আপনার জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

সকল মাসায়েল একত্রে দেখুন

তাওহিদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি ও পুরস্কার

প্রশ্নঃ ২৫১০০. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, তাওহিদ নিয়ে বিস্তারিত জানতে চাই।,

১৩ নভেম্বর, ২০২২

ঢাকা ১২১৪

উত্তর

و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم


এক. প্রিয় প্রশ্নকারী ভাই, নবীগণের জীবনের প্রধান লক্ষ্য ছিল, আল্লাহ তাআলার ‘খালিস ইবাদত’ তথা শিরকের মিশ্রণমুক্ত উপাসনা এবং ‘কামিল ইতাআত’ -চূড়ান্ত ও নিরঙ্কুশ আনুগত্য, যা একমাত্র আল্লাহরই প্রাপ্য। আর এটাই তাওহিদ। একে নিজের জীবনে বাস্তবায়িত করা, অন্য সবার জীবনেও প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা আবশ্যক। আর আপনি এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়েই প্রশ্ন করেছেন। এজন্য আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন।
মূলত তাওহিদ বাস্তবায়িত হয়, কালিমায়ে শাহাদাতের বাস্তবায়নের মাধ্যমে। আর এই বাস্তবায়নের রয়েছে, দুটি স্তর। ওয়াজিব স্তর এবং মুস্তাহাব স্তর।
ওয়াজিব স্তর বাস্তবায়িত হয়, চারটি জিনিস বর্জন করার মাধ্যমে। যেগুলোকে আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভী রহ. বলেছেন, তাওহীদের চার প্রতিপক্ষ।
১. প্রকাশ্য, আপ্রকাশ্য, ছোট, বড় সব ধরণের শিরক বর্জনের মাধ্যমে। এ মর্মে আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنْصَارٍ
নিশ্চয় যে আল্লাহর সাথে শরীক করে, তার উপর অবশ্যই আল্লাহ জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন এবং তার ঠিকানা আগুন। আর জালিমদের কোনো সাহায্যকারী নেই। (সূরা মায়েদাহ ৭২)
২. সব ধরণের কুফর বর্জনের মাধ্যমে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى
অনন্তর যে দুর্বৃত্তকে প্রত্যাখ্যান করে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে সে তো ধারণ করল সুদৃঢ় হাতল। (সূরা বাকারা ২৫৬)
৩. সব ধরণের বেদআত বর্জনের মাধ্যমে। কেননা, বেদআত মূলত শরীয়তের পূর্ণাঙ্গতাকে উপেক্ষা করে। অথচ আল্লাহ তাআলা বলে দিয়েছেন,
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا
আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্ম সম্পূর্ণ করলাম এবং আমার নেয়ামত তোমার উপর পরিপূর্ণ করলাম। আর ইসলামকে তোমাদের ধর্মরূপে পছন্দ করলাম। (সূরা মাইদা ৩)
৪. গাফলত বর্জনের মাধ্যমে। কেননা, খালেস দীন তথা তাওহিদ থেকে বিমুখ হওয়ার এক ব্যাপক কারণ হল, গাফলত বা উদাসীনতা। আল্লাহর সাথে সম্পর্কহীনতা ও তাঁর বিধিবিধান সম্পর্কে অবহেলা। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ نَسُوا اللَّهَ فَأَنْسَاهُمْ أَنْفُسَهُمْ أُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ
আর ওদের মতো হয়ো না, যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে। ফলে আল্লাহ ওদেরকে আত্মবিস্মৃত করে দিয়েছেন। (সূরা হাশর ১৯)
পক্ষান্তরে মুস্থাতাহাব স্তর; যা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বান্দা একজন অপরজনের উপর মর্যাদাবান হয়। তাহল এই যে, অন্তরের দিক থেকে সম্পূর্ণ আল্লাহমুখী থাকা। আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো বস্তু বা ব্যক্তি থেকে অন্তরকে এমনভাবে বিমুখ রাখা যে, তার প্রতিটি কথা হবে আল্লাহর জন্য, তার সকল কর্ম হবে আল্লাহর জন্য, এমনকি তার হৃদয়ের স্পন্দনও স্পন্দিত হবে তো আল্লাহর জন্য। এক কথায়, তার হৃদয়ের ভাবনা, মুখের ভাষা ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কাজ-সবই পরিপূর্ণ মাত্রায় আল্লাহর নিরঙ্কুশ আনুগত্য করবে।

দুই. উক্ত দুই স্তরের তাওহিদ বাস্তবায়ন করতে হলে কিছু জিনিসের প্রয়োজন পড়ে।
১. ইলম। কেননা, তাওহিদের ইলম না থাকলে, তাওহিদ না বুঝলে বাস্তবায়ন করবে কিভাবে! আমল করবে কিভাবে!
২. অন্তরের বিশ্বাস। অর্থাৎ, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল ﷺ যেসব সংবাদ পরিবেশন করেছেন, সেগুলোর সত্যতার ব্যাপারে দৃঢ় ও পরিপূর্ণ বিশ্বাস রাখা।
৩. আল্লাহ ও তাঁর রাসুল ﷺ যেসব আদেশ ও নিষেধ করেছেন, সেগুলো নিজের জীবনে বাস্তবায়িত করা।
উক্ত তিনটি বিষয় যার জীবনে যত বেশি ধারণ ও লালন করতে পারবে তার তাওহিদ হবে তত বেশি শাণিত এবং সে আল্লাহর কাছে হবে তত বেশি মর্যাদাপূর্ণ। আর এটাকেই বলা হয়, ‘খালিস ইবাদত’ তথা শিরকের মিশ্রণমুক্ত উপাসনা এবং ‘কামিল ইতাআত’ -চূড়ান্ত ও নিরঙ্কুশ আনুগত্য। আল্লাহ বলেন,
أَلَا لِلَّهِ الدِّينُ الْخَالِص
মনে রেখো, খাঁটি ইবাদত একমাত্র আল্লাহরই প্রাপ্য। (সূরা যুমার ৩)
وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّهِ
এবং যেন উপাসনা-আনুগত্য শুধু আল্লাহর হয়। (সূরা আনফাল ৩৯)

তিন. রাসুলুল্লাহ ﷺ আমাদেরকে পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, যে ব্যক্তি তাওহিদের সর্বোচ্চ স্তর বাস্তবায়ন করতে পারবে তাহলে সে ওই সত্তর হাজারের মধ্যে একজন হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করবে, যাদের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে যে, এরা বিনা হিসাবে জান্নাতে যাবে।
এ মর্মে বুখারী (৫৭০৫) ও মুসলিম (২২০)-এর হাদিসে এসেছে,
عن ابْنُ عَبَّاسٍ رضي الله عنهما قال : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ عُرِضَتْ عَلَيَّ الْأُمَمُ فَرَأَيْتُ النَّبِيَّ وَمَعَهُ الرُّهَيْطُ وَالنَّبِيَّ وَمَعَهُ الرَّجُلُ وَالرَّجُلَانِ وَالنَّبِيَّ لَيْسَ مَعَهُ أَحَدٌ إِذْ رُفِعَ لِي سَوَادٌ عَظِيمٌ فَظَنَنْتُ أَنَّهُمْ أُمَّتِي فَقِيلَ لِي هَذَا مُوسَى ﷺ وَقَوْمُهُ وَلَكِنْ انْظُرْ إِلَى الْأُفُقِ فَنَظَرْتُ فَإِذَا سَوَادٌ عَظِيمٌ فَقِيلَ لِي انْظُرْ إِلَى الْأُفُقِ الْآخَرِ فَإِذَا سَوَادٌ عَظِيمٌ فَقِيلَ لِي هَذِهِ أُمَّتُكَ وَمَعَهُمْ سَبْعُونَ أَلْفًا يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ بِغَيْرِ حِسَابٍ وَلَا عَذَابٍ ثُمَّ نَهَضَ فَدَخَلَ مَنْزِلَهُ فَخَاضَ النَّاسُ فِي أُولَئِكَ الَّذِينَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ بِغَيْرِ حِسَابٍ وَلَا عَذَابٍ فَقَالَ بَعْضُهُمْ فَلَعَلَّهُمْ الَّذِينَ صَحِبُوا رَسُولَ اللَّهِ ﷺ وَقَالَ بَعْضُهُمْ فَلَعَلَّهُمْ الَّذِينَ وُلِدُوا فِي الْإِسْلَامِ وَلَمْ يُشْرِكُوا بِاللَّهِ وَذَكَرُوا أَشْيَاءَ فَخَرَجَ عَلَيْهِمْ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ فَقَالَ مَا الَّذِي تَخُوضُونَ فِيهِ فَأَخْبَرُوهُ فَقَالَ هُمْ الَّذِينَ وَلَا يَسْتَرْقُونَ وَلَا يَتَطَيَّرُونَ ولا يكتوون وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ فَقَامَ عُكَّاشَةُ بْنُ مِحْصَنٍ فَقَالَ ادْعُ اللَّهَ أَنْ يَجْعَلَنِي مِنْهُمْ فَقَالَ أَنْتَ مِنْهُمْ ثُمَّ قَامَ رَجُلٌ آخَرُ فَقَالَ ادْعُ اللَّهَ أَنْ يَجْعَلَنِي مِنْهُمْ فَقَالَ سَبَقَكَ بِهَا عُكَّاشَةُ
ইবনু আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,, স্বপ্নে আমার সামনে সকল উম্মতকে উপস্থিত করা হয়, তখন কোন কোন নবীকে দেখলাম যে, তাঁর সঙ্গে ছোট্ট একটি দল রয়েছে; আর কাউকে দেখলাম, তাঁর সঙ্গে একজন কিংবা দু’জন লোক; আবার কেউ এমনও ছিলেন যে, তাঁর সাথে কেউ নেই। হঠাৎ আমার সামনে এক বিরাট দল দেখা গেল। মনে হল, এরা আমার উম্মত। তখন আমাকে বলা হল, ইনি . মূসা আ. ও তাঁর উম্মত; তবে আপনি উপর দিগন্তে তাকিয়ে দেখুন। আমি ওদিকে তাকালাম, দেখি বিরাট এক দল। আবার বলা হল, আপনি উপর দিগন্তে তাকিয়ে দেখুন, (আমি ওদিকে তাকালাম) এক বিরাট দল।
বলা হলো, এরা আপনার উম্মত। এদের মধ্যে সত্তর হাজার এমন লোক আছে যারা শাস্তি ব্যতীত হিসাব ছাড়াই জান্নাতে প্রবেশ করবে। এই বলে রাসুলুল্লাহ ﷺ তাঁর ঘরে চলে গেলেন। আর উপস্থিত সাহাবীগণ তখন এই হিসাব ও আযাববিহীন জান্নাতে প্রবেশকারী কারা হবেন–এই নিয়ে বিতর্ক শুরু করলেন। কেউ বললেন, তাঁরা রাসুলুল্লাহ ﷺ–এর সাহাবী। কেউ বললেন, তাঁরা সেসব লোক যারা ইসলামের উপর জন্মলাভ করেছে এবং আল্লাহর সঙ্গে কোন প্রকার শিরক করে নি। এসব বিতর্ক শুনে রাসুলুল্লাহ ﷺ বেরিয়ে এলেন এবং বললেন, তোমরা কী নিয়ে বিতর্ক করছ? সবাই বিষয়টি খুলে বললেন।
তখন রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন, এরা সেই সব লোক, যারা (নাজায়েয) ঝাঁড়-ফুক করে না বা তা গ্রহণও করে না, অশুভ লক্ষণ মানে না বরং সর্বদাই আল্লাহর উপর নির্ভর করে। তখন উককাশা ইবনু মিহসান (রাঃ) দাঁড়িয়ে বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার জন্য দুআ করুন, আল্লাহ যেন আমাকে তাঁদের অন্তভুক্ত করে নেন। রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেন, তুমি তাদেরই একজন থাকবে। তারপর আরেক ব্যাক্তি দাঁড়িয়ে বলল, আমার জন্যও দোয়া করুন, আল্লাহ যেন আমাকেও তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। রাসুলুল্লাহ ﷺ উত্তর দিলেন, এই সুযোগ লাভে উককাশা তোমার চেয়ে অগ্রগামী হয়ে গেছে।
আল্লাহ আমাদেরকে জীবনের সর্বাংশে তাওহিদ বাস্তবায়ন করার তাওফিক দান করুন। আমীন।

والله اعلم بالصواب

উত্তর দিয়েছেনঃ শাইখ উমায়ের কোব্বাদী
সিনিয়র মুহাদ্দিস, মাদরাসা দারুর রাশাদ, মিরপুর
খতীব, বাইতুল ফালাহ জামে মসজিদ, মিরপুর

মন্তব্য ()

কোনো মন্তব্য নেই।

এ সম্পর্কিত আরও জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

২৪০৭১

কাদের কারণে আল্লাহ পৃথিবী ধ্বংস করেন না?


৩১ অক্টোবর, ২০২২

WW৫V+W২৩

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ শাইখ উমায়ের কোব্বাদী

৯০৬৭৫

আমরা কেন ফিরক্বায়ে আহলে হাদীসের বিরোধীতা করি?


৪ মার্চ, ২০২৫

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী শাহাদাত হুসাইন ফরায়েজী

২১০০৬

নামাজ না পড়লে কি সন্তানকে মিরাস থেকে বঞ্চিত করা যাবে?


১৮ অক্টোবর, ২০২৩

Debidwar

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ মুফতী সিরাজুল ইসলাম

২৫৩৭৩

আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম কী সৃষ্টি করেন?


২২ নভেম্বর, ২০২২

ঢাকা

question and answer icon

উত্তর দিয়েছেনঃ শাইখ উমায়ের কোব্বাদী

Logoমুসলিম বাংলা
play storeapp store
TopOfStack Software © 2025 All rights reserved. Privacy Policy