আপনার জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

সকল মাসায়েল একত্রে দেখুন

আল কুরআনে মশা প্রসঙ্গ

প্রশ্নঃ ৪৪৪২৭. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, আল্লাহ,তায়ালা মশা কেন সৃষ্টি করেছেন এ বিষয়ে কিছু জানতে যাচ্ছি মশা তো মানুষের কোন উপকার করে না বরং মানুষকে কষ্ট দেয়,

৩০ অক্টোবর, ২০২৩

লক্ষ্মীপুর

উত্তর

و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم


আল কুরআনে মশা প্রসঙ্গ
ড. মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ
(daily nayadiganta এর সৌজন্যে)

মশা বর্তমান সময়ে একটি আলোচিত প্রসঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। হঠাৎ করে এডিস মশার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় অসংখ্য মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে ভুগছে। এমনকি বেশ কিছু মানুষের মৃত্যুও হয়েছে এ কারণে।

আল কুরআনে মশা সম্পর্কে বিশেষ কিছু তথ্য দেয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ নিঃসন্দেহে মশা বা তদূর্ধ্ব বস্তু দ্বারা উপমা পেশ করতে লজ্জাবোধ করেন না। বস্তুত যারা মুমিন তারা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করে যে, তাদের পালনকর্তা কর্তৃক উপস্থাপিত এ উপমা সম্পূর্ণ নির্ভুল ও সঠিক। আর যারা কাফের তারা বলে, এরূপ উপমা উপস্থাপনে আল্লাহর মতলবই বা কী ছিল? এ দ্বারা আল্লাহ তায়ালা অনেককে বিপথগামী করেন, আবার অনেককে সঠিক পথও প্রদর্শন করেন। তিনি অনুরূপ উপমা দ্বারা অসৎ ব্যক্তিবর্গ ভিন্ন কাউকেও বিপথগামী করেন না’ (সূরা আল-বাকারাহ-২: ২৬)।

এ আয়াতে সাতটি বিষয়ের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যেমন- ১. মশা সৃষ্টির মধ্যেও মানুষের জন্যে আল্লাহর নিদর্শন রয়েছে; ২. মশার চেয়েও ক্ষুদ্র সৃষ্টি রয়েছে; ৩. বিশ্বাসীরাই কুরআনে বর্ণিত বিষয়সমূহে সত্য সঠিক হিসাবে বিশ্বাস স্থাপন করে; ৪. অবিশ্বাসীরা কোনো কিছুতেই আল্লাহর নিদর্শন বুঝতে পারে না; ৫. এরকম নিদর্শনও মানুষের জন্য সঠিক পথের দিশা হতে পারে; ৬. আবার অনেককে বিপথগামী করতে পারে; ৭. অসৎ ব্যক্তিদের আল্লাহ কখনো সঠিক পথে নেন না।

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লক্ষ করলেও আমরা আশ্চর্য হবো এটা জেনে যে, কুরআন যে তথ্য প্রায় চৌদ্দশত বছর আগে মানব জাতিকে দিয়েছিল তা আধুনিক বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণিত হওয়ায় শুধু কুরআনের বিশুদ্ধতা নয়, বরং কুরআন যে একটি জীবন্ত মুজেজা তাও বিবেচিত হচ্ছে। এ আয়াতে তিনটি বৈজ্ঞানিক বিষয়কে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে বলে ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। যথা-
প্রথমত. গঠনগত কারণে মশার সৃষ্টি অন্য যেকোনো প্রাণী থেকে অনন্য এমনকি অন্যান্য উড়ন্ত পতঙ্গ থেকেও অনেকগুলো কারণে ভিন্ন।

দ্বিতীয়ত. কুরআনে ব্যবহৃত শব্দ ‘বাউদাহ’ মূলত স্ত্রীবাচক শব্দ। যা নারী মশাকে বোঝায় এবং আধুনিক বিজ্ঞান ইতোমধ্যে এটি প্রমাণ করেছে যে, শুধু স্ত্রী মশাই মানুষের রক্ত খায়। রক্ত খায় তারা তাদের ডিমে নিউট্রিশনের প্রয়োজন পূরণ করার জন্য এবং তৃতীয়ত, মশার চেয়েও ভিন্ন পতঙ্গ রয়েছে যারা তাদের উপরে প্রভাব বিস্তার করে বা তাদের থেকে রক্ত খায়। অত্যন্ত আশ্চর্যের যে, ১৯২২ সালে প্রথম বিজ্ঞানী এফ ডব্লিউ এডওয়ার্ডস তার গবেষণা পত্রে দাবি করেন, দক্ষিণ এশিয়ার মালয় অঞ্চলে এমন এক ধরনের পতঙ্গ পাওয়া গেছে, যা মশা থেকেই রক্ত খায়। এ প্রাণীটির নাম দিয়েছেন কুলিকোইডস এনোফেলিস। (দেখুন : সায়েন্টিফিক আমেরিকা, মস্কিউটস হেভ ফ্লাইং, ব্লাড সাকিং প্যারাসাইট অব দিয়ার ওন, ২০১৪)


উল্লেখ্য, মশা সম্পর্কে আমাদের কিছু ভুল ধারণা আছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো- মশা বেঁচে থাকার জন্যে আমাদের রক্ত খায়। আসলে রক্ত মশার খাবার নয়। তারা বিভিন্ন ফল-মূল থেকে বেঁচে থাকার জন্যে জুস হিসেবে খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। রক্ত শুধু নারী মশাদের ডিম পাড়ার জন্য প্রয়োজন হয় এবং এটি তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াস মাত্র। কিন্তু এ রক্ত সংগ্রহ করার সময় তাদের দ্বারা বাহ্যিক বিভিন্ন রকমের জীবাণু আমাদের শরীরে প্রবেশ করে ফলে আমাদের বিভিন্ন রকম অসুখ হয়। অর্থাৎ স্ত্রী মশারাই আমাদের মশাবাহিত রোগের মূল কারণ।

মশার কথা আল্লাহ কেন কুরআনে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তার কিছু অন্তর্নিহিত কারণ বুঝতে আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের সহায়তা করেছে। মশার আচারণ, প্রকৃতি ও গঠনগত দিক থেকে বেশ কিছু তথ্য তারা আবিষ্কার করেছে যা সত্যিই সচেতন যে কাউকে ভাবনায় ফেলে দেবে। তন্মধ্যে অন্যতম কয়েকটি হলো- ১. প্রায় দুই হাজার ৭০০ প্রজাতির মশা রয়েছে; ২. মশার এক শ’র ও বেশি চোখ রয়েছে; ৩. মশার মুখে ৪৮টা দাঁত রয়েছে; ৪. একটি মশার তিনটি পূর্ণ হার্ট (হৃদযন্ত্র) রয়েছে; ৫. মশার নাকে ছয়টি পৃথক ছুরি রয়েছে এবং প্রত্যেকটি ছুরির পৃথক ব্যবহার তারা করে থাকে; ৬. মশার শরীরে ডিজিটাল এক্সরে মেশিন আছে, যা রাতের আঁধারে মানুষের চামড়াকে শনাক্ত করার কাজে লাগায়; ০৭. প্রত্যেক মশার নিজস্বভাবে এনেস্থেশিয়া দেয়ার জন্য এক ধরনের ভ্যাকসিন আছে, যা মানুষের শরীরে তাদের হুল ফোটানোর মাধ্যমে রক্ত নেয়ার সময় ব্যবহার করে সেই জায়গাটাকে অবশ করে নেয় যাতে রক্ত নিলেও কোনো ব্যথা পাই না আমরা, ৮. রক্ত পরীক্ষা করার বিশেষ ব্যবস্থা এদের আছে। কারণ, এরা সব ধরনের রক্ত পছন্দ করে না; ৯. পূর্ণিমার সময়ে মশা প্রায় ৫০০ গুণ বেশি কামড়ায়; ১০. মশা উড়ার সময় সেকেন্ডে প্রায় ৫০০ বার তাদের পাখা নাড়ায়; ১১. বিশ্বব্যাপী মানুষের মৃত্যুর জন্য সকল প্রাণীর মধ্যে মশাই বেশি দায়ী, (১২) ১৮ ফুট দূর থেকে তাদের টার্গেট ঠিক করতে পারে, ১৩. পুরুষের চেয়ে নারী মশারা বেশি দিন বাঁচে এবং (১৪) মশার মতো আরো একটি ক্ষুদ্র পতঙ্গ আছে, যা মশা থেকেই রক্ত সংগ্রহ করে।


যদিও আধুনিক বিজ্ঞান মশা সম্পর্কে অনেক তথ্যই আমাদের দিয়েছে তবুও আমরা বলব, আরো অনেক তথ্যই অজানা রয়ে গেছে। কারণ, বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আধুনিক বিজ্ঞান হিমশিম খাচ্ছে। কার্যকরী উপায় বের হওয়ার আগেই প্রাণ হারাতে হচ্ছে শক্তিমান এ মানব জাতির অনেককেই। তাই, ভবিষ্যৎ বিজ্ঞান হয়তো সেগুলোকেও আমাদেরকে জানিয়ে দেবে।

মশা নিয়ে কুরআনের একটি গল্প মনে করিয়ে দিতে চাই। মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম আ:-এর সময়ের রাজার নাম ছিল নমরুদ। সে নিজেকে এতটাই উচ্চতায় ভাবত যে, সৃষ্টিকর্তা হিসেবেও দাবি করেছিল। জন্ম-মৃত্যু, খাদ্যের জোগান সব কিছু তার ক্ষমতার মধ্যে বলেও দাবি করেছিল। তার সাথে নবী ইবরাহিম আ:-এর একটি কথোপকথন আল্লাহ তায়ালা কুরআনে উল্লেখ করেছেন- (দেখুন সূরা আল-বাকারাহ-২: ২৫৮)। এই নমরুদের সেনাবাহিনীকে শেষ করে দেয়া হয়েছিল অসংখ্য মশা দ্বারা। আর ছোট্ট এই মশা প্রবেশ করেছিল নমরুদের নাকের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছিল সৃষ্টিকর্তা দাবি করা এই পাপিষ্ঠের একটি মশার কারণে।

কুরআনের এ গল্পটি আমাদেরকে স্মরণ করে দেয় মশার ক্ষমতা এবং এর ব্যবহারের উদ্দেশ্য। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে যেমন আমাদের পরীক্ষা করার নিমিত্তে হতে পারে, তেমনি আমাদের পাপের শাস্তিও হতে পারে। নমরুদের বেলায়ও তাই হয়েছিল।

একটু খেয়াল করলে দেখতে পাবো, কী হচ্ছে বর্তমান পৃথিবীতে? কী পরিস্থিতি পার করছি আমরা। জীবন সেখানে অনিরাপদ হয়েছে বিভিন্ন কারণে। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ সেখানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা, নিরপরাধ মানুষদের হত্যা, পাপের প্রসারতা, মদ ও মাদকদ্রব্যের ব্যাপকতা, হারামকে হালাল মনে করার প্রবণতা, দুর্নীতি বৃদ্ধি, ন্যায়বিচার উপেক্ষা, ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি অনিহাসহ অন্যান্য কারণ কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী হতে পারে। আল্লাহই জানেন প্রকৃত রহস্য, উদ্দেশ্য। তদুপরি, হঠাৎ করে আমাদের দেশে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বৃদ্ধি এবং ইতোমধ্যে কিছু প্রাণহানি কিন্তু আমাদের অনেক কিছু জানিয়ে দেয়।

অন্যান্য কার্যকরী পদক্ষেপের পাশাপাশি আল্লাহর রহমত ছাড়া এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের আশু কোনো পথ দেখছি না। আমাদের প্রত্যেকের উচিত সৃষ্টিকর্তা যার ক্ষমতা শুধু অসীম না বরং সব কিছুতে তার কর্তৃত্ব সমাসীন, চিরস্থায়ী তার কাছেই জীবনের সুস্থতা ও নিরাপত্তার জন্য দোয়া করা প্রয়োজন। প্রিয় নবী মুহাম্মদ সা: একটি দোয়া আমাদের শিখিয়েছেন। তারই ভাষায়, ‘আল্লাহর পূর্ণ কালিমার বিনিময়ে তাঁর সৃষ্টির সব অনিষ্ট থেকে পরিত্রাণ চাচ্ছি’ (সুনানে আবু দাউদ, ৩৮৯৮ ও ৩৮৯৯)।
লেখক : প্রবন্ধকার

والله اعلم بالصواب

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি
উস্তাজুল ইফতা, জামিয়া ইমাম বুখারী, উত্তরা, ঢাকা।

মন্তব্য ()

কোনো মন্তব্য নেই।

এ সম্পর্কিত আরও জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

৯০২১৪

রজব শব্দটি মুনসারিফ নাকি গায়রে মুনসারিফ?


২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

৮P৩C+GV৭

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী নাঈম সিদ্দীকী বিন আব্দুস সাত্তার

৮৮৭৩৭

মুদারাবার পদ্ধতি


১১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

খাগড়াছড়ি

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি

৮৮৮২৯

তাহাজ্জুদের ফযীলত


১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

Tamil Nadu ৬২৮৪০২

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী আবু সাঈদ

৭৭১৪৪

নবীর কাছে উম্মতের গুনাহ পেশ করা হয়?


২৪ নভেম্বর, ২০২৪

HHMC+F৪৭ - Old Umm Al Quwain - Umm Al Quawain - সংযুক্ত আরব আমিরাত (AE)

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী শাহাদাত হুসাইন ফরায়েজী

Logoমুসলিম বাংলা
play storeapp store
TopOfStack Software © 2025 All rights reserved. Privacy Policy