বাম হাতে তাসবিহ পাঠ করা যাবে কি?
প্রশ্নঃ ৭৫৮৭. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, বাম হাতে তাসবিহ পাঠ করা যায় না। কাউন্টার মেশিনের ক্ষেত্রে বাম হাতে নিয়ে তাসবিহ পাঠ করা যাবে?
২৮ ডিসেম্বর, ২০২৪
ঢাকা
উত্তর
و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
প্রিয় প্রশ্নকারী ভাই!
হাঁটতে, চলতে, উঠতে-বসতে, সফরে কিংবা হজরে যিকিরের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সহজ মাধ্যম হলো তাসবীহ। প্রাচীনকাল থেকেই মুসলিমগণ হাতের আঙুল ব্যবহার করে তাসবীহ গণনা করে আসছেন। তবে বর্তমানে অনেকেই দানার তাসবীহ কিংবা আধুনিক ডিজিটাল তাসবীহ কাউন্টার ব্যবহার করেন।
এই ডিজিটাল তাসবীহ বহনে সহজ এবং গননায়ও বেশ স্বস্তিদায়ক হওয়ায় বহু মানুষ এটি ব্যবহার করে থাকেন।
তাসবীহ ব্যবহার করে যিকির করা শরিয়তের দৃষ্টিতে জায়েয। তবে সরাসরি আঙ্গুল ব্যবহার করে তাসবীহ ব্যবহার করাটা উত্তম। নবীজি (ﷺ) বলেন,
حُمَيْضَةَ بِنْتِ يَاسِرٍ عَنْ جَدَّتِهَا، يُسَيْرَةَ وَكَانَتْ مِنَ الْمُهَاجِرَاتِ قَالَتْ قَالَ لَنَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " عَلَيْكُنَّ بِالتَّسْبِيحِ وَالتَّهْلِيلِ وَالتَّقْدِيسِ وَاعْقِدْنَ بِالأَنَامِلِ فَإِنَّهُنَّ مَسْئُولاَتٌ مُسْتَنْطَقَاتٌ وَلاَ تَغْفُلْنَ فَتَنْسَيْنَ الرَّحْمَةَ " .
বুসায়রা, ইনি মুহাজির মহিলাদের অন্যতমা ছিলেন (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদেরকে বলেছেনঃ তোমরা সুবহানাল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু এবং সুবহানাল মালিকিল কুদ্দুস পাঠ করবে। আর তা আঙ্গুলে গণনা করবে। কেননা এই আঙ্গুলগুলোকেও জিজ্ঞাসা করা হবে, এদেরও কথা বলান হবে। তোমরা উদাসীন হবে না, যদি হও তবে রহমতের বিষয়েও তোমাদের ভুলে যাওয়া হবে।
জামে' তিরমিযী, হাদীস নং: ৩৫৮৩।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, یَّوۡمَ تَشۡہَدُ عَلَیۡہِمۡ اَلۡسِنَتُہُمۡ وَاَیۡدِیۡہِمۡ وَاَرۡجُلُہُمۡ بِمَا کَانُوۡا یَعۡمَلُوۡنَ
যে দিন তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে তাদের বিরুদ্ধে তাদের জিহ্বা, তাদের হাত ও তাদের পা সাক্ষ্য দেবে। (সূরা রূম, আয়াত নং ২৪)
প্রিয় ভাই! তাসবীহ গণনা নিঃসন্দেহে ভালো কাজ। সকল ভালো কাজ ডান দিক থেকে করাই নবীজির সুন্নাহ।
عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ: كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ «يُعْجِبُهُ التَّيَمُّنُ، فِي تَنَعُّلِهِ، وَتَرَجُّلِهِ، وَطُهُورِهِ، وَفِي شَأْنِهِ كُلِّهِ»
আয়িশা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, নবী (ﷺ) জুতা পরা, চুল আঁচড়ানো এবং পবিত্রতা অর্জন করা তথা প্রত্যেক কাজই ডান দিক থেকে শুরু করতে ভালবাসতেন। (সহীহ বুখারী, আন্তর্জাতিক নং: ১৬৮)
হাদীসের ব্যাখ্যাঃ
আল্লাহ তা'আলা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মানবজাতির জন্য আদর্শ করে পাঠিয়েছেন। কুরআন মাজীদে ইরশাদ-
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ
বস্তুত রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ- এমন ব্যক্তির জন্য, যে আল্লাহ ও আখিরাত দিবসের আশা রাখে।(সূরা আহযাব (৩৩), আয়াত ২১)
আমরা আল্লাহ তা'আলার উপর বিশ্বাস রাখি এবং আখিরাতে মুক্তির আশা রাখি। তাই আমাদেরকে অবশ্যই রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আদর্শরূপে গ্রহণ করতে হবে। তা করতে হবে জীবনের সকল ক্ষেত্রে। কোন কাজ কীভাবে করব, কোন অঙ্গের কেমন ব্যবহার করব, সে ক্ষেত্রেও আমাদের কর্তব্য তাঁকে অনুসরণ করা। আমরা দেখতে পাচ্ছি তিনি পবিত্রতা অর্জন, মাথা আঁচড়ানো, জুতা পরিধান ও খানা খাওয়ায় ডান দিককে প্রাধান্য দিতেন। অর্থাৎ ওযু করতে প্রথমে ডান হাত ধুইতেন, তারপর বাম হাত। প্রথমে ডান পা, পরে বাম পা। মাথা আঁচড়াতে শুরুটা করতেন ডানদিক থেকে। পানাহার তো ডান হাতেই করতেন। এমনকি জুতা পরার ক্ষেত্রেও তাই করতেন- প্রথমে ডান পায়ে পরতেন, তারপর বাম পায়ে।
বাম হাত ব্যবহার করতেন কোন কোন কাজে? এ সম্পর্কে হাদীসে আছে- وَكَانَتِ الْيُسْرَى لِخَلَائِهِ وَمَا كَانَ مِنْ أَذَى (আর বাম হাত ছিল হাম্মামের কাজ ও ময়লা পরিষ্কার করার জন্য)। অর্থাৎ তিনি শৌচকর্ম করতেন বাম হাতে। এমনিভাবে নাক পরিষ্কার করা, শরীরে কোনও ময়লা বা নাপাকি লাগলে এমনিভাবে কোথাও কোনও ময়লা বা নাপাকি পড়ে থাকলে তা পরিষ্কার করার কাজে বাম হাত ব্যবহার করতেন।
ইদানীং অন্যদের দেখাদেখি মুসলিমসমাজ থেকেও ডান ও বাম হাত ব্যবহারের এ প্রভেদ অনেকটা দূর হয়ে গেছে। নির্বিচারে যে-কোনও কাজে যে-কোনও হাত ব্যবহার করতে লক্ষ করা যায়। বরং পানাহারে ডান হাতের পরিবর্তে বাম হাতের ব্যবহারই রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটাই যেন ভদ্রতা। নামাযী-কালামী মানুষকে পর্যন্ত বাম হাতে পানি ও চা পান করতে দেখা যায়। তারা অসংকোচে এটা করছে। দীনী মজলিসে পর্যন্ত বাম হাতে চা পান করতে দ্বিধাবোধ করছে না। কারণ তারা এতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এটা খুবই আফসোসের কথা। বড়ই লজ্জার কথা। আমরা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত ভুলে অমুসলিমদের সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। প্রতিদিন কত বার খাবার খাওয়া, পানি পান করা, চা পান করা, ওষুধ খাওয়া বা অন্য কিছু মুখে নেওয়া হয়ে থাকে। প্রতিবারই তা করা হচ্ছে বাম হাতে। তাহলে এ ক্ষেত্রে প্রতিদিন কতবার সুন্নতের খেলাফ করা হচ্ছে? এক পানাহারের ক্ষেত্রে আমরা রোজ কতবার নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ-পরিপন্থী কাজ করছি? এতে আমরা বিবেকের কোনও তাড়না বোধ করছি না। আমাদের দীনী অবক্ষয় কতটা গভীরে পৌঁছে গেছে! এ কেবল ডান হাতের স্থলে বাম হাতের ব্যবহার করা নয়। এটা অবিরত সুন্নতের বরখেলাফ কাজ। এটা দীনী অবক্ষয় ও ঈমানী অধঃপতনের পরিচায়ক। এর থেকে আমাদের মুক্তি পেতে হবে। আমাদের দীনী চেতনা জাগ্রত করতে হবে। ঈমান বলীয়ান করতে হবে। আর তা করা যাবে সুন্নতের অনুসরণ দ্বারা। সুন্নতের অনুসরণ বাদ দিয়ে আমরা কোনওদিনই ঈমানী বলে বলীয়ান হতে পারব না। সুতরাং অন্যান্য সুন্নতের মতো হাতের ব্যবহারেও আমাদেরকে অবশ্যই সুন্নতের পাবন্দি করতে হবে।
হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ
ক. আমরা অবশ্যই পানাহার ও পোশাক-আশাক পরিধানসহ প্রতিটি উত্তম ও রুচিকর কাজে ডানহাতের ব্যবহার করব।
খ. শৌচকর্ম এবং নাপাকি ও ময়লা পরিষ্কার করব বামহাত দিয়ে।
- ব্যাখ্যা সূত্রঃ_ রিয়াযুস সালিহীন (অনুবাদ- মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম হাফি.)
তবে একান্ত অপারগতা থাকলে সেটা ভিন্ন কথা।
ইমাম নববী রহ. বলেন,
وهذا إذا لم يكن عذر، فإن كان عذر يمنع الأكل والشرب باليمين من مرض أو جراحة أو غير ذلك فلا كراهة في الشمال
এটা তখন, যখন কোনো ওযর থাকবে না। কিন্তু যদি অসুস্থতা, আঘাত ইত্যাদি ওযর থাকে, যার কারণে ডান হাতে পানাহার গ্রহণ কষ্টকর হয় তাহলে বাম হাত ব্যবহার করা মাকরূহ হবে না। (তুহফাতুল আহওয়াযী ৫/ ৫১৮)
والله اعلم بالصواب
শাহাদাত হুসাইন ফরায়েজী
মুফতী, ফাতাওয়া বিভাগ, মুসলিম বাংলা
লেখক ও গবেষক, হাদীস বিভাগ, মুসলিম বাংলা
খতীব, রৌশন আলী মুন্সীবাড়ী জামে মসজিদ, ফেনী
মন্তব্য (0)
কোনো মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্য করুন!
মন্তব্য করতে লগইন করুন
এ সম্পর্কিত আরও জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর
মাসায়েল-এর বিষয়াদি
আল কুরআনুল কারীম
৪
হাদীস ও সুন্নাহ
৬
তাসাউফ-আত্মশুদ্ধি । ইসলাহী পরামর্শ
৩
শরীআত সম্পর্কিত
১৪
ফিতনাসমুহ; বিবরণ - করণীয়
২
আখিরাত - মৃত্যুর পরে
৩
ঈমান বিধ্বংসী কথা ও কাজ
৬
ফিরাকে বাতিলা - ভ্রান্ত দল ও মত
২
পবিত্রতা অর্জন
৮
নামাযের অধ্যায়
১৯
যাকাত - সদাকাহ
৫
রোযার অধ্যায়
৬
হজ্ব - ওমরাহ
২
কাফন দাফন - জানাযা
৫
কসম - মান্নত
১
কুরবানী - যবেহ - আকীকা
৪
বিবাহ শাদী
৮
মীরাছ-উত্তরাধিকার
২
লেনদেন - ব্যবসা - চাকুরী
৯
আধুনিক মাসায়েল
৬
দন্ড বিধি
২
দাওয়াত ও জিহাদ
৩
ইতিহাস ও ঐতিহ্য
৬
সীরাতুন নবী সাঃ । নবীজীর জীবনচরিত
৩
সাহাবা ও তাবেঈন
৩
ফাযায়েল ও মানাকেব
৩
কিতাব - পত্রিকা ও লেখক
৩
পরিবার - সামাজিকতা
৭
মহিলা অঙ্গন
২
আখলাক-চরিত্র
২
আদব- শিষ্টাচার
১২
রোগ-ব্যধি। চিকিৎসা
২
দোয়া - জিকির
২
নাম। শব্দ জ্ঞান
৩
নির্বাচিত
২
সাম্প্রতিক
১
বিবিধ মাসআলা
১