আপনার জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

সকল মাসায়েল একত্রে দেখুন

বিবাহও কি তাকদিরে লেখা আছে?

প্রশ্নঃ ৫৮০৯১. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, কার সাথে কার বিয়ে হবে তা যদি জন্মের আগে থেকেই নির্ধারিত থাকে তাহলে আল্লাহর কাছে চরিএবান ও নেককার স্ত্রী চেয়ে দোয়া করা প্রয়োজন কেন? দোয়া করলে কি তাকদীর পরিবর্তন হয়?,

১৬ মে, ২০২৪

কুমিল্লা

উত্তর

و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم


জ্বি, হ্যাঁ। দোয়ার দ্বারা এই ধরনের বিষয়ের তাকদীর পরিবর্তন হয়। বিবাহ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তিনি মানুষকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। তিনি বলেন, (وَّخَلَقۡنٰکُمۡ اَزۡوَاجًا ۙ) আর তোমাদেরকে (নর ও নারীর) যুগল রূপে সৃষ্টি করেছি। (সূরা নাবা, আয়াত ৮)
শুধু বিবাহ নয় একজন মানুষের জন্ম থেকে নিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত যাবতীয় বিষয় তাকদীরে লিখা রয়েছে, এপ্রসঙ্গে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، وَرَفَعَ الْحَدِيثَ، أَنَّهُ قَالَ " إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ قَدْ وَكَّلَ بِالرَّحِمِ مَلَكًا فَيَقُولُ أَىْ رَبِّ نُطْفَةٌ أَىْ رَبِّ عَلَقَةٌ أَىْ رَبِّ مُضْغَةٌ . فَإِذَا أَرَادَ اللَّهُ أَنْ يَقْضِيَ خَلْقًا - قَالَ - قَالَ الْمَلَكُ أَىْ رَبِّ ذَكَرٌ أَوْ أُنْثَى شَقِيٌّ أَوْ سَعِيدٌ فَمَا الرِّزْقُ فَمَا الأَجَلُ فَيُكْتَبُ كَذَلِكَ فِي بَطْنِ أُمِّهِ " .
আনাস ইবনে মালিক (রাযিঃ) থেকে মারফূ সনদে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ তাআলা রেহেমে (মাতৃগর্ভে) একজন ফিরিশতা নিযুক্ত করে দেন। তখন ফিরিশতা বলতে থাকেনঃ হে আমার প্রতিপালক! (এখন তো) বীর্য। হে আমার প্রতিপালক! (এখনও) জমটি রক্ত। হে আমার প্রতিপালক! (এখনও) গোশতের টুকরা। এরপর যখন আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি করার ফয়সালা করেন তখন ফিরিশতা বলেন, হে আমার রব! (সে কি) পুরুষ না স্ত্রীলোক, দুর্ভাগ্য না ভাগ্যবান হবে? তার জীবিকা (কি হবে)? তার আয়ু (কী হবে)? এরপর নির্দেশ মুতাবিক তার মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায়ই এ সব কিছু লিপিবদ্ধ করা হয়।
—সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৬৪৮৯

অন্য বর্ননায় আসছে,
أَنَّ أَبَا الطُّفَيْلِ حَدَّثَهُ قَالَ دَخَلْتُ عَلَى أَبِي سَرِيحَةَ حُذَيْفَةَ بْنِ أَسِيدٍ الْغِفَارِيِّ فَقَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم بِأُذُنَىَّ هَاتَيْنِ يَقُولُ " إِنَّ النُّطْفَةَ تَقَعُ فِي الرَّحِمِ أَرْبَعِينَ لَيْلَةً ثُمَّ يَتَصَوَّرُ عَلَيْهَا الْمَلَكُ " . قَالَ زُهَيْرٌ حَسِبْتُهُ قَالَ الَّذِي يَخْلُقُهَا " فَيَقُولُ يَا رَبِّ أَذَكَرٌ أَوْ أُنْثَى فَيَجْعَلُهُ اللَّهُ ذَكَرًا أَوْ أُنْثَى ثُمَّ يَقُولُ يَا رَبِّ أَسَوِيٌّ أَوْ غَيْرُ سَوِيٍّ فَيَجْعَلُهُ اللَّهُ سَوِيًّا أَوْ غَيْرَ سَوِيٍّ ثُمَّ يَقُولُ يَا رَبِّ مَا رِزْقُهُ مَا أَجَلُهُ مَا خُلُقُهُ ثُمَّ يَجْعَلُهُ اللَّهُ شَقِيًّا أَوْ سَعِيدًا " .
আবু তুফায়ল (রাহঃ) আবু সারীহা হুযাইফা ইবনে আসীদ গিফারী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। বলেন, আমি আমার এই দুই কানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে বলতে শুনেছি যে, শুক্র জরায়ুতে চল্লিশ রাত অবস্থান করে। এরপর একজন ফিরিশতা তাকে আকৃতি দান করেন। রাবী যুহাইর (রাহঃ) বলেন, আমার ধারণা মতে তিনি বলেছেন, (যিনি আল্লাহর হুকুমে) তাকে সৃষ্টি করেন। তখন তিনি বলতে থাকেন, হে আমার প্রতিপালক! সে কি পুরুষ না স্ত্রীলোক? এরপর আল্লাহ তাকে পূরুষ কিংবা স্ত্রীলোক বানিয়ে দেন। এরপর তিনি (ফিরিশতা) বলতে থাকেন, হে আমার প্রতিপালক! সে কি পূর্ণাঙ্গ হবে না অপূর্ণাঙ্গ? তখন আল্লাহ তাকে পূর্ণাঙ্গ কিংবা অপূর্ণ করে দেন। এরপর তিনি জিজ্ঞাসা করেন, হে আমার প্রতিপালক! তার জীবিকা, তার বয়স, তার চরিত্র কি হবে? এরপর আল্লাহ তাকে দুর্ভাগা কিংবা ভাগ্যবান বানিয়ে দেন।

হাদীসের ব্যাখ্যা:
তাকদীর লেখা সম্পর্কে কিছু কথা:
এ হাদীছে বলা হয়েছে, ফিরিশতা মাতৃগর্ভে শিশুর চারটি বিষয় লিখে থাকে। বাহ্যত বোঝা যায় লেখার কোনও পাত্রেই তা লেখা হয়। মুসলিম শরীফের এক বর্ণনায় স্পষ্টই আছে ثم تطوى الصحف، فلا يزاد فيها ولا ينقص ‘তারপর সহীফা (রেজিস্ট্রার) ভাঁজ করে ফেলা হয়। তাতে আর কিছু বাড়ানো ও কমানো হয় না।
কিন্তু হযরত আবূ যার রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে আছে ثم يكتب بين عينيه ما هو لاق ‘তারপর তার দুই চোখের মাঝখানে (কপালে) লিখে দেয় সে যা-কিছুর সম্মুখীন হবে তা সব। বাস্তবিকপক্ষে উভয় বর্ণনার মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। হাদীছে বর্ণিত বিষয়গুলো যেমন কোনও রেজিস্ট্রারে লেখা হয়, তেমনি শিশুর ললাটেও লিখে দেওয়া হয়।
প্রশ্ন হতে পারে, কোনও কোনও হাদীছ দ্বারা তো জানা যায় তাকদীর লেখা হয়েছে মানবসৃষ্টির অনেক আগে, যেমন হযরত আব্দুল্লাহ ইবন উমর রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে আছে كتب الله مقادير الخلائق قبل أن يخلق السماوات والأرض بخمسين ألف سنة “আল্লাহ মাখলুকাতের তাকদীর লিখেছেন আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর আগে।
উভয় বর্ণনা কি পরস্পরবিরোধী নয়?
উত্তর হলো, না, পরস্পরবিরোধী নয়। কেননা মুসলিম শরীফের এ হাদীছে যে তাকদীর লিখনের কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে লাওহে মাহফূযের লেখা, যাকে ‘উম্মুল কিতাব'ও বলা হয়। সর্বপ্রথম আল্লাহ তাআলা তাতে সমস্ত মাখলূক সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয় লিপিবদ্ধ করেছেন। হযরত উবাদা ইবনুস সামিত রাযি. থেকে বর্ণিত এক হাদীছে আছে أول ما خلق الله : القلم، ثم قال له: أكتب قال: وما أكتب؟ قال: القدر، قال فكتب ما يكون وما هو كائن إلى أن تقوم الساعة “আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম যে জিনিস সৃষ্টি করেছেন তা হলো কলম। তাকে বললেন, লেখ। সে বলল, কী লিখব? বললেন, তাকদীর। তখন কলম কিয়ামত সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত যা-কিছু ঘটবে সব লিখল।
অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা নিজ 'ইলম ও কুদরতে যা-কিছু সৃষ্টি করবেন বলে স্থির করেছেন এবং প্রত্যেক সৃষ্টির আনুষাঙ্গিক যা-কিছু নির্ধারণ করেছেন তা সব সে আদি কলম দ্বারা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। সে লেখার কোনও পরিবর্তন নেই। এটি অপরিবর্তনীয় তাকদীর। তারপর ফিরিশতাদের দ্বারা মাতৃগর্ভে যে তাকদীর লেখানো হয় বলে আমাদের আলোচ্য এ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, এটা স্বতন্ত্র লিখন, যা প্রত্যেক মানবশিশুর জন্য পৃথক পৃথকভাবে লেখা হয়ে থাকে। এ লেখায় পরিবর্তনেরও সুযোগ থাকে। বিভিন্ন হাদীছে যে বিভিন্ন আমলের দ্বারা আয়ু বাড়া-কমার উল্লেখ পাওয়া যায়, তার সম্পর্কও এ লেখার সঙ্গেই। কুরআন মাজীদেও এর প্রতি ইশারা পাওয়া যায়। ইরশাদ হয়েছে يَمْحُو اللَّهُ مَا يَشَاءُ وَيُثْبِتُ وَعِنْدَهُ أُمُّ الْكِتَابِ 'আল্লাহ যা চান (অর্থাৎ যে বিধানকে ইচ্ছা করেন) রহিত করে দেন এবং যা চান বলবৎ রাখেন। সমস্ত কিতাবের যা মূল, তা তাঁরই কাছে।

মাতৃগর্ভে যে চারটি বিষয় লেখা হয়;
এ হাদীছে যে চারটি জিনিস লেখা হয় বলে জানানো হয়েছে, তার মধ্যে একটি হলো রিযিক। এর দ্বারা আমাদেরকে পরিতুষ্টির গুণ অর্জনে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ তোমাদের প্রত্যেকের রিযিক যখন নির্ধারিত আছে, তখন অহেতুক লোভ করো না। বাড়তি উপার্জনের জন্য উন্মত্ত হয়ে যেও না। চেষ্টা অবশ্যই করবে, তবে তাতে বাড়াবাড়ি করবে না। যখন যা অর্জিত হয় তাতে সন্তুষ্ট থাকবে। আরও কেন অর্জিত হলো না সে আক্ষেপ করবে না।
দুনিয়ায় কে কতদিন বাঁচবে তাও লিখে দেওয়া হয়। কাজেই যার যতদিন আয়ু সে ততদিনই বাঁচবে, তার বেশিও নয় কমও নয়। কুরআন মাজীদে ইরশাদ فَإِذَا جَاءَ
أَجَلُهُمْ لَا يَسْتَأْخِرُونَ سَاعَةً وَلَا يَسْتَقْدِمُونَ "যখন তাদের সেই নির্দিষ্ট সময় এসে পড়ে, তখন তারা এক মুহূর্তও বিলম্ব করতে পারে না এবং ত্বরাও করতে পারে না।
সুতরাং যার যখন মৃত্যু হয়, তা তার নির্দিষ্ট সময়ই হয়। তার প্রিয়জনদের উচিত আল্লাহ তাআলার ফয়সালা হিসেবে তা মেনে নেওয়া। এমন কোনও কথা বলা উচিত নয়, যা তাকদীর বা আল্লাহ তাআলার ফয়সালার বিরুদ্ধে অভিযোগ বলে মনে হয়।
বস্তুত তাকদীরের উপর বিশ্বাস রাখা ঈমানের অপরিহার্য অঙ্গ। এ বিশ্বাস ছাড়া কেউ মুমিনই হতে পারে না। মৃত্যু তো বটেই, ছোটখাটো কোনও আঘাতও তাকদীরের লিখন ছাড়া হয় না। যে-কোনও অর্জন বা যে-কোনও ক্ষয় ও বিয়োগ তাকদীর অনুযায়ীই হয়ে থাকে। এতে বিশ্বাস রাখাতেই দুনিয়ার প্রশান্তি ও আখেরাতের মুক্তি।
এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন ما بلغ عبد حقيقة الإيمان، حتى يعلم أن ما أصابه لم يكن ليخطئه، وما أخطأه لم يكن ليصيبه “কোনও বান্দা ঈমানের প্রকৃত স্তরে পৌঁছতে পারে না, যতক্ষণ না সে মনেপ্রাণে জেনে নেয় যে, যা সে লাভ করেছে তা তার হারানোর ছিল না, আর যা সে হারিয়েছে তা তার পাওয়ার ছিল না।
প্রকাশ থাকে যে, তাকদীরের বিষয়টি আল্লাহ তাআলার এক গুপ্ত রহস্য। এর প্রকৃত স্বরূপ আল্লাহ তাআলাই জানেন। এ নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করা উচিত নয়। ঘাঁটাঘাটি করলে এর কুলকিনারা পাওয়ার কোনও নিশ্চয়তা নেই। বরং তাতে অস্থিরতাই বাড়ে। এমনকি পদস্খলিত হওয়ারও যথেষ্ট আশঙ্কা থাকে। উলামায়ে কেরাম বলেন, আল্লাহ তাআলা নিজ হিকমতে তাকদীরের জ্ঞান মানুষের থেকে আড়াল করে রেখেছেন। কারও আকল-বুদ্ধি তা আয়ত্ত করতে সক্ষম নয়। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাস'উদ রাযি. থেকে বর্ণিত আছে যে, যখন তাকদীরের আলোচনা আসে, তখন তোমরা ক্ষান্ত হয়ে যেও। বলা হয়ে থাকে, জান্নাতবাসীগণ যখন জান্নাতে প্রবেশ করবে, তখনই তাদের কাছে তাকদীরের রহস্য উন্মোচিত হবে, তার আগে নয়।
এমনিভাবে লেখা হয়—–কে ভাগ্যবান আর কে হতভাগা তাও। এর মানে আমলও লেখা হয়। কেননা যার আমল ভালো সে জান্নাত লাভ করবে। আর যে জান্নাত লাভ করবে সেই ভাগ্যবান। যার আমল মন্দ সে জাহান্নামে যাবে। আর যে জাহান্নামে যাবে সেই হতভাগা।

জান্নাতলাভে আমলের ভূমিকা প্রসঙ্গ ;
বোঝা গেল জান্নাত ও জাহান্নামে প্রবেশের সঙ্গে আমলের সম্পর্ক আছে। যে ব্যক্তি জান্নাতে যাওয়ার আশা রাখে, তাকে অবশ্যই সৎকর্ম করতে হবে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ خَالِدِينَ فِيهَا جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ “নিশ্চয়ই যারা বলেছে, আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ, তারপর এতে অবিচল থেকেছে, তাদের কোনও ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না। তারা হবে জান্নাতবাসী। সেখানে তারা থাকবে সর্বদা। তারা যা করত তার প্রতিদানস্বরূপ।
অপর এক আয়াতে ইরশাদ سَلَامٌ عَلَيْكُمُ ادْخُلُوا الْجَنَّةَ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ 'তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। তোমরা যে আমল করতে, তার ফলে জান্নাতে প্রবেশ কর।
এরকম আরও বহু আয়াত আছে, যা দ্বারা স্পষ্টই বোঝা যায়, জান্নাত দেওয়া হবে বান্দার আমলের প্রতিদানে। এ কথা ঠিক যে, কোনও কোনও হাদীছে এরকমও আছে যে, কেউ নিজ আমল দ্বারা মুক্তি পাবে না। যেমন এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে «ما من أحد يدخله عمله الجنة»، فقيل: ولا أنت يا رسول الله؟ قال: «ولا أنا، إلا أن يتغمدني ربي برحمة»“তোমাদের কাউকে তার আমল জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারবে না। জিজ্ঞেস করা হলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনাকেও নয়? তিনি বললেন, আমাকেও নয়, যদি না আমার প্রতিপালক নিজ রহমত দ্বারা আমাকে আচ্ছন্ন করে নেন।
প্রকৃতপক্ষে আয়াতের সঙ্গে এ হাদীছের কোনও বিরোধ নেই। কেননা আয়াতে যে আমল দ্বারা জান্নাত পাওয়া যাবে বলে জানানো হয়েছে, সে আমল তো আল্লাহ তাআলার তাওফীক হলেই করা সম্ভব। আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তাওফীক লাভ হয় একান্তই তাঁর রহমত ও দয়ায়। তাছাড়া সৎকর্ম আল্লাহ তাআলার রহমত পাওয়ার অছিলাও বটে।
হাদীছটিতে বান্দার আমল প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- فيسبق عليه الكتاب (তাকদীরের) লিখন তার অগ্রবর্তী হয়ে যায়। তোমাদের একেকজন সারা জীবন জান্নাতবাসীদের আমলের মত আমল করতে থাকে, এমনকি তার ও জান্নাতের মধ্যে মাত্র এক হাতের দূরত্ব থাকে। ঠিক এ অবস্থায় (তাকদীরের) লিখন তার অগ্রবর্তী হয়। তখন সে জাহান্নামবাসীদের আমলের মত আমল করতে শুরু করে। ফলে সে জাহান্নামে প্রবেশ করে।
একই কথা বলা হয়েছে জাহান্নামীদের সম্পর্কেও।
এর অর্থ হলো, বান্দার চালিয়ে যাওয়া আমল এবং তার সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য সম্পর্কিত লিখনের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। তাতে লিখন জয়ী হয়ে যায়। তারপর বান্দা সে লিখন অনুযায়ীই আমল করতে থাকে। এটিকেই فيسبق عليه الكتاب (তাকদীরের) লিখন তার অগ্রবর্তী হয়ে যায়' বাক্যে ব্যক্ত করা হয়েছে। কেননা প্রতিযোগিতায় যে অগ্রগামী হয়, সেই তার উদ্দেশ্যে সফল হয়। যে পেছনে পড়ে যায় সে সফল হতে পারে না। বিষয়টি এভাবে বোঝা যেতে পারে যে, আমল ও লিখনকে যদি পৃথক দুই ব্যক্তি কল্পনা করা হয় আর তারা দু'জন দৌড় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়, তবে সেই দৌড়ে ‘লিখন' নামক ব্যক্তি আগে চলে যাবে এবং 'আমল' নামক ব্যক্তি পেছনে পড়ে থাকবে।

মৃত্যু নেক আমলের অবস্থায় হওয়াটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ

এর দ্বারা বোঝা গেল শেষ সময়ের আমলই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমদিকে যত ভালো আমলই করুক, যদি নেক আমলের অবস্থায় মৃত্যু না হয়, তবে তার পরিণাম অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। তাই মনে খুব ভয় রাখা দরকার। বর্তমান ভালো অবস্থার কারণে গর্বিত হওয়া বা আত্মমুগ্ধতায় ভোগার কোনও সুযোগ নেই। তাই তো এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে لا عليكم أن لا تعجبوا بأحد، حتى تنظروا بم يختم له، فإن العامل يعمل زمانا من عمره، أو برهة من دهره، بعمل صالح، لو مات عليه دخل الجنة، ثم يتحول فيعمل عملا سيئا، وإن العبد ليعمل البرهة من دهره بعمل سيئ، لو مات عليه دخل النار، ثم يتحول فيعمل عملا صالحا، وإذا أراد الله بعبد خيرا استعمله قبل موته»، قالوا: يا رسول الله، وكيف يستعمله؟ قال: «يوفقه لعمل صالح، ثم يقبضه عليه».“তোমরা কারও আমল দেখে আশ্চর্যবোধ করো না, যতক্ষণ না দেখতে পাও তার মৃত্যু কোন আমলের উপর হয়। কেননা কোনও কোনও আমলকারী জীবনভর বা জীবনের দীর্ঘ একটা কাল সৎকর্মে রত থাকে। যদি ওই অবস্থায় সে মারা যেত, অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করত। কিন্তু পরে তার অবস্থার পরিবর্তন হয় এবং সে অসৎকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এমনিভাবে কোনও কোনও বান্দা জীবনের একটা দীর্ঘকাল অসৎকর্মে লিপ্ত থাকে। সেই অবস্থায় মারা গেলে অবশ্যই জাহান্নামে যেত। পরে তার পরিবর্তন ঘটে। সে সৎকর্মে লিপ্ত হয়। আল্লাহ তাআলা তার যে বান্দার কল্যাণ চান, তাকে তার মৃত্যুর আগে আমলে লাগিয়ে দেন। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কিভাবে আমলে লাগান? তিনি বললেন, তাকে সৎকর্মের তাওফীক দেন। তারপর সে অবস্থায় তাকে মৃত্যু দেন।
মৃত্যুর আগে যেহেতু অবস্থা পরিবর্তনের সম্ভাবনা থাকে, তাই যাদেরই নেক আমলের তাওফীক লাভ হয়, তাদের আল্লাহ তাআলার কাছে এ দুআ করাও জরুরি যেন তিনি মৃত্যু পর্যন্ত সে তাওফীক জারি রাখেন এবং সর্বাবস্থায় সৎকর্মে অবিচল থাকতে সাহায্য করেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুআ শিক্ষা দিয়েছেন يا مقلب القلوب ثبت قلبي على دينك “হে অন্তরসমূহের পরিবর্তনকারী! আপনি আমার অন্তর আপনার দীনের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখুন।'রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও এ দুআ খুব বেশি পড়তেন।
উল্লেখ্য, এ হাদীছটি মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের সত্যতার পক্ষে এক শক্তিশালী দলীল। কেননা যে মহান আল্লাহ মাতৃগর্ভে তুচ্ছ শুক্রবিন্দুকে জমাট রক্তে, তারপর মাংসপিণ্ডে, তারপর সুবিন্যস্ত অস্থিকাঠামোয় পূর্ণাঙ্গ মানবরূপ দিয়ে তার ভেতর রূহ ফুঁকে দিতে পারেন, তারপর তার মধ্যে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ বহুবিচিত্র গুণের সমাহার ঘটিয়ে এ নশ্বর জগতে নিয়ে আসতে পারেন, তিনি তাকে তার মৃত্যুর পর বিচূর্ণ বিক্ষিপ্ত অংশসমূহ একত্র করে পুনর্জীবিত করতে পারবেন না কেন? নিশ্চয়ই পারবেন। মহান সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাআলার পক্ষে কোনওকিছুই অসম্ভব নয়।

হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. তাকদীরের লিখন সত্য। মানুষের রিযিক, আয়ু সবই লেখা আছে।

খ. রিযিক ও অর্থ-সম্পদের জন্য লোভ-লালসা না করে আপন অবস্থায় পরিতুষ্ট থাকা ও পরিমিত চেষ্টা করাই কাম্য।

গ. প্রিয়জনের মৃত্যুতে তাকদীর-বিরোধী অনুচিত মন্তব্য করা হতে বিরত থেকে আল্লাহর ফয়সালায় রাজি থাকাই ঈমানের দাবি।

ঘ. আল্লাহ তাআলার রহমত ও জান্নাতলাভের জন্য আমল সহায়ক। তাই আমলে অবহেলা উচিত নয়।

ঙ. নিজের বা অন্যের আপাতকালীন আমল দেখে ধোঁকায় পড়া উচিত নয়। যে-কারও ভালো আমল শেষটায় মন্দ আমলে পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আবার যে-কোনও মন্দ আমলকারীও শেষটায় ভালো আমলে মনোযোগী হতে পারে বলে আশা থাকে।

চ. নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও মাতৃগর্ভে ভ্রূণের পর্যায়ক্রমিক বৃদ্ধি সম্পর্কে সংবাদ দেওয়াটা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াতের সত্যতার পক্ষে একটি মজবুত দলীল।

ছ. এ হাদীছ দ্বারা মৃত্যুর পর পুনরুত্থান সম্পর্কেও ধারণা মেলে।
—সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৬৪৮৭

সারসংক্ষেপ কথা হল, যাবতীয় বিষয় তাকদীরে লিখা থাকলেও তাকদীর একটি গুপ্ত বিষয় যা মানুষের চেষ্টার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়ে থাকে এবং দোয়ার মাধ্যমে পরিবর্তন হয়ে থাকে। এজন্য তাকদীরের উপর নির্ভর করে বসে থাকাটা বোকামী বৈ কিছুই নয়। নেককার নারীর জন্য নেক আমল ও দোয়া করতে থাকুন। ইনশাআল্লাহ আল্লাহ তাআলা কল্যাণের ফায়সালা করবেন।

والله اعلم بالصواب

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী শাহাদাত হুসাইন ফরায়েজী
খতীব, রৌশন আলী মুন্সীবাড়ী জামে মসজিদ, ফেনী

মন্তব্য ()

কোনো মন্তব্য নেই।

এ সম্পর্কিত আরও জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

৮৩৬৫৯

কোন নামাজে কোন সূরা


৪ জানুয়ারী, ২০২৫

চাঁদপুর

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ শফিকুল ইসলাম হাটহাজারী

৮১৭৯৯

অমুসলিমের সাথে বর্গা চুক্তি করলে উশর নাকি খারাজ দিবে?


২০ ডিসেম্বর, ২০২৪

নামবিহীন রাস্তা

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী শাহাদাত হুসাইন ফরায়েজী

৯০২১৪

রজব শব্দটি মুনসারিফ নাকি গায়রে মুনসারিফ?


২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

৮P৩C+GV৭

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী নাঈম সিদ্দীকী বিন আব্দুস সাত্তার

৯০২৩৩

তোমাদের সন্তানদের সন্ধ্যায় ঘরে আটকিয়ে রাখ এবং কিছু সময়ের পর ছেড়ে দিও এটা কোরান বা হাদীসের কোথাও কি আছে?


২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

ঢাকা

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী নাঈম সিদ্দীকী বিন আব্দুস সাত্তার

Logoমুসলিম বাংলা
play storeapp store
TopOfStack Software © 2025 All rights reserved. Privacy Policy