আদাবুল মাসাজিদ ও হুকুকুল মাসাজিদ
প্রশ্নঃ ৬৭২১৯. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, আমার প্রশ্ন টি হচ্ছে, যে একজন মুমিন পুরুষ এর জন্য মসজিদে কী কী হক রয়েছে? মসজিদে মুসাফির অবস্থায় থাকতে হলে কি কি বিষয় মনে চলতে হবে? জাঝাকআল্লাহ খয়রান মুহতারাম।,
১২ জুলাই, ২০২৪
২W৬৮+H৩P
উত্তর
و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
প্রবন্ধ :- ১
মসজিদের সাথে সম্পর্ক
মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহমান
মাসিক আলকাউসার
রজব ১৪৩৭ || এপ্রিল ২০১৬
মসজিদ আল্লাহ তাআলার ঘরÑ এতে তাঁর যিকির ও ইবাদত হয়। তাঁর বড়ত্ব ও মহিমার বর্ণনা হয়। তাঁর তাওহীদ ও রুবুবিয়াতের আলোচনা হয়।
আল্লাহ তাআলা বলেন, (তরজমা) ... সেইসব গৃহে, যাকে মর্যাদা দিতে ও যাতে তাঁর নাম স্মরণ করতে আল্লাহ আদেশ করেছেন। তাতে সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর তাসবীহ করে সেইসব লোক, যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বেচাকেনা আল্লাহর স্মরণ থেকে এবং নামায কায়েম ও যাকাত আদায় থেকে গাফেল করে না...। Ñসূরা নূর (২৪) : ৩৬
অন্যত্র বলেন, (তরজমা) আল্লাহ যদি মানবজাতির এক দলকে অন্য দলের মাধ্যমে প্রতিহত না করতেন, তবে ধ্বংস করে দেওয়া হত (খ্রিস্টান সংসারবিরাগীদের) উপাসনাস্থান, গির্জা, (ইহুদীদের) উপাসনালয় ও মসজিদসমূহ, যাতে আল্লাহর যিকির করা হয় বেশি-বেশি...। Ñসূরা হজ্ব (২২) : ৪০
এক বেদুইন মসজিদে পেশাব করলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, মসজিদে পেশাব বা কোনো ধরনের ময়লার কোনো অবকাশ নেই। এ তো কেবল আল্লাহর যিকির, নামায ও কুরআন তিলাওয়াতের জন্য। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ২৮৫
পৃথিবীতে জায়গার কোনো শেষ নেই এবং সবখানে আল্লাহ তাআলার যিকির করা যায়। কিন্তু এসবের মধ্যে মসজিদ এক অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এতে শুধু তাঁর যিকিরই করা যায়। যিকির পরিপন্থী কোনো কিছু তাতে জায়েয নয়। এগুলো মসজিদ নির্মাণের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পরিপন্থী। হাদীসে এসেছে, যে ব্যক্তি মসজিদে কাউকে হারানো বস্তু সন্ধান করতে শোনে সে যেন বলে, আল্লাহ তোমার কাছে তা না ফেরান। কেননা মসজিদ এ কাজের জন্য বানানো হয়নি। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ৫৬৮
এজন্য মসজিদ আল্লাহ তাআলার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা এবং দিনরাত তাঁর রহমত নাযিলের ক্ষেত্র। হাদীসের ভাষায়Ñ ‘আল্লাহর কাছে সবচেয়ে পছন্দনীয় স্থান মসজিদ আর সবচেয়ে নিকৃষ্ট স্থান বাজার।’ Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৭১
এ থেকেই উপলব্ধি করা যায়, মসজিদের সাথে মুমিনের কী গভীর সম্পর্ক থাকা উচিত এবং সেটা তার জন্য কী উপকারী ও কল্যাণকর!
বস্তুত মসজিদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন আত্মিক প্রশান্তি লাভ, আল্লাহর নৈকট্য অর্জন ও ঈমান-আমল উন্নত করার এক পবিত্র ও বরকতময় উপায়।
সুতরাং মুমিনের কর্তব্য, মসজিদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা এবং একে জ্ঞান ও আলো, হেদায়েত ও সফলতার কেন্দ্র মনে করা।
সম্পর্কের কিছু দিক
মসজিদের সাথে সম্পর্কের অনেক দিক আছে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ কিছু দিক আলোচনা করা হল১
এক. অন্তরগত সম্পর্ক
অন্তরগত সম্পর্কের বিভিন্ন দিক আছে। যেমনÑ
(ক) মসজিদের স্বরূপ উপলব্ধি ও বিশ্বাস
আগে মসজিদের যে স্বরূপ উল্লেখ করা হয়েছে সেটি গভীরভাবে উপলব্ধি ও বিশ্বাস করা কর্তব্য। মসজিদের সাথে যাবতীয় সম্পর্ক নির্ভর করে এই উপলব্ধি ও বিশ্বাসের উপর। এটা যত গভীর ও আলোকিত হবে সম্পর্ক তত দৃঢ় ও সুন্দর হবে। তাই মসজিদের স্বরূপের যথার্থ উপলব্ধি ও বিশ্বাস অতি জরুরি।
আল্লাহর যিকিরের বিস্তৃত অর্থ ও নানা অধ্যায় এবং আল্লাহর যিকির পরিপন্থী বিষয়াদি সম্পর্কেও সঠিক জ্ঞান ও উপলব্ধি অর্জন করা প্রয়োজন। যাতে মসজিদের হক আদায় হয় আর না-হক কাজ থেকে মসজিদ পবিত্র থাকে।
(খ) মসজিদের সার্বিক কল্যাণ কামনা
মসজিদের সার্বিক কল্যাণ কামনার অর্থ, প্রতিটি গ্রামে মসজিদ প্রতিষ্ঠা হোক, এসব মসজিদ সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পরিচালিত হোক, মুসল্লী ও যিকিরকারী দ্বারা পরিপূর্ণ হোক এবং এর মাধ্যমে সবখানে হেদায়েতের আলো ছড়িয়ে পড়ুকÑ এ প্রত্যাশা করা। এটা মসজিদের সাথে সম্পর্কের শুধু গুরুত্বপূর্ণ দিকই নয়, ঈমানের অংশ। পক্ষান্তরে মসজিদের কোনোরূপ অকল্যাণ কামনা এর প্রতি চরম বেআদবি ও কুফরের পরিচায়ক।
তামীম দারী রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, দ্বীন হল কল্যাণকামিতা। বর্ণনাকারী বলেন, আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, কার কল্যাণকামিতা? উত্তরে তিনি বললেন, আল্লাহর, তাঁর কিতাবের, তাঁর রাসূলের, মুসলমানদের ইমামদের এবং সকল মুসলমানের। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ৯৫
এখানে যেসব ক্ষেত্রে খুলূস ও কল্যাণকামিতাকে দ্বীন বলা হয়েছে তার মধ্যে সবার আগে রয়েছে আল্লাহ তাআলার প্রতি খুলূস ও কল্যাণকামিতা। আর এতে তাঁর প্রতি ঈমান আনা, তাঁর সঙ্গে কোনো কিছু শরীক না করা যেমন রয়েছে তেমনি মসজিদের কল্যাণকামনাও। কেননা মসজিদ তাঁর সবচেয়ে প্রিয় জায়গা।
(গ) মসজিদের সাথে অন্তরের সম্পর্ক
কর্ম অবলম্বন শুধু মানবিক প্রয়োজনই নয়, হালাল পন্থায় হালাল কর্ম অবলম্বন ইসলামের এক ফরয বিধান। এই কর্মব্যস্ততার মধ্যেও যদি মসজিদের সাথে অন্তরের সম্পৃক্ততা থাকে, তবে তা অত্যন্ত মর্যাদার বিষয়। হাদীসে এসেছে, সাত শ্রেণির মানুষকে আল্লাহ তাঁর (আরশের) ছায়াতলে আশ্রয় দিবেন, যেদিন তাঁর (আরশের) ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না। ন্যায়পরায়ণ ইমাম (বাদশাহ)। ঐ যুবক, যে তার প্রতিপালকের ইবাদতে লালিত-পালিত হয়। ঐ ব্যক্তি, যার অন্তর মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত থাকে (এখান থেকে বেরুবার পর থেকে আবার ফেরা পর্যন্ত)...। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ৬৬০; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৩১
মসজিদের সাথে অন্তর সম্পৃক্ত থাকার অর্থ, সে নামাযের সময়ের ব্যাপারে সতর্ক থাকে। সময়মত মসজিদে গমন করে। নামাযের পর যখন মসজিদ থেকে বের হয় পরবর্তী নামাযের প্রতীক্ষায় থাকে। ফলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযই সে স্বচ্ছন্দে মসজিদে গিয়ে জামাতের সাথে আদায় করতে সক্ষম হয়।
দুই. আমলগত সম্পর্ক
আমলগত সম্পর্কেরও বহু দিক আছে। যথাÑ
(ক) মসজিদে গিয়ে জামাতের সাথে নামায আদায়
নামায শুধু একটি ফরয বিধানই নয়, ঈমানের নিদর্শন এবং ইসলামের শিআর। এজন্য প্রয়োজন ছিল তা প্রকাশ্যে সম্মিলিতভাবে আদায়ের ব্যবস্থা। এ জামাতের নামায বিধিবদ্ধ হওয়ার অন্যতম তাৎপর্য। আর এর জন্য জায়গা নির্বাচিত হয় মসজিদ। প্রত্যেক সুস্থ-সবল বালেগ পুরুষের কর্তব্য পাঁচ ওয়াক্ত নামায মসজিদে গিয়ে জামাতের সাথে আদায় করা।
জামাতের ফযীলত ও উপকারিতা অনেক। এতে দৈনিক অন্তত পাঁচবার নিজের ঈমান-আমলের হিসাব নেওয়ার সুযোগ হয়। নিয়মিত নামায পড়ার সৌভাগ্য হয় এবং পারস্পরিক ঐক্য-সম্প্রীতি রক্ষার প্রেরণা জাগে ইত্যাদি।
হাদীসে এসেছে, একা নামাযের চেয়ে জামাতের নামাযের মর্যাদা সাতাশ গুণ বেশি। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৫০
অন্য এক হাদীসে এসেছে, যে সবচেয়ে দূর থেকে (মসজিদে) আসে তার নামাযের সওয়াব সবচেয়ে বেশি। তারপর যে তার চেয়ে কম দূর থেকে আসে। আর যে ইমামের সাথে নামায আদায়ের জন্য অপেক্ষা করে, সে ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা বেশি সওয়াব লাভ করবে যে নামায পড়ে ঘুমিয়ে যায়। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৬২
এ থেকে বোঝা যায়, মসজিদ দূরে হলেও সেখানে গিয়েই নামায আদায় করতে হবে এবং দূরত্ব অনুযায়ী সওয়াবের পরিমাণও বেশি হবে।
অপর এক হাদীসে আছে, ব্যক্তির জামাতের নামায ঘরে বা বাজারের নামাযের চেয়ে পঁচিশগুণ বেশি মর্যাদা রাখে। আর তা এ কারণে যে, সে যখন উত্তমরূপে অযু করে ঘর থেকে শুধু নামাযের উদ্দেশ্যেই বের হয়, তার প্রতি কদমে একটি মর্যাদা বৃদ্ধি আর একটি গুনাহ মাফ করা হয়। এরপর যখন সে নামায পড়ে তখন ফিরিশতারা তার জন্য দুআ করতে থাকে; যতক্ষণ সে নামাযের স্থানে থাকে। তারা বলে, ইয়া আল্লাহ! তুমি তাকে মাফ করো, তার প্রতি রহমত নাযিল করো। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৪৭
পক্ষান্তরে জামাতের ব্যাপারে কোনোরূপ অবহেলা অতি নিন্দনীয়। হাদীসে এ বিষয়ে কঠোরভাবে সতর্ক করা হয়েছে। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ঐ সত্তার কসম যার হাতে আমার জান! আমার ইচ্ছে হয়, আমি লাকড়ি জমা করার নির্দেশ দেই। তারপর আযানের হুকুম করি। এরপর কাউকে ইমামতির আদেশ দেই। আর আমি ঐ সব লোকের কাছে যাই, যারা নামাযে আসে না। অতঃপর তাদেরসহ তাদের ঘর জ্বালিয়ে দেই। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৫১
এ থেকে যে কেউ উপলব্ধি করতে পারবেন যে, জামাতের ব্যাপারে অবহেলা করা কত ভয়াবহ! নবী-যুগে এটাকে মুনাফিকের আলামত মনে করা হত। কারণ মুনাফিক বা অসুস্থ ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ জামাতের নামায পরিত্যাগ করত না। বরং কোনো কোনো অসুস্থ ব্যক্তিও অন্যের কাঁধে ভর করে জামাতে অংশগ্রহণ করত। (দ্রষ্টব্য : সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৫৪)
(খ) তালীমের মজলিশে উপস্থিতি
মসজিদ শুধু নামায আদায় নয়, কুরআন-হাদীস, মাসআলা-মাসাইল ও ইসলমী শিক্ষা-নির্দেশনা শেখা- শেখানোরও জায়গা। নবী যুগ থেকে সাহাবা, তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন ও পরবর্তী অনেক সময় পর্যন্ত এ কাজগুলো প্রধানত মসজিদেই সম্পন্ন হত। পরবর্তীতে এসবের জন্য স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হলেও মসজিদে তা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি এবং তা সমীচীনও নয়। কারণ মসজিদে উপস্থিতি এক স্বতন্ত্র আমল (দৈনিক অন্তত পাঁচবার)। তাই এর আগে বা পরে কিছু তালীম হওয়া শুধু সহজই নয়, বরকতময়ও বটে। হাদীসে এসেছে, যখন কিছু লোক আল্লাহর কোনো ঘরে একত্রিত হয়ে তাঁর কিতাব তিলাওয়াত করে, এর ইলম অর্জন করে এবং তা পরস্পর আলোচনা করে তখন তাদের উপর ‘সাকীনা’ নাযিল হয়, রহমত তাদের আচ্ছন্ন করে ফেলে, ফিরিশতারা তাদের বেষ্টন করে ফেলে এবং আল্লাহ তাঁর কাছে যারা থাকেন তাদের সাথে তাদের আলোচনা করেন। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৯৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৯২৭৪
সুতরাং সকলের কর্তব্য মসজিদে তালীমের ব্যবস্থা করা এবং তাতে নিয়মিত উপস্থিতির চেষ্টা করা। আর এই তালীমে ব্যাপকতা কাম্যÑ তালীমে দ্বীন, তালীমে কুরআন, দরসে কুরআন, তালীমে সুন্নাহ, তালীমে হাদীস, তালীমে ফাযাইল, তালীমে মাসাইল ইত্যাদি।
(গ) মানুষকে মসজিদের দিকে আহ্বান
নামাযের জামাত ও তালীমের মজলিশে অধিক পরিমাণে মানুষের উপস্থিতি, পুরো এলাকায় হেদায়েতের আলো বিস্তার মসজিদ আবাদের অংশ। এক্ষেত্রে নি¤েœাক্ত আয়াত দু’টি সামনে রাখা যায় :
১. (তরজমা) ..আল্লাহর মসজিদ তো আবাদ করে তারাই, যারা আল্লাহ ও পরকালে ঈমান এনেছে, নামায কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করে না। এরূপ লোকদের সম্পর্কেই আশা আছে যে, তারা হেদায়েতপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। Ñসূরা তাওবা (৯) : ১৮
২. সূরা নূরের ৩৬ নং আয়াত, যা শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে অর্থাৎ ‘সেইসব গৃহে, যাকে মর্যাদা দিতে ও যাতে তাঁর নাম স্মরণ করতে আল্লাহ আদেশ করেছেন। তাতে সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর তাসবীহ করে সেইসব লোক...’।
এ থেকে বোঝা যায়, প্রকৃত মসজিদ আবাদ কেবল বাহ্যিক কারুকার্যে নয়; বরং ক্রমাগত মুসল্লীর সংখ্যা-বৃদ্ধি, তাদের মধ্যে তাকওয়া ও খোদাভীতি সঞ্চার এবং সর্বত্র হেদায়েতের আলো ছড়িয়ে পড়া ইত্যাদিতে। এ কারণে বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রাচুর্য সত্ত্বেও তা যদি মুসল্লীশূন্য হয়, তবে সেটা বিরান হিসেবেই গণ্য হয়।
মুফতী শফী রাহ. সূরা বাকারার ১১৪ নং আয়াত (অর্থাৎ যে আল্লাহর মসজিদসমূহে তাঁর নাম নিতে বাধা দেয় এবং একে বিরান করার চেষ্টা করে...)-এর অধীনে লিখেছেন, ‘(এ থেকে) বোঝা গেল যে, মসজিদ বিরান করার যত পন্থা আছে সবই নিষিদ্ধ। এতে খোলাখুলিভাবে মসজিদ বিধ্বস্ত করা যেমন শামিল তেমনি এমন কোনো উপায়-উপকরণ সৃষ্টি করাও শামিল, যাতে তা বিরান হয়ে যায়। মসজিদের বিরান এই যে, তাতে নামাযের জন্য মানুষজন আসে না বা কম হয়। কেননা মসজিদের প্রকৃত আবাদ প্রাচীর বা কারুকার্য দ্বারা নয়, আল্লাহর যিকিরকারীদের দ্বারা...।’ Ñতাফসীরে মাআরিফুল কুরআন ১/৩০০
সুতরাং মসজিদের নির্মাণ ও উন্নয়নে যেমন চেষ্টা করা কর্তব্য তেমনি মানুষকে মসজিদমুখী করার ব্যাপারেও ঐকান্তিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা জরুরি।
পক্ষান্তরে মানুষকে মসজিদবিমুখ করা কিংবা তাতে আসতে বা যিকির-ইবাদত করতে বাধা দেওয়া খুবই অন্যায় এবং জঘন্য ধৃষ্টতা।
আল্লাহ তাআলা বলেন, (তরজমা) সেই ব্যক্তির চেয়ে বড় জালেম আর কে আছে, যে আল্লাহর মসজিদসমূহে তাঁর নাম নিতে বাধা দেয় এবং একে বিরান করার চেষ্টা করে? অথচ এরূপ লোকদের জন্য তো সংগতই ছিল না যে, ভীত-বিহ্বল না হয়ে তাতে প্রবেশ করে। এরূপ লোকদের জন্য দুনিয়ায় রয়েছে লাঞ্ছনা আর তাদের জন্য আখিরাতে রয়েছে মহা শাস্তি। Ñসূরা বাকারা (২) : ১১৪
মসজিদে যিকির বা নামায থেকে বাধা দেওয়ার যেকোনো পন্থাই না-জায়েয। তার মধ্যে একটি পন্থা হচ্ছে মসজিদে যেতে বা তাতে যিকির-ইবাদত করতে স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করা। আরেকটি পন্থা হচ্ছে মসজিদে হট্টগোল বা আশেপাশে গান-বাজনা করে মানুষের নামায বা যিকিরে বিঘœ সৃষ্টি করা। এমনিভাবে নামাযের সময় যখন মুসল্লীরা নফল নামায বা তাসবীহ কিংবা তিলাওয়াত ইত্যাদিতে মশগুল থাকে তখন মসজিদে উচ্চস্বরে তিলাওয়াত বা যিকির করা, যাতে তাদের নামাযে বিঘœ সৃষ্টি হয়Ñ এটাও এক ধরনের বাধা প্রদান। তবে মসজিদে যখন মুসল্লী না থাকে তখন উচ্চস্বরে যিকির বা তিলাওয়াত করতে কোনো অসুবিধা নেই। Ñদেখুন : তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন ১/২৯৯
(ঘ) মসজিদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় অংশগ্রহণ
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। মসজিদের ক্ষেত্রে তা আরো জরুরি। মসজিদ ইসলামের অন্যতম শিআর এবং সম্মিলিত ইবাদতের জায়গা।
কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে, (তরজমা) এবং আমি ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে গুরুত্ব দিয়ে বলেছি যে, তোমরা উভয়ে আমার ঘরকে সে সকল লোকের জন্য পবিত্র করো, যারা তাওয়াফ করবে, ইতিকাফ করবে এবং রুকূ ও সেজদা করবে। Ñসূরা বাকারা (২) : ১৬৫
এখানে বাহ্যিক নাপাকী ও ময়লা-আবর্জনা এবং বাতেনী নাপাকীÑ যেমন কুফর, শিরক বিদাআত ইত্যাদিÑ সব কিছু থেকে পবিত্র করা উদ্দেশ্য।
আর আয়াতটি কাবা ঘরের ব্যাপারে নাযিল হলেও ‘আমার ঘর’ বাক্যটি এ দিকে ইঙ্গিত করে যে, এ বিধান অন্যান্য মসজিদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কেননা সমস্ত মসজিদই তাঁর ঘর। Ñদ্রষ্টব্য : তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন ১/৩২৩
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে মহল্লায় মসজিদ বানাতে, তা পরিষ্কার রাখতে ও তাতে সুগন্ধি লাগাতে আদেশ করেছেন। Ñসুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৫৬; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ১৬৩৪
অন্য এক হাদীসে এসেছে, আমার উম্মতের ভালো-মন্দ সব আমলই আমার কাছে পেশ করা হয়। তাদের ভালো আমলগুলোর মধ্যে একটি পেয়েছি, কষ্টদায়ক বস্তু রাস্তা থেকে সরানো। আর মন্দ আমলগুলোর মধ্যে একটি পেয়েছি, মসজিদে পড়ে থাকা থুথু পরিষ্কার না করা। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ৫৫৪
সুতরাং মসজিদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার গুরুত্ব বিবেচনা করে এর জন্য আলাদা খাদেম রাখা উচিত। এক্ষেত্রে সকলের কর্তব্য মসজিদকে আর্থিকভাবে শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ করা। এভাবে সকলেই মসজিদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় অংশগ্রহণ করতে পারেন। আর সরাসরি অংশগ্রহণ তো আরো সৌভাগ্যের বিষয়।
বড় বড় ক্ষেত্র না হয় বাদই, ছোট ছোটও এমন বহু ক্ষেত্র আছে যাতে স্বচ্ছন্দে সরাসরি অংশগ্রহণ করা যায়। যেমন কাগজের টুকরা পড়ে আছে, সেটা নির্দিষ্টি জায়গায় রেখে দেওয়া। কার্পেট বা তার উপরের চাদর এলোমেলো হয়ে আছে, তা ঠিক করে দেওয়া ইত্যাদি। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, প্রত্যেকের এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা যে, আমার দ্বারা যেন মসজিদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ক্ষুণœ না হয়।
(ঙ) ইতিকাফ
মসজিদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের সাথে ইতিকাফের সম্পর্ক সুগভীর। ইতিকাফের মধ্য দিয়ে বান্দা যে একাগ্রচিত্তে তার প্রতিপালকের যিকির-ইবাদতে মশগুল থাকার সৌভাগ্য অর্জন করে সেটার কোনো তুলনা হয় না। তার উপর তা যদি হয় রমযানুল মুবারকে তাহলে তো নূরুন আলা নূর!
যে খায়ের, বরকত ও ফযীলত নিয়ে রমযানুল মুবারাকের আগমন ঘটে, তা অর্জনের ক্ষেত্রে ইতিকাফের ভূমিকা অসাধারণ। রমযানুল মুবারকের এক বড় নিআমত লাইলাতুল কদর। বিভিন্ন হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, এটি রমযানের শেষ দশকেরই কোনো এক রাত। এজন্য শেষ দশকে সাধ্য মত পুরো রাত ইবাদতে কাটানোর বিশেষ নির্দেশ রয়েছে, যা অধিকতর সহজ হয় ইতিকাফের মাধ্যমেই।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাদানী জীবনে এক বছর ছাড়া২ বাকি সব বছর ইতিকাফ করেছেন এবং উম্মতকেও এর প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন।
এজন্য প্রতিটি মসজিদে অন্তত একজনের ইতিকাফ করা অবশ্যকর্তব্য। কেউ না করলে পুরো এলাকাবাসী সুন্নাতে মুআক্কাদা ছাড়ার গুনাহগার হবে।
(চ) আযান
আযান ইসলামের অন্যতম শিআর এবং পূর্ণাঙ্গ ও প্রভাবক এক আহ্বান। এতে ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো তথা তাওহীদ, রিসালাত ও মসজিদে নামায আদায়ের আহ্বান রয়েছে। এ দিক থেকে মসজিদের সাথে আযানের সম্পর্ক বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ। মুমিনের কর্তব্য বিশুদ্ধ আযান শিক্ষা করা এবং সময়-সুযোগ হলে আযান দেওয়া। আর মুয়াযযিন হওয়ার সৌভাগ্য হলে তো কোনো কথাই নেই!
হাদীসে এসেছে, কিয়ামতের দিন মুয়াযযিনদের ঘাড় সকলের চেয়ে উঁচু হবে। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ৩৮৭
অন্য হাদীসে আছে, মুয়াযযিনের দূর-আওয়ায মানুষ বা জিন কিংবা যেকোনো বস্তু শুনে, কিয়ামতের দিন সে তার জন্য সাক্ষ্য দিবে। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ৬০৯
তিন. অর্থগত সম্পর্ক
প্রতিটি গ্রামে একটি মসজিদ আবশ্যক এবং তা এতটুকু প্রশস্ত ও উন্নত হওয়া উচিত যাতে এলাকাবাসী সকলেই স্বচ্ছন্দে ও প্রয়োজনীয় আরামের সাথে নামাযসহ মসজিদের সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আমল করতে সক্ষম হয়।
এর প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব সরকারের। দ্বিতীয় পর্যায়ে জনগণের। প্রত্যেকের কর্তব্য নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী মসজিদের নির্মাণ ও উন্নয়নে সহায়তা করা। যাতে যেসব গ্রামে মসজিদ নেই বা থাকলেও তেমন উন্নত নয় সেখানে একটি উন্নত মসজিদ নির্মাণসহ যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ সম্ভব হয়। এটি অত্যন্ত সওয়াবের কাজ এবং সদকায়ে জারিয়ার অন্তর্ভুক্ত। হাদীসে এসেছে, যে আল্লাহর (সন্তুষ্টির) জন্য মসজিদ নির্মাণ করে, আল্লাহর তার জন্য জান্নাতে অনুরূপ ঘর তৈরি করবেন। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ৪৫০
প্রবন্ধ :- ২
হাদীসের আলোকে মসজিদে ঘুমানোর শরয়ী বিধান
মাওলানা তাহমীদুল মাওলা
আহলে হক মিডিয়া
এক ভাই আমাকে কয়েকটি বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলেন এবং সাথে একটি প্রবন্ধের ফটোকপি পাঠিয়ে ছিলেন। যাতে লেখা হয়েছে, তাবলীগ জামাতের মসজিদে রাত্রি যাপন হারাম, তারা মসজিদে বায়ূত্যাগ করে যা গুনাহের কাজ, হানাফী মাযহাবে একদিন এক রাতের কম কোন ইতিকাফ নেই, রোযা না রেখে ইতিকাফ হয় না ইত্যাদি। অকথ্য ভাষায় অভদ্রতার চরম সীমা অতিক্রম করে তিনি লিখেছেন। তবে এখানে আমি তার পরিচয় উল্লেখ করিনি। কারণ, ব্যক্তির পরিচয়ের মধ্যে কোন কল্যান নেই । বিধান জানাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য।
আমি প্রশ্নকারীকে বিষয়গুলো মুখে বললাম। তখন তিনি আমাকে সেগুলো লিখে দেওয়ার অনুরোধ করেন। এ বিষয়ের দলিল প্রমাণ হাদীস ও ফিকহের কিতাবে ভরপুর। যা একত্র করতে চাইলে রীতিমত একটি পুস্তকে হয়ে যাবে। কিন্তু তখন আমি চরম ব্যস্ততার মাঝে তাড়াহুড়ো করে কিছু কথা লিখে দিয়েছিলাম। বিষয়টি যেহেতু অনেকেই জানতে চায়, তাই আমার ইচ্ছা হল, আপাতত এতটুকুই পাঠকের হাতে তুলে দেই।
১. মসজিদে ঘুমানোর হুকুম কী?
২. নফল ইতিকাফের সর্বনিম্ন পরিমাণ কতটুকু? নফল ই‘তিকাফের জন্য কি রোজা রাখা শর্ত?
৩. মসজিদে বাতকর্ম (বায়ু ত্যাগ) করার বিধান কী?
উত্তর
(১) মসজিদে ঘুমানো সম্পর্কে কয়েকটি হাদীস-
ইমাম বুখারী রহ. (মৃ.২৫৬ হি.) সহীহ বুখারীতে একটি অধ্যায় রেখেছেন, باب نَوْمِ الْمَرْأَةِ فِي الْمَسْجِدِ ‘মহিলাদের জন্য মসজিদে ঘুমানো জায়েয’। এ অধ্যায়ে দলীল হিসেবে বর্ণনা করেন,
عَنْ عَائِشَةَ “أَنَّ وَلِيدَةً كَانَتْ سَوْدَاءَ لِحَيٍّ مِنْ …فَجَاءَتْ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأَسْلَمَتْ قَالَتْ عَائِشَةُ فَكَانَ لَهَا خِبَاءٌ فِي الْمَسْجِدِ أَوْ حِفْشٌ قَالَتْ فَكَانَتْ تَأْتِينِي فَتَحَدَّثُ عِنْدِي قَالَتْ فَلاَ تَجْلِسُ عِنْدِي مَجْلِسًا إِلاَّ قَالَتْ: وَيَوْمَ الْوِشَاحِ مِنْ تعَاجِيبِ رَبِّنَا … أَلاَ إِنَّهُ مِنْ بَلْدَةِ الْكُفْرِ أَنْجَانِي
একটি বাঁদীর ঘটনা। ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন হযরত আয়শা রা.। তিনি বলেন মহিলাটি ইসলাম গ্রহণ করলে তাঁর থাকার জন্য মসজিদে একটি তাবু খাটানো হল। সহীহ বুখারী হা. নং ৪৩৯
এ হাদীসে ব্যাখ্যায় ‘হানাফী’ ফকীহ ও মুহাদ্দিস আল্লামা আইনী রহ. বলেন,
قال ابن بطال فيه أن من لم يكن له مسكن ولا مكان مبيت يباح له المبيت في المسجد سواء كان رجلا أو امرأة
ইবনে বত্তাল রহ. বলেছেন, এ হাদীস থেকে বুঝা যায় রাত যাপনের স্থান নেই এমন যে কোন নারী-পুরুষের জন্য মসজিদে থাকা জয়েয। (উমদাতুল কারী, বুখারী শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ)
অতঃপর ইমাম বুখারী আরেকটি অধ্যায়ের শিরোনাম দিয়েছেন, بَاب نَوْمِ الرِّجَالِ فِي الْمَسْجِدِ অর্থাৎ ‘পুরুষদের জন্য মসজিদে ঘুমানো জায়েয’। এ অধ্যায়ে দলিল হিসেবে তিনটি হাদীস বর্ণনা করেছেন।
১. সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. নিজের সম্পর্কে বলেন,
عَبْدُ اللَّهِ، ” أَنَّهُ كَانَ يَنَامُ وَهُوَ شَابٌّ أَعْزَبُ لَا أَهْلَ لَهُ فِي مَسْجِدِ النَّبِيِّ . ولفظ ابن ابى شيبة-كنا ونحن شباب نبيت في عهد رسول الله صلى الله عليه و سلم في المسجد ونقيل. وهكذا لفظ الترمذى.
তিনি ছিলেন অবিবাহিত যুবক। স্ত্রী-পুত্র কেউ ছিল না। তখন তিনি মসজিদে নববীতেই (রাতে ও দিনে) ঘুমাতেন। (সহীহ বুখারী,) জামে তিরমিযী (তিরমিযী শরীফ) ও ইবনে আবীশাইবার বর্ণনায় বক্তব্যটি তুলে ধরা হয়েছে এভাবে, ‘আমারা একদল যুবক রাতে ও দিনে মসজিদে শয়ন করতাম’।
এ হাদীসের ব্যাখ্যায় হাফেজ আইনী রহ. (মৃ.৮৫৫ হি.) বলেন,
وهو جواز النوم في المسجد لغير الغريب …
এতে স্থানীয় লোকদের জন্যও (যারা মুসাফির নয়) মসজিদে ঘুমানো জায়েয বলে প্রমাণিত হয়। (উমদাতুল কারী)
হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ. (মৃ.৮৫২ হি.) বলেন,
قوله: “باب نوم الرجال في المسجد” أي جواز ذلك، وهو قول الجمهور،
অর্থাৎ পুরুষদের জন্য মসজিদে ঘুমানো জায়েয। এটাই অধিকাংশের মত। (ফাতহুল বারী)
২. হযরত সাহল ইবনে সা‘দ রা. বলেন,
” جَاءَ رَسُولُ اللَّهِ بَيْتَ فَاطِمَةَ فَلَمْ يَجِدْ عَلِيًّا فِي الْبَيْتِ، فَقَالَ: أَيْنَ ابْنُ عَمِّكِ؟ قَالَتْ: كَانَ بَيْنِي وَبَيْنَهُ شَيْءٌ فَغَاضَبَنِي فَخَرَجَ فَلَمْ يَقِلْ عِنْدِي، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ لِإِنْسَانٍ: انْظُرْ أَيْنَ هُوَ، فَجَاءَ فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، هُوَ فِي الْمَسْجِدِ رَاقِدٌ، فَجَاءَ رَسُولُ اللَّهِ وَهُوَ مُضْطَجِعٌ قَدْ سَقَطَ رِدَاؤُهُ عَنْ شِقِّهِ وَأَصَابَهُ تُرَابٌ، فَجَعَلَ رَسُولُ اللَّهِ يَمْسَحُهُ عَنْهُ، وَيَقُولُ: قُمْ أَبَا تُرَابٍ، قُمْ أَبَا تُرَابٍ.
একদিন রাসূলুল্লাহ সা. হযরত ফাতেমার ঘরে এসে আলীকে (রা.) পাননি। জিজ্ঞেস করলেন, আলী কোথায়? ফাতেমা বললেন, আমাদের দু’জনে মধ্যে কিছু রাগারাগি হয়েছে। ফলে তিনি রাগ করে এখানে বাইরে চলে গেছেন। রাসূলুল্লাহ সা. একজনকে বললেন, তাকে একটু খুঁজে দেখ কোথায়। লোকটি এসে জানাল, আলী মসজিদে ঘুমিয়ে আছেন। রাসূলুল্লাহ সা. এসে দেখলেন আলী শুয়ে আছেন। শরীর এক পাশ থেকে চাদর পড়ে গেছে। আর গায়ে ধুলো-বালি লেগে রয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর গায়ের বালি ঝেঁড়ে দিচ্ছেন আর বলছেন ‘আবু তোরাব উঠ উঠ। (সহীহ বুখারী)
এ হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা আইনী রহ. (মৃ.৮৫৫ হি.) বলেন,
فيه إباحة النوم في المسجد لغير الفقراء ولغير الغريب وكذا القيلولة في المسجد فإن عليا لم يقل عند فاطمة رضي الله تعالى عنها ونام في المسجد وفي كتاب المساجد لأبي نعيم من حديث بشر بن جبلة عن أبي الحسن عن عمرو بن دينار عن نافع بن جبير بن مطعم عن أبيه يرفعه لا تمنعوا القائلة في المسجد مقيما ولا ضيفا.
এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয়, ঘর-বাড়িহীন দরিদ্র ও ভীনদেশী মুসাফির ছাড়া স্থানীয়দের জন্যও মসজিদে ঘুমানো জায়েয। অনুরূপ মসজিদে কাইলূলা (দিবসকালীন বিশ্রাম) করাও জায়েয। কারণ (জায়েয বলেই) হযরত আলী (রা.) ফাতেমা রা. এর ঘরে বিশ্রাম না করে মসজিদে গিয়ে ঘুমালেন। ইমাম আবু নু‘আইম ইসফাহানী রহ. ‘কিতাবুল মাসাজিদে’ হযরত জুবাইর ইবনে মুতইম রা. থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, মেহমান বা স্থানীয় যে কেউ মসজিদে বিশ্রাম নিতে আসলে তাকে বাধা দিও না। (উমদাতুল কারী)
৩. তৃতীয় বর্ণনায় আহলে ছুফফার বিবরণ তুলে ধরেছেন। তাঁরা মসজিদে নববীতেই রাত দিন থাকতেন। এ অধ্যায়ে উল্লিখিত হাদীসের ব্যাখ্যায় হাফেজ ইবনে রজব রহ. (মৃ.৭৯৫ হি.) বলেন,
وليس المقصود من ذلك في هذا الباب إلا نومهم في المسجد ولا شك في أن أهل الصفة كانوا ينامون في المسجد ، لم يكن لهم مأوى بالليل والنهار غير الصفة ،
এখানে এ হাদীস বর্ণনা করার উদ্দেশ্য আহলে ছুফফার মসজিদে ঘুমানোর কথা তুলে ধরা। সন্দেহ নেই আহলে ছুফফা মসজিদেই ঘুমাতেন। রাত দিনে তাদের ঘুমানোর আর কোন স্থান ছিল না।
ইবনে সা‘দ রহ. (মৃ.২৩০ হি.) বর্ণনা করেন,
عن يزيد بن عبد الله بن قسيط ، قال : كان أهل الصفة ناسا فقراء من أصحاب رسول الله لا منازل لهم ، فكانوا ينامون على عهد رسول الله في المسجد ويظلون فيه ، ما لهم مأوى غيره ،..ذكره ابن رجب فى فتح البارى له
আহলে ছুফফা ছিলেন রাসূলের একদল দরিদ্র সাহাবী। তাদের কোন বাড়ি ঘর ছিল না। তাঁরা মসজিদেই ঘুমাতেন, মসজিদেই থাকতেন। এছাড়া তাদের আর কোন আশ্রয় ছিল না। (তাবাকাতুল কুবরা, ইবনে সাদ, ফাতহুল বারী, ইবনে রাজব)
এ সংক্রান্ত আরো কয়েকটি হাদীস
৪. সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যায়েদ আনসারী রা. বলেন,
” أَنَّهُ رَأَى رَسُولَ اللَّهِ مُسْتَلْقِيًا فِي الْمَسْجِدِ وَاضِعًا إِحْدَى رِجْلَيْهِ عَلَى الْأُخْرَى
আমি রাসূলুল্লাহ সা. কে দেখেছি, মসজিদে এক পা অপর পায়ের উপর রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন। (সহীহ বুখারী)
৫. হযরত আসমা বিনতে ইয়াযীদ বলেন,
أَنَّ أَبَا ذَرٍّ الْغِفَارِيَّ كَانَ يَخْدُمُ النَّبِيَّ صلى الله عليه و سلم فَإِذَا فَرَغَ مِنْ خِدْمَتِهِ، آوَى إِلَى الْمَسْجِدِ، فَكَانَ هُوَ بَيْتُهُ، يَضْطَجِعُ فِيهِ، فَدَخَلَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه و سلم الْمَسْجِدَ لَيْلَةً، فَوَجَدَ أَبَا ذَرٍّ نَائِمًا مُنْجَدِلًا فِي الْمَسْجِدِ، فَنَكَتَهُ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه و سلم بِرِجْلِهِ حَتَّى اسْتَوَى جَالِسًا، فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه و سلم :” أَلَا أَرَاكَ نَائِمًا؟ “، قَالَ أَبُو ذَرٍّ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، فَأَيْنَ أَنَامُ، هَلْ لِي مِنْ بَيْتٍ غَيْرُهُ؟،. قال فى المجمع: رواه أحمد والطبراني وروى بعضه في الكبير وفيه شهر بن حوشب وفيه كلام وقد وثق
হযরত আবুযর রা. রাসূলুল্লাহ সা. -এর খেদমত করতেন। ফারেগ হলেই মসজিদে চলে যেতেন। মসজিদই ছিল তাঁর ঘর। এখানেই ঘুমাতেন। একদিন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসে দেখলেন, আবুজর মসজিদে শুয়ে আছেন। তিনি তাকে পা দিয়ে স্পর্শ করলেন। আবুযর রা. উঠে বসলেন। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এখানে ঘুমিয়ে কেন? আবুযর বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! কোথায় ঘুমাব আর ?! এ ছাড়াকি আমার আর কোন ঘর আছে? (মুসনাদে আহমদ হা.২৬৯২৮ মাজমাউয যাওয়াইদ হা. ২০২৩)
অন্য বর্ণনায় রয়েছে,
أنه كان يخدم النبي صلى الله عليه و سلم فإذا فرغ من خدمته أتى المسجد فاضطجع فيه.رواه الطبراني في الأوسط وفيه شهر وفيه كلام وقد وثق
তিনি রাসূলুল্লাহ সা. -এর খেদমত করতেন। যখনই অবসর হতেন, মসজিদে এসে শুয়ে আরাম করতেন। (আলমুজামুল আওসাত, তাবারানী। মাজমাউয যাওয়াইদ হা. ২০২৪)
মোট কথা হযরত আবু যর রা. এর থাকার মত কোন ঘরই ছিল না। তিনি সব সময়ই মসজিদে থাকতেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন দিনই তাঁকে মসজিদে ঘুমাতে নিষেধ করেননি।
খলীফা হযরত উমর ও হযরত উসমান রা.
বুখারী শরীফের এক বর্ণনায় রয়েছে, সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যায়েদ আনসারী রা. বলেন,
” أَنَّهُ رَأَى رَسُولَ اللَّهِ مُسْتَلْقِيًا فِي الْمَسْجِدِ وَاضِعًا إِحْدَى رِجْلَيْهِ عَلَى الْأُخْرَى ” وَعَنِ ابْنِ شِهَابٍ، عَنْ سَعِيدِ بْنِ الْمُسَيِّبِ، قَالَ: كَانَ عُمَرُ وَعُثْمَانُ يَفْعَلَانِ ذَلِكَ.
আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছি, মসজিদে এক পা অপর পায়ের উপর রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন। হযরত সায়ীদ ইবনুল মুসায়্যিব বলেন, হযরত উমর ও উসমান রা. ও এভাবে মসজিদে ঘুমাতেন। (সহীহ বুখারী)
হযরত হাসান বছরী (মৃত. ১১০ হি.) রা. বলেন,
قال رأيت عثمان بن عفان نائما فيه ليس حوله أحد وهو أمير المؤمنين قال وقد نام في المسجد جماعة من السلف …
আমি হযরত উসমান রা. কে দেখেছি মসজিদে ঘুমিয়ে আছেন। তাঁর পাশে কেউ নেই। অথচ তখন তিনি আমীরুল মুমিনীন। হযরত হাসান আরো বলেন, সাহাবা তাবেয়ীদের অনেকেই মসজিদে ঘুমাতেন। (তাবারী, উমদাতুল কারী)
এ বিষয়ে মহান তাবেয়ীদের কয়েকজনের মতামত তুলে ধরছি
۱. عن الحارث بن عبد الرحمن قال سألت سليمان بن يسار عن النوم في المسجد فقال كيف تسألون عن هذا وقد كان أهل الصفة ينامون فيه ويصلون فيه
১.হযরত হারেস ইবনে আব্দুর রহমান বলেন, হযরত সুলায়মান ইবনে ইয়াসারকে জিজ্ঞেস করলাম, মসজিদে ঘুমানোর বিধান কী? তিনি উত্তরে বললেন, তোমরা কেন এবিষয়ে প্রশ্ন কর? আহলে ছুফফাতো মসজিদেই থাকতেন, মসজিদেই নামাজ পড়তেন। অর্থাৎ মসজিদে ঘুমানো জায়েয। আহলে ছুফফার মসজিদে ঘুমানোটাই এর দলীল। (মুসান্নাফে ইবনে আবীশাইবা হা. ৪৯১১)
٢. عن يونس قال رأيت بن سيرين ينام في المسجد
২.হযরত ইউনুস রহ. বলেন, আমি তাবেয়ী ইবনে সীরীনকে মসজিদে ঘুমাতে দেখেছি। (মুসান্নাফে ইবনে আবীশাইবা )
٣. عن الحسن قال كان له مسجد يصلي فيه وينام فيه
৩.বিখ্যাত তাবেয়ী হযরত হাসান বছরী রহ. এর একটি মসজিদ ছিল। তিনি তাতে নামাজও পড়তেন, ঘুমাতেনও। (মুসান্নাফে ইবনে আবীশাইবা হা. ৪৯১৩)
٤. عن بن جريج قال قلت لعطاء أتكره النوم في المسجد قال بل أحبه
৪.ইবনে জুরাইজ রহ. বলেন, আমি হযরত আতা রা. কে জিজ্ঞেস করলাম, মসজিদে ঘুমানোকে কি আপনি অপছন্দ করেন? বললেন, না, বরং মসজিদে ঘুমানোকে আমি পছন্দ করি। (মুসান্নাফে ইবনে আবীশাইবা হা. ৪৯১৭)
٥. سعيد بن المسيب إنه سئل عن النوم في المسجد فقال أين كان أهل الصفة يعني ينامون فيه
৫.হযরত সায়ীদ ইবনুল মুসায়্যিবকে জিজ্ঞেস করা হল, মসজিদে ঘুমানো জায়েয আছে কী? তিনি উত্তরে বললেন, আহলে ছুফ্ফা কোথায় থাকতেন তাহলে? অর্থাৎ তারা মসজিদেই ঘুমাতেন। (সুতরাং মসজিদে ঘুমানো জায়েয এবং এটি সুস্পষ্ট) (মুসান্নাফে ইবনে আবীশাইবা হা. ৪৯২২)
٦. عن بن أبي نجيح قال نمت في المسجد الحرام فاحتلمت فيه فسألت سعيد بن جبير فقال اذهب واغتسل يعني ولم ينهه
৬.হযরত ইবনে আবী নাজীহ বলেন , আমি মসজিদে হারামে ঘুমিয়েছিলাম। তখন আমার স্বপ্নদোষ হল। তাবেয়ী সায়ীদ ইবনে জুবাইর রহ. কে জিজ্ঞেস করলাম, কি করব? বলেন, গোসল করে আস। অর্থাৎ তিনি তাকে মসজিদে ঘুমাতে নিষেধ করেননি। (মুসান্নাফে ইবনে আবীশাইবা হা. ৪৯২৩ )
۷. وقال عمرو بن دينار : كنا نبيت في المسجد على عهد ابن الزبير .
৭.হযরত আমর ইবনে দীনার বলেন, সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর রা. এর খিলাফত কালে আমরা মসজিদেই রাত যাপন করতাম। (ফাতহুল বারী, ইবনে রজব।)
সার কথা
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়সাল্লাম, খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত উমর, হযরত উসমান, হযরত আলী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর, হযরত আবুযর গিফারী রা. ও আহলে ছুফ্ফা সকলেই মসজিদে ঘুমিয়েছেন। তাই তাবেয়ী-তবে তাবেয়ীনের অনেকেই মসজিদে ঘুমিয়েছেন এবং নির্দ্বিধায় মসজিদে ঘুমানোকে জায়েয বলেছেন। ফলে প্রসিদ্ধ চার মাযহাবের ইমামগণ, আবু হানীফা, মালেক, শাফেয়ী ও আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. প্রয়োজনে মসজিদে ঘুমানোকে জায়েয বলেছেন। তবে ইমাম মালেক ও আহমদ রহ. বলেছেন, নিজের পৃথক ঘুমানোর জায়গা থাকা সত্ত্বেও মসজিদকে নিয়মিত ঘুমানোর জায়গা বানিয়ে নেয়া উচিত নয়। হাঁ ইবাদত ও নেক কাজের উদ্দেশ্যে সকল মাযহাবেই নির্দ্বিধায় মসজিদে ঘুমানো জায়েয। (দ্র. ফাতহুল বারী, ইবনে রজব, ই‘লামুস্-সাজিদ বিআহ্কামিল মাসাজিদ, মুহাম্মদ ইবনে আব্দিল্লাহ যারকাশী (মৃ.৭৯৪ হি.) পৃ. ৩০৫-৩০৭)
হানাফী মাযহাব
বদরুদ্দীন আইনী রহ. (মৃ. ৮৫৫ হি.) হানাফী মাযহাবের একজন উল্লেখযোগ্য মুহাদ্দিস ও ফকীহ। মসজিদে ঘুমানো জায়েয হওয়া সম্পর্কে তাঁর সুস্পষ্ট বক্তব্য পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। তথাপি হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ কিতাব ‘আলফাতাওয়াল হিন্দিয়া’য় (ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী) উদ্ধৃত হয়েছে,
وَلَا بَأْسَ لِلْغَرِيبِ وَلِصَاحِبِ الدَّارِ أَنْ يَنَامَ في الْمَسْجِدِ في الصَّحِيحِ من الْمَذْهَبِ وَالْأَحْسَنُ أَنْ يَتَوَرَّعَ فَلَا يَنَامُ كَذَا في خِزَانَةِ الْفَتَاوَى
বিশুদ্ধ মত অনুসারে মুসাফির ও স্থানীয় উভয়ের জন্যই মসজিদে ঘুমানো জায়েয। তবে উত্তম হল (অবশ্য প্রয়োজন ছাড়া) না ঘুমানো। খিযানাতুল ফাতাওয়া। (ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী)
তবে অপ্রয়োজনে ঘুমানো উচিত নয় উল্লেখ করে অনত্র বলেন,
وَيُكْرَهُ النَّوْمُ وَالْأَكْلُ فيه لِغَيْرِ الْمُعْتَكِفِ وإذا أَرَادَ أَنْ يَفْعَلَ ذلك يَنْبَغِي أَنْ يَنْوِيَ الِاعْتِكَافَ فَيَدْخُلَ فيه وَيَذْكُرَ اللَّهَ تَعَالَى بِقَدْرِ ما نَوَى أو يُصَلِّيَ ثُمَّ يَفْعَلَ ما شَاءَ كَذَا في السِّرَاجِيَّةِ
ই‘তিকাফের নিয়ত ছাড়া মসজিদে ঘুমানো ও খাওয়া-দাওয়া করা মাকরূহ (তবে এটি মাকরূহে তাহরীমী তথা হারাম নয়; বরং মাকরূহে তান্যীহী অর্থাৎ অপসন্দনীয় ও অনুচিত কাজ)। তাই যদি কেউ মসজিদে ঘুমাতে চায়, তাহলে তার উচিৎ ই‘তিকাফের নিয়তে মসজিদে প্রবেশ করে ইচ্ছানুসারে আল্লাহর যিকর অথবা নামায পড়ে নেবে। তার পর যা ইচ্ছা করবে। সিরাজিয়া। (ফাতাওয়ায়ে আলমগীরী)
ইমাম আলাউদ্দীন হাছ্কাফী রহ. (মৃ. ১০৮৮ হি.) এর বক্তব্যের ব্যাখ্যায় ইবনে আবীদীন শামী রহ. (মৃ.১২৬০ হি.) তাঁর বিখ্যাত ফিকাহ গ্রন্থ “ফতুয়ায়ে শামীতে” লেখেন,
قال فى الدر المختار: لكن قال ابن كمال لا يكره الأكل والشرب والنوم فيه مطلقا ونحوه في المجتبى. وقال ابن عابدين فى شرحه: ( قوله لكن إلخ ) استدراك على ما في الأشباه وعبارة ابن الكمال عن جامع الإسبيجابي لغير المعتكف أن ينام في المسجد مقيما كان أو غريبا أو مضطجعا أو متكئا رجلاه إلى القبلة أو إلى غيرها فالمعتكف أولى ا هـ ونقله أيضا في المعراج وبه يعلم تفسير الإطلاق. قال ط : لكن قوله رجلاه إلى القبلة غيرمسلم لما نصوا عليه من الكراهة ومفاد كلام الشارح ترجيح هذا الاستدراك. والظاهر أن مثل النوم الأكل والشرب إذا لم يشغل المسجد ولم يلوثه لأن تنظيفه واجب كما مر.
ইবনু কামাল পাশা রহ.‘জামে ইস্বীজানীর’ উদ্ধৃতিতে বলেন, ই‘তিকাফকারী ছাড়া অন্যদের জন্যও মসজিদে ঘুমানো জায়েয। ব্যক্তি স্থানীয় হোক বা মুসাফির। চিৎ হয়ে ঘুমাক কিংবা কিবলার দিকে বা যে কোন দিকে পা দিয়ে। সুতরাং ই‘তিকাফকারীর জন্য মসজিদে ঘুমানো জায়েয হওয়ার বিষয়টি সুস্পষ্ট। শামী রহ. বলেন, মি‘রাজুদদিরায়া কিতাবেও তা উদ্ধৃত করেছেন। … তবে তাঁর বক্তব্যে কিবলার দিকে পা দেওয়া জায়েয হওয়ার বিষয়টি অগ্রহণযোগ্য। বরং তা মাকরূহ। শামী রহ. বলেন, মসজিদে ঘুম খাবার-দাবার জায়েয বটে; কিন্তু তা যেন মসজিদকে অপবিত্র না করে। কারণ মসজিদ পবিত্র রাখা ওয়াজিব। (রদ্দুল মুহতার, ফাতাওয়ায়ে শামী)
সুতরাং মসজিদে ই‘তিকাফের নিয়ত ছাড়াই ঘুমানো জায়েয। তবে ই‘তিকাফের নিয়ত করে নেয়া ভাল। তবে সর্বাবস্থায়ই মসজিদের আদবের প্রতি লক্ষ রাখা আবশ্যক।
উপরোল্লেখিত আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট বুঝা যায়,
১.যার থাকার যায়গা নেই, যে মুসাফির বা পথিক (এখানে মুসাফির বলতে বাড়ি থেকে দূরে যে কোন লোককেই বুঝানো হয়েছে। ফিকহ শাস্ত্রের পরিভাষার মুসাফির উদ্দেশ্য নয়)
২.যে ইবাদত বন্দেগী তথা নেক কাজ করার জন্য মসজিদে থাকতে চায়,
৩.যে ইতিকাফের নিয়ত করেছে,
৪.যে দীনী ইলম, জ্ঞান শিখতে বা শিখাতে চায় তাদের সকলের জন্যত মসজিদে থাকা অবশ্যই জায়েয। ৫.বরং এসকল উদ্দেশ্য ছাড়াও মসজিদে ঘুমানো যায়েজ। তবে এক্ষেত্রে ইতিকাফের নিয়ত করে নেয়া ভাল।
বলা বাহুল্য যে,
১.তাবলীগ জামাতের লোকেরা সাধারণত মুসাফিরই হয়ে থাকে। অন্তত বাড়ী থেকে এত দূরে যায় যেখান থেকে বাড়ীতে এসে ঘুমাতে হলে তাঁর দাওয়াতের কাজ, তাঁর দীন শিক্ষা করা বা দীন শিক্ষা দেওয়ার মূল উদ্দেশ্যটিই ব্যর্থ হবে।
২.তা ছাড়া তাবলীগে গমনের একটি মৌলিক উদ্দেশ্য হল, (ফাজায়েলে আমল ইত্যাদি) তালীমের মাধ্যমে, মোজাকারা (পরষ্পরে আলোচনা) ও মোশাওয়ারার মাধ্যমে নিজে দীন শিক্ষা করা, অন্য নতুন সাথীদেরকে দীন শিক্ষা দেওয়া এবং এলাকার মুসলমান ভাইদেরকে দীন শিক্ষা দেওয়া ও তাদেরকে মসজিদমুখী করা।
৩.তাছাড়া তাবলীগে গমনের আরেকটি প্রধান উদ্দেশ্য হল, মানুষ আপন বাড়িতে নিজ পরিবেশে থেকে গুনাহে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। তাদের গুনাহের অভ্যাস ছাড়িয়ে নেক কাজের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলার জন্যই বছরে এবং মাসে কিছু দিন আল্লাহর ঘরে নেক কাজের উদ্দেশ্যে থাকা। ৪. লোকেরা যখন তাবলীগের উদ্দেশ্যে বের হয়, তখন মারকাজ থেকে তাদের উদ্দেশ্যে বেশ কিছু গুরুত্ত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেয়া হয় অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে কঠুরতার সাথে। তাদের পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত যিম্মাদারকে তত্ত্বাবধান করার দায়িত্ব থাকে। তখন তাদের বলা হয়, সব সময় নফল ইতিকাফের নিয়ত করে রাকতে। এবং মসজিদের সকল আদব রক্ষা করে চলতে।
সুতরাং উপরে উল্লেখিত চারটি কোন একটি শর্ত না থাকলেও মসজিদে ঘুমানো যায়েজ। কোন একটি শর্ত পাওয়া গেলেতো অবশ্যই যায়েজ। আর যদি চারটি শর্তই থাকে তাহলে তাদের মসজিদে থাকার বিষয়ে প্রশ্ন তোলে সাহস কার আছে বলেন!
বিশেষ করে আল্লাহ তাআলা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে হুকুম করেছেন, “ তোমরা আমার ঘরকে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী ও রুকু সেজদাকারী তথা, নামাযীদের জন্য পবিত্র করে রাখ” (সূরা বাকারা আয়াত, ১২৫)
এখানে আল্লাহ তাআলা ইতিকাফকারীদের জন্য তাঁর ঘরকে সাজিয়ে রাখতে বলেছেন। সুতরাং কেউ যদি মসজিদে থাকার সময় ইতিকাফের নিয়ত করে তাহলে কার সাধ্য আছে আল্লাহর মেহমানকে আল্লাহর ঘরে থাকতে বাধা দেয়ার!
আসলে আমাদের সমাজের সাধারণ মুসলমানরা না জানার কারণে বা কিছু মুর্খ, স্বার্থান্বেশী, দাওয়াতজীবী ও ওয়াজজীবী, দাওয়াত খাওয়া ও ওয়াজেব্যবসা করাই যাদের পেশা, এমন লোকদের কথায় কথায় কত বড় অন্যায় করে আসছে! এটাত আল্লাহর বিরুদ্ধে শত্রুতা! আল্লাহর দুশমনি! হায়, কে বুঝাবে তাদের। এরা বুঝতেও রাজি না। আল্লাহ, এরাতো আমাদেরই জ্ঞাতি ভাই। এদের তুমি সঠিক জ্ঞান দান কর। আমাদেকে এবং তাদেরকে সকলকে ক্ষমা করে দাও।
(২) ই‘তিকাফের সময় ও এর জন্য রোজা
কেউ কেউ বলে থাকেন, ইতিকাফের জন্য রোজা রাখা আবশ্যক। তাবলীগীরা যেহেতু রোজা রাখেনা, তাই তাদের ইতিকাফের নিয়ত করলেও তা ধর্তব্য হবে না!
কিন্তু তাদের এ বক্তব্য নিতান্তই অবান্তর। কারণ ই‘তিকাফ তিন প্রকার। ওয়াজিব, সুন্নত ও নফল। প্রথম দুই প্রকার ই‘তিকাফের জন্য (ইমাম আবুহানীফা, আবু ইউসূফ ও মুহাম্মদ রহ. এর মতানুসারে) রোজা রাখা শর্ত। (দ্র. আহকামুল কুরআন, জাছ্ছাছ) কিন্তু নফল ই‘তিকাফের জন্য কোন নির্দিষ্ট সময়ের প্রয়োজন নেই। যে কোন মুহুর্তে হয়। এবং এর জন্য রোজা রাখাও শর্ত নয়।
ইবনে আবীদীন শামী রহ. বলেন,
( وأقله نفلا ساعة ) من ليل أو نهار عند محمد وهو ظاهر الرواية عن الإمام لبناء النفل على المسامحة وبه يفتى
ইমাম মুহম্মদ রহ. এর মতে নফল ই‘তিকাফের সর্বনিম্ন পরিমাণ এক মূহুর্ত। ইমাম আবু হানীফা রহ. এর মতও এটিই। তাঁর থেকে এ মতটি ‘জাহেরী রেওয়াতের’ আলোকে অর্থাৎ নির্ভরযোগ্য ও সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত। এমতের উপরই ফতোয়া দেওয়া হয়। (রদ্দুল মুহ্তার, ফাতওয়ায়ে শামী)
ই‘তিকাফের জন্য রোজা রাখা শর্ত কি না, এ প্রসঙ্গে ইমাম আবু হানীফা রহ. থেকে দুই ধরণের বর্ণনাই রয়েছে। তবে এর মধ্যে ‘জাহেরে রেওয়ায়াত’ হল, নফল ই‘তিকাফের জন্য রোজা রাখা জরুরী নয়। কারণ নফল ই‘তিকাফ এক মহুর্তের জন্যও হয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে ফকীহ ইবনে নুজাইম রহ. বলেন,
( قوله : وأقله نفلاساعة ) لقول محمد في الأصل إذا دخل المسجد بنية الاعتكاف فهو معتكف ما أقام تارك له إذا خرج فكان ظاهر الرواية واستنبط المشايخ منه أن الصوم ليس من شرطه على ظاهر الرواية ؛ لأن مبنى النفل على المسامحة حتى جازت صلاته قاعدا ، أو راكبا مع قدرته على الركوب والنزول ولا يخفى أن ما ادعاه أمر عقلي مسلم وبهذا لا يندفع ما صرح به المشايخ الثقات من أن ظاهر الرواية أن الصوم ليس من شرطه وممن صرح به صاحب المبسوط وشرح الطحاوي وفتاوى قاضي خان والذخيرة والفتاوى الظهيرية والكافي للمصنف والبدائع والنهاية وغاية البيان والتبيين وغيرهم والكل مصرحون بأن ظاهر الرواية أن الصوم ليس من شرطه
অর্থাৎ ই‘তিকাফ সম্পর্কে ‘জাহেরে রেওয়ায়াতের’ আলোকে দুটি বিষয় প্রমাণিত:
১. (নফল) ই‘তিকাফের সর্বনিম্ন পরিমাণ এক মূহুর্ত
২. রোযা রাখা (নফল) ই‘তিকাফের জন্য শর্ত নয়। ফুকাহা-মাশায়েখ স্পষ্ট ভাষায় একথা উল্লেখ করেছেন।
হানাফী মাযহাবের ১.আলমাবসূত, ২.শরহু মুখতাছারুত্তাহাবী, ৩.ফাতওয়ায়ে কাযী খান, ৪.যাখীরা, ৫.ফাতাওয়ায়ে জহীরিয়া, ৬.আল কাফী, ৭.বাদাইউছ ছানায়ে, ৮.আননিহায়া, ৯.গায়াতুল বয়ান, ১০.তাব্য়ীন ইত্যাদি কিতাবে একথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। (আল-বাহরুর রায়েক, আরো দ্রষ্টব্য, ফাতহুল কাদীর, রাদ্দুল মুহ্তার (ফাতাওয়ায়ে শামী), আলমুহীতুল বুরহানী ইত্যাদি)
এটিই হানাফী মাযহাবে গ্রহণযোগ্য মত। ইমাম মুহাম্মদ রহ. এর সপক্ষে দলীল হিসেবে বর্ণনা করেন,
أخبرنا محمد عن أبي يوسف عن ليث بن أبي سليم عن الحكم عن مقسم عن علي بن أبي طالب رضوان الله عليه أنه قال ليس على المعتكف صوم إلا أن يوجبه على نفسه-المبسوط لمحمد.
হযরত আলী রা. বলেন, ই‘তিকাফকারীর জন্য রোজা রাখা জরুরী নয়। তবে সে যদি নিজের উপর (মান্নতের মাধ্যমে) রোজা ওয়াজিব করে তাহলে ভিন্ন কথা। (কিতাবুল আছল, মাবসূতে মুহাম্মদ)
সুতরাং দ্বীনি প্রয়োজনে বা কোন ভাল উদ্দেশ্যে মসজিদে থাকতে হলে নফল ই‘তিকাফের নিয়ত করে নিতে কোন সমস্যা নেই। এতে মসজিদে ঘুমানো জায়েযত হবেই, উপরন্তু তার ঘুম, খাওয়া-দাওয়া সবটাই ইবাদতে গণ্য হবে। হাঁ, মসজিদে অবস্থানকারীদের জন্য মসজিদের আদবের প্রতি যত্নবান হওয়া বাঞ্ছনীয়। কারা জানা না থাকার কারণে বা ভুলে আদবের খেলাফ কিছু হয়ে গেলে, যে জানে তার দায়িত্ব হল তাকে জানিয়ে দেয়া।
এজন্যই তাবলীগ জামাতের পক্ষ থেকে যখন কোন জামাতকে কোন মসজিদে পাঠানো হয়, তখন অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে মসজিদের আদব সমূহ তাদের রপ্ত করিয়ে দেওয়া হয়। তাতে সাধারণ শিক্ষিত-অশিক্ষত নানা ধরণের লোক থাকে বলেই তাদের মধ্যে এক্ষেত্রে কিছু ভুল-ত্রুটি হয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক। আমাদের দায়িত্ব হল কারো ভুল ত্রুটি ধরা পড়লে তাকে মার্জিত ভাবে বলে দেওয়া। কিন্তু একে কেন্দ্র করে ‘তাবলীগ জামাতের’ কোন দূর্ণাম করার সুযোগ নেই। এবং কারো ব্যক্তিগত ভুল-ত্রুটির জন্য ‘মসজিদে ঘুমানো জায়েয, এ হুকুম পরিবর্তন করে ফেলার মত দুঃসাহস আমাদের হয় কি করে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের হিফাযত করেন।
(৩) মসজিদে বাতকর্ম (বায়ূ ত্যাগ) করা:
আবার কেউ কেউ নির্লজ্জের মত তাবলীগীদের বদনাম করার জন্য বলে এরা মসজিদ নাপাক করে। এদেরকে মসজিদে থাকতে দেওয়া উচিত নয়।
কিন্তু তাঁদের এ মন্তব্যটি বড়ই দুঃখ জনক। মূলত এটি বিদ্বেষ প্রসূত। হিংসা বিদ্বেষের বসবর্তী হয়েই মানুষ এ ধরণের অপকথা বলতে থাকে। বস্তুত মসজিদ ইবাদতের স্থান। একে দুর্গন্ধযুক্ত বস্তু থেকে পবিত্র রাখা জরুরী। অপরদিকে আমাদেরকে নামায, তিলাওয়াত, যিকির, তালীম (দ্বীনি শিক্ষা-দীক্ষার কাজ) ও ওয়াজ-নসীহতের জন্য আমাদের মসজিদে অবস্থান করতে হয়। ফলে যে কোন সময় বায়ূ নিঃসারণের সম্ভাবনা থাকে। কারণ বায়ূ ত্যাগের বিষয়টি অনেক সময়ই ইচ্ছাধীন থাকেনা। আপনিতেই বের হয়ে যায়। তাই অনিচ্ছাকৃত ভাবে বায়ূ ত্যাগ হয়ে গেলে তাতে কোন সমস্যা নেই। বরং হাদীস থেকে বুঝা যায় নামাযে থাকাকালীন সময়ে বা নামায শেষে বায়ূ ত্যাগের প্রয়োজন হলে ইচ্ছাকৃত বায়ূ নিঃসারণ করলেও গুনাহ হবে না। এখানে কয়েকটি হাদীস উদ্ধৃত করছি,
১. হযরত আয়শা রা. বলেন,
عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ: قَالَ النَّبِيُّ: ” إِذَا أَحْدَثَ أَحَدُكُمْ فِي صَلَاتِهِ فَلْيَأْخُذْ بِأَنْفِهِ ثُمَّ لِيَنْصَرِفْ “.
রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, তোমাদের কেউ যদি নামাযে ‘বায়ূ ত্যাগ’ করে, তাহলে সে যেন নাক চেপে ধরে নামাযের স্থান থেকে বের যায়। (অতঃপর অযু করে বাকী নামায পূর্ণ করে)। (সুনানে আবু দাউদ হা. ১১১৪)
২. হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. বর্ণনা করেন,
أنَّ رَسُولَ اللَّهِ قَالَ: ” إِذَا صَلَّى أَحَدُكُمْ فَلَمْ يَدْرِ زَادَ أَمْ نَقَصَ فَلْيَسْجُدْ سَجْدَتَيْنِ وَهُوَ قَاعِدٌ فَإِذَا أَتَاهُ الشَّيْطَانُ، فَقَالَ: إِنَّكَ قَدْ أَحْدَثْتَ، فَلْيَقُلْ: كَذَبْتَ إِلَّا مَا وَجَدَ رِيحًا بِأَنْفِهِ أَوْ صَوْتًا بِأُذُنِهِ
রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, … আর যদি শয়তান কারো মনে সন্দেহ সৃষ্টি করে বলে, তোমার অযু ভেঙে গেছ, তাহলে সে তাকে বলবে মিথ্যা কথা। তাই বায়ূ নিঃসরণের সন্দেহ হলেই সে নামায ত্যাগ করবে না। হ্যাঁ, যখন তার নাকে দুর্গন্ধ লাগে, অথবা নিজ কানে বায়ূ ত্যাগের আওয়াজ শুনে (অর্থাৎ বায়ূ ত্যাগের বিষয়টি নিশ্চিত হলে) তবেই সে নামায ত্যাগ করতে পারবে। (সুনানে আবু দাউদ হা. ১০২৯)
অর্থাৎ বায়ূ ত্যাগের চাপ অনুভব করলে তা আটকানোর চেষ্টা করবে। যদি সম্ভব না হয়, তাহলে বায়ূ ত্যাগের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পরই নামায ভাঙবে। অন্যথায় নয়।
৩. হযরত আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন,
” لَا يَزَالُ الْعَبْدُ فِي صَلَاةٍ، مَا كَانَ فِي مُصَلَّاهُ يَنْتَظِرُ الصَّلَاةَ، وَتَقُولُ الْمَلَائِكَةُ: اللَّهُمَّ اغْفِرْ لَهُ، اللَّهُمَّ ارْحَمْهُ، حَتَّى يَنْصَرِفَ أَوْ يُحْدِثَ “، قُلْتُ: مَا يُحْدِثُ؟ قَالَ: يَفْسُو أَوْ يَضْرِطُ. رواه مسلم والبخارى.
আল্লাহর কোন বান্দা যতক্ষণ পর্যন্ত নামাযের স্থানে নামাযের অপেক্ষায় বসে থাকে, ততক্ষণ সে নামাযেই থাকে। ফেরেশতারা বলতে থাকেন, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিন। তার উপর রহমত নাযিল করুন। যখনি সে স্থান ত্যাগ করে বা অযু ভেঙে যায় তখন আর সে নামাযি গণ্য হয় না এবং ফেরেশতারাও দোয়া বন্ধ করে দেন। বর্ণনাকারী বলেন, আমি হযরত আবু হুরায়রা রা. কে জিজ্ঞেস করলাম, অযু ভাঙা মানে কী? তিনি বলেন, বায়ূ ত্যাগ করা। (সহীহ মুসলিম, হা.১০৬৭ সহীহ বুখারী)
ইমাম বুখারী রাহ. সহীহ বুখারীতে এ হাদীসের শিরোনাম দিয়েছেন, ‘ باب الحدث في المسجدِ ’ “মসজিদে বায়ূত্যাগ (জায়েজ হওয়ার) অধ্যায়”। সুতরাং এ হাদীস থেকে বুঝা যায় নামাযের স্থানে বসেই সে বায়ূ ত্যাগ করেছে। তথাপি তাকে হাদীসে কোন রূপ তিরস্কার করা হয়নি। তাই মসজিদে বায়ূত্যাগ করা কোন রূপ গোনাহর কাজ নয়। কিন্তু মসজিদে এরূপ ইচ্ছাকৃত না করাটাই ভাল।
তাই ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়ায় বলা হয়েছে,
وقال فى الهندية: وَاخْتُلِفَ في الذي يَفْسُو في الْمَسْجِدِ فلم يَرَ بَعْضُهُمْ بَأْسًا وَبَعْضُهُمْ قالوا لَا يَفْسُو وَيَخْرُجُ إذَا احْتَاجَ إلَيْهِ وهو الْأَصَحُّ كَذَا في التُّمُرْتَاشِيِّ. انتهىى من كتاب الكراهية,
মসজিদে ইচ্ছাকৃত বায়ূ ত্যাগ করা বিষয়ে ফুকাহায়ে কেরাম দ্বিমত পোষণ করেছেন। তাঁদের একদল এটাকে কোন সমস্যা মনে করেননি। অপর একদল ফকীহ বলেন, মসজিদে ইচ্ছাকৃত বায়ূ ত্যাগ করবে না। বরং প্রয়োজন অনুভব করলে বাইরে চলে যাবে। তামারতাশী বলেছেন, এমতটি অধিক বিশুদ্ধ (অর্থাৎ ইচ্ছাকৃত বায়ূত্যাগ থেকে বিরত থাকা। বলাবাহুল্য ভদ্রজন কখনোই মানুষের ভরা মজলিসে ইচ্ছাকৃত বায়ূ ত্যাগ করেন না) (আলমগীরী, কিতাবুল কারাহিয়্যা)
সুতরাং যে ব্যক্তি ই‘তিকাফ করে বা মসজিদে কোন কারণে ঘুমায়, অথবা মসজিদে নামায পড়তে আসে, তার থেকে অনিচ্ছাকৃত বা ইচ্ছাকৃত বায়ূ ত্যাগ হয়ে যায়। এমনটি হওয়াই স্বাভাবিক। এবং তাঁর হৃদয়ে যদি আল্লাহর ঘরের প্রতি কোনরূপ তাচ্ছিল্য না থাকে তাহলে তাতে গুনাহর কিছু আছে বলে আমাদের জানা নেই।
والله اعلم بالصواب
উস্তাজুল ইফতা, জামিয়া ইমাম বুখারী, উত্তরা, ঢাকা।
মন্তব্য (০)
কোনো মন্তব্য নেই।
এ সম্পর্কিত আরও জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর
২৯৯০১
মসজিদে নিজের জন্য কোনো স্থান খাস করে নেওয়া
১৪ মার্চ, ২০২৩
নামবিহীন রাস্তা

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি
৮২৫৮৯
টুপির ওপর সেজদা করার বিধান
২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪
West Bengal ৭২১৬৫৮

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি
৭৭৬৭৬
মাসজিদুল হারামে ইমাম সাহেব যেখানে দাঁড়ান তাঁর চেয়ে এগিয়ে দাঁড়ানো যাবে?
২০ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫
ঢাকা ১২০৮

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী নাঈম সিদ্দীকী বিন আব্দুস সাত্তার
সাম্প্রতিক প্রশ্নোত্তর
মাসায়েল-এর বিষয়াদি
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে
মাসায়েল-এর বিষয়াদি লোড হচ্ছে