আপনার জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

সকল মাসায়েল একত্রে দেখুন

১২ ই রবিউল আউয়ালে বিশেষ রোযা বা আমল আছে কি?

প্রশ্নঃ ৪১০০০. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, রবিউল আউয়াল মাসের কি আলাদা রোযা/আমলের বিধান আছে? ১২ রবিউল আউয়াল পালনের বিধান কি?,

৬ নভেম্বর, ২০২৩

ঢাকা

উত্তর

و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم


জ্বী,না। রবিউল আউয়াল মাসের আলাদা কোন রোযা বা আমল ইত্যাদী নেই। শরীয়তে রবিউল আউয়াল মাসের সাথে যুক্ত কোনো আমলেরই অস্তিত্ব নেই, সেখানে আমলের বিশেষ সূরত ও তার ফযীলত তো দূরের কথা।

আপনার জ্ঞাতার্থে এখানে রবিউল আউয়াল কেন্দ্রিক কিছু বানোয়াট আমল ও তার বর্ণিত ফযীলতের খণ্ডনসহ উল্লেখ করা হলো।

রবিউল আউয়ালে বিশেষ নামায এবং দরূদ পাঠের ফযীলতঃ

বাজারে প্রচলিত বার চান্দের ফযীলত নামের কিছু পুস্তিকায় রবিউল আউয়াল মাসের আমল শিরোনামের অধীনে লেখা হয়েছে-

এক. “যে ব্যক্তি রবীউল আউয়াল মাসের চাঁদ দেখে সে রাতে দুই দুই রকাত করে ১৬ রাকাত নামায আদায় করে। প্রত্যেক রাকাতে সূরা ফাতিহার পর তিনবার সূরা ইখলাস পাঠ করবে। আর নামায শেষ করে নি¤েœাক্ত দরূদ শরীফ ১০০০ বার পাঠ করবে। এরূপ একাধারে ১২ দিন পর্যন্ত পাঠ করলে ১২ দিন যেতে না যেতেই সে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্নযোগে দেখতে পাবে। দরূদ শরীফটি হল...।”

দুই. “যে ব্যক্তি এ মাসের প্রথম দিন হতে শুরু করে মাসের শেষ দিন পর্যন্ত প্রত্যহ এশার নামাযের পর নি¤েœাক্ত দরূদ...। ...সে ব্যক্তি প্রচুর পরিমাণে ধন-সম্পদের মালিক হবে এবং তার সংসারে সুখ-শান্তি বিরাজ করবে...।”

তিন. “যে ব্যক্তি ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখে বেশি পরিমাণে নফল নামায, কোরআন তেলাওয়াত, যিকির... তার গুনাহ মাফ করে সম্মান বৃদ্ধি করে দেবেন...। ”

চার. “ যে ব্যক্তি এই দরূদ শরীফ সোয়া লক্ষ বার রবিউল আউয়াল মাসের মধ্যে পড়িবে সে...। ”

পাঁচ. “১২ রবিউল আউয়ালে তাবে তাবেয়ীগণ হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র রূহের প্রতি হাদিয়া স্বরূপ ২০ রাকাত নফল নামায পড়িতেন। প্রত্যেক রাকাতে...।”

এভাবে বিভিন্ন পুস্তকে রবিউল আউয়াল মাসের আমল হিসাবে বিভিন্ন ধরনের মনগড়া পদ্ধতির নামায ও দরূদ শরীফের আমল এবং তার মনগড়া ফযীলত লেখা হয়েছে। এগুলো সবই বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।

সাখাবী রাহ. দরূদ শরীফ বিষয়ক তার কিতাব ‘আলকাওলুল বাদী’-এ সপ্তাহের বিভিন্ন দিনে বা নির্দিষ্ট মাসে বিশেষ ধরনের নামাযের সাথে সাথে দরূদ পাঠের ফযীলত বিষয়ক কিছু জাল বর্ণনা উল্লেখ করার পর বলেন-

ولم أورد هذه وشبهه إلا للتنبيه على وهائه.

এ বর্ণনাটি এবং এজাতীয় অন্যান্য যে (ভিত্তিহীন) বর্ণনা আমি এখানে উল্লেখ করেছি; তা কেবল এগুলোর অসারতা ও ভিত্তিহীন হওয়ার বিষয়ে সতর্ক করার উদ্দেশ্যেই। -আলকাওলুল বাদী‘, পৃ. ২৯৮

আর আমাদের আলোচ্য বর্ণনাগুলো এমন ধরনের বানোয়াট কথা যে, জাল বর্ণনা বিষয়ক কিতাবাদিতেও তা পাওয়া যায় না। জাল বর্ণনা বিষয়ক বেশ কিছু কিতাব ঘেঁটেও রবিউল আউয়াল মাস কেন্দ্রিক বিশেষ কোনো নামাযের জাল বর্ণনাও পাওয়া যায়নি। পূর্ববর্তী হাদীস জালকারীরা বছরের অন্যান্য মাস বা দিনের আমল সম্পর্কে হাদীস জাল করেছে, কিন্তু রবিউল আউয়াল মাস বিষয়ে কোনো জাল বর্ণনা পাওয়া যায়নি। কারণ, রবিউল আউয়াল মাস-মুহাররম, রমযান, যিলহজ্ব ইত্যাদি মাসের মত বিশেষ আমলের মাস নয়। আল্লাহই ভালো জানেন, বার চান্দের আমল শিরোনামের পুস্তিকাওয়ালারা এসকল কথা কোথা থেকে পেল; যা তারা ‘কিতাবে উল্লেখ আছে’ বা ‘কিতাবে বর্ণিত আছে’ ইত্যাদি বলে পেশ করেছে।

আর দরূদ শরীফ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ও বহুত বড় নেক আমল। আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীমে মুমিনদের দরূদ পাঠের নির্দেশ দিয়েছেন। এর সবচে বড় ফযীলত হল, দরূদ পাঠকারীর উপর আল্লাহ তাআলা রহমত নাযিল করেন। কেবল রহমতই নাযিল করেন না; একবার দরূদ পাঠ করার কারণে দশবার রহমত নাযিল করেন। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

مَنْ صَلَّى عَلَيَّ وَاحِدَةً صَلَّى الله عَلَيْهِ عَشْرًا.

যে আমার প্রতি একবার দরূদ পাঠ করে আল্লাহ তার প্রতি দশবার রহমত বর্ষণ করেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪০৮

এছাড়াও দরূদ পাঠের মাধ্যমে গুনাহ মাফ হয় এবং মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

مَنْ صَلَّى عَلَيَّ مِنْ أُمَّتِي صَلَاةً مُخْلِصًا مِنْ قَلْبِهِ، صَلَّى الله عَلَيْهِ بِهَا عَشْرَ صَلَوَاتٍ، وَرَفَعَهُ بِهَا عَشْرَ دَرَجَاتٍ، وَكَتَبَ لَهُ بِهَا عَشْرَ حَسَنَاتٍ، وَمَحَا عَنْهُ عَشْرَ سَيِّئَاتٍ.

যে ব্যক্তি আমার প্রতি অন্তর থেকে একবার দরূদ পেশ করবে আল্লাহ তাআলা এর বিনিময়ে তার উপর দশবার রহমত বর্ষণ করবেন। তার মর্তবা দশ স্তর পর্যন্ত উন্নীত করবেন। তাকে দশটি নেকী দান করবেন এবং তার দশটি গুনাহ মাফ করে দেবেন। -সুনানে কুবরা, নাসায়ী, হাদীস ৯৮৯২, ৯৮৯৩; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ১২৯৭; আমালুল ইয়াউমি ওয়াল লাইলাহ, নাসায়ী, হাদীস ৩৬২

তেমনি বেশি বেশি দরূদ পাঠের মাধ্যমে নবীজীর নৈকট্য লাভ হয়, ফিরিশতাদের দুআ লাভ হয়। চিন্তা-পেরেশানী দূর হয়। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

أَوْلَى النَّاسِ بِي يَوْمَ القِيَامَةِ أَكْثَرُهُمْ عَلَيَّ صَلاَةً.

কিয়ামতের দিন আমার নৈকট্য লাভ করবে ঐ ব্যক্তি, যে আমার প্রতি অধিক পরিমাণে দরূদ পাঠ করে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৪৮৪

আমের ইবনে রবীআ তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

مَا صَلّى عَلَيّ أَحَدٌ صَلَاةً، إِلّا صَلّتْ عَلَيْهِ الْمَلَائِكَةُ مَا دَامَ يُصَلِّي عَلَيّ، فَلْيُقِلّ عَبْدٌ مِنْ ذَلِكَ أَوْ لِيُكْثِرْ.

কোনো ব্যক্তি যতক্ষণ আমার উপর দরূদ পাঠ করতে থাকে ফিরিশতারা তার জন্য দুআ-ইসতিগফার করতে থাকে। এখন ব্যক্তির ইচ্ছা, চাইলে আমার উপর অধিক পরিমাণে দরূদ পাঠ করুক অথবা কম। (যে পরিমাণে দরূদ পাঠ করবে সে হিসাবেই ফিরিশতাদের দুআ-ইসতিগফার লাভ করবে।) -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৫৬৮৯; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৯০৭; আলমুনতাখাব মিন মুসনাদি আবদ ইবনু হুমাইদ, হাদীস ৩১৭

উবাই ইবনে কা‘ব রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ...আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আপনার প্রতি বেশি বেশি দরূদ পড়ে থাকি।... (একপর্যায়ে) নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-

إِذًا تُكْفَى هَمَّكَ، وَيُغْفَرُ لَكَ ذَنْبُكَ.

তাহলে তো তোমার (দুনিয়া-আখিরাতের) সকল প্রয়োজন পুরা হবে, সকল পেরেশানী দূর হবে এবং তোমার গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৪৫৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২১২৪২

আর নির্দিষ্ট দিনে দরূদ পড়ার বিষয়ে সহীহ হাদীসে যা পাওয়া যায় তা হল, জুমার দিন বেশি বেশি দরূদ পাঠ করা। হযরত আউস ইবনে আউস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

إنَّ مِنْ أفضل أيامِكُم يومَ الجُمعة... فأكثروا عَلَيَّ مِن الصَّلاةِ فيه، فإنَّ صَلاتَكم مَعرُوضَةٌ عَلَيَّ...

নিশ্চয়ই জুমার দিন শ্রেষ্ঠতম দিনগুলোর অন্যতম। ...সুতরাং সেদিন তোমরা আমার উপর বেশি বেশি দরূদ পড়। নিশ্চয় তোমাদের দরূদ আমার কাছে পেশ করা হয়। ... -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১০৪৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৬১৬২; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৯১০

অন্য হাদীসে হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

أَكْثِرُوا الصَّلَاةَ عَلَيَّ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَلَيْلَةَ الْجُمُعَةِ؛ فَمَنْ صَلَّى عَلَيَّ صَلَاةً صَلَّى الله عَلَيْهِ عَشْرًا.

তোমরা জুমার রাত ও জুমার দিনে আমার উপর বেশি বেশি দরূদ পাঠ কর। যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরূদ পাঠ করে আল্লাহ তাআলা তার উপর দশবার রহমত নাযিল করেন। -সুনানে কুবরা, বায়হাকী (৩/২৪৯), হাদীস ৫৯৯৪;; ফাযাইলুল আওকাত, বায়হাকী, হাদীস ২৭৭; আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লাইলাহ, ইবনুস সুন্নী, হাদীস ৩৭৯

দরূদ পাঠের ফযীলত বিষয়ক এরকম আরো অনেক সহীহ হাদীস রয়েছে। এসকল সহীহ বর্ণনা এবং সেগুলোতে দরূদের এত বড় বড় ফযীলত বর্ণিত হওয়া সত্ত্বেও একশ্রেণির মানুষ নিজে থেকে আরো বিভিন্ন ফযীলত আবিষ্কার করেছে। আল্লাহ তাদের মাফ করুন এবং আমাদেরকে সহীহটা জেনে আমল করার তাওফীক দান করুন। নবীজীর উপর বেশি বেশি দরূদ পাঠ এবং তাঁর সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরার মাধ্যমে তাঁর শাফাআত লাভে ধন্য করুন- আমীন।

** বার চাঁদের আমল শিরোনামের কিছু পুস্তকে রবিউল আউয়াল মাস কেন্দ্রিক আরওকিছু বানোয়াট আমল ও তার ফযীলত উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলোর একটিতে লেখা হয়েছে-

রবিউল আউয়াল মাসে নিম্নোক্তরূপে আমল করলে আল্লাহ পাকের কৃপায় যে কোনো বাসনা সফল এবং অশেষ নিআমত লাভ হয়।
আমল করার নিয়ম : মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে গোসল করত একটি নির্ধারিত স্থান সুগন্ধযুক্ত করবে, অতঃপর নতুন পোশাক পরিধান করে ঐ সুগন্ধযুক্ত স্থানে বসে সর্বপ্রথম একচল্লিশবার নিম্নোক্ত দুআটি পাঠ করে একবার সূরা মুয্যাম্মিল পাঠ করে একচল্লিশবার নিম্নোক্ত দ্বিতীয় দুআটি পাঠ করবে...প্রথম দুআ... দ্বিতীয় দুআ...।

আরেকটিতে রবিউল আউয়ালের আমল হিসেবে লেখা হয়েছে-
যদি কেউ এই মাসের ১২, ১৩, ১৪ তারিখের রাত্রিতে বিতিরের নামাযের পর ৭ হাজার ৭ শত ৪১ বার উক্ত দরূদ (নির্দিষ্ট একটি দরূদ) শরীফ পাঠ করে, তহলে সে গরীব থাকলে ধনী হবে। শর্ত হল, ১২ তারিখ দোয়া পাঠের শুরুর দিনটি সোমবার, বৃহস্পতিবার বা শুক্রবার হওয়া চাই।

আরেকটি পুস্তকে লেখা হয়েছে-
হাদীসের কিতাবে আছে, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মদিনে বেশি পরিমাণে নফল নামায, কোরআন তেলাওয়াত, যেকের, তসবীহ-তাহলীল পাঠ, দান-খয়রাত ও তাঁর পবিত্র সীরাত আলোচনা করা, তাঁর সুন্নতের কথা মানুষকে জানিয়ে দেয়া অনেক সওয়াবের কাজ। এতে গোনাহ মাফ হয়, মর্যাদা বৃদ্ধি পায়, অভাব দূর হয়।
এভাবে বার চাঁদের আমল শিরোনামের বিভিন্নটাতে বিভিন্ন আমল মনগড়াভাবে বলা হয়েছে।
এসবের কোনোটা উল্লেখ করতে গিয়ে তারা বলেছে, হাদীসের কিতাবে আছে...। অথচ হাদীসের কিতাবের সাথে এগুলোর ন্যূনতম কোনো সম্পর্ক নেই। মনগড়া কথাকে হাদীসের কিতাবে আছে বলে চালিয়ে দেয়া অনেক বড় অন্যায় ও গুনাহের কাজ।
এগুলোর বর্ণনাভঙ্গি ও ভাষা-উপস্থাপন থেকেই স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, এগুলো বানিয়ে বানিয়ে বলা হচ্ছে।
সবচেয়ে বড়কথা হল, শরীয়তে রবিউল আউয়াল মাসের সাথে যুক্ত কোনো আমলেরই অস্তিত্ব নেই, সেখানে আমলের বিশেষ সূরত ও তার ফযীলত তো দূরের কথা।
আল্লাহ আমাদের এজাতীয় ভিত্তিহীন বানোয়াট বিষয় বলা ও বিশ্বাস করা থেকে রক্ষা করুন। (আল কাউসার)

২য় প্রশ্নের উত্তরঃ

১২ই রবিউল আউয়াল কি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্ম ও ওফাত দিবস ?

ইতিহাস ও সিরাতের কিতাবের উপর যাদের নযর আছে তারা জানেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম ও ওফাতের তারিখ কোনোটিই নিশ্চিতভাবে ১২ রবিউল আওয়াল বলা ঠিক নয়। অনেক গবেষকই জন্মতারিখ ৯ই রবিউল আউয়াল সোমবার ও ওফাতের তারিখ ২ রবিউল আউয়াল সোমবার-কে তারজীহ দিয়েছেন (সবচেয়ে সহীহ বলেছেন)। (দ্র. ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার আসকালানী খ. ৮ পৃ.৭৬৩ কিতাবুল মাগাযী,বাব ৮৩; রাহমাতাল লিল আলামীন, কাজী মুহাম্মাদ সুলাইমান সালমান মানসুরপুরী খ.১ পৃ.৩৫; আসাহহুস সিয়ার পৃ.৫৫০-৫৫২; মাকালাতুল কাউছারী পৃ. ৩৬২-৩৭০;আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া খ. ৪ পৃ. ২২৭-২৩০

সে যাই হোক ইসলামে জন্ম ও মৃত্যু দিবস পালন করার কোনো অনুমতি নেই। কোনো সাহাবী, তাবেয়ী, ইমাম, উলামায়ে উম্মাহ কেউ এমনটি করেন নি; বরং করাকে বিদআত বলেছেন। সুতরাং তা পরিত্যাজ্য। আল্লাহ আমাদের সকল প্রকার রসম-রেওয়াজ ও বিদআত থেকে হেফাজত করুন। এগুলোর পিছনে না পড়ে পুরোপুরি সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন যাপন করার তাওফিক দান করুন।

আরো সবিস্তারে জানতে নিম্নের কিতাব ও প্রবন্ধে দেখুনঃ

কিতাবঃ নবীজির সা. জন্মতারিখ ও ঈদে মীলাদুন্নবী- মাওলানা তাহমীদুল মাওলা দাঃ।

প্রবন্ধঃ
রাসূল করীম (সা.)-এর জন্মতারিখঃ বিচার-বিশ্লেষণ-সংশয়-সন্দেহের অপনোদন
মূল লেখক- মুফতী রেজাউল হক : শায়খুল হাদীস : দারুল উলূম যাকারিয়া দ.আফ্রিকা
অনুবাদ : মুফতী আতীকুল্লাহ

(রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শুভ জন্ম কোন বছরে, কোন মাসে, কোন দিনে, কখন ও কোন জায়গায় হয়, এ নিয়ে কার কী মত? বিশুদ্ধ মতামত কোনটি? বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে সে বিষয়ে আলোচন-পর্যালোচনা করা হয়েছে।)

মুহাক্কিক ও গবেষকদের মতে, ৯ ই রবিউল আউয়াল মোতাবেক ২০ শে এপ্রিল ৫৭১ খ্রিস্টাব্দ, রোজ সোমবার আনুমানিক ভোর ৪টা ৪০ মিনিটে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর শুভাগমনে পৃথিবী চির ধন্য হয়।

জন্মের বছর :

রাসূল করীম (সা.)-এর শুভাগমন হয় ‘আমুল ফিল’-এ তথা অভিশপ্ত আবরাহা তার বিশাল হাতি বাহিনী নিয়ে কা’বা শরীফের ওপর যে বছর আক্রমণ করে, সেই বছরে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শুভ জন্মলাভ করেন।

এই বিষয়ে সকল ঐতিহাসিক ও সীরাত প্রণেতাগণ ঐক্যমত্য পোষণ করেছেন। (আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, ২/৩২১, ছিফাতুস সাফওয়াহ-১/৫১, আর-রাওযুল আনফ ১/২৭৬)

হাতি বাহিনীর অভিযানের কয় দিন পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অবির্ভাব ঘটে তা নিয়ে অবশ্য বিভিন্ন মতামত পাওয়া যায়, তবে যে মতটি সর্বাধিক প্রচলিত ও অধিক প্রসিদ্ধ তা হলো, পঞ্চাশ দিন পরে রাসূল (সা.) জন্মলাভ করেন।

হাফেয ইবনে কাসীর (রহ.) বলেন,

ولد عام الفيل…. فقيل بعده بشهر… وقيل بخمسين يوما، وهو أشهر

“জন্ম লাভ করেন ‘আমুল ফিল’-এ। কেউ কেউ বলেন, ঘটনার এক মাস পরে; আর কেউ কেউ বলেন, পঞ্চাশ দিন পরে, আর এই মতটিই অধিক প্রসিদ্ধ।” (আল-বিদায় : ২/৩২১)

জন্ম মাস :

কোন মাসে জন্ম লাভ করেন? এ বিষয়ে বহু মতপার্থক্য রয়েছে।

আল্লামা কাসতলানী (রহ.) (মৃ. ৯২৩ হি.) ছয়টি মত উল্লেখ করেছেন। যথাÑ

১. মুহাররম,

২. ছফর,

৩. রবিউল আউয়াল,

৪. রবিউল আখের,

৫. রজব,

৬. রমাজান।

তবে জমহুর (সংখ্যাগুরু ঐতিহাসিকগণ) এ বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর জন্মগ্রহণ রবিউল আউয়াল মাসে হয়েছে।

হাফেজ ইবনে কাছীর (রহ.) বলেন,

ثم الجمهور على أنه كان فى شهر ربيع الأول

“অতঃপর জমহুর একমত হয়েছেন রবিউল আউয়াল মাসের ওপর।” (আল-বিদায়া ২/৩২০)

বিশ্বনন্দিত প্রসিদ্ধ আলেমে দ্বীন আল্লাম মুহাম্মদ যাহেদ কাউসারী (রহ.) বলেন, রবিউল আউয়াল ব্যতীত অন্য মাসে জন্ম লাভ করার মতামতটি বিজ্ঞ ওলামায়ে কেরামের নিকট গ্রহণযোগ্য নয়, তা ভুলক্রমে কারো কলমে চলে এসেছে হয়তো। (মাকালাতে কাউছারী, পৃ. ৪০৫)

জন্মদিন :

কোন দিনটিতে জন্ম লাভ করেন? এ কথাই সকল ঐতিহাসিক একমত যে রাসূল (সা.)-এর জন্ম সোমবার হয়েছে।

فى الحديث: وسئل رسول الله صلى الله عليه وسلم عن يوم الإثنين، فقال ذلك يوم ولدت فيه ويوم يبعث

‘‘হাদীসে বর্ণিত আছে যে রাসূল (সা.)-কে সোমবার-বিষয়ক প্রশ্ন করা হলো। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উত্তরে বললেন, সেটি এমন দিন, যাতে আমার জন্ম হয়েছে এবং প্রেরিত হয়েছি। (মুসলিম শরীফ, হা. ১১৬২; আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ২/৩১৯)

জন্মতারিখ :

রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মাহে রবিউল আউয়ালের সোমবারে জন্ম লাভ করেছেন এ কথা স্পষ্ট ও চিহ্নিত, তবে কোন তারিখে হয়েছে, তা নির্দিষ্ট ও চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি।

পক্ষান্তরে অধিকাংশ ওলামায়ে কেরাম বলেন, নির্দিষ্ট তারিখ রয়েছে। কিন্তু নির্দিষ্ট কোন তারিখে জন্মগ্রহণ করেছেন, তা নিয়ে ইখতিলাফ রয়েছে ও বিভিন্ন রেওয়ায়ত রয়েছে।

আল্লামা কসতলানী (রহ.) মোট সাতটি রেওয়ায়াত উল্লেখ করেছেন। যথাÑ

১.

২ রবিউল আউয়াল।

২.

৮ রবিউল আউয়াল।

৩.

১০ রবিউল আউয়াল।

৪.

১২ রবিউল আউয়াল।

৫.

১৭ রবিউল আউয়াল।

৬.

১৮ রবিউল আউয়াল।

৭.

২২ রবিউল আউয়াল। (আল- মাওয়াহিবুল লাদুননিয়্যাহ ১/১৪০-১৪২)

আল্লামা যাহেদ কাউছারী (রহ.) বলেন, ৮, ৯ ও ১০Ñএই তিন মতামত ব্যতীত অন্যান্য মতামত গ্রহণযোগ্য নয়।

সুতরাং আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হলো এই তিনটি রেওয়ায়াত। এখন প্রশ্ন হল, এ তিনটির কোনটি প্রাধান্য পাওয়ার যোগ্য এবং কেন?

১০ তারিখের রেওয়ায়াত :

এ রেওয়ায়াতকে ইবেন সা’আদ (রহ.) (মৃ. ২৩০ হি.) মুহাম্মদ বাকের (রহ.) (মৃ. ১১৪)-এর দিকে নিসবত করেন।

কিন্তু এ সনদে তিন বর্ণনাকারী এমন রয়েছেন যাঁরা বিতর্কিত, যাঁদের বিষয়ে কালাম রয়েছে।

সুতরাং ১০ তারিখের রেওয়ায়াতটি প্রাধান্য পাওয়ার যোগ্য নয়।

আর এ রেওয়ায়াতটির দিকে আল্লামা কাউছারী ( রহ.) ইঙ্গিত করেছেন। এ রেওয়ায়াত নকল করা হয় তবকাতে কুবরা থেকে। রেওয়ায়াতটি হলো,

قال ابن سعد: أخبرنا محمد بن عمر بن واقد الأسلمى قال: حدثنى أبو بكر ابن عبد الله بن ابى سبرة عن إسحاق بن عبد الله بن أبى فروة عن أبى جعفر محمد بن على (يعرف بمحمد الباقر) قال: ولد رسول الله صلى الله عليه وسلم يوم الإثنين لعشر ليال خلون من شهر ربيع الأول، …. فبين الفيل وبين مولد رسول الله صلى الله عليه وسلم خمس وخمسين ليلة

অনুবাদ : আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে আলী যিনি মুহাম্মদ আল বাকের নামে প্রসিদ্ধ। তিনি বলেন, রাসূলে কারীম (সা.)-এর জন্ম হয়েছে ১০ রবিউল আউয়াল। …হাতি বাহিনীর অভিযান ও রাসূল (সা.)-এর পবিত্র জন্মের মধ্যকার সময়ের ব্যবধান ৫৫ দিন। (আত-তাবকাতুল কুবরা, ১/১০০)

‘১২ রবিউল আউয়াল’-এর রেওয়ায়াত :

এ রেওয়ায়াতের বর্ণনাকারী হলেন মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক (মৃ. ১৫১ হি.) কিন্তু তিনি কোনো সনদ বর্ণনা করেননি।

এ বর্ণনাটি যদিওবা অধিক প্রসিদ্ধ ও সর্বাধিক প্রচলিত এবং মক্কাবাসী সেই অনেক আগে থেকেই এ দিনেই সিরাত সেমিনার করে থাকেন সাথে সাথে পৃথিবীব্যাপী সভা-সেমিনার এই দিনেই হয়ে আসছে এতদ্বসত্ত্বেও এ রেওয়ায়াতটি প্রমাণসিদ্ধ নয় এবং এই দিনেই যে রাসূল (সা.)-এর জন্ম হয়েছে, তার কোনো দলিল-প্রমাণ পাওয়া যায় না।

একটি রেওয়ায়াত পাওয়া গেলেও সেটি মুত্তাসিল না হওয়াতে অগ্রহণযোগ্য বরং তা সনদহীন রেওয়ায়াতের ন্যায়। রেওয়ায়াতটি নিম্নে প্রদত্ত হলো

حَدَّثَنَا أَبُو الْحَسَنِ مُحَمَّدُ بْنُ أَحْمَدَ بْنِ شَبُّوَيْهِ الرَّئِيسُ بِمَرْوَ، ثنا جَعْفَرُ بْنُ مُحَمَّدٍ النَّيْسَابُورِيُّ، ثنا عَلِيُّ بْنُ مِهْرَانَ، ثنا سَلَمَةُ بْنُ الْفَضْلِ، عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ إِسْحَاقَ، قَالَ: «وُلِدَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِاثْنَتَيْ عَشْرَةَ لَيْلَةً مَضَتْ مِنْ شَهْرِ رَبِيعٍ الْأَوَّلِ

মুহাম্মদ ইবেন ইসহাক থেকে বর্ণিত “রাসূল (সা.) জন্মগ্রহণ করেন রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে।” (মুসতাদরাকে হাকেম, হা. ৪১৮৩)

৯ তারিখে জন্মগ্রহণ নিয়ে বিশ্লেষণ :

সূত্র ও যুক্তির বিচারে যে মতটি প্রাধান পাওয়ার যোগ্য তা হলো, রাসূল (সা.)-এর জন্ম রবিউল আউয়াল মাসের আট দিন পর নবম তারিখে।

বর্ণনাসমূহ :

১.

আল্লামা ইবনে আব্দিল বার (রহ.) (মৃ. ৪৬৩ হি.)

এ বিষয়ে মতানৈক্য বর্ণনা করতে গিয়ে উপরোক্ত মতটি সর্বাগ্রে উল্লেখ করেছেন। [আল ইস্তি’আব ইবনে আব্দিল বার (রহ.), ১/৩০]

قال أبو عمر: وقد قيل لثمان وخلون منه وقيل..، قيل… وقيل..

২.

হাফেয ইবনে কাসীর (রহ.) বলেন,

وَقِيلَ لِثَمَانٍ خَلَوْنَ مِنْهُ حَكَاهُ الْحُمَيْدِيُّ عَنِ ابْنِ حَزْمٍ.

وَرَوَاهُ مَالِكٌ وَعُقَيْلٌ وَيُونُسُ بْنُ يَزِيدَ وَغَيْرُهُمْ عَنِ الزُّهْرِيِّ عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ جُبَيْرِ بْنِ مُطْعِمٍ وَنَقَلَ ابْنُ عَبْدِ الْبَرِّ عَنْ أَصْحَابِ التَّارِيخِ أَنَّهُمْ صَحَّحُوهُ وَقَطَعَ بِهِ الْحَافِظُ الْكَبِيرُ مُحَمَّدُ بْنُ مُوسَى الْخُوَارِزْمِيُّ وَرَجَّحَهُ الحافظ أبو الخطاب بن دِحْيَةَ فِي كِتَابِهِ التَّنْوِيرِ فِي مَوْلِدِ الْبَشِيرِ النَّذِيرِ

“কেউ কেউ বলেন, রাসূল (সা.)-এর জন্ম মাসের আট দিন অতিবাহিত হওয়ার পর নবম দিনে হয়েছে।

হুমায়দি (রহ.) ইবনে হাযম থেকে বর্ণনা করেন, মালেক, উকাইল, ইউনুস বিন ইয়াযিদ প্রমুখ ইমাম যোহরী (রহ.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি মুহাম্মদ ইবনে জুবাইর ইবনে মুতঈম (রহ.) থেকে বর্ণনা করেন।

ইবনে আব্দিল বার (রহ.) বলেন, ইতিহাসবিদরা উপরোক্ত মতের সত্যায়ন করেছেন।

হাফেযে কবীর মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল-খারযেমী (রহ.) তাঁকে আরো সুনিশ্চিত ও মাযবুত করেছেন এবং হাফেয আবুল খাত্তাব ইবনে দিহয়া নিজ গ্রন্থে এ রেওয়ায়াতকে প্রাধান্য দিয়েছেন।” (আল-বিদায়া আন-নিহায়া ২/৩২০)

৩.

হযরত মাওলানা হিফজুর রহমান (রহ.) (মৃ. ১৩৮২ হি.) লিখেছেন,

সাধারণ জনগণের মধ্যে ১২ রবিউল আউয়ালের মতটি অধিক প্রচার-প্রসার হয়, যার ভিত্তি দুর্বল রেওয়ায়াতের ওপর। আর কিছুসংখ্যক উলামায়ে কেরামের মত হলো, ৮ রবিউল আউয়াল, তবে বিশুদ্ধ ও প্রমাণসিদ্ধ মতটি হচ্ছে ৯ রবিউল আউয়াল।

বিশ্ব্যবিখ্যাত জীবনীকার, ইতিহাস রচয়িতা ও আইম্মায়ে হাদীসসহ অনেকেই এ তারিখকে সহীহ ও মজবুত বলেছেন।

তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন হুমাইদী (রহ.), উকাইল (রহ.), ইউনুস ইবনে ইয়াযিদ (রহ.), ইবনে হাযম (রহ.), মুহাম্মদ ইবনে মুসা খারযেমী (রহ.), আবুল খাত্তাব ইবনে দিহয়া (রহ.), ইবনে তাইমিয়া (রহ.), ইবনুল কাইয়ূম (রহ.), ইবনে কাসীর (রহ.), ইবনে হাজর আসকালানী (রহ.) ও শায়খ বদরুদ্দীন আইনী (রহ.)। (কাসাসুল কোরআন ৪/২৫৩)

৪.

আল্লামা সুলাইমান নদভী (রহ.) ও ৯ রবিউল আউয়ালকে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর জন্মতারিখ হওয়ার মতকে প্রাধান্য দিয়েছেন। (রাহমাতুল লিল আলামীন, ১/৩৮-৩৯)

যুক্তির বিচারে ৯ রবিউল আউয়াল

১.

মুহাম্মদ ইবনে মুসা খারযেমী (রহ.) (মৃ. ২৩৫ হি.) ছিলেন সৌরবিজ্ঞানী। তাঁর মতের কথা আগেই বলা হয়েছে।

২.

সৌরবিজ্ঞানী মাহমুদ পাশা মিশরী (১৩০২ হি.) ফ্রান্সিস ভাষায় تقويم العرب قبل الإسلام (ইসলামপূর্ব আরবরে ক্যালেন্ডার) এ বিষয়ে অসাধারণ এক গ্রন্থ রচনা করেন। আরবীতে অনুবাদ করেন, আল্লামা আহমদ যকী পাশা (মৃ. ১৩৫৩ হি.) যার নাম হলো,

نتائج الإفهام فى تقويم القرب قبل الإسلام وفى تحقيق مولد النبى وعمره عليه الصلاة والسلام

এই কিতাবটিতে বহু বৈজ্ঞানিকের উদ্ধৃতিকে সামনে রেখে করা গবেষণা ও বিশ্লেষণে ৯ রবিউল আউয়াল তারিখটি স্পষ্ট হয়ে উঠে। ( নাতায়িজুল আফহাম…, পৃ. ৩৫-৩৮)

উপরোক্ত কিতাবে উল্লেখ করা বিশ্লেষণসমূহ থেকে একটি বিশ্লেষণ নিম্নে প্রদত্ত হলোঃ

রাসূল (সা.)-এর পবিত্র যুগে দশম হিজরীর মাহে শাওয়ালের শেষ তারিখে সূর্যগ্রহণ হয়েছিল।

একই দিনেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহেবজাদা হযরত ইবরাহীম (রা.) মৃত্যুবরণ করেন,

يَوْم مَاتَ إِبْرَاهِيم يَعْنِي بن النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَقَدْ ذَكَرَ جُمْهُورُ أَهْلِ السِّيَرِ أَنَّهُ مَاتَ فِي السَّنَةِ الْعَاشِرَةِ مِنَ الْهِجْرَةِ …… وَالْأَكْثَرُ عَلَى أَنَّهَا وَقَعَتْ فِي عَاشِرِ الشَّهْرِ

হাফেয ইবনে হাজর আসকালানী (রহ.) (মৃ. ৮৫২ হি.) বলেন, যেদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর প্রিয় ছেলে ইবরাহীম (রা.) মৃত্যুবরণ করেন (সেদিনই সূর্যগ্রহণের ঘটনা ঘটে)।

অধিকাংশ সীরাত প্রণেতাগণ বলেন, তিনি মারা যান দশম হিজরিতে। কোন মাসে এ ঘটনা সংঘটিত হয় সে বিষয়ে মতানৈক্য থাকলেও সংখ্যাগুরু উলামায়ে কেরামের মতামত হচ্ছে দশম মাস তথা শাওয়াল মাসে সূর্যগ্রহণের ঘটনাটি ঘটেছিল। (ফাতহুল বারী, ৩/৪৮৯)

উপরোক্ত হিসাব অনুযায়ী গণনা করা হলে রাসূল (সা.)-এর জন্মগ্রহণ রবিউল আউয়ালের ৯ তারিখে হওয়াটাই প্রমাণিত হয়।

কেননা, জন্মের দিনটি যে সোমবার এ বিষয়ে তো সাবাই একমত আর সেদিনটি হস্তি বাহিনী ধ্বংসের বছরের রবিউল আউয়ালের ৯ তারিখেই হয়।

এ ছাড়া অন্য তারিখে হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই।

আল্লামা মাহমুদ পাশা বলেন, “সমস্ত উলামায়ে কেরাম ঐকমত্য পোষণ করেন যে রাসূল (সা.)-এর শুভ জন্মের শুভ দিনটি ছিল সোমবার। (আবরাহার হাতি বাহিনীর অভিযানের বছরের) রবিউল আউয়াল মাসের ৮ কিংবা ১২তম তারিখে সোমবার পাওয়া যায় না। সে মাসের নবম দিনে সোমবার ছিল।

সুতরাং নবম দিন ভিন্ন অন্য কোনো তারিখে রাসূল (সা.)-এর জন্ম হয়েছেÑএ কথা অগ্রহণযোগ্য বলেই সাব্যস্ত হবে।”

হযরত মাওলানা হিফজুর রহমান (রহ.) বলেন, মাহমুদ পাশা (কুসতুনতুনিয়ার প্রসিদ্ধ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও সৌরবিজ্ঞানী ছিলেন) তিনি জ্যোতির্বিদ্যার আলোকে যে নক্ষত্রসূচি/বর্ষপুঞ্জি প্রণয়ন করেছেন, যার উদ্দেশ্য ছিল রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর যুগ থেকে এ যুগ পর্যন্ত সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের যত ঘটনা ঘটে গিয়েছে তার একটা সঠিক হিসাব বের করা।

তিনি তাতে পূর্ণ তাহকীকের সাথে প্রমাণ করেছেন যে রাসূল (সা.)-এর মোবারক জন্মের বছরে কোনোভাবেই সোমবার ১২ রবিউল আউয়ালে পড়ে না বরং তা একমাত্র ৯ রবিউল আউয়ালেই পড়ে।

শক্তিশালী দলিল-প্রমাণের ভিত্তিতে, বিশুদ্ধ সূত্র ও বর্ণনার নিরিখে, জ্যোতির্বিদ্যা ও সৌরবিজ্ঞানের আলোকে রাসূল (সা.)-এর জন্মগ্রহণের গ্রহণযোগ্য প্রামাণ্য তারিখ হলো ৯ রবিউল আউয়াল। (কাসাসুল কোরআন ৪/২৫৩)

৩.

উপরোক্ত নাতায়েজু আফহাম… নামক গ্রন্থের এক অ্যাডিশনে ভূমিকা লিখেছেন সে যুগের প্রসিদ্ধ ইসলামিক চিন্তাবিদ, ইতিহাসবিদ ও বিখ্যাত সাহিত্যিক শায়খ আলি তানতাবী (রহ.) (মৃ. ১৪২০ হি.)।

তিনি নিজের লিখিত ভূমিকায় গ্রন্থ প্রণেতা কর্তৃক গৃহীত প্রাধান্য পাওয়া ৯ তারিখের মতের পক্ষে জোরদার সমর্থন জুগিয়েছেন। (মুকাদ্দামাতুত তানতাবী, ৮৩)

৪.

স্বনামধন্য মুহাদ্দিস ও গবেষক শায়খ আহমদ শাকের (রহ.) (আহমদ বিন মুহাম্মদ আব্দুল কাদের, মৃ. ১৩৭৭ হি.) তিনিও শায়খ বৈজ্ঞানিক মাহমুদ পাশার গবেষণা মেনে নিয়েছন এবং সে গবেষণা থেকে সূর্যগ্রহণ-বিষয়ক সহযোগিতা নিয়েছেন। (হাশিয়াতুশ শায়খ আহমদ শাকের ‘আলাল মুহাল্লা বিল আছার, ৫/১১৪-১১৫)

৫.

আরবের গবেষক সৌরবিজ্ঞানী আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম (মৃ. ১৪১৬ হি.) লিখেছেন, “বিশুদ্ধ রেওয়ায়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) শুভাগমন হয় ২০ এপ্রিল ৫৭১ ইংরেজিতে আমুল ফিল’-এ…সুতরাং তাঁর জন্ম-মৃত্যুর দিন খুব সূক্ষ্মভাবে বের করা সম্ভব…এর ভিত্তিতে বর্ণনার বিচারে ও যুক্তির আলোকে রাসূল (সা.)-এর জন্মতারিখ হলো ৯ রবিউল আউয়াল হিজরীপূর্ব ৫৩ সনে মোতাবেক ২০ এপ্রিল, ৫৭১ খ্রিস্টাব্দ। (তাকভীমুল আযমান, পৃ. ১৪৩)

আরো দ্রষ্টব্য

গবেষণা প্রবন্ধ যার শিরোনাম হলো

تحديد ميلاده الشريف

যা সন্নিবেশিত রয়েছে

ما شاع ولم يثبت فى السيرة النبوية নামক গ্রন্থে, লেখক হলেন মুহাম্মদ ইবেন আবদুল্লাহ। সে প্রবন্ধে প্রবন্ধকার বৈজ্ঞানিক আবদুল্লাহ ইবনে ইবরাহীমের উপরোক্ত উদ্ধৃতি উল্লেখপূর্বক অন্যান্য উলামায়ে কেরামের মতামতের আলোকে ৯ তারিখের মতকে প্রাধান্য দিয়েছেন।

অনুরূপ আল্লামা যাহেদ কাউসারী (রহ.) নিজের রচিত প্রবন্ধ

المولد الشريف النبوى

-এ মাহমুদ পাশার উচ্চ প্রশংসা করেছেন এবং প্রবন্ধ রচনায় তাঁর রচিত কিতাব থেকে যথেষ্ট সহযোগিতা নিয়েছেন এবং তাঁর সাথে সহমতপোষণ করেছেন। (মাকালাতে কাউসারী, পৃ. ৪০৫-৪০৮)

আরো দ্রষ্টব্য হযরত মাওলানা মুফতী ্ওমর ফারুক সাহেব (শায়খুল হাদীস দারুল উলূম লন্ডন) কর্তৃক রচিত প্রবন্ধ, যা তাঁ র প্রণীত কিতাব ফেকহী জাওয়াহের-এ সন্নিবেশিত, ১/৬৮-৭১ ৮ ও ৯ তারিখের বর্ণনাদ্বয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন মনে রাখতে হবে, কিছু কিছু উলামা হযরাত ৮ তারিখের মতটি গ্রহণ করেছেন এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ৮ ও ৯ উভয়ের মধ্যে একটিকে অপরটির ওপর প্রাধান্য দেওয়ারও চেষ্টা করা হয়েছে।

মাওলানা হিফজুর রহমান সাহেব (রহ.) মতদ্বয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করেছেন। তিনি বলেন, ৮ ও ৯ এর মধ্যে বাস্তবিকার্থে কোনো এখতিলাফ নেই।

কেননা তা মাসের ২৯ ও ৩০ এর হিসাবের ওপর নির্ভরশীল। হিসাব করে দেখা যায়, সঠিক তারিখটি ছিল মূলত ২১ এপ্রিল। এ হিসেবে ৮ তারিখের সকল বর্ণনা ৯ তারিখের জন্য সহায়ক হয়ে যায়। (কাসাসুল কোরআন, ৪/২৫৪)

জন্মের সময়কাল :

সোমবারের কোন সময়ে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জন্মগ্রহণ করেন? সীরাতের কিতাবসমূহে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে যে নবী কারীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর জন্ম সুবহে সাদিকের সময় হয়েছে আর পবিত্র মক্কা নগরীতে ২০ এপ্রিল সুবহে সাদিক হয় ৪টা ৩৯ মিনিটে।

সুতরাং বলা যায় রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ৯ রবিউল আউয়াল, হিজরীপূর্ব ৫৩ সনে; ২০ এপ্রিল, ৫৭১ খ্রিস্টাব্দ, রোজ সোমবার আনুমানিক ভোর ৪টা ৪০ মিনিটে এ ধরাতে তাশরীফ এনেছেন।

উপরোক্ত আলোচনা-পর্যালোচনা থেকে এ কথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে আকল ও নকলের আলোকে, যুক্তি ও সূত্রের বিচারে রাসূল (সা.)-এর মোবারক জন্মের গ্রহণযোগ্য তারিখ হলো, ৯ রবিউল আউয়াল।

জন্মস্থান :

জমহুর উলামায়ে কেরাম বলেন, রাসূল (সা.) পবিত্র জন্মস্থান হলো পবিত্র মক্কা নগরী। তবে নির্দিষ্ট কোন জায়গায় জন্মলাভ করেন তা নিয়ে মতভেদ থাকলেও প্রসিদ্ধ মত হচ্ছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর জন্ম শা’বে বনি হাশেম নামক প্রসিদ্ধ জায়গায় হয়েছে। কয়েক বছর পূর্বেও মানুষ সে জায়গার জিয়ারতের উদ্দেশ্যে যেতেন। বর্তমানে সে জায়গা বন্ধ করে দিয়ে তাতে মাকতাবা নির্মাণ করা হয়েছে।

# আল কাউসার ও আহলে হক

والله اعلم بالصواب

উত্তর দিয়েছেনঃ মুসলিম বাংলা ইফতা বিভাগ

মন্তব্য ()

কোনো মন্তব্য নেই।

এ সম্পর্কিত আরও জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

৩১২১৮

তাহাজ্জুদের নামাজ জামাতের সাথে পড়া প্রসঙ্গে।


২১ মার্চ, ২০২৩

ঢাকা

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী মাহমুদুল হাসান

৩১২৬২

জুমার দিন বয়ান চলাকালীন কাবলাল জুমআ আদায় করা যাবে কি?


১২ এপ্রিল, ২০২৩

ফুলতলা

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ শাইখ উমায়ের কোব্বাদী

৩৯৯৫০

মাগরিবের আগে নফল পড়ার বিধান


৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

মহারাষ্ট্র ৪১০২১৮

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতি সাইদুজ্জামান কাসেমি

২৫৪৫৩

চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণের সময় কি গর্ভবতী নারী কিছু খেতে কিংবা ঘর থেকে বের হতে পারবে?


১৯ নভেম্বর, ২০২২

আলাইয়ারপুর

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ শাইখ উমায়ের কোব্বাদী

Logoমুসলিম বাংলা
play storeapp store
TopOfStack Software © 2025 All rights reserved. Privacy Policy