প্রবন্ধ

পাশ্চাত্যের দৃষ্টিতে মানবাধিকার

লেখক:ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন
১৯ জানুয়ারী, ২০২২
৩২৩৭ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

পশ্চিমা বিশ্বের নেতারা মানবাধিকার নিয়ে সোচ্চার। তারা নিজেদেরকে মানবাধিকারের প্রবক্তা মনে করে গোটা দুনিয়াকে মানুষের অধিকারের সবক দেন। ইতিহাস প্রমাণ করে, দেশে দেশে তারাই সবচেয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী। পশ্চিমা দেশগুলোতে মানবাধিকারের ধারণাটি সাম্প্রতিক বলে মনে করা হয়। সতেরো শতকের আগে মানবাধিকার এবং নাগরিক অধিকার সম্পর্কে পশ্চিমাদের কোনো ধারণা ছিল না। ১৭ শতকে পশ্চিমের সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক চেতনা কিছুটা গতি লাভ করে এবং তারা তখনকার স্বৈরাচারী ও সর্বগ্রাসী নিয়মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। সাধারণ মানুষ, শাসকশ্রেণী, গণতন্ত্রী ও অভিজাতদের মধ্যে একটা টানাপড়েন চলছিল। কঠোর সংগ্রামের পর গণতান্ত্রিক শক্তি শাসকশ্রেণীর কাছ থেকে কিছু প্রাথমিক অধিকার আদায়ে সফল হয়। সময়ের সাথে সাথে এ ধরনের অধিকারের সংখ্যা বাড়তে থাকে। কিন্তু এটি আশ্চর্যের বিষয় যে, ১৭ শতকের পরে, দর্শন ও আইনশাস্ত্র সম্পর্কে চিন্তাবিদরা তাদের ধারণাগুলো উপস্থাপন করেন। এসব ধারণার বাস্তব প্রমাণ এবং প্রদর্শন শুধু ১৮ শতকের শেষের দিকে ফ্রান্সের ঘোষণা এবং সংবিধানে পাওয়া যায়। ১৯৮৯ সালে ফরাসি জাতীয় পরিষদ সব পুরুষের সমান অধিকার প্রদান করে ‘মানুষের অধিকার’ ঘোষণা করে। এর পর অনেক দেশই তাদের নিজ নিজ সংবিধানে মৌলিক মানবাধিকারের ধারাগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। প্রায়ই কাগজে-কলমে যেসব অধিকার দেয়া হয়েছিল, তা বাস্তব জীবনে মানুষকে দেয়া হয়নি।


অবশেষে ১০ ডিসেম্বর ১৯৪৮ সালে জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা প্রদান করে। মানুষের অধিকারের প্রতি বিশ্বাস নিশ্চিত করে ৩০টি ধারা নিয়ে এ ঘোষণা তৈরি করা হয়। এটিকে আইনত বাধ্যতামূলক প্রয়োগ করার জন্য ১৯৬৬ সালে নাগরিক অধিকারের ঐচ্ছিক প্রোটোকলসহ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের জন্য দু’টি চুক্তি তৈরি করা হয়। উভয় চুক্তিতেই আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে প্রথম ধারায় সন্নিবেশিত করা হয়। সর্বপ্রকার জাতিগত বৈষম্য দূরীকরণের ঘোষণাটি এর আগে করা হয়েছিল। জাতিসঙ্ঘ ১৯৬০ সালে ঔপনিবেশিক দেশ ও জনগণকে স্বাধীনতা দেয়ার ঘোষণা দেয়। ঘোষণার ৭ অনুচ্ছেদে বলা হয় যে, ‘সব রাষ্ট্র বিশ্বস্ত ও কঠোরভাবে জাতিসঙ্ঘ ঘোষিত মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা এবং বর্তমান ঘোষণার বিধানগুলো পালন করবে।’


গত ৭৩ বছরে মানবাধিকার ঘোষণা বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র কদাচিৎ বাস্তবায়িত করেছে, যদিও তারা ঘোষণা, চুক্তি এবং রেজ্যুলেশন অনুমোদন করেছে। জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ এসব অধিকারকে কার্যকর করার জন্য সদস্য দেশগুলোকে বাধ্য করতে পারেনি এবং কার্যকর করতে ব্যর্থ দেশগুলোর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে সক্ষম হয়নি। জাতিসঙ্ঘের সব ডিক্লারেশন ও সোচ্চার প্রস্তাব সত্ত্বেও সারা বিশ্বে মানবাধিকার নির্বিচারে লঙ্ঘন করা এবং পদদলিত হয়েছে। আরাকান, দক্ষিণ ফিলিপাইন (মিন্দানাও), কাশ্মির, লেবানন, ফিলিস্তিন, ইরাক, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা ও কসোভোর নিরীহ জনগণকে হত্যা, গুম, খুন ও ধর্ষণ এবং তাদের ওপর রাষ্ট্রীয় সহিংসতা বন্ধে জাতিসঙ্ঘের নিছক প্রস্তাব, পরামর্শ ও সুপারিশ কোনো ইতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারেনি। বর্তমান বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করে, জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ন্ত্রণে তার প্রভাব প্রয়োগ এবং প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করার অবস্থানে নেই। কার্যত জাতিসঙ্ঘ এক অসহায় দর্শক ও নীরব পর্যবেক্ষক হয়ে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইহুদি-খ্রিষ্ট লবির স্বার্থে।


সাম্প্রতিক ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো এ সত্যের সাক্ষ্য দেয় যে, জাতিসঙ্ঘ সম্ভবত মার্কিন কৌশলগত স্বার্থ হাসিলে একটি প্রচ্ছন্ন ভূমিকা পালন করতে পছন্দ করেছে বা নীরব দর্শক থেকেছে। অমানবিক নিবর্তন, গণহত্যা, নৃশংসতা ও জাতিগত নির্মূল অভিযানের বিষয়ে কিছু মৃদু বিবৃতি দেয়া ছাড়া জাতিসঙ্ঘ কিছুই করেনি। কাশ্মিরের অধিকারকামী জনগণের প্রতি ভারতের রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের নিপীড়ন, ফিলিস্তিনিদের নির্বাসনে ইহুদি আগ্রাসন, সার্বিয়ান কসাইয়ের হাতে বসনিয়া-হার্জেগোভিনার জনগণের হত্যাযজ্ঞ, তামিল জঙ্গিদের গুলির মুখে শ্রীলঙ্কার মুসলমানদের বাস্তুচ্যুতি, নাগরনো-কারাবাখ ছিটমহলের বন্দী বাসিন্দাদের প্রতি খ্রিষ্টান আর্মেনীয়দের ভয়ঙ্কর আচরণ, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা কর্তৃক আরাকানের রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পুশইন, তুর্কি সাইপ্রাসের দুর্ভাগা জনগণের দুর্ভোগ নিরসন, সিরিয়া এবং আফ্রিকার সিয়েরা লিওন, গিনি, আইভরিকোস্ট ও ঘানার লাইবেরিয়ান মুসলিম উদ্বাস্তুদের সমস্যাগুলোর প্রতি জাতিসঙ্ঘ উদাসীন ছিল।


উল্লিখিত লোমহর্ষক ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, জাতিসঙ্ঘের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব সীমিত। এমনকি ইসরাইল, ভারত, আর্মেনিয়া ও সার্বিয়ার জঘন্য অপরাধের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ অনুভব করেনি এই বিশ্ব সংস্থা। মানবাধিকার বিষয়ক ঘোষণা বাস্তবায়িত না হওয়ায় জাতিসঙ্ঘের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া ভেটো ক্ষমতার অধিকারী পাঁচটি দেশ নিরাপত্তা পরিষদের সহায়তায় মানবাধিকার নিয়ে বৈশি^ক রাজনীতিতে ‘ডাবল স্ট্যান্ডার্ড’ বজায় রাখছে। এ কারণেই জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার ঘোষণার ৩০তম বার্ষিকীতে জাতিসঙ্ঘের তৎকালীন মহাসচিব পেরেজ ডি কুয়েলার দুঃখের সাথে মন্তব্য করেন, ‘আমরা এখনো আমাদের লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে। বিশ্বের অনেক জায়গায়, মানুষ এখনো বেঁচে থাকার মৌলিক উপায় থেকে বঞ্চিত। তাদের শারীরিক, মানসিক অখণ্ড মনোযোগের ওপর এখনো আক্রমণ করা হয়। জাতিগত বৈষম্যের বিভিন্ন রূপ, নির্যাতনের চর্চা, বিনাবিচারে আটক, সংক্ষিপ্ত মৃত্যুদণ্ড এগুলোর কিছুই এখনো বিশ্বসমাজে একটি অপরিচিত ঘটনা হয়ে ওঠেনি।’


প্রতি বছর ১০ ডিসেম্বর ‘জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার দিবস’ পালন আনুষ্ঠানিকতায় রূপ নিয়েছে। অথচ জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার চুক্তিগুলো ১৯৬৩ সালে জাতিগত বৈষম্যের ঘৃণ্য অনুশীলনকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। ১৯৬৮ সালের তেহরান সম্মেলন এবং ১৯৫৬ সালের অক্টোবরের ২১৪২ রেজ্যুলেশনের মাধ্যমে সাধারণ পরিষদ এটিকে অবৈধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু এ ঘোষণা, চুক্তি ও রেজ্যুলেশন মূল্যহীন হয়ে পড়েছে; কারণ বর্ণবৈষম্যের বিভিন্ন রূপ এবং বর্ণবৈষম্যের অনুশীলন সমসাময়িক আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে অবিচ্ছিন্নভাবে চলছে। ইরিত্রিয়া ও নামিবিয়াসহ অনেক দেশে এ ঘোষণা প্রতিপালিত হচ্ছে না। সংখ্যাগুরু কালো মানুষের ওপর সাদা সংখ্যালঘুদের শাসন এখনো বহাল আছে। জাতিসঙ্ঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো এসব ঘোষণাকে পুরোপুরি ও বিশ্বস্তভাবে পালন করেনি। ১৯৯২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেসে জাতিগত সহিংসতায় ৫০ জন কালো চামড়ার মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়া হয় এবং এক বিলিয়ন ডলারেরও বেশি মূল্যের সম্পত্তি ধ্বংস করে দেয়া হয়। মার্কিন সরকার বিশ্বজুড়ে মানবাধিকারের চ্যাম্পিয়নের ভূমিকা পালন করলেও বর্তমানে তারা নিরপরাধ বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে যেভাবে অস্ত্র ব্যবহার করছে সেটি রীতিমতো উদ্বেগজনক।


উপর্যুক্ত পর্যবেক্ষণগুলো কৃষ্ণাঙ্গ সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব ও জয়েন্ট চিফ অব স্টাফের সাবেক চেয়ারম্যান কলিন এল পাওয়েল বক্তব্যে ফুটে উঠেছে। ব্ল্যাক ফিশ ইউনিভার্সিটিতে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদ বিস্তৃতি লাভ করছে। লস অ্যাঞ্জেলেসের দাঙ্গা কৃষ্ণাঙ্গদের হতাশ করেছে যারা উন্নত আমেরিকার স্বপ্ন দেখে। সহিংসতার সেই দৃশ্যগুলো আমাদের স্পষ্টভাবে বলে যে, আমাদের স্বপ্নগুলো বাস্তবে পরিণত করতে আমাদের অনেক দূর যেতে হবে।’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অনেক উন্নত দেশে, শ্বেতাঙ্গদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত প্রশাসনের অধীনে বর্ণবৈষম্য এবং কালো মানুষদের কোণঠাসা করে রাখার একটি ভিন্ন রূপ স্পষ্ট। সুবিধাবঞ্চিত কালো সম্প্রদায়ের গৃহহীনতা, বেকারত্ব, চিকিৎসাসেবা ও শিক্ষার সমস্যাগুলো প্রশমিত করার জন্য শুধু ঘোষণা, কোনো আশাব্যঞ্জক ও উৎসাহজনক ফলাফল দেয় না। সব নাগরিক অধিকার প্রদান এবং কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য আরো ভালো চুক্তি নিশ্চিত করার জন্য আইন পাস করা সত্ত্বেও, সম্প্রদায়টি ‘সামাজিক মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন’ রয়ে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখনো রাস্তাঘাটে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্তৃক কৃষ্ণাঙ্গদের নির্মম নিপীড়ন ও পা দিয়ে চেপে শ্বাসরুদ্ধ করে মেরে ফেলার দৃশ্য নতুন নয়।

১৯৪৮ সালে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র গৃহীত হওয়ার পর থেকে শুধু আফ্রিকাতেই ১৭টি গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং ইউরোপ ও এশিয়ায় নিরবচ্ছিন্নভাবে হত্যা চলছে। এ সময়ে বিশ্বব্যাপী প্রায় এক বিলিয়ন মানুষ মৌলিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত এবং ২০০ মিলিয়ন শিশু কাজ করতে বাধ্য হয়। এটি মানবতার জন্য একটি ট্র্যাজেডি এবং মানবাধিকার অব্যাহতভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার প্রমাণ। এগুলো ছাড়াও সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে এক বছরে প্রায় দুই হাজার নারী নির্যাতনের শিকার হন এবং সাত লাখ নারীর সতীত্ব জোরপূর্বক হরণ করা হয়। তাদের মধ্যে ৬১ শতাংশ ১৮ বছরের কম বয়সী, যখন ১১ শতাংশ ১১ বছরের কম। এই পরিসংখ্যানটি আমেরিকান মুক্ত সমাজের একটি ভয়ঙ্কর চিত্র অথচ দেশটি বিশ্বের নারীবাদী আন্দোলনের সবচেয়ে উন্নত ও শক্তিশালী ফোয়ারা হিসেবে পরিচিত।


আমরা সতর্কতার সাথে একটি মন্তব্য করতে পারি, ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ সা: প্রায় ১৫ শতাব্দী আগে আরাফাত উপত্যকায় তাঁর বিদায় ভাষণে ধর্ম-বর্ণ ও ভাষার এ ভেদের অবসান ঘটিয়ে সমগ্র মানবতার কাছে উচ্চারিত মৌলিক মানবাধিকারগুলো আরো অনেক বেশি জোরালো ও বাস্তবধর্মী। আজ অবধি জাতিসঙ্ঘ বা বিশ্বের অন্য যেকোনো সংস্থার চেয়ে মহানবী সা:-এর ঘোষণা অনেক ব্যাপক এবং কার্যত অনেক বেশি সাফল্যের সাথে বাস্তবায়িত হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংবিধানে জীবন, সম্পত্তি এবং মর্যাদার অধিকারের আধুনিক ধারণা কেবল ডিক্লারেশনের মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং খুব কমই বাস্তবায়িত হয়েছে। আধুনিক যুগে মানবাধিকারের ধারণাটি বিশ্বাসের (ঈমান) ওপর ভিত্তি করে নয়, মানবতাবাদের ধর্মনিরপেক্ষ ধারণার ফলে তৈরি হয়েছে। ফলে কমবেশি এর লঙ্ঘন লক্ষ করা যায় এবং আন্তরিকতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। এ কারণেই পশ্চিমা বিশ্ব তাদের মানবাধিকারের তত্ত্ব ও অনুশীলনে ‘দ্বৈতনীতি’ বজায় রাখছে। এখানে মানবাধিকারের স্বীকৃতি আল্লাহ ও তাঁর সৃষ্টির প্রতি গভীর মমত্ববোধ ও সুদৃঢ় ঈমানের ভিত্তিতে গড়ে ওঠেনি। এই অধিকারের বাস্তবায়নকে তাকওয়া এবং পরকালের জন্য লাভ হিসেবে গণ্য করা হয়নি।


মহানবী সা: সতর্ক করে দিয়েছেন, সেই অধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে মানুষ কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে। ঈমান ও নেক আমলের সাথে যুক্ত এ ধারণাটি সেসব অধিকারের ধর্মনিরপেক্ষ ধারণার চেয়ে বেশি পবিত্র। এসব অধিকার পায়ের নিচে পদদলিত করা হয় এবং একটি পুঁজিবাদী সমাজে যেখানে সম্পদ বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণীর হাতে ন্যস্ত থাকে, সেসব অধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়। এ কারণে ধর্মনিরপেক্ষ পুঁঁজিবাদী সমাজে মৌলিক অধিকারগুলো বেশির ভাগই থাকে অরক্ষিত। তাই খোদাবিহীন মানবতাবাদ উচ্চস্বরে ঘোষণা দিয়েও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর ঘটনা সন্দেহাতীতভাবে এটি প্রমাণ করেছে। একুশ শতকের প্রাক্কালে সারা বিশ্বে একটি আধ্যাত্মিক পুনরুত্থান চলছে। এ প্রক্রিয়ায় ইসলামের আদর্শ এবং মহানবী সা:-এর মানবাধিকার ঘোষণা কার্যকর করার পথ খোলার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। তাই মানব সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে মানবজাতিকে মহানবী সা:-এর জীবনঘনিষ্ঠ সুন্নতের আশ্রয় নিতে হবে। এ ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।


মানবিক আদর্শের দীপ্তিতে আলোকিত একটি কল্যাণধর্মী সমাজ প্রতিষ্ঠা ছিল বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর নবী জীবনের অন্যতম লক্ষ্য। শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ, ধনী-নির্ধন, প্রভু-ভৃত্য, আমির-ফকিরের জাত্যাভিমানের ভেদাভেদ ঘুচিয়ে মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন তিনি। মানবজাতি দেহের মতো এক অখণ্ড সত্তা। দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে যেমন পৃথক করে দেখা যায় না, তেমনিভাবে সমাজে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকেও পরস্পরের চেয়ে খাটো করে দেখা যায় না। কর্মে, ব্যবসায় ও পদমর্যাদায় একজন অপরজন থেকে পৃথক হতে পারে কিন্তু মানুষ হিসেবে সবার মর্যাদা সমান। মানুষ একে অন্যের ভাই। সব মানুষ আল্লাহর বান্দা। সবার আদি পিতা আদম আ:। মহানবী সা: বলেন, ‘সব সৃষ্টি আল্লাহর পরিবারভুক্ত। আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় হচ্ছে ওই ব্যক্তি যে আল্লাহর অপরাপর সৃষ্টিকুলের প্রতি অনুগ্রহ করে।’ (মিশকাত, পৃ-৪২৫) রাসূলুল্লাহ সা: মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে আদর্শ সমাজ গড়ে তোলেন। বংশকৌলীন্য ও আভিজাত্যের গৌরবের পরিবর্তে মানবতার ভিত্তিতে সমাজ বন্ধন সুদৃঢ় করেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা দেন, ‘আরবের ওপর অনারবের, অনারবের ওপর আরবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সব মানুষ একে অপরের ভাই। সব মানুষ আদমের বংশধর আর আদম মাটি থেকে তৈরি।’ (আহমদ ইবনে হাম্বল, মুসনাদ, পঞ্চম খণ্ড, পৃ-৪১১, জাহিয, আল বায়ান ওয়াত তিবঈন, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ-৩৩)


১২১৫ সালের ম্যাগনা কার্টা, ১৬২৮ সালের পিটিশন অব রাইট, ১৬৭৯ সালের হেবিয়াস কর্পাস অ্যাক্ট, ১৬৮৯ সালের বিল অব রাইটস এবং ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসঙ্ঘ ঘোষিত সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার (টহরাবৎংধষ উবপষধৎধঃরড়হ ড়ভ ঐঁসধহ জরমযঃং) ১৫শ’ বছর আগে মানবতার ঝাণ্ডাবাহী মহানবী সা: সর্বপ্রথম মানুষের আর্থসামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অধিকার ঘোষণা করেছিলেন। পরস্পরবিরোধী ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে মহানবী সা: কর্তৃক সম্পাদিত ‘মদিনা সনদ’ সমগ্র মানবজাতি ও অখণ্ড মানবতার এক চূড়ান্ত উত্তরণ। তিনি কেবল ঘোষণা দিয়ে ক্ষান্ত হননি, ২৩ বছরের নবুয়তি জীবনে তা বাস্তবায়ন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →