আপনার জিজ্ঞাসা/প্রশ্ন-উত্তর

সকল মাসায়েল একত্রে দেখুন

কাতার সোজা করানো কার দায়িত্ব? ইমামের না মুয়াজ্জিনের?

প্রশ্নঃ ১৮৫০৭. আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ, কোন মুয়াজ্জিন জামাতে দাঁড়ানোর জন্য 'ইনশাআল্লাহ কাতার সোজা করুন' একথা বলে ইকামাত শুরু করতে পারবে কিনা? এভাবে যদি কেউ বলে তাহলে এটা কি ভুলের অন্তর্ভুক্ত হবে? মুয়াজ্জিনের জন্য কিভাবে নামাজের কাতার সোজা করার কথা ঘোষণা দেওয়া উচিত? এগুলোর উত্তর জানাবেন ইনশাআল্লাহ।

৩০ জুলাই, ২০২৫
ঢাকা ১২১২

উত্তর

و علَيْــــــــــــــــــــكُم السلام ورحمة الله وبركاته

بسم الله الرحمن الرحيم


এভাবে বললেও কোনো অসুবিধা নাই। কাতার সোজা করানো মূলত ইমামের দায়িত্ব মুয়াজ্জিনের নয়। রাসুলুল্লাহ সা. গুরুত্বের সাথে মুসল্লিদের কাতার সোজা করাতেন।

حَدَّثَنَا قُتَيْبَةُ، حَدَّثَنَا أَبُو عَوَانَةَ، عَنْ سِمَاكِ بْنِ حَرْبٍ، عَنِ النُّعْمَانِ بْنِ بَشِيرٍ، قَالَ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يُسَوِّي صُفُوفَنَا فَخَرَجَ يَوْمًا فَرَأَى رَجُلاً خَارِجًا صَدْرُهُ عَنِ الْقَوْمِ فَقَالَ " لَتُسَوُّنَّ صُفُوفَكُمْ أَوْ لَيُخَالِفَنَّ اللَّهُ بَيْنَ وُجُوهِكُمْ " . قَالَ وَفِي الْبَابِ عَنْ جَابِرِ بْنِ سَمُرَةَ وَالْبَرَاءِ وَجَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ وَأَنَسٍ وَأَبِي هُرَيْرَةَ وَعَائِشَةَ . قَالَ أَبُو عِيسَى حَدِيثُ النُّعْمَانِ بْنِ بَشِيرٍ حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ . وَقَدْ رُوِيَ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم أَنَّهُ قَالَ " مِنْ تَمَامِ الصَّلاَةِ إِقَامَةُ الصَّفِّ " . وَرُوِيَ عَنْ عُمَرَ أَنَّهُ كَانَ يُوَكِّلُ رِجَالاً بِإِقَامَةِ الصُّفُوفِ فَلاَ يُكَبِّرُ حَتَّى يُخْبَرَ أَنَّ الصُّفُوفَ قَدِ اسْتَوَتْ . وَرُوِيَ عَنْ عَلِيٍّ وَعُثْمَانَ أَنَّهُمَا كَانَا يَتَعَاهَدَانِ ذَلِكَ وَيَقُولاَنِ اسْتَوُوا . وَكَانَ عَلِيٌّ يَقُولُ تَقَدَّمْ يَا فُلاَنُ تَأَخَّرْ يَا فُلاَنُ .

২২৭. কুতায়বা (রাহঃ) .... নুমান ইবনে বাশীর (রাযিঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন রাসূল (ﷺ) আমাদের কাতার সোজা করে দিতেন। একদিন তিনি বেরিয়ে দেখলেন জনৈক ব্যক্তি জামাআতের কাতার থেকে বুক বের করে দাড়িয়ে আছে। তখন বললেন তোমরা অবশ্যই তোমাদের কাতার সোজা রাখবে নইলে আল্লাহ তোমাদের চেহারা পাল্টে দিবেন।

আল জামিউল কাবীর- ইমাম তিরমিযী রহঃ (জামে' তিরমিযী)
হাদীস নং: ২২৭ আন্তর্জাতিক নং: ২২৭

হাদীসের ব্যাখ্যাঃ
এ হাদীছে নামাযে কাতার সোজা করার প্রতি জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে এবং কাতার সোজা না করার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তোমরা যদি নামাযে কাতার সোজা না কর তবে আল্লাহ তা'আলা তোমাদের চেহারাগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বিরোধ সৃষ্টি করে দেবেন।
চেহারার মধ্যে পারস্পরিক বিরোধ ও বৈপরিত্য সৃষ্টি দ্বারা কী বোঝানো উদ্দেশ্য— সে সম্পর্কে 'উলামায়ে কিরাম বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। একদল 'উলামার মতে বাস্তব আকার-আকৃতিগত পরিবর্তন বোঝানো উদ্দেশ্য। সে হিসেবে কেউ বলেন, এর অর্থ চেহারাকে তার আপন স্থান থেকে ঘুরিয়ে পেছনমুখী করে দেওয়া। এরূপ এক সতর্কবাণী কুরআন মাজীদের এক আয়াতেও উচ্চারিত হয়েছে। তাতে আহলে কিতাবকে শেষ নবীর প্রতি নাযিলকৃত কিতাবে ঈমান আনার আদেশ দিয়ে বলা হয়েছেঃ- يَاأَيُّهَا الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ آمِنُوا بِمَا نَزَّلْنَا مُصَدِّقًا لِمَا مَعَكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ نَطْمِسَ وُجُوهًا فَنَرُدَّهَا عَلَى أَدْبَارِهَا অর্থ : হে কিতাবীগণ! তোমাদের কাছে যে কিতাব (পূর্ব থেকে) আছে তার সমর্থকরূপে (এবার) আমি যা (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি, তোমরা তাতে ঈমান আন, এর আগে যে, আমি কতক চেহারাকে মিটিয়ে দিয়ে সেগুলোকে তার পেছন দিকে ঘুরিয়ে দেব।
কেউ বলেন, এর অর্থ চেহারা বিকৃত করে দেওয়া অর্থাৎ মানুষের চেহারার পরিবর্তে অন্য কোনও প্রাণীর চেহারায় পরিণত করে দেওয়া। যেমন বনী ইসরাঈলের একদল অপরাধীকে এরকম শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। তাদেরকে মানব আকৃতি পরিবর্তন করে শূকর ও বানরের আকৃতিতে পরিণত করা হয়েছিল।
অপর একদল 'উলামার মতে এর দ্বারা মনের অমিল, শত্রুতা ও পারস্পরিক বিদ্বেষ বোঝানো উদ্দেশ্য। যেমন বলা হয়ে থাকেঃ- تغير وجه فلان 'অমুকের চেহারা পরিবর্তন হয়ে গেছে।'
অর্থাৎ তার চেহারায় মনের অসন্তোষ প্রকাশ পেয়েছে। মানে তার মনের অবস্থা আগের মত নেই।
এভাবে চেহারা পরিবর্তন দ্বারা মানসিক অবস্থার পরিবর্তন বোঝানো হয়ে থাকে। তো নামাযের কাতারে অমিল হওয়াটা যদিও একটা প্রকাশ্য অমিল, কিন্তু এ প্রকাশ্য অমিল মনের বিরোধ ও আত্মিক অমিল সৃষ্টির একটি বড় কারণ।এই ব্যাখ্যার সমর্থন পাওয়া যায় আবূ দাউদ শরীফের একটি বর্ণনা দ্বারা। তাতে আছেঃ- أو ليخالفن الله بين قلوبكم “তোমরা কাতার সোজা না করলে আল্লাহ তা'আলা তোমাদের অন্তরের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করে দেবেন।'
মোটকথা, وجه (চেহারা) শব্দটিকে যদি বিশেষ অঙ্গের অর্থে ধরা হয়, তবে এর পরিবর্তন দ্বারা চেহারাকে পেছন দিকে নিয়ে যাওয়া অথবা মানব আকৃতি পরিবর্তন করে দেওয়া বোঝানো হবে। আর যদি এর অর্থ করা হয় 'ব্যক্তিসত্তা', তবে এর পরিবর্তন দ্বারা পারস্পরিক ঐক্য ও সম্প্রীতির পরিবর্তন তথা নিজেদের মধ্যে কলহ-বিবেদ সৃষ্টি হয়ে যাওয়া বোঝানো হবে।
নামায ঈমানের পর সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ আমল, যা কায়েম করার মধ্যে গোটা দীন কায়েম করার রহস্য নিহিত। জামাতবদ্ধ নামায যেমন মু'মিনদের বাহ্যিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে, তেমনি জামাতের যাবতীয় আহকাম ও আদব রক্ষার দ্বারা তাদের আত্মিক ঐক্য ও সম্প্রীতিও প্রতিষ্ঠা হয়। কাতার সোজা করা—জামাতে নামায আদায়ের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এটা ঠিকঠাকভাবে আদায় না করা হলে বাহ্যিক অনৈক্য সাধিত হয় এবং সে অনৈক্যের পরিণামে মনের মধ্যেও অমিল দেখা দেয়। মু'মিনদের পারস্পরিক অমিল ও অসদ্ভাব তাদের জাতীয় বিপর্যয়ের এক অন্যতম প্রধান কারণ। তা থেকে রক্ষার জন্য। অনৈক্যের প্রতিটি কারণ সম্পর্কে সতর্ক থাকা ও তা থেকে বেঁচে থাকা অতি জরুরি। নামাযে কাতার সোজা না করাও যেহেতু সেরকম এক কারণ, তাই এ হাদীছে কাতার সোজা করার জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে এবং তা না করলে যে পরিণামে চেহারার অমিল তথা আত্মিক অমিল ও অসদ্ভাব দেখা দিতে পারে, সে সম্পর্কে সাবধান করে দেওয়া হয়েছে।
মুসলিম শরীফের বর্ণনায় নবী সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক কাতার সোজ করার তদারকিকে তিরের কাঠি সোজা করার সাথে তুলনা করা হয়েছে। এর দ্বারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তিনি নামাযে কাতার সোজা করার বিষয়টিকে কত গুরুত্ব দিতেন। এর দ্বারা এটাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ইমামের কর্তব্য নিজ তদারকিতে মুসল্লীদের কাতার সোজা করানো। কেবল কাতার সোজা করার নির্দেশ দিয়েই ক্ষান্ত হওয়া উচিত নয়। আজকাল এ ব্যাপারে ব্যাপক অবহেলা লক্ষ করা যাচ্ছে।
এর দ্বারা আরও বোঝা যায় কাতার সোজা করার কাজটি আন্তরিক প্রযত্নের সাথেই সম্পন্ন হওয়া উচিত। সেভাবে সম্পন্ন করা হলেই এর কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া সম্ভব। অর্থাৎ তখনই এটা মুসল্লীবৃন্দের মধ্যে সদ্ভাব ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবে। ইদানীং আমরা এ কাজটিকে একটি অটোমেটিক (স্বয়ংক্রিয়) আমলে পরিণত করে ফেলেছি। মসজিদে কাতারের রেখা টানা থাকে, সেই রেখা বরাবর পা রাখা হয়, ব্যস কাতার সোজা হয়ে যায়। কাতার সোজা করা যে নামাযের একটি অবশ্যকরণীয় কাজ, সে কথা মাথায় রেখে এর প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া হয় না। রেখা টানা থাকলেও কাতার সোজা করার নিয়তে ও সুন্নতের অনুসরণার্থে মনোযোগ সহকারে সে বরাবর পা রাখা চাই এবং বিনয়-নম্রতার সঙ্গে দু'পাশের মুসল্লীদের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়া চাই।


হাদীস থেকে শিক্ষণীয়ঃ

ক. এ হাদীছ দ্বারা নামাযের কাতার সোজা করার গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। সুতরাং আমরা নামাযে কাতার সোজা করার ব্যাপারে বিশেষভাবে যত্নবান থাকব।

খ. আরও জানা যায় নামাযে কাতার সোজা না করা পারস্পরিক বিরোধ ও অনৈক্যের একটি বড় কারণ।

গ. ইমামের উচিত নিজ তদারকিতে নামাযের কাতার সোজা করানো।

والله اعلم بالصواب

সাইদুজ্জামান কাসেমি বাইতুল কুরআন মাদারাসা, মোহাম্মাদপুর, ঢাকা।
প্রসঙ্গসমূহ:

মন্তব্য (0)

কোনো মন্তব্য নেই। প্রথম মন্তব্য করুন!

মন্তব্য করতে লগইন করুন