প্রবন্ধ

সোশ্যাল মিডিয়া, নাস্তিক্যবাদ ও আমাদের করণীয়

লেখক:শাঈখুল ইসলাম মুফতি তাকী উসমানী
১৮ জানুয়ারী, ২০২২
২৮৬৪ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

মুসলিমের সন্তান তার মা-বাবার জন্য পার্থিব নিআমতই শুধু নয়; আখিরাতের সঞ্চয় ও শ্রেষ্ঠ সদকায়ে জারিয়াও বটে, যদি সে সন্তান হয় ঈমানদার।


সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে ঈমান-লুটেরার দল কীভাবে নীরবে আমাদের আগামী প্রজন্মকে অঃযরংস ও নাস্তিক্যবাদের দিকে ধাবিত করছে তার কিছু বৃত্তান্ত এই লেখায় উপস্থাপন করব। দৃশ্যত অধ্যয়ন ও এন্টারটেইনমেন্টের সদুদ্দেশ্যে যে মা-বাবা তাদের কচিকাঁচা সন্তানকে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহারের অবাধ  স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছেন বিশেষভাবে তাঁরা এই লেখাটা পড়–ন। আল্লাহ না করুন আপনার সন্তানও হয়ত এই ফিতনার শিকার হয়ে ঈমান হারানোর কাছাকাছি পৌঁছে গেছে অথচ  সে সম্পর্কে আপনার বিন্দু-বিসর্গও জানা নেই।


করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ ও পাকিস্তানের অন্যান্য শহরে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে নাস্তিক্যবাদ এখন খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। সাধারণত মুসলিম পরিবারের ১৫-২০ বছর বয়সের ছেলে-মেয়েরাই এতে আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। উদাহরণ এক-দুটি নয়, শত শত। উলামায়ে কেরাম দিন-রাত তা লক্ষ্য করছেন।


বিষয়টি এই যে, সোশ্যাল মিডিয়া, বিশেষত ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও টুইটারে এমন অসংখ্য একাউন্ট আছে, যেগুলোর কাজই হচ্ছে দিন-রাত বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে আল্লাহ্র অস্তিত্ব অস্বীকার করে যাওয়া, ইসলামের বিধি-বিধান নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা, আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আপত্তি তোলা এবং আলিম-উলামাদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের নিশানা বানানো।


এদের অধিকাংশই ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন এনজিওর সাথে যুক্ত এবং এদের টার্গেটই এটা। এগুলোর নামের ধরন সাধারণত এরকম হয়ে থাকে-


Ex-Muslims Together


Atheist Muslims


Muslims Liberated


Muslims Awakening


Islam Exposed


এদের কর্মী ও সহমত পোষণকারী হিসেবে রয়েছে শত শত ছেলে-মেয়ে, যারা ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত। এদের অধিকাংশই দ্বীন সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ ও পশ্চিমা শিক্ষা-ব্যবস্থার প্রোডাক্ট। এরা পাকিস্তান, বাংলাদেশ, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও অন্যান্য মুসলিম দেশের তরুণ-তরুণীদের দলে ভেড়ানোর কাজে ব্যস্ত। এরা দৃশ্যত মুসলিম-সংশ্লিষ্ট নামের একাউন্ট রাখলেও মতাদর্শগতভাবে নাস্তিক্যবাদী।


এদের আলোচনার ধরন অনেকটা এরকম...


প্রথম দিকে ইসলামের উপর প্রশ্ন তোলা হয় না; বরং কিছু কিছু ইসলামী বিধানকে সাইন্স ও লজিকের মানদণ্ডে পরীক্ষা করা হয়। এ পর্যায়ে পরিকল্পিতভাবে এমন কিছু দ্বীনী বিষয়ই নির্বাচন করা হয়, যা সাইন্স দ্বারাও প্রমাণিত। এই উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে এই মানসিকতা গঠন করা হয় যে, দ্বীনের সকল বিধান বিজ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আর বিজ্ঞান যা সমর্থন করে তা নিঃসন্দেহে সত্য।


এর পরের ধাপে আলোচনায় আনা হয় ঐসকল বিষয়, যা সাইন্সের আওতার ঊর্ধ্বে। যেমন আল্লাহ্র অস্তিত্ব ও গুণাবলি, অহী, মিরাজ ইত্যাদি, যা  একান্তই গায়েবের বিষয়। এগুলোও সন্দেহাতীতভাবে সত্য তবে সাইন্সের আওতা-বহির্ভূত। কিন্তু ইতিপূর্বে যেহেতু মানসিকতাটা এভাবেই তৈরি করা হয়েছে যে, সত্য-মিথ্যা নিরূপণের অব্যর্থ মাপকাঠি হচ্ছে সাইন্স, তাই এ ধাপে এসে এই মৌলিক আকীদাগুলো সম্পর্কে সংশয় দানা বাঁধতে থাকে। (দ্বীনের সঠিক জ্ঞান না থাকা আর সাইন্সের ব্যাপারে অতিউৎসাহের ফলে কোন্ বিষয়টি সাইন্সের আওতাভুক্ত আর কোন্টি তার আওতা-বহির্ভূত- তা উপলব্ধি করার ফুরসত থাকে না।)


এর পরের ধাপে আরো অগ্রসর হয়ে সরাসরি আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যক্তিগত জীবনের নির্দিষ্ট কিছু দিক আলোচনায় নিয়ে আসা হয়। এ পর্যায়ে এমন কিছু বিষয়কে বিকৃতভাবে তুলে ধরা হয়, যা দ্বীন সম্পর্কে অসচেতন ব্যক্তিদের সাধারণ জ্ঞান-বুদ্ধির উপরের। যেমন দাস-প্রথা, নারী-পুরুষে সমতা, আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একধিক বিয়ে ও দাসী, বিয়ের সময় আম্মাজান আয়েশা রা.-এর বয়স ইত্যাদি।


প্রজ্ঞাবান মুসলিমের কাছে এই বিষয়গুলো স্পষ্ট, কিন্তু কাঁচা বুদ্ধির আবেগপ্রবণ মুসলিম ছেলে-মেয়ের কাছে, যারা একে তো দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞ, অন্যদিকে পশ্চিমা চিন্তা-ধারা ও জীবন-ধারায় প্রভাবিত, এ বিষয়গুলো খুবই অস্বস্তিকর ও দুর্বোধ্য হয়ে দাঁড়ায়।


এদিকে দ্বীন ও উলামায়ে দ্বীনের সাথে মেলামেশা না থাকায় এসবের সঠিক স্বস্তিদায়ক উত্তর পাওয়ারও তাদের রাস্তা থাকে না। এরা তখন গুগল ও ইন্টারনেটের শরণাপন্ন হয়, যেখানে নাস্তিক্যবাদী ও ধর্ম-বিদ্বেষীদের পূর্ব প্রস্তুতকৃত বিভিন্ন ওয়েবসাইট তাদের সন্দেহ-সংশয়কে অটল বিশ্বাসে রূপান্তরিত করে। এরপর ঈমান খুব দ্রুত বিদায় নিয়ে যায়।


হজ্ব-কুরবানী থেকে শুরু করে বিয়েশাদী ও মীরাছের বিধি-বিধান পর্যন্ত ইসলামের প্রত্যেক বিধানকে পশ্চিমের সরবরাহকৃত মাপকাঠিতে পরীক্ষা করার পর অবশেষে একে মনগড়া ধর্ম আখ্যা দিয়ে নীরবে তার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করা হয়। (নাউযু বিল্লাহ)


প্রকাশ্যে ইসলামের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শানে গোস্তাখী ও আল্লাহ্র অস্তিত্বের অস্বীকারের পর্যায়টা এর পরে আসে। এরপর এই ছেলে-মেয়েগুলোই ঐসব সংগঠনের ক্রীড়নকে পরিণত হয়ে যায়। বন্ধু-বান্ধবকেও দ্বীন-ধর্ম সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ করতে থাকে।


এই গোটা বিষয়টা আমাদের আশেপাশেই ঘটছে। আমাদের পাশে বসেই ১৫-২৫ বয়সের তরুণ-তরুণীরা টুইটার, ফেসবুক ইত্যাদিতে এই কাজ করে চলেছে, কিন্তু আমরা একেবারেই বেখবর।


এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সন্তান-সন্ততিকে আমরা কীভাবে রক্ষা করতে পারি। এ প্রসঙ্গে নীচের বিষয়গুলো লক্ষ্য করুন :


-মাঝেমধ্যে আলেমদের কাছে ও বুযুর্গানে দ্বীনের মজলিসে নিজেও যান, সন্তানকেও নিয়ে যান। যেন তাদের সাথে স্বাভাবিক পরিচয় গড়ে ওঠে এবং বিভিন্ন বিষয়ে তাদের পরামর্শ গ্রহণ করতে পারে।


-সন্তান-সন্ততিকে কাছে টেনে নিন, ভালবাসুন। তাদের সমস্যাগুলো শুনুন ও পরামর্শ দিন। তাদের সাথে নিজের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পরামর্শ করুন এবং তাদেরকে নিজের চিন্তা-ভাবনার ধারক হিসেবে গড়ে তুলুন।


আপনি যদি তাদের দূরে ঠেলে রাখেন তাহলে বিপথগামী লোকেরা ওদের কাছে টেনে নেবে।


-ধীরে ধীরে নিজের ধর্ম সম্পর্কে জানুন এবং ঘরেও তা আলোচনা করুন।


-ছেলে-মেয়ে ছোট হলে তাদের জাগতিক শিক্ষার পাশাপাশি দ্বীনী শিক্ষা-দীক্ষারও ব্যবস্থা করুন।


-অতি প্রয়োজন ছাড়া বাচ্চাদের হাতে স্মার্টফোন দেয়া থেকে বিরত থাকুন নিজেও তা থেকে বিরত থাকুন।


-একান্ত দিতে হলে শর্তসাপেক্ষে দিন, অসময়ে এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করুন। রাতে সবার ফোন নিজের কক্ষে জমা রাখুন। এর সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন করুন।


-বিনা কারণে সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় কাটানো থেকে নিজেও বাঁচুন, ছেলে-মেয়েকেও বাঁচান।


-ছেলে-মেয়ের সামনে সবসময় ফোন ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।


-যে কোনো প্রশ্ন বা সংশয়ের জবাব পেতে ইন্টারনেটের সামনে না বসে বিজ্ঞ আলেমের শরণাপন্ন হোন।


ঈমানদারের সবচেয়ে বড় সাফল্য, ঈমানকে নিরাপদে কবরে নিয়ে যাওয়া। ছেলে-মেয়েকে ঈমান-লুটেরাদের কবল থেকে রক্ষা করুন। যেন আমাদের আগামী প্রজন্মের মাঝেও দ্বীন ও ঈমান বাকি থাকে।


আল্লাহ তাআলা হেফাযত করুন- আমীন।

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

টেষ্ট টিউবের মাধ্যমে প্রজনন এবং এতদসংশ্লিষ্ট শরয়ী বিধান

...

আল্লামা খালিদ সাইফুল্লাহ রহমানী দাঃ
১০ নভেম্বর, ২০২৪
২৩৩৬ বার দেখা হয়েছে

আড়াই মিনিট

...

মাওলানা হাবীবুর রহমান খান
৮ নভেম্বর, ২০২৪
২৩১০ বার দেখা হয়েছে

মুসলমানদের অধঃপতনের মূল কারণ

...

শাঈখুল ইসলাম মুফতি তাকী উসমানী
১০ নভেম্বর, ২০২৪
২৫২৬৯ বার দেখা হয়েছে

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →

মুফতী আবুল হাসান শামসাবাদী

শাইখুল ইসলাম আল্লামা যাহেদ কাউছারী রহঃ

মুফতী আব্দুল হান্নান হাবীব

মুফতী সালমান মানসুরপুরী

শাইখুল হাদীস আল্লামা আব্দুল কুদ্দুস দাঃ

আল্লামা আহমাদ মায়মূন

মাওলানা আতাউল্লাহ আব্দুল জলীল

আল্লামা রফী উসমানী রহঃ

মুফতী রশীদ আহমদ লুধিয়ানভী রহ.

মাওলানা নূর আলম খলীল আমিনী

হযরত মাওলানা আবদুল হাই পাহাড়পুরী রহঃ

হযরতজী মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভি রহঃ

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রহমান

মাওলানা মুহাম্মাদ ইমরান হুসাইন

মাওলানা শাহাদাত সাকিব

আল্লামা ইসহাক ওবায়দী রহঃ

মাওলানা ওমর পালনপুরী

মুফতী আবুল কাসেম নোমানী

হাকীমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানভী (রহ)

আল্লামা মানাযির আহসান গিলানী রহঃ