আপনার জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

সকল মাসায়েল একত্রে দেখুন

বাদশাহ আওরঙ্গজেব আলমগীর সম্পর্কে কিছু আপত্তি ও তার নিরসন

প্রশ্নঃ ৪১৭৪৫. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, মুহতারাম, আমি ইতিহাস বিভাগে অধ্যয়নরত একজন ছাত্র। সম্রাট আওরঙ্গজেব সম্পর্কে আমাদের হযরত উলামায়ে কেরাম ভালো ধারণা পোষণ করে থাকেন। কিন্তু সেক্যুলাররা পাশাপাশি এরকম প্রশ্নও করে থাকেন যে আওরঙ্গজেব তো তার পিতাকে গৃহবন্দী করেছিলেন, দুই ভাইকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন এবং এক ভাইকে রাজ্য থেকে পলায়নে বাধ্য করেছিলেন। আমার প্রশ্ন হচ্ছে তার এরূপ কর্মকাণ্ড কি শরিয়ত অনুযায়ী ঠিক ছিল নাকি সত্যিই নিছক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্যই এমনটা করেছিলেন?

৩ অক্টোবর, ২০২৩
ঢাকা

উত্তর

و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم


প্রথমত, মোগল বাদশাহ আবুল মুজাফ্ফার মুহিউদ্দীন আওরঙ্গজেব আলমগীর রাহঃ (১৬১৮-১৭০৭ খ্রি.) সম্পর্কে প্রামাণিক তথ্যাদী ও সঠিক ইতিহাস জানতে আল্লামা শিবলী নোমানী রাহঃ কর্তৃক উর্দু ভাষায় রচিত 'এক নজরে বাদশাহ আলমগীর ' একটি শ্রেষ্ঠ ও অদ্বিতীয় গ্রন্থনা। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে সঠিক ইতিহাস জানতে এটি অবশ্যই অধ্যয়ন করা উচিত।

এবার সংক্ষেপে প্রশ্নোক্ত আপত্তি সমূহের খণ্ডন করত: সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে আলোকপাত করা যাক।

বাদশাহ আলমগীর একজন দ্বীনদার বুযুর্গ বাদশাহ ও পিতা-মাতার একান্ত অনুগত সন্তান ছিলেন। ভাইদের সাথে বিরোধের পূর্বে তার এসব বৈশিষ্ট্য নিয়ে মুসলিম হোক কিংবা ইসলাম বিদ্বেষী ঐতিহাসিকদের কারও কোন মতানৈক্য নেই।
ঘটনার সূত্রপাত ঘটে ১০৬৭ হিজরির মাঝামাঝি সময়ে, যখন গদিনশীন বাদশাহ শাহজাহান পেশাব আটকে যাওয়া জনিত কারণে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। এবং তখন আলমগীর শত্রু কেল্লা অবরোধরত অবস্থায় ছিলেন। বড় শাহজাদা দারা শিকোহ বাদশাহর অসুস্থতার খবর গোপন রাখে এবং বাদশাহর বর্তমানেই সভাসদদের তার প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। –স্বভাবগতভাবে দারা শিকোহ ছিল রগচটা, ভীরু প্রকৃতির ও রাষ্ট্র পরিচালনায় অনভিজ্ঞ, যার দরুন সে মোগল আমলের যুদ্ধ কবলিত এই শেষ সময়ে বাদশাহ পদের জন্য একজন অযোগ্য দাবিদার ছাড়া আর কিছুই ছিল না, আর ইসলাম থেকে মুখ ফিরিয়ে সম্রাট আকবরের মতো তার সর্বধর্মের চিন্তা লালন করার প্রসঙ্গ নাহয় বাদই দিলাম– ওদিকে বাকি তিন শাহজাদা শুজা, আওরঙ্গজেব আলমগীর ও মুরাদকে তার নির্দেশে কিছুই জানানো হয়নি। এতে রাজকার্যে বিঘ্নতার সৃষ্টি হতে থাকে ও গোলযোগ বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে ঘটনা জানতে পেরে শুজা ও মুরাদ দারা শিকোহর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। অথচ আলমগীর তখনও নির্বিকার ছিলেন। উপরন্তু তিনি তাদের এরূপ করতে বারণ পর্যন্ত করেছেন। যখন দেখলেন, দারা শিকোহ তার সেনাবাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও অফিসারদের রাজধানীতে তলব করে এবং তার দূতকে আটক করে তার কাজের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে, তখন নিরুপায় হয়ে তিনি ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তার উদ্দেশ্য ছিল, বাদশাহ শাহজাহানের সাথে দেখা করত: আলোচনার মাধ্যমে বিবাদের নিষ্পত্তি করা। সম্রাট শাহজাহানেরও এটাই ইচ্ছা ছিল। কিন্তু তাকে বাদশাহর সাথে দেখা ও আলোচনা থেকে বাঁধা দেয়া হয়। দারা শিকোহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রাজা যশোবন্ত সিং এর সাথে পথিমধ্যে যুদ্ধ বেঁধে গেলে তাতে যশোবন্ত সিং এর শোচনীয় পরাজয় ঘটে। এতে দুটো বিষয় আলমগীরের সামনে আসে:
১- দারা শিকোহ বাদশাহ শাহজাহানকে বন্দী করে রেখেছে এবং ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছে।
২- এখন বাদশাহর সাথে আলোচনার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো, বাদশাহ ও সালতানাতের পক্ষ হয়ে ক্ষমতার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা দারা শিকোহর ফিতনা নির্মূল করে রাষ্ট্রের শান্তি শৃংখলা পুনরায় ফিরিয়ে আনা।
এজন্য তিনি সেদিকে মনোনিবেশ করেন, তাকে দারা শিকোহর সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয় এবং এতে দারা শিকোহর শোচনীয় পরাজয় ঘটে। রাষ্ট্রদ্রোহীর ব্যাপারে সুপারিশের জন্য অসুস্থ পিতাকে ব্যবহার করতে থাকে কুচক্রী নেত্রী জাহানারা, পয়গাম আসে, মহলে গিয়ে পিতা বাদশাহ শাহজাহানের সাথে দেখা করার।
যেহেতু আওরঙ্গজেব আলমগীর একজন বিচক্ষণ শাসক ছিলেন, তাই তিনি দারাশিকোহ ও জাহানারার ষড়যন্ত্রের আশংকায় তা প্রত্যাখ্যান করলেন। হতে পারে, পিতা ডেকেছে, ষড়যন্ত্র ছিল না এটা, কিন্তু আশু ষড়যন্ত্রের আশংকায় মহলে না যাওয়ার পূর্ণ অধিকার ছিল আলমগীরের। মু'মিন ব্যক্তি ধোঁকা দিবে না এবং প্রতারণার ফাঁদেও পা দিবে না। আর যেহেতু পিতার মন মস্তিষ্কের উপর ওদের প্রবল প্রভাব ছিল, তাই তারজন্য রাষ্ট্রের শান্তি শৃংখলা বজায় রাখতে প্রয়োজন ছিল ওদের মধ্যকার যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে রাখা। তাইজন্য উনি সামগ্রিক কল্যাণের বিবেচনায় সাময়িক পিতাকে নজরবন্দী করে রেখেছিলেন, বন্দী বানাননি। এটাকে ইসলাম বিদ্বেষী ঐতিহাসিকরা কদর্যভাবে উপস্থাপন করেছেন। অথচ এই অবস্থায় নিজ পুত্রকে প্রয়োজনীয় খাদ্য ও আসবাবপত্র সহ দাদার দেখাশোনার জন্যও নিয়োজিত করেছিলেন তিনি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তিনি পিতাকে নজরবন্দী থেকে মুক্ত করে তার আরামের ব্যবস্থা করেন।
আর দারা শিকোহর শোচনীয় পরাজয়ের পর রাষ্ট্রের শান্তি শৃংখলা বজায় রাখতে তাকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়। অনেক ঐতিহাসিক বলেন, দারা শিকোহ ইসলাম বিদ্বেষী মনোভাব রাখার দরুনই তাকে মরতে হয়েছে। এটা সঠিক নয়, বরং তার চেয়ে মূখ্য কারণ এটা ছিল যে, সে রাষ্ট্রদ্রোহী ও রাষ্ট্রের শান্তি ও নিরাপত্তায় প্রতিবন্ধক ছিল। কোনো ঐতিহাসিক এটা প্রমাণ করতে পারবেনা যে, আওরঙ্গজেব আলমগীর পিতার জীবদ্দশায় বাদশাহী হাসিল করেছিলেন। কেননা, তিনি সত্যনিষ্ঠ ও অনুগত সন্তান ছিলেন। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও পিতার জীবদ্দশায় বাদশাহী হাসিলের চিন্তাও করেননি।
এবার আসি শাহজাদা মুরাদ প্রসঙ্গে, সে রাষ্ট্রের অন্তর্দ্বন্দ্ব নিরসনে ভাইয়ের সঙ্গ দিয়ছিল ঠিকই, কিন্তু ক্ষমতার লোভ তাকে অন্ধ করে দেয়। ফলে সে আওরঙ্গজেব আলমগীরের মন্ত্রী আমলাদের উস্কানি দেয় ও তাদের কিনে তার দলে ভিড়াতে সচেষ্ট হয়। ফলে এতেও দেশের শান্তি শৃংখলা বিঘ্নিত হয়ে আবারও যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়। অগত্যা বাধ্য হয়ে আলমগীরকেও পদক্ষেপ নিতে হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে মুরাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
এখানে চরম আপত্তি এজন্য জাগে যে, আলমগীর বিপুল রক্তপাত থেকে বিমুখ হয়ে তদবিরের সাহায্যে অসংখ্য মানুষের জান বাঁচাতে তার মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে যুদ্ধ পরিস্থিতি উতরে গেছেন এবং দেশের শান্তি শৃংখলা ফিরিয়ে এনেছেন। কিন্তু যদি যুদ্ধ হতো এবং যুদ্ধে মুরাদ সহ অসংখ্য মানুষের নিহত হবার মধ্য দিয়ে এর সমাপ্তি হতো। তাহলে ভাইকে মারার এই আপত্তি আদৌ উঠত না। বরং তখন এভাবে দেখা হতো যে, আলমগীরের সঙ্গে যুদ্ধে পেরে উঠেনি, ভাগ্যে ছিল বিধায় মরেছে। তাই তখনকার পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আলমগীরের গৃহীত সিদ্ধান্তে ভূল ধরার চেষ্টাই অবান্তর নয়কি? উপরন্তু দারা শিকোহ ও মুরাদকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান কেবলই রাষ্ট্রের অরাজকতা দমন ও শান্তি শৃংখলা রক্ষার্থেই হয়েছে। এখানে বাদশাহ আলমগীরের কোনোরূপ ব্যক্তিস্বার্থ ছিল না। একই অবস্থা হয়েছে শুজার ক্ষেত্রেও। ক্ষমতার লোভ তাকেও আলমগীরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে নামিয়েছে। ফলে শাস্তিস্বরূপ তাকে দেশান্তর করা হয়। তাদের প্রত্যেকেই বিদ্রোহ ও অরাজকতা সৃষ্টির দরুন পাপের শাস্তি ভোগ করেছেন।
আর দিল্লির মসনদের এই ত্রিভুজ লড়াইয়ে আলমগীরের অংশ না নিলে প্রতাপশালী মোঘল সাম্রাজ্যের সূর্য সময়ের একশবছর আগেই ডুবে যেত। কারণ, বাদশাহ আওরঙ্গজেব আলমগীর সর্বশ্রেষ্ঠ মোগল সম্রাট ছিলেন এবং তিনি যে বাকি ভাইদের চেয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য অনেক বেশী দক্ষ, বিচক্ষণ ও কুশলী ছিলেন এতে কারও দ্বিমত নেই। এবং তার মৃত্যুর মধ্য দিয়েই মোঘল সাম্রাজ্যের পতনের ডাক শুরু হয়ে গিয়েছিল।
পরিশেষে, কথা এটিই রয়ে যায় যে, দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কায়েম করনার্থে তার গৃহীত এসব সিদ্ধান্ত শরীআতের দৃষ্টিতে সঠিক ছিল কিনা?
উত্তর: এটা আশা করা যায় যে, লোভ প্রবৃত্তি, খুনী মনোভাব ও ব্যক্তিগত স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে উম্মাহর বৃহত্তর স্বার্থে ও কেবলই রাষ্ট্রের কল্যাণে নেয়া তার এসব সিদ্ধান্তের জন্য তিনি আল্লাহর দরবারে মাযুর গণ্য হবেন।

সূত্রঃ আল্লামা শিবলী নোমানী রাহঃ রচিত 'এক নজরে বাদশাহ আলমগীর ' পৃষ্ঠা: ৮৬-১১২। (উর্দু মূল নুসখা)

والله اعلم بالصواب

মুসলিম বাংলা ইফতা বিভাগ

মন্তব্য (0)

কোনো মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্য করুন!

মন্তব্য করতে লগইন করুন

এ সম্পর্কিত আরও জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর