আপনার জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

সকল মাসায়েল একত্রে দেখুন

যেসব আমলে গুনাহ মাফ হয়

প্রশ্নঃ ৮২১০. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, যে সকল আমল দ্বারা গোনাহ মাফ হয়, তার বিবরণ পাওয়া যাবে কি ??,

২১ জানুয়ারী, ২০২৫

গৌরনদী

উত্তর

و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم


যে সকল আমল দ্বারা গোনাহ মাফ হয়

গোনাহ যেন মুমিনের কাছে মাথার উপর পতনোন্মুখ বিশাল পাহাড়, যে কোনো মুহূর্তে তা ধ্বংস করে দিতে পারে তাকে। ফলে কোনো গোনাহ হয়ে গেলে মুমিন পেরেশান হয়ে যায়- কীভাবে তা থেকে মাফ পাওয়া যায়; বান্দার হক হলে- কীভাবে তা থেকে দ্রুত মুক্ত হওয়া যায়।

পক্ষান্তরে ফাসেক-ফাজেরের কাছে গোনাহ কোনো পেরেশানীর বিষয়ই নয়। একটি হাদীসে একটি সুন্দর উপমার মাধ্যমে বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে-

إِنّ المُؤْمِنَ يَرَى ذُنُوبَهُ كَأَنّهُ قَاعِدٌ تَحْتَ جَبَلٍ يَخَافُ أَنْ يَقَعَ عَلَيْهِ، وَإِنّ الفَاجِرَ يَرَى ذُنُوبَهُ كَذُبَابٍ مَرّ عَلَى أَنْفِهِ.

মুমিনের কাছে গোনাহ যেন পতনোন্মুখ পাহাড়, যার পাদদেশে সে বসা; যে কোনো মুহূর্তে তা ভেঙে পড়তে পারে তার উপর (ধ্বংস করে দিতে পারে তাকে)। আর ফাসেক-ফাজেরের কাছে গোনাহ যেন নাকের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া সামান্য মাছির মত। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৩০৮

হাঁ, মুমিনের কাছে গোনাহ এমনই। গোনাহকে মুমিন পাহাড়সম বোঝা হিসেবে দেখে। কোনো পাপ হয়ে গেলে ব্যথিত হয়, কষ্টে থাকে। আফসোস-আক্ষেপ করতে থাকে- কেন পাপে জড়ালাম! আর এটিই ঈমানের আলামত।

এক সাহাবী নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে জিজ্ঞেস করল-

مَا الْإِيمَانُ؟

ঈমান (-এর আলামত) কী, আল্লাহর রাসূল!

নবীজী উত্তরে বললেন-

إِذَا سَرّتْكَ حَسَنَتُكَ، وَسَاءَتْكَ سَيِّئَتُكَ فَأَنْتَ مُؤْمِنٌ.

যদি তোমার নেক আমল তোমাকে আনন্দিত করে এবং তোমার পাপ তোমাকে ব্যথিত করে (পাপ হয়ে গেলে তুমি কষ্টে ভুগতে থাক)। তাহলেই (বুঝবে) তুমি মুমিন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২১৬৬

গোনাহ তো হয়েই যায়। শয়তানের ধোঁকায়, নফসের প্ররোচনায়, ইচ্ছায়, অনিচ্ছায়- গোনাহ হয়েই যায়। কিন্তু আশার কথা হল, আল্লাহ বান্দার জন্য রেখেছেন পাপ মোচনের অগণিত পথ। একে তো যে কোনো পাপ মোচনের জন্যই আল্লাহ খোলা রেখেছেন তাওবার দরজা, যা বান্দার পাপ মোচন করে দেয় এবং শয়তানকে ব্যর্থ করে দেয়। সাথে সাথে বিভিন্ন উপলক্ষে, বিভিন্ন নেক আমলের দ্বারাও আল্লাহ বান্দার পাপ মোচন করেন। মুমিন বুদ্ধিমান। সে এসকল আমল-উপলক্ষকে কাজে লাগায় এবং পাপ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে সচেষ্ট থাকে।



তওবা : সব গোনাহ মুছে দেয়

শয়তানের সারাদিনের চেষ্টা বরং দীর্ঘদিনের চেষ্টা মুহূর্তে ব্যর্থ করে দিতে পারে মুমিন বান্দা। মুমিনকে আল্লাহ তাআলা এমন হাতিয়ার দান করেছেন। কী সেই হাতিয়ার, যা ব্যর্থ করে দিতে পারে শয়তানের সকল চক্রান্ত?

তাওবা। তাওবার মাধ্যমে মহাপাপীও হয়ে যেতে পারে গোনাহমুক্ত; শয়তানের সকল অপচেষ্টা মুহূর্তে ধূলিস্মাৎ করে দিতে পারে। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-

التّائِبُ مِنَ الذّنْبِ، كَمَنْ لَا ذَنْبَ لَهُ.

গোনাহ থেকে তওবাকারী গোনাহমুক্ত ব্যক্তির মত। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৪২৫০

মুমিন তো গোনাহ নিয়ে বসে থাকতে পারে না। গোনাহ তো মুমিনের কাছে পাহাড়সম বোঝা। তাই মুমিন গোনাহ হওয়ার সাথে তওবা করে নেয়। কুরআনে কারীম আল্লাহ তাআলা মুমিনের এ গুণের কথা বর্ণনা করেছেন এভাবে-

وَ الَّذِیْنَ اِذَا فَعَلُوْا فَاحِشَةً اَوْ ظَلَمُوْۤا اَنْفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللهَ فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوْبِهِمْ وَ مَنْ یَّغْفِرُ الذُّنُوْبَ اِلَّا اللهُ، وَ لَمْ یُصِرُّوْا عَلٰی مَا فَعَلُوْا وَ هُمْ یَعْلَمُوْنَ.

এবং তারা সেই সকল লোক, যারা কখনো কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেললে বা (অন্য কোনোভাবে) নিজেদের প্রতি যুলুম করলে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার ফলশ্রুতিতে নিজেদের গোনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ ছাড়া কেই বা আছে, যে গোনাহ ক্ষমা করতে পারে? আর তারা জেনেশুনে তাদের কৃতকর্মে অবিচল থাকে না। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৩৫

আর আল্লাহ তাআলাও বান্দার তওবা কবুলের জন্য তাঁর ক্ষমার হাত প্রসারিত করেই রাখেন; দিনে-রাতে, সর্বদা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

إِنّ اللهَ عَزّ وَجَلّ يَبْسُطُ يَدَهُ بِاللّيْلِ لِيَتُوبَ مُسِيءُ النّهَارِ، وَيَبْسُطُ يَدَهُ بِالنّهَارِ لِيَتُوبَ مُسِيءُ اللّيْلِ، حَتّى تَطْلُعَ الشّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا.

আল্লাহ তাআলা রাতে তাঁর (ক্ষমার) হাত প্রসারিত করেন, যাতে দিনে যারা পাপ করেছে তারা তওবা করতে পারে। আর দিনে তাঁর (ক্ষমার) হাত প্রসারিত করেন, যাতে রাতে যারা পাপ করেছে তারা তওবা করতে পারে। এভাবে (তাঁর অবারিত ক্ষমা) চলতে থাকবে সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উদিত হওয়া পর্যন্ত। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৭৫৯

তো যত বড় গোনাহই হোক না কেন, তওবার মাধ্যমে সব গোনাহ মুছে যায়। বিভিন্ন নেক আমলের দ্বারা তো সগীরা গুনাহগুলো মিটে যায় কিন্তু তওবা- সগীরা-কবীরা সব গোনাহ মিটিয়ে দেয়।

এখানে স্মরণ রাখতে হবে এবং সচেতন থাকতে হবে- বান্দার হকের ব্যাপারে। তা থেকে মুক্ত হতে হলে, বান্দার প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে হবে বা তার থেকে মাফ নিয়ে নিতে হবে তারপর আল্লাহ মাফ করবেন, তার আগে নয়। সুতরাং বান্দার হকের ব্যাপারে সাবধান! শত সাবধান!!



নেক আমল : কৃত পাপ মুছে দেয়

কোনো পাপ হয়ে গেলে মুুমিনের করণীয় কী? পাপ হওয়ার সাথে সাথেই তো মুমিন পেরেশান হয়ে যায় তা মোচনের জন্য। আল্লাহ তাআলা মুমিনকে বাতলেছেন সে পথ। পাপ হয়ে গেছে বান্দা? তওবা কর এবং নেক আমল দ্বারা সেটি মিটিয়ে দাও। ইরশাদ হয়েছে-

وَ اَقِمِ الصَّلٰوةَ طَرَفَیِ النَّهَارِ وَ زُلَفًا مِّنَ الَّیْلِ، اِنَّ الْحَسَنٰتِ یُذْهِبْنَ السَّیِّاٰتِ، ذٰلِكَ ذِكْرٰی لِلذّٰكِرِیْنَ .

তুমি সালাত কায়েম কর দিবসের দুই প্রান্তভাগে এবং রজনীর প্রথমাংশে। অবশ্যই নেক আমল পাপসমূহ মিটিয়ে দেয়। যারা উপদেশ গ্রহণ করে, এ তাদের জন্য এক উপদেশ। -সূরা হূদ (১১) : ১১৪

সুতরাং নেক আমলের প্রতি যত্নবান হওয়া চাই। কোনো পাপ হয়ে গেলে সাথে সাথে তাওবা করা চাই এবং নেক আমলের মাধ্যমে পাপ মিটিয়ে ফেলা চাই। নবীজীর প্রিয় সাহাবী আবু যর রা.-কে একবার এ উপদেশই দিয়েছেন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-

اتّقِ الله حَيْثُمَا كُنْتَ، وَأَتْبِعِ السّيِّئَةَ الحَسَنَةَ تَمْحُهَا.

হে আবু যর! যেখানেই থাক আল্লাহকে ভয় কর এবং কোনো পাপ হয়ে গেলেই নেক আমল কর; তা তোমার পাপ মিটিয়ে দিবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯৮৭

যে সকল নেক আমল দ্বারা পাপ মিটে যায় এর শীর্ষে হল নামায; উপরোল্লেখিত আয়াতে সেদিকে ইশারা রয়েছে। আর পাপ হয়ে গেলে আল্লাহর কাছে মাফ চাওয়ার সর্বোত্তম পদ্ধতিও হল নামায। নামাযের মাধ্যমে মাফ চাইলে আল্লাহ দ্রুত মাফ করেন। হযরত আবু বকর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন-

مَا مِنْ رَجُلٍ يُذْنِبُ ذَنْبًا فَيَتَوَضّأُ فَيُحْسِنُ الْوُضُوءَ، قَالَ مِسْعَرٌ: وَيُصَلِّي، وَقَالَ سُفْيَانُ: ثُمّ يُصَلِّي رَكْعَتَيْنِ، فَيَسْتَغْفِرُ اللهَ عَزّ وَجَلّ إِلّا غُفَرَ لَهُ.

কারো কোনো পাপ হয়ে গেলে সে যদি উত্তমরূপে ওযু করে এবং দুই রাকাত নামায পড়ে আল্লাহর কাছে মাফ চায় আল্লাহ তাকে মাফ করে দেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২

এছাড়াও হাদীস শরীফে নামাযের মাধ্যমে পাপ মোচন হওয়ার অনেক বর্ণনা এসেছে।



পাঁচ ওয়াক্ত নামায : মধ্যবর্তী গোনাহগুলো মিটিয়ে দেয়

যে ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের ব্যাপারে যত্নবান তার কি কোনো গোনাহ থাকতে পারে? একে তো নামাযী ব্যক্তি গোনাহ থেকে বেঁচে থাকতে চেষ্টা করবে, প্রতি নামাযেই গোনাহ থেকে মাফ চাইবে এবং গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার সংকল্প করবে- এটাই স্বাভাবিক। তারপরও যদি কোনো গোনাহ হয়ে যায় তো আল্লাহ তাআলা গাফুরুর রাহীম- নামাযের মাধ্যমে বান্দার গোনাহগুলো মিটিয়ে দেন। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন-

أَرَأَيْتُمْ لَوْ أَنّ نَهْرًا بِبَابِ أَحَدِكُمْ يَغْتَسِلُ مِنْهُ كُلّ يَوْمٍ خَمْسَ مَرّاتٍ، هَلْ يَبْقَى مِنْ دَرَنِهِ شَيْءٌ؟ قَالُوا: لَا يَبْقَى مِنْ دَرَنِهِ شَيْءٌ، قَالَ: فَذَلِكَ مَثَلُ الصَّلَوَاتِ الْخَمْسِ، يَمْحُو اللهُ بِهِنّ الْخَطَايَا.

(তোমাদের কী মনে হয়?) কারো বাড়ির পাশে যদি নদী থাকে আর সে তাতে প্রতিদিন পাঁচ বার গোসল করে, তার শরীরে কি কোনো ময়লা থাকবে? সাহাবায়ে কেরাম উত্তরে বললেন, না, তার শরীরে কোনো ময়লা অবশিষ্ট থাকবে না। নবীজী তখন বললেন-

فَذلِكَ مَثَلُ الصّلَوَاتِ الْخَمْسِ، يَمْحُو اللهُ بِهِنّ الْخَطَايَا.

পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের দৃষ্টান্তও এরূপ। এর মাধ্যমে আল্লাহ (বান্দার) পাপসমূহ মিটিয়ে দেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৬৭; সহীহ বুখারী, হাদীস ৫২৮

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন-

الصّلَوَاتُ الْخَمْسُ، وَالْجُمْعَةُ إِلَى الْجُمْعَةِ، وَرَمَضَانُ إِلَى رَمَضَانَ، مُكَفِّرَاتٌ مَا بَيْنَهُنّ إِذَا اجْتَنَبَ الْكَبَائِرَ

পাঁচ ওয়াক্ত নামায, এক জুমা থেকে আরেক জুমা, এক রমযান থেকে আরেক রমযান এর মধ্যবর্তী সময়ের গোনাহকে মিটিয়ে দেয়; যদি ওই ব্যক্তি কবীরা গোনাহ থেকে বেঁচে থাকে (ওই ব্যক্তির যদি কবীরা গোনাহ না থাকে)। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৩৩

অর্থাৎ, কবীরা গোনাহ করলে সকল গোনাহের কাফফারা হবে না; বরং শুধু সগীরা গোনাহের কাফফারা হবে। কারণ, কবীরা গোনাহ তওবা ছাড়া মাফ হয় না (তেমনি বান্দার হকও; যা অন্য হাদীস থেকে বোঝা যায়)।



জুমার নামায : সারা সপ্তাহের গোনাহ মিটিয়ে দেয়

হযরত আবু হুরায়রা রা. বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

مَنْ تَوَضّأَ فَأَحْسَنَ الْوُضُوءَ، ثُمّ أَتَى الْجُمُعَةَ، فَاسْتَمَعَ وَأَنْصَتَ، غُفِرَ لَهُ مَا بَيْنَهُ وَبَيْنَ الْجُمُعَةِ، وَزِيَادَةُ ثَلَاثَةِ أَيّامٍ، وَمَنْ مَسّ الْحَصَى فَقَدْ لَغَا.

যে ব্যক্তি উত্তমরূপে ওযু করল এবং জুমায় এল। এরপর মনোযোগসহ খুতবা শুনল ও চুপ থাকল। আল্লাহ তাআলা তার গত জুমা ও এই জুমার মধ্যবর্তী সময়ের গোনাহ মাফ করে দিবেন; আরো অতিরিক্ত তিন দিনের গোনাহও মাফ করবেন। আর যে ব্যক্তি নুড়ি স্পর্শ করল সে অনর্থক কাজ করল। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮৫৭

ওযু : গোনাহ ধুয়ে দেয়

নামাযের জন্য, তিলাওয়াত বা অন্য কোনো আমলের জন্য আমরা ওযু করি। নির্দিষ্ট অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধৌত করি; ওযুর মাধ্যমে আমরা পবিত্র হই। আমরা দেখি, আমাদের শরীরের ধুলো-ময়লা ধুয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে ওযু এর চেয়েও বেশি কিছু। তা শুধু শরীরের ধুলো-ময়লা ধুয়ে দেয় এবং আমাদের পবিত্র করে- এটুকুই নয়; বরং তা আমাদের গোনাহগুলোও ধুয়ে দেয়। গোনাহের নাপাকী থেকেও আমাদের পবিত্র করে। হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

إِذَا تَوَضّأَ الْعَبْدُ الْمُسْلِمُ - أَوِ الْمُؤْمِنُ - فَغَسَلَ وَجْهَهُ خَرَجَ مِنْ وَجْهِهِ كُلّ خَطِيئَةٍ نَظَرَ إِلَيْهَا بِعَيْنَيْهِ مَعَ الْمَاءِ - أَوْ مَعَ آخِرِ قَطْرِ الْمَاءِ -، فَإِذَا غَسَلَ يَدَيْهِ خَرَجَ مِنْ يَدَيْهِ كُلّ خَطِيئَةٍ كَانَ بَطَشَتْهَا يَدَاهُ مَعَ الْمَاءِ أَوْ مَعَ آخِرِ قَطْرِ الْمَاءِ -، فَإِذَا غَسَلَ رِجْلَيْهِ خَرَجَتْ كُلّ خَطِيئَةٍ مَشَتْهَا رِجْلَاهُ مَعَ الْمَاءِ - أَوْ مَعَ آخِرِ قَطْرِ الْمَاءِ - حَتّى يَخْرُجَ نَقِيّا مِنَ الذّنُوبِ.

যখন মুসলিম ওযু করে- চেহারা ধোওয়ার সময় পানির ফোঁটার সাথে চোখের গোনাহগুলো ধুয়ে যায় (বর্ণনাকারী বলেন, অথবা নবীজী বলেছেন, পানির শেষ ফোঁটার সাথে ধুয়ে যায়)। যখন হাত ধোয় তো হাতের গোনাহগুলো ধুয়ে যায়।... যখন পা ধোয় তো পানির ফোঁটার সাথে পায়ের দ্বারা কৃত গোনাহগুলো ধুয়ে যায়।... এভাবে বান্দা গোনাহ থেকে একেবারে পাক-সাফ হয়ে যায়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৪৪



কষ্টের মুহূর্তে পূর্ণরূপে ওযু করা : গোনাহের কাফফারা

প্রচ- শীতের রাতে ওযু করতে যে কী কষ্ট- তা বর্ণনা করা সম্ভব নয়; শুধু ওযু করার সময় তা অনুভব করা যায়। পানি ছুতেই যেন ভয় লাগে। সে অবস্থায় যে পূর্ণরূপে ওযু করবে তার পুরস্কার কী?

এর পুরস্কার হল, গোনাহ মিটে যাওয়া। এর দ্বারা আল্লাহ গোনাহ মিটিয়ে দেন। বান্দার গোনাহ মিটে যাওয়ার চেয়ে বড় পুরস্কার আর কী হতে পারে? একটি দীর্ঘ হাদীসে একে ‘কাফফারাতুন’-পাপ মোচনকারী বলা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-

وَالكَفّارَاتُ المكْثُ فِي المَسَاجِدِ بَعْدَ الصّلَاةِ، وَالْمَشْيُ عَلَى الْأَقْدَامِ إِلَى الْجَمَاعَاتِ، وَإِسْبَاغُ الوُضُوءِ فِي المَكَارِهِ.

পাপ মোচনাকরী হল- নামাযের পর (আরেক নামাযের অপেক্ষায়) মসজিদে অবস্থান করা। পায়ে হেঁটে মসজিদে গমন এবং কষ্টের মুহূর্তে পূর্ণরূপে ওযু করা। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩২৩৩



নামাযের জন্য মসজিদে গমন : কদমে কদমে গোনাহ মাফ

জামাতের নামায আল্লাহ তাআলার কাছে অনেক প্রিয়। ফলে জামাতের নামাযের জন্য যে কদম আগে বাড়ে তাও আল্লাহ তাআলার কাছে প্রিয়। জামাতে নামাযের জন্য আগে বাড়া প্রতিটি কদমের বিনিময়ে আল্লাহ বান্দার গোনাহ মাফ করেন এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

صَلاَةُ الرّجُلِ فِي الجَمَاعَةِ تُضَعّفُ عَلَى صَلاَتِهِ فِي بَيْتِهِ، وَفِي سُوقِهِ، خَمْسًا وَعِشْرِينَ ضِعْفًا، وَذَلِكَ أَنَّهُ: إِذَا تَوَضَّأَ، فَأَحْسَنَ الوُضُوءَ، ثُمّ خَرَجَ إِلَى المَسْجِدِ، لاَ يُخْرِجُهُ إِلّا الصّلاَةُ، لَمْ يَخْطُ خَطْوَةً، إِلّا رُفِعَتْ لَهُ بِهَا دَرَجَةٌ، وَحُطّ عَنْهُ بِهَا خَطِيئَةٌ.

জামাতের নামায ঘরের বা বাজারের নামায অপেক্ষা পঁচিশ গুণ বেশি সওয়াব রাখে। কারণ, বান্দা যখন উত্তমরূপে ওযু করে এবং একমাত্র নামাযের উদ্দেশ্যেই ঘর থেকে বের হয় তো প্রতিটি কদমের বিনিময়ে আল্লাহ তার একটি করে মর্যাদা বৃদ্ধি করেন এবং একটি করে গোনাহ মিটিয়ে দেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪৭



আমীন বলা : ফিরিশতার সাথে মিলে গেলে...

নামাযে বান্দা চুপিসারে আল্লাহর সাথে কথা বলে। আল্লাহর তাসবীহ পড়ে, হাম্দ ও ছানা করে, দুআ ও প্রার্থনা করে। সূরা ফাতেহার মধ্যে বান্দা হাম্দ ও ছানার সাথে সাথে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে। সূরা ফাতেহা যখন শেষ হয় তখন মুসল্লী আমীন বলে। ফিরিশতারাও তখন আমীন বলেন। বান্দার আমীন ও ফিরিশতার আমীন মিলে গেলে আল্লাহ বান্দার পূর্বের সব গোনাহ মাফ করে দেন। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

إِذَا قَالَ الْإِمَامُ: غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضّالِّينَ، فَقُولُوا: آمِينَ، فَإِنّ الْمَلَائِكَةَ تَقُولُ : آمِينَ، وَإِنّ الْإِمَامَ يَقُولُ: آمِينَ، فَمَنْ وَافَقَ تَأْمِينُهُ تَأْمِينَ الْمَلَائِكَةِ، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدّمَ مِنْ ذَنْبِهِ.

যখন ইমাম غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ বলেন তখন তোমরাও আমীন বল। কেননা তখন ফিরিশতারাও আমীন বলে। ইমামও আমীন বলে। আর যার আমীন বলা ফিরিশতাদের আমীন বলার সাথে মিলবে তার পূর্বের সব পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৭১৮৭; সহীহ বুখারী, হাদীস ৭৮০

রব্বানা লাকাল হামদ : পূর্বের গোনাহ মাফ

রুকু থেকে উঠে ইমাম ঘোষণা করেন- سَمِعَ اللهُ لِمَنْ حَمِدَهُ (আল্লাহ শোনেন- যে তার প্রশংসা করে)। এ ঘোষণা শুনে কি মুমিন চুপ থাকতে পারে? সাথে সাথে মুমিনও তার রবের প্রশংসায় সচকিত হয়। সে বলে- رَبّنَا لَكَ الحَمْدُ (সকল প্রশংসা তোমারই হে আমাদের রব!)। এহেন মুহূর্তে কি ফিরিশতারা নিরব থাকবে? তারাও আল্লাহর প্রশংসায় সরব হয়। সৃষ্টি হয় অভূতপূর্ব এক দৃশ্যের। আল্লাহ খুশি হন। যে বান্দার তাহমীদ (রব্বানা লাকাল হাম্দ বলা) ফিরিশতাদের সাথে মিলে যায় তার পূর্বের সব গোনাহ আল্লাহ মাফ করে দেন। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

إِذَا قَالَ الإِمَامُ: سَمِعَ اللهُ لِمَنْ حَمِدَهُ، فَقُولُوا: اللّهُمّ رَبّنَا لَكَ الحَمْدُ، فَإِنّهُ مَنْ وَافَقَ قَوْلُهُ قَوْلَ المَلاَئِكَةِ، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدّمَ مِنْ ذَنْبِهِ.

যখন ইমাম سَمِعَ اللهُ لِمَنْ حَمِدَهُ বলে তোমরা বল- اللّهُمّ رَبّنَا لَكَ الحَمْدُ। কারণ, যার তাহমীদ ফিরিশতাদের সাথে মিলবে তার পূর্বের সব পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৭৯৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪০৯

রোযার সাথে গোনাহমাফির সম্পর্ক খুব গভীর। রমযানের ফরয রোযা যেমন গোনাহ মিটিয়ে দেয় তেমনি বছরের বিভিন্ন সময়ের নফল রোযাও গোনাহ মিটিয়ে দেয়।



রমযান মাস : দুই রমযানের মাঝের গোনাহ মিটিয়ে দেয়

রমযান মাস আল্লাহ তাআলার কাছে অনেক প্রিয় মাস। এ মাস কুরআনের মাস। এ মাস রোযার মাস। সিয়াম-কিয়াম, তিলাওয়াত-মুনাজাতে মুখরিত থাকে এ মাস। তাই আল্লাহর কাছে এ মাস অনেক প্রিয়। বছর ঘুরে যখন এ মাস আসে এবং বান্দা আমলে মনোযোগী হয়, যেমন গত রমযানে হয়েছিল তখন আল্লাহ দুই রমযানের মাঝের গোনাহগুলো মাফ করে দেন।

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন-

...وَرَمَضَانُ إِلَى رَمَضَانَ، مُكَفِّرَاتٌ مَا بَيْنَهُنّ إِذَا اجْتَنَبَ الْكَبَائِرَ.

...এক রমযান থেকে আরেক রমযান এর মধ্যবর্তী সময়ের গোনাহের কাফফারা- গোনাহ মোচনকারী; যদি ওই ব্যক্তি কবীরা গোনাহ থেকে বেঁচে থাকে (ওই ব্যক্তির যদি কবীরা গোনাহ না থাকে)। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৩৩

উল্লেখ্য, এ প্রবন্ধের বর্ণনাসমূহে গোনাহ মাফ হওয়ার যে কথা রয়েছে, তার দ্বারা উদ্দেশ্য হল, সগীরা গোনাহ; কারণ, কবীরা গোনাহ তাওবা ছাড়া মাফ হয় না।



রমযানের রোযা : গোনাহ পুড়িয়ে ছাই করে দেয়

রমযান মাসে একদিকে বান্দা রহমতের বারিধারায় স্নাত হয়- প্রতি রাতে, প্রতি সকালে, সাহরীর মুহূর্তে, ইফতারীর মুহূর্তে; রহমত ঢেকে ফেলে বান্দাকে। অপরদিকে মাগফিরাতের অগ্নিশিখা জ্বালিয়ে দেয় বান্দার সব পাপ। রোযা সব পাপ জ্বালিয়ে দেয়, ভস্ম করে দেয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدّمَ مِنْ ذَنْبِهِ.

যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রমযান মাসের রোযা রাখবে, তার পূর্ববর্তী গোনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৮



রমযানে কিয়ামুল লাইল : পাপের অন্ধকার থেকে মুক্ত করে

রমযান মাসের আমলসমূহের মধ্যে কিয়ামুল লাইল অন্যতম প্রধান আমল। তারাবী আর তাহাজ্জুদে কুরআন তিলাওয়াতের নূর নূরানী করে রাখে রমযানের রাত। সে নূরে স্নাত হয় বান্দার দেহ-মন। রাতের বিভিন্ন প্রহরে বান্দা দণ্ডায়মান হয় সালাতে, মশগুল হয় তিলাওয়াতে এবং সিজদাবনত হয় মহান প্রভুর সামনে। তখন গোনাহের কথা স্মরণ করে বান্দা অশ্রুসজল হয়- রহমতের আশায়, মাগফিরাতের প্রত্যাশায়। আল্লাহ তাআলাও তখন বান্দাকে ঢেকে নেন রহমতের চাদরে। মাফ করে দেন বান্দার গোনাহ-খাতা।

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

مَنْ قامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدّمَ مِنْ ذَنْبِهِ.

যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রমযানের রাতে নামাযে দ-ায়মান হয়, তার পূর্ববর্তী গোনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হয়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৭



লাইলাতুল কদরে কিয়ামুল লাইল : পুণ্যের পাহাড় আর ক্ষমার দরিয়া

লাইলাতুল কদর। ওয়ামা আদ্রা-কা মা- লাইলাতুল কদ্র। লাইতুল কদরের ফযীলতের বিশালতা কী বলে প্রকাশ করা যায়? এক রাতের বিনিময়ে আল্লাহ সওয়াব দান করবেন- হাজার রাতের নয়; হাজার মাসের চেয়েও বেশি। এ রাতের যদি আমরা কদর না করি তো আর কোন রাতের কদর করব? এ এক রাতের তালাশে দশ রাত কেন শত রাতও তো কিছু না। এ রাতের কদরকারীর জন্য শুধু পুণ্যের পাহাড় নয়, ক্ষমার দরিয়াও। এখন প্রয়োজন শুধু কদর করার আর আমল ও ইসতিগফারের মাধ্যমে সে দরিয়ায় ¯œাত হয়ে পাপমুক্ত হওয়ার। সালাত-তিলাওয়াতে যে বান্দা রাতটিকে সজীব করবে আল্লাহ তার পূর্বের সব গোনাহ মাফ করে দিবেন।

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

مَنْ قامَ لَيْلَةَ القَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدّمَ مِنْ ذَنْبِهِ.

যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় কদরের রাতে নামাযে দণ্ডায়মান হবে, তার পূর্ববতী গোনাহসমূহ মাফ করে দেওয়া হবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯০১



ইয়াওমে আরাফার রোযা : দুই বছরের গোনাহ মাফ

এক দিন রোযা রাখার দ্বারা কত দিনের গোনাহ মাফ হতে পারে? দশ দিনের? এক শ দিনের? না, মাত্র এক দিনের রোযার বিনিময়ে আল্লাহ দুই বছরের গোনাহ মাফ করেন।

আবু কাতাদা রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ، إِنِّي أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السّنَةَ الّتِي قَبْلَهُ وَالسّنَةَ الّتِي بَعْدَهُ.

আরাফার দিনের রোযার বিষয়ে আমি আল্লাহর কাছে প্রত্যাশা করি যে, (এর দ্বারা) বিগত বছরের এবং বর্তমান বছরের গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৭৪৯; (সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬২)



আশুরার রোযা : বিগত বছরের কাফফারা

আশুরার দিবসের রোযা এতটাই ফযীলতপূর্ণ যে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দিবসের খোঁজ রাখতেন এবং এর ফযীলত লাভের জন্য রোযা রাখতেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-কে আশুরার রোযা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন-

مَا عَلِمْتُ أَنّ رَسُولَ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ صَامَ يَوْمًا يَطْلُبُ فَضْلَهُ عَلَى الْأَيّامِ إِلّا هَذَا الْيَوْمَ وَلَا شَهْرًا إِلّا هَذَا الشّهْرَ. يَعْنِي رَمَضَانَ.

আমার জানা মতে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যান্য দিবসের রোযার তুলনায় আশুরার রোযার ফযীলত লাভের জন্য বেশি উদগ্রীব থাকতেন। তেমনি অন্য মাসের তুলনায় রমযান মাসের রোযার ব্যাপারেও। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৩২; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ২৩৭০

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আশুরার রোযার ফযীলত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন-

يُكَفِّرُ السّنَةَ الْمَاضِيَةَ.

এই রোযা বিগত বছরের কাফফারা হয়ে যায়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬২



হজ্ব গোনাহ মিটিয়ে দেয় : যেন সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশু

যে শিশুটি আজকে জন্ম নিল তার কি কোনো গোনাহ থাকে? আমরা বলি, মাছূম বাচ্চা, নিষ্পাপ শিশু। তো হজ্ব বান্দার গোনাহ কিরূপ মিটিয়ে দেয় তার উদাহরণ দেওয়া হয়েছে- যেন আজকে জন্ম নেওয়া শিশু। অর্থাৎ আজকে জন্ম নেওয়া শিশুটির যেমন কোনো গোনাহ থাকে না তেমনি যাকে আল্লাহ ‘হজ্জে মাবরূর’ নসীব করেছেন সেও আজকে জন্ম নেওয়া শিশুটির মত গোনাহমুক্ত হয়ে যায়।

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবীজী সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি-

مَنْ حَجّ لِلهِ فَلَمْ يَرْفُثْ، وَلَمْ يَفْسُقْ، رَجَعَ كَيَوْمِ وَلَدَتْهُ أُمّهُ.

যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হজ্ব করল এবং অশ্লীল কথা-বার্তা ও গোনাহ থেকে বিরত থাকল সে ঐ দিনের মত নিষ্পাপ হয়ে হজ্ব থেকে ফিরবে, যেদিন সে জন্ম নিয়েছিল। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৫২১



তওয়াফ : প্রতি কদমে গোনাহ মাফ হয়

তওয়াফ হজ্ব ও উমরার অন্যতম প্রধান রোকন। ইহরামের সাদা পোশাকে হজ্ব-উমরাকারীদের তওয়াফের দৃশ্য দেখলে যেন মনে হয়- এঁরা আল্লাহর রহমতের সাগরে ভাসছে। তাসবীহ-তাহলীল-দুআর গুঞ্জরণে মুখরিত হয় কা‘বা চত্তর। সাদা-কালো, আরব-অনারব একাকার হয়ে প্রভুর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে প্রদক্ষিণ করছে কা‘বা।

হাঁ, এসময় আল্লাহর রহমতের সাগরেও মওজ ওঠে। তাদেরকে আল্লাহর রহমত ঘিরে ফেলে এবং তওয়াফকারীর প্রতিটি কদমের বিনিময়ে আল্লাহ নেকি দান করেন এবং গোনাহ মাফ করেন।

আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি-

لَا يَضَعُ قَدَمًا وَلَا يَرْفَعُ أُخْرَى إِلّا حَطّ اللهُ عَنْهُ خَطِيئَةً وَكَتَبَ لَهُ بِهَا حَسَنَةً.

(তওয়াফকারীর) প্রতিটি কদমের বিনিময়ে আল্লাহ একটি গোনাহ মাফ করেন এবং একটি নেকি দান করেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৯৫৯



হজরে আসওয়াদ : গোনাহগুলো যেন শুষে নেয়

হজরে আসওয়াদ জান্নাত থেকে আসা এক পাথর। হজরে আসওয়াদ অর্থ কালো পাথর অথচ পাথরটি ছিল দুধের চেয়েও সাদা। বনী আদমের গোনাহ দুধের চেয়ে সাদা এ পাথরটিকেই কালো বানিয়ে দিয়েছে। ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

نَزَلَ الحَجَرُ الأَسْوَدُ مِنَ الجَنّةِ، وَهُوَ أَشَدّ بَيَاضًا مِنَ اللّبَنِ فَسَوّدَتْهُ خَطَايَا بَنِي آدَمَ.

হজরে আসওয়াদ জান্নাত থেকে এসেছে। এটি দুধের চেয়েও সাদা ছিল। কিন্তু বনী আদমের গোনাহ এটিকে কালো বানিয়ে দিয়েছে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৮৭৭

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজরে আসওয়াদ চুমু খেতেন। তাঁর অনুসরণেই সাহাবায়ে কেরাম হজরে আসওয়াদ চুমু খেতেনে। একবার ওমর রা. হজরে আসওয়াদের কাছে গেলেন এবং চুমু খেলেন। এরপর বললেন-

إِنِّي أَعْلَمُ أَنّكَ حَجَرٌ، لاَ تَضُرّ وَلاَ تَنْفَعُ، وَلَوْلاَ أَنِّي رَأَيْتُ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يُقَبِّلُكَ مَا قَبّلْتُكَ.

আমি জানি, তুমি একটি পাথর মাত্র; উপকার-অপকার করার কোনো ক্ষমতা তোমার নেই। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চুমু খেতে দেখেছি বলেই আমি তোমাকে চুমু খেলাম। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৫৯৭

আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. রুকনে ইয়ামানী ও হাজরে আসওয়াদের নিকট দাঁড়াতেন এবং তা স্পর্শ করতেন। এ ব্যাপারে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি-

إِنّ مَسْحَهُمَا كَفّارَةٌ لِلْخَطَايَا.

এ দুইয়ের স্পর্শ গোনাহ মিটিয়ে দেয়। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৯৫৯

ইয়াওমে আরাফা : এদিন যে হেফাযত করবে দৃষ্টি, কান ও যবান

এদিন হাজ্বী সাহেবান আরাফার ময়দানে সমবেত হন। উস্কোখুস্কো চুল আর ধুলোয় মলিন চেহারা নিয়ে খোলা ময়দানে তারা সমবেত। দুআ-ইস্তিগফার আর রোনাজারিতে কাটে তাদের সারাটা দিন। এহেন অবস্থায় আল্লাহ ফেরেশতাদের সামনে তাদের নিয়ে গর্ব করেন। আল্লাহর রহমত তাদের ঢেকে নেয়, ক্ষমার বারিধারায় স্নাত হয় তাঁরা।

এমন পুণ্যময় একটি দিনে যে ব্যক্তি নিজের দৃষ্টি, কান ও যবানের হেফাজত করবে; অন্যায় দৃষ্টি আর কটূবাক্য থেকে বেঁচে থাকবে তাকেও আল্লাহ মাফ করে দিবেন।

ইবনে আব্বাস রা. বলেন, ...রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

إِنّ هَذَا يَوْمٌ مَنْ مَلَكَ فِيهِ سَمْعَهُ وَبَصَرَهُ وَلِسَانَهُ غُفِرَ لَهُ.

এটি এমন একটি দিন; যে ব্যক্তি এ দিনে তার কান, দৃষ্টি ও যবানের নিয়ন্ত্রণ করবে (গোনাহ থেকে বেঁচে থাকবে) আল্লাহ তাকে মাফ করে দিবেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৩০৪১; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস ২৮৩২; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৩৭৭৭; মুসনাদে আবি ইয়ালা, হাদীস ২৪৪১



উমরা : দুই উমরার মাঝের গোনাহ মাফ

আমাদের দেশের অনেক মধ্যবিত্তেরও উমরার তাওফিক হয়। অনেক মানুষ রয়েছেন, যাদের হজ্বের সামর্থ্য নেই, কিন্তু কষ্ট করে উমরার টাকা যোগাড় করে ফেলেন। বহু কষ্টে জমানো অর্থ দিয়ে তারা বায়তুল্লাহ যিয়ারতের তৃষ্ণা মেটান, পূরণ করেন বুকের মাঝে লালিত দীর্ঘদিনের স্বপ্ন।

আর যেসকল ধনীদের আল্লাহ বায়তুল্লাহর মহব্বত দান করেছেন তারা তো বছরের বিভিন্ন সময় ছুটে যান বায়তুল্লাহ্য়। তেমনি যারা আরবের বাসিন্দা বা বায়তুল্লাহর প্রতিবেশী তারাও। যাকে আল্লাহ অর্থ বা সামর্থ্য দিয়েছেন সাথে আল্লাহর মহব্বতও দান করেছেন সে কি বারবার বায়তুল্লাহর যিয়ারত না করে পারে?

তাছাড়া উমরার মাধ্যমে আল্লাহ গোনাহ মাফ করেন। এক উমরা তার পূর্ববর্তী উমরার মাঝের গোনাহগুলো মিটিয়ে দেয়।

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

العُمْرَةُ إِلَى العُمْرَةِ كَفّارَةٌ لِمَا بَيْنَهُمَا.

এক উমরা পূর্ববর্তী উমরার মাঝের গোনাহগুলোর কাফফারা হয়ে যায়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৭৭৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৩৪৯



বিপদে ধৈর্য ধারণ : গাছের পাতার মত ঝরে যায় গোনাহ

মানুষের জীবনে বিভিন্ন ধরনের বিপদ আসে। কখনো রোগ-শোকে কাতর হয়ে যায় মানুষ। কখনো অর্থ-কষ্টে জর্জরিত হয় জীবন। বিপদ যেমনই আসুক- মুমিন ধৈর্য ধারণ করে। কারণ, মুমিন যদি বিপদে ধৈর্য ধারণ করে আল্লাহ এর বিনিময় দান করেন এবং এর কারণে গোনাহ মাফ করেন। এমনকি শরীরে কাঁটা ফুটলেও এর বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা গোনাহ মাফ করেন। সায়েব ইবনে খাল্লাদ রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

مَا مِنْ شَيْءٍ يُصِيبُ الْمُؤْمِنَ حَتّى الشّوْكَةِ تُصِيبُهُ إِلّا كَتَبَ لَهُ بِهَا حَسَنَةً أَوَ حَطّ عَنْهُ بِهَا خَطِيئَةً.

মুমিন যে ধরনের বিপদেই আক্রান্ত হোক না কেন, এমনকি কাঁটা ফুটলেও এর বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা একটি নেকি লেখেন অথবা একটি গোনাহ মাফ করে দেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৬৫৬০; সহীহ মুসলিম (আয়েশা রা. থেকে), হাদীস ২৫৭২

একবার নবীজী প্রচ- জ্বরে কাঁপছিলেন। এমন সময় আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. নবীজীর কাছে হাজির হলেন। একপর্যায়ে নবীজী বললেন-

مَا مِنْ مُسْلِمٍ يُصِيبُهُ أَذًى إِلّا حَاتّ اللهُ عَنْهُ خَطَايَاهُ، كَمَا تَحَاتّ وَرَقُ الشّجَر.

মুমিন যখন কোনো (বিপদ বা) কষ্টে নিপতিত হয় তখন আল্লাহ এর বিনিময়ে তার গোনাহগুলো (ঝরিয়ে দেন) মাফ করে দেন যেমন (শীতকালে) গাছের পাতা ঝরে পড়ে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫৬৪৭

বিপদে মুমিন শুধু ধৈর্য ধারণই করে না; বরং আল্লাহ যে অবস্থায় রেখেছেন তার উপরই শুকরিয়া আদায় করে, ফলে আল্লাহ তার গোনাহগুলো এমনভাবে মাফ করেন, যেন সে সদ্যভূমিষ্ঠ নিষ্পাপ শিশু, যার কোনো গোনাহই থাকে না। এমনকি অসুস্থ ব্যক্তি ধৈর্য ধারণ করলে সুস্থ অবস্থায় সে যে নেক আমল করত তার সওয়াবও দান করা হয়।

শাদ্দাদ ইবনে আওস রা. ও সুনাবিহী রা. এক অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছেন? তিনি উত্তরে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন, বললেন, আল্লাহর নিআমতের মধ্যে আছি। তা শুনে শাদ্দাদ রা. বললেন, তুমি গোনাহের কাফফারা ও পাপ মোচনের সুসংবাদ গ্রহণ কর। কারণ, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তাআলা বলেন-

إِنِّي إِذَا ابْتَلَيْتُ عَبْدًا مِنْ عِبَادِي مُؤْمِنًا، فَحَمِدَنِي عَلَى مَا ابْتَلَيْتُهُ، فَإِنّهُ يَقُومُ مِنْ مَضْجَعِهِ ذَلِكَ كَيَوْمِ وَلَدَتْهُ أُمّهُ مِنَ الْخَطَايَا، وَيَقُولُ الرّبّ عَزّ وَجَلّ: أَنَا قَيّدْتُ عَبْدِي، وَابْتَلَيْتُهُ، فَأَجْرُوا لَهُ كَمَا كُنْتُمْ تُجْرُونَ لَهُ وَهُوَ صَحِيحٌ.

আমি যখন আমার কোনো মুমিন বান্দাকে বিপদে আক্রান্ত করি আর এ অবস্থার উপরও সে আমার প্রশংসা করে তখন সে (রোগের) বিছানা থেকে সেদিনের মত পাপমুক্ত হয়ে ওঠে, যেদিন তার মা তাকে জন্ম দিয়েছিল। এবং আল্লাহ ফিরিশতাদের বলেন, আমিই আমার বান্দাকে (আমল থেকে) বিরত রেখেছি এবং পরীক্ষায় নিপতিত করেছি; সুতরাং সে সুস্থ অবস্থায় যে নেক আমল করত এ অসুস্থ অবস্থায়ও সে নেক আমলের সওয়াব লিখতে থাক। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৭১১৮

মানুষের বিপদ কখনো হয় শারীরিক অসুস্থতার দ্বারা, কখনো সম্পদের ক্ষতির মাধ্যমে, আবার সন্তান-পরিবার আক্রান্ত হওয়ার মাধ্যমেও বিপদ আসে। তো যে ধরনের বিপদেই মুমিন আক্রান্ত হোক না কেন, এর বিনিময়ে তার গোনাহ মাফ হতে থাকে। গোনাহ মাফ হতে হতে একপর্যায়ে সে গোনাহমুক্ত হয়ে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করে। তাই যে কোনো ধরনের বিপদেই মুমিন হতাশ হয়ে যায় না; ধৈর্য ধারণ করে।

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

لَا يَزَالُ الْبَلَاءُ بِالْمُؤْمِنِ أَوِ الْمُؤْمِنَةِ، فِي جَسَدِهِ، وَفِي مَالِهِ، وَفِي وَلَدِهِ، حَتّى يَلْقَى اللهَ وَمَا عَلَيْهِ مِنْ خَطِيئَةٍ.

মুমিন পুরুষ, মুমিন নারী বিপদাক্রান্ত হতে থাকে; সে বিপদে কখনো আক্রান্ত হয় শরীর, কখনো সম্পদ, কখনো সন্তান-সন্ততি। (এসকল বিপদে মুমিন ধৈর্য ধারণ করে, ফলে আল্লাহ তার গোনাহ মাফ করতে থাকেন।) একপর্যায়ে সে গোনাহমুক্ত হয়ে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৭৮৫৯



মুসাফাহা : হৃদয়ের বন্ধন জোড়ে, গোনাহ মাফ করে

এক মুসলিমের সাথে আরেক মুসলিমের সাক্ষাতে সালাম বিনিময়ের পর প্রথম কাজই হল মুসাফাহা। এটা মুসলিমের সংস্কৃতি। দুই হাতের মিলন হৃদয়কেও ছুঁয়ে যায়, জুড়ে দেয় হৃদয়ের বন্ধন, ঘুঁচে যায় দূরত্ব।

এক মুমিন আরেক মুমিনের এমনই কাছাকাছি থাকবে, অন্তরঙ্গ থাকবে- এমনটিই আল্লাহ চান। ফলে মুসাফাহা আল্লাহর কাছে অনেক পছন্দের আমল। এর কারণে আল্লাহ খুশি হন এবং তাদের মাফ করে দেন।

বারা ইবনে আযেব রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

مَا مِنْ مُسْلِمَيْنِ يَلْتَقِيَانِ فَيَتَصَافَحَانِ إِلّا غُفِرَ لَهُمَا قَبْلَ أَنْ يَفْتَرِقَا.

সাক্ষাৎকালে দুজন মুসলিম যখন মুসাফাহা করে তখন তারা পৃথক হওয়ার আগেই তাদেরকে মাফ করে দেওয়া হয়। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৭২৭; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫২১২



খাবারও খেলাম গুনাহ্ও মাফ হল

আমার সামনে গরম গরম সুস্বাদু খাবার উপস্থিত। এত সুস্বাদু খাবার আমার সামনে এসেছে অথচ এর জন্য আমি সামান্যই কষ্ট স্বীকার করেছি। একেই বলে রিযিক, যা বান্দাকে আল্লাহ দান করেন। প্রতিদিন, প্রতি বেলা দান করেন। তো বান্দার কি উচিত নয় তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা? আল্লাহ চান বান্দা যেন আল্লাহ্র রিযিক গ্রহণ করে কৃতজ্ঞ হয়, কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে।

আবার আল্লাহ্রই দেওয়া রিযিক গ্রহণ করে বান্দা যদি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে তাহলে আল্লাহ খুশী হন এবং বান্দাকে মাফ করে দেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

مَنْ أَكَلَ طَعَامًا فَقَالَ: الحَمْدُ لِلهِ الّذِي أَطْعَمَنِي هَذَا وَرَزَقَنِيهِ مِنْ غَيْرِ حَوْلٍ مِنِّي وَلاَ قُوّةٍ، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدّمَ مِنْ ذَنْبِهِ.

যে ব্যক্তি কোনো খাবার খাওয়ার পর বলে-

الحَمْدُ لِلّهِ الّذِي أَطْعَمَنِي هَذَا وَرَزَقَنِيهِ مِنْ غَيْرِ حَوْلٍ مِنِّي وَلاَ قُوّةٍ.

(সকল প্রসংসা আল্লাহ্র, যিনি কোনো প্রকার কষ্ট-মেহনত ছাড়া আমাকে এ খাবার খাওয়ালেন, এ রিযিক দান করলেন।) আল্লাহ তার পূর্ববর্তী সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৪৫৮; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪০২৩


আযান শুনে যে বলবে...

আযান। আল্লাহর ঘরের মিনার থেকে আল্লাহর বড়ত্বের ঘোষণা। তাওহীদ ও রিসালাতের সুউচ্চ আওয়ায। আল্লাহর দিকে আহ্বান। সালাতের দিকে আহ্বান। চির কামিয়াবির দিকে আহ্বান।

মুমিন আরাম নিদ্রায় থাক কিংবা থাক কর্মব্যস্ত- এ আহ্বান মুমিনকে জাগ্রত করে, এ আহ্বান মুমিনকে সচকিত করে; আরামের কম্বল থেকে বেরিয়ে আসে মুমিন, মাথার উপর উঁচু হওয়া কুঠার পিছনেই ছেড়ে দেয়। কারণ, এ যে মহান প্রভুর ডাকে সাড়া দেওয়ার আহ্বান- হাইয়া আলাস সালা-হ, হাইয়া আলাল ফালা-হ।

শত ব্যস্ততার মাঝেও মুমিন আযানের জবাব দেয়। আযান শেষে নবীজীর উপর দরূদ পাঠ করে, দুআ পড়ে এবং আল্লাহর ঘরে উপস্থিত হয়ে জামাতে নামাযের মাধ্যমে এ আহ্বানের দাবি পূরণ করে।

আযানের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে রয়েছে, তাওহীদ ও রিসালাতের ঘোষণা। তাওহীদের ঘোষণার মাধ্যমেই শেষ হয় আযান- লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ। তো তাওহীদ ও রিসালাতের ঘোষণা শোনার পর মুমিনও যদি তাওহীদ ও রিসালাতের স্বীকারোক্তিমূলক নিম্নোক্ত বাক্যগুলো বলে, আল্লাহ তাকে মাফ করে দেন।

সা‘দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

مَنْ قَالَ حِينَ يَسْمَعُ الْمُؤَذِّنَ أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، وَأَنّ مُحَمّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، رَضِيتُ بِاللهِ رَبّا وَبِمُحَمّدٍ رَسُولًا، وَبِالْإِسْلَامِ دِينًا، غُفِرَ لَهُ ذَنْبُهُ.

আযান শুনে যে ব্যক্তি বলবে-

أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلهَ إِلّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، وَأَنّ مُحَمّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ.

رَضِيتُ بِاللهِ رَبّا وَبِمُحَمّدٍ رَسُولًا، وَبِالْإِسْلَامِ دِينًا.

(আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। তিনি এক, তাঁর কোনো শরীক নেই। এবং আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল।

আমি আল্লাহকে রব হিসাবে পেয়ে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবী হিসাবে পেয়ে এবং ইসলামকে দ্বীন হিসাবে পেয়ে সন্তুষ্ট।) তার (সগীরা) গোনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩৮৬



কাফফারাতুল মাজলিস : মজলিসের গোনাহগুলো মাফ হয়ে যাক

আমাদের মজলিসগুলোতে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় কিছু অসংলগ্ন কথাবার্তা হয়ে যায়। কোনো কোনো সময় গোনাহের কথাও হয়ে যায়। তো মজলিসের এ গোনাহগুলো যেন মিটে যায়- এজন্য নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের দুআ শিখিয়েছেন। মজলিস শেষে এ দুআ পড়লে আল্লাহ মজলিসে অসংলগ্ন কথার কারণে হয়ে যাওয়া গোনাহগুলো মাফ করে দেন।

আবু বারযা আসলামী রা. বলেন-

كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ، يَقُولُ بِأَخَرَةٍ إِذَا أَرَادَ أَنْ يَقُومَ مِنَ الْمَجْلِسِ: سُبْحَانَكَ اللّهُمّ وَبِحَمْدِكَ، أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلّا أَنْتَ، أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوبُ إِلَيْكَ.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মজলিস থেকে উঠে যাওয়ার সময় এ দুআ পড়তেন-

سُبْحَانَكَاللّهُمّوَبِحَمْدِكَ،أَشْهَدُأَنْلَاإِلهَإِلّاأَنْتَ،أَسْتَغْفِرُكَوَأَتُوبُإِلَيْكَ.

এক সাহাবী এর কারণ জিজ্ঞেস করলে নবীজী বললেন-

كَفّارَةٌلِمَايَكُونُفِيالْمَجْلِسِ.

এ দুআ মজলিসে (অহেতুক বা অন্যায় কথা-বার্তার কারণে) হয়ে যাওয়া গোনাহের কাফফারা। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৮৫৯



সৃষ্টির প্রতি দয়া : টেনে আনে স্রষ্টার দয়া ও ক্ষমা

সকল সৃষ্টিই আল্লাহর। আল্লাহর কোনো সৃষ্টির প্রতি যদি কেউ দয়া করে আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট হন; তার প্রতিও দয়া করেন। শুধু তাই নয়, আল্লাহ তাকে ক্ষমাও করে দেন। এ সংক্রান্ত কিছু ঘটনা হাদীস শরীফে উল্লেখ হয়েছে।

আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

بَيْنَا رَجُلٌ يَمْشِي، فَاشْتَدّ عَلَيْهِ العَطَشُ، فَنَزَلَ بِئْرًا، فَشَرِبَ مِنْهَا، ثُمّ خَرَجَ فَإِذَا هُوَ بِكَلْبٍ يَلْهَثُ يَأْكُلُ الثّرَى مِنَ العَطَشِ، فَقَالَ: لَقَدْ بَلَغَ هَذَا مِثْلُ الّذِي بَلَغَ بِي، فَمَلَأَ خُفّهُ، ثُمّ أَمْسَكَهُ بِفِيهِ، ثُمّ رَقِيَ، فَسَقَى الكَلْبَ، فَشَكَرَ اللهُ لَهُ، فَغَفَرَ لَهُ.

হাঁটতে হাঁটতে একবার এক পথিকের খুব পিপাসা লাগল। সে একটি কূপে নামল। পান করে কূপ থেকে উঠছে এমন সময় একটি কুকুরকে দেখল পানির পিপাসায় তার জিহ্বা বের হয়ে গেছে। পানিযুক্ত কাদা চাটছিল। লোকটি মনে মনে বলল, আহা! কুকুরটিরও বুঝি আমার মত পিপাসা লেগেছে।

তার দয়া হল। সে কুয়ায় নেমে নিজ চামড়ার মোজায় পানি নিল। দাঁত দিয়ে মোজা কামড়ে ধরে কূপ থেকে উঠল এবং কুকুরকে পান করালো। আল্লাহ তার এ কাজে সন্তুষ্ট হলেন এবং তাকে মাফ করে দিলেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৩৬৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২২৪৪

সৃষ্টির প্রতি দয়ার আচরণ আল্লাহর কাছে এতই পছন্দনীয় আমল যে, এর দ্বারা আল্লাহ তাআলা পাপিষ্ঠা নারীকেও ক্ষমা করে দিয়েছেন। সে ঘটনাও হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

একবার এক পাপিষ্ঠা নারী পথ দিয়ে যাচ্ছিল। সে একটি কুকুরকে দেখল, পিপাসায় তার জিহ্বা বেরিয়ে এসেছে। মরণপ্রায় অবস্থা। কুকুরটি কুয়ার পাশ দিয়ে ঘুরছিল।

কুকুরটির এ অবস্থা দেখে তার দয়া হল। সে নিজের পায়ের চামড়ার মোজা খুলে ওড়নার সাথে বেঁধে কুয়া থেকে পানি ওঠালো এবং কুকুরকে পান করালো। তার এ কাজের কারণে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হল। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৩২১

কাপড় পরিধানের দুআ : পূর্বের গোনাহ মাফ হয়

পোশাক আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নিআমত। সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন সকল মানুষই পোশাক পরে। কোনো পশু পোশাক পরে না। কিন্তু মানুষ পরে। এটি মানবের বৈশিষ্ট্য। এর জন্য মানুষ অনেক অর্থ খরচ করে। এটা মানুষের স্বভাবজাত।

তবে পার্থক্য হয়ে যায় মানুষের রুচিবোধে। সৌন্দর্যের ধারণা সকল মানুষেরই আছে। কিন্তু সঠিক রুচিবোধ ও শালীনতা-অশালীনতার বিষয়ে মানুষ প্রভাবিত হয় নিজ প্রবৃত্তি ও পরিবেশ-পারিপার্শ্বিকতা দ্বারা। এ থেকে উত্তরণ ঘটে তাদের, যারা এক্ষেত্রেও আল্লাহর বিধান মানে। সুতরাং যাদেরকে আল্লাহ তাআলা এক্ষেত্রেও তাঁর হুকুম মানার তাওফীক দিয়েছেন তাদের তো শুকরিয়া আদায় করাই উচিত-

الْحَمْدُلِلهِالّذِيكَسَانِيهَذَاالثّوْبَوَرَزَقَنِيهِمِنْغَيْرِحَوْلٍمِنِّي،وَلَاقُوّةٍ.

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাকে এ পোশাক পরিয়েছেন। এবং কোনো প্রকার কষ্ট-মেহনত ছাড়া আমাকে তা দান করেছেন।

সারাদিনে আমরা কতবার কাপড় পরি? চার-পাঁচ বার হবে। কাপড় পরিধান করার সময় যদি আমরা উপরোক্ত দুআ পড়ি তাহলে আল্লাহ আমাদের গোনাহ মাফ করে দিবেন।

হযরত মুআয ইবনে আনাস রা. তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

مَنْ لَبِسَ ثَوْبًا فَقَالَ: الْحَمْدُ لِلهِ الّذِي كَسَانِي هَذَا الثّوْبَ وَرَزَقَنِيهِ مِنْ غَيْرِ حَوْلٍ مِنِّي، وَلَا قُوّةٍ غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدّمَ مِنْ ذَنْبِهِ.

যে ব্যক্তি পোশাক পরিধান করে বলবে-

الْحَمْدُلِلهِالّذِيكَسَانِيهَذَاالثّوْبَوَرَزَقَنِيهِمِنْغَيْرِحَوْلٍمِنِّي،وَلَاقُوّةٍ.

আল্লাহ তার পূর্বের গোনাহ মাফ করে দিবেন। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪০২৩; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ১৮৭০



...যদিও গোনাহ সমুদ্রের ফেনা বরাবর হয়

বান্দার গোনাহ আল্লাহ মাফ করেন। তাঁর মাফের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। বান্দার গোনাহ কত হতে পারে? সব গোনাহ তিনি ক্ষমা করে দিবেন। এমন রবের বান্দা কি নিরাশ হতে পারে। শুধু প্রয়োজন তাঁর দুয়ারে ফিরে আসার।

কিছু হাদীসে উদাহরণ টানা হয়েছে তাঁর ক্ষমার প্রশস্ততার- কী পরিমাণ গোনাহ হওয়ার পরও তিনি ক্ষমা করেন। কোনো হাদীসে এসেছে, ...যদিও গোনাহ মেঘমালা পর্যন্ত পৌঁছে যায়। কোনো হাদীসে এসেছে, ...যদিও বান্দা উপস্থিত হয় পৃথিবী-ভর্তি গোনাহ নিয়ে। কোনো বর্ণনায় এসেছে, ...যদিও গোনাহ সমুদ্রের ফেনা পরিমাণ হয়।

সমুদ্রের ফেনা কী পরিমাণ হয়? সমুদ্র যত বিশাল এর ফেনার পরিমাণও তেমন পরিমাপের ঊর্ধ্বে। কে পারে সমুদ্রের ফেনারাশি পরিমাপ করতে। তার অর্থ, বান্দা যত গোনাহ নিয়েই তাওবার দরজায় ধরনা দিক না কেন, আল্লাহ মাফ করে দিবেন।

সামনে আমরা কিছু আমলের কথা উল্লেখ করব, যেসবের ফযীলতে বলা হয়েছে- আল্লাহ মাফ করে দিবেন, যদিও গোনাহ সমুদ্রের ফেনা পরিমাণ হয়।

১. নামাযের পর ৩৩ বার...এবং

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

مَنْ سَبّحَ اللهَ فِي دُبُرِ كُلِّ صَلَاةٍ ثَلَاثًا وَثَلَاثِينَ، وَحَمِدَ اللهَ ثَلَاثًا وَثَلَاثِينَ، وَكَبّرَ اللهَ ثَلَاثًا وَثَلَاثِينَ، فَتلِكَ تِسْعَةٌ وَتِسْعُونَ، وَقَالَ: تَمَامَ الْمِائَةِ: لَا إِلَهَ إِلّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ غُفِرَتْ خَطَايَاهُ وَإِنْ كَانَتْ مِثْلَ زَبَدِ الْبَحْرِ.

যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরয নামাযের পর তেত্রিশবার সুবহানাল্লাহ, তেত্রিশবার আলহামদু লিল্লাহ ও তেত্রিশবার আল্লাহু আকবার, বলবে। এই হল নিরানব্বই। এরপর একশ পূরণ করবে এই বলে-

لَا إِلهَ إِلّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ.

তার গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে, যদিও তা সমুদ্রের ফেনা বরাবর হয়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫৯৭

২. দিনে ১০০ বার সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

مَنْقَالَ: سُبْحَانَاللهِوَبِحَمْدِهِ،فِييَوْمٍمِائَةَمَرّةٍ،حُطّتْخَطَايَاهُ،وَإِنْكَانَتْمِثْلَزَبَدِالبَحْرِ.

যে ব্যক্তি দিনে একশত বার-

سُبْحَانَاللهِوَبِحَمْدِهِ (সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী) বলবে। তার পাপসমূহ মিটে যাবে যদিও তা সমুদ্রের ফেনা বরাবর হয়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪০৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৯১

৩. ফজর নামাযের পর তাসবীহ ও তাহলীল ১০০ বার

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

مَنْ سَبّحَ فِي دُبُرِ صَلَاةِ الْغَدَاةِ مِائَةَ تَسْبِيحَةٍ، وَهَلّلَ مِائَةَ تَهْلِيلَةٍ، غُفِرَتْ لَهُ ذُنُوبُهُ، وَلَوْ كَانَتْ مِثْلَ زَبَدِ الْبَحْر.

যে ব্যক্তি ফজর নামাযের পর একশ বার সুবহানাল্লাহ এবং একশ বার লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ বলবে, তার গোনাহগুলো মাফ করে দেওয়া হবে, যদিও তা সমুদ্রের ফেনা বরাবর হয়। -সুনানে নাসায়ী, হাদীস ১৩৫৪

৪. যে এই দুআ পড়বে...

আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

مَا عَلَى الأَرْضِ أَحَدٌ يَقُولُ: لَا إِلَهَ إِلّا اللهُ وَاللهُ أَكْبَرُ وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوّةَ إِلّا بِاللهِ، إِلّا كُفِّرَتْ عَنْهُ خَطَايَاهُ وَلَوْ كَانَتْ مِثْلَ زَبَدِ البَحْرِ.

যে ব্যক্তিই এই দুআ পড়বে-

لَا إِلهَ إِلّا اللهُ وَاللهُ أَكْبَرُ وَلَا حَوْلَ وَلَا قُوّةَ إِلّا بِاللهِ.

তার পাপগুলো মিটে যাবে, যদিও তা সমুদ্রের ফেনা পরিমাণ হয়। -জামে তিরমিযী, হাদসি ৩৪৬০



সদাকা : গোনাহের আগুন নিভিয়ে দেয়

কোনো মানুষই পৃথিবীতে সম্পদ নিয়ে আসে না; আসে খালি হাতে। অতপর আল্লাহ অনুগ্রহ করে সম্পদ দান করেন। সুতরাং আমার যত সম্পদ সব আল্লাহর দান। এ থেকে আমি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য খরচ করব- এতে আবার সংকোচ কীসের! সূরা বাকারার শুরুতে আল্লাহ মুত্তাকীদের কিছু গুণ বলেছেন, তার মধ্যে-

وَ مِمَّا رَزَقْنٰهُمْ یُنْفِقُوْنَ.

এবং আমি তাদেরকে যা কিছু দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে। [সূরা বাকারা (২) : ২]

সুতরাং আল্লাহর দেওয়া সম্পদ আল্লাহর জন্য ব্যয় করতে কোনো সংকোচ-কার্পণ্য নেই।

আবার তাঁর দেওয়া সম্পদ থেকে দান-সদকা করলে তিনি খুশি হন এবং মাফ করেন-

إِنْ تُبْدُوا الصَّدَقَاتِ فَنِعِمَّا هِيَ وَإِنْ تُخْفُوهَا وَتُؤْتُوهَا الْفُقَرَاءَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ وَيُكَفِّرُ عَنْكُمْ مِنْ سَيِّئَاتِكُمْ وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ .

তোমরা যদি প্রকাশ্যে দান কর তবে তা ভালো। আর যদি গোপনে কর এবং অভাবগ্রস্তকে দাও তা তোমাদের জন্য আরো ভালো। এবং তিনি তোমাদের কিছু পাপ মোচন করবেন। তোমরা যা কর আল্লাহ তা সম্যক অবহিত। -সূরা বাকারা (২) : ২৭১

আর সদাকা শুধু পাপ মোচনই করে না; পাপের আগুন একেবারে নিভিয়ে দেয়, যেমন পানি দাউদাউ আগুন নিভিয়ে দেয়। এক দীর্ঘ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রিয় সাহাবী মুআয ইবনে জাবাল রা.-কে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন-

...وَالصّدَقَةُ تُطْفِئُ الخَطِيئَةَ كَمَا يُطْفِئُ المَاءُ النّارَ.

...আর সদাকা পাপ (নিভিয়ে দেয়) মোচন করে, যেমন পানি আগুন নিভিয়ে দেয়। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৬১৬



১০০ নকী লাভ ১০০ গোনাহ মাফ

বিভিন্ন দুআর মাধ্যমে আল্লাহ গোনাহ মাফ করেন। তার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য দুআ এ শিরোনামের অধীনে উল্লেখ করব। এর দ্বারা শুধু যে নেকী লাভ আর গোনাহ মাফ হয় তা নয়, বরং এর দ্বারা ব্যক্তি সারাদিন শয়তান থেকে হেফাযতে থাকবে এবং শ্রেষ্ঠ আমলকারী বলে গণ্য হবে। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

مَنْ قَالَ: لاَ إِلَهَ إِلّا اللهُ، وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ، لَهُ المُلْكُ وَلَهُ الحَمْدُ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ، فِي يَوْمٍ مِائَةَ مَرّةٍ، كَانَتْ لَهُ عَدْلَ عَشْرِ رِقَابٍ، وَكُتِبَتْ لَهُ مِائَةُ حَسَنَةٍ، وَمُحِيَتْ عَنْهُ مِائَةُ سَيِّئَةٍ، وَكَانَتْ لَهُ حِرْزًا مِنَ الشّيْطَانِ يَوْمَهُ ذَلِكَ حَتّى يُمْسِيَ، وَلَمْ يَأْتِ أَحَدٌ بِأَفْضَلَ مِمّا جَاءَ بِهِ، إِلّا أَحَدٌ عَمِلَ أَكْثَرَ مِنْ ذَلِكَ.

যে ব্যক্তি দিনে একশ বার এই দুআ পড়বে-

لاَإِلَهَإِلّااللهُ،وَحْدَهُلاَشَرِيكَلَهُ،لَهُالمُلْكُوَلَهُالحَمْدُ،وَهُوَعَلَىكُلِّشَيْءٍقَدِيرٌ.

তার আমলনামায় দশটি গোলাম আযাদ করার সওয়াব লেখা হবে। একশ নেকী লেখা হবে এবং একশ গোনাহ মিটিয়ে দেওয়া হবে। আর সে ঐ দিনের সন্ধ্যা পর্যন্ত শয়তান থেকে হেফাযতে থাকবে। (যে ব্যক্তি এই আমল করল) তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ আমল আর কেউ করেনি; তবে ঐ ব্যক্তি, যে তার মতো বা তার চেয়ে বেশি আমল করেছে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩২৯৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৯১ হ

নবীজীর উপর দরূদ পাঠ : মর্যাদা বৃদ্ধি করে গোনাহ মাফ করে

নবীজীর উপর দরূদ পাঠ- এটি উম্মতের উপর নবীজীর সাধারণ হক। যাঁর মাধ্যমে হেদায়েতের আলো পেলাম, যাঁর মাধ্যমে সকল অন্ধকার থেকে মুক্তি পেলাম তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ভালবাসা তো সাধারণ দাবি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই হক্ব আদায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হচ্ছে দরুদ পাঠ।

আল্লাহ তাআলা মুমিনদের নির্দেশ দিয়েছেন- তাঁর উপর দরূদ পাঠ করতে। এমনকি একদল ফিরিশতা নিযুক্ত আছে, উম্মতের দরূদ নবীজী পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য। দুআর আগে-পড়ে দরূদ পাঠ করলে সে দুআ কবুল হয়। তাছাড়া অধিক দরূদ পাঠ আখেরাতে নবীজীর সান্নিধ্য পাওয়ার একটি বড় মাধ্যম। জুমার দিন অধিকহারে দরূদ পাঠের ব্যাপারে হাদীসে উৎসাহিত করা হয়েছে।

দরূদ পাঠের মাধ্যমে আল্লাহর রহমত লাভ হয়, মর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং গোনাহ মাফ হয়। আনাস ইবনে মালেক রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

مَنْ صَلّى عَلَيّ صَلَاةً وَاحِدَةً صَلّى اللهُ عَلَيْهِ عَشْرَ صَلَوَاتٍ، وَحُطّتْ عَنْهُ عَشْرُ خَطِيئَاتٍ، وَرُفِعَتْ لَهُ عَشْرُ دَرَجَاتٍ.

যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরূদ পাঠ করবে আল্লাহ তার প্রতি দশটি রহমত নাযিল করবেন। তার দশটি গোনাহ মাফ করে দিবেন এবং দশটি মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন। -সুনানে নাসায়ী, হাদীস ১২৯৭

শুধু তাই নয়, দরূদ পাঠের মাধ্যমে বান্দার দুনিয়ার ফায়েদাও রয়েছে। দুনিয়ার চিন্তা-পেরেশানীও দূর হয়।

এক হাদীসে এসেছে, এক সাহাবী দুআর মধ্যে বেশি বেশি দরূদ পাঠ সম্পর্কে নবীজীকে জিজ্ঞাসা করলেন; আমার দুআর কতটুকু অংশ দরূদ পাঠ করব? একপর্যায়ে সাহাবী বললেন, আমি আমার পুরো দুআতেই দরূদ পাঠ করব। তখন নবীজী বললেন-

إِذًا تُكْفَى هَمّكَ، وَيُغْفَرُ لَكَ ذَنْبُكَ.

তাহলে তো তোমার চিন্তা-পেরেশানী দূর হবে এবং গোনাহ মাফ হবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৪৫৭

একহাজার নেকী লাভ একহাজার গোনাহ মাফ

প্রতিদিন এক হাজার নেকী লাভ হওয়া এবং এক হাজার গোনাহ মাফ হওয়ার সৌভাগ্য কে হাতছাড়া করতে চায়! তাও আবার যদি হয় সহজ কোনো আমলের দ্বারা। তাই তো নবীজী এ আমলের ফযীলত উপস্থাপনই করলেন একটু ভিন্ন আঙ্গিকে। তিনি বললেন-

أَيَعْجِزُ أَحَدُكُمْ أَنْ يَكْسِبَ كُلّ يَوْمٍ أَلْفَ حَسَنَةٍ؟

তোমাদের জন্য কি প্রতিদিন এক হাজার নেকী লাভ করা কঠিন কিছু?

তখন এক সাহাবী বললেন, আল্লাহর রাসূল! কী করলে এক হাজার নেকী লাভ করা যাবে? তখন নবীজী বললেন-

يُسَبِّحُ مِائَةَ تَسْبِيحَةٍ، فَيُكْتَبُ لَهُ أَلْفُ حَسَنَةٍ، أَوْ يُحَطّ عَنْهُ أَلْفُ خَطِيئَةٍ.

একশ বার সুবহানাল্লাহ বললে এক হাজার নেকী লেখা হবে অথবা (কোনো কোনো বর্ণনায় রয়েছে- এবং) এক হাজার গোনাহ মোচন হবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৯৮ ; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৮২৫; মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস ৭২৩



ফজর ও মাগরিবের পর যে এই দুআ পড়বে...

সকাল-সন্ধ্যার বিভিন্ন দুআর মধ্যে এই দুআটি উল্লেখযোগ্য-

لَا إِلَهَ إِلّا اللهُ، وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ، وَهُوَ عَلى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ.

হাদীস শরীফে এসেছে-

مَنْ قَالَ إِذَا صَلّى الصّبْحَ: لَا إِلَهَ إِلّا اللهُ، وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ عَشْرَ مَرّاتٍ، كُنّ كَعَدْلِ أَرْبَعِ رِقَابٍ، وَكُتِبَ لَهُ بِهِنّ عَشْرُ حَسَنَاتٍ، وَمُحِيَ عَنْهُ بِهِنّ عَشْرُ سَيِّئَاتٍ، وَرُفِعَ لَهُ بِهِنّ عَشْرُ دَرَجَاتٍ، وَكُنّ لَهُ حَرَسًا مِنَ الشّيْطَانِ حَتّى يُمْسِيَ، وَإِذَا قَالَهَا بَعْدَ الْمَغْرِبِ فَمِثْلُ ذَلِكَ.

যে ব্যক্তি ফজরের নামাযের পর দশ বার পড়বে- ...لَا إِلَهَ إِلّا اللهُ। এর বিনিময়ে তার আমলনামায় চারজন গোলাম আযাদ করার সওয়াব লেখা হবে, দশটি নেকী লেখা হবে, দশটি গোনাহ মাফ হবে, দশটি মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে এবং এ কালিমাগুলো সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য শয়তান থেকে হেফাজতের কারণ হবে।

তেমনি মাগরিবের পর পড়লে অনুরূপ সওয়াব মিলবে এবং সকাল পর্যন্ত শয়তান থেকে হেফাজতে থাকবে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৩৫১৮

কোনো কোনো বর্ণনায় দুআটিতেيُحْيِي وَيُمِيتُ শব্দ রয়েছে-

لَا إِلَهَ إِلّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ المُلْكُ وَلَهُ الحَمْدُ، يُحْيِي وَيُمِيتُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ.

(দ্র. জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৫৩৪)

আর দুআটি কখন পড়তে হবে- এ ব্যাপারে কোনো বর্ণনায় রয়েছে, নামাযের বৈঠক থেকে ওঠার পূর্বে, কোনো কথা বলার আগেই পড়বে। কোনো বর্ণনায় শুধু নামাযের পর পড়ার কথা এসেছে। (দ্র. জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৫৩৪, ৩৪৭৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৭৯৯০)

আবার ফযীলতের বিষয়ে কোনো বর্ণনায় এসেছে-

كُتِبَ لَهُ بِهَا مِائَةُ حَسَنَةٍ، وَمُحِيَ عَنْهُ بِهَا مِائَةُ سَيِّئَةٍ، وَكَانَتْ لَهُ عَدْلَ رَقَبَةٍ.

...তার আমলনামায় একশ নেকী লেখা হবে, একশ গোনাহ মাফ হবে এবং একজন গোলাম আযাদ করার সওয়াব পাবে। (দ্র. মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৮৭১৯)

কোনো বর্ণনায় আছে, ইসমাঈল আ.-এর বংশধরের একজন গোলাম আযাদ করার সওয়াব পাওয়া যাবে। কোনো বর্ণনায় এসেছে, দশজন গোলাম আযাদের সওয়াব পাওয়া যাবে। (দ্র. সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫০৭৭; জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৫৩৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৩৫৬৮)

যাইহোক, আমাদের আলোচ্য বিষয় হল, ফজর ও মাগরিবের পর এই দুআর আমলের মাধ্যমে আল্লাহ বান্দার গোনাহ মাফ করেন।

যে আমল গোনাহকে পাল্টে দেয় নেকীতে

নেক আমল দ্বারা আল্লাহ বান্দার গোনাহ তো মাফ করেনই; কিন্তু কোনো কোনো নেক আমল দ্বারা গোনাহমাফির সাথে সাথে আল্লাহ গোনাহগুলোকে নেকী দ্বারা পরিবর্তিতও করে দেন।

যখন কিছু মানুষ একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়ে আল্লাহর যিকির করে- তাঁর বড়ত্ব ও মহত্ব বর্ণনা করে, তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা করে, প্রশংসা করে, আল্লাহর মহিমা সম্পর্কে আলোচনা করে, তাঁর নিআমতের আলোচনা করে, দুআ-ইসতিগফার করে, তাঁর সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা ও চিন্তা-ফিকির করে, কুরআন তিলাওয়াত করে, কুরআনের ইলম নিয়ে মুযাকারা করে, দ্বীনী আলোচনা করে, দ্বীনী ইলমের চর্চা করে তখন আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হন এবং মাফ করে দেন। শুধু মাফ করেই দেন না, তাদের গোনাহগুলো নেকী দ্বারা পরিবর্তিত করে দেন।

হাদীসের ভাষ্যমতে এ ধরনের মজলিশের ব্যাপারে হাদীসের এই বাণী প্রযোজ্য হয় যে, তাদের উদ্দেশে আসমান থেকে একজন ঘোষক ঘোষণা করতে থাকেন-

قُومُوا مَغْفُورًا لَكُمْ، قَدْ بُدِّلَتْ سَيِّئَاتُكُمْ حَسَنَاتٍ.

যাও, তোমরা ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়েছ আর তোমাদের গোনাহগুলো নেকী দ্বারা পরিবর্তিত করে দেওয়া হয়েছে। (দ্র. মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১২৪৫৩; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৫৩০; মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস ৪১৪১)



যে ব্যক্তি এই বাক্য দ্বারা ইসতিগফার করবে...

শয়তানের প্রতিজ্ঞা- বনী আদমকে সে গোনাহে লিপ্ত করেই ছাড়বে। কিন্তু তাতে কী আসে যায়- আল্লাহ তো বনী আদমকে ইসতিগফারের হাতিয়ার দিয়েছেন। বান্দা দিল থেকে ক্ষমা চাওয়ার সাথে সাথেই আল্লাহ মাফ করে দিবেন আর শয়তানের সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবে।

একটি হাদীসে নবীজী বলেছেন-

إِنّ الشّيْطَانَ قَالَ: وَعِزّتِكَ يَا رَبِّ، لَا أَبْرَحُ أُغْوِي عِبَادَكَ مَا دَامَتْ أَرْوَاحُهُمْ فِي أَجْسَادِهِمْ، قَالَ الرّبّ: وَعِزّتِي وَجَلَالِي لَا أَزَالُ أَغْفِرُ لَهُمْ مَا اسْتَغْفَرُونِي.

শয়তান বলল, হে রব! আপনার ইযযতের কসম! আপনার বান্দাদেরকে আমি পথভ্রষ্ট করতেই থাকব যতক্ষণ তাদের দেহে প্রাণ থাকবে। তখন আল্লাহ বললেন, আমার ইযযত ও জালালের কসম! আমিও তাদের ক্ষমা করতে থাকব যতক্ষণ তারা ইসতিগফার করতে থাকবে-ক্ষমা চাইতে থাকবে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১১২৩৭

হাদীস শরীফে ইসতিগফারের বিভিন্ন বাক্য বর্ণিত হয়েছে। এর মধ্যে একটি ইসতিগফারের ব্যাপারে এসেছে-

مَنْ قَالَ أَسْتَغْفِرُ اللهَ الّذِي لَا إِلٰهَ إِلّا هُوَ الحَيّ القَيّومُ وَأَتُوبُ إِلَيْهِ، غُفِرَ لَهُ وَإِنْ كَانَ فَرّ مِنْ الزّحْفِ.

যে ব্যক্তি বলবে-

أَسْتَغْفِرُ اللهَ الّذِي لَا إِلٰهَ إِلّا هُوَ الحَيّ القَيّومُ وَأَتُوبُ إِلَيْهِ.

তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে, যদিও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৫৭৭; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৫১৭

আরেক হাদীসে ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

مَنْ قَالَ أَسْتَغْفِرُ اللهَ الّذِي لَا إِلٰهَ إِلّا هُوَ الْحَيّ الْقَيّومُ، وَأَتُوبُ إِلَيْهِ، ثَلَاثًا غُفِرَتْ ذُنُوبُهُ، وَإِنْ كَانَ فَارّا مِنَ الزّحْفِ.

যে ব্যক্তি তিনবার বলবে-

أَسْتَغْفِرُ اللهَ الّذِي لَا إِلٰهَ إِلّا هُوَ الْحَيّ الْقَيّومُ، وَأَتُوبُ إِلَيْهِ.

তার পাপসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে, যদিও সে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়নকারী হয়। -মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ২৫৫০



থাক বার্ধক্যের সাদা চুল : গোনাহ মাফ হোক

প্রতিটি মানুষই চায়- চির যুবক থাকতে। কিন্তু তা তো আর সম্ভব না এই দুনিয়াতে। একটু বয়স বাড়ার সাথে সাথেই ভাটা পড়ে যৌবনে। উকিঝুঁকি দেয় বার্ধক্য। সর্বপ্রথম বার্ধক্যের যে আলামত প্রকাশিত হয় তা হল, চুল পাকা। দু-একটি করে চুল সাদা হতে থাকে। এ যেন বার্ধক্যের ‘হোয়াইট সিগনাল’- আসছে বার্ধক্য; প্রস্তুত হও...!

এতদিনের যুবক তখন আগত বার্ধক্য মানতে চায় না; স্বীকার করতে চায় না- সে বার্ধক্যে পা রাখতে চলেছে। তখন সে চেষ্টা করে আড়াল করতে; সাদা চুল কালো করে কিংবা সমুলে উপড়ে ফেলে। কিন্তু কী লাভ তাতে! বার্ধক্য তো আর বাধাপ্রাপ্ত হয় না এতে।

যাইহোক, মুসলিমের এতে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। মুসলিম বাস্তবতাকে মেনে নেবে এবং আখেরাতের প্রস্তুতিতে মনোযোগ দেবে। আগত বার্ধক্যের সাদা চুলের উপর সবর করবে এবং সওয়াবের আশা রাখবে। এ চুল উপড়ে ফেলবে না।

কারণ, সে নবীজীর হাদীস শুনেছে-

نَهَى رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ عَنْ نَتْفِ الشّيْبِ، وَقَالَ: هُوَ نُورُ الْمُؤْمِنِ.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বার্ধক্যের সাদা চুল উপড়ে ফেলতে নিষেধ করেছেন। এবং বলেছেন- এ হল ‘মুমিনের নূর’। (মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৬৯৩৭)

নূর বলতে- কিয়ামতের দিন তা নূর হবে, যেদিন নূরের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আমর ইবনে আবাসা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

مَنْ شَابَ شَيْبَةً فِي الإِسْلَامِ كَانَتْ لَهُ نُورًا يَوْمَ القِيَامَةِ.

মুসলিম অবস্থায় যার কোনো চুল বা দাড়ি পাকবে, কিয়ামতের দিন তা ঐ ব্যক্তির জন্য নূর হবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৬৩৪

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো ইরশাদ করেছেন-

مَا شَابَ رَجُلٌ فِي الْإِسْلَامِ شَيْبَةً، إِلّا رَفَعَهُ اللهُ بِهَا دَرَجَةً، وَمُحِيَتْ عَنْهُ بِهَا سَيِّئَةٌ، وَكُتِبَتْ لَهُ بِهَا حَسَنَةٌ.

যখন কোনো মুসলিমের চুল বা দাড়ি পাকে তখন আল্লাহ এর বিনিময়ে একটি মর্যাদা বৃদ্ধি করেন, একটি গোনাহ মাফ করা হয় এবং একটি নেকী লেখা হয়। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৬৯৩৭; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪২০২

অসুস্থতা : গোনাহমাফির কারণ

সুস্থতা-অসুস্থতা মিলেই মানুষের জীবন। সুস্থতা যেমন নিআমত তেমনি অসুস্থতাও গোনাহমাফির কারণ। ফলে অসুস্থতায় মুমিনের কষ্ট হয় ঠিকই কিন্তু সে সবর করে, গোনাহমাফির আশা রাখে। নিরাময়ের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করে এবং সবর করে; সে ভেঙে পড়ে না, হা-হুতাশ, অর্থহীন অভিযোগ বা অনুচিত মন্তব্য করে না।

সে জানে, যিনি রোগ দেন তিনিই আরোগ্য দান করেন-

وَ اِذَا مَرِضْتُ فَهُوَ یَشْفِیْنِ.

এবং রোগাক্রান্ত হলে তিনিই আমাকে আরোগ্য দান করেন। -সূরা শুআরা (২৬) : ৮০

ফলে তাঁর কাছেই আরোগ্য লাভের জন্য দুআ করতে থাকে এবং সবর করে। আর গোনাহ মাফ হওয়ার আশ্বাস-বাণী ধৈর্যধারণে আরো বড় সহায়ক হয়। সে তো নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বাণী শুনেছে-

الْمَرِيضُ تَحَاتّ خَطَايَاهُ كَمَا يَتَحَاتّ وَرَقُ الشّجَرِ.

অসুস্থ ব্যক্তির গোনাহগুলো ঝরে যায়, যেমন (শীতকালে) গাছের পাতা ঝরে পড়ে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৬৬৫৪

আরেক হাদীসে ইরশাদ হয়েছে-

مَا مِنْ مُسْلِمٍ يُصِيبُهُ أَذًى مِنْ مَرَضٍ، فَمَا سِوَاهُ إِلّا حَطّ اللهُ بِهِ سَيِّئَاتِهِ، كَمَا تَحُطّ الشّجَرَةُ وَرَقَهَا.

কোনো মুসলিম যখন অসুস্থতা বা অন্য কোনো কষ্টে নিপতিত হয় আল্লাহ তার গোনাহগুলো মিটিয়ে (ঝরিয়ে) দেন, যেমন (শীতকালে) গাছ তার পাতা ঝরায়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৭১

শুধু গোনাহমাফিই নয়, মুমিনের নেকীর খাতাও সমৃদ্ধ হতে থাকে অসুস্থ অবস্থায়; যাতে আফসোস করতে না হয়- অসুস্থতার কারণে আমি কত নেক আমল থেকে বঞ্চিত হচ্ছি, সুস্থ থাকলে তো আমি তাহাজ্জুদ-তিলাওয়াতসহ অন্যান্য নেক আমল করতে পারতাম। এখন তো কিছুই করতে পারছি না।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে সান্ত¦না বাণী শুনিয়েছেন-

إِذَا مَرِضَ العَبْدُ، أَوْ سَافَرَ، كُتِبَ لَهُ مِثْلُ مَا كَانَ يَعْمَلُ مُقِيمًا صَحِيحًا.

যখন বান্দা অসুস্থ হয় বা সফরে থাকে তখন সুস্থ অবস্থায় বা বাড়িতে থাকা অবস্থায় সে যে নেক আমল করত তার সওয়াব লেখা হতে থাকে (যদিও অসুস্থতা বা সফরের কারণে সে উক্ত নেক আমলগুলো করতে পারছে না)। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৯৯৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৬৬৭৯



জ্বরের আগুন গোনাহ জ্বালিয়ে দেয়

সব ধরনের অসুস্থতার কারণেই গোনাহ মাফ হয়। এর মধ্য থেকে ‘জ্বর’ বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে। কারণ, সব রোগ সকলের হয় না, কিন্তু জ্বরে আক্রান্ত হয়নি এমন মানুষ হয়ত পাওয়াই যাবে না।

জ্বর এমন রোগ, যাতে মানুষ একেবারে কাবু হয়ে যায়। কখনো কখনো মৃত্যুর প্রহরও গুনতে থাকে।

একবার নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসুস্থ উম্মুস সায়েব বা (তার নাম ছিল) উম্মুল মুসায়্যিবকে দেখতে গেলেন। তখন তিনি জ্বরে কাঁপছিলেন। নবীজী বললেন, তুমি কাঁপছো কেন? তিনি বললেন, আল্লাহর রাসূল! জ্বর এসেছে। এবং বললেন, ‘লা- বারাকাল্লাহু ফী-হা’ অর্থাৎ সে জ্বরের জন্য বদদুআ করল। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-

لَا تَسُبِّي الْحُمّى، فَإِنّهَا تُذْهِبُ خَطَايَا بَنِي آدَمَ، كَمَا يُذْهِبُ الْكِيرُ خَبَثَ الْحَدِيدِ.

(বদদুআর মাধ্যমে) জ্বরকে গালি দিয়ো না। কারণ, তা বনী আদমের গোনাহগুলো মিটিয়ে দেয়, যেমন কামারের হাপর লোহার জং দূর করে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৭৫; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ২৯৩৮; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৯৩৭৯



মুআযযিনের গোনাহ মাফ : আওয়ায যতদূর যায়...

মুআযযিন। যিনি প্রতিদিন মিনার থেকে আল্লাহু আকবার ধ্বনির মাধ্যমে আমাদের আল্লাহর ঘরে ডাকেন। প্রতিদিন পাঁচবার যাঁর মুখে আকাশে-বাতাসে, মাঠ-পাথারে তাওহীদ ও রিসালাতের ধ্বনি গুঞ্জরিত হয়। প্রতিদিন যিনি আমাদের ‘হাইয়া আলাস সালাহ-হাইয়া আলাল ফালাহ’ বলে নামাযের দিকে ডাকেন, চির কল্যাণের দিকে আহ্বান করেন। যিনি সায়্যেদুনা বিলালের উত্তরসূরি, যিনি বিলালের আল্লাহু আকবার ধ্বনির মহান ওয়ারিস।

যিনি দুনিয়াতে আল্লাহর নাম সমুন্নত করেছেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার মর্যাদা সমুন্নত করবেন; তার গর্দান থাকবে সবার উপরে। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-

الْمُؤَذِّنُونَ أَطْوَلُ النّاسِ أَعْنَاقًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ.

কিয়ামতের দিন মুআযযিনদের গর্দান হবে সবার চেয়ে লম্বা, সবার উপরে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩৩৭

শুধু তাই নয়। মুআযযিনকে আল্লাহ মাফ করে দিবেন এবং তার আযানের ধ্বনি যতদূর পর্যন্ত যাবে ততদূর পর্যন্ত প্রতিটি জীব-জড় তার জন্য সাক্ষী হবে। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

الْمُؤَذِّنُ يُغْفَرُ لَهُ بِمَدِّ صَوْتِهِ وَيَشْهَدُ لَهُ كُلّ رَطْبٍ وَيَابِسٍ.

মুআযযিনের আওয়ায যতদূর যাবে মুআযযিনকে সে অনুপাতে ক্ষমা করা হবে। এবং (তার আওয়ায যতদূর পর্যন্ত পৌঁছবে ততদূর সকল) জীব ও জড় তার পক্ষে সাক্ষী দেবে। -সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৬৪৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫১৫; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৭২৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৯৩২৮



যে আমল ঋণ ছাড়া সব গোনাহ মিটিয়ে দেয়

আল্লাহর দেয়া এ জীবন একমাত্র তাঁর সন্তুষ্টির জন্য বিলিয়ে দেয়া জীবনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আমল। শাহাদাতের তামান্না প্রতিটি মুমিনেরই ঈমানী সম্বল। সাহাবায়ে কেরাম এর জীবন্ত নমুনা। স্বয়ং নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাহাদাতের তামান্না হাদীসে বর্ণিত হয়েছে এভাবে-

وَالّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَوَدِدْتُ أَنِّي أُقْتَلُ فِي سَبِيلِ اللهِ، ثُمّ أُحْيَا، ثُمّ أُقْتَلُ، ثُمّ أُحْيَا، ثُمّ أُقْتَلُ، ثُمّ أُحْيَا، ثُمّ أُقْتَلُ.

যে সত্তার হাতে আমার প্রাণ, তাঁর কসম! আমার আকাক্সক্ষা হয়- আমি আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হব। তারপর আবার আমাকে জীবিত করা হবে, আমি আবার শহীদ হব। আবার আমাকে জীবিত করা হবে, আমি আবার শহীদ হব। আবার আমাকে জীবিত করা হবে, তারপর আমি আবার শহীদ হব। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৭৯৭

মুমিন মাত্রই শাহাদাতের তামান্না রাখে। কারণ, শাহাদাতের তামান্না না থাকা নিফাকের আলামত। আর আল্লাহর রাস্তায় শাহাদাতের মাধ্যমে আল্লাহ বান্দার সব গোনাহ মিটিয়ে দেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. থেকে বর্ণিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

الْقَتْلُ فِي سَبِيلِ اللهِ يُكَفِّرُ كُلّ شَيْءٍ، إِلّا الدّيْنَ.

আল্লাহর রাস্তায় শাহাদাত সকল গোনাহ মিটিয়ে দেয়, তবে ঋণ ছাড়া। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৮৮৬

আরেক বর্ণনায় এসেছে-

يُغْفَرُ لِلشّهِيدِ كُلّ ذَنْبٍ إِلّا الدّيْنَ.

শহীদের সকল গোনাহ ক্ষমা করা হবে, তবে ঋণ ছাড়া। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৮৮৬

এখানে একটি বিষয় বিশেষ লক্ষ্যণীয়। ঋণ কত গুরুতর বিষয় যে, শহীদের সব গোনাহ মাফ করে দেওয়া হবে, কিন্তু ঋণ মাফ করা হবে না। একটি বর্ণনায় বিষয়টি এভাবে উপস্থাপিত হয়েছে-

عَنْ أَنَسٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: القَتْلُ فِي سَبِيلِ اللهِ يُكَفِّرُ كُلّ خَطِيئَةٍ، فَقَالَ جِبْرِيلُ: إِلّا الدّيْنَ، فَقَالَ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: إِلّا الدّيْنَ.

আনাস রা. বর্ণনা করেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-

القَتْلُ فِي سَبِيلِ اللهِ يُكَفِّرُ كُلّ خَطِيئَةٍ.

আল্লাহর রাস্তায় শাহাদাত সকল গোনাহ মিটিয়ে দেয়।

তখন জিবরীল আলাইহিস সালাম বললেন-

إِلّا الدّيْنَ.

তবে ঋণ ছাড়া।

তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও বললেন-

إِلّا الدّيْنَ.

তবে ঋণ ছাড়া। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৬৪০

প্রথমে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম إِلّا الدّيْنَ এ অংশ বলেননি, ফলে জিবরীল আ. সতর্ক করলেন এবং এ অংশ যুক্ত করে দিলেন। ঋণ কত গুরুতর বিষয় তা উপলব্ধি করার জন্য এ একটি বর্ণনা-ই যথেষ্ট।

আল্লাহ আমাদের ঋণসহ সব ধরনের বান্দার হক থেকে হেফাজত করুন, ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা করে দিন এবং শাহাদাতের মৃত্যু নসীব করুন- আমীন।



সুবহানাল্লাহ, আলহামদু লিল্লাহ... : গাছের পাতার মত গোনাহ ঝরিয়ে দেয়

বাক্য বলে যা কিছু আছে, এর মধ্য থেকে আল্লাহ তাআলা চারটি বাক্য নির্বাচন করেছেন; যে চারটি বাক্য আল্লাহ তাআলার কাছে অতি প্রিয়।

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

إِنّ اللهَ اصْطَفَى مِنَ الْكَلَامِ أَرْبَعًا: سُبْحَانَ اللهِ، وَالْحَمْدُ لِلهِ، وَلَا إِلهَ إِلّا اللهُ، وَاللهُ أَكْبَرُ.

আল্লাহ তাআলা চারটি বাক্য নির্বাচন করেছেন- সুবহানাল্লাহ, আলহামদু লিল্লাহ, লা-ইলা-হা ইল্লাল্লাহ ও আল্লাহু আকবার। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৮০১২

এ চারটি বাক্যের দ্বারা আমরা আল্লাহ তাআলার পবিত্রতা বর্ণনা করি, তাঁর প্রশংসা করি, তাঁর একত্ববাদের স্বীকারোক্তি দিই এবং তাঁর বড়ত্ব বর্ণনা করি।

এ চারটি বাক্য বনী আদমের গোনাহগুলো ঝরিয়ে দেয় যেমন শীতকালে গাছের পাতা ঝরে যায়।

আনাস রা. থেকে বর্ণিত, একবার নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গাছের একটি ডাল ধরে ঝাঁকি দিলেন, কোনো পাতা পড়ল না। আবার ঝাঁকি দিলেন, এবারও কোনো পাতা পড়ল না। তৃতীয়বার ঝাঁকি দেওয়ার পর পাতা ঝরল। তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-

إِنَّ سُبْحَانَ اللهِ، وَالْحَمْدُ لِلهِ، وَلَا إِلهَ إِلّا اللهُ، وَاللهُ أَكْبَرُ، تَنْفُضُ الْخَطَايَا كَمَا تَنْفُضُ الشّجَرَةُ وَرَقَهَا.

নিশ্চয় সুবহানাল্লাহ, আলহামদু লিল্লাহ, লা- ইলা-হা ইল্লাহ ও আল্লাহু আকবার বলা- বান্দার গোনাহ ঝরিয়ে দেয়, যেমন (শীতকালে) গাছ তার পাতা ঝরায়। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১২৫৩৪



পুনশ্চ :

এই প্রবন্ধের জুমাদাল উলা ১৪৪০/ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সংখ্যায় ‘আযান শুনে যে বলবে...’ শিরোনামের অধীনে লেখা হয়েছে-

“সা‘দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

مَنْ قَالَ حِينَ يَسْمَعُ الْمُؤَذِّنَ أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلهَ إِلّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، وَأَنّ مُحَمّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، رَضِيتُ بِاللهِ رَبّا وَبِمُحَمّدٍ رَسُولًا، وَبِالْإِسْلَامِ دِينًا، غُفِرَ لَهُ ذَنْبُهُ.

আযান শুনে যে ব্যক্তি বলবে-

أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلهَ إِلّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، وَأَنّ مُحَمّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ.

رَضِيتُ بِاللهِ رَبّا، وَبِمُحَمّدٍ رَسُولًا، وَبِالْإِسْلَامِ دِينًا.

(আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। তিনি এক, তাঁর কোনো শরীক নেই। এবং আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল।

আমি আল্লাহকে রব হিসাবে পেয়ে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবী হিসাবে পেয়ে এবং ইসলামকে দ্বীন হিসাবে পেয়ে সন্তুষ্ট।) তার গোনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩৮৬”

এখানের তরজমা ও উপস্থাপন থেকে মনে হচ্ছে, এ দুআটি আযান শেষে পড়া হবে। হাঁ, এ দুআটি আযানের শেষে পড়তেও কোনো আপত্তি নেই। একাধিক হাদীস ব্যাখ্যাকার কোনো কোনো রেওয়ায়েতের ইঙ্গিত থেকে এমনই বুঝেছেন। তবে সহীহ ইবনে খুযায়মা এবং তহাবী শরীফের বর্ণনায় স্পষ্টভাবে এসেছে যে, দুআটি মুআযযিন যখন আশহাদু... বলবে তখন পড়া হবে।

এ দুই কিতাবে সা‘দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রা. থেকেই এভাবে বর্ণিত হয়েছে-

مَنْ سَمِعَ الْمُؤَذِّنَ يَتَشَهّدُ فَالْتَفَتَ فِي وَجْهِهِ، فَقَالَ: أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، وَأَنّ مُحَمّدًا رَسُولُ اللهِ، رَضِيتُ بِاللهِ رَبّا، وَبِالْإِسْلَامِ دِينًا، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدّمَ مِنْ ذَنْبِهِ.

যে মুআযযিনকে তাশাহহুদ তথা ‘আশহাদু আল লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ ও আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ’ বলতে শুনে সেদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এবং বলে-

أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، وَأَنّ مُحَمّدًا رَسُولُ اللهِ، رَضِيتُ بِاللهِ رَبّا، وَبِالْإِسْلَامِ دِينًا.

তার পূর্বের সব (সগীরা) গোনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। -সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস ৪২২; শরহু মাআনিল আছার, তহাবী, হাদীস ৮৯২

বুঝা গেল, এ দুআটির মূল সময় আযানের কালিমায়ে শাহাদাতের সময়। [দ্র. আলআরফুশ শাযী, আনোয়ার শাহ কাশ্মীরি, আলোচ্য হাদীস (হাদীস নং ২০১)-এর অধীনে]

বারবার হজ্ব-উমরা : দারিদ্র্য ও গোনাহ মিটিয়ে দেয়

হজ্ব-উমরা শব্দটা শুনলেই মুমিনের মন উড়াল দেয়- ঐ মক্কায়। যে মুসলিম কোনো দিন হজ্বে যায়নি, সে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয় আর যে একবার গিয়েছে সে আবার যেতে চায়, বারবার যেতে চায়। এই হল মুমিনের অবস্থা। সেই মুমিন কি সামর্থ্য হলে ঘরে বসে থাকবে?

হজ্ব-উমরার সুযোগ সবার জীবনে আসে না। যাদের আসে তাদের আবার সবাই বারবার হজ্ব-উমরা করতে পারেন না। কিন্তু কিছু মানুষ তো এমন, যাদের বারবার হজ্ব-উমরা করার সুযোগ থাকে। হয়ত আল্লাহ তাকে তাওফীক দিয়েছেন, বায়তুল্লাহর প্রতিবেশী হওয়ার। কিংবা এমন সামর্থ্য দিয়েছেন যে, সেখানে যাওয়াটা তার জন্য দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাওয়ার চেয়েও সহজ ব্যাপার। ইচ্ছাটাই সবকিছু; অর্থ-কড়ি কোনো বিষয় নয়।

তবে মনে রাখা চাই, বায়তুল্লাহর প্রতিবেশী হওয়া বা অঢেল অর্থের মালিক হওয়াই সব নয়; আসল হল ঈমানী জযবা এবং নেক আমলের অদম্য স্পৃহা।

তাই তো আমরা দেখি, বাহ্যিক সামর্থ্য নেই এমন কত মানুষ বারবার যাচ্ছেন। একবার হজ্ব বা উমরা করেছেন তো তার যেন পিপাসা আরো বেড়ে গেছে- আবার যেতে চায়, আবার যেতে চায়। সুযোগ খোঁজে আর চাতকের মত আকাশ পানে চায়- এই বুঝি ডাক এল।

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে বারবার হজ্ব-উমরা করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। শুনিয়েছেন এর ফযীলত। ইরশাদ হয়েছে-

تَابِعُوا بَيْنَ الحَجِّ وَالعُمْرَةِ، فَإِنّهُمَا يَنْفِيَانِ الفَقْرَ وَالذّنُوبَ كَمَا يَنْفِي الكِيرُ خَبَثَ الحَدِيدِ، وَالذّهَبِ، وَالفِضّةِ، وَلَيْسَ لِلْحَجّةِ المَبْرُورَةِ ثَوَابٌ إِلّا الجَنّةُ

তোমরা একের পর এক হজ্ব-উমরা করতে থাকো। কারণ তা দারিদ্র্য ও গোনাহকে এমনভাবে মিটিয়ে দেয়, যেমন কামারের হাপর লোহা ও সোনা-রূপার ময়লা দূর করে। আর ‘হজ্জে মাবরূর’-এর প্রতিদান জান্নাত ছাড়া আর কী! -জামে তিরমিযী, হাদীস ৮১০; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস ২৫১২; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৩৬৯৩; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ২৬৩০; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২৮৮৭

আসুন, সাধ্যমত বারবার হজ্ব-উমরার মাধ্যমে নেক আমলের ভা-ারকে সমৃদ্ধ করি আর গোনাহগুলো মুছে ফেলি।



তাহিয়্যাতুল ওযু : পূর্বের গোনাহ ধুয়ে দেয়

কারো সাথে সাক্ষাৎ হলে আমরা তাকে সালাম-মুসাফাহার মাধ্যমে অভিবাদন জানাই। তেমনি কিছু বিষয় আছে, যেগুলোকে আমরা একটি আমলের মাধ্যমে অভিবাদন জানাই। যেমন মসজিদে প্রবেশ করলে মসজিদকে তাহিয়্যা বা অভিবাদন জানাই দুই রাকাত নামাযের মাধ্যমে। বায়তুল্লাহকে অভিবাদন জানাই তাওয়াফের মাধ্যমে।

তেমনি পবিত্রতার জন্য আমরা যে ওযু করি এরও অভিবাদন পদ্ধতি রয়েছে, যা আমরা নবীজী সাল্লাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শিখেছি। এটি রাসূলের সুন্নত। তো ওযুর তাহিয়্যা বা অভিবাদন হল, নামায। এর দ্বারা বান্দার গোনাহ মাফ হয় এবং মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।

আমীরুল মুমিনীন উসমান রা. একদিন ওযুর পানি চাইলেন। তিন বার সুন্দর করে দুই হাতের কব্জি পর্যন্ত ধুলেন। তারপর তিন বার কুলি করলেন ও নাকে পানি দিয়ে নাক পরিষ্কার করলেন। এরপর তিন বার চেহারা ধুলেন এবং দুই হাতের কনুই পর্যন্ত ভালোভাবে তিন বার ধৌত করলেন। তারপর মাথা মাসেহ করলেন এবং টাখনু পর্যন্ত পা তিন বার ধৌত করলেন। এরপর বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

مَنْ تَوَضّأَ نَحْوَ وُضُوئِي هَذَا، ثُمّ صَلّى رَكْعَتَيْنِ لاَ يُحَدِّثُ فِيهِمَا نَفْسَهُ، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدّمَ مِنْ ذَنْبِهِ.

যে ব্যক্তি এভাবে (সুন্দর করে) ওযু করবে, তারপর দুই রাকাত নামায আদায় করবে, যাতে (দুনিয়ার) কোনো খেয়াল করবে না, তার পেছনের সকল (ছগীরা) গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৫৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২২৬

শুধু গোনাহ মাফই নয়, এ আমলের দ্বারা মর্যাদাও বৃদ্ধি পায়। একদিন ফজরের নামাযের সময় বেলাল রা.-কে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, বেলাল! আমাকে বল দেখি, ইসলামে দাখেল হওয়ার পর থেকে তোমার কোন্ আমলটি তোমার কাছে (সওয়াবের আশার দিক থেকে) সবচেয়ে উত্তম বলে মনে হয়? কারণ, আমি জান্নাতে আমার সামনে সামনে তোমার চপ্পলের আওয়ায শুনেছি।

বেলাল রা. বললেন, তেমন কোনো আমল আমার নেই, যার দ্বারা আমি (বিশাল সওয়াবের) আশা করতে পারি। তবে দিবা-রাত্রির যখনই ওযু করি তখনই উক্ত ওযু দ্বারা যে কয় রাকাত সম্ভব নামায আদায় করি। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১১৪৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৪৫৮



কাছরাতুস সুজূদ : জান্নাতে নবীজীর সঙ্গ লাভ আর গোনাহ মাফ

কে না চায়- জান্নাতে নবীজীর সঙ্গ লাভ করতে? এর চেয়ে বড় চাওয়া আর কী হতে পারে? এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী থাকতে পারে?

রবীআ আসলামীর রা. তাই একটিই চাওয়া- জান্নাতে নবীজীর সঙ্গ লাভ। আর কী চাই হে রবীআ! নবীজীর জিজ্ঞাসা। উত্তর আগেরটাই- জান্নাতে আপনার সঙ্গ।

বিশেষ সুযোগে বড় কারো কাছে মানুষ বিশেষ কিছুই চায়। আর তিনি নিজেই যদি চাইতে বলেন, তাহলে তো কথাই নেই। তবে চাইতে তো জানতে হয়। আসুন রবীআ আসলামী রা. থেকে শিখি- কী চাইতে হয়। তিনি বলেন-

كُنْتُ أَبِيتُ مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ فَأَتَيْتُهُ بِوَضُوئِهِ وَحَاجَتِهِ فَقَالَ لِي: سَلْ، فَقُلْتُ: أَسْأَلُكَ مُرَافَقَتَكَ فِي الْجَنّةِ. قَالَ: أَوْ غَيْرَ ذَلِكَ، قُلْتُ: هُوَ ذَاكَ. قَالَ: فَأَعِنِّي عَلَى نَفْسِكَ بِكَثْرَةِ السّجُودِ

আমি (কখনো কখনো) রাতে নবীজীর সাথে থাকতাম। এক রাতে(র ঘটনা,) আমি তাঁর জন্য ওযু-ইস্তিঞ্জার পানির ব্যবস্থা করলাম। তিনি (খুশি হলেন।) বললেন, রবীআ! তুমি যা খুশি চাইতে পার। রবীআ বলেন, তখন আমি বললাম, ‘জান্নাতে আপনার সাথে থাকতে চাই’। নবীজী বললেন, আর কী চাও? (এবারও রবীআর একই উত্তর। তিনি বলেন,) আমি তখন বললাম, আমার ওই একটাই চাওয়া। একথা শুনে নবীজী বললেন-

فَأَعِنِّي عَلَى نَفْسِكَ بِكَثْرَةِ السُّجُودِ.

তাহলে ‘কাছরাতুস সুজূদ’ তথা বেশি বেশি নফল নামাযের মাধ্যমে আমাকে এ বিষয়ে সাহায্য কর। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৮৯

মুমিনের চাওয়াও ওই একটাই। সাহাবীগণের চাওয়াও ছিল এটি। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. একদিন (নফল) নামায পড়ছিলেন। নবীজী এলেন। সেখানে আবু বকর রা. ও ওমরা রা.-ও ছিলেন। একপর্যায়ে ইবনে মাসউদ রা. দুআ করতে আরম্ভ করলেন। তখন নবীজী দূর থেকেই বললেন, ইবনে মাসউদ! চাও, তুমি যা চাইবে তোমাকে দেওয়া হবে। তখন তিনি যে দুআগুলো করছিলেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল-

اَللّٰهُمّ إِنِّي أَسْأَلُكَ إِيْمَانًا لَا يَرْتَدّ، وَنَعِيمًا لَا يَنْفَدُ، وَمُرَافَقَةَ نَبِيِّكَ مُحَمَّدٍ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ فِي أَعْلَى جَنّةِ الْخُلْدِ.

হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে এমন ঈমান চাই, যার পর কুফরের দিকে প্রত্যাবর্তন নেই। এমন নিআমত চাই, যা ফুরোবার নয়। আর চাই- জান্নাতে তোমার নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গ।

ইবনে মাসউদ রা. তো নিজে থেকেই এ দুআ করেছেন। ‘ইবনে মাসউদ! চাও, তুমি যা চাইবে তোমাকে দেওয়া হবে’- নবীজীর এ বাক্য তো তিনি শোনেননি। ফলে ওমর রা. এ সুসংবাদ দেওয়ার জন্য তার কাছে গেলেন। গিয়ে দেখলেন আবু বকর রা. আগেই সেখানে পৌঁছে গেছেন। বললেন, আপনি তো সকল ভালো কাজেই আগে থাকেন! (দ্র. মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৪২৫৫; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ১৯৭০)

কোনো কোনো বর্ণনায় আছে, ইবনে মাসউদ রা. বলেন, আমার অধিকাংশ দুআতেই আমি এ বাক্যগুলো দ্বারা দুআ করি। (দ্র. মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৩৬৬২)

হাঁ, এ চাওয়া তখনই বাস্তবে রূপ নেবে যখন মুমিন বেশি বেশি সিজদা তথা নফল নামায আদায় করবে। কারণ, হাদীস শরীফে এসেছে, বান্দা যখন সিজদা করে তখন বান্দা আল্লাহর সবচেয়ে নিকটবর্তী হয়। তো বান্দা বেশি বেশি আল্লাহর নিকটবর্তী হলে তার মর্যাদা তো বৃদ্ধি পাবেই। আর আল্লাহ যে বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন তার গোনাহ কি বাকি রাখবেন? না, আল্লাহ তার গোনাহগুলো বাকি রাখবেন না। হাদীস শরীফে এসেছে, যে বান্দা বেশি বেশি নফল নামায আদায় করবে আল্লাহ তার গোনাহগুলো মিটিয়ে দিবেন।

মা‘দান ইবনে আবি তালহা রাহ. বলেন, আমি নবীজীর আযাদকৃত গোলাম ছাওবান রা.-এর সাথে সাক্ষাৎ করে জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে এমন আমলের কথা বলে দিন, যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে! তিনি বলেন, অথবা আমি বলেছি, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় আমলের কথা বলে দিন। এভাবে তিন বার জিজ্ঞাসা করার পর তিনি বললেন, আমিও নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তখন তিনি বলেছিলেন-

عَلَيْكَ بِكَثْرَةِ السّجُودِ لِلهِ، فَإِنّكَ لَا تَسْجُدُ لِلهِ سَجْدَةً، إِلّا رَفَعَكَ اللهُ بِهَا دَرَجَةً، وَحَطّ عَنْكَ بِهَا خَطِيئَةً.

তুমি বেশি বেশি সিজদা কর (নফল নামায পড়)। কেননা তোমার প্রতিটি সিজদার বিনিময়ে আল্লাহ তোমার একটি মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন এবং একটি গোনাহ মিটিয়ে দিবেন।

মা‘দান বলেন, পরবর্তীতে আমি আবুদ দারদা রা.-এর সাথে সাক্ষাৎ হলে তাঁকেও এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেছি, তিনিও একই উত্তর দিয়েছেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৮৮

হযরত আবু উমামা রা. থেকে বর্ণিত, একবার নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন-

اعْلَمْ أَنّكَ لَا تَسْجُدُ لِلهِ سَجْدَةً إِلّا رَفَعَكَ اللهُ بِهَا دَرَجَةً وَحَطَّ عَنْكَ بِهَا خَطِيئَةً.

জেনে রাখ, তোমার প্রতিটি সিজদার বিনিময়ে আল্লাহ তোমার একটি মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন এবং একটি গোনাহ মিটিয়ে দিবেন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২২২০



তাহাজ্জুদ নামায : পাপ মোচনকারী

তাহাজ্জুদ নামায। বান্দা ও রবের মাঝে একান্ত সাক্ষাৎ। সবাই ঘুমিয়ে। এখন আমি আর আমার রব। এ যেন আল্লাহর সাথে বান্দার বিশেষ সম্পর্ক, বিশেষ নৈকট্যের মাধ্যম। একে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘দা’বুস সালিহীনা কাবলাকুম’-‘পূর্ববর্তী উম্মতের নেককারদের শান-বৈশিষ্ট্য’ বলেছেন। এর মাধ্যমে বিশেষ নৈকট্য হাসিল হয়। তাই তো তা এই উম্মত ও পূর্ববর্তী উম্মতের সালিহীনদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল।

এশার নামায আদায় করার পর থেকে সুবহে সাদিক পর্যন্ত যে কোনো সময়ে তাহাজ্জুদের নামায পড়া যায়। কিন্তু রাতের শেষ ভাগই তাহাজ্জুদের জন্য বেশি উত্তম। তাছাড়া রাতের শেষ ভাগে আল্লাহ বান্দাদের ডাকতে থাকেন, কার কী চাওয়ার আছে, চাও, আমি দিব। ক্ষমা প্রার্থনা কর, আমি ক্ষমা করব।

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

يَنْزِلُ رَبّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلّ لَيْلَةٍ إِلَى السّمَاءِ الدّنْيَا حِينَ يَبْقَى ثُلُثُ اللّيْلِ الآخِرُ يَقُولُ: مَنْ يَدْعُونِي، فَأَسْتَجِيبَ لَهُ، مَنْ يَسْأَلُنِي فَأُعْطِيَهُ، مَنْ يَسْتَغْفِرُنِي فَأَغْفِرَ لَهُ.

আমাদের রব প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করেন এবং বলেন, কে আছো, দুআ করবে আমি তার দুআ কবুল করব। কে আছো, আমার কাছে (তার প্রয়োজন) চাইবে আমি তাকে দান করব। কে আছো, আমার কাছে ক্ষমা চাইবে আমি তাকে ক্ষমা করব। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১১৪৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৫৮

সুনানে ইবনে মাজাহ-এ রয়েছে, উক্ত বর্ণনা উল্লেখ করার পর রাবী বলেন-

فَلِذَلِكَ كَانُوا يَسْتَحِبّونَ صَلَاةَ آخِرِ اللّيْلِ عَلَى أَوّلِهِ.

একারণেই তারা প্রথম রাতের তুলনায় তাহাজ্জুদ শেষ রাতে পড়াকে বেশি পছন্দ করতেন। (দ্র. সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৩৬৬)

আমরা জানতে পারলাম, শেষ রাতে আল্লাহ তাআলা বান্দাকে ক্ষমা করার জন্য ডাকতে থাকেন। আর শেষ রাতের নামায তাহাজ্জুদের বিষয়ে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- তা পাপ মোচনকারী। আবু উমামা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

عَلَيْكُمْ بِقِيَامِ اللّيْلِ فَإِنّهُ دَأَبُ الصّالِحِينَ قَبْلَكُمْ، وَهُوَ قُرْبَةٌ إِلَى رَبِّكُمْ، وَمَكْفَرَةٌ لِلسّيِّئَاتِ، وَمَنْهَاةٌ لِلإِثْمِ.

তোমরা কিয়ামুল লাইল তথা তাহাজ্জুদের নামাযের প্রতি যত্নবান হও; এটি পূর্বসূরী সালিহীনের শান-তাঁদের আমল-অভ্যাস। এর মাধ্যমে রবের নৈকট্য হাসিল হয়, পাপ মোচন হয় এবং তা গোনাহ থেকে ফিরিয়ে রাখে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৫৪৯; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস ১১৩৫; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ১১৫৬; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ২৮২৪

আল্লাহ আমাদের সকলকে নিয়মিত তাহাজ্জুদ আদায়ের তাওফীক দান করুন- আমীন।

মায়্যিতকে গোসল দেওয়া : গোসলদাতার গোনাহ ধুয়ে দেয়

কোনো মুসলিম ইন্তেকাল করলে সুন্দর মত তার কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করা মুসলিমদের দায়িত্ব। কেউ এগিয়ে আসবে কবর খননের জন্য, কেউ ব্যবস্থা করবে কাফনের, কেউ বা গোসল দিবে মায়্যিতকে। এভাবে সকলে মিলে তার সুন্দর কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করবে। জানাযায় শরীক হবে, তার জন্য মাগফিরাতের দুআ করবে, দাফন পর্যন্ত উপস্থিত থাকবে। এ সবই মুসলিমের উপর মুসলিমের হক। এসকল আমলের ভিন্ন ভিন্ন ফযীলত বর্ণিত হয়েছে হাদীস শরীফে। এর মধ্য থেকে মায়্যিতকে গোসল দেওয়ার ফযীলত বর্ণিত হয়েছে বিশেষ গুরুত্বের সাথে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

مَنْ غَسّلَ مُسْلِمًا فَكَتَمَ عَلَيْهِ غَفَرَ اللهُ لَهُ أَرْبَعِينَ مَرّةً، وَمَنْ حَفَرَ لَهُ فَأَجَنّهُ أَجْرَى عَلَيْهِ كَأَجْرِ مَسْكَنٍ أَسْكَنَهُ إِيّاهُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ، وَمَنْ كَفّنَهُ كَسَاهُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ مِنْ سُنْدُس وَإِسْتَبْرَقِ الْجَنّةِ.

যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমকে (মায়্যিতকে) গোসল দিবে এবং তার দোষ-ত্রুটি গোপন করবে আল্লাহ চল্লিশবার তার গোনাহ মাফ করবেন। আর যে ব্যক্তি কবর খনন করবে এবং তাকে কবরে রাখবে আল্লাহ তাকে কিয়ামত পর্যন্ত তার বাসস্থানের ব্যবস্থা করার সওয়াব দান করবেন। আর যে ব্যক্তি কাফনের ব্যবস্থা করবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে মিহি ও পুরু রেশমের কাপড় পরাবেন। -সুনানে কুবরা, বায়হাকী, হাদীস ৬৬৫৫; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ১৩৪০

অন্যকে ক্ষমা কর, আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করবেন

কিয়ামতের দিন বান্দার সবচেয়ে বড় প্রয়োজন- আল্লাহর ক্ষমা। আল্লাহ যদি মাফ করে দেন, বান্দার আর কোনো চিন্তা নেই। তো বিশেষ কী আমল করলে বান্দা কাল কিয়ামতের কঠিন মুহূর্তে রাব্বে কারীমের ক্ষমা লাভ করতে পারে? কত আমলের কথাই তো আমরা জানি, কত আমলই তো আমরা করি; যাতে ক্ষমা পাই রাব্বে কারীমের! কিন্তু কোন্ আমলটি সবচেয়ে উত্তম, যার মাধ্যমে ক্ষমা লাভের আশা প্রবল?

হাঁ, একটি অতি কার্যকর আমল আছে, যার মাধ্যমে আশা করা যায়- বান্দাকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন। আরবীতে একটি কথা আছে- ‘আলজাযাউ মিন জিনসিল আমাল’, অর্থাৎ ‘কর্ম যা, প্রতিদানও তার মাধ্যমে’। সুতরাং ক্ষমা করাই ক্ষমা লাভের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ও কার্যকরী উপায়। আমি যদি মানুষকে ক্ষমা করে দিই, তো আশা করা যায়- এর প্রতিদান স্বরূপ আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করে দেবেন।

কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাঁর ক্ষমার প্রতি ধাবিত হওয়ার আহ্বান করেছেন; সেখানে ক্ষমা লাভকারীদের যে গুণাবলি উল্লেখ করা হয়েছে তার অন্যতম প্রধান হল, মানুষকে ক্ষমা করে দেওয়া। ইরশাদ হয়েছে-

وَ سَارِعُوْۤا اِلٰی مَغْفِرَةٍ مِّنْ رَّبِّكُمْ وَ جَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمٰوٰتُ وَ الْاَرْضُ اُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِیْنَ، الَّذِیْنَ یُنْفِقُوْنَ فِی السَّرَّآءِ وَ الضَّرَّآءِ وَ الْكٰظِمِیْنَ الْغَیْظَ وَ الْعَافِیْنَ عَنِ النَّاسِ، وَ اللهُ یُحِبُّ الْمُحْسِنِیْنَ.

তোমরা ধাবমান হও স্বীয় প্রতিপালকের ক্ষমার দিকে এবং সেই জান্নাতের দিকে, যার বিস্তৃতি আসমান ও যমীনের ন্যায়। যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে মুত্তাকীদের জন্য; যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় ব্যয় করে এবং যারা ক্রোধ সংবরণকারী এবং ‘মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল’। আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের ভালবাসেন। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৩৩-১৩৪

হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-

ارْحَمُوا تُرْحَمُوا، وَاغْفِرُوا يَغْفِرِ اللهُ لَكُمْ.

তোমরা (অন্যের প্রতি) দয়া কর, তোমাদের প্রতি দয়া করা হবে। তোমরা (অন্যকে) ক্ষমা কর, তোমাদেরকে ক্ষমা করা হবে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৭০৪১; আলআদাবুল মুফরাদ, হাদীস ৩৮০

সূরা মুলক : যে সূরার সুপারিশে ক্ষমা লাভ হয়

সূরা মুলক। ঊনত্রিশ নাম্বার পারার প্রথম সূরা। সূরা নাম্বার ৬৭। জীবনের উদ্দেশ্য, আল্লাহর কুদরত ও নিআমতের স্মরণ, আখেরাতে জাহান্নামীদের অবস্থা ও তাদের আক্ষেপ ইত্যাদি বিষয় রয়েছে এ সূরাটিতে। অনেক ফযীলত সম্বলিত সূরা এটি। এ সূরাকে বলা হয়, ‘মানেআ’-বাধাদানকারী, প্রতিবন্ধক। এ সূরাটি আমলকারীর জন্য কবরের আযাব থেকে প্রতিবন্ধক হবে। সুপারিশ করে বান্দাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে, জাহান্নাম থেকে প্রতিবন্ধক হবে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সূরাটি তিলাওয়াত না করা পর্যন্ত ঘুমাতেন না। জাবের রা. বলেন-

كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ لَا يَنَامُ حَتّى يَقْرَأَ الم تَنْزِيلُ السّجْدَةَ، وَتَبَارَكَ الّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলিফ লাম মীম তানযীল আসসাজদা (সূরা সাজদাহ) ও তাবারাকাল্লাযি বিইয়াদিহিল মুলক (সূরা মুলক)- এ দুই সূরা তিলাওয়াত না করে ঘুমাতেন না। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৪৬৫৯; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ৩৫৪৫

অন্যান্য ফযীলতের সাথে সাথে এ সূরার একটি বিশেষ ফযীলত হল, এ সূরার আমলের মাধ্যমে ক্ষমা লাভ হয়। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

إِنّ سُورَةً مِنَ القُرْآنِ ثَلَاثُونَ آيَةً شَفَعَتْ لِرَجُلٍ حَتّى غُفِرَ لَهُ، وَهِيَ سُورَةُ تَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ المُلْكُ

কুরআনে ত্রিশ আয়াত বিশিষ্ট একটি সূরা রয়েছে, তা এক ব্যক্তির জন্য সুপারিশ করেছে ফলে আল্লাহ ঐ ব্যক্তিকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। সূরাটি হল, তাবারাকাল্লাযি বিইয়াদিহিল মুলক-সূরা মুলক। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৮৯১; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ৩৮৩৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৭৯৭৫

জামাতের উদ্দেশে পায়ে হেঁটে মসজিদে গমন : গোনাহমাফির কারণ

ইতিপূর্বে লেখা হয়েছে- ‘নামাযের জন্য মসজিদে গমন : কদমে কদমে গোনাহ মাফ’ এই শিরোনামে। আর এখানে যে বিষয়টি লেখার ইচ্ছা তা হল, সক্ষম ব্যক্তিদের জন্য পায়ে হেঁটে জামাতের নামাযে যাওয়া- এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল এবং ফযীলতের বিষয়। বিভিন্ন বর্ণনার ভাষা ও উপস্থাপন থেকে বিষয়টি উপলব্ধি করা যায়। ফলে পায়ে হেঁটে জামাতের নামাযে শরীক হওয়ার বিষয়টি আলাদা গুরুত্বের দাবি রাখে।

এক হাদীসে নামাযের দিকে হেঁটে যাওয়া প্রতিটি কদমকে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদাকা বলেছেন। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

كُلّ خُطْوَةٍ تَمْشِيهَا إِلَى الصّلَاةِ صَدَقَةٌ.

নামাযের দিকে হেঁটে যাওয়া প্রতিটি কদম তোমার জন্য সদাকা। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০০৯

আর এটি গোনাহমাফিরও কারণ। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

كَفّارَاتُ الْخَطَايَا، إِسْبَاغُ الْوُضُوءِ عَلَى الْمَكَارِهِ، وَإِعْمَالُ الْأَقْدَامِ إِلَى الْمَسَاجِدِ، وَانْتِظَارُ الصّلَاةِ بَعْدَ الصّلَاةِ.

পাপ মোচনকারী হল- কষ্টের মুহূর্তে পূর্ণরূপে ওযু করা, মসজিদের দিকে পা সঞ্চালন, এক নামাযের পর আরেক নামাযের অপেক্ষা করা। (অর্থাৎ, আরেক

নামাযের অপেক্ষায় মসজিদে অবস্থান।) -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৪২৮

ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত এক হাদীসে কুদসীতে বর্ণিত হয়েছে- আল্লাহ তাআলা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্নে জিজ্ঞাসা করেন-

يَا مُحَمّدُ هَلْ تَدْرِي فِيمَ يَخْتَصِمُ المَلَأُ الأَعْلَى؟

হে মুহাম্মাদ! আপনি জানেন কি, ঊর্ধ্ব জগতের অধিবাসীরা কী নিয়ে বিবাদ করে?

একপর্যায়ে নবীজী উত্তরে বললেন-

فِي الكَفّارَاتِ، وَالكَفّارَاتُ المُكْثُ فِي المَسَاجِدِ بَعْدَ الصّلَاةِ، وَالْمَشْيُ عَلَى الْأَقْدَامِ إِلَى الْجَمَاعَاتِ، وَإِسْبَاغُ الوُضُوءِ فِي المَكَارِهِ.

তারা পাপমোচনকারী বিষয় নিয়ে বিবাদ করে। [অর্থাৎ এর ফযীলত নিয়ে অথবা এর সওয়াব নিয়ে আসমানে আরোহণ বিষয়ে বিবাদ করে। -মিরকাত] আর পাপ মোচনাকরী হল- নামাযের পর (আরেক নামাযের অপেক্ষায়) মসজিদে অবস্থান করা। পায়ে হেঁটে মসজিদে গমন এবং কষ্টের মুহূর্তে পূর্ণরূপে ওযু করা। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩২৩৩

শেষ রাতে ক্ষমা প্রার্থনার দ্বারা গোনাহ মাফ হয়

গোনাহ তো হয়েই যায়। কিন্তু মুমিনের বৈশিষ্ট্য হল, গোনাহ হওয়ার সাথে সাথে সে পেরেশান হয়; কীভাবে সে গোনাহ থেকে মুক্ত হতে পারে, কীভাবে ক্ষমা পেতে পারে! কুরআনে মুমিনের এ গুণ-বৈশিষ্ট্য আলোচিত হয়েছে এ ভাষায়-

وَ الَّذِیْنَ اِذَا فَعَلُوْا فَاحِشَةً اَوْ ظَلَمُوْۤا اَنْفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللهَ فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوْبِهِمْ ۪ وَ مَنْ یَّغْفِرُ الذُّنُوْبَ اِلَّا اللهُ وَ لَمْ یُصِرُّوْا عَلٰی مَا فَعَلُوْا وَ هُمْ یَعْلَمُوْنَ.

এবং যারা কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেললে অথবা নিজেদের প্রতি জুলুম করলে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজেদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ ছাড়া কে পাপ ক্ষমা করবে? আর তারা যা করে ফেলে জেনে বুঝে তাতে অটল থাকে না। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৩৫

হাঁ, মুমিন পেরেশান হয় এবং চিন্তা করতে থাকে- কীভাবে কখন আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলে আল্লাহ ক্ষমা করবেন! রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের জানিয়েছেন- কোন্ সময় ক্ষমা চাইলে ক্ষমা লাভের আশা করা যায়। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

يَنْزِلُ رَبّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلّ لَيْلَةٍ إِلَى السّمَاءِ الدّنْيَا حِينَ يَبْقَى ثُلُثُ اللّيْلِ الآخِرُ يَقُولُ: مَنْ يَدْعُونِي، فَأَسْتَجِيبَ لَهُ، مَنْ يَسْأَلُنِي فَأُعْطِيَهُ، مَنْ يَسْتَغْفِرُنِي فَأَغْفِرَ لَهُ.

আমাদের রব প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করেন এবং বলেন, কে আছো, দুআ করবে আমি তার দুআ কবুল করব। কে আছো, আমার কাছে (তার প্রয়োজন) চাইবে আমি তাকে দান করব। কে আছো, আমার কাছে ক্ষমা চাইবে আমি তাকে ক্ষমা করব। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১১৪৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৫৮

শেষ রাতে ইসতিগফার আল্লাহর খাছ বান্দাদের বৈশিষ্ট্য। কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা শেষ রাতে ইসতিগফারকারীদের প্রশংসা করেছেন। জান্নাতীদের গুণ বর্ণনায় আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

وَ الْمُسْتَغْفِرِیْنَ بِالْاَسْحَارِ

...এবং রাতের শেষ প্রহরে ক্ষমাপ্রার্থীগণ। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৭

আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. দুআ-ইসতিগফারের জন্য শেষ রাতের এনতেযারে থাকতেন। ইবনে কাসীর রাহ. উপরোক্ত আয়াতের অধীনে উল্লেখ করেন- ইবনে ওমর রা. রাতে নামাযে মশগুল থাকতেন। একপর্যায়ে নাফে রাহ.-কে জিজ্ঞেস করতেন, সাহার (শেষ রাত) কি ঘনিয়ে এসেছে? যখন নাফে বলতেন, হাঁ তখন ইবনে ওমর রা. দুআ-ইসতিগফারে মশগুল হতেন।

ইবনে মাসউদ রা. শেষ রাতে দুআ-ইসতিগফারে মশগুল হতেন এবং বলতেন-

وَهَذَا سَحَرٌ، فَاغْفِرْ لِي.

(হে আল্লাহ!) এখন ‘সাহার’ (প্রতিশ্রুত শেষ রাত) সুতরাং তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। (তাফসীরে ইবনে আবি হাতেম, বর্ণনা ১১৯৮২, সূরা ইউসুফ আয়াত ৯৮-এর অধীনে) -তাফসীরে ইবনে কাসীর, সূরা আলে ইমরান আয়াত ১৭-এর অধীনে

রাতে ঘুম ভাঙলে ইসতিগফার...

অনেকসময় রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। এসময় উচিত- আল্লাহর যিকির-তাসবীহ করা। দুআ-ইসতিগফার করা। সম্ভব হলে নামায আদায় করা। কারণ, এ সময়ের দুআ-ইসতিগফার-নামায কবুল করা হয়। বিশেষ করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া। এসময় ক্ষমা চাইলে আল্লাহ ক্ষমা করেন। হযরত উবাদা ইবনে সামেত রা. থেকে বর্ণিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

مَنْ تَعَارّ مِنَ اللّيْلِ، فَقَالَ: لاَ إِلَهَ إِلّا اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ، لَهُ المُلْكُ وَلَهُ الحَمْدُ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ، الحَمْدُ لِلهِ، وَسُبْحَانَ اللهِ، وَلاَ إِلَهَ إِلّا اللهُ، وَاللهُ أَكْبَرُ، وَلاَ حَوْلَ وَلاَ قُوّةَ إِلّا بِاللهِ، ثُمّ قَالَ: اللّهُمّ اغْفِرْ لِي، أَوْ دَعَا، اسْتُجِيبَ لَهُ، فَإِنْ تَوَضّأَ وَصَلّى قُبِلَتْ صَلاَتُهُ.

কারো যদি রাতে ঘুম ভেঙে যায় এবং সে এই দুআ পড়ে-

لاَ إِلَهَ إِلّا اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ، لَهُ المُلْكُ وَلَهُ الحَمْدُ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ، الحَمْدُ لِلهِ، وَسُبْحَانَ اللهِ، وَلاَ إِلَهَ إِلّا اللهُ، وَاللهُ أَكْبَرُ، وَلاَ حَوْلَ وَلاَ قُوّةَ إِلّا بِاللهِ.

এরপর বলে-

اللّهُمَّ اغْفِرْ لِي.

(হে আল্লাহ্! আমাকে ক্ষমা করুন।) তাহলে তাকে ক্ষমা করা হবে। যদি দুআ করে, তার দুআ কবুল করা হবে। আর যদি ওযু করে নামায আদায় করে তাহলে তার নামায কবুল করা হবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১১৫৪; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ২৫৯৬

যাদের জন্য ফিরিশতারা মাগফিরাতের দুআ করে

কিছু আমল রয়েছে, যেগুলোর কারণে ফিরিশতারা মাগফিরাতের দুআ করে। আর ফিরিশতাদের দুআ আল্লাহ কবুল করবেন- এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং এসকল আমলের দ্বারা মাগফিরাতের আশা করা যায়। কাজেই এ আমলগুলোর প্রতিও আমরা যতœবান হব ইনশাআল্লাহ; যাতে রাব্বে কারীমের ক্ষমা লাভ করতে পারি।

এক. নামাযের পর নামাযের স্থানে বসে থাকা

যেসকল আমলের কারণে ফিরিশতা মাগফিরাতের দুআ করে এর মধ্যে অন্যতম প্রধান হল, নামাযের পর ওযু অবস্থায় নামাযের স্থানে (বা মসজিদে) বসে থাকা। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

المَلاَئِكَةُ تُصَلِّي عَلَى أَحَدِكُمْ مَا دَامَ فِي مُصَلّاهُ الّذِي صَلّى فِيهِ، مَا لَمْ يُحْدِثْ، تَقُولُ: اللّهُمّ اغْفِرْ لَهُ، اللّهُمّ ارْحَمْهُ.

কোনো ব্যক্তি নামাযের পর নামাযের স্থানে যতক্ষণ পবিত্র অবস্থায় বসে থাকে ফিরিশতারা তার জন্য দুআ করতে থাকে; তারা বলে-

اللّهُمّ اغْفِرْ لَهُ، اللّهُمّ ارْحَمْهُ.

আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দাও, তার প্রতি দয়া কর। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৪৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৪৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৬৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১০৫২০;

কোনো কোনো বর্ণনায় রয়েছে-

مَا دَامَ فِي المَسْجِدِ.

(যতক্ষণ মসজিদে অবস্থান করবে)। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৩০

দুই. এক নামাযের পর আরেক নামাযের ইনতিযারে মসজিদে অবস্থান করা

এক নামাযের পর আরেক নামাযের ইনতিযারে মসজিদে অবস্থান করা অনেক বড় ফযীলতের বিষয়। এটি আল্লাহর কাছে অনেক পছন্দনীয় আমল; এমন পছন্দনীয় যে, আল্লাহ তাআলা ফিরিশতাদের সাথে তাঁর ঐ বান্দাদের বিষয়ে গর্ব করেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. বলেন, একবার আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে মাগরিবের নামায আদায় করলাম। নামাযের পর যারা বাড়িতে ফেরার ফিরে গেল, কিন্তু কিছু মানুষ এশার নামাযের ইনতিযারে মসজিদেই থেকে গেল। এরই মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাঁপাতে হাঁপাতে কাপড় গুটিয়ে দ্রুত তাশরীফ আনলেন। বললেন-

أَبْشِرُوا، هَذَا رَبّكُمْ قَدْ فَتَحَ بَابًا مِنْ أَبْوَابِ السَّمَاءِ، يُبَاهِي بِكُمُ الْمَلَائِكَةَ، يَقُولُ: انْظُرُوا إِلَى عِبَادِي قَدْ قَضَوْا فَرِيضَةً، وَهُمْ يَنْتَظِرُونَ أُخْرَى.

তোমরা (যারা আরেক নামাযের ইনতিযারে মসজিদে অবস্থান করছ তারা) সুসংবাদ গ্রহণ কর। তোমাদের রব আসমানের বিশেষ এক দরজা উন্মুক্ত করেছেন। তিনি তোমাদের নিয়ে তাঁর ফিরিশতাদের সাথে গর্ব করে বলছেন, তোমরা দেখ আমার বান্দাদের! তারা এক ফরয (নামায) আদায়ের পর আরেক ফরয (নামায) আদায়ের ইনতিযারে রয়েছে। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৮০১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৬৭৫০

আরেক হাদীসে একে ‘রিবাত’ বলা হয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

أَلَا أَدُلّكُمْ عَلَى مَا يَمْحُو اللهُ بِهِ الْخَطَايَا، وَيَرْفَعُ بِهِ الدّرَجَاتِ؟ قَالُوا بَلَى يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ: إِسْبَاغُ الْوُضُوءِ عَلَى الْمَكَارِهِ، وَكَثْرَةُ الْخُطَا إِلَى الْمَسَاجِدِ، وَانْتِظَارُ الصّلَاةِ بَعْدَ الصّلَاةِ، فَذَلِكُمُ الرِّبَاطُ.

আমি কি তোমাদের ঐসমস্ত আমলের কথা বলে দিব, যার দ্বারা আল্লাহ তাআলা পাপসমূহ মিটিয়ে দেন এবং মর্যাদা সমুন্নত করেন? সাহাবায়ে কেরাম আরয করলেন, অবশ্যই বলে দিন আল্লাহর রাসূল! তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কষ্টের মুহূর্তে পূর্ণরূপে ওযু করা, মসজিদে বেশি বেশি গমন করা এবং এক নামাযের পর আরেক নামাযের অপেক্ষা করা। (অর্থাৎ, আরেক নামাযের অপেক্ষায় মসজিদে অবস্থান করা।) এটিই হল ‘রিবাত’। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫১; জামে তিরমিযী, হাদীস ৫১

রিবাত হল, শত্রুর সাথে জিহাদে এবং জিহাদের প্রস্তুতিতে নিজেকে আবদ্ধ রাখা। আর এখানে রিবাত দ্বারা উদ্দেশ্য, নিজেকে নেক কাজে আবদ্ধ রাখা। (মেরকাত, আলোচ্য হাদীসের ব্যাখ্যায়)

এ থেকেই বোঝা যায়, এক নামাযের পর আরেক নামাযের ইনতিযারে মসজিদে অবস্থান আল্লাহর কাছে কত প্রিয় আমল।

আর এ আমলের কারণে ফিরিশতারাও মাগফিরাতের দুআ করতে থাকে। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

أَحَدُكُمْ مَا قَعَدَ يَنْتَظِرُ الصّلَاةَ، فِي صَلَاةٍ، مَا لَمْ يُحْدِثْ، تَدْعُو لَهُ الْمَلَائِكَةُ: اللهُمّ اغْفِرْ لَهُ، اللهُمّ ارْحَمْهُ.

কোনো ব্যক্তি এক নামাযের পর যতক্ষণ আরেক নামাযের ইনতিযারে (মসজিদে) থাকে সে নামাযে রয়েছে বলেই গণ্য হয়; যতক্ষণ সে পবিত্র অবস্থায় থাকে। আর ফিরিশতারা তার জন্য দুআ করতে থাকে; ফিরিশতারা বলে-

اللهُمّ اغْفِرْ لَهُ، اللهُمّ ارْحَمْهُ.

হে আল্লাহ! তাকে ক্ষমা করে দাও, তার প্রতি দয়া কর। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৪৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৯৪৬২

তিন. পবিত্র অবস্থায় রাত্র যাপন করা

রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় ওযু করে ঘুমানো উচিত। এব্যাপারে হাদীস শরীফে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। একবার নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বারা ইবনে আযেব রা.-কে বললেন-

إِذَا أَتَيْتَ مَضْجَعَكَ، فَتَوَضّأْ وُضُوءَكَ لِلصّلاَةِ، ثُمّ اضْطَجِعْ عَلَى شِقِّكَ الأَيْمَنِ.

যখন তুমি ঘুমানোর জন্য বিছানায় যাও তখন নামাযের ওযুর মত ওযু কর। অতপর ডান কাত হয়ে শোও। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৪৭

সুতরাং আমরা ঘুমানোর আগে ওযু করে পবিত্র অবস্থায় ঘুমানোর চেষ্টা করব। আর আরেক হাদীসে পবিত্র অবস্থায় রাত্র যাপনের ফযীলতও বর্ণিত হয়েছে। এর মাধ্যমে ফিরিশতাদের দুআ পাওয়া যায় এবং মাগফিরাত লাভ হয়। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

مَنْ بَاتَ طَاهِرًا بَاتَ فِي شِعَارِهِ مَلَكٌ فَلَمْ يَسْتَيْقِظْ إِلّا، قَالَ الْمَلَكُ: اللّهُمّ اغْفِرْ لِعَبْدِكَ فُلَانٍ، فَإِنّهُ بَاتَ طَاهِرًا.

যে ব্যক্তি পবিত্র অবস্থায় রাত্র যাপন করে একজন ফিরিশতা তার শিয়রে অবস্থান করে। যখনই সে জাগ্রত হয় ফিরিশতা বলে-

اللّهُمّ اغْفِرْ لِعَبْدِكَ فُلَانٍ، فَإِنّهُ بَاتَ طَاهِرًا.

আল্লাহ আপনি আপনার (অমুক) বান্দাকে মাফ করে দিন; সে পবিত্র অবস্থায় রাত্র যাপন করেছে। -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ১০৫১; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ২৫২৬; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস ১১৪৬

চার. ফজর ও আসরের নামায জামাতে আদায় করা

ফজরের নামায হল দিনের শুরুর নামায আর আসরের নামায হল দিনের শেষ নামায। আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে রাতে নিযুক্ত ফিরিশতারা ফজরের সময় আসমানে উঠে যায়। আর দিনের ফিরিশতারা ফজরের সময় আগমন করে। তেমনি দিনে নিযুক্ত ফিরিশতারা আসরের পর আসমানে চলে যায় আর রাতে নিযুক্ত ফিরিশতারা আগমন করে। দিনের ফিরিশতারা ফজরের সময় এসে আল্লাহর কিছু বান্দাদের নামাযরত দেখে। তেমনি আসরেও তাদেরকে নামাযরত দেখে। অর্থাৎ তাদের আগমন এবং যাওয়ার সময় আল্লাহর কিছু বান্দাদের নামাযরত দেখে। তেমনি রাতের ফিরিশতারাও। তখন তারা আল্লাহর কাছে সেভাবেই রিপোর্ট পেশ করে এবং তাদের মাগফিরাতের জন্য দুআ করে। বিষয়টি হাদীস শরীফে এভাবে বিবৃত হয়েছে-

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

يَجْتَمِعُ مَلَائِكَةُ اللّيْلِ وَمَلَائِكَةُ النّهَارِ فِي صَلَاةِ الْفَجْرِ وَصَلَاةِ الْعَصْرِ، فَيَجْتَمِعُونَ فِي صَلَاةِ الْفَجْرِ فَتَصْعَدُ مَلَائِكَةُ اللّيْلِ، وَتَثْبُتُ مَلَائِكَةُ النّهَارِ، وَيَجْتَمِعُونَ فِي صَلَاةِ الْعَصْرِ فَتَصْعَدُ مَلَائِكَةُ النّهَارِ، وَتَثْبُتُ مَلَائِكَةُ اللّيْلِ، فَيَسْأَلُهُمْ رَبّهُمْ: كَيْفَ تَرَكْتُمْ عِبَادِي، فَيَقُولُونَ: أَتَيْنَاهُمْ وَهُمْ يُصَلّونَ وَتَرَكْنَاهُمْ وَهُمْ يُصَلّونَ، فَاغْفِرْ لَهُمْ يَوْمَ الدِّينِ.

রাতে নিযুক্ত ফিরিশতারা এবং দিনে নিযুক্ত ফিরিশতারা ফজর ও আসরের নামাযে একত্রিত হয়। ফজরের সময় রাতের ফিরিশতারা আসমানে চলে যায় এবং দিনের ফিরিশতারা কাজে যোগ দেয়। তেমনি আসরের সময় দিনে নিযুক্ত ফিরিশতারা আসমানে চলে যায় আর রাতের ফিরিশতারা কাজে যোগ দেয়। আসমানে গেলে তাদের রব তাদের জিজ্ঞাসা করেন-

كَيْفَ تَرَكْتُمْ عِبَادِي؟

আমার বান্দাদের কী অবস্থায় দেখে এসেছ?

তখন তারা উত্তরে বলে-

أَتَيْنَاهُمْ وَهُمْ يُصَلّونَ وَتَرَكْنَاهُمْ وَهُمْ يُصَلّونَ، فَاغْفِرْ لَهُمْ يَوْمَ الدِّينِ.

আমরা যখন গিয়েছি তখন তাদের নামাযরত দেখেছি। আবার যখন ফিরেছি তখনও নামাযরত দেখেছি। সুতরাং হে রব! আপনি কিয়ামতের দিন তাদের ক্ষমা করে দিন। -সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস ৩২২; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ২০৬১; মুসনাদে বাযযার, হাদীস ৯২৭৪



পাঁচ. রুগি দেখতে যাওয়া : সত্তর হাজার ফিরিশতা ইসতিগফার করতে থাকে

রুগি দেখতে যাওয়া, রুগির সেবা-শুশ্রƒষা করা- এক মুসলিমের উপর অপর মুসলিমের হক। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

এক মুসলিমের উপর অপর মুসলিমের ছয়টি হক রয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, কী সেই হকগুলো? তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-

إِذَا لَقِيتَهُ فَسَلِّمْ عَلَيْهِ، وَإِذَا دَعَاكَ فَأَجِبْهُ، وَإِذَا اسْتَنْصَحَكَ فَانْصَحْ لَهُ، وَإِذَا عَطَسَ فَحَمِدَ اللهَ فَسَمِّتْهُ، وَإِذَا مَرِضَ فَعُدْهُ وَإِذَا مَاتَ فَاتّبِعْهُ.

যখন তার সাথে দেখা হবে সালাম দেবে। দাওয়াত করলে দাওয়াত কবুল করবে। তোমার কাছে উপদেশ-পরামর্শ চাইলে কল্যাণকামিতার সাথে উপদেশ-পরামর্শ দেবে। হাঁচির পর আলহামদু লিল্লাহ বললে এর জবাব দেবে (ইয়ারহামুকাল্লাহ বলবে)। যখন অসুস্থ হবে তাকে দেখতে যাবে, শুশ্রƒষা করবে। মৃত্যুবরণ করলে জানাযা-দাফনে শরীক হবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১৬২

আর এটি অনেক বড় ফযীলতের আমলও বটে। এর মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর রহমত লাভ করে। জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

مَنْ عَادَ مَرِيضًا، لَمْ يَزَلْ يَخُوضُ فِي الرَّحْمَةِ حَتَّى يَجْلِسَ، فَإِذَا جَلَسَ اغْتَمَسَ فِيهَا.

ব্যক্তি যখন কোনো অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যায় সে আল্লাহর রহমতের মাঝে প্রবেশ করে। আর যখন (তার পাশে) বসে তখন সে রহমতের মাঝে ডুব দেয়। -মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, হাদীস ১০৮৩৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৪২৬০

আর সবচেয়ে বড় ফযীলত হল, এর দ্বারা গোনাহ মাফ হওয়ার আশা করা যায়। সত্তর হাজার ফিরিশতা তার জন্য ইসতিগফার করতে থাকে। হাসান ইবনে আলী রা. অসুস্থ হলে আবু মূসা আশআরী রা. একবার তাঁকে দেখতে গেলেন। তখন আলী রা. বললেন, আপনি কি বেড়ানোর উদ্দেশে এসেছেন, নাকি রুগি দেখতে এসেছেন? তখন তিনি উত্তরে বললেন, বরং রোগি দেখতে এসেছি। তখন আলী রা. বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি-

مَنْ عَادَ مَرِيضًا بَكَرًا شَيّعَهُ سَبْعُونَ أَلْفَ مَلَكٍ، كُلّهُمْ يَسْتَغْفِرُ لَهُ حَتّى يُمْسِيَ، وَكَانَ لَهُ خَرِيفٌ فِي الْجَنّةِ، وَإِنْ عَادَهُ مَسَاءً شَيّعَهُ سَبْعُونَ أَلْفَ مَلَكٍ كُلّهُمْ يَسْتَغْفِرُ لَهُ، حَتّى يُصْبِحَ وَكَانَ لَهُ خَرِيفٌ فِي الْجَنّةِ.

কেউ যদি সকালে কোনো অসুস্থ ব্যক্তির খোঁজ-খবর নিতে যায় তার সাথে সত্তর হাজার ফিরিশতা সঙ্গ দেয় এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য ইসতিগফার করতে থাকে এবং জান্নাতে তার একটি বাগান লাভ হয়। আর যদি সন্ধ্যায় রুগি দেখতে যায় তাহলে সত্তর হাজার ফিরিশতা তার সঙ্গ দেয় এবং সকাল পর্যন্ত তার জন্য ইসতিগফার করতে থাকে। আর জান্নাতে সে একটি বাগানের অধিকারী হয়। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৯৭৫; সুনানে কুবরা, বায়হাকী, হাদীস ৬৫৮৫; জামে তিরমিযী, হাদীস ৯৬৯; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ১২৬৪ (মাওকূফ হিসেবে) সুনানে আবু দাউদ, বর্ণনা ৩০৯৮; মুসনাদে আহমাদ, বর্ণনা ৯৭৬

এতক্ষণ আমরা ঐসকল বর্ণনা নিয়ে আলোচনা করেছি, যেখানে স্পষ্ট শব্দে -যেমন, اللهُمّ اغْفِرْ لَهُ- ফিরিশতাদের ক্ষমা প্রার্থনার কথা উল্লেখ আছে। এপর্যায়ে ঐসকল বর্ণনা আলোচনা করব, যেখানে ‘সালাত’ শব্দে ফিরিশতাদের ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়টি এসেছে। কারণ, বান্দার প্রতি ফিরিশতাদের ‘সালাত’ অর্থ দুআ ও ইসতিগফার উভয়টিই হয়। (জামিউ বায়ানিল ইলম, ১৮৩ নং হাদীসের অধীনে; তরহুত তাছরীব ফী শরহিত তাকরীব ২/৩৬৭; তাফসীরে কুরতুবী, সূরা আহযাব ৪৩ নং আয়াতের অধীনে) কোনো কোনো বর্ণনায় ফিরিশতাদের ‘সালাত’-এর ভাষা-ই হল ইসতিগফার। যেমন-

إِنّ الْعَبْدَ إِذَا جَلَسَ فِي مُصَلاهُ بَعْدَ الصّلاةِ، صَلّتْ عَلَيْهِ الْمَلائِكَةُ، وَصَلاتُهُمْ عَلَيْهِ: اللهُمّ اغْفِرْ لَهُ اللهُمّ ارْحَمْهُ .

(মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১২১৯; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ২৭০০) মোটকথা, ফিরিশতাদের সালাত অর্থ, দুআ-ইসতিগফার। নি¤েœ এধরনের কিছু বর্ণনা পেশ করা হল :



ছয়. প্রথম কাতারে নামায আদায়

জামাতের নামাযে প্রথম কাতারের ফযীলত কী? এ প্রশ্নের উত্তর হাদীস শরীফে একটু ভিন্নভাবে দেওয়া হয়েছে। এর ফযীলত এত এত- এভাবে না বলে বলা হয়েছে- এর ফযীলত যদি তোমরা জানতে তাহলে লটারী করে হলেও প্রথম কাতারে স্থান করে নিতে, প্রথম কাতারে দাঁড়াতে! এর দ্বারা এ আমলের প্রতি আমাদের তীব্র আগ্রহ সৃষ্টি করা হয়েছে; যাতে আমরা এ আমলের ফযীলত লাভ করতে পারি। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

لَوْ يَعْلَمُ النّاسُ مَا فِي النِّدَاءِ وَالصّفِّ الأَوّلِ، ثُمّ لَمْ يَجِدُوا إِلّا أَنْ يَسْتَهِمُوا عَلَيْهِ لاَسْتَهَمُوا...

আযান এবং প্রথম কাতারের ফযীলত যদি মানুষ জানত; আর লটারী করা ছাড়া এ আমলের সুযোগ পাওয়া না যেত, তাহলে লটারী করে হলেও মানুষ এ আমলে অংশ নিত। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬১৫

এ হাদীসে যদিও অভিনব উপস্থাপনের মাধ্যমে আমলের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে, নির্দিষ্ট কোনো ফযীলতের উল্লেখ আসেনি, কিন্তু আরেক হাদীসে এ আমলের এমন এক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে, যা লাভ করার জন্য আসলেও লটারী করে প্রথম কাতারে দাঁড়ানো উচিত। বারা ইবনে আযেব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি-

إِنّ اللهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلّونَ عَلَى الصّفِّ الْأَوّلِ.

যারা প্রথম কাতারে দাঁড়ায় আল্লাহ তাআলা তাদের উপর রহমত নাযিল করেন এবং তাঁর ফিরিশতারা তাদের জন্য দুআ-ইসতিগফার করে। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৯৯৭

একটু চিন্তা করে দেখি, এ আমলের দ্বারা আমরা শুধু ফিরিশতাদের দুআ-ইসতিগফারই নয়; বরং বান্দার প্রতি আল্লাহর ‘সালাত’ তথা রহমতও লাভ করতে পারি।

উপরোল্লিখিত বর্ণনায় الصف الأَوّل (প্রথম কাতার) শব্দে বর্ণিত হয়েছে; তবে কিছু বর্ণনায় الصفوف الأُوَل (সামনের দিকের কাতারসমূহ)-এই শব্দে বর্ণিত হয়েছে। (দ্র. সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৬৬৪) সে হিসাবে সামনের দিকের কাতারে দাঁড়ানোর মাধ্যমেও এ ফযীলত লাভের আশা করা যায়। সুতরাং সামনের কাতারগুলো পূরণ করার ব্যাপারে যতœবান হওয়া উচিত।

আর সামনের কাতার পুরা করা ফিরিশতাদের ছিফাত। জাবের ইবনে সামুরা রা. থেকে বর্ণিত, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-

أَلَا تَصُفّونَ كَمَا تَصُفّ الْمَلَائِكَةُ عِنْدَ رَبِّهَا؟ فَقُلْنَا يَا رَسُولَ اللهِ، وَكَيْفَ تَصُفّ الْمَلَائِكَةُ عِنْدَ رَبِّهَا؟ قَالَ: يُتِمّونَ الصّفُوفَ الْأُوَلَ وَيَتَرَاصّونَ فِي الصّفِّ.

তোমরা কি সেভাবে কাতারে দাঁড়াবে না, যেভাবে ফিরিশতারা তাদের রবের সামনে দাঁড়ায়! তখন আমরা বললাম, ফিরিশতারা তাদের রবের সামনে কীভাবে কাতারে দাঁড়ায়? তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তারা সামনের কাতারগুলো আগে পূরণ করে এবং মিলে মিলে দাঁড়ায়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৩০

আরেক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

أَتِمّوا الصّفّ الْمُقَدّمَ، ثُمّ الّذِي يَلِيهِ، فَمَا كَانَ مِنْ نَقْصٍ فَلْيَكُنْ فِي الصّفِّ الْمُؤَخّرِ.

তোমরা প্রথম কাতার আগে পুরা কর। এরপর এর পরের কাতার। যদি কোনো কাতার অপূর্ণ থাকতে হয় সেটা সবচেয়ে পেছনের কাতার থাক (অর্থাৎ, সামনের কোনো কাতার যেন অপূর্ণ না থাকে।) -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৬৭১

তবে একেবারে সামনের কাতারে দাঁড়ানোর ফযীলত যে সবচেয়ে বেশি এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তাই সর্বোচ্চ চেষ্টা করা- একেবারে সামনের কাতারে দাঁড়াতে। আবু উমামা রা. থেকে বর্ণিত, একবার একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন-

إِنّ اللهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلّونَ عَلَى الصّفِّ الْأَوّلِ.

যারা প্রথম কাতারে দাঁড়ায় আল্লাহ তাআলা তাদের উপর রহমত নাযিল করেন এবং তাঁর ফিরিশতারা তাদের জন্য দুআ-ইসতিগফার করে।

একথা শুনে সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আল্লাহর রাসূল! দ্বিতীয় কাতারের উপরও? তাদের এ প্রশ্ন শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার বললেন-

إِنّ اللهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلّونَ عَلَى الصّفِّ الْأَوّلِ.

এভাবে তিনবার ঘটার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার বললেন-

وَعَلَى الثّانِي.

হাঁ, দ্বিতীয় কাতারের উপরও! -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২২৬৩

সাত. বিচ্ছিন্ন কাতারকে সংযুক্ত করা

ইতিপূর্বে আমরা জেনেছি আল্লাহর সামনে ফিরিশতারা কীভাবে দাঁড়ায়। তারা গায়ে গায়ে লেগে লেগে মিলে মিলে দাঁড়ায়। কাতারের মাঝে কোনো ফাঁকা রাখে না। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় অসচেতনতা বসত আমরা কাতারের মাঝে বেশ ফাঁকা রেখেই দাঁড়িয়ে যাই। ফলে কাতার বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ বিচ্ছিন্ন

কাতারকে যুক্ত করা অনেক ফযীলতের কাজ। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-

وَمَنْ وَصَلَ صَفّا وَصَلَهُ اللهُ، وَمَنْ قَطَعَ صَفّا قَطَعَهُ اللهُ.

যে ব্যক্তি (বিচ্ছিন্ন) কাতারকে যুক্ত করবে আল্লাহ তাকে (তাঁর রহমতের সাথে) যুক্ত করবেন। আর যে কাতারকে বিচ্ছিন্ন করবে আল্লাহ তাকে (তাঁর রহমত থেকে) বিচ্ছিন্ন করবেন। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৬৬৬

আর বিচ্ছিন্ন কাতারকে যুক্ত করার সবচেয়ে বড় ফযীলত হল এর দ্বারা আল্লাহর রহমত লাভ হয় এবং ফিরিশতাদের দুআ-ইসতিগফার লাভ হয়। আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

إِنّ اللهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلّونَ عَلَى الّذِينَ يَصِلُونَ الصّفُوفَ، وَمَنْ سَدّ فُرْجَةً رَفَعَهُ اللهُ بِهَا دَرْجَةً.

যারা (বিচ্ছিন্ন) কাতারকে যুক্ত করে আল্লাহ তাআলা তাদের উপর রহমত নাযিল করেন এবং তাঁর ফিরিশতারা তাদের জন্য দুআ-ইসতিগফার করে। আর যে কাতারের ফাঁকা জায়গা পূরণ করে আল্লাহ তাদের মর্যাদা সমুন্নত করেন। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৯৯৫; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস ১৫৫০; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ২১৬৪

আট. কাতারের ডান দিকে দাঁড়ানো

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম সব বিষয়ে ডান দিক পছন্দ করতেন। কাতারের ক্ষেত্রেও একই কথা। সাহাবায়ে কেরাম রা. যখন নবীজীর পিছনে নামায পড়তেন তখন কাতারের ডান দিকে দাঁড়াতে চেষ্টা করতেন। বারা ইবনে আযেব রা. বলেন-

كُنّا إِذَا صَلّيْنَا خَلْفَ رَسُولِ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ، أَحْبَبْنَا أَنْ نَكُونَ عَنْ يَمِينِهِ.

আমরা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পিছনে নামায পড়তাম তাঁর ডানে দাঁড়ানো পছন্দ করতাম। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৬১৫

আর হাদীস শরীফে কাতারের ডান দিকে দাঁড়ানোর বিশেষ ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

إِنّ اللهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلّونَ عَلَى مَيَامِنِ الصّفُوفِ.

যারা কাতারের ডান দিকে দাঁড়ায় আল্লাহ তাআলা তাদের উপর রহমত নাযিল করেন এবং তাঁর ফিরিশতারা তাদের জন্য দুআ-ইসতিগফার করে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৬৭৬; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১০০৫; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ২১৬০

সুতরাং স্বাভাবিকভাবে কাতারের ডান দিকে দাঁড়াতে চেষ্টা করব। কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে, কাতারের ডান দিকে দাঁড়ানোর জন্য সামনের কাতারের বাম দিক খালি রেখে পিছনের কাতারের ডান দিকে দাঁড়ানো হবে।

নয়. সাহরী খাওয়ার ফযীলত

সাহরী খাওয়া একটি বরকতপূর্ণ আমল। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহরী খাওয়ার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

تَسَحّرُوا، فَإِنّ فِي السّحُورِ بَرَكَةً.

তোমরা সাহরী খাও; কারণ, সাহরীতে বরকত রয়েছে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯২৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৯৫

এ বরকত লাভের জন্যই সামান্য পানি পান করে হলেও সাহরী খেতে বলা হয়েছে। আর বরকত লাভ ছাড়াও সাহরী দ্বারা অনেক বড় ফযীলত লাভ হয়। ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

إِنّ اللهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلّونَ عَلَى الْمُتَسَحِّرِينَ.

যারা সাহরী খায় আল্লাহ তাআলা তাদের উপর রহমত নাযিল করেন এবং তাঁর ফিরিশতারা তাদের জন্য দুআ-ইসতিগফার করে। -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৩৪৬৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১১০৮৬; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস ৪৮৪০

দশ. ইলমে দ্বীনের শিক্ষক

মানুষকে যারা দ্বীন শেখায় তাদেরকে আল্লাহ অতি উঁচু মর্যাদা দান করেছেন। কারণ, দ্বীন ছাড়া মানুষের জীবন অর্থহীন, দুনিয়া-আখেরাত অর্থহীন, সবকিছুই অর্থহীন। ফলে যারা মানুষকে দ্বীন শিক্ষা দেন তাদের জন্য আসমানের অধিবাসী, যমিনের অধিবাসী, জল-স্থলের অধিবাসী মোটকথা সকলেই দুআ করতে থাকে। আর ‘সকলে’ বলতে বাস্তবেই সকলে- এটা বুঝানোর জন্য হাদীসে বলা হয়েছে, তাঁদের জন্য সমুদ্রের তিমি (হুত) এমনকি গর্তের পিপিলিকাও দুআ করে। আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি রহমত নাযিল করেন, ফিরিশতারা তাঁদের জন্য দুআ-ইসতিগফার করতে থাকে। এর চেয়ে মর্যাদার বিষয় আর কী হতে পারে!

আবু উমামা বাহেলী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

إِنّ اللهَ وَمَلاَئِكَتَهُ وَأَهْلَ السّمَوَاتِ وَالأَرضِينَ حَتّى النّمْلَةَ فِي جُحْرِهَا وَحَتّى الحُوتَ لَيُصَلّونَ عَلَى مُعَلِّمِ النّاسِ الخَيْرَ.

যারা মানুষকে ‘খায়ের’ তথা ইলমে দ্বীন শিক্ষা দেয় আল্লাহ তাআলা তাদের উপর রহমত নাযিল করেন এবং তাঁর ফিরিশতারা তাদের জন্য দুআ-ইসতিগফার করে। আসমান-যমীনের অধিবাসী, গর্তের পিপিলিকা এমনকি সমুদ্রের তিমি (হূত) পর্যন্ত তাদের জন্য দুআ করে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৬৮৫; আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ৭৯১২; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস ৫১৩

এখানে ‘মুআল্লিম’ তথা শিক্ষক দ্বারা উদ্দেশ্য দ্বীন শিক্ষাদানকারী শিক্ষক। যাকে পরিভাষায় অলেম বলা হয়। আলোচ্য বিষয়টি হযরত আবুদ দারদা রা. থেকে বর্ণিত দীর্ঘ হাদীসে এ শব্দে বর্ণিত হয়েছে-

وَإِنّ العَالِمَ لَيَسْتَغْفِرُ لَهُ مَنْ فِي السّمَوَاتِ وَمَنْ فِي الأَرْضِ حَتّى الحِيتَانُ فِي المَاءِ.

আর আলেমের জন্য আসমান-যমীনের অধিবাসী, এমনকি সমুদ্রের তিমি পর্যন্ত ইসতিগফার করে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৬৮২; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৬৪১; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ১৫৭৩

তেমনি ‘খায়ের’ দ্বারাও এখানে ইলমে দ্বীন উদ্দেশ্য, যেমনটি উপরের রেওয়ায়েত থেকে বোঝা যায়। হাদীসের বিভিন্ন ব্যাখ্যাগ্রন্থেও বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। [দ্র. মেরকাতুল মাফাতীহ (আলোচ্য হাদীস); ফয়যুল কদীর ৩/৫০৬]

এগার. নবীজীর উপর দরূদ পাঠ

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি মহব্বত মুমিনের ঈমান। আর এ ঈমানের প্রকাশক্ষেত্র হল, তাঁর আনীত দ্বীন ও সুন্নাহর অনুসরণ এবং তাঁর প্রতি বেশি বেশি দরূদ পাঠ। আর নবীজীর উপর দরূদ পাঠের মাধ্যমে আল্লাহর রহমত লাভ হয়। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

مَنْ صَلّى عَلَيّ صَلَاةً صَلّى الله عَلَيْهِ بِهَا عَشْرًا.

যে ব্যক্তি আমার উপর দরূদ পড়ে আল্লাহ তার প্রতি দশটি রহমত নাযিল করেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩৮৪

আর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর দরূদ পাঠের মাধ্যমে ফিরিশতাদের দুআ-ইসতিগফারও লাভ হয়। কোনো ব্যক্তি যতক্ষণ নবীজীর উপর দরূদ পড়তে থাকে ফিরিশতা তার জন্য দুআ-ইসতিগফার করতে থাকে। আমের ইবনে রবীআ তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

مَا صَلّى عَلَيّ أَحَدٌ صَلَاةً، إِلّا صَلّتْ عَلَيْهِ الْمَلَائِكَةُ مَا دَامَ يُصَلِّي عَلَيّ، فَلْيُقِلّ عَبْدٌ مِنْ ذَلِكَ أَوْ لِيُكْثِرْ.

কোনো ব্যক্তি যতক্ষণ আমার উপর দরূদ পাঠ করতে থাকে ফিরিশতারা তার জন্য দুআ-ইসতিগফার করতে থাকে। এখন ব্যক্তির ইচ্ছা, চাইলে আমার উপর অধিক পরিমাণে দরূদ পাঠ করুক অথবা কম। (যে পরিমাণে দরূদ পাঠ করবে সে হিসাবেই ফিরিশতাদের দুআ-ইসতিগফার লাভ করবে।) -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৫৬৮৯; আলমুনতাখাব মিন মুসনাদে আবদ ইবনু হুমাইদ, হাদীস ৩১৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৯০৭

যাদের জন্য ফিরিশতারা মাগফিরাতের দুআ করে

বারো. রোযাদারের সামনে খাওয়া হলে ফিরিশতা রোযাদারের জন্য দুআ করে

রোযাদারকে আল্লাহ অনেক ভালবাসেন। কত ভালবাসেন- একটি বর্ণনা থেকে তা আমরা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারি। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

...وَلَخُلُوفُ فَمِ الصّائِمِ أَطْيَبُ عِنْدَ اللهِ مِنْ رِيحِ المِسْكِ.

...আর রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশকের চেয়েও প্রিয়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৯২৭

এ বর্ণনা থেকেই উপলব্ধি করা যায়- রোযাদারকে আল্লাহ কত ভালবাসেন। এর কারণ কী? এর কারণ হল, রোযা একমাত্র আল্লাহর জন্য রাখা হয়। রোযার মাঝে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে আল্লাহকে ভয় করার বিষয়টি সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রকাশ পায়। এজন্যই তো শত সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বান্দা এক ঢোক পানিও পান করে না; পানিতে ডুব দিয়েও না, বন্ধ ঘরেও না। এমনকি সে ওযু, গোসল ইত্যাদির সময়ও সতর্ক থাকে- ভুলক্রমেও যেন এক ফোঁটা পানি তার গলার ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে। একারণেই রোযা আল্লাহর এত প্রিয়, রোযাদার আল্লাহর এত প্রিয়পাত্র।

যাইহোক, এত কষ্ট করে একমাত্র আল্লাহর ভয়ে রোযারাখা এ মানুষটির সামনে যখন কোনো মানুষ খায় তখন ফিরিশতারা রোযাদার ব্যক্তির জন্য দুআ করতে থাকে। যতক্ষণ রোযাদারের সামনে খাওয়া হয় ততক্ষণ দুআ করতে থাকে। রহমত ও মাগফিরাতের দুআ করে। কারণ, স্বাভাবিকভাবে রোযাদার ব্যক্তির ক্ষুধার কষ্ট থাকে। এ অবস্থায় রোযাদারের সামনে খেলে তার মানসিক কষ্ট হবে এটাই স্বাভাবিক। এজন্যই ফিরিশতারা তার জন্য মাগফিরাতের দুআ করতে থাকে।

একবার নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মে উমারা রা. বাড়িতে গেলেন। তিনি নবীজীর সামনে খাবার পেশ করলেন। নবীজী তাকেও খেতে অনুরোধ করলেন। তিনি বললেন, আমি তো রোযা আছি। একথা শুনে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-

إِنّ الصّائِمَ تُصَلِّي عَلَيْهِ الْمَلاَئِكَةُ إِذَا أُكِلَ عِنْدَهُ حَتّى يَفْرُغُوا.

রোযাদারের সামনে খাওয়া হলে খাওয়া শেষ পর্যন্ত ফিরিশতারা রোযাদারের জন্য (মাগফিরাতের) দুআ করতে থাকে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৭৮৫; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৩৪৩০

(ইমাম তিরমিযী রাহ. বলেন-

هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ)

এ থেকে এ বিষয়টিও বুঝে আসে, ওযর না থাকলে রোযাদারের সামনে খাওয়াটা উচিত নয়। কারণ, এতে রোযাদারের কষ্ট হয়। ফলে হতে পারে রোযাদারের জন্য ফিরিশতা মাগফিরাতের দুআ করবে ঠিকই; কিন্তু আমার জন্য বদদুআ করতে পারে। আর ফিরিশতার দুআ যেমন কবুলের সম্ভাবনা বেশি তেমনি বদদুআও...। সুতরাং একান্ত অপারগতা ছাড়া আমরা রোযাদারের সামনে খাব না।

তেরো. দ্বীনের আলেম-তালিবুল ইলম : যার জন্য মাগফিরাতের দুআ করে...

মুসলিমের জন্য প্রথম যে ওহী নাযিল হয়েছে তা হল- اِقْرَأْ (পড়)। ফলে পড়া তথা দ্বীনী ইলম অর্জন করা মুসলিমের জীবনের সাধারণ বিষয়। মুসলিম হতে হলে পড়তে হবে। দ্বীনের উপর চলতে হলে পড়তে হবে। পড়া ছাড়া মুসলিমের কোনো গত্যন্তর নেই। এজন্যই প্রতিটি মুসলিমকেই দ্বীনী ইলম অর্জন করতে হয় এবং প্রতিটি মুসলিমই তালিবুল ইলম। আর যে মুসলিম দ্বীনী ইলমের ক্ষেত্রে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন তিনি হলেন আলেম। সকলের পক্ষে আলেম হওয়া সম্ভব না হলেও তালিবুল ইলম হওয়া তো সম্ভব; বরং আরেক ভাষায় বলি, আলেম হতে না পারলেও প্রতিটি মুসলিমকে ‘তালিবুল ইলম’ তো হতেই হবে। তাহলে আসমান-যমীনের সকল অধিবাসি আমাদের জন্য মাগফিরাতের দুআ করবে; এমনকি সমুদ্রের মাছ, গর্তের পিপিলিকা পর্যন্ত এদের জন্য মাগফিরাতের দুআ করে। আবুদ দারদা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলত শুনেছি-

مَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَبْتَغِي فِيهِ عِلْمًا سَلَكَ اللهُ بِهِ طَرِيقًا إِلَى الجَنّةِ، وَإِنّ المَلَائِكَةَ لَتَضَعُ أَجْنِحَتَهَا رِضًا لِطَالِبِ العِلْمِ، وَإِنّ العَالِمَ لَيَسْتَغْفِرُ لَهُ مَنْ فِي السّمَوَاتِ وَمَنْ فِي الأَرْضِ حَتّى الحِيتَانُ فِي المَاءِ.

যে ব্যক্তি ইলমের জন্য পথ চলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন। আর ফিরিশতারা তালিবুল ইলমের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে ডানা রেখে দেন। আর আলেমের জন্য আসমান ও যমিনের অধিবাসিরা ইসতিগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) করে। এমনকি সমুদ্রের মাছ পর্যন্ত তাঁদের জন্য ইসতিগফার করে...। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৬৮২; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৬৪১; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ১৫৭৩; আলমাদখাল ইলাস সুনানিল কুবরা, বায়হাকী, হাদীস ৩৪৭

দ্রষ্টব্য : কেউ কেউ এই হাদীসের لَتَضَعُ أَجْنِحَتَهَا এই বাক্যের ব্যাখ্যা করেছেন- ‘ডানা বিছিয়ে দেয়া’। আবার কেউ বলেছেন, এর অর্থ হল, ‘তালিবুল ইলমের সম্মানে বিনয়াবনত হওয়া’। কেউ বলেছেন, ‘উড্ডয়ন বন্ধ করে থেমে যাওয়া ও যিকিরের জন্য অবতরণ করা।’ মূলত এ বাক্যের মাঝে এ সবক’টি অর্থেরই অবকাশ রয়েছে।

কিছু বর্ণনায় ‘আলেম’-এর স্থলে ‘তালিবুল ইলম’ শব্দ এসেছে। সে হিসাবে আলেম তালিবুল ইলম উভয়েই এই ফযীলতে শামিল। আর বাস্তবে আলেমও তো তালিবুল ইলম-ই।

আর অলোচ্য বর্ণনায় তলবে ইলমের একটি সুন্দর গল্পও রয়েছে। সে গল্পটিসহ ‘তালিবুল ইলম’ শব্দে বর্ণিত রেওয়াতটি পেশ করছি-

কাছীর ইবনে কায়স রাহ. বলেন, একদিন আমি দামেস্কের মসজিদে আবুদ দারদা রা.-এর কাছে বসা ছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি আগমন করলেন। তিনি বললেন, আবুদ দারদা! আমি মদীনা থেকে এসেছি-মাদীনাতুর রাসূল থেকে। আমার আসার উদ্দেশ্য হল, আমি জানতে পেরেছি যে, আপনি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করেন (অমুক হাদীস)। আমি আপনার মুখ থেকে তা সরাসরি শোনার জন্য এসেছি।

তখন আবুদ দারদা রা. বললেন, তুমি ব্যবসার উদ্দেশ্যে আসনি তো? তিনি বললেন, না। তিনি আবার বললেন, ব্যবসা ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে এসেছ? এবারও লোকটি বলল, না; (আমি কেবল আপনার মুখ থেকে হাদীস শোনার জন্যই সুদূর মদীনা থেকে দামেস্কে এসেছি। একথা শুনে) আবুদ দারদা রা. বললেন, আমি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি-

مَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَلْتَمِسُ فِيهِ عِلْمًا، سَهّلَ اللهُ لَهُ طَرِيقًا إِلَى الْجَنّةِ، وَإِنّ الْمَلَائِكَةَ لَتَضَعُ أَجْنِحَتَهَا رِضًا لِطَالِبِ الْعِلْمِ، وَإِنّ طَالِبَ الْعِلْمِ يَسْتَغْفِرُ لَهُ مَنْ فِي السّمَاءِ وَالْأَرْضِ، حَتّى الْحِيتَانِ فِي الْمَاءِ.

যে ব্যক্তি ইলমের জন্য পথ চলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন। আর ফিরিশতারা তালিবুল ইলমের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে ডানা রেখে দেন। আর তালিবুল ইলমের জন্য আসমান ও যমিনের অধিবাসিরা ইসতিগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) করে। এমনকি সমুদ্রের মাছ পর্যন্ত তাঁদের জন্য ইসতিগফার করে...। (দ্র. সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২২৩; সুনানুদ দারেমী, হাদীস ৩৫৪)

আলোচ্য বর্ণনায় ‘আসমানের অধিবাসি’ দ্বারা উদ্দেশ্য, ফিরিশতা। সুতরাং আমরা বলতে পারি, আলেম-তালিবুল ইলমের জন্যও ফিরিশতারা মাগফিরাতের দুআ করেন। আল্লাহ আমাদের সকলকে ইলম অন্বেষণের তাওফীক দান করুন; আলেম বা তালিবুল ইলম হিসাবে কবুল করুন- আমীন।

এ পর্যন্ত আমরা ১৩টি বিষয় জানলাম, যার কারণে ফিরিশতারা মাগফিরাতের দুআ করেন। সামনে আমরা গোনাহ মাফ হওয়ার আরো কিছু সাধারণ আমল বা বিষয় জানব।

সোম ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখি : এদিন গোনাহ মাফ করা হয়...

আমাদের গোনাহ যত ব্যাপক, আল্লাহর ক্ষমার দুয়ার বা বলি ক্ষমার বাহানা-উপলক্ষ্য তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি ও বিস্তৃত। প্রয়োজন শুধু বান্দার আল্লাহমুখী হওয়া, ফিরে আসা; আল্লাহর ক্ষমা ও রহমতের দরিয়ায় অবগাহন করা।

তেমনি একটি উপলক্ষ্য হল, সোম ও বৃহস্পতিবারের রোযা। সপ্তাহের দিনগুলোর মধ্যে সোম ও বৃহস্পতিবার গুরুত্বপূর্ণ। আমলের মাধ্যমে কল্যাণ লাভের বিচারে সপ্তাহের সব দিনই গুরুত্বপূর্ণ, তবে কিছু দিবস একটু বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে।

সোমবার তো বিভিন্ন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ; যাঁর মাধ্যমে আমরা আমাদের রবকে চিনেছি, যাঁর মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের হেদায়েত দিয়েছেন, যাঁর মাধ্যমে আমরা ওহীর আলোর সন্ধান পেয়েছি, যাঁর মাধ্যমে..., যাঁর মাধ্যমে..., সরকারে দো আলম, সায়্যিদুল মুরসালীন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দিনেই জন্মগ্রহণ করেছেন। যে কিতাবের মাধ্যমে আমরা রবের কালাম লাভ করেছি, আসমানী নূরে স্নাত হয়েছি, হেদায়েতের বাণী লাভ করেছি- সে কিতাবও নাযিল হয়েছে সোমবারে। আবু কাতাদা আনসারী রা. থেকে বর্ণিত-

أَنّ رَسُولَ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ سُئِلَ عَنْ صَوْمِ الِاثْنَيْنِ؟

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সোমবারের রোযা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হল। (এ দিনের রোযার ফযীলত কী? বা কেন আপনি গুরুত্বের সাথে এদিন রোযা রাখেন?) তিনি তখন উত্তরে বললেন-

فِيهِ وُلِدْتُ وَفِيهِ أُنْزِلَ عَلَيّ.

এ দিনেই অমি জন্মলাভ করেছি এবং এ দিনেই আমার উপর ওহী নাযিল হয়েছে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬২

এছাড়াও আরো কারণ রয়েছে- নবীজীর প্রিয় সাহাবী উসামা বিন যায়েদ রা. একবার নবীজীকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনাকে অনেক গুরুত্বের সাথে দুই দিন রোযা রাখতে দেখি! নবীজী তখন জিজ্ঞেস করলেন-

أَيّ يَوْمَيْنِ؟

কোন্ দুই দিনের কথা বলছ, উসামা!

তিনি বললেন, সোম ও বৃহস্পতিবার।

তখন নবীজী বললেন-

ذَانِكَ يَوْمَانِ تُعْرَضُ فِيهِمَا الْأَعْمَالُ عَلَى رَبِّ الْعَالَمِينَ، فَأُحِبّ أَنْ يُعْرَضَ عَمَلِي وَأَنَا صَائِمٌ.

এ দু’দিন রাব্বুল আলামীনের সামনে বান্দার আমলসমূহ পেশ করা হয়; ফলে আমি চাই- আমার আমল পেশ করার সময় আমি রোযা অবস্থায় থাকি। -সুনানে নাসায়ী, হাদীস ২৩৫৮

আর কেমন গুরুত্বের সাথে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোম ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখতেন! আয়েশা রা. বলেন-

كَانَ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يَتَحَرّى صَوْمَ الِاثْنَيْنِ وَالخَمِيسِ.

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গুরুত্বের সাথে খোঁজ রেখে রেখে সোম ও বৃহস্পতিবারের রোযা রাখতেন! -জামে তিরমিযী, হাদীস ৭৪৫

আর এ দুই দিনের রোযার সবচেয়ে বড় ফযীলত হল, এর মাধ্যমে আল্লাহ গোনাহ মাফ করেন। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (গুরুত্বের সাথে) সোম ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখতেন। ফলে নবীজীকে জিজ্ঞাসা করা হল-

يَا رَسُولَ اللهِ إِنّكَ تَصُومُ الِاثْنَيْنِ وَالْخَمِيسَ؟

আল্লাহর রাসূল! আপনি (গুরুত্বের সাথে) সোম ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখেন! (এর কারণ কী?)। তখন নবীজী বললেন-

إِنّ يَوْمَ الِاثْنَيْنِ وَالْخَمِيسَ يَغْفِرُ اللهُ فِيهِمَا لِكُلِّ مُسْلِمٍ، إِلّا مُتَهَاجِرَيْنِ، يَقُولُ: دَعْهُمَا حَتَّى يَصْطَلِحَا.

সোম ও বৃহস্পতিবারে আল্লাহ সকল মুসলিমকে ক্ষমা করে দেন। তবে ঐ দুই ব্যক্তি ছাড়া, যারা একে অপরকে বর্জন করেছে। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘তারা পরস্পর মিলে যাওয়া পর্যন্ত এদেরকে আপন অবস্থায় ছেড়ে দাও।’ -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৭৪০

আল্লাহ আমাদের সোম ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখার তাওফীক দান করুন, হিংসা-বিবাদ-বিদ্বেষ থেকে রক্ষা করুন এবং আমাদের গোনাহগুলো ক্ষমা করুন- আমীন।

জনমানবহীন মাঠে-ময়দানে, পাহাড়-পর্বতে আযান দিয়ে নামায পড়া...

মানুষ যখন কেবল আল্লাহর ভয়ে তাঁর ইবাদত করে আল্লাহ খুশি হন। আর তা যদি হয় জনমানবহীন মরুভূমিতে, বা পাহাড়েরর চূড়ায়, কিংবা জনমানবহীন মাঠে-ময়দানে তখন আল্লাহ আরো বেশি খুশি হন।

আমরা জানি, জামাতে নামায আদায় করলে একাকী নামাযের তুলনায় পঁচিশ থেকে সাতাশ গুণ বেশি সওয়াব হয়। কিন্তু এক হাদীসে এসেছে, জনমানবহীন প্রান্তরে নামায আদায় করলে পঞ্চাশ নামাযের সওয়াব লাভ হয়। আবু সাঈদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

الصّلَاةُ فِي الْجَمَاعَةِ تَعْدِلُ خَمْسًا وَعِشْرِينَ صَلَاةً فَإِذَا صَلّاهَا في الْفَلَاةِ فَأَتَمّ رُكُوعَهَا وَسُجُودَهَا بَلَغَتْ خَمْسِينَ صَلَاةً.

জামাতে নামায আদায়ের দ্বারা পঁচিশ নামাযের সওয়াব লাভ হয়। কিন্তু যদি জনমানবহীন প্রান্তরে তা আদায় করা হয় এবং পূর্ণরূপে রুকু-সিজদা আদায় করা হয়- এর দ্বারা পঞ্চাশ নামাযের সওয়াব লাভ হয়। -শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ২৫৭২; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫৬০; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ৭৫৩

স্বাভাবিকভাবে এ হাদীস থেকে যদিও বোঝা যায় যে, একাকী পড়–ক বা জামাতে পড়–ক- এ সওয়াব লাভ হবে। কিন্তু এর দ্বারা ‘জামাতে পড়া’ উদ্দেশ্য নেওয়াটাই বেশি যুক্তিযুক্ত। ইবনে হাজার রাহ. ফাতহুল বারীতে বলেন-

حَمْلُهُ عَلَى الْجَمَاعَةِ أَوْلَى وَهُوَ الّذِي يَظْهَرُ مِنَ السِّيَاقِ.

এখানে ‘জামাতে নামায’ উদ্দেশ্য নেওয়াটাই বেশি ভালো (ও যুক্তিযুক্ত)। কারণ, হাদীসের আগ-পর বিচারে এ অর্থই বুঝা যায়। -ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ২/১৩৫

আর যে ব্যক্তি এমন জনমানবহীন প্রান্তরে একাকী আযান-ইকামাত দিয়ে নামায আদায় করে, তার পেছনে ফিরিশতারা নামায আদায় করে। দৃষ্টিসীমার শেষ পর্যন্ত অসংখ্য ফিরিশতা তার নামাযে শরীক হয়। সালমান ফারসী রা. থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

إِذَا كَانَ الرّجُلُ بِأَرْضِ قِيٍّ فَحَانَتِ الصّلَاةُ فَلْيَتَوَضّأْ، فَإِنْ لَمْ يَجِدْ مَاءً فَلْيَتَيَمّمْ، فَإِنْ أَقَامَ صَلّى مَعَهُ مَلَكَاهُ، وَإِنْ أَذّنَ وَأَقَامَ صَلّى خَلْفَهُ مِنْ جُنُودِ اللهِ مَا لَا يُرَى طَرَفَاهُ.

যখন কোনো ব্যক্তি জনমানবহীন নির্জন ভূমিতে অবস্থান করে এবং নামাযের সময় হয় তখন যেন সে ওযু করে। পানি না পেলে তায়াম্মুম করে নেয়। এ অবস্থায় যদি সে ইকামাত দিয়ে নামায আদায় করে তখন সাথের ফিরিশতাদ্বয় তার সাথে নামাযে শরীক হয়। আর যদি আযান-ইকামাত উভয়টি দিয়ে নামাযে দাঁড়ায় তখন তার পেছনে দৃষ্টিসীমার শেষ পর্যন্ত আল্লাহর সৈনিকেরা (ফিরিশতারা) দাঁড়িয়ে যায়। -মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীস ১৯৫৫; আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ৬১২০; সুনানে কুবরা, বায়হাকী, হাদীস ১৯০৮

আর সবচেয়ে বড় কথা হল, জনমানবহীন প্রান্তরে যখন কেউ আযান দিয়ে নামায আদায় করে তখন আল্লাহ এত খুশি হন যে, তাকে নিয়ে ফিরিশতাদের কাছে গর্ব করেন এবং ঐ বান্দাকে মাফ করে দেন। উকবা ইবনে আমের রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

يَعْجَبُ رَبّكُمْ مِنْ رَاعِي غَنَمٍ فِي رَأْسِ شَظِيّةٍ بِجَبَلٍ، يُؤَذِّنُ بِالصّلَاةِ، وَيُصَلِّي، فَيَقُولُ اللهُ عَزّ وَجَلّ: انْظُرُوا إِلَى عَبْدِي هَذَا يُؤَذِّنُ، وَيُقِيمُ الصّلَاةَ، يَخَافُ مِنِّي، قَدْ غَفَرْتُ لِعَبْدِي وَأَدْخَلْتُهُ الْجَنّةَ.

তোমাদের রব ঐ মেষপালকের প্রতি খুশি হন, যে পাহাড়ের চূড়ায় আযান দিয়ে নামায আদায় করে। আল্লাহ তাআলা বলেন, দেখো, আমার এই বান্দা আমার ভয়ে আযান দিয়ে নামায পড়ছে।

এরপর আল্লাহ বলেন, আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম এবং তাকে জান্নাত দান করলাম। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১২০৩; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৬৬৬; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ১৬৬০

সুতরাং জনমানবহীন প্রান্তরে একাকী থাকলেও আমরা আযান-ইকামত দিয়ে নামায আদায় করব। যাতে এই ফযীলত লাভ করতে পারি।

নামাযের শেষ বৈঠকে যে ব্যক্তি এই দুআ পড়বে...

বান্দার ক্ষমা চাওয়া বা ইসতিগফারের যত মুহূর্ত ও ক্ষেত্র রয়েছে এর মধ্যে নামায সবচেয়ে উত্তম ক্ষেত্র। বিশেষ করে নামাযের শেষ বৈঠক। আবু বকর রা. নবীজীর কাছে নামাযে পড়ার জন্য দুআ শেখানোর অনুরোধ করলে নবীজী ইসতিগফার বা ক্ষমাপ্রার্থনার দুআ শিখিয়ে দেন-

اللّهُمّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي ظُلْمًا كَثِيرًا، وَلاَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلّا أَنْتَ، فَاغْفِرْ لِي مَغْفِرَةً مِنْ عِنْدِكَ، وَارْحَمْنِي إِنّكَ أَنْتَ الغَفُورُ الرّحِيمُ.

এ দুআ আমাদের সবার জানা। এসময় পড়ার মত আরেকটি দুআর কথাও হাদীসে এসেছে। মিহজান ইবনুল আরদা‘ রা. বলেন-

أَنّ رَسُولَ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ دَخَلَ الْمَسْجِدَ، إِذَا رَجُلٌ قَدْ قَضَى صَلَاتَهُ وَهُوَ يَتَشَهّدُ، فَقَالَ: اللّهُمّ إِنِّي أَسْأَلُكَ يَا اَللهُ بِأَنّكَ الْوَاحِدُ الْأَحَدُ الصّمَدُ، الّذِي لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ، أَنْ تَغْفِرَ لِي ذُنُوبِي، إِنّكَ أَنْتَ الْغَفُورُ الرّحِيمُ، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: قَدْ غُفِرَ لَهُ، ثَلَاثًا.

একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে প্রবেশ করলেন। দেখলেন এক ব্যক্তি নামাযের শেষ বৈঠকে তাশাহহুদ পড়ছে। এরপর সে এ বাক্যে দুআ করল, ইসতিগফার করল-

اللّهُمّ إِنِّي أَسْأَلُكَ يَا اَللهُ بِأَنّكَ الْوَاحِدُ الْأَحَدُ الصّمَدُ، الّذِي لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ، أَنْ تَغْفِرَ لِي ذُنُوبِي، إِنّكَ أَنْتَ الْغَفُورُ الرّحِيمُ.

তা শুনে নবীজী বললেন-

قَدْ غُفِرَ لَهُ (ثَلَاثًا)

তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে, তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে, তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। -সুনানে নাসায়ী, হাদীস ১৩০১; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৯৮৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৮৯৭৪

হজ্ব শেষে হলক করি, নবীজীর মাগফিরাতের দুআয় হিসসা নিই

হজ্ব শেষে হালাল হওয়ার জন্য আমরা হলক (মাথা মুণ্ডানো) বা কসর (চুল ছাঁটা) করে থাকি। হলক বা কসর যেটাই করা হোক হালাল হয়ে যাবে; কিন্তু হলক করা উত্তম। হাদীস শরীফে হলকের আলাদা ফযীলতও বর্ণিত হয়েছে। হলককারীদের জন্য নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন বার মাগফিরাতের দুআ করেছেন। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-

اللهُمّ اغْفِرْ لِلْمُحَلِّقِينَ.

আল্লাহ! তুমি হলককারীদের মাফ করে দাও।

একথা শুনে কিছু সাহাবী বললেন-

يَا رَسُولَ اللهِ، وَلِلْمُقَصِّرِينَ؟

আল্লাহর রাসূল! কসরকারীদের জন্যও দুআ করুন!

নবীজী আবার বললেন-

اللهُمّ اغْفِرْ لِلْمُحَلِّقِينَ.

আল্লাহ! তুমি হলককারীদের মাফ করে দাও।

তারা আবার বললেন-

يَا رَسُولَ اللهِ، وَلِلْمُقَصِّرِينَ؟

আল্লাহর রাসূল! কসরকারীদের জন্যও দুআ করুন!

একথা শুনে নবীজী আবার বললেন-

اللهُمّ اغْفِرْ لِلْمُحَلِّقِينَ.

আল্লাহ! তুমি হলককারীদের মাফ করে দাও।

তারা আবারও বললেন-

يَا رَسُولَ اللهِ، وَلِلْمُقَصِّرِينَ؟

আল্লাহর রাসূল! কসরকারীদের জন্যও দুআ করুন!

এবার নবীজী বললেন-

وَلِلْمُقَصِّرِينَ

আল্লাহ! তুমি কসরকারীদেরও মাফ করে দাও। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৩০২; সহীহ বুখারী, হাদীস ১৭২৮

সালাম দিই, ভালো কথা বলি...

কারো সাথে সাক্ষাৎ হলে আমরা সালাম দিই। তারপর হাসিমুখে কুশল বিনিময় করি। মুসলিম হিসেবে এটি আমাদের সাধারণ অভ্যাস। এটি ইসালামেরই শিক্ষা। ইসলামের বদৌলতেই এটি আমাদের জীবনের সাধারণ ব্যাপার; কিন্তু বাস্তবে এর মূল্য অনেক। মূল্যটা বুঝে আসে- এর বিপরীত চিত্রটা সামনে এলে। অর্থাৎ পরস্পর সাক্ষাতে সালাম ও হাসিমুখের পরিবর্তে যদি একজন অপরজন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তখন বুঝে আসে- এ সাধারণ বিষয়টি কত মূল্যবান এবং এর বিপরীত বিষয়টি কত নিন্দনীয়।

এ বিপরীত দিকটিকে ইসলামে কঠিনভাবে নিন্দা করা হয়েছে। একে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-

لاَ يَحِلّ لِمُسْلِمٍ أَنْ يَهْجُرَ أَخَاهُ فَوْقَ ثَلاَثَةِ أَيّامٍ.

কোনো মুসলিমের জন্য বৈধ নয় যে, সে তার ভাইকে তিন দিনের বেশি সময় পর্যন্ত বর্জন করবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬০৬৫

পরস্পরে মনোমালিন্য হতে পারে, মান-অভিমান হতে পারে; কিন্তু এ কারণে তিন দিনেরও বেশি সময় নিজ ভাইকে বর্জন করা- এটা মুসলিমের জন্য সাজে না।

আরেক বর্ণনায় এ বর্জনের চিত্র সামনে আনা হয়েছে এবং এ অবস্থা থেকে প্রথমে যে বেরিয়ে আসে অর্থাৎ সালাম দিয়ে মিলে যায় তার প্রসংশা করা হয়েছে। আবু আইয়ূব আনসারী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

لاَ يَحِلّ لِرَجُلٍ أَنْ يَهْجُرَ أَخَاهُ فَوْقَ ثَلاَثِ لَيَالٍ، يَلْتَقِيَانِ: فَيُعْرِضُ هَذَا وَيُعْرِضُ هَذَا، وَخَيْرُهُمَا الّذِي يَبْدَأُ بِالسّلاَمِ.

কোনো ব্যক্তির জন্য বৈধ নয় যে, সে তার ভাইকে তিন রাতের বেশি সময় পর্যন্ত বর্জন করবে; দেখা হলে এ ওর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, ও এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এদের মধ্যে সে-ই শ্রেষ্ঠ, যে প্রথমে সালাম দেয় (এবং মিলে যায়)। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬০৭৭

হাঁ, আরো কঠোর ভাষায় নিন্দা করা হয়েছে এ মন্দ কর্মের; এমন ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার সাধারণ ক্ষমা থেকে বঞ্চিত হয়। এক হাদীসে ইরশাদ হয়েছে-

إِنّ يَوْمَ الِاثْنَيْنِ وَالْخَمِيسَ يَغْفِرُ اللهُ فِيهِمَا لِكُلِّ مُسْلِمٍ، إِلّا مُتَهَاجِرَيْنِ، يَقُولُ: دَعْهُمَا حَتَّى يَصْطَلِحَا.

সোম ও বৃহস্পতিবারে আল্লাহ প্রতিটি মুসলিমকে ক্ষমা করে দেন। তবে ঐ দুই ব্যক্তি ছাড়া, যারা একে অপরকে বর্জন করেছে। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘তারা পরস্পর মিলে যাওয়া পর্যন্ত এদেরকে আপন অবস্থায় ছেড়ে দাও।’ -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৭৪০

হাঁ, একে অপরকে বর্জন করার দ্বারা বান্দা আল্লাহর সাধারণ ক্ষমা থেকেও বঞ্চিত হয়। পক্ষান্তরে সালাম দেওয়া, হাসিমুখে উত্তম কথা বলার দ্বারা ক্ষমা লাভ হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

إِنّ مِنْ مُوجِبَاتِ الْمَغْفِرَةِ بَذْلُ السّلَامِ، وَحُسْنُ الْكَلَامِ.

যেসকল আমলের মাধ্যমে মাগফিরাত লাভ হয় এর মধ্যে অন্যতম প্রধান হল, বেশি বেশি সালাম দেওয়া এবং ভালো কথা বলা। -আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ৪৬৯; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস ১২৭২৩; মাকারিমুল আখলাক, খারাইতী, হাদীস ১৪৬

ঋণগ্রহিতাকে ক্ষমা করলে বা ছাড় দিলে...

ক্ষমার প্রতিদান ক্ষমা। যেমন আল্লাহ সূরা আররাহমানে বলেছেন- ‘ইহসানের প্রতিদান তো ইহসানই।’ আল্লাহ হলেন, ‘গাফফার’-মহা ক্ষমাশীল। তিনি ছোট থেকে ছোট বাহানায়ও বান্দাকে ক্ষমা করে দেন।

এমন রবের বান্দা যদি অপর বান্দাকে ক্ষমা করে তিনি কি বান্দাকে ক্ষমা না করে পারেন? আর যদি বান্দা ক্ষমাই করে এই আশায় যে, (এই ক্ষমার বিনিময়ে) আল্লাহ যেন তাকে ক্ষমা করে দেন, তাহলে!

আসুন, সবাইকে ক্ষমা করে দিই; এভাবে- আমি সবাইকে ক্ষমা করে দিলাম। আখেরাতে আমার কারণে আর কেউ পাকাড়াও হবে না; সবাইকে মাফ করে দিলাম, সব হক ছেড়ে দিলাম। তাহলে হতে পারে- এর বিনিময়ে আল্লাহ্ও আখেরাতে আপনাকে ঠেকাবেন না। আপনার সব গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন। এমনকি আশা করা যায়, আপনার উপর যদি কারো হক বাকি থাকে তো আল্লাহ তার জামিন হয়ে যাবেন; আপনার পক্ষ থেকে আল্লাহ তাকে খুশি করে দেবেন।

সুতরাং ক্ষমা পেতে ক্ষমা করুন। এমনকি ঐ চোরকেও, যে আপনার সখের কোনো বস্তু চুরি করেছে। কারণ, ক্ষমা না করলেও আপনি ঐ বস্তু আর ফিরে পাচ্ছেন না; কিন্তু ক্ষমা করার কারণে তার চেয়ে আরো দামি জিনিষ-‘ক্ষমা’ লাভ করা সম্ভব। সুতরাং এটা তো লাভেরই সওদা!

দুনিয়ার ছোট ছোট বিষয়ে ক্ষমা করার দ্বারা আপনি লাভ করতে পারেন মহা ক্ষমা। হতে পারে আল্লাহ জাহান্নাম থেকে ক্ষমা করে দেবেন; জাহান্নাম থেকে পানাহ দেবেন; ছোট্ট কোনো বিষয়ে ক্ষমার কারণে। শুনুন নবীজীর বাণী-

كَانَ رَجُلٌ يُدَايِنُ النَّاسَ، فَكَانَ يَقُولُ لِفَتَاهُ: إِذَا أَتَيْتَ مُعْسِرًا فَتَجَاوَزْ عَنْهُ، لَعَلَّ اللهَ يَتَجَاوَزُ عَنَّا، فَلَقِيَ اللهَ فَتَجَاوَزَ عَنْهُ.

এক ব্যক্তি লোকদের ঋণ দিত বা বাকিতে পণ্য দিত। সে তার খাদেম বা কর্মচারীকে বলত, যদি ব্যক্তি অস্বচ্ছল হয় তাহলে ছাড় দিও (বা মাফ করে দিও); আশা করা যায়, এর বিনিময়ে আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন। এরপর যখন সে (ইন্তেকাল করল এবং) আল্লাহ্র সাথে সাক্ষাৎ করল আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিলেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫৬২; সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৪৮০

পথ হতে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দিই : আমলের খাতা থেকে আল্লাহ আমার গোনাহগুলো সরিয়ে দেবেন

আমাদের গোনাহগুলো আখেরাতে আমাদের কষ্টের কারণ। আমাদের গোনাহগুলো আমাদের জন্য জান্নাতের পথের কাঁটা। এখন কীভাবে আমরা আখেরাতে কষ্টের এ কারণ থেকে মুক্তি পাব, জান্নাতের পথের কাঁটাগুলো অপসারিত করব। এজন্য আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের অনেক আমল বাতলেছেন। ছোট্ট একটি আমল নিয়ে আলোচনা করব, যার মাধ্যমে আল্লাহ আখেরাতের কষ্ট এবং জান্নাতের পথের কাঁটা দূর করে দেবেন।

আমলটি হল, মানুষ কষ্ট পাবে-পথে এমন কিছু দেখলে তা অপসারিত করা, সরিয়ে দেওয়া। এই ছোট্ট কাজটির দ্বারা আল্লাহ আমলের খাতা থেকে আমার গোনাহগুলো সরিয়ে দেবেন।

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

بَيْنَمَا رَجُلٌ يَمْشِي بِطَرِيقٍ وَجَدَ غُصْنَ شَوْكٍ عَلَى الطّرِيقِ فَأَخرَهُ، فَشَكَرَ اللهُ لَهُ فَغَفَرَ لَهُ.

এক ব্যক্তি পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। দেখল, পথের মাঝে একটি কাঁটাদার ডাল পড়ে আছে। (এতে মানুষের কষ্ট হবে তাই) সে ডালটি পথ থেকে সরিয়ে রাখল। আল্লাহ তার এই কাজে খুশি হলেন এবং তাকে মাফ করে দিলেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৫২; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯১৪

হাঁ, এ তো মুমিনের সাধারণ বৈশিষ্ট্য; এ তো মুমিনের ঈমানের প্রমাণ। মুমিন পরোপকারী হবে। মুমিন অন্যের কষ্ট দূর করতে সচেষ্ট হবে। এজন্যই তো পথ হতে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেয়া, অন্যের কষ্ট দূর করতে সচেষ্ট হওয়া; অন্য ভাষায় পরোপকারী হওয়া মুমিনের ঈমানের ন্যূনতম আলামত। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

الْإِيمَانُ بِضْعٌ وَسَبْعُونَ -أَوْ بِضْعٌ وَسِتّونَ- شُعْبَةً، فَأَفْضَلُهَا قَوْلُ لَا إِلهَ إِلّا اللهُ، وَأَدْنَاهَا إِمَاطَةُ الْأَذَى عَنِ الطّرِيقِ، وَالْحَيَاءُ شُعْبَةٌ مِنَ الْإِيمَانِ.

ঈমানের সত্তরটিরও (বা নবীজী বলেছেন, ষাটটিরও) বেশি শাখা-প্রশাখা রয়েছে। তন্মধ্যে সর্বাপেক্ষা উত্তম শাখা হচ্ছে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা। আর সর্বনিম্নশাখা হচ্ছে (পথ চলার সময়) পথ হতে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেয়া। আর লজ্জা ঈমানের একটি অঙ্গ। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩৫

মুসলিম সবসময় চেষ্টা করে, তার কারণে যেন কেউ কষ্ট না পায়; বরং সে অন্যের কষ্ট দূর করতে চেষ্টা করে। অন্যকে আরাম পৌঁছাতে চেষ্টা করে। আরেক ভাই যেন কষ্টের শিকার না হন এজন্য সে নিজে কষ্ট করে। এটিই মুমিনের আখলাক। এটিই নবীজীর শিক্ষা।

এর প্রতি উৎসাহিত করার জন্য এ কাজটিকে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি সদাকা হিসেবে ঘোষণা করেছেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, পথ হতে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেয়া একটি সদাকা। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৯৮৯

অনেকসময় এমন হয় যে, আমি মানুষের কষ্টের কারণ হচ্ছি, কিন্তু সেদিকে আমার নযর যাচ্ছে না। যেমন রাস্তার পাশে ময়লা ফেলে রাখা, যার কারণে ঐ পথ দিয়ে চলতে মানুষের কষ্ট হয়। নাক চেপে ধরে ঐ পথ অতিক্রম করতে হয়। আমার নিজেরও এর কারণে কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু আমি খেয়াল করছি না-এর কারণ আমি নিজেই। সুতরাং সচেতন হব।

আর এটি সামাজিক সচেতনতারও বিষয়। একজনকে দেখে আরেকজন শেখার বিষয়। আমি যদি এ ব্যাপারে যত্নবান হই তাহলে অন্যরা আমাকে দেখে শিখবে; তেমনি ছোটরাও আমাকে দেখে শিখবে এবং এটা তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাবে।

র্কুরা ইবনে ইয়াস আলমুযানী রাহ. তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি একবার মা‘কিল ইবনে ইয়াসার রা.-এর সাথে কোথাও যাচ্ছিলাম। পথে তিনি একটি কষ্টদায়ক বস্তু দেখে সরিয়ে দিলেন। কিছুদূর পর আমিও এমন একটি কষ্টদায়ক বস্তু দেখে সরিয়ে দিলাম। তখন তিনি আমার হাত ধরে বললেন, ভাতিজা! কোন্ জিনিস তোমাকে এ কাজে উদ্বুদ্ধ করল? উত্তরে তিনি বললেন, আপনাকে দেখে শিখলাম। আপনার অনুসরণ করলাম। তখন তিনি বললেন, (তাহলে শোনো বলি!) আমি নিজ কানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি-

مَنْ أَمَاطَ أَذًى عَنْ طَرِيقِ الْمُسْلِمِينَ كُتِبَتْ لَهُ حَسَنَةٌ، وَمَنْ تُقُبِّلَتْ مِنْهُ حَسَنَةٌ دَخَلَ الْجَنّةَ.

যে ব্যক্তি মুসলিমদের পথ থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দিল, তার নামে একটি নেকি লেখা হবে। আর যার একটি নেকি কবুল হবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। -আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ৫০২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৭৪৭৯ মাজমাউয যাওয়াইদ, হাদীস ৪৭৪৮

সুতরাং পথ হতে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দিতে সচেষ্ট হব; আশা করা যায়, এর বিনিময়ে আল্লাহ আমলের খাতা থেকে আমার গোনাহগুলো সরিয়ে দেবেন।

যিকিরের মজলিস : যে মজলিসের উদ্দেশ্যহীন অংশগ্রহণকারীকেও ক্ষমা করা হয়

আল্লাহর দয়ার কি সীমা-পরিসীমা আছে! বান্দাকে ক্ষমা করার জন্য সদা প্রসারিত থাকে তাঁর ক্ষমার হাত। প্রয়োজন শুধু বান্দা সে সুযোগটাকে কাজে লাগানো এবং তাঁর কাছে মাফ চাওয়া। বান্দা ইসতিগফার করলে তিনি মাফ করেন। এটিই স্বাভাবিক নিয়ম; কিন্তু তিনি এমন মহা ক্ষমাকারী যে, বান্দা মাফ না চাইলেও তিনি ক্ষমা করেন। বান্দাকে ক্ষমা করার জন্য বাহানা তালাশ করেন।

তেমনই একটি ‘বাহানা’ হল, যিকিরের মজলিস। যিকিরের মজলিসে যে উপস্থিত হয় শুধু মজলিসে উপস্থিতির ভিত্তিতে আল্লাহ ক্ষমা করেন; হোক তার এই মজলিসের উপস্থিতি ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্যে। তারপরও আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন-কেবল এই মজলিসের শরীক হওয়ার কারণে।

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত,

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

إِنّ لِلهِ مَلاَئِكَةً يَطُوفُونَ فِي الطّرُقِ يَلْتَمِسُونَ أَهْلَ الذِّكْرِ، فَإِذَا وَجَدُوا قَوْمًا يَذْكُرُونَ اللهَ تَنَادَوْا: هَلُمّوا إِلَى حَاجَتِكُمْ قَالَ: فَيَحُفّونَهُمْ بِأَجْنِحَتِهِمْ إِلَى السّمَاءِ الدّنْيَا قَالَ: فَيَسْأَلُهُمْ رَبّهُمْ، وَهُوَ أَعْلَمُ مِنْهُمْ، مَا يَقُولُ عِبَادِي؟ قَالُوا: يَقُولُونَ: يُسَبِّحُونَكَ وَيُكَبِّرُونَكَ وَيَحْمَدُونَكَ وَيُمَجِّدُونَكَ قَالَ: فَيَقُولُ: هَلْ رَأَوْنِي؟ قَالَ: فَيَقُولُونَ: لاَ وَاللهِ مَا رَأَوْكَ؟ قَالَ: فَيَقُولُ: وَكَيْفَ لَوْ رَأَوْنِي؟ قَالَ: يَقُولُونَ: لَوْ رَأَوْكَ كَانُوا أَشَدّ لَكَ عِبَادَةً، وَأَشَدّ لَكَ تَمْجِيدًا وَتَحْمِيدًا، وَأَكْثَرَ لَكَ تَسْبِيحًا...، قَالَ: فَمِمّ يَتَعَوّذُونَ؟ قَالَ: يَقُولُونَ: مِنَ النّارِ قَالَ: يَقُولُ: وَهَلْ رَأَوْهَا؟ قَالَ: يَقُولُونَ: لاَ وَاللهِ يَا رَبِّ مَا رَأَوْهَا قَالَ: يَقُولُ: فَكَيْفَ لَوْ رَأَوْهَا؟ قَالَ: يَقُولُونَ: لَوْ رَأَوْهَا كَانُوا أَشَدّ مِنْهَا فِرَارًا، وَأَشَدّ لَهَا مَخَافَةً قَالَ: فَيَقُولُ: فَأُشْهِدُكُمْ أَنِّي قَدْ غَفَرْتُ لَهُمْ قَالَ: يَقُولُ مَلَكٌ مِنَ المَلاَئِكَةِ: فِيهِمْ فُلاَنٌ لَيْسَ مِنْهُمْ، إِنّمَا جَاءَ لِحَاجَةٍ. قَالَ: هُمُ الجُلَسَاءُ لاَ يَشْقَى بِهِمْ جَلِيسُهُمْ.

আল্লাহর পক্ষ থেকে একদল ফিরিশতা নিয়োজিত রয়েছে, যারা ঘুরে ঘুরে যিকিরকারীদের তালাশ করে। যখন কিছু মানুষকে আল্লাহর যিকিরে মশগুল দেখে তারা একে অপরকে আহ্বান করে-এসো, তোমাদের লক্ষ্যের দিকে এসো। (তোমরা যা খুঁজছ তা মিলে গেছে।) নবীজী বলেন, এরপর তারা নিজেদের ডানা দ্বারা মজলিসটিকে ঘিরে নেয়। এভাবে নিকটবর্তী আসমান পর্যন্ত পৌঁছে যায়।

নবীজী বলেন, তখন তাদের রব তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন, -অথচ তিনি তাদের চেয়ে অধিক জ্ঞাত-আমার বান্দাগণ কী বলছে? ফিরিশতারা বলে, তারা আপনার পবিত্রতা বর্ণনা করছে, আপনার বড়ত্ব ঘোষণা করছে, আপনার প্রশংসা করছে এবং আপনার মর্যাদা ঘোষণা করছে। নবীজী বলেন, তখন আল্লাহ বলেন, তারা কি আমাকে দেখেছে? উত্তরে ফিরিশতারা বলে, না; আল্লাহর কসম, তারা আপনাকে দেখেনি।

নবীজী বলেন, অতঃপর আল্লাহ বলেন, যদি তারা আমাকে দেখত তাহলে তাদের কী অবস্থা হত? ফিরিশতারা বলে, যদি তারা আপনাকে দেখত তাহলে আরও একনিষ্ঠভাবে আপনার ইবাদত করত, অপনার মর্যাদা ঘোষণায় এবং আপনার প্রশংসা প্রকাশে আরো সক্রিয় হত এবং আরো অধিক পরিমাণে আপনার তাসবীহ পাঠ করত!

নবীজী বলেন, তখন আল্লাহ বলেন, তারা আমার নিকট কী চায়? ফিরিশতারা বলে, তারা আপনার নিকট জান্নাত চায়! আল্লাহ বলেন, তারা কি জান্নাত দেখেছে? ফিরিশতারা বলে, না, হে রব! তারা জান্নাত দেখেনি। তখন আল্লাহ বলেন, যদি তারা জান্নাত দেখত তাহলে কী করত? ফিরিশতারা বলেন, যদি তারা জান্নাত দেখত তাহলে তার প্রতি আরো লালায়িত হত, তার অন্বেষণে আরো মনোযোগী হত এবং তা লাভের জন্য আরো ব্যাকুল হত।

নবীজী বলেন, আল্লাহ বলেন, তারা কী থেকে পানাহ চাচ্ছে? ফিরিশতারা বলে, জাহান্নাম থেকে। আল্লাহ বলেন, তারা কি জাহান্নাম দেখেছে? ফিরিশতারা বলে, না, আল্লাহর কসম হে রব! তারা জাহান্নাম দেখেনি। তখন আল্লাহ বলেন, যদি তারা জাহান্নাম দেখত তাহলে কী করত? ফিরিশতারা বলে, যদি তারা জাহান্নাম দেখত তাহলে আরো বেশি ভয় করত এবং তা থেকে বাঁচতে আরো অধিক চেষ্টা করত।

নবীজী বলেন, তখন আল্লাহ বলেন-

فَأُشْهِدُكُمْ أَنِّي قَدْ غَفَرْتُ لَهُمْ.

তোমাদের সাক্ষী রাখছি, আমি তাদেরকে ক্ষমা করে দিলাম।

নবীজী বলেন, তখন একজন ফিরিশতা বলে ওঠে, তাদের মধ্যে তো অমুক রয়েছে; যে তাদের দলের নয়, সে অন্য কাজে এসেছে। (সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় রয়েছে, তাদের মাঝে তো এক পাপী রয়েছে।) একথা শুনে আল্লাহ বলেন-

هُمُ الجُلَسَاءُ لاَ يَشْقَى بِهِمْ جَلِيسُهُمْ.

তারা এমন জামাত, (এটি এমন মজলিস, যার) যাদের কোনো অংশগ্রহণকারীই মাহরূম হয় না। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪০৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৮৯

যেভাবে বেচাকেনা-লেনদেন করলে আল্লাহ ক্ষমা করেন

প্রতিটি ব্যক্তিরই কিছু দুর্বলতা থাকে। কিছু ত্রুটি থাকে। এখন কী করলে আমি আমি আমার ত্রুটি ও দুর্বলতাগুলো ছাপিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারব; তাঁর ক্ষমা লাভে ধন্য হব!

হাঁ, অন্যের ত্রুটি ও দুর্বলতাগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখলে আশা করা যায়, আল্লাহ আমার ত্রুটি ও দুর্বলতাগুলো ক্ষমা করে দেবেন। আমার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন।

মানুষ বাকিতে পণ্য নেয়। অভাবের সংসার, নিতে হয়। নির্দিষ্ট একটি মেয়াদে নেয়; এত দিন পর ইনশাআল্লাহ দিয়ে দিব। তার পরিকল্পনা থাকে-অমুক অর্থটা পেলে ঋণটা শোধ দিয়ে দিব। বা ফসল লাগিয়েছি; দু’মাস গেলেই ফসলটা বিক্রি করে ঋণটা দিয়ে দিব। কিন্তু পরে দেখা গেল, যে টাকাটা পাওয়ার কথা ছিল, পাওয়া গেল না। বা ফসল নষ্ট হয়ে গেল। এখন সে পেরেশান হয়-কথা দিয়েছিলাম, অমুক সময় ঋণটা পরিশোধ করে দিব, দিতে পারছি না। সে আরেকটু সময় চায়; অমুক সমস্যার কারণে সময় হয়ে যাওয়া সত্তে¡ও দিতে পারছি না-আমাকে আরেকটু সময় দিন। সে যে ঋণটা সময়মত পরিশোধ করতে পারল না-এটা তার দুর্বলতা। তার এ দুর্বলতার সময় আমি দুই ধরনের আচরণ করতে পারি-বলতে পারি, সমস্যা নেই, যখন টাকা হাতে আসবে তখনই দিয়েন। অথবা তার দুর্বলতার সুযোগে তার সাথে আমি রূঢ় আচরণ করতে পারি, দু’কথা শুনিয়ে দিতে পারি-ঋণ নেয়ার সময় হুঁশ ছিল না, এখন...!

আমি আচরণ যা-ই করি, ঋণটা কিন্তু এখন পাচ্ছি না। যদি দ্বিতীয় আচরণ করি, তাহলে ঋণও পেলাম না, তার মনে কষ্টও দিলাম। আর যদি প্রথম আচরণটা করি তো আমি ঋণ তো যখন পাওয়ার ছিল তখনই পাব; মাঝখান দিয়ে কত বড় পুরস্কার পেয়ে যাব আল্লাহর কাছ থেকে তা কি আমার জানা আছে!

হুযায়ফা রা. নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন-

أَنّ رَجُلًا مَاتَ، فَدَخَلَ الْجَنّةَ، فَقِيلَ لَهُ: مَا كُنْتَ تَعْمَلُ؟ - قَالَ: فَإِمّا ذَكَرَ وَإِمّا ذُكِّرَ - فَقَالَ: إِنِّي كُنْتُ أُبَايِعُ النّاسَ، فَكُنْتُ أُنْظِرُ الْمُعْسِرَ، وَأَتَجَوّزُ فِي السِّكّةِ - أَوْ فِي النّقْدِ - فَغُفِرَ لَهُ.

এক ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করল। সে জান্নাতে প্রবেশ করল। তাকে জিজ্ঞেস করা হল, তুমি কী আমল করতে? (যার বিনিময়ে তুমি জান্নাত লাভ করলে?)

তখন -তার স্মরণ হল অথবা তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হল-সে বলল : আমি মানুষের সাথে বেচাকেনা করতাম; অসচ্ছল হলে (বাকিতে দিতাম এবং) সচ্ছলতা পর্যন্ত সুযোগ দিতাম, ছাড় দিতাম। আর সচ্ছল হলে দিনার-দিরহামে ত্রুটি থাকলে মেনে নিতাম। ফলে (এ আমলের বিনিময়েই) তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫৬০

মুমিন বুদ্ধিমান। সে প্রথম আচরণই করবে। কারণ, এত বড় পুরস্কারের জন্য ঋণের টাকা কেবল দেরিতে গ্রহণই নয়, পুরো টাকাটা হাদিয়া দিয়ে দিলেও তা পুরস্কারের তুলনায় তুচ্ছ। হ

লেনদেনে সহজতা অবলম্বন করি : আল্লাহ আমার গোনাহ মাফ করবেন

সমাজে চলতে একে অপরের সাথে যে লেনদেন সবচেয়ে বেশি হয় তা হল, বেচা-কেনা। তেমনি ঋণ আদান-প্রদানও করে থাকি আমরা। এখন বেচা-কেনা এবং ঋণ আদান-প্রদানে যদি আমরা সহজ হই তাহলে আল্লাহ আমাদের প্রতি সহজ হবেন। আমাদের গোনাহগুলো মাফ করে দেবেন।

বিক্রির ক্ষেত্রে সহজতা- যেমন, ক্রেতাকে ভালো পণ্যটি দিতে চেষ্টা করা কিংবা ক্রেতার প্রয়োজন বিবেচনায় অল্প লাভে পণ্য বিক্রি করে দেওয়া; তেমনি ক্রেতা বাকি চাইলে তাকে সুযোগ দেওয়া অথবা কেনার পর ফেরৎ দিতে চাইলে গ্রহণ করা এবং মূল্য ফিরিয়ে দেওয়া ইত্যাদি। ক্রয়ের ক্ষেত্রে সহজতা হল, কথামতো মূল্য পরিশোধ করে দেওয়া, কোনো টালবাহানা না করা। বিক্রেতার যাতে লাভ হয় সেদিকে খেয়াল রাখা ইত্যাদি। মোটকথা ক্রেতা-বিক্রেতা একে অপরের সুবিধার প্রতি লক্ষ রাখা।

ঋণ আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে সহজতার বিষয়টি আমরা সহজেই বুঝতে পারি। কারো প্রয়োজনে স্বতস্ফূর্ত ঋণ দেওয়াটাই ঋণগ্রহিতার সাথে প্রথম সহজ আচরণ। এরপর সম্ভব হলে সে যে মেয়াদে ঋণ নিতে চায় তা গ্রহণ করা। তেমনি মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পরিশোধ করতে না পারলে তার ওযর গ্রহণ করা এবং সুযোগ দেওয়া। তার সাথে ভালো আচরণ করা ইত্যাদি। তেমনি ঋণগ্রহিতা ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে টালবাহানা না করা; ওজর না থাকলে সময়মত ঋণ পরিশোধ করা। ওজর থাকলে ঋণদাতাকে জানানো ইত্যাদি। এভাবে লেনদেনে যে ব্যক্তি সহজতা অবলম্বন করবে ইনশাআল্লাহ আল্লাহ তাকে মাফ করে দেবেন, যেমন পূর্ববর্তী উম্মতের এক ব্যক্তিকে মাফ করে দিয়েছেন। জাবের রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

غَفَرَ اللهُ لِرَجُلٍ كَانَ مِنْ قَبْلِكُمْ، كَانَ سَهْلًا إِذَا بَاعَ، سَهْلًا إِذَا اشْتَرَى، سَهْلًا إِذَا قَضَى، سَهْلًا إِذَا اقْتَضَى.

আল্লাহ তাআলা পূর্ববর্তী উম্মতের এক ব্যক্তিকে ক্ষমা করে দিয়েছেন; কারণ সে বেচা-কেনার সময় সহজতা অবলম্বন করত। ঋণ আদায়ের সময় সহজতা অবলম্বন করত। অন্যের কাছে ঋণ তলবের সময়ও সহজতা অবলম্বন করত। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৪৬৫৮; জামে তিরমিযী, হাদীস ১৩২০; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ১০৭৪২

নীরব থেকে মনোযোগসহকারে জুমার খুতবা শুনলে দশ দিনের গোনাহ মাফ...

ইমাম যখন জুমার খুতবা প্রদান করেন তখন দেখা যায়, কিছু মানুষ গল্প-গুজবে লিপ্ত। প্রায় প্রতিটি মসজিদেই এ দৃশ্য চোখে পড়ে। বিষয়টি না জানা বা না বোঝার কারণে হয়ত এমনটি হয়ে থাকে। এ থেকে বেঁচে থাকা আবশ্যক। খুতবাচলাকালীন গল্প-গুজব তো দূরের কথা, আরেকজন কথা বললে তাকে চুপ করতে বলাও নিষেধ। কারণ, দশজনে কথা বললে পাঁচজন যদি তাদেরকে চুপ করতে বলে তাহলে পনেরজনের আওয়াজ একত্র হয়ে হট্টগোল মত শোনা যাবে। সাধারণত আরেকজনকে চুপ করতে বলাটা একটু উঁচু আওয়াজেই হয়ে থাকে। আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

إِذَا قُلْتَ لِصَاحِبِكَ يَوْمَ الجُمُعَةِ: أَنْصِتْ، وَالإِمَامُ يَخْطُبُ، فَقَدْ لَغَوْتَ.

ইমাম খুতবা দিচ্ছেন- এমন সময় যদি তুমি তোমার পাশেরজনকে বল, ‘চুপ কর’ তাহলে তুমিও অনর্থক কাজ করলে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৯৩৪

সুতরাং খুতবাচলাকালীন আমরা কোনো কথা বলব না; বরং নিরব থেকে মনোযোগ সহকারে খুতবা শুনব। তাহলে আল্লাহ তাআলা আমার গত জুমা এবং এই জুমার মধ্যবর্তী সগীরা গোনাহগুলো মাফ করে দেবেন; বরং বিগত দশ দিনের গোনাহ মাফ করে দেবেন। আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

مَنْ تَوَضّأَ فَأَحْسَنَ الْوُضُوءَ، ثُمّ أَتَى الْجُمُعَةَ، فَاسْتَمَعَ وَأَنْصَتَ، غُفِرَ لَهُ مَا بَيْنَهُ وَبَيْنَ الْجُمُعَةِ، وَزِيَادَةُ ثَلَاثَةِ أَيّامٍ، وَمَنْ مَسّ الْحَصَى فَقَدْ لَغَا.

যে ব্যক্তি উত্তমরূপে ওযু করল এবং জুমায় এল। এরপর নীরব থেকে মনোযোগসহ খুতবা শুনল। আল্লাহ তাআলা তার গত জুমা ও এই জুমার মধ্যবর্তী সময়ের গোনাহ মাফ করে দেবেন; আরো অতিরিক্ত তিন দিনের গোনাহও মাফ করবেন। আর যে ব্যক্তি নুড়ি স্পর্শ করল সে অনর্থক কাজ করল। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮৫৭

বায়তুল মাকদিসে নামাযের উদ্দেশ্যে গমন গোনাহ মাফ করে

বায়তুল মাকদিস। মুসলিমের প্রথম কিবলা। মসজিদে হারাম কিবলা হওয়ার পূর্বে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবীগণ ষোল-সতের মাস এদিক ফিরে নামায আদায় করেছেন। (দ্র. সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫২৫) মসজিদে হারামের পরই আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে এ মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। (দ্র. সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫২০) মেরাজের সময় এখান থেকেই নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঊর্ধ্বজগৎ ভ্রমণ শুরু হয়েছে। (দ্র. সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৬২) এছাড়াও বায়তুল মাকদিসের রয়েছে আরো অনেক ফযীলত ও মর্যাদা।

কেউ যদি কেবল নামাযের উদ্দেশ্যে বায়তুল মাকদিসে যায় তাহলে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর ন্যায় সে গোনাহ থেকে পবিত্র হয়ে যায়। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন-

لَمّا فَرَغَ سُلَيْمَانُ بْنُ دَاوُدَ مِنْ بِنَاءِ بَيْتِ الْمَقْدِسِ، سَأَلَ اللهَ ثَلَاثًا: حُكْمًا يُصَادِفُ حُكْمَهُ، وَمُلْكًا لَا يَنْبَغِي لَأَحَدٍ مِنْ بَعْدِهِ، وَأَلّا يَأْتِيَ هَذَا الْمَسْجِدَ أَحَدٌ لَا يُرِيدُ إِلّا الصَّلَاةَ فِيهِ، إِلّا خَرَجَ مِنْ ذُنُوبِهِ كَيَوْمِ وَلَدَتْهُ أُمّهُ، فَقَالَ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: أَمّا اثْنَتَانِ فَقَدْ أُعْطِيَهُمَا، وَأَرْجُو أَنْ يَكُونَ قَدْ أُعْطِيَ الثّالِثَةَ.

قال النووي في تهذيب الأسماء (১/২৩৩) : رواه النسائي في سننه بإسناد صحيح.

সুলাইমান আলাইহিস সালাম যখন বায়তুল মাকদিসের নির্মাণকাজ সমাপ্ত করলেন তখন আল্লাহর কাছে তিনটি বিষয় চাইলেন- এক. আমাকে এমন ফয়সালার যোগ্যতা দিন, যা আপনার ফয়সালার অনুগামী হয়। দুই. আমাকে এমন রাজত্ব দান করুন, যেমন রাজত্ব আর কাউকে দেওয়া হবে না। তিন. যে ব্যক্তি কেবল নামায আদায়ের উদ্দেশ্যে এ মসজিদে আসবে সে সদ্যভূমিষ্ঠ নিষ্পাপ শিশুর মত গোনাহমুক্ত হয়ে যাবে।

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তাঁর দুটি আরজি তো কবুল করা হয়েছে; তিনি এ প্রথম দুটি লাভ করেছেন। আর আমি আশা করি, তাঁর তৃতীয় আরজিও কবুল করা হয়েছে। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৪০৮; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৬৯৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৬৬৪৪; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস ১৩৩৪; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৩৮৭৭



লাইলাতুন নিসফি মিন শা‘বান

শিরক ও বিদ্বেষ থেকে মুক্ত থাকি, এ রাতের ক্ষমা লাভ করি

অর্ধ শাবানের রজনী তথা শাবান মাসের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতের রয়েছে বিশেষ তাৎপর্য ও ফযীলত। এ রাতকে হাদীসের ভাষায়- ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শা‘বান’ বলে। প্রচলিত ভাষায় আমরা যাকে ‘শবে বরাত’ বলে ব্যক্ত করি। এ রাতের বিশেষ ফযীলত হল, আল্লাহ এ রাতে বান্দাদের ক্ষমা করেন। সুতরাং এ রাতের ক্ষমা লাভের জন্য সচেষ্ট হওয়া উচিত।

হযরত মুআয ইবনে জাবাল রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

يَطْلُعُ اللهُ إِلَى خَلْقِهِ فِي لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِجَمِيعِ خَلْقِهِ إِلّا لِمُشْرِكٍ أَوْ مُشَاحِنٍ.

অর্ধ শাবানের রাতে আল্লাহ সৃষ্টির প্রতি (রহমতের বিশেষ) দৃষ্টি প্রদান করেন। অতঃপর শিরককারী ও বিদ্বেষপোষণকারী ছাড়া সমগ্র সৃষ্টিকে ক্ষমা করে দেন। -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৫৬৬৫

হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী এ রাতের ক্ষমা লাভ করার জন্য আমাকে প্রথম যে কাজটি করতে হবে তা হল, শিরক থেকে মুক্ত থাকতে হবে। ছোট-বড় সব ধরনের শিরক থেকে আমরা মুক্ত থাকতে চেষ্টা করব। তেমনি এ ক্ষমা লাভের জন্য আমাদেরকে আরেকটি মন্দ গুণ থেকেও পবিত্র থাকতে হবে। সে মন্দ গুণটি হল, ‘শাহনা’ তথা ‘বিদ্বেষ’। ‘শাহনা’ মানে হিংসার বসবর্তী হয়ে কারো প্রতি শত্রুতা পোষণ করা, তার অমঙ্গল কামনা করা। সুতরাং আমরা সকল মন্দ গুণ থেকে নিজেদের পবিত্র রাখতে সচেষ্ট হব; বিশেষ করে শিরক ও বিদ্বেষ থেকে, তাহলেই ধন্য হব এ রাতের ক্ষমা লাভে।

এর সাথে সাথে এ রাতে নফল আমলের প্রতিও যত্নবান হব। হযরত আলা ইবনুল হারিছ রাহ. থেকে বর্ণিত, আয়েশা রা. বলেন-

قَامَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ مِنَ اللّيْلِ يُصَلِّي فَأَطَالَ السّجُودَ حَتّى ظَنَنْتُ أَنّهُ قَدْ قُبِضَ، فَلَمّا رَأَيْتُ ذَلِكَ قُمْتُ حَتّى حَرّكْتُ إِبْهَامَهُ فَتَحَرّكَ، فَرَجَعْتُ، فَلَمّا رَفَعَ رَأْسَهُ مِنَ السّجُودِ، وَفَرَغَ مِنْ صَلَاتِهِ، قَالَ: يَا عَائِشَةُ أَوْ يَا حُمَيْرَاءُ ظَنَنْتِ أَنّ النّبِيّ خَاسَ بِكِ؟ ، قُلْتُ: لَا وَاللهِ يَا رَسُولَ اللهِ وَلَكِنِّي ظَنَنْتُ أَنّكَ قُبِضْتَ لِطُولِ سُجُودِكَ، فَقَالَ: أَتَدْرِينَ أَيّ لَيْلَةٍ هَذِهِ؟ ، قُلْتُ: اللهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ، قَالَ: هَذِهِ لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ، إِنّ اللهَ عَزّ وَجَلّ يَطْلُعُ عَلَى عِبَادِهِ فِي لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِلْمُسْتَغْفِرِينَ، وَيَرْحَمُ الْمُسْتَرْحِمِينَ، وَيُؤَخِّرُ أَهْلَ الْحِقْدِ كَمَا هُمْ.

একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে নামাযে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সিজদা করেন যে, আমার ধারণা হল, তিনি হয়তো মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সিজদা থেকে উঠলেন এবং নামায শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ করে বললেন, হে আয়েশা, অথবা বলেছেন, ও হুমায়রা! তোমার কি এই আশংকা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন?

আমি উত্তরে বললাম- আল্লাহর কসম, না, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার দীর্ঘ সিজদা থেকে আমার আশংকা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না।

নবীজী জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জান এটা কোন্ রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বললেন, এটা হল অর্ধ-শাবানের রাত। (শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত।) আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে তাঁর বান্দার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেন এবং ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহপ্রার্থীদের প্রতি অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই। অর্থাৎ তাদের ক্ষমা করেন না। -শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৩৫৫৪

ইমাম বায়হাকী রাহ. এই হাদীসটি বর্ণনা করার পর এর সনদের ব্যাপারে বলেন-

هذا مرسل جيد.

এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, এ রাতে দীর্ঘ নফল নামায পড়া, যাতে সিজদাও দীর্ঘ হবে, শরীয়তের দৃষ্টিতে কাম্য। তবে মনে রাখতে হবে যে, অনেক অনির্ভরযোগ্য ওযীফার বই-পুস্তকে নামাযের যে নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন লেখা আছে অর্থাৎ এত রাকাআত হতে হবে, প্রতি রাকাআতে এই সূরা এতবার পড়তে হবে- এগুলো ঠিক নয়, হাদীস শরীফে এসব নেই; এগুলো মানুষের মনগড়া পন্থা। সঠিক পদ্ধতি হল, নফল নামাযের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী দুই রাকাত করে যত রাকাত সম্ভব হয় এবং যে সূরা দিয়ে সম্ভব হয় পড়তে থাকা, কুরআনে কারীম তিলাওয়াত করা, দরূদ শরীফ পড়া, ইসতিগফার করা, দুআ করা ইত্যাদি। আর আগেই আমরা আলোচনা করেছি, এ রাতের ক্ষমা লাভের জন্য অবশ্যই আমাকে শিরক ও বিদ্বেষমুক্ত থাকতে হবে। সুতরাং সেদিকেও বিশেষ নযর দিব।

৭৯. গোনাহ হয়ে গেলে দুই রাকাত নামায পড়ে ইসতিগফার করা...

মুমিন চেষ্টা করে গোনাহ থেকে বেঁচে থাকতে। কিন্তু কখনো শয়তানের ধোঁকায় পড়ে গোনাহ হয়ে যায়। তখন মুমিনের আফসোস ও আক্ষেপের শেষ থাকে না; কেন গোনাহে জড়ালাম, কেন গোনাহের পথে পা বাড়ালাম, কীভাবে পরিত্রাণ পাব এ গোনাহ থেকে। কৃত গোনাহ তাকে কষ্টে নিপতিত করে। আর এটিই মুমিনের পরিচয়। এটিই তার ঈমানের প্রমাণ। আবু উমামা রা. বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করল, ঈমান কী আল্লাহর রাসূল! (আমি কীভাবে বুঝব আমার মাঝে ঈমান আছে?)

তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-

إِذَا سَرَّتْكَ حَسَنَتُكَ، وَسَاءَتْكَ سَيِّئَتُكَ فَأَنْتَ مُؤْمِنٌ.

যখন তোমার নেক আমল তোমাকে আনন্দিত করবে এবং তোমার গোনাহ তোমাকে কষ্টে নিপতিত করবে (গোনাহের কারণে তুমি কষ্ট পেতে থাকবে)- তাহলে (বুঝবে) তুমি মুমিন। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২১৬৬; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ৩৩

হাঁ, মুমিনের এ কষ্ট হল গোনাহ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ব্যাকুলতার কষ্ট। এ কষ্ট থেকেই মুমিন আল্লাহর দুয়ারে ক্ষমার ভিখারী হয়ে ধরনা দেয়। উত্তমরূপে ওযু করে এবং নামাযে দাঁড়িয়ে যায়। ইসতিগফারের অশ্রুতে সিক্ত হয়।

আর তখনই রাহমানুর রাহীমের ক্ষমার দরিয়ায় মৌজ ওঠে। বান্দার সব গোনাহ ধুয়ে সাফ করে দেয়। সিদ্দীকে আকবর আবু বকর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

مَا مِنْ مُسْلِمٍ يُذْنِبُ ذَنْبًا ثُمَّ يَتَوَضَّأُ فَيُصَلِّي رَكْعَتَيْنِ، ثُمَّ يَسْتَغْفِرُ اللهَ لِذَلِكَ الذَّنْبِ، إِلاَّ غَفَرَ لَهُ وَقَرَأَ هَاتَيْنِ الْآيَتَيْنِ: وَ مَنْ یَّعْمَلْ سُوْٓءًا اَوْ یَظْلِمْ نَفْسَهٗ ثُمَّ یَسْتَغْفِرِ اللهَ یَجِدِ اللهَ غَفُوْرًا رَّحِیْمًا.

وَ الَّذِیْنَ اِذَا فَعَلُوْا فَاحِشَةً اَوْ ظَلَمُوْۤا اَنْفُسَهُمْ...

মুসলিম যখন কোনো গোনাহ করে ফেলে অতঃপর ওযু করে দুই রাকাত নামায আদায় করে এবং উক্ত পাপের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায় তখন আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন।

এরপর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দুটি আয়াত তিলাওয়াত করেন,

وَ مَنْ یَّعْمَلْ سُوْٓءًا اَوْ یَظْلِمْ نَفْسَهٗ ثُمَّ یَسْتَغْفِرِ اللهَ یَجِدِ اللهَ غَفُوْرًا رَّحِیْمًا.

[যে ব্যক্তি কোনো মন্দ কাজ করে ফেলে বা নিজের প্রতি জুলুম করে বসে, তারপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়, সে অবশ্যই আল্লাহকে অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালুই পাবে। -সূরা নিসা (৪) : ১১০]

وَ الَّذِیْنَ اِذَا فَعَلُوْا فَاحِشَةً اَوْ ظَلَمُوْۤا اَنْفُسَهُمْ...

[এবং তারা সেই সকল লোক, যারা কখনও কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেললে বা (অন্য কোনোভাবে) নিজেদের প্রতি জুলুম করলে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার ফলশ্রুতিতে নিজেদের গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে...। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৩৫]

-মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৪৭; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৬২৩; মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস ১৩

৮০. চল্লিশ থেকে একশ মুসলিম যার জানাযা পড়ে তাকে মাফ করে দেওয়া হয়

কোনো মুসলিম ইন্তেকাল করলে অপর মুসলিমদের উপর তার হক- জানাযায় শরীক হওয়া; তার জন্য ইসতিগফার করা, দুআ করা। কুরআনে কারীমে মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে- তারা পরলোকগত মুমিনদের জন্য মাগফিরাত কামনা করে।

জানাযার নামাযে মূলত আমরা মায়্যেতের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি। তার জন্য ইসতিগফার ও দুআর মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সুপারিশ করি- আল্লাহ তাকে মাফ করে দিন। তাকে গোনাহ থেকে পবিত্র করুন। তাকে কবরের আযাব থেকে, জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করুন। তাকে জান্নাতে প্রবেশ করান।

মায়্যেতের জন্য আমাদের এ ইসতিগফারের অনেক মূল্য। এর মাধ্যমে আমরা তো সওয়াব লাভ করবই; কিন্তু এর চাইতে বড় কথা- আমাদের ইসতিগফারের কারণে আল্লাহ মায়্যেতকে মাফ করে দেবেন। এজন্য গুরুত্বের সাথে জানাযায় শরীক হওয়া উচিত। কারণ, যত বেশি মানুষ মায়্যেতের জন্য ইসতিগফার করবে, ক্ষমা লাভ তত সহজ হবে। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

مَنْ صَلّى عَلَيْهِ مِائَةٌ مِنَ الْمُسْلِمِينَ غُفِرَ لَهُ.

একশ মুসলিম যার জানাযা পড়ে, আল্লাহ তাকে মাফ করে দেন। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৪৮৮; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৮৮১৫

আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত আরেক বর্ণনায় বিষয়টি এসেছে এ ভাষায়-

مَا مِنْ مَيِّتٍ تُصَلِّي عَلَيْهِ أُمّةٌ مِنَ الْمُسْلِمِينَ يَبْلُغُونَ مِائَةً، كُلّهُمْ يَشْفَعُونَ لَهُ، إِلّا شُفِّعُوا فِيهِ.

যে মায়্যেতের উপর একটি জামাত জানাযা আদায় করে, যাদের সংখ্যা এক শ’তে পৌঁছে আর তারা তার জন্য সুপারিশ করে (দুআ-ইসতিগফার করে) তাদের সুপারিশ কবুল করা হয় (অর্থাৎ তাকে মাফ করে দেওয়া হয়)। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৯৪৭; জামে তিরমিযী, হাদীস ১০২৯; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ১৯৯১

উপরের বর্ণনায় এক শ মুসলিম জানাযা আদায়ের কথা বলা হয়েছে। আবার ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত এক হাদীসে চল্লিশজনের কথা বলা হয়েছে-

ইবনে আব্বাস রা.-এর আযাদকৃত গোলাম কুরাইব বর্ণনা করেন, একবার ‘কুদাইদ’ বা ‘উসফান’ নামক স্থানে ইবনে আব্বাস রা.-এর এক সন্তান ইন্তেকাল করেন। তখন জানাযা পড়ার আগে ইবনে আব্বাস রা. বললেন, দেখ জানাযায় উপস্থিতি কতজন? উপস্থিতির বিষয়ে খবর দিতে গেলে তিনি বললেন, কী বল, উপস্থিতি কি চল্লিশজন হবে? খবরদাতা হাঁ-সূচক উত্তর দিলে বললেন, এবার তাকে জানাযার জন্য বের করা যায়; আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি-

مَا مِنْ رَجُلٍ مُسْلِمٍ يَمُوتُ، فَيَقُومُ عَلَى جَنَازَتِهِ أَرْبَعُونَ رَجُلًا، لَا يُشْرِكُونَ بِاللهِ شَيْئًا، إِلّا شَفّعَهُمُ اللهُ فِيهِ.

কোনো মুসলিম মৃত্যুবরণ করলে তার জানাযায় যদি এমন চল্লিশজন উপস্থিত হয়, যারা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করে না, আল্লাহ তার ব্যাপারে তাদের সুপারিশ (দুআ-ইসতিগফার) কবুল করেন (অর্থাৎ তাকে মাফ করে দেন)। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৯৪৮; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩১৭০; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৩০৮২; সুনানে কুবরা, বায়হাকী, হাদীস ৫৬২১

আর মালেক ইবনে হুবায়রা রা.-এর বর্ণনায় তিন কাতারের কথা এসেছে। মারছাদ ইবনে আব্দুল্লাহ রাহ. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, মালেক ইবনে হুবায়রা রা. যদি কোনো জানাযায় শরীক হতেন আর সেখানে উপস্থিতি কম হত তাহলে তিনি মুসল্লিদের তিন কাতারে ভাগ করে দিতেন আর বলতেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

مَنْ صَلّى عَلَيْهِ ثَلَاثَةُ صُفُوفٍ فَقَدْ أَوْجَبَ.

قال الترمذي : حَدِيثُ مَالِكِ بْنِ هُبَيْرَةَ حَدِيثٌ حَسَنٌ.

তিন কাতার মুসলিম যার জানাযা আদায় করবে, তার জন্য জান্নাত অবধারিত। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১০২৮; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৪৯০; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩১৬৬

এখানে কোনো বর্ণনায় দেখা যাচ্ছে একশ, কোনো বর্ণনায় চল্লিশ। আবার কোনো বর্ণনায় বলা হয়েছে তিন কাতারের কথা। এসবের মধ্যে আসলে কোনো বৈপরীত্য নেই। কারণ, এসব ক্ষেত্রে সাধারণত বেশি সংখ্যা আগে বলা হয় আর কম সংখ্যা পরে বলা হয়। আর হতে পারে সংখ্যা এখানে উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য হল, আধিক্য বোঝানো। অর্থাৎ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুমিন যদি কোনো মুসলিমের জানাযা আদায় করে তাহলে এদের দুআ-ইস্তিগফারের ওসিলায় আল্লাহ মায়্যেতকে মাফ করে দেন। (মিরকাতুল মাফাতীহ, হাদীস ১৬৬১-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য)

আমার জানাযায় শরীক হয়ে অধিকসংখ্যক মানুষ আমার জন্য ইস্তিগফার করলে ইনশাআল্লাহ আল্লাহ আমাকে মাফ করে দেবেন; এক্ষেত্রে আমার করণীয় কী? আমার জানাযায় হাজির হওয়া-না হওয়া- এটা তো অন্যদের বিষয়; এক্ষেত্রে আমার কি কোনো করণীয় আছে?

হাঁ, আমার করণীয় আছে। আমার করণীয় হল, মানুষের সাথে ভালো আচরণ করা, মানুষের বিপদে-আপদে সাহায্যের হাত বাড়ানো, তাদের সুখে-দুঃখে পাশে থাকা। তাহলেই তো আমি ইন্তিকাল করলে মানুষ আমার পাশে থাকবে, আমার জানাযায় শরীক হবে, আমার জন্য দুআ-ইস্তিগফার করবে। সুতরাং এ ফযীলত ও ক্ষমা লাভ করতে চাইলে জীবদ্দশায় সকলের সাথে ভালো আচরণ করতে হবে, সুখে-দুঃখে সকলের পাশে থাকতে হবে।

৮১. মৃতের পক্ষে প্রতিবেশীদের নেক সাক্ষ্য...

এক হল মায়্যেতের জন্য মুমিনদের দুআ-ইস্তিগফার করা; যার দ্বারা মায়্যেত ক্ষমা লাভ করে। আরেক হল, মানুষ মৃতের প্রশংসা করা। ভালো মানুষ হিসেবে সাক্ষ্য দেয়া; এর মাধ্যমেও আল্লাহ বান্দাকে মাফ করেন, জান্নাত দান করেন। আনাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মানুষের পাশ দিয়ে একজন মুমিনের জানাযা নিয়ে যাওয়া হল। মানুষ তার প্রশংসা করল। এ দেখে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-

وَجَبَتْ

(অবধারিত হয়ে গেছে।)

আরেকজনের জানাযা নিয়ে যাওয়া হল। লোকেরা তার বিষয়ে মন্দ বলল। এ শুনেও নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-

وَجَبَتْ

(অবধারিত হয়ে গেছে।)

তখন ওমর রা. প্রশ্ন করলেন-

مَا وَجَبَتْ؟

কী অবধারিত হয়ে গেল, (আল্লাহর রাসূল!)

(একজনের উত্তম প্রশংসা করা হল, তাকে ভালো বলা হল তখন আপনি বললেন, ‘অবধারিত হয়ে গেছে।’ আবার আরেকজনের বিষয়ে মন্দ বলা হল তখনও বললেন, ‘অবধারিত হয়ে গেছে।’- এর অর্থ কী?)

নবীজী উত্তরে বললেন-

هَذَا أَثْنَيْتُمْ عَلَيْهِ خَيْرًا، فَوَجَبَتْ لَهُ الجَنّةُ، وَهَذَا أَثْنَيْتُمْ عَلَيْهِ شَرّا، فَوَجَبَتْ لَهُ النّارُ، أَنْتُمْ شُهَدَاءُ اللهِ فِي الأَرْضِ.

তোমরা যার প্রশংসা করেছ তার জন্য জান্নাত অবধারিত হয়ে গেছে আর তোমরা যাকে মন্দ বলেছ তার জন্য জাহান্নাম অবধারিত হয়ে গেছে। তোমরা হলে পৃথিবীতে আল্লাহর সাক্ষী। অর্থাৎ তোমরা পৃথিবীতে ব্যক্তির ভালো-মন্দের সাক্ষী। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৩৬৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৯৪৯

আরেক হাদীসে বিষয়টি একটু অন্যভাবে এসেছে। সেখানে মৃতের পক্ষে প্রতিবেশীর উত্তম সাক্ষ্যের কারণে তাকে মাফ করে দেওয়ার কথা এসেছে। আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَمُوتُ فَيَشْهَدُ لَهُ أَرْبَعَةُ أَهْلِ أَبْيَاتٍ مِنْ جِيرَتِهِ الْأَدْنَيْنَ أَنّهُمْ لَا يَعْلَمُونَ إِلّا خَيْرًا إِلّا قَالَ اللهُ جَلّ وَعَلَا قَدْ قَبِلْتُ عِلْمَكُمْ فِيهِ وَغَفَرْتُ لَهُ ما لا تعلمون.

কোনো মুসলিম মৃত্যুবরণ করলে তার নিকট প্রতিবেশীদের চার পরিবার যদি সাক্ষ্য দেয়- তারা তাকে ভালোই জানে; তখন আল্লাহ তাআলা বলেন-

قَدْ قَبِلْتُ عِلْمَكُمْ فِيهِ وَغَفَرْتُ لَهُ ما لا تعلمون.

তার ব্যাপারে তোমাদের উত্তম ধারণা আমি গ্রহণ করলাম আর তোমরা তার বিষয়ে যা জানো না তা (অর্থাৎ তার পাপ) আমি ক্ষমা করে দিলাম। -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৩০২৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৩৫৪১; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ১৩৯৮; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৯১২১; মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস ৩৪৮১; আলআহাদীসুল মুখতারা, যিয়া আলমাকদীসী, হাদীস ১৬৬০; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস ৩৯৬০

এক্ষেত্রে আমাকে যে কথাটি মনে রাখতে হবে তা হল, প্রতিবেশীর উত্তম প্রশংসা কিন্তু এমনিতেই লাভ হয় না; প্রতিবেশীর সাথে উত্তম আচরণের মাধ্যমেই তা হাসিল হয়। সুতরাং এ ফযীলত লাভ করতে হলে প্রতিবেশী ও অন্যদের সাথে সদাচরণ করতে হবে। এর মাধ্যমেই মুত্যুর পর তাদের উত্তম প্রশংসা ও আল্লাহর ক্ষমা লাভ হবে।

আরেকটি বিষয়, এখান থেকেই হয়ত কোনো কোনো সমাজে একটি প্রচলন দেখা যায়- জানাযা সামনে রেখে সকলকে জিজ্ঞেস করা হয়- লোকটি কেমন ছিলেন? সকলে সমস্বরে উত্তর দেয়- ভালো ছিলেন।

আসলে এই যে মানুষের উত্তম প্রশংসা- এটা স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বপ্রণোদিত প্রশংসা। প্রশ্নের মুখে চক্ষুলজ্জায় করা প্রশংসা নয়। তাই তো হাদীসের ভাষা হল, ‘তার প্রশংসা করা হল’ বা ‘লোকেরা তার প্রশংসা করল’।

যাইহোক, এ প্রশংসা মৃত্যুর পর অর্জন করার বিষয় নয়; তা অর্জনের সময় জীবনব্যাপী। মানুষের জীবনব্যাপী কর্ম ও আচরণই এ প্রশংসা এনে দেয়।

# আল কাউসার

والله اعلم بالصواب

উত্তর দিয়েছেনঃ মুসলিম বাংলা ইফতা বিভাগ

মন্তব্য ()

কোনো মন্তব্য নেই।

এ সম্পর্কিত আরও জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

৩৭৮১৮

অবৈধ সম্পদ কাজে খাটিয়ে উপার্জিত সম্পদের হুকুম


২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

C২৫৬+RCX

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ ইসহাক মাহমুদ

৩৪০১৭

নিজের হক আদায়ে জন্য মিথ্যা বলার হুকুম।


৯ জুন, ২০২৩

ত্রিশাল

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী আবু সাঈদ

৩৫১২৫

স্ত্রীর মাসিক অবস্থায় সহবাস করে ফেললে করণীয়


১৯ জুন, ২০২৩

Dhaka

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ শাইখ উমায়ের কোব্বাদী

৩৯৭৫৩

স্বামীর পকেট থেকে টাকা নেওয়ার ব্যাপারে ইসলাম কি বলে??


১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

ঢাকা

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী আরিফুর রহমান

Logoমুসলিম বাংলা
play storeapp store
TopOfStack Software © 2025 All rights reserved. Privacy Policy