দ নাও হয়। একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
إِذَا جَاءَكُمْ مَنْ تَرْضَوْنَ دِينَهُ وَخُلُقَهُ فَأَنْكِحُوهُ، إِلّا تَفْعَلُوا تَكُنْ فِتْنَةٌ فِي الأَرْضِ وَفَسَادٌ.
তোমাদের নিকট যদি এমন কারো প্রস্তাব আসে, যার দ্বীনদারী এবং চরিত্রের ব্যাপারে তোমরা সন্তুষ্ট তাহলে তার সাথে বিবাহ সম্পন্ন করে ফেল। অন্যথায় জগতে ফিতনা ও বিশৃংখলা হবে।
একথা শুনে সাহাবায়ে কেরাম আরয করলেন-
يَا رَسُولَ اللهِ، وَإِنْ كَانَ فِيهِ؟ قَالَ: إِذَا جَاءَكُمْ مَنْ تَرْضَوْنَ دِينَهُ وَخُلُقَهُ فَأَنْكِحُوهُ، ثَلَاثَ مَرّاتٍ.
ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি তার মধ্যে অন্য কোনো ত্রুটি থাকে? জবাবে আল্লাহর রাসূল তিন বার বললেন-
إِذَا جَاءَكُمْ مَنْ تَرْضَوْنَ دِينَهُ وَخُلُقَهُ فَأَنْكِحُوهُ.
তোমাদের নিকট যদি এমন কারো প্রস্তাব আসে, যার দ্বীনদারী এবং চরিত্রের ব্যাপারে তোমরা সন্তুষ্ট তাহলে তার সাথে বিবাহ সম্পন্ন করে ফেল। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১০৮৫; সুনানে কুবরা, বায়হাকী, হাদীস ১৩৪৮১
প্রাধান্য দাও দ্বীনদারীকে
বিবাহের ক্ষেত্রে কোন্ বিষয়কে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হবে। সৌন্দর্য! তা তো দুই দিনের। সম্পদ! তা তো যখন-তখন হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। এজন্য নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশনা দিয়েছেন- তুমি দ্বীনদারীকে প্রাধান্য দাও। তিনি বলেছেন-
تُنْكَحُ المَرْأَةُ لِأَرْبَعٍ: لِمَالِهَا وَلِحَسَبِهَا وَجَمَالِهَا وَلِدِينِهَا، فَاظْفَرْ بِذَاتِ الدِّينِ، تَرِبَتْ يَدَاكَ.
নারীকে বিবাহ করা হয় চারটি জিনিস দেখে। তার সম্পদ দেখে, বংশমর্যাদা দেখে। রূপ দেখে এবং দ্বীনদারী দেখে। (হে মুমিন!) তুমি দ্বীনদার নারী বিবাহ করে ধন্য হয়ে যাও। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০৯০; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৪৬৬
হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
تُنْكَحُ الْمَرْأَةُ عَلَى مَالِهَا، وَتُنْكَحُ الْمَرْأَةُ عَلَى جَمَالِهَا، وَتُنْكَحُ الْمَرْأَةُ عَلَى دِينِهَا، خُذْ ذَاتَ الدِّينِ، وَالْخُلُقِ تَرِبَتْ يَمِينُكَ.
নারীকে বিবাহ করা হয়ে থাকে তার অর্থ সম্পদের জন্য, রূপের জন্য, তার দ্বীনের জন্য। তুমি দ্বীনদার-চরিত্রবান নারীকে বিবাহ করে ধন্য হও। -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৪০৩৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১১৭৬৫
রূপ-সৌন্দর্যে কাবু হয়ে যেও না
অনেক সময় কারো বাহ্যিক রূপ- সৌন্দর্যে মানুষ এতটাই মুগ্ধ হয় যে, দ্বীনদারী ও অন্যান্য উত্তম গুণাবলীর কথা মনে থাকে না। বা বাহ্যিক রূপ- সৌন্দর্যকেই সব মনে করে। ভুলে যায় দুনিয়ার বিপদসংকুল দীর্ঘ পথের কথা; যে পথ চলতে প্রয়োজন নেককার, চরিত্রবান ও ধৈর্যধারণকারী জীবনসঙ্গীর।
শুধু সৌন্দর্যে কাবু হয়ে গেলে অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ বিস্মৃত হয়ে যায় এসকল অত্যাবশ্যকীয় গুণ-বৈশিষ্ট্যের কথা। ফলে বিবাহপরবর্তী সামান্য কিছু দিন যেতেই যখন জীবনের বাস্তবতার সম্মুখীন হয় এবং রূপ-সৌন্দর্যের ঘোর কেটে যায়, তখন আক্ষেপ-আফসোসই হয় তার নিত্যসঙ্গী। আর যদি স্বয়ং ঈমানই হয় রূপ-সৌন্দর্যের বলি, তাহলে তো সবই হারালো। তাই আল্লাহ মুমিনকে সতর্ক করেছেন-
وَ لَا تَنْكِحُوا الْمُشْرِكٰتِ حَتّٰی یُؤْمِنَّ، وَ لَاَمَةٌ مُّؤْمِنَةٌ خَیْرٌ مِّنْ مُّشْرِكَةٍ وَّ لَوْ اَعْجَبَتْكُمْ، وَ لَا تُنْكِحُوا الْمُشْرِكِیْنَ حَتّٰی یُؤْمِنُوْا، وَ لَعَبْدٌ مُّؤْمِنٌ خَیْرٌ مِّنْ مُّشْرِكٍ وَّ لَوْ اَعْجَبَكُمْ، اُولٰٓىِٕكَ یَدْعُوْنَ اِلَی النَّارِ، وَ اللّٰهُ یَدْعُوْۤا اِلَی الْجَنَّةِ وَ الْمَغْفِرَةِ بِاِذْنِهٖ، وَ یُبَیِّنُ اٰیٰتِهٖ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ یَتَذَكَّرُوْنَ.
তোমরা মুশরিক নারীকে বিবাহ করো না যতক্ষণ না তারা ঈমান আনে। মুশরিক নারী তোমাদেরকে মুগ্ধ করলেও (জেনে রাখো,) একজন মুমিন বাদীও (স্বাধীন) মুশরিক নারী থেকে উত্তম। এবং ঈমান না আনা পর্যন্ত তোমরা মুশরিক পুরুষদের সাথে বিবাহ দিয়ো না; মুশরিক পুরুষ তোমাদেরকে মুগ্ধ করলেও। একজন মুমিন গোলামও (স্বাধীন) মুশরিক থেকে উত্তম। তারা ডাকে জাহান্নামের দিকে আর আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তোমাদেরকে ডাকেন জান্নাত এবং ক্ষমার দিকে। তিনি স্বীয় বিধানাবলী মানুষের জন্য সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করেন, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে। -সূরা বাকারা (২) : ২২১
স্ত্রী নেককার : আর কী চাই!
পৃথিবীতে মানুষ যত নিআমত লাভ করে, এর মধ্যে নেককার স্ত্রী অন্যতম প্রধান নিআমত। স্ত্রী নেককার ও আখলাকওয়ালা হলে পরিবারে জান্নাতী আবেশ বিরাজ করে। অন্যথায় শান্তির পরিবারই হয়ে যায় সাক্ষাৎ জাহান্নাম। তাই তো নেককার স্ত্রীকে হাদীস শরীফে মহা নিআমত ও সৌভাগ্যের বিষয় বলা হয়েছে। আর বদকার স্ত্রীকে দুর্ভাগ্যের বিষয় বলা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مِنْ سَعَادَةِ ابْنِ آدَمَ ثَلاثَةٌ، وَمِنْ شِقْوَةِ ابْنِ آدَمَ ثَلاثَةٌ، مِن سَعَادَةِ ابْنِ آدَمَ: الْمَرْأَةُ الصّالِحَةُ، وَالْمَسْكَنُ الصّالِحُ، وَالْمَرْكَبُ الصّالِحُ، وَمِنْ شِقْوَةِ ابْنِ آدَمَ: الْمَرْأَةُ السّوءُ، وَالْمَسْكَنُ السّوءُ، وَالْمَرْكَبُ السّوءُ .
আদম সন্তানের সৌভাগ্যের বিষয় তিনটি। তেমনি দুর্ভাগ্যের বিষয়ও তিনটি। প্রথম তিনটি হল, সালিহা (দ্বীনদার-নেককার) স্ত্রী, ভালো বাসস্থান, ভালো সওয়ারী। দ্বিতীয় তিনটি হল, খারাপ স্ত্রী, খারাপ বাসস্থান ও খারাপ সওয়ারী। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৪৪
আরেক হাদীসে এসেছে-
مَا اسْتَفَادَ الْمُؤْمِنُ بَعْدَ تَقْوَى اللهِ خَيْرًا لَهُ مِنْ زَوْجَةٍ صَالِحَةٍ، إِنْ أَمَرَهَا أَطَاعَتْهُ، وَإِنْ نَظَرَ إِلَيْهَا سَرّتْهُ، وَإِنْ أَقْسَمَ عَلَيْهَا أَبَرّتْهُ، وَإِنْ غَابَ عَنْهَا نَصَحَتْهُ فِي نَفْسِهَا وَمَالِهِ.
আল্লাহর তাকওয়া অর্জনের পর একজন মুমিনের সবচেয়ে বড় অর্জন একজন সালিহা-দ্বীনদার-নেককার স্ত্রী; স্বামী কোনো আদেশ করলে তা মানে, তার দিকে তাকালে আনন্দ লাভ হয়, তার বিষয়ে স্বামী কোনো কসম করলে সে তাকে মুক্ত করে, স্বামীর অনুপস্থিতিতে নিজের বিষয়ে ত্রবং স্বামীর সম্পদের বিষয়ে কল্যাণ কামনা করে। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৮৫৭
আরেক হাদীসে এসেছে-
إِنّمَا الدّنْيَا مَتَاعٌ، وَلَيْسَ مِنْ مَتَاعِ الدّنْيَا شَيْءٌ أَفْضَلَ مِنَ الْمَرْأَةِ الصَّالِحَةِ.
দুনিয়া তো (ক্ষণস্থায়ী) প্রয়োজন পূরণের। আর মানুষ দুনিয়াতে যা কিছু দ্বারা কল্যাণ ও উপকার লাভ করে, তার মধ্যে সালিহা-দ্বীনদার-নেককার স্ত্রীর চেয়ে উত্তম আর কিছু নেই। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৮৫৫
আরেক হাদীসে এসেছে-
أَرْبَعٌ مَنْ أُعْطِيَهُنّ أُعْطِيَ خَيْرَ الدّنْيَا وَالْآخِرَةِ: قَلْبًا شَاكِرًا، وَلِسَانًا ذَاكِرًا، وَبَدَنًا عَلَى الْبَلَاءِ صَابِرًا، وَزَوْجَةً لَا تَبْغِيهِ خَوْنًا فِي نَفْسِهَا وَلَا مَالِهِ.
চারটি বস্তু যাকে দান করা হল, তাকে দুনিয়া ও আখেরাতের সকল কল্যাণ দান করা হল। শোকরকারী অন্তর, যিকিরকারী জিহ্বা, বিপদে ধৈর্যধারণকারী শরীর এবং এমন স্ত্রী, যে নিজের ক্ষেত্রে এবং স্বামীর সম্পদের ক্ষেত্রে কোনো খেয়ানত করে না। -আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ১১২৭৫; আমুজামুল আওসাত, তবারানী, হাদীস ৭২১২ মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস ৭৪৩৭
নেককার স্ত্রী : আল্লাহ তোমার দ্বীনদারী অর্ধেক এগিয়ে দিয়েছেন
মুমিনের জীবনে নেককার স্ত্রীর এতটাই গুরুত্ব যে, একে দ্বীনদারীর পথে অর্ধেক এগিয়ে যাওয়া ধরা হয়েছে। আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَنْ رَزَقَهُ اللهُ امْرَأَةً صَالِحَةً، فَقَدْ أَعَانَهُ عَلَى شَطْرِ دِينِهِ، فَلْيَتّقِ اللهَ فِي الشّطْرِ الثّانِي.
আল্লাহ তাআলা যাকে সালিহা স্ত্রী দান করেছেন, তাকে তার দ্বীনের অর্ধাংশের ক্ষেত্রে সাহায্য করেছেন, (অর্ধাংশ সহজ করে দিয়েছেন।) সুতরাং সে যেন বাকি অর্ধাংশের ক্ষেত্রে আল্লাহকে ভয় করে। -মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ২৬৮১; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৫১০১; আলমুজামুল আওসাত, তবারানী, হাদীস ৯৭২; মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৪/২৭২
পরস্পরে আখেরাতের সহযোগী
বিবাহের মাধ্যমে দুটি জীবন একসাথে পথচলা শুরু করে। তাই সবক্ষেত্রে একে অপরের সহযোগী, উভয়ে উভয়ের কল্যাণকামী। আর দুনিয়ার কল্যাণ ও আখেরাতের কল্যাণ- এ দুয়ে মিলেই মুমিনের কল্যাণ। কারণ, মুমিন দুআ করে-
رَبَّنَاۤ اٰتِنَا فِی الدُّنْیَا حَسَنَةً وَّ فِی الْاٰخِرَةِ حَسَنَةً وَّ قِنَا عَذَابَ النَّار.
হে আমাদের রব! আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দাও এবং আখেরাতে কল্যাণ দাও এবং আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা কর। -সূরা বাকারা (২) : ২০১
তাই মুমিন দম্পতি দুনিয়ার ক্ষেত্রে যেমন একে অপরের সহযোগী ও কল্যাণকামী তেমনি আখেরাতের ক্ষেত্রেও। এটাই মুমিন দম্পতির জীবনের স্বাভাবিক ধারা।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রিয় সাহাবী হযরত মুআয রা.-কে বলেন-
يَا مُعَاذُ قَلْبًا شَاكِرًا، وَلِسَانًا ذَاكِرًا، وَزَوْجَةً صَالِحَةً تُعِينُكَ عَلَى أَمْرِ دُنْيَاكَ وَدِينِكَ خَيْرُ مَا اكْتَسَبَهُ النّاسُ.
হে মুআয, মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন হল, শোকরকারী অন্তর, যিকিরকারী জিহ্বা, সালিহা (দ্বীনদার) স্ত্রী, যে তাকে দুনিয়া ও দ্বীনের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে। -আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ৭৮২৮; মাযমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস ৭৪৩৮
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
مَنِ اسْتَيْقَظَ مِنَ اللّيْلِ وَأَيْقَظَ امْرَأَتَهُ، فَصَلّيَا رَكْعَتَيْنِ جَمِيعًا، كُتِبَا مِنَ الذّاكِرِينَ اللهَ كَثِيرًا، وَالذّاكِرَاتِ.
যখন কোনো পুরুষ রাতে জাগ্রত হয় অতপর তার স্ত্রীকেও জাগ্রত করে, অতপর উভয়ে দুই রাকাত নামায আদায় করে, তাদেরকে ‘যাকিরীন’ ও ‘যাকিরাত’-এর তালিকাভুক্ত করা হয়। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৪৫১; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৩৩৫
হযরত উসমান ইবনু আবিল আস রা. থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে-
كَانَ لِدَاوُدَ نَبِيِّ اللهِ عَلَيْهِ السّلَامُ مِنَ اللّيْلِ سَاعَةٌ يُوقِظُ فِيهَا أَهْلَهُ، فَيَقُولُ: يَا آلَ دَاوُدَ قُومُوا فَصَلّوا، فَإِنّ هَذِهِ سَاعَةٌ يَسْتَجِيبُ اللهُ فِيهَا الدّعَاءَ.
হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম রাতের এক সময়ে জাগ্রত হয়ে পরিবারের সকলকে জাগিয়ে দিতেন এবং বলতেন, হে দাউদ- পরিবার! ওঠ এবং নামায পড়। কেননা এটা এমন এক সময় যখন আল্লাহ তাআলা দুআ কবুল করেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৬২৮১; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস ৪৪৭১
আশা করি, উল্লেখিত আয়াত-হাদীসসমূহে বিবাহের মাকসাদ কী, তাতে কী কী বিষয় লক্ষণীয় এবং দাম্পত্য জীবনে কী কী করণীয়- এর কিছু দিক আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে এসেছে। এখন দেখার বিষয় হল, আমরা এসব বিষয়ের প্রতি কতটুকু লক্ষ রাখছি।
একটু ভাবি
মুমিনের সকল বিষয়ের মতো বিবাহের ক্ষেত্রেও সূচনাতেই দ্বীনদারী তথা আখেরাতের দিকটি বিবেচনায় রেখে অগ্রসর হতে বলা হয়েছে। আমরা তা করছি কি? সর্বাগ্রে পাত্র-পাত্রীর দ্বীনদারী লক্ষ করার কথা বলা হয়েছে; আমাদের সমাজে তা করা হয় কি না? বাহ্যিক রূপ-সৌন্দর্য ও সহায়-সম্পত্তি বা জাগতিক অন্য কিছুকে দ্বীনের উপর প্রাধান্য দিচ্ছি না তো! কোনো পাত্র বা পাত্রীর জাগতিক কিছু নেই বা তুলনামূলক কম আছে; কিন্তু তার দ্বীনদারী, উত্তম চরিত্র ও দ্বীনী জ্ঞান অন্যান্য বিষয় থেকে অনেক বেশি, সেক্ষেত্রে আমরা দ্বীনদারী ও আখলাকের বিশেষ মূল্যায়ন করছি কি? শরীয়তে দ্বীনদারীকে প্রাধান্য দিতে বলা হয়েছে। আমরা অন্যগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে দ্বীনদারীকে পিছে ঠেলছি না তো!
দাম্পত্য জীবনে পরস্পরের কল্যাণভাবনা
বিবাহ কার্য সম্পাদন হয়ে গেল। অতপর স্বামী-স্ত্রী পরস্পরে জাগতিক সকল ক্ষেত্রে একে অপরের সহযোগী ও শরীক হয়ে গেল, কিন্তু আখেরাতের ক্ষেত্রে তারা একে অপরের সহযোগী হল কি? জাগতিক সকল ক্ষেত্রে পরস্পরের কল্যাণ তালাশ করে, কিন্তু আখেরাতের কল্যাণ তালাশ করে কি? এ বিষয়টি ভাবতে হবে প্রতিটি স্বামী-স্ত্রীর।
যে স্বামী স্ত্রীর আখেরাত নিয়ে ভাবে এবং যে স্ত্রী স্বামীর আখেরাত নিয়ে ভাবে, তাদের জন্য নবীজী রহমতের দুআ করেছেন। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
رَحِمَ اللهُ رَجُلًا قَامَ مِنَ اللّيْلِ فَصَلّى وَأَيْقَظَ امْرَأَتَهُ فَصَلّتْ، فَإِنْ أَبَتْ رَشّ فِي وَجْهِهَا الْمَاءَ، رَحِمَ اللهُ امْرَأَةً قَامَتْ مِنَ اللّيْلِ فَصَلَّتْ وَأَيْقَظَتْ زَوْجَهَا فَصَلّى، فَإِنْ أَبَى رَشّتْ فِي وَجْهِهِ الْمَاءَ.
আল্লাহ রহমত করুন ঐ স্বামীর প্রতি, যে রাতে জাগ্রত হয়ে নামায পড়ে এবং স্ত্রীকেও জাগ্রত করে; উঠতে না চাইলে চেহারায় পানি ছিটিয়ে হলেও ওঠানোর চেষ্টা করে। আল্লাহ রহমত করুন ঐ স্ত্রীর প্রতি, যে রাতে জাগ্রত হয়ে নামায পড়ে এবং স্বামীকে জাগিয়ে দেয়; সে উঠতে না চাইলে চেহারায় পানি ছিটিয়ে ওঠানোর চেষ্টা করে। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৩৩৬; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৪৫০
হাঁ, এমনই হওয়া উচিত মুমিন দম্পতির আখেরাতের ক্ষেত্রে পরস্পরের কল্যাণকামনা ও সহযোগিতা।
একজন মুমিনের সবচে বড় সম্পদ তার ঈমান ও আকীদা। তাই সর্বাগ্রে স্বামীর উচিত স্ত্রীর ঈমানের খোঁজ-খবর নেয়া। সে ইসলামী আকীদাগুলো জানে কি না এবং নিঃসন্দেহে মানে কি না। তার মাঝে ঈমান-বিরোধী কোনো চিন্তা-দর্শন বা কোনো আমল আছে কি না। সহীহ আকীদা পোষণ করে থাকলে তা তার মধ্যে বদ্ধমূল হয়েছে কি না?
ঈমানের পর তার নামাযের খোঁজ নেয়া। গুরুত্বের সাথে ওয়াক্তমত নামায পড়ে কি না। পড়লে তা সহীহ তরীকায় পড়ে কি না। এটা তো বাস্তব যে, আমাদের সমাজে পুরুষরা নামায ইত্যাদি মকতবের উসতায বা ইমাম সাহেব থেকে শিখলেও নারীরা শেখে ঘরের অন্য নারী থেকে। ফলে অনেক সময় দেখা যায়, যে নারী থেকে শিখেছে তার শেখানোটা সহীহ ছিল না। ফলে শেখাটা অসম্পূর্ণ বা অশুদ্ধ থেকে যায়।
নামাযের প্রাণ হল কুরআন তিলাওয়াত। তাই দেখা দরকার, সে সহীহ-শুদ্ধভাবে তিলাওয়াত করতে পারে কি না। সহীহ-শুদ্ধ হলে প্রাত্যহিক নির্দিষ্ট পরিমাণ তিলাওয়াত করে কি না। তেমনিভাবে নামাযের দুআগুলো- সানা, তাসবীহ, আত্তাহিয়্যাতু, দরূদ, দুআ ইত্যাদি সহীহ-শুদ্ধভাবে পড়তে পারে কি না।
নামাযের দুআগুলো ছাড়াও দৈনন্দিন জীবনে আমলের অনেক দুআ আছে, যা একজন মুমিনের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ; সেগুলো পাঠে মুমিনের দুনিয়া-আখেরাতের বহু কল্যাণ অর্জিত হয়, যাকে আমরা দুআয়ে মাছূরা বা মাসনূন দুআ বলি। এগুলোর মধ্যে কিছু তো আছে নির্দিষ্ট সময় বা আমলের সাথে সম্পৃক্ত, যথা সকাল-সন্ধ্যা, আহার, নিদ্রা-জাগরণ ইত্যাদি সময়ে পঠিত দুআ। আর কিছু আছে ব্যাপক দুআ, যা মুনাজাত, নামায বা যেকোনো সময় পড়া যায়। যে মুমিন এসব থেকে মাহরূম হল সে বহু কল্যাণ থেকে মাহরূম হল। তাই স্বামীর কর্তব্য, স্ত্রী এসব দুআ পারে কি না বা আমল করে কি না- খোঁজ নেয়া।
পর্দা নারীর স্বভাবজাত বিষয়। শরীয়তেরও বিধান। স্ত্রী তা যথাযথ পালন করছে কি না- তাও খুব গুরুত্ব সহকারে খোঁজ রাখা স্বামীর জন্য জরুরি।
সর্বোপরি দ্বীন শেখা প্রত্যেক নর-নারীর জন্য আবশ্যক। স্ত্রীর দ্বীনী জ্ঞান অর্জনের ব্যবস্থা করছে কি না? ঘরে তালীম হচ্ছে কি না? দ্বীনী কিতাবাদি সংগ্রহ করে স্ত্রীকে পড়ার সুযোগ করে দিচ্ছে কি না?
আসলে সব দিক এখানে উল্লেখ করা সম্ভব নয় এবং তার প্রয়োজনও নেই। মূলকথা হল, স্ত্রীর আখেরাতের বিষয়ে ফিকির করা এবং তাকে সার্বিক সহযোগিতা করা।
এ তো গেল স্ত্রীর প্রতি স্বামীর করণীয়। একজন স্ত্রীরও দায়িত্ব স্বামীর ইবাদত, আমল-আখলাক, লেনদেন, হালাল উপার্জন ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে দৃষ্টি রাখা এবং তাকে সহযোগিতা করা। বিশেষ করে স্বামীর আয়-উপার্জনের বিষয়ে ফিকির করা- তা হালাল কি না। কারণ, খাবার হারাম হলে ইবাদাত-বন্দেগী কবুল হয় না। তাই একজন স্ত্রীর কর্তব্য, স্বামীর আয়-উপার্জনের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখা এবং সবর ও অল্পেতুষ্টির মাধ্যমে হালাল উপার্জনের ক্ষেত্রে স্বামীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা। কিন্তু এমন যেন না হয় যে, স্বামী আখেরাতের পথে চলতে চায় আর স্ত্রী তার বিরোধিতা করে। কিংবা স্বামী নিজ স্ত্রীর দ্বীনদারীতে বাধা দেয়।
মোদ্দাকথা, স্বামী-স্ত্রী যেহেতু একে অপরের আখেরাতেরও সহযোগী, তাই প্রত্যেকে নিজের আখেরাতের ফিকিরের সাথে সাথে অপরের আখেরাতের ফিকির করাও আবশ্যক। তাই তাদের মাঝে জাগতিক বিষয়ের আলোচনার ন্যায় আখেরাতের বিষয় নিয়েও আলোচনা হতে হবে। কারও মধ্যে কোনো আমল বা গুণের অভাব থাকলে তা চিিহ্নত করে বাস্তবে আনার চেষ্টা করতে হবে। একজন কোনো ভালো কিছু পড়লে, শুনলে বা জানলে অপরকে জানাবে, একজন একটি নেক কাজ করলে অপরজনকেও শরীক করবে। সর্বদা ঘরে আখেরাতের মুযাকারার পরিবেশ রাখবে।
কিন্তু আমাদের অনেকের অবস্থা হল, তাদের সম্পর্ক শুধু জাগতিক; জাগতিক কাজ-কর্মে একজন আরেকজনের নিত্যসঙ্গী, কিন্তু আখেরাতের ক্ষেত্রে পরস্পরের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা নেই। ফলে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কোনো দ্বীনী মুযাকারা নেই, কোনো আমলের কথা নেই, কোনো ভালো কথা শুনলে তা অপরজনকে শোনানো নেই।
এমনকি কোনো কোনো পরিবারে স্বামী দ্বীনদার ও দ্বীনী জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও স্ত্রীর দ্বীনদারী ও দ্বীনী জ্ঞান আজীবন ঐ অবস্থায়ই থেকে যায়, যা নিয়ে বিবাহের সময় সে এ ঘরে এসেছে। স্বামী আলেম, কুরআনের পারদর্শী, কিন্তু স্ত্রী কুরআনের ক্ষেত্রে প্রায় অজ্ঞ, না জানে পূর্ণ শুদ্ধ করে তিলাওয়াত করতে, না পারে বুঝতে; এভাবে জীবন কেটে যায়!
সন্তানের কল্যাণকামনা : এগিয়ে দিন আখেরাতের পথে
জানাকথা, স্বাভাবিকভাবে বিবাহের পর সন্তান-সন্ততি হবে। আর সন্তানের প্রতি মাতা-পিতার ভালবাসা ও কল্যাণকামনার কোনো তুলনা হয় না। সন্তানের কল্যাণ কামনারও দুটি দিক রয়েছে। এক হল জাগতিক হিসাবে; আমার সন্তান বড় হবে, আয়-উপার্জন করবে, অনেক বড় সম্পদশালী হবে, নাম-সুনাম কামাবে, আমার সুখ ও সুনাম হবে। আরেকটি হল, এ সন্তান যেহেতু আল্লাহ দান করেছেন, সুতরাং তাকে খাঁটি আল্লাহর বান্দারূপে গড়ে তুলব। এজন্যই আল্লাহর নবীগণ যখন আল্লাহ তাআলার নিকট সন্তান চাইতেন এ উদ্দেশ্যেই চাইতেন। হযরত যাকারিয়া আলাইহিস সালাম বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ার পরও আল্লাহর নিকট এ বলে সন্তান চেয়েছেন। (তরজমা) হে আল্লাহ! আমার অস্থিরাজি পর্যন্ত দুর্বল হয়ে গেছে, মাথায় বার্ধক্য উজ্জল হয়ে উঠেছে। ...সুতরাং আপনি আপনার নিকট থেকে এমন এক উত্তরাধিকারী দান করুন, যে আমারও উত্তরাধিকারী হবে এবং ইয়াকুবেরও এবং আপনি তাকে আপনার সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত বানান। -সূরা মারইয়াম (১৯) : ৪-৬
ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সন্তানদের জন্য এভাবে দুআ করেন-
رَبِّ اجْعَلْنِیْ مُقِیْمَ الصَّلٰوةِ وَ مِنْ ذُرِّیَّتِیْ، رَبَّنَا وَ تَقَبَّلْ دُعَآءِ.
হে আমার প্রতিপালক! আমাকে সালাত কায়েমকারী করুন; এবং আমার বংশধরদের মধ্য হতেও। হে আমাদের প্রতিপালক আমার প্রার্থনা কবুল করুন। -সূরা ইবরাহীম (১৪) : ৪০
সন্তানেরা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করবে- সুলাইমান আলাইহিস সালাম এজন্যও সন্তান কামনা করেছেন। ইমাম বুখারী রাহ. তাঁর ঘটনা উল্লেখ করেছেন এ শিরোনামে- ‘বাবু মান তালাবাল ওলাদা লিল জিহাদ’ (অধ্যায় : যিনি জিহাদের উদ্দেশ্যে সন্তান কামনা করেছেন)
আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে ইবাদুর রহমান (রহমানের বান্দা)-এর গুণাগুণ বর্ণনা করে একটি দীর্ঘ প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন, সেখানে তাদের একটা গুণ বর্ণিত হয়েছে এভাবে-
‘এবং যারা বলে,
رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ اَزْوَاجِنَا وَ ذُرِّیّٰتِنَا قُرَّةَ اَعْیُنٍ وَّ اجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِیْنَ اِمَامًا.
‘হে আমাদের রব আমাদেরকে চক্ষু শীতলকারী স্ত্রী-সন্তান দান করুন এবং আমাদেরকে বানান মুত্তাকীদের ইমাম-মুত্তাকীদের জন্য অনুসরণযোগ্য। -সূরা ফুরকান (২৫) : ৭৪
অর্থাৎ স্ত্রী-সন্তানদের দ¦ীনদারী কামনা ইবাদুর রহমানের বৈশিষ্ট্য। এমন দুআ করা আল্লাহর বিশেষ বান্দাদের গুণ।
আশা করি, পূর্বের আলোচনা থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে যে, বিবাহের মধ্যে দুটি দিক রয়েছে, একটি হল জাগতিক দিক, অন্যটি হল দ্বীনী বা আখেরাতের দিক। তাই মুমিন স্বামী-স্ত্রী একে অপরের জাগতিক কল্যাণ নিয়ে যেমন ভাববে, তেমনি আখেরাতের কল্যাণ কামনায়ও ব্যাকুল হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন, রহম করুন- আমীন।
(মাওলানা মুহাম্মাদ ইমদাদুল হক দাঃ)
২- সুখী দাম্পত্যের চাবিকাঠি
হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনÑ
خَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لأَهْلِهِ وَأَنَا خَيْرُكُمْ لأَهْلِي
তোমাদের মাঝে সে সবচে’ ভালো, যে তার পরিবারের জন্য ভালো। আর আমি আমার পরিবারের জন্য সবারচে’ ভালো। Ñজামে তিরমিযী ২/২২৮, হাদীস ৩৮৯৫; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৪২
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনÑ
أَكْمَلُ الْمُؤْمِنِينَ إِيمَانًا أَحْسَنُهُمْ خُلُقًا، وَخَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لِنِسَائِهِمْ.
সবচে’ কামিল মুমিন সে, যার স্বভাব ও আচরণ সবচে’ ভালো। আর তোমাদের মাঝে শ্রেষ্ঠ সে, যে তার স্ত্রীর জন্য শ্রেষ্ঠ। Ñজামে তিরমিযী ১/২১৯, হাদীস ১১৬২
ব্যাখ্যা : এ বিষয়ে আরো অনেক হাদীস রয়েছে, যা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কারো ভালো-মন্দের একটি মাপকাঠি হল স্ত্রীর সাথে তার আচরণ। আল্লাহ তাআলা বৈবাহিক সম্পর্র্ককে মিয়াঁ-বিবি উভয়ের জন্য শান্তি ও পবিত্রতার মাধ্যম বানিয়েছেন এবং এ মধুর সম্পর্ককে তাঁর বিশেষ নিআমতসমূহের মধ্যে গণ্য করেছেন। মিয়াঁ-বিবি উভয়ে যদি একে অপরের হকের বিষয়ে খেয়াল রাখে, তাহলে এ সম্পর্কই পুরো পরিবেশকে জান্নাতী পরিবেশে পরিণত করে। পক্ষান্তরে খোদানাখাস্তা এ সম্পর্কে যদি চির ধরে তাহলে পুরো পরিবেশ বিষিয়ে ওঠে এবং জীবনটাই একটা বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এতে কেবল পার্থিব সুখ-শান্তিই বিদায় নেয় না, ধীরে ধীরে তা দ্বীন ও ঈমান, দুনিয়া ও আখেরাত সবকিছুই বরবাদ করে ছাড়ে। আর এ কারণেই শয়তান স্বামী-স্ত্রীর মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করতে পারলে যত পুলকিত হয়, অন্য কিছুতেই তত হয় না। সহীহ মুসলিমের একটি হাদীসে আছেÑ
إِنّ إِبْلِيسَ يَضَعُ عَرْشَهُ عَلَى الْمَاءِ، ثُمّ يَبْعَثُ سَرَايَاهُ، فَأَدْنَاهُمْ مِنْهُ مَنْزِلَةً أَعْظَمُهُمْ فِتْنَةً، يَجِيءُ أَحَدُهُمْ فَيَقُولُ: فَعَلْتُ كَذَا وَكَذَا، فَيَقُولُ: مَا صَنَعْتَ شَيْئًا، قَالَ ثُمّ يَجِيءُ أَحَدُهُمْ فَيَقُولُ: مَا تَرَكْتُهُ حَتّى فَرّقْتُ بَيْنَهُ وَبَيْنَ امْرَأَتِهِ، قَالَ: فَيُدْنِيهِ مِنْهُ وَيَقُولُ: نِعْمَ أَنْتَ.
ইবলিস পানির উপর তার আসন পাতে। তারপর মানুষকে বিপথগামী করার জন্য তার চেলাদের এদিক ওদিক প্রেরণ করে। যে যত বিপথগামী করতে পারে, সে তার তত নৈকট্য অর্জন করে। তো ইবলিস যখন তার পেয়াদাদের কার্যবিবরণী শোনে তখন এক চেলা বলেÑ আজ আমি অমুকের মাধ্যমে এই এই গোনাহ সংঘটিত করেছি। ইবলিস বলে, নাহ, কিছুই করতে পারিসনি। আরেক চেলা বলে, আমি অমুকের পিছে লেগেই ছিলাম। তাকে তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে আর স্ত্রীকে তার বিরুদ্ধে এমনভাবে ক্ষেপিয়ে তুলি যে, অবশেষে এদের মাঝে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে এসেছি। ইবলিস এ শুনে তাকে জড়িয়ে ধরে। বলে, শাবাশ! কাজের কাজ তুমিই যা করেছ। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ২৮১৩
স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারলে শয়তানের এত আনন্দ কেন? কারণ স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের অবনতি ও বিচ্ছেদ শুধু তাদের দুয়ের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে না। উভয়ের পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবার সম্পর্ককেই তা প্রভাবিত করে। যার কারণে অনেক সমস্যা সৃষ্টি হয়।
বৈবাহিক সম্পর্কের এই গুরুত্বের নিরিখে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলমানদের যে হেদায়েত দিয়েছেন, তা যথাযথ মেনে চললে পরিবারিক অশান্তি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
এ প্রসঙ্গে সীরাত ও সুন্নাহ্র এক গুরুত্বপূর্ণ হেদায়েত হল, পরিবার-পরিজনের সাথে সুন্দর ও কোমল ব্যবহার। ঘরের ভেতর আইনের শাসন চলে না। এখানে প্রীতি ও ভালবাসা এবং আখলাক ও ব্যক্তিত্বের প্রভাবই কার্যকর হয়। যারা নিজের ঘরে সামান্য সামান্য বিষয়ে চটে যান, হুমকি ধমকি ও রুক্ষতার দ্বারা দাম্পত্যের চাকা সচল রাখতে চান, তারা আসলে বিকারগ্রস্ত। সুন্দর ব্যবহার পাওয়া স্ত্রীর সবচে’ বড় হক এবং ঈমানের দাবি।
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপরোক্ত নির্দেশনা যদিও মৌলিকভাবে পুরুষের উদ্দেশে এবং ঘরে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির পরিবেশ গড়ে তোলাও মৌলিকভাবে তারই দায়িত্ব, তথাপি মুসলিম রমণীগণও এখান থেকে দিকনিদের্শনা গ্রহণ করতে পারেন; করা উচিতও বটে। স্বামী-স্ত্রীর মাঝে ঈমানের পূর্ণতায় তিনিই অগ্রগামী, যিনি অন্যের চেয়ে ভালো ব্যবহার উপহার দিতে পারেন।
ভালো আখলাকের একটি দিক হচ্ছে, নিজের অধিকার তলবের চেয়ে অপরের হক আদায়ে বেশি সচেষ্ট থাকা। কোনো বিষয়ে একজন রেগে গেলে অপরজনও ফুঁসে ওঠবে না। ধৈর্য্য ও কোমলতার সাথে আপোস-মীমাংসা করবে।
আল্লামা আবদুল ওয়াহহাব শা‘রানী রাহ. বলেন, এক লোক তার শায়েখের কাছে বিবির মুখরা স্বভাবের অভিযোগ করলে তিনি বললেন, স্ত্রীর দেয়া যন্ত্রণা যে সইতে পারে না, সে স্ত্রী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করতে পারে কীভাবে!
তো দাম্পত্য জীবনে হুসনে আখলাক যত কার্যকর থাকবে জীবন যাপনও তত সুখের হবে। মিয়াঁ-বিবির যিনিই হুসনে আখলাকে ভূষিত হবেন তিনিই সুন্দর ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী হবেন। বস্তুত ভালো ব্যবহারই ঐ উপায়, যা দাম্পত্য জীবনকে শান্তিময় করতে পারে।
মূলঃ মাওলানা ইউসুফ লুধিয়ানবী
(ভাষান্তর : মুহাম্মাদ আশিক বিল্লাহ তানভীর)
৩-
দাম্পত্যজীবন, অজ্ঞতা ও পরিণাম
মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ
কিছু দিন আগে আমার এক প্রিয় তালিবে ইলম দেখা করতে এসে বললো, হুযূর, আগামী পরশু আমার বিবাহ। চমকে উঠে তাকালাম। বড় ‘বে-চারা’ মনে হলো। কারণ আমিও একদিন বড় অপ্রস্ত্তত অবস্থায় জেনেছিলাম, আগামীকাল আমার বিবাহ! ভিতর থেকে হামদরদি উথলে উঠলো। ইচ্ছে হলো তাকে কিছু বলি, যিন্দেগির এই নতুন রাস্তায় চলার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু পাথেয়, আল্লাহর তাওফীকে তাকে দান করি। আল্লাহর তাওফীক ছাড়া আমরা কেই বা কী করতে পারি!
তো তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, বিবাহের জন্য কী প্রস্ত্ততি নিয়েছো? বড় ভোলাভালা নও জোয়ান! সরলভাবে বললো, আমার কিছু করতে হয়নি, সব প্রস্ত্ততি আববা -আম্মাই নিয়েছেন। কেনা-কাটা প্রায় হয়ে গেছে, শুধু বিয়ের শাড়ীটা বাকি।
অবাক হলাম না, তবে দুঃখিত হলাম, আমার এই প্রিয় তালিবে ইলম এখন একজন যিম্মাদার আলিমে দ্বীন। দীর্ঘ কয়েক বছর আমাদের ছোহবতে ছিলো, তার কাছে বিবাহের প্রস্ত্ততি মানে হলো জিনিসপত্র এবং বিয়ের শাড়ী! তাহলে অন্যদের অবস্থা কী?!
বড় মায়া লাগলো; বললাম, দেখো, মানুষ যে কোন কাজ করতে চায়, প্রথমে সে ঐ বিষয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করে। কাজটির হাকীকত ও উদ্দেশ্য কী? কাজটি আঞ্জাম দেয়ার সঠিক পন্থা কী? শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কী কী সমস্যা হতে পারে, সেগুলোর সমাধান কী? এগুলো জেনে নেয়। এজন্য দস্ত্তর মত আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার আয়োজন আছে, এমনকি বাস্তব প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা আছে।
অথচ জীবনের সবচে’ কাঠিন ও জটিল অধ্যায়ে মানুষ প্রবেশ করে, বরং বলতে পারো ঝাঁপ দেয়, কিছু না শিখে, না জেনে এবং না বুঝে একেবারে অপ্রস্ত্তত অবস্থায়। ফল কী হতে পারে?! কী হয়?! অন্যদের কথা থাক, চোখের সামনে আমার ক’জন ছাত্রের ঘর ভেঙ্গে গেলো! একজনের তো এমনকি দু’জন সন্তানসহ। কিংবা ঘর হয়ত টিকে আছে, কিন্তু শান্তি নেই। স্বাভাবিক শান্তি হয়ত বজায় আছে, কিন্তু বিবাহ যে দুনিয়ার বুকে মানবের জন্য আল্লাহর দেয়া এক জান্নাতি নেয়ামত, সুকূন ও সাকীনাহ, সে খবর তারা পায়নি, শুধু অজ্ঞতার কারণে, শুধু শিক্ষার অভাবে।
আশ্চর্য, মা-বাবা সন্তানকে কত বিষয়ে কত উপদেশ দান করেন; উস্তাদ কত কিছু শিক্ষা দেন, নছীহত করেন, কিন্তু জীবনের সবচে’ কঠিন ও জটিল বিষয়টি কেন যেন তারা সযত্নে এড়িয়ে যান!
তাকে বললাম, যদিও তুমি এ উদ্দেশ্যে আসোনি তবু তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই, যা ইনশাআল্লাহ আগামী জীবনে তোমার কাজে আসবে।
খুব জযবা ছিলো, অবেগের তোড় ছিলো, ‘দিল কো নিচোড় ক্যর’, বাংলায় যদি বলি তাহলে বলবো, হৃদয় নিংড়ে, কিন্তু দিল কো নিচোড়না-এর ভাব হৃদয় নিংড়ানোতে আসবে কোত্থেকে! যাক, বলছিলাম, হৃদয়টাকে নিংড়ে কিছু কথা তাকে বলেছিলাম। পরে আফসোস হলো যে, কথাগুলো তো সব হাওয়ায় উড়ে গেলো, যদি বাণীবদ্ধ করে রাখা যেতো কত ভালো হতো! হয়ত আল্লাহর বহু বান্দার উপকারে আসতো। শেষে বললাম, এককাজ করো, এ কথাগগুলোর খোলাছা কাগজে লিখে আমাকে দেখিও।
আগামী পরশুর বিয়ের খবর দিয়ে ছেলেটা সেই যে গেলো, তিন বছরে আর দেখা নেই! দাম্পত্য জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিভিন্ন সময় দরসেও আমি অনেক কথা বলেছি। ‘সবচে’ বেশী বলেছি আমার নূরিয়ার জীবনের প্রিয় ছাত্র (বর্তমানের হাতিয়ার হুযূর) মাওলানা আশরাফ হালীমীকে, আশা করি তিনি সাক্ষ্য দেবেন, অনেকবার বলেছেন, আমার কথাগুলো তার জীবনে বে-হদ উপকারে এসেছে। আরো অনেকে বলেছে, কিন্তু কথাগুলো কেউ ‘কলমবন্দ’ করেনি।
তো এখন এই উপলক্ষকে কেন্দ্র করে তোমাদের মজলিসে ঐ কথাগুলো আবার বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আফসোস, সেই আবেগ ও জযবা তো এখন নেই যা ঐ প্রিয় তালিবে ইলমকে বলার সময় ছিলো। আবেগভরা দিলের কথা তো রসভরা ইক্ষু, আর শুধু চিন্তা থেকে বলা কথা হলো রস নিংড়ে নেয়া ইক্ষুর ছোবা! তবু কিছু না কিছু ফায়দা তো ইনশাআল্লাহ হবে।
আমি আমার প্রিয় ছাত্রটিকে বলেছিলাম, এখন তোমার জীবনের এই যে নতুন অধ্যায় শুরু হচ্ছে উর্দূতে এটাকে বলে ইযদিওয়াজী যিন্দেগী, বাংলায় বলে দাম্পত্য জীবন, অর্থাৎ এটা জীবন ও যিন্দেগির খুবই এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ, শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং অত্যন্ত জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ। এটা তোমাকে ঘাবড়ে দেয়ার জন্য বলছি না; প্রয়োজনীয় প্রস্ত্ততি গ্রহণ ও পাথেয় সংগ্রহ করার জন্য বলছি, যাতে পূর্ণ আস্থা ও সাহসের সঙ্গে তুমি তোমার এই নতুন জীবন শুরু করতে পারো। আল্লাহ যদি সাহায্য করেন তাহলে সবই সহজ।
এটা যে শুধু তোমার ক্ষেত্রে হচ্ছে তা নয়! আমার জীবনেও হয়েছে, আমার মা-বাবার জীবনেও হয়েছে! তোমার মা-বাবাও একদিন এ জীবন শুরু করেছিলেন। যদি সহজ ও অন্তরঙ্গ সম্পর্ক থাকে তাহলে তোমার মাকে, বাবাকে জিজ্ঞাসা করতে পারো, কীভাবে তারা এ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছেন? জীবনের শুরুতে তারা কী ভেবেছিলেন, কী চেয়েছিলেন, কী পেয়েছেন?
কখন কী সমস্যা হয়েছে, সেগুলো কীভাবে সমাধান করেছেন। এই জীবনের শুরুতে তোমার প্রতি তাদের কী উপদেশ? এধরনের সহজ আন্তরিক আলোচনায় সংসার জীবনের পথচলা অনেক সহজ হয়ে যায়। অবশ্য সব মা-বাবার সঙ্গে সব সন্তানের এমন সহজ সম্পর্ক থাকে না, তবে থাকা উচিত। জীবনের যে কোন সমস্যার সমাধানের জন্য সন্তান মা-বাবার কাছেই আসবে, মা-বাবাকেই নিরাপদ আশ্রয় মনে করবে, বন্ধুবান্ধবকে নয়। কঠিন সমস্যার মুখে একজন অপরিপক্ব বন্ধু কীভাবে সঠিক পথ দেখাতে পারে! কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটাই ঘটে। সন্তান মা-বাবাকে ভয় করে, হয়ত কোন জটিলতায় পড়েছে; তখন তাদের প্রথম চেষ্টা হয় যে, মা-বাবা যেন জানতে না পারে, কারণ তাদের কানে গেলে সর্বনাশ! ছেলে তার বন্ধুর শরণাপন্ন হয়, মেয়ে তার বান্ধবীর কাছে বলে, তারা তাদের মত করে পরামর্শ দেয়। ফলে অবস্থা আরো গুরুতর হয়।
অতীতে যাই ছিলো, এখন তো অপরিহার্য হয়ে পড়েছে, মা-বাবার জন্য সন্তানের বন্ধু হওয়া। বিপদে সমস্যায় সন্তানকে তিরস্কার পরে করা, আগে তার পাশে দাঁড়ানো। তাহলে সন্তান আরো বড় অন্যায় করা থেকে এবং আরো গুরুতর অবস্থায় পড়া থেকে বেঁচে যায়। কিন্তু এখন অবস্থা হলো, সন্তান মা-বাবাকে ভয় করে, বন্ধুকে নিরাপদ আশ্রয়স্থল মনে করে। আমার ছেলেকে আমি এটা বোঝাতে চেয়েছি এবং আশা করি, কিছুটা বোঝাতে পেরেছি। অনেক সমস্যা থেকে সে রক্ষা পেয়েছে, কারণ সবার আগে সে আমার কাছে এসেছে, আর আমি বলেছি, ভয় নেই, আমি তোমার পাশে আছি। আগে তাকে সাহায্য করেছি, তারপর প্রয়োজনে দরদের সঙ্গে তিরস্কার করেছি, বা শিক্ষা দিয়েছি। বন্ধুর কাছে আগে পাওয়া যায় সাহায্য, মা-বাবার কাছ থেকে আগে আসে তিরস্কার। তাই সন্তান সমস্যায় পড়ে মা-বাবার কাছে আসে না, বন্ধুর কাছে আসে। এভাবে নিজের কারণেই সবচে’ কাছের হয়েও মা-বাবা হয়ে যায় দূরের, আর দূরের হয়েও বন্ধু হয়ে যায় কাছের। সন্তানের সমস্যা বন্ধু জানে সবার আগে। মা-বাবা জানে সবার পরে, পানি যখন মাথার উপর দিয়ে চলে যায় তখন।
তো আমি আশা করছি, জীবনের অন্যসকল ক্ষেত্রে যেমন তেমনি, আল্লাহ না করুন দাম্পত্যজীবনে যদি কোন রকম সমস্যার সম্মুখীন হয় তাহলে সন্তান সবার আগে আমার কাছে আসবে, তার মায়ের কাছে আসবে, আমাদের উপদেশ, পরামর্শ নেবে।
আলহামদু লিল্লাহ, সেই রকমের সহজ অন্তরঙ্গ সম্পর্কই সন্তানের সঙ্গে আমার, আমাদের।
আমার প্রিয় ছাত্রটিকে বললাম, কথা অন্য দিকে চলে গেছে, তো এই প্রসঙ্গে তোমাকে একটি আগাম নছীহত করি; আজ তোমরা স্বামী-স্ত্রী, দু’দিন পরেই হয়ে যাবে, মা এবং বাবা। সেটা তো জীবনের আরো কঠিন, আরো জটিল অধ্যায়। আমি প্রায় বলে থাকি, প্রাকৃতিক নিয়মে মা-বাবা হয়ে যাওয়া খুব সহজ। কিন্তু আদর্শ মা-বাবা হওয়ার জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ শিক্ষা ও দীক্ষা। তো তোমরা দু’জন জীবনের শুরু থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করতে শুরু করো যে, একটি মেয়ে কীভাবে একজন আদর্শ মা হতে পারে এবং একটি ছেলে কীভাবে একজন আদর্শ বাবা হতে পারে! আগে বলেছিলাম একটি নছীহত, এখন বলছি দু’টি নছীহত।
সন্তানের সামনে কখনো তার মাকে অসম্মান করো না। তোমাকে মনে রাখতে হবে, সে তোমার স্ত্রী, কিন্তু তোমার সন্তানের মা, তোমার চেয়েও অধিক শ্রদ্ধার পাত্রী। সন্তান যেন কখনো, কখনোই মা-বাবাকে ঝগড়া-বিবাদ করতে না দেখে। এ নছীহত আমি তোমাকে করছি, আল্লাহর শোকর নিজে আমল করে। আমার বড় সন্তানের বয়স ত্রিশ বছর, এর মধ্যে কখনো সে আমাদের বিবাদ করতে এমনকি তর্ক করতেও দেখেনি। দ্বিতীয়ত তোমরা উভয়ে সন্তানের বন্ধু হওয়ার চেষ্টা করো, এমন বন্ধু যাকে নিজের মনের কথা, সব কথা নিঃসঙ্কোচে জানাতে পারে।
আগের কথায় ফিরে আসি; আগামীপরশু তোমার বিবাহ। তার মানে, আজ তুমি নিছক একটি যুবক ছেলে, অথচ আগামী পরশু হয়ে যাচ্ছো, একজন দায়িত্ববান স্বামী। কত বিরাট পার্থক্য তোমার আজকের এবং আগামী পরশুর জীবনের মধ্যে। বিষয়টি তোমাকে বুঝতে হবে। কেন তুমি বিবাহ করছো? বিবাহের উদ্দেশ্য কী? দেখো, আমাদের দেশে পারিবারিক পর্যায়ে একটা নিন্দনীয় মানসিকতা হলো, সংসারের প্রয়োজনে, আরো খোলামেলা যদি বলি, কাজের মানুষের প্রয়োজনে ছেলেকে বিয়ে করানো। সবাই যে এমন করে তা নয়, তবে এটা প্রবলভাবে ছিলো, এখনো কিছু আছে। আমি নিজে সাক্ষী, আমার একজন মুহতারাম তাঁর মেয়েকে বিয়ে দিলেন, বিয়ে হওয়ামাত্র ছেলের বাবা স্বমূর্তি ধারণ করে বলতে লাগলেন, আর দেরী করা যাবে না, তাড়াতাড়ি মেয়ে বিদায় করেন। মেয়ের মা ও বাবা তো হতবাক!
মেয়ে বিদায় হলো। শশুরবাড়ীতে রাত পোহালো, আর পুত্রবধুর সামনে কাপড়ের স্ত্তপ নিক্ষেপ করে শাশুড়ী আদেশ করলেন, কাপড়ে সাবান লাগাও, দেখি, মায়ের বাড়ী থেকে কেমন কাজ শিখে এসেছো!
আমার এক ছাত্রের কথা, বিয়ের প্রয়োজন। কেন? কারণ মা-বাবার খেদমত করার কেউ নেই।
এটা কিন্তু বিবাহের উদ্দেশ্য বা মাকছাদ হতে পারে না। মা-বাবার খেদমত মূলত তোমার দায়িত্ব। এখন সে যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে তোমার সাথে এতে শরীক হয়, তবে সেটা তোমাদের উভয়ের জন্য সৌভাগ্যের কারণ হতে পারে। দেখো, আল্লাহ চাহে তো অচিরেই আমাদেরও ঘরে পুত্রবধু আসবে। আমরা আমাদের না দেখা সেই ছোট্ট মেয়েটির প্রতীক্ষায় আছি। কিন্তু আমি আমার পুত্রকে অবশ্যই বলবো, বিবাহের উদ্দেশ্য মা-বাবার খেদমত করা হতে পারে না।
আমি দু’আ করি, তোমার মা-বাবা তোমার যেমন, তেমনি তোমার স্ত্রীরও যেন মেহেরবান মা-বাবা হতে পারেন। আমার দুই মেয়ের শশুর, দু’জনই এখন জান্নাতবাসী (ইনশাআল্লাহ)। আল্লাহর কাছে আমার সাক্ষ্য এই যে, সত্যি সত্যি তারা আমার মেয়েদু’টির ‘বাবা’ ছিলেন। আমার ছোট মেয়ের শশুর বড় আলিম ছিলেন, তাঁকে আমার একটি বই হাদিয়া দিয়েছিলাম এভাবে, ‘সাফফানার আববুর পক্ষ হতে সাফফানার আববাকে’। তিনি খুশী হয়ে অনেক দু’আ করেছিলেন, আর বলেছিলেন, ‘আপনি তো এই ছোট্ট একটি বাক্যে সম্পর্কের মহামূল্যবান এক দর্শন তুলে ধরেছেন!
আমার বড় মেয়ের অবস্থা হলো, মায়ের বাড়ী থেকে যাওয়ার সময় সে কাঁদে না, কাঁদে ‘আম্মার’ বাড়ী থেকে আসার সময়।
দুআ’ করি, আমার দেশের প্রতিটি মেয়ে যেন মা-বাবার ঘর থেকে এমন মা-বাবার ঘরে প্রবেশ করতে পারে। আর তুমি দু’আ করো, আমরা দু’জন যেন আমাদের অনাগত মেয়েটির জন্য তেমন মা-বাবাই হতে পারি।
তো বলছিলাম বিবাহের উদ্দেশ্যের কথা। বৈধ উপায়ে স্ত্রীপরিচয়ে কাউকে ভোগ করা, এটাও বিবাহের উদ্দেশ্য বা মাকছাদ হতে পারে না।
স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে বলা হয় শরীকে হায়াত, জীবনসঙ্গী এবং জীবনসঙ্গিনী। বস্ত্তত এই শব্দটির মধ্যেই দাম্পত্য জীবনের সুমহান উদ্দেশ্যটি নিহিত রয়েছে। আর যদি কোরআনের ভাষায় বলি তাহলে বিবাহের উদ্দেশ্য হল,
هن لباس لكم وانتم لباس لهن
তুমি তো কোরআন বোঝো। ভেবে দেখো, দাম্পত্য-সম্পর্কের কী গভীর তাৎপর্য এখানে নিহিত!
পেয়ারা হাবীব ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বিবাহ হচ্ছে আমার সুন্নত। আর বলেছেন, যে আমার সুন্নতের প্রতি বিমুখ হবে সে আমার উম্মতভুক্ত নয়।
বিবাহ নবীর সুন্নত! সুতরাং সহজেই বোঝা যায়, বিরাট ও মহান কোন মাকছাদ রয়েছে এর পিছনে।
বিবাহের আসল মাকছাদ বা উদ্দেশ্য হলো স্বামী ও স্ত্রী- এই পরিচয়ে একটি নতুন পরিবার গঠন করা এবং মা ও বাবা- এই পরিচয়ে সন্তান লাভ করা। তারপর উত্তম লালন-পালন এবং আদর্শ শিক্ষা-দীক্ষা ও তারবিয়াতের মাধ্যমে নেক সন্তানরূপে গড়ে তুলে দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করা, যাতে নস্লে ইনসানি বা মানববংশ কেয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর পছন্দমত আগে বাড়তে থাকে।
এটাই হলো বিবাহের আসল উদ্দেশ্য; অন্য যা কিছু আছে তা সব পার্শ্ব-উদ্দেশ্য। তো এখনই তুমি নিয়ত ঠিক করে নাও যে, কেন কী উদ্দেশ্যে বিবাহ করবে। উদ্দেশ্য যদি ঠিক হয়ে যায় তাহলে দেখতে পাবে, আল্লাহ চাহে তো এখনই তোমার ভিতরে কত সুন্দর পরিবর্তন আসছে! কী আশ্চর্য এক পরিপূর্ণতা নিজের মধ্যে অনুভূত হচ্ছে! আগামী জীবনের সকল দায়দায়িত্ব পালন করার জন্য গায়ব থেকে তুমি আত্মিক শক্তি লাভ করছো। আল্লাহ তাওফীক দান করেন।
এবার আসো জীবনের বাস্তবতার কথা বলি, এতদিন তোমার জীবনে ছিলেন শুধু তোমার মা, যিনি তোমাকে গর্ভে ধারণ করেছেন, প্রসববেদনা ভোগ করেছেন। নিজেকে তিলে তিলে ক্ষয় করে তোমাকে প্রতিপালন করেছেন। এতদিন তোমার উপর ছিলো তাঁর অখন্ড অধিকার। হঠাৎ তিনি দেখছেন, তাঁর আদরের ধন, তাঁর অাঁচলের রত্ন পুত্রের জীবনে স্ত্রীপরিচয়ে অন্য এক নারীর প্রবেশ (অনুপ্রবেশ?) ঘটেছে! এভাবে পুত্রের উপর তার অখন্ড অধিকার খন্ডিত হতে চলেছে। যে পুত্র ছিলো এতদিন তাঁর একক অবলম্বন, এখন সে হতে চলেছে অন্য এক নারীর অবলম্বন। এ বাস্তবতা না তিনি অস্বীকার করতে পারছেন, না মেনে নিতে পারছেন। সংসারে প্রত্যেক মায়ের জীবনে এ কঠিন সময়টি আসে। এমন এক অর্ন্তজ্বালা শুরু হয় যা শুধু তিনি নিজেই ভোগ করেন, কাউকে বোঝাতে পারেন না, এমনকি এতদিনের আদরের ধন পুত্রকেও না। ফলে সামান্য সামান্য কারণে, এমনকি অকারণেও তিনি খুব সংবেদনশীল হয়ে পড়েন; তাঁর অনুভূতি আহত হয়। এমন সময় ছেলে (এবং তার স্ত্রী অজ্ঞতা, অনভিজ্ঞতা ও অপিরপক্বতার কারণে) যদি অসঙ্গত কিছু বলে বা করে বসে তাহলে তো মায়ের মনে কষ্টের শেষ থাকে না। প্রসববেদনা থেকে শুরু করে প্রতিপালনের সব কষ্ট একসঙ্গে মনে পড়ে যায়।
আম্মার কাছে শুনেছি, গ্রামের এক মা তার পুত্রবধুকে বলেছিলেন, ‘ততা ফানি আমি খাইছিলাম, না তুই খাইছিলি?’
তখনকার যুগে প্রসবপরবর্তী বেশ কিছু দিন মা ও শিশুর স্বাস্থ্যগত কল্যাণ চিন্তা করে মাকে গরম পানি খেতে দেয়া হতো, ঠান্ডা পানি দেয়া হতো না।
তো কথাটা কিন্তু নির্মম। আমার জন্য ‘তাতানো পানি’ আমার মা খেয়েছেন, আমার সব আবর্জনা আমার মা পরিস্কার করেছেন। নিজের জীবন তিলে তিলে ক্ষয় করে তিনি আমাকে বড় করেছেন, উপযুক্ত করেছেন। সেই সব কষ্টের সুফল হঠাৎ করে অন্য একটি মেয়ে এসে অধিকার করে বসেছে। তখন সব হারানোর একটা বেদনা তাকে কুরে কুরে খায়। তো তোমার মায়ের অন্তরেও এরকম অনুভূতি হওয়া স্বাভাবিক। মায়ের মনের এই কষ্টের উপশম, এই বেদনার সান্ত্বনা তোমাকেই চিন্তা করতে হবে।
মায়ের পর দ্বিতীয় পর্যায়ে আসে বাবার কথা, তারপর ভাই-বোনদের কথা। (এসম্পর্কেও ছাত্রটিকে বিশদভাবে বলেছিলাম।)
তৃতীয়ত তোমার স্ত্রী। যদিও তৃতীয় বলছি, কিন্তু বাস্তবে এটাই হলো সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ এবং সবচে’ নাযুক। তবে এটা থাকবে তোমার দিলে, তোমার অন্তরে। মা-বাবার সামনে মুখের কথায় বা আচরণে এটা প্রকাশ করা প্রজ্ঞার পরিচায়ক হবে না।
কেন বলছি স্ত্রীর বিষয়টি সবচে’ নাযুক? তার আগে আমার একটি প্রশ্নের উত্তর দাও; কোন বিবাহে কোন ছেলেকে কাঁদতে দেখেছো?! কোন ছেলের মা-বাবাকে বিষণ্ণ দেখেছো?! দেখোনি; (হয়তো ব্যতিক্রম এক দুইটি ঘটনা থাকতে পারে। কিন্তু সাধারণ অবস্থা এটিই, এদের কেউ কাঁদে না।) কেন? কারণ বিবাহের মাধ্যমে ছেলে কিছু হারায় না, ছেলের মা-বাবা কিছু হারায় না, বরং অর্জন করে। তাই তাদের মুখে থাকে অর্জনের হাসি এবং প্রাপ্তির তৃপ্তি।
বিবাহের আসরে কাঁদে শুধু মেয়ে, আর মেয়ের মা-বাবা। কেন কাঁদে একটি মেয়ে? কারণ তাকে সবকিছু হারাতে হয়, সবকিছু ত্যাগ করতে হয়। মা-বাবাকে ছেড়ে আসতে হয়, শৈশবের সব স্মৃতি তাকে মুছে ফেলতে হয়। একটি ছোট্ট মেয়ের জীবনে এটি অনেক বড় আঘাত। এ যেন একটি ছোট্ট গাছের চারাকে শিকড়শুদ্ধ উপড়ে ফেলে বহু দূরে ভিন্ন পরিবেশে নতুন মাটিতে এনে রোপণ করা। বাকি জীবন তাকে এই মাটি থেকেই রস আহরণ করে বেঁচে থাকতে হবে।
হিন্দিতে বলে, ‘আওর্যত কী ডোলী যাহা উত্যরতী হ্যয়, উসকী আর্থী ওহীঁ সে উঠতি হ্যয়।’ অর্থাৎ মেয়েদের পালকি যেখানে গিয়ে নামে, সেখান থেকেই তার জানাযা ওঠে।
কত বড় নির্মম সত্য! তো তোমার স্ত্রীরূপে তোমার ঘরে আসা এই ছোট্ট মেয়েটির যখমি দিলে তাসাল্লির মরহম তোমাকেই রাখতে হবে। একমাটি থেকে উপড়ে এনে আরেক মাটিতে রোপণ করা একটি চারাগাছ থেকে দু’দিন পরেই ফল দাবী করা কতটা নিষ্ঠুরতা! ফল পেতে হলে তোমাকে ধৈর্য ধরতে হবে। চারা গাছটির পরিচর্যা করতে হবে, সকাল-সন্ধ্যা তার গোড়ায় পানি দিতে হবে। ধীরে ধীরে শিকড় যখন মাটিতে বসবে এবং মাটি থেকে রস সংগ্রহ করার উপযুক্ত হবে, তখন তোমাকে ফল চাইতে হবে না; সজীব বৃক্ষ নিজে থেকেই ফল দিতে শুরু করবে।
কত আফসোসের বিষয়, দাম্পত্য জীবনের শুরুতে যত আদেশ-উপদেশ সব ঐ ছোট্ট মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বর্ষিত হয়। প্রথম দিনেই তাকে শুনতে হয়, এখন থেকে তাকে স্বামীর মন জয় করতে হবে, শশুর-শাশুড়ি সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে, শশুর বাড়ীর সবার মন যুগিয়ে চলতে হবে। তার নিজের যেন কোন ‘মন’ নেই। সুতরাং সেটা জয় করারও কারো গরজ নেই।
তো মায়ের মন তোমাকেই রক্ষা করতে হবে, আবার স্ত্রীর মনোরঞ্জনও তোমাকেই করতে হবে। সবদিক তোমাকেই শামাল দিয়ে চলতে হবে। কত কঠিন দায়িত্ব! অথচ না শিক্ষাঙ্গনে, না গৃহপ্রাঙ্গণে, কোথাও এ সম্পর্কে শিক্ষার নূন্যতম কোন ব্যবস্থা নেই। সম্পূর্ণ অপ্রস্ত্তত অবস্থায় দু’টি অপরিপক্ব তরুণ-তরুণীকে যেন সংসার সমুদ্রে ভাসিয়ে দেয়া! মেয়েটিও জানে না, আজ থেকে সে আর ছোট্ট মেয়েটি নেই। সে এখন স্ত্রী হয়ে একটি অপরিচিত মানুষের জীবনে প্রবেশ করছে, যার মা আছে, বাবা আছে, ভাইবোন আছে এবং তাদের প্রতি তার স্বামীর অনেক দায়-দায়িত্ব আছে। সহানুভূতির সঙ্গে কোমলাতার সঙ্গে এই দায়িত্ববোধ কেউ তার মধ্যে জাগ্রত করে দেয়নি। এ দোষ কার!
তো আমার প্রিয় ছাত্রটিকে বলেছিলাম, কথা দ্বারা আচরণ দ্বারা তোমার মাকে তুমি বোঝাবে, মা, আমি আপনারই ছিলাম, আছি এবং থাকবো। স্ত্রী হলো আমার জীবনের নতুন প্রয়োজন; আপনি আমার প্রাণ, আপনার সঙ্গে আমার নাড়ির টান।
অন্যদিকে স্ত্রীকে বোঝাতে হবে, এই সংসার সমুদ্রে তুমি একা নও; আমি তোমার পাশে আছি। নতুন জীবনে চলার পথে আমারও অনেক কষ্ট হবে, তোমারও অনেক কষ্ট হবে। তবে সান্ত্বনা এই যে, তুমিও একা নও, আমিও একা নই। আমার পাশে তুমি আছো, তোমার পাশে আমি আছি। আমার কষ্টের সান্ত্বনা তুমি, তোমার কষ্টের সান্ত্বনা আমি। আমরা পরস্পরের কষ্ট হয়ত দূর করতে পারবো না, তবে অনুভব করতে পারবো এবং হয়ত কিছুটা লাঘব করতে পারবো।
আল্লাহর কসম, এমন কোন নারিহৃদয় নেই যা এমন কোমল সান্ত্বনায় বিগলিত হবে না।
তোমার স্ত্রীকে তুমি এভাবে বলবে, আমাদের জীবন তো আলাদা ছিলো। আমরা তো একে অপরকে চিনতামও না। আল্লাহ আমাদের কেন একত্র করেছেন জানো?! একা একা জান্নাতে যাওয়া কঠিন। আল্লাহ আমাদের একত্র করেছেন একসঙ্গে জান্নাতের পথে চলার জন্য। আমি যদি পিছিয়ে পড়ি, তুমি আমাকে টেনে নিয়ে যাবে; তুমি যদি পিছিয়ে পড়ো, আমি তোমাকে টেনে নিয়ে যাবো। তুমি সতর্ক থাকবে, আমার দ্বারা যেন কারো হক নষ্ট না হয়; আমিও সতর্ক থাকবো, তোমার দ্বারা যেন কারো প্রতি যুলুম না হয়।
প্রিয় ছাত্রটিকে আমি আরো বললাম, স্ত্রীকে বোঝানোর জন্য তার সন্তানকে সামনে আনতে হবে। অর্থাৎ তুমি তাকে বলবে, দেখো, জীবন কত গতিশীল! সবকিছু কত দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে! দু’দিন আগে আমরা শুধু যুবক-যুবতী ছিলাম, আজ হয়ে গেছি স্বামী-স্ত্রী। দু’দিন পরেই হয়ে যাবো মা-বাবা। আমি বাবা, তুমি মা! আল্লাহর কাছে একজন মায়ের মর্যাদা কত! তোমার কদমের নীচে হবে তোমার সন্তানের জান্নাত! যেমন আমার মায়ের কদমের নীচে আমার জান্নাত। তো তোমার সন্তান কেমন হলে তুমি খুশী হবে? আমাকেও আমার মায়ের ঐরকম সন্তান হতে তুমি সাহায্য করো। আমি যদি ভুল করি, মায়ের কোন হক নষ্ট করি, মায়ের সামনে ‘উফ’ করি, তুমি আমাকে সাবধান করো, আমাকে সংশোধন করো। তাহলে ইনশাআল্লাহ তোমার সন্তানও তুমি যেমন চাও তেমন হবে।
প্রয়োজন হলে স্ত্রীকে মা-বাবার সামনে তিরস্কার করবে, তবে ঘরে এসে একটু আদর, একটু সোহাগ করে বোঝাতে হবে, কেন তুমি এটা করেছো?! বোঝানোর এই তরযগুলো শিখতে হবে, আর এটা দু’একদিনের বিষয় নয়, সারা জীবনের বিষয়। কিন্তু আমরা ক’জন এভাবে ভারসাম্যপূর্ণ জীবন যাপন করি?! হয় মাতৃভক্তিতে স্ত্রীর প্রতি অবিচার করি, না হয়, স্ত্রীর ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে মা-বাবার দিলে আঘাত দেই, আর দুনিয়া-আখেরাত বরবাদ হয়। আমার একটা কথা মনে রেখো, মায়ের পক্ষ নিয়ে স্ত্রীর প্রতি অবিচার করা মূলত মায়ের প্রতি যুলুম, তদ্রূপ স্ত্রীর পক্ষ নিয়ে মায়ের হক নষ্ট করা আসলে স্ত্রীর প্রতি যুলুম। আমার একথার উৎস হলো,
أنصر أخاك ظالما أو مظلوما
অবশ্য সবকিছু হতে হবে হিকমত ও প্রজ্ঞার সঙ্গে।
একটি ঘটনা তোমাকে বলি, তোমার মত আলিমে দ্বীন নয়, সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত একজন মানুষ আমাকে বলেছেন, একবার তার মা তাকে বললেন, তোর বউ আজ তোর এত আপন হয়ে গেলো কীভাবে!
আমি বললাম, দেখো মা, তোমাকে আমি মা বলি; এই ‘মা’ ডাকটুকু পাওয়ার জন্য তোমাকে কত কষ্ট করতে হয়েছে! অথচ ‘পরের বাড়ীর মেয়েটি’র মুখ থেকে তুমি বিনা কষ্টে ‘মা’ ডাক শুনতে পাও! তোমাকে যে মা বলে ডাকে সে আমার আপন হবে না কেন মা?
আরেকটা ঘটনা, এক মা তার মেয়ের শাশুড়ী সম্পর্কে বললেন, মানুষ না, মেয়েটাকে আনতে পাঠালাম, দু’টো পিঠে বানিয়ে খাওয়াবো, দিলো না, ফেরত পাঠিয়ে দিলো!
দু’দিন আগে তিনিও একই কাজ করেছিলেন, ছেলের বউকে নিতে এসেছিলো মায়ের বাড়ী থেকে। তিনি বললেন, দু’দিন পরে আমার মেয়েরা আসবে এখন তুমি গেলে কীভাবে চলবে!
ভদ্রমহিলাকে বললাম, আপনার কাজটা কি ঠিক হয়েছিলো? আপনাকে কষ্ট দেয়া আমার উদ্দেশ্য নয়, সতর্ক করা উদ্দেশ্য। আল্লাহর কাছে যদি আটকা পড়েন তখন তো আপনিই বলবেন, তুমি তো হাদীছ-কোরআন পড়েছো, আমাকে সতর্ক করোনি কেন?
মোটকথা, মেয়েদেরকে তারবিয়াত করতে হবে যাতে তারা আদর্শ স্ত্রী, আদর্শ মা এবং আদর্শ শাশুড়ীরূপে আদর্শ জীবন যাপন করতে পারে। পুরুষ হচ্ছে কাওয়াম ও পরিচালক। সুতরাং তারবিয়াত ও পরিচালনা করা পুরুষেরই দায়িত্ব। স্ত্রী, মা ও শাশুড়ী, জীবনের এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন ধাপের জন্য ঘরে ঘরে আমরা যদি আমাদের মেয়েদের গড়ে তুলতে পারি, আদেশ দ্বারা, উপদেশ, সর্বোপরি নিজেদের আচরণ দ্বারা তাহলেই সংসার হতে পারে সুখের, শান্তির।
প্রিয় ছাত্রটিকে আরেকটি কথা বললাম, তোমার স্ত্রীর কোন আচরণ তোমার অপছন্দ হতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রথমে তোমাকে ভাবতে হবে, তোমার সব আচরণ কি সুন্দর, তোমার স্ত্রীর পছন্দের? তাছাড়া তোমার স্ত্রীর ভালো দিক কি কিছু নেই। সেই ভালো দিকগুলোর জন্য শোকর করো, আর যা তোমার কাছে মন্দ লাগে তার উপর ছবর করো। আর যদি সংশোধন করতে চাও তাহলে ভালো দিকগুলোর প্রশংসা করো, তারপর কোমল ভাষায় বলো, তোমার এই বিষয়টা যদি না থাকতো তাহলে তুমি আরো অনেক ভালো হতে। তবে আল্লাহর পেয়ারা হাবীব ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেই প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ মনে রাখতে হবে, একটু বাঁকা থাকবেই, এই বক্রতা, সাহিত্যের ভাষায় যাকে বলে নায, আন্দায, মান, অভিমান, লাস্যতা, এই বক্রতা নারীর সৌন্দর্য, নারীর শক্তি। এটাকে সেভাবেই গ্রহণ করে তার সঙ্গে জীবন যাপন করতে হবে, পূর্ণ সোজা করতে চাইলে ভেঙ্গে যাবে, আর সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে।
সত্যি সত্যি যদি তোমার স্ত্রীর গুরুতর কোন ত্রুটি থাকে তবে সেটা সংশোধনের দায়িত্ব ও কর্তব্য অবশ্যই তোমার। তবে সেক্ষেত্রেও সংশোধনের জন্য অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে দিনের পর দিন চেষ্টা করে যেতে হবে। ধমক দিয়ে, জোর খাটিয়ে সংশোধন করা যায় না, ঘরে অশান্তি আনা যায়, ঘর ভাঙ্গা যায়, আর সন্তানদের জীবনে বিপর্যয় আনা যায়।
ইসলামপুরে আমার আববার দোকানের অপর দিকে এক ভদ্রলোকের দোকান ছিলো। অবস্থা ছিলো এই যে, দোকানে বসেই মদ খেতো। আববা তাকে দাওয়াত দিলেন, আর সে খুব দুর্ব্যবহার করলো, কিন্তু আববা ধৈর্যের সঙ্গে দাওয়াত চালিয়ে গেলেন। দু’বছর পর তিনি মসজিদমুখী হলেন এবং এমন মুবাল্লিগ হলেন যে, বউকে তালাক দেবেন। কারণ সে দ্বীনের উপর আসছে না।
আববা তাকে এভাবে বুঝালেন, ‘আমার সঙ্গে আপনার আচরণ কি মনে আছে? আমি যদি ধৈর্যহারা হয়ে আপনাকে ত্যাগ করতাম! এই পুরো কথাটা যেহেনে রেখে স্ত্রীকে তালিম করতে থাকেন। ছবর করেন, ছবর করলে আমার প্রতি আপনার যুলুম আল্লাহ মাফ করবেন। আল্লাহ যদি প্রশ্ন করেন আমার বান্দা তোমাকে আমার ঘরের দিকে ডেকেছে, তুমি তার প্রতি যুলুম করেছো কেন? তখন আপনি বলতে পারবেন, হে আল্লাহ, আমিও আপনার বান্দীর পিছনে ছবরের সঙ্গে মেহনত করেছি।’
সেই লোকের স্ত্রী কিন্তু পরবর্তী সময়ে পরদানশীন হয়েছিলো। অথচ জোশের তোড়ে লোকটা তো ঘরই ভেঙ্গে ফেলছিলো।
আসলে দোষ আমাদের। আমরা তারবিয়াত করার তরীকা শিখিনি। বোঝানোর তরয আয়ত্ত্ব করিনি।
প্রিয় ছাত্রটিকে আরো অনেক কথা বলেছিলাম, প্রায় দু’ঘণ্টা সময় তার জন্য ব্যয় করেছিলাম। সবকথা এখন মনেও নেই।
তবে একটা কথা তাকে বলা হয়নি, এখন তোমাদের মজলিসে বলি, স্ত্রীর সঙ্গে আচরণ কেমন হবে, এ সম্পর্কে একজনকে যা বলতে শুনেছিলাম, তা ছিল খুবই মর্মান্তিক। তিনি বলেছিলেন, ‘মেয়েলোক যেন তোমার মাথায় চড়ে না বসে, তাই প্রথম দিন থেকেই তাকে শাসনের মধ্যে রাখবা। পূর্ণ ইতা‘আত ও আনুগত্য আদায় করে নিবা, গোরবা কুশতান দর শবে আওয়াল।’
এ প্রবাদ এমনই বিশ্ববিশ্রুত যে, আমাদের নিরীহ বাংলাভাষায়ও বলে, ‘বাসর রাতেই বেড়াল মারতে হবে’। কিন্তু জীবনের সর্বক্ষেত্রের মত এক্ষেত্রেও আমাদের অনুসরণীয় হলো সুন্নাতে রাসুল, আর তিনি ইরশাদ করেছেন,
خيركم خيركم لأهله وأنا خيركم لأهلي
তো জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শরীয়তের সীমারেখায় থেকে স্ত্রীর সঙ্গে এমন আচরণই আমাকে করতে হবে, যাতে সে মনে করে, আমি সর্বোত্তম স্বামী, আমার মতো উত্তম স্বামী হয় না, হতে পারে না।
স্ত্রীগণের সঙ্গে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণ কী ছিলো তা জানতে হবে এবং অনুসরণ করতে হবে। স্বামীর খেদমত করার মাধ্যমে স্ত্রী অনেক আজর ও ছাওয়াবের অধিকারিণী হতে পারে, এটা আলাদা কথা। তবে আমাকে মনে রাখতে হবে যে, এটা স্ত্রীর মহত্ত্ব, স্বামীর অধিকার নয়। তারা যদি কখনো মায়ের বাড়ী যেতে চায়, আমরা প্রশ্ন করি, ‘আমার খাওয়া-দাওয়ার কী হবে?’ অথচ এটা তার বিবেচনার বিষয় হতে পারে, আমার প্রশ্ন করার বিষয় নয়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সামান্য কথা বলেই মজলিস শেষ করছি। সহবাস দাম্পত্য জীবনের একটি অপরিহার্য সত্য। এ বিষয়ে আলোচনাকে হায়া-শরমের খেলাফ মনে করা হয়। ফলে বিষয়টি অজ্ঞতার মধ্যে থেকে যায়। একারণে এমনকি অনেক সময় দাম্পত্য জীবন বিষাক্ত হয়ে পড়ে।
স্ত্রী তোমার সারা জীবনের সম্পদ এবং সেরা সম্পদ।
متاع মানে সম্পত্তি নয়, ভোগের বস্ত্ত নয় متاع মানে সম্পদ, ঐশ্বর্য। বিষয়টি বুঝতে না পেরে আধুনিক বুদ্ধিজীবীরা হাদীছের সমালোচনা করেন। আমরা হাদীছটির তরজমা ও ব্যাখ্যা এমন খন্ডিতভাবে করি যে, তারাও সুযোগ পেয়ে যায়।
তো স্ত্রী তোমার সম্পত্তি নয়, স্ত্রী হলো তোমার জীবনের সর্বোত্তম সম্পদ, যা যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে তোমাকে রাখতে হবে এবং ব্যবহার করতে হবে।
প্রথমেই বর্বর ও পাশবিকরূপে নিজেকে স্ত্রীর সামনে তুলে ধরা বিরাট মুর্খতা ছাড়া আর কিছু নয়। স্ত্রী স্বামীর ভোগের পাত্রী নয়, বরং স্বামী-স্ত্রী হলো পরস্পরকে উপভোগ করার জন্য। যত দিন লাগে, দীর্ঘ সাধনা করে প্রথমে হৃদয় জয় করো, মনের দুয়ার খোলো, অন্তরের গভীরে প্রবেশ করো।
যিন্দেগীর এই কঠিন মারহালা সম্পর্কে কত কিছু যে বলার আছে, কত কিছু যে শেখার আছে! দেখি, যদি আবার কখনো সুযোগ হয়।
[দাম্পত্যজীবন সুখময় হওয়ার জন্য শুধু পুরুষের প্রচেষ্টা ও সচেতনতাই যথেষ্ট নয়, নারীরও সদিচ্ছা ও সচেতনতা অতি প্রয়োজন।
এ বিষয়ে তারও আছে অনেক দায়িত্ব। কিন্তু নারীর তালীম-তরবিয়তের ভারও তো পুরুষেরই উপর। বিয়ের আগে পিতামাতা তার তরবিয়ত করবেন, বিয়ের পর স্বামী। দাম্পত্যজীবনে নারীর দায়িত্ব কী কী, সেই সকল দায়িত্ব সম্পর্কে তাকে সচেতন করার পদ্ধতি কী এবং তার তালীম-তরবিয়ত কীভাবে করতে হবে-এটি আলাদা একটি বিষয়।
আল্লাহ করুন, কোনো মজলিসে আমরা যেন হুজুরের কাছ থেকে এ বিষয়েও বিস্তারিত দিক-নির্দেশনা লাভ করি।-তত্ত্বাবধায়ক]
والله اعلم بالصواب
মন্তব্য (০)
কোনো মন্তব্য নেই।
এ সম্পর্কিত আরও জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর
৩০২৮১
ব্যাংকারের মেয়েকে বিবাহ করা বা ব্যাংকার ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দেওয়া কি জায়েজ?
১৬ আগস্ট, ২০২৪
ঢাকা

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি
৩০৯৫৪
পালিয়ে বিয়ে করার পর মেয়েটি স্বামীকে ছাড়তে পারবে কি?
১ এপ্রিল, ২০২৩
শেরপুর

উত্তর দিয়েছেনঃ শাইখ উমায়ের কোব্বাদী
সাম্প্রতিক প্রশ্নোত্তর
মাসায়েল-এর বিষয়াদি
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে