আপনার জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

সকল মাসায়েল একত্রে দেখুন

مَنْ رَأَى مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ - হাদিসের ব্যাখ্যা

প্রশ্নঃ ৫২৬৯৯. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, আমি যখন কোন মানুষকে মাজারে সেজদা দিতে দেখব তখন আমার কী করনীয়?,

২৩ জানুয়ারী, ২০২৪

মাদারীপুর

উত্তর

و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم


সেটা আপনার অবস্থা এবং আবস্থানের উপর নির্ভর করবে। নিচের হাদিসটি দেখুন।

أَخْبَرَنَا مُحَمَّدُ بْنُ بَشَّارٍ قَالَ حَدَّثَنَا عَبْدُ الرَّحْمَنِ قَالَ حَدَّثَنَا سُفْيَانُ عَنْ قَيْسِ بْنِ مُسْلِمٍ عَنْ طَارِقِ بْنِ شِهَابٍ قَالَ قَالَ أَبُو سَعِيدٍ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَنْ رَأَى مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ وَذَلِكَ أَضْعَفُ الْإِيمَانِ
মুহাম্মাদ ইবনে বাশশার (রাহঃ) ......... আবু সাঈদ খুদরী (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছিঃ যখন তোমাদের কেউ কোন অন্যায় দেখতে পায়, তখন সে যেন তা নিজ হাতে প্রতিহত করে। যদি ততটুকু শক্তি তার না থাকে, তবে সে যেন মুখে তা দূর করতে তৎপর হয়। যদি এই শক্তিও তার না থাকে, তবে সে যেন উক্ত মন্দ কাজকে মনে মনে ঘৃণা করে। আর এ হলো ঈমানের নিম্নতম পর্যায়।

কিতাবুস সুনান (আলমুজতাবা) - ইমাম নাসায়ী রহঃ (সুনানে নাসায়ী)
হাদীস নং: ৫০০৮ আন্তর্জাতিক নং: ৫০০৮

হাদীসের লিংকঃ https://muslimbangla.com/hadith/24539


হাদীসের ব্যাখ্যাঃ
অন্যায়-অপরাধ প্রতিরোধ সম্পর্কে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক হাদীছ। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপস্থিত সাহাবায়ে কিরামসহ অনাগত ভবিষ্যতের সমস্ত মুসলিমকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দান করেছেন। তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, অন্যায়-অপরাধ প্রতিরোধের চেষ্টা করা ঈমানের এক গুরুত্বপূর্ণ শাখা। আপন আপন সামর্থ্য অনুযায়ী প্রত্যেক মু'মিনের এই চেষ্টা অব্যাহত রাখা অবশ্যকর্তব্য।
অন্যায়-অপরাধ প্রতিহত করা কখন কর্তব্য
সাধারণত অন্যায়-অপরাধ কোথাও না কোথাও হয়ই। সবসময় তা সকলের চোখে পড়ে না এবং সকলে জানতেও পারে না। এ অবস্থায় তা প্রতিরোধ করার দায়িত্ব কার? প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদীছটির শুরুতে জানিয়ে দিয়েছেন যে, এ দায়িত্ব ওই ব্যক্তির, যে তা জানতে পারে। এখানে শব্দ আছে رأى , যার অর্থ চোখে দেখা, জানতে পারা, বিশ্বাস করা ইত্যাদি। এস্থলে 'জানতে পারা' অর্থই বোঝানো উদ্দেশ্য । সুতরাং কোনও অন্যায় কাজ প্রতিরোধের জন্য তা চোখে দেখা শর্ত নয়; বরং যে-কোনও উপায়ে জানতে পারাই যথেষ্ট। নির্ভরযোগ্য সূত্রে যদি জানা যায় কোথাও কোনও অন্যায় কাজ হচ্ছে, তবে মু'মিন ব্যক্তির কর্তব্য হবে আপন সামর্থ্য অনুযায়ী তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
কারও সম্পর্কে কোনও কথা কানে আসলে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর আগে ভালোভাবে যাচাই করে নেওয়া চাই আসলেই সে কাজটি করেছে কি না। এজন্য পত্র পত্রিকার সংবাদ কিংবা লোকমুখে শোনা খবর যথেষ্ট নয়। এসব খবরের ভিত্তিতে প্রতিবাদ করতে গেলে অনেক সময় নিরপরাধ ব্যক্তির সম্মানহানি বা আরও অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যায়, যা কোনওক্রমেই জায়েয নয়। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছেঃ- يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ جَاءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوا أَنْ تُصِيبُوا قَوْمًا بِجَهَالَةٍ فَتُصْبِحُوا عَلَى مَا فَعَلْتُمْ نَادِمِينَ ‘হে মুমিনগণ! কোনও ফাসেক যদি তোমাদের কাছে কোনও সংবাদ নিয়ে আসে, তবে ভালোভাবে যাচাই করে দেখবে, যাতে তোমরা অজ্ঞতাবশত কোনও সম্প্রদায়ের ক্ষতি করে না বস । ফলে নিজেদের কৃতকর্মের কারণে তোমাদেরকে অনুতপ্ত হতে হয়।
প্রকাশ থাকে যে, প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে কেবল তখনই, যখন নিশ্চিতভাবে জানা যাবে সে কাজটি অন্যায় ও অপরাধ। যদি তা নিশ্চিত না হয় তখন তাতে বাধা দেওয়া উচিত হবে না। কেননা দমন করতে বলা হয়েছে منكر (মুনকার) কাজকে। মুনকার হচ্ছে শরীআতবিরোধী কাজ। কাজেই যতক্ষণ পর্যন্ত কোনও কাজ শরী'আতবিরোধী সাব্যস্ত না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রশ্ন আসে না।
অনেকে ভিন্ন মাযহাবের আমলকে ভুল আখ্যায়িত করে তার বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণা চালায়, অথচ ওই মাযহাবে সে আমলটি দলীল-প্রমাণের ভিত্তিতে গৃহীত হয়েছে। আর যে আমল দলীল-প্রমাণভিত্তিক তা মুনকার হয় কিভাবে? তা মুনকার তো নয়ই; বরং তাকে মুনকার সাব্যস্ত করাই মুনকার ও শরী' আতবিরোধী কাজ। এরূপ কাজে লিপ্ত হওয়া একরকম ফিতনা বিস্তারের নামান্তর। এর থেকে বিরত থাকা জরুরি।
হুকুম দেওয়া হয়েছে- সে যেন তা প্রতিরোধ করে। বোঝা গেল অন্যায় কাজ প্রতিহত করা ফরয ও অবশ্যকর্তব্য। এটা ফরয হওয়া সম্পর্কে এ হাদীছ ছাড়াও কুরআন-সুন্নাহ'র একাধিক দলীল আছে। কোথাও অন্যায় কাজ হচ্ছে বলে যদি কোনও একজন জানতে পারে তবে তো তা প্রতিহত করা তার জন্য ফরযে আইন হবে, আর যদি একাধিক ব্যক্তি জানে তবে ফরযে কিফায়াহ। তাদের মধ্যে যে-কোনও একজন তা প্রতিহত করলে সকলের পক্ষ থেকে দায়িত্ব আদায় হয়ে যাবে।

অপরাধ প্রতিহত করার স্তরসমূহ
হাদীছটিতে অন্যায় কাজ প্রতিহত করার তিনটি স্তর বলা হয়েছে। তার মধ্যে সর্বপ্রথম হচ্ছে হাত দ্বারা প্রতিহত করা। হাত দ্বারা প্রতিহত করার মানে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে অন্যায়-অপরাধ দমন করা। অর্থাৎ অন্যায় কাজটি যদি এমন হয় যা প্রতিহত করার জন্য শক্তিপ্রয়োগ দরকার হয়, তবে যার শক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা আছে তার কর্তব্য শক্তিপ্রয়োগ দ্বারাই তা প্রতিহত করা।
দ্বিতীয় স্তর হচ্ছে বাকশক্তির ব্যবহার। আর তৃতীয় হল অন্তরে ঘৃণা পোষণ। হাত ও বাকশক্তির ব্যবহার অবশ্যকর্তব্য হয় তখনই, যখন তা ব্যবহারের ক্ষমতা থাকে। যদি তা ব্যবহারের ক্ষমতা থাকে, তা সত্ত্বেও ব্যবহার করা না হয়, তবে তা দায়িত্বে অবহেলারূপে গণ্য হবে। সেজন্য আখিরাতে জবাবদিহিতার পাশাপাশি দুনিয়ায়ও শাস্তির ভয় আছে। যেমন হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাযি. বর্ণিত এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- ما من قوم يعمل فيهم بالمعاصي، ثم يقدرون على أن يغيروا فلا
يغيروا، إلا يوشك أن يعمهم الله بعقاب “কোনও কওমের মধ্যে যদি পাপাচার করা হয় আর তাদের তা প্রতিহত করার ক্ষমতা থাকে, তা সত্ত্বেও প্রতিহত না করে, তবে আশঙ্কা রয়েছে আল্লাহ তাআলা তাদের সকলকেই শাস্তিদান করবেন।
আবূ দাউদ শরীফে আছে, এ হাদীছটি বর্ণনা করার পর ইমাম শু'বা রহ. বলেন, এর অর্থ অপরাধকারীগণ অপেক্ষা নিরপরাধ লোক যদি বেশি হয়।
হযরত জারীর রাযি. বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছিঃ- ما من رجل يكون في قوم يعمل فيهم بالمعاصي يقدرون أن يغيروا عليهم فلا يغيرون إلا أصابهم الله بعقاب قبل أن يموتوا ‘কোনও সম্প্রদায়ের মধ্যে যদি এমন কোনও ব্যক্তি থাকে, যে পাপাচারে লিপ্ত থাকে আর তারা তাকে বাধা দিতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও বাধা না দেয়, তবে আল্লাহ তাআলা তাদের মৃত্যুর আগে তাদেরকে শাস্তি দান করেন।
হাঁ, যদি হাতে বা মুখে বাধা দেওয়ার দ্বারা নিজের জানমালের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে, সে ক্ষেত্রে বাধা দেওয়া ফরয থাকে না। উপরে বর্ণিত হাদীছে যে সক্ষমতার কথা বলা হয়েছে তা দ্বারাও এর প্রতি ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে ليس للمؤمن أن يذل نفسه، أن يعرضها من البلاء لما لا طاقة له به ‘মুমিন ব্যক্তির উচিত নয় নিজেকে লাঞ্ছিত করা। অর্থাৎ নিজেকে এমন বিপদের সম্মুখীন করা, যা বহনের ক্ষমতা তার নেই।
তবে কেবল গালমন্দ বা কটুকথা শোনার ভয়ে এ দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকার সুযোগ নেই । এমনিভাবে অপরাধকারী যদি প্রভাবশালী ব্যক্তি হয়, কিন্তু তার পক্ষ থেকে জানমালের ক্ষয়-ক্ষতির আশঙ্কা না থাকে, তবে কেবল প্রভাব-প্রতিপত্তিতে দমিত হয়ে তার অন্যায়-অপরাধের প্রতিবাদ পরিত্যাগ করা যাবে না। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর এক ভাষণে ইরশাদ করেনঃ- ألا لا يمنعن رجلا هيبة الناس أن يقول بحق إذا علمه “শোন, কাউকে যেন কোনও ব্যক্তির প্রভাব-প্রতিপত্তি তার সামনে হক কথা বলতে নিবৃত্ত না করে, যদি তার তা জানা থাকে ।
অপরাধ দমনের প্রথম স্তর : শক্তিপ্রয়োগ
কোনও কোনও অপরাধ এমন আছে, যা দমনের জন্য শক্তিপ্রয়োগ দরকার হয়, যেমন মদের পাত্র, বাদ্যযন্ত্র, অবৈধ খেলাধুলার সামগ্রী, সিনেমা হল, নাটক-থিয়েটারের মঞ্চ, নৃত্যশালা, বেদীনী বই-পুস্তক ও দীনবিরোধী প্রচারপত্র এবং এরকম আরও যা-কিছু পাপকর্মের আসবার-উপকরণ আছে, তার উৎখাত-উৎপাটন শক্তিপ্রয়োগ ছাড়া সম্ভব নয়। কাজেই যাদের সে ক্ষমতা আছে তাদের ওপর এ দায়িত্ব বর্তায় যে, তারা এসবের দমনে শক্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। মৌলিকভাবে এটা সরকারের দায়িত্ব। সরকার তার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে এ দায়িত্ব আঞ্জাম দেবে।
এ দায়িত্ব আমজনগণের নিজ হাতে তুলে নেওয়া উচিত নয়। তাতে হিতে বিপরীত হয়। হাঁ, কোথাও যদি তার প্রয়োজন বোধ হয় তবে সে ক্ষেত্রে সরকারি অনুমতিক্রমে ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ আছে। যদি সরকার নিজে ব্যবস্থা না নেয় এবং জনগণকেও ব্যবস্থা গ্রহণের অনুমতি না দেয়, সে ক্ষেত্রে কর্তব্য জনমত গড়ে তোলা। কোনও অবস্থাতেই হঠকারী পদক্ষেপ গ্রহণ উচিত নয়। শরী'আত প্রত্যেককে তার সামর্থ্য অনুপাতেই দায়িত্ব প্রদান করেছে। সে সামর্থ্যের একটা অংশ হচ্ছে সরকার বা অন্য কোনও ক্ষমতাবানদের পক্ষ থেকে বাধা না থাকা। সেরকম বাধা থাকা অবস্থায় শক্তি প্রয়োগ করতে গেলে আরও বড় ক্ষতি এবং আরও বেশি অন্যায়-অপরাধ বিস্তারের আশঙ্কা থাকে। এরূপ ক্ষেত্রে করণীয় প্রতিরোধের দ্বিতীয় পন্থা অবলম্বন করা, যা পরবর্তী বাক্যে বলা হয়েছে।
অপরাধ দমনের দ্বিতীয় স্তর : বাকশক্তির ব্যবহার
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্বিতীয় পর্যায়ে বলেন, যার হাত দিয়ে প্রতিহত করার ক্ষমতা নেই সে প্রতিহত করবে মুখের কথা দিয়ে। অর্থাৎ অপরাধীকে বুঝিয়ে সমঝিয়ে অপরাধ থেকে ফেরানোর চেষ্টা করবে। তাকে আল্লাহর ভয় দেখাবে, আখিরাতের শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করবে এবং দরদ ও মমতার সাথে তাকে উপদেশ দেবে। প্রয়োজনে তিরস্কারও করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে স্থান, কাল, পাত্র বিবেচ্য। সকলের জন্য সকল পন্থা উপযোগী হয় না। কেউ নরম কথায় সংশোধন হয়ে যায়, আবার কারও জন্য ধমক ও তিরস্কারই হয়। কাউকে একাকী বোঝাতে হয়, কাউকে জনসম্মুখে তিরস্কার করতে হয়। মোটকথা কাজ করতে হবে হিকমত ও বুদ্ধিমত্তার সাথে।
সরকারি বা রাষ্ট্রীয় অন্যায়-অনাচার দমনে বাহুবল ব্যবহারের অবকাশ কম। এ ক্ষেত্রে বাকশক্তিই কার্যকর। সুতরাং জানমালের ওপর আঘাত আসার আশঙ্কা না থাকলে জনগণের কর্তব্য সরকারি অন্যায়-অপরাধের প্রতিবাদ করা। সেরকম আশঙ্কা থাকলে প্রতিবাদ করা জরুরি নয় বটে, কিন্তু সে ক্ষেত্রেও যাদের জুলুম-নিপীড়ন সহ্য করার হিম্মত আছে, তারা যদি প্রতিবাদ করে তবে জিহাদের ছাওয়াব পাবে। এক হাদীছে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেনঃ- أفضل الجهاد كلمة حق عند سلطان جائر 'সর্বোত্তম জিহাদ জালেম শাসকের সামনে সত্য-ন্যায়ের কথা বলা।
প্রকাশ থাকে যে, কলমের ব্যবহারও বাকশক্তি ব্যবহারেরই পর্যায়ভুক্ত। যার সে যোগ্যতা আছে তার কর্তব্য লেখার মাধ্যমে অন্যায়-অপরাধের প্রতিবাদ করা, তা পত্র পত্রিকায় লেখার দ্বারা হোক বা বই-পুস্তক ও রচনার মাধ্যমে। যে সকল রিপোর্টার বা সাংবাদিক ইখলাস ও সততার সাথে এ কাজ করবে, তারা অবশ্যই শরী'আতের দৃষ্টিতে 'আমর বিল মারূফ ও নাহী আনিল মুনকার'-এর দায়িত্ব পালনকারীরূপে বিবেচিত হবে এবং এজন্য তারা বিপুল ছাওয়াবের অধিকারী হবে।
অপরাধ দমনের তৃতীয় স্তর : অন্তরে ঘৃণা পোষণ
অন্যায় প্রতিরোধের তৃতীয় স্তর হচ্ছে অন্তর দ্বারা ঘৃণা করা। অর্থাৎ যখন শক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা না থাকে আবার মুখের কথায়ও কাজ না হয় কিংবা মুখে বলার মত অবস্থাও না থাকে, তখন মনে মনে সে কাজকে ঘৃণা করবে এবং ওই ব্যক্তির প্রতি ভেবে আক্ষেপ করবে যে, আহা, সে এরূপ পাপকর্ম করে নিজের দুনিয়া আখিরাত বরবাদ করছে! সেইসঙ্গে এ নিয়তও রাখবে যে, কখনও তার শক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা হলে কিংবা মুখে কিছু বলার সুযোগ হলে সে অবশ্যই সেরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
এই যে শেষোক্ত উপায় অর্থাৎ মনে মনে ঘৃণা করা, এটা সর্বাবস্থায়ই জরুরি। কেননা এর জন্য কোনও সামর্থ্যের ব্যাপার নেই। প্রথমোক্ত দুই ব্যবস্থা যেহেতু সামর্থ্যের ওপর নির্ভরশীল, তাই যার সে সামর্থ্য আছে কেবল সেই তা অবলম্বন করবে। কিন্তু মনে মনে ঘৃণা করার ব্যাপারটা সকলের পক্ষেই সম্ভব। তাই এটা সকলের জন্যই জরুরি।
প্রশ্ন হতে পারে, অন্তরের ঘৃণা দ্বারা অপরাধ দমন হয় কিভাবে? উত্তর এই যে, প্রথমত এর দ্বারা নিজের হেফাজত হয়। অন্যায়-অপরাধকে ঘৃণা না করাও এক কঠিন অপরাধ । কাজেই ঘৃণা করার দ্বারা নিজের ক্ষেত্রে এ অপরাধকে দমন করা হয়। দ্বিতীয়ত কোনও অপরাধের প্রতি অন্তরে ঘৃণা থাকলে সেই অপরাধকারীর সঙ্গে মেলামেশা ওইরকম স্বাভাবিক থাকবে না, যেমনটা অন্তরঙ্গ লোকের সঙ্গে হয়ে থাকে। একরকম পাশকাটানো আচরণ তার সঙ্গে হবেই। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ লোক কিংবা বিশিষ্ট কোনও ব্যক্তি সেই অপরাধকারীকে পাশ কাটিয়ে চলে, তবে তার কিছু না কিছু প্রভাব তার অন্তরে পড়তে বাধ্য। একপর্যায়ে তার অন্তরে অনুশোচনা জাগবে এবং সে অপরাধ থেকে নিবৃত্ত হবে। এভাবে ঘৃণা পোষণ দ্বারাও নীরবে অপরাধ দমন হতে পারে।
কেউ কেউ এ তিন স্তরকে এভাবে ভাগ করেছেন যে, শক্তিপ্রয়োগ দ্বারা অপরাধ দমন করা সরকারের দায়িত্ব। মুখের কথা দ্বারা প্রতিরোধ করা উলামার দায়িত্ব। আর অন্তর দ্বারা প্রতিহত করার দায়িত্ব আহলে দিল মাশায়েখের। অর্থাৎ তারা অপরাধকারীর ব্যাপারে আল্লাহর দিকে রুজ্জু করবে এবং তার সংশোধনের জন্য আল্লাহ তা'আলার কাছে রোনাজারি করবে। সেইসঙ্গে তার দিকে তাওয়াজ্জুহ দেবে ও আত্মিক শক্তি প্রয়োগ করবে। আত্মিক শক্তি প্রয়োগ দ্বারা অপরাধ দমন অভিনব কিছু নয়। ইসলামের ইতিহাসে আওলিয়া ও মাশায়েখের এমন বহু ঘটনা পাওয়া যায়, যাতে কোনওরূপ বাহুবল বা বাকশক্তি প্রয়োগ ছাড়াই কেবলমাত্র রূহানী শক্তি ব্যবহারের ফলে গুরুতর অপরাধীর জীবনও আমূল বদলে গেছে।
তবে উলামা-মাশায়েখের কেউ কেউ অপরাধ প্রতিরোধের এ তিন উপায়কে তিন শ্রেণীর লোকের মধ্যে ভাগ করলেও প্রকৃতপক্ষে অবস্থাভেদে সকলেই এ তিন প্রকারের আওতাভুক্ত। মনে মনে ঘৃণার ব্যাপারটা তো সর্বদা সকলের জন্যই প্রযোজ্য। আর শক্তিপ্রয়োগ আমভাবে সকলের পক্ষে সর্বক্ষেত্রে সম্ভব না হলেও শরী'আতের সীমার ভেতর কোনও কোনও ক্ষেত্রে সকলের পক্ষেই সম্ভব, যেমন পিতামাতার পক্ষে তার সন্তানদের, শিক্ষকের পক্ষে তার ছাত্রদের এবং অভিভাবকের পক্ষে তার অধীনস্তদের শাসন করা। এর বাইরেও যথাযথ শর্তসাপেক্ষে অনেক ক্ষেত্রে আমজনগণেরও শক্তি প্রয়োগের সুযোগ রয়েছে। আর মুখের কথা দ্বারা অন্যায়-অপরাধে বাধা দেওয়াটা শক্তিপ্রয়োগ অপেক্ষা অনেক সহজ। কোন্ কোন্‌টা অন্যায় কাজ, তার অধিকাংশই আমলোকেও বোঝে। তাই উলামা ছাড়াও অনেকের পক্ষে অন্যায়-অপরাধের প্রতিরোধে মুখের ব্যবহার সম্ভব।
ঈমানের সর্বনিম্ন স্তর
সবশেষে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, এটা ঈমানের সর্বনিম্ন স্তর। অর্থাৎ অন্যায়ের প্রতি অন্তরে ঘৃণা পোষণ করা ঈমানের দুর্বলতম স্তর। এক বর্ণনায় আছেঃ- وليس وراء ذلك من الإيمان حبة خردل ‘এরপর আর সরিষার দানা পরিমাণও ঈমানের স্তর নেই।
এর দ্বারা বোঝা যায় অন্যায়ের প্রতি অন্তরে ঘৃণা না থাকা অন্তর থেকে ঈমান চলে যাওয়ার প্রমাণ বহন করে। এ কারণেই হযরত আব্দুল্লাহ ইব্ন মাস'উদ রাযি. বলেনঃ- هلك من لم يعرف بقلبه المعروف والمنكر “ওই ব্যক্তি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, যে তার অন্তরে ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য অনুভব করে না।”
কেননা এটা এমন এক ফরয, যা কোনও অবস্থায়ই কারও থেকে রহিত হয় না। বরং অন্যায়ের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা নিকৃষ্টতম অপরাধ। এতে কার্যত অপরাধ না করেও নিজেকে অপরাধী বানানো হয়। এক হাদীছে ইরশাদ হয়েছে— إذا عملت الخطيئة في الأرض كانت من شهدها فكرهها كمن غاب عنها، ومن غاب عنها فرضيها كان كمن شهدها ‘পৃথিবীতে যখন কোনও পাপকার্য করা হয় তখন যে ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত থাকে এবং তা ঘৃণা করে সে ওই ব্যক্তির মত, যে সেখানে উপস্থিত থাকে না। পক্ষান্তরে অনুপস্থিত ব্যক্তি যদি তাতে সন্তুষ্ট থাকে, তবে সে ওই ব্যক্তির মত গণ্য হবে, যে সেখানে উপস্থিত থাকে।
প্রশ্ন হতে পারে, যে ব্যক্তির বাহুবল বা বাকশক্তি ব্যবহারের ক্ষমতা নেই তার সে অক্ষমতা তো একটা ওযর, এ অবস্থায় সে যদি মনে মনে অপরাধের প্রতি ঘৃণা পোষণ করে, তবে তা ঈমানের দুর্বলতম স্তর হবে কেন?
উত্তর এই যে, এটাকে দুর্বল বলা হয়েছে অন্য স্তরদুটি হিসেবে। তার মানে এ হাদীসে ঈমান দ্বারা ঈমানের গুরুত্বপূর্ণ শাখা- -সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ -কে বোঝানো হয়েছে। এ শাখার তিনটি স্তর। তার মধ্যে 'অন্তরে ঘৃণা পোষণ' হচ্ছে সর্বাপেক্ষা দুর্বল স্তর। কেননা এর জন্য যেমন বাহ্যিক কোনও শক্তির প্রয়োজন হয় না, তেমনি বিশেষ মানসিক শক্তি ও হিম্মতেরও দরকার হয় না। বোঝানো হচ্ছে যে, অন্য দু'টির তুলনায় এ কাজটি সহজ। কিংবা বলা যায় যে, প্রথম দু'টিতে শেষেরটিও যুক্ত থাকে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি বাহুবল বা বাকশক্তি ব্যবহার করে তার অন্তরে অপরাধ ও অন্যায়ের প্রতি ঘৃণাও থাকে। পক্ষান্তরে প্রথম দু'টি ব্যবস্থা যে অবলম্বন করে না তার অন্তরে কেবল ঘৃণাটুকুই থাকে, এর বেশি কিছু নয়। মোটকথা, এটিকে ঈমানের দুর্বলতম স্তর বলা হয়েছে কাজ হিসেবে, ব্যক্তি হিসেবে নয়।
আবার এরকমও বলা যায় যে, একে দুর্বল বলা হয়েছে ফলাফলের দৃষ্টিতে। কেননা বাহুবল ও বাকশক্তি ব্যবহার দ্বারা যেমন সুফল পাওয়া যায়, অতটা সুফল মনের ঘৃণা পোষণ দ্বারা পাওয়া যায় না। অর্থাৎ সুফল উৎপাদনের দিক থেকে এটি একটি দুর্বল ব্যবস্থা। এর দ্বারা এ কথা বোঝানো উদ্দেশ্য নয় যে, ওযরের কারণে যে ব্যক্তি প্রথম দুই ব্যবস্থা অবলম্বন করতে না পারায় শেষোক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করে অর্থাৎ মনে মনে অপরাধের প্রতি ঘৃণা পোষণ করে, সে দুর্বল ঈমানদার।
হাঁ, এতে তো কোনও সন্দেহ নেই যে, ওযর না থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি প্রথম দুই ব্যবস্থা অবলম্বন করে না, কেবল শেষ ব্যবস্থা অবলম্বন করেই ক্ষান্ত থাকে, সে একজন দুর্বল ঈমানদারই বটে।
হাদীছটির গুরুত্ব
উলামায়ে কিরাম বলেন, এটি এমন এক হাদীছ যাকে ইসলামের এক-তৃতীয়াংশ সাব্যস্ত করা যেতে পারে। কেননা শরী'আতের বিধান সর্বমোট ছয় প্রকার ফরয (ও ওয়াজিব), সুন্নত, মুবাহ, অনুত্তম, মাকরূহ ও হারাম। এর মধ্যে দুই প্রকার বিধানের কথা এ হাদীছ দ্বারা জানা গেল। প্রথম জানা গেল যে, যাবতীয় ফরয (-ওয়াজিব) সম্পর্কে আদেশ করা অবশ্যকর্তব্য। দ্বিতীয়ত জানা গেল যাবতীয় হারাম কাজে নিষেধ করা একান্ত কর্তব্য। এভাবে ছয় প্রকারের দুই প্রকার এ হাদীছের মধ্যে এসে গেল ।
কেউ কেউ বলেন, এ হাদীছের মধ্যে দীনের অর্ধেক এসে গেছে। কেননা শরী'আত নির্দেশিত কার্যাবলী দু'রকম। ক. অর্জনীয় কাজ ও খ. বর্জনীয় কাজ। অর্জনীয় কাজ তথা সৎকর্ম সম্পর্কে আদেশ করা জরুরি আর বর্জনীয় কাজ সম্পর্কে জরুরি তাতে লিপ্ত হতে নিষেধ করা। এ দ্বিতীয়টিই হাদীছের বিষয়বস্তু। সে হিসেবে দীনের অর্ধেক বিষয় এ হাদীছে পাওয়া গেল।
এক দৃষ্টিতে বলা যায় গোটা শরী'আতই এ হাদীছের বিষয়বস্তু। কেননা অর্জনীয় কাজ না করাটা অপরাধ। যেমন নামায একটি অর্জনীয় আমল। এ আমল না করা পাপ ও অন্যায় । সুতরাং কেউ যদি নামায না পড়ে, তখন অন্যের কর্তব্য হবে তাকে এ পাপ ও অন্যায় থেকে ফেরানো অর্থাৎ তাকে নামাযের আদেশ করা ও নামাযী বানানোর চেষ্টা করা। ব্যস এভাবে অর্জনীয় বিষয়গুলোও হাদীছটির অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।


হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা একটি ঈমানী দায়িত্ব। প্রত্যেক মু'মিনের কর্তব্য আপন আমলে যত্নবান থাকার পাশাপাশি সাধ্যমত এ দায়িত্ব পালন করে যাওয়া।

খ. কোনও কাজের প্রতিবাদ করার আগে ভালোভাবে জেনে নেওয়া চাই বাস্তবেই সে কাজটি নাজায়েয ও অপরাধ কি না।

গ. তারপর জেনে নেওয়া জরুরি যার সম্পর্কে অভিযোগ সে বাস্তবিকই অপরাধটি করেছে কি না।

ঘ. যে কাজটি বাস্তবিকই অপরাধ, তার প্রতিবাদকারী যেহেতু ঈমানী দায়িত্ব পালন করছে তাই তার সমালোচনা ও বিরোধিতা না করে অন্যদের কর্তব্য তার সমর্থন করা।

ঙ. মানুষের বাহুবল ও বাকশক্তি আল্লাহ তা'আলার দেওয়া অনেক বড় নি'আমত। এর অপচয় না করে ঈমানী দায়িত্ব পালনে ব্যবহার করা চাই।

চ. অন্যায়-অপরাধের প্রতি অন্তরে ঘৃণা পোষণ করাও ঈমানের দাবি। যার অন্তরে সে ঘৃণা নেই তার উচিত নিজ ঈমানের ব্যাপারে সতর্ক ও সচেতন হওয়া।

والله اعلم بالصواب

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি
উস্তাজুল ইফতা, জামিয়া ইমাম বুখারী, উত্তরা, ঢাকা।

প্রসঙ্গসমূহ:

মন্তব্য ()

কোনো মন্তব্য নেই।

এ সম্পর্কিত আরও জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

৪০৯৩৩

রাসূলুল্লাহ সা. কি সম্পর্কে ওয়ারাকা ইবনে নওফিলের ভাতিজা ছিলেন?


১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

গোবিন্দগঞ্জ

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি

৯৫৩১৪

সালামের জবাবে পাল্টা সালাম দেয়া কি ঠিক?


১২ মার্চ, ২০২৫

মুরাদনগর

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী শাহাদাত হুসাইন ফরায়েজী

৬১৩৪১

রাসুলুল্লাহ সা. কবে থেকে নবী?


১৯ মে, ২০২৪

ঢাকা ১২০৮

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী শাহাদাত হুসাইন ফরায়েজী

৪০৪৯১

নিষিদ্ধ সময়ের ঘুম


১ অক্টোবর, ২০২৩

লৌহজং

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি

Logoমুসলিম বাংলা
play storeapp store
TopOfStack Software © 2025 All rights reserved. Privacy Policy