প্রবন্ধ
শিশুদের সাথে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। যে-ই তাঁর সংস্পর্শে গিয়েছে তাঁর আচরণে মুগ্ধ হয়েছে এবং তাঁর মহৎ চরিত্রের প্রশংসা করেছে। শিশুদের প্রতি ছিল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অকৃত্রিম স্নেহ ও ভালবাসা। শিশুদের সাথে তাঁর আচরণ ছিল উপভোগ্য ও অনুসরণীয়। আসুন, শিশুদের সাথে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেসব আখলাকের চমকপ্রদ কিছু দৃশ্য উপভোগ করি এবং নিজেদের জীবনে তা গ্রহণ করার চেষ্টা করি।
শিশুদের আদর-স্নেহ করা
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশুদের খুব আদর-স্নেহ করতেন। অন্যদেরকে তাদের প্রতি কোমল আচরণের নির্দেশ দিতেন। তাদের সাথে দয়া ও সহানুভূতির আচরণের উপদেশ দিতেন। যারা শিশুদের সাথে দয়ার আচরণ করে না তাদের ভর্ৎসনা করতেন। তিনি বলেছেন-
لَيْسَ مِنّا مَنْ لَمْ يَرْحَمْ صَغِيرَنَا، وَيَعْرِفْ حَقّ كَبِيرِنَا.
যে আমাদের ছোটদের প্রতি রহম করে না এবং আমাদের বড়দের অধিকারের প্রতি লক্ষ রাখে না, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯৪৩; জামে তিরমিযী, হাদীস ২০৩২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৬৭৩৩
আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, একদা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নাতি হাসান রা.-কে চুমু খেলেন। আকরা ইবনে হাবিস রা. পাশে বসা ছিলেন। তিনি বললেন, আমার দশটা সন্তান। একজনকেও আমি কখনো চুমু দিইনি। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিকে তাকিয়ে বললেন-
إِنّهُ مَنْ لَا يَرْحَمُ لَا يُرْحَمُ.
নিশ্চয় যে দয়া করে না তার প্রতিও দয়া করা হবে না। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৯৯৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৩১৮
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, জনৈক বেদুইন সাহাবী নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসেছে। (নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক শিশুকে চুমু দিলে) সে বলল-
يَا رَسُولَ اللهِ، أَتُقَبِّلُ الصِّبْيَانَ؟
হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি শিশুদের চুমু খান?
উত্তরে নবীজী বললেন, হাঁ।
সে বলল, আমরা তো শিশুদের চুমু দিই না।
একথা শুনে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
أَوَأَمْلِكُ لَكَ أَنْ نَزَعَ اللهُ مِنْ قَلْبِكَ الرّحْمَةَ؟
আল্লাহ তোমার দিল থেকে রহম ছিনিয়ে নিলে আমার কী করার আছে! -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৯৯৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৩১৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩৬৬৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৪২৯১
শিশুদের কোলে নেওয়া, চুমু খাওয়া
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশুদের খুব আদর করতেন। তাদের চুমু খেতেন, কোলে তুলে নিতেন। ইয়ালা ইবনে র্মুরা রা. বলেন-
إِنّهُمْ خَرَجُوا مَعَ النّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَى طَعَامٍ دُعُوا لَهُ، فَإِذَا حُسَيْنٌ يَلْعَبُ فِي السِّكّةِ، قَالَ: فَتَقَدّمَ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ أَمَامَ الْقَوْمِ، وَبَسَطَ يَدَيْهِ، فَجَعَلَ الْغُلَامُ يَفِرّ هَاهُنَا وَهَاهُنَا، وَيُضَاحِكُهُ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ حَتّى أَخَذَهُ، فَجَعَلَ إِحْدَى يَدَيْهِ تَحْتَ ذَقَنِهِ، وَالْأُخْرَى فِي فَأْسِ رَأْسِهِ ثُمّ أَقْنَعَ رَأْسَهُ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ فَوَضَعَ فَاهُ عَلَى فِيهِ فَقَبّلَهُ وَقَالَ: حُسَيْنٌ مِنِّي، وَأَنَا مِنْ حُسَيْنٍ، أَحَبّ اللهُ مَنْ أَحَبّ حُسَيْنًا، حُسَيْنٌ سِبْطٌ مِنَ الْأَسْبَاطِ.
কিছু সাহাবী নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে দাওয়াত খেতে বের হলেন। হঠাৎ দেখা গেল হুসাইন রাস্তায় খেলা করছে! নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবার সামনে এগিয়ে গেলেন এবং তাকে কোলে নেওয়ার জন্য উভয় হাত তার দিকে প্রসারিত করলেন। এ দেখে হুসাইন এদিক-সেদিক ছোটাছুটি আরম্ভ করল। তখন নবীজী তাকে (ধরার জন্য এটাসেটা বলে) হাসাচ্ছিলেন। অবশেষে তাকে ধরে ফেললেন। এরপর তিনি এক হাত তার থুতনির নিচে রাখলেন, আরেক হাত মাথার পিছনে রাখলেন। তারপর তার মাথাকে নিচু করে তার মুখে মুখ রেখে চুমু খেলেন এবং বললেন- হুসাইন আমা হতে, আমি হুসাইন হতে। (অর্থাৎ আমাকে যে ভালবাসে সে হুসাইনকেও ভালবাসবে; হুসাইনকে ভালবাসা মানে আমাকে ভালবাসা) যে হুসাইনকে মহব্বত করে আল্লাহ তাকে মহব্বক করুন। হুসাইন আমার (প্রধান) দৌহিত্র। (তার মাধ্যমেই আমার বংশের বড় অংশের বিস্তৃতি ঘটবে)। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৪৪; মুসান্্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ৩২৮৬০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৭৫৬১; আলআদাবুল মুফরাদ, বুখারী, হাদীস ৩৬৪; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৬৯৭১
স্নেহের পরশ বুলিয়ে দেওয়া
শিশুদের প্রতি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দয়া-মায়া ছিল অপরিসীম। শিশুদের তিনি আদর করতেন, স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিতেন। কখনো মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতেন। কখনো আবার চিবুক বা গণ্ডদ্বয় ধরে আদর করতেন।
জাফর রা. মূতার যুদ্ধে শহীদ হলে তার শোকাহত পরিবারের খোঁজ-খবর ও সান্ত¦নাদানের জন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জাফর রা.-এর বাড়িতে যান। তার পরিবারের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেন এবং তার সন্তানদের আদর করেন, স্নেহের পরশ বুলিয়ে দেন। জাফর রা.-এর ছেলে আব্দুল্লাহ রা. বড় হয়ে সে মধুর স্মৃতি বর্ণনা করেছেন এভাবে-
مَسَحَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ بِيَدِهِ عَلَى رَأْسِي قَالَ فَلَمّا مَسَحَ قَالَ: اللّهُمّ اخْلُفْ جَعْفَرًا فِي وَلَدِهِ.
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন এবং আমাদের জন্য দুআ করলেন-
اللّهُمّ اخْلُفْ جَعْفَرًا فِي وَلَدِهِ.
হে আল্লাহ! আপনি নিজেই জাফরের সন্তানদের অভিভাবক হয়ে যান। -মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস ১৩৭৯
আব্দুল্লাহ ইবনে সা‘লাবা রা. হিজরতের চার বছর পূর্বে জন্মগ্রহণ করেন। মুসআব ইবনে আব্দুল্লাহ রাহ. বলেন-
...وَحُمِلَ إِلَى رَسُولِ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ فَمَسَحَ وَجْهَهُ وَبَرّكَ عَلَيْهِ عَامَ الْفَتْحِ.
মক্কা বিজয়ের বছর আব্দুল্লাহ ইবনে সা‘লাবাকে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আনা হল। তিনি তার চেহারায় হাত বুলিয়ে দেন এবং তার জন্য বরকতের দুআ করেন। -মুস্তাদরাকে হাকেম, বর্ণনা ৫২১৫
জাবের ইবনে সামুরা রা. বলেন-
صَلّيْتُ مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ صَلَاةَ الْأُولَى، ثُمّ خَرَجَ إِلَى أَهْلِهِ وَخَرَجْتُ مَعَهُ، فَاسْتَقْبَلَهُ وِلْدَانٌ، فَجَعَلَ يَمْسَحُ خَدّيْ أَحَدِهِمْ وَاحِدًا وَاحِدًا، قَالَ: وَأَمّا أَنَا فَمَسَحَ خَدّي، قَالَ: فَوَجَدْتُ لِيَدِهِ بَرْدًا وَرِيحًا كَأَنّمَا أَخْرَجَهَا مِنْ جُؤْنَةِ عَطّارٍ.
আমি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ফজরের নামায পড়লাম। নামাযের পর তিনি বাড়ির দিকে রওয়ানা হলেন। আমিও তার সাথে বের হলাম। কয়েকজন শিশু তাঁর সামনে এসেছে। তিনি একজন একজন করে প্রত্যেকের গণ্ডদ্বয়ে কোমল স্পর্শ দিলেন। আমার গালেও পবিত্র হাতের শীতল স্পর্শ দান করলেন। তাঁর হাত থেকে তখন এমন শীতলতা ও সুঘ্রাণ পেয়েছি, (মনে হল) যেন এইমাত্র তাঁর হাত তুলে এনেছেন আতরওয়ালার পাত্র থেকে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৩২৯; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ৩২৪২৪; মুসনাদে বাযযার, হাদীস ৪২৫৭
আনাস রা. বলেন-
كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يَزُورُ الْأَنْصَارَ فَإِذَا جَاءَ إلَى دُورِ الْأَنْصَارِ جَاءَ صِبْيَانُ الْأَنْصَارِ يَدُورُونَ حَوْلَهُ فَيَدْعُو لَهُمْ وَيَمْسَحُ رُءُوسَهُمْ وَيُسَلِّمُ عَلَيْهِمْ.
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনসারদের যিয়ারতে যেতেন। আনসারী শিশুরা নবীজীর চতুর্দিকে ভিড় করত। তিনি শিশুদের সালাম দিতেন, মাথায় হাত বুলাতেন এবং তাদের জন্য দুআ করতেন। -সুনানে কুবরা, নাসায়ী, হাদীস ১০০৮৮; মুসনাদে বাযযার, হাদীস ৬৮৭২; শরহু মুশকিলিল আসার, হাদীস ১৫৭৭; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৪৫৯
শিশুদের অনুরাগ-অনুভূতির মূল্যায়ন করা
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশুদের চাহিদা ও অনুরাগ-অনুভূতির মূল্যায়ন করতেন। আদর-সোহাগ করে তাদের কাঁধে উঠাতেন। এবং তাদের শিশুসুলভ আচরণকে সহাস্যবদনে বরণ করে নিতেন। শাদ্দাদ ইবনুল হাদ রা. বর্ণনা করেন- একদা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান বা হুসাইনকে কোলে নিয়ে মাগরিব বা ইশার নামাযের উদ্দেশে বের হলেন। তাকে পাশে রেখে তিনি সামনে অগ্রসর হলেন এবং তাকবীর বলে নামায শুরু করলেন। নামাযের মাঝখানে একটি সিজদা খুব লম্বা করলেন। আমি মাথা উঠালাম। দেখি, তিনি সিজদায়, আর শিশুটি তার পিঠে! আমি আবার সিজদায় চলে গেলাম। নামায শেষ হলে সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! নামাযের মধ্যে একটি সিজদা অনেক দীর্ঘ করলেন! আমাদের তো আশঙ্কা হচ্ছিল- কোনো দুর্ঘটনা ঘটল না তো! বা ভাবছিলাম, আপনার প্রতি কোনো ওহী নাযিল হল! নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
كُلّ ذَلِكَ لَمْ يَكُنْ وَلَكِنّ ابْنِي ارْتَحَلَنِي فَكَرِهْتُ أَنْ أُعَجِّلَهُ حَتّى يَقْضِيَ حَاجَتَهُ.
এগুলোর কোনোটিই ঘটেনি; বরং আমার এই ছেলে (নাতি) আমার উপর সওয়ার হয়েছে। আমার পছন্দ হল না- তার (শিশুমনের) ইচ্ছেটুকু পূরণ হওয়ার আগে তাকে সরিয়ে দিই। -সুনানে নাসায়ী, হাদীস ১১৪১; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস ৩২৮৫৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৬০৩৩
আনন্দদানের জন্য শিশুদেরকে কাঁধে উঠানো
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশুদেরকে আনন্দ দিতেন; কাঁধে চড়িয়ে তাদের আহ্লাদ-আবদার পুরা করতেন। আবু কাতাদা রা. বলেন- একদিন আমরা মসজিদে বসা। নবীজী তাঁর কন্যা যয়নব রা.-এর মেয়ে উমামাকে কাঁধে করে আমাদের সামনে এলেন। (তিনি বলেন-)
فَصَلّى رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ، وَهِيَ عَلَى عَاتِقِهِ، يَضَعُهَا إِذَا رَكَعَ، وَيُعِيدُهَا إِذَا قَامَ، حَتّى قَضَى صَلَاتَهُ يَفْعَلُ ذَلِكَ بِهَا.
এরপর নামাযের ইমামতি শুরু করলেন। উমামা তখনও নবীজীর কাঁধে। রুকু করার সময় তাকে নামিয়ে রাখেন। সিজদা থেকে উঠে আবার উঠিয়ে নেন। পুরো নামায তিনি এভাবেই আদায় করলেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৯৯৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫৪৩; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৯১৮; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৮২৭, ১২০৫
আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করনে-
رَأَيْتُ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ حَامِلَ الْحُسَيْنِ بْنِ عَلِيٍّ عَلَى عَاتِقِهِ، وَلُعَابُهُ يَسِيلُ عَلَيْهِ.
একবার দেখলাম, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুসানইকে কাঁধে উঠিয়ে রেখেছেন আর তার লালা গড়িয়ে পড়ছে নবীজীর গতরে। -সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৬৫৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৯৭৭৯
শিশুদেরকে নিজ বাহনে চড়িয়ে আনন্দদান
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশুদের আনন্দদানের জন্য নিজের সাথে বাহনে চড়াতেন। ইবনে আব্বাস রা. বলেন-
এক সফরে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় আগমন করলে আব্দুল মুত্তালিব গোত্রের শিশুরা এগিয়ে এল নবীজীকে এস্তেকবাল-স্বাগত জানানোর জন্য। তখন তিনি আব্বাসের দুই ছেলে- কুসাম ও ফযলকে তাঁর সাথে বাহনে উঠিয়ে নিলেন। একজনকে বসালেন তাঁর সামনে, অন্যজনকে পেছনে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৭৯৮, ৫৯৬৬
আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রা. বলেন- (নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সফর থেকে ফিরে এলে) আমরা তিন শিশু; আমি, আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর ও আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস নবীজীকে স্বাগত জানানোর জন্য আসি। তখন তিনি আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর ও আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসকে তাঁর সাথে বাহনে উঠিয়ে নেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩০৮২
আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর রা. বর্ণনা করেন-
كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ إِذَا قَدِمَ مِنْ سَفَرٍ تُلُقِّيَ بِصِبْيَانِ أَهْلِ بَيْتِهِ، قَالَ: وَإِنّهُ قَدِمَ مِنْ سَفَرٍ فَسُبِقَ بِي إِلَيْهِ، فَحَمَلَنِي بَيْنَ يَدَيْهِ، ثُمّ جِيءَ بِأَحَدِ ابْنَيْ فَاطِمَةَ، فَأَرْدَفَهُ خَلْفَهُ، قَالَ: فَأُدْخِلْنَا الْمَدِينَةَ، ثَلَاثَةً عَلَى دَابّةٍ.
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো সফর থেকে ফিরে এলে তাঁর পরিবারের শিশুদেরকে এস্তেকবালের জন্য বের করা হত। একদিন তিনি এক সফর থেকে এলে আমাকে তাঁর নিকট আনা হয়। তিনি আমাকে বাহনে উঠিয়ে তাঁর সামনে বসান। এরপর হাসান বা হুসাইনকে আনা হলে তিনি তাকে তাঁর পেছনে বসান। আমরা মদীনায় প্রবেশ করি এক বাহনে তিনজন আরোহণ করে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৪২৮; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৫৬৬
সালামা ইবনে আকওয়া রা. বলেন- নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং হাসান ও হুসাইন নবীজীর শাহবা (ধূসর) খচ্চরে আরোহণ করলে আমি খচ্চরটি টেনে টেনে নবীজীর হুজরা পর্যন্ত তাঁদেরকে নিয়ে যাই। তাঁদের একজন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে, আরেকজন তাঁর পিছনে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৪২৩; সুনানে তিরমিযী, হাদীস ২৯৮০
শিশুদের সাথে হাসি-আনন্দ
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো কখনো শিশুদের সাথে রসিকতা করতেন। হাসি-আনন্দ করতেন। আনাস রা. নবীজীর খেদমত করতেন। তিনি ছিলেন খুব চঞ্চল। নবীজী রসিকতা করে তাঁকে দুই কানওয়ালা বলে ডাকতেন। আনাস রা. বলেন-
إِنّ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ قَالَ لَهُ: يَا ذَا الأُذُنَيْنِ، قَالَ مَحْمُودٌ: قَالَ أَبُو أُسَامَةَ: يَعْنِي مَازَحَهُ.
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে হে ‘দুই কানওয়ালা’ বলে ডেকেছেন। বর্ণনাকারী বলেন, নবীজী তার সাথে রসিকতা করে এভাবে ডেকেছেন। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫০০২; জামে তিরমিযী, হাদীস ২১০৯; আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ৬৬২, ৬৬৩
উম্মে সুলাইম রা.-এর এক সন্তানের নাম ছিল আবু উমাইর। ছোট্ট শিশু। তার একটা ‘নুগাইর’ পাখি ছিল। সে এটা দিয়ে খেলা করত। আনাস রা. বলেন-
إِنّ ابْنًا لِأُمِّ سُلَيْمٍ صَغِيرًا كَانَ يُقَالُ لَهُ: أَبُو عُمَيْرٍ، وَكَانَ لَهُ نُغَيْرٌ، وَكَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ إِذَا دَخَلَ عَلَيْهَا ضَاحَكَهُ، فَدَخَلَ عَلَيْهِ فَرَآهُ حَزِينًا، فَقَالَ: مَالِي أَرَى أَبَا عُمَيْرٍ حَزِينًا؟ فَقَالُوا: مَاتَ نُغَرُهُ الّذِي كَانَ يَلْعَبُ بِهِ، فَكَانَ إِذَا جَاءَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ فَرَآهُ، قَالَ: أَبَا عُمَيْرٍ مَا فَعَلَ النّغَيْرُ.
উম্মে সুলাইম রা.-এর এক ছোট্ট ছেলে ছিল। নাম আবু উমাইর। তার একটা ‘নুগাইর’ পাখি ছিল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই উম্মে সুলাইম রা.-এর ঘরে আসতেন আবু উমাইরের সাথে হাসি-ঠাট্টা করতেন। একদিন তার কাছে এসে দেখেন- তার মন খারাপ। বললেন, কী হল আবু উমাইরের, মন খারাপ কেন? লোকেরা বলল, সে যে নুগাইর পাখিটা দিয়ে খেলা করত সেটা মারা গেছে। এরপর থেকে যখনই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দেখতেন, বলতেন, আবু উমাইর! তোমার নুগাইরটার কী হল! (দেখছি না যে!) -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬২০৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১৫০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১২৯৫৭, ১৩০৭৭, ১৩২০৯
আবু হুরায়রা রা. বলেন, একদিন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনী কায়নুকার বাজারে গেলেন। সেখান থেকে ফিরে এসে ফাতেমা রা.-এর ঘরের আঙিনায় গিয়ে হাসানকে লক্ষ করে তিনবার ডাক দিলেন, আমার নানু কোথায়! হাসান রা. দৌঁড়ে এলেন। নবীজী তাকে দেখে আপন হস্তদ্বয় প্রসারিত করে দেন। হাসানও তার হাত বাড়িয়ে দেন। নবীজী তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন-
اللّهُمّ إِنِّي أُحِبّهُ فَأَحِبّهُ، وَأَحِبّ مَنْ يُحِبّهُ.
হে আল্লাহ! আমি তাকে মহব্বত করি। তুমি তাকে মহব্বত কর এবং যে তাকে মহব্বত করে তাকেও মহব্বত কর। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২১২২, ৫৮৮৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৪২১
একদিন মাহমুদ ইবনে রবী রা.-কে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে আনা হল। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রসিকতা করে বালতি থেকে মুখে একটু পানি নিয়ে তার চেহারায় ছিটিয়ে দেন। তখন মাহমুদ রা.-এর বয়স ছিল পাঁচ বছর। পরবর্তীতে তিনি নিজেই নিজের সে স্মৃতি বর্ণনা করেন। (দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারী, হাদীস ৭৭)
শিশুরা কোনো কিছুতে ‘না’ বললে- করার জন্য চাপাচাপি না করা
কখনো কখনো শিশুকে কোনো কাজের হুকুম করলে সে করতে চায় না। তখন তাকে কাজটা করার জন্য চাপাচাপি করা উচিত নয়। চাপাচাপি করলে হয়ত তখন সে কাজটা করে ফেলবে; কিন্তু একসময় সে জেদি হয়ে যাবে। তখন আপনি যে কোনো হুকুম করবেন সে জিদ দেখাবে। মারলেও সে আপনার কথা মানবে না। তাই শিশুর দ্বারা কোনো কাজ করাতে চাইলে তার স্বতঃস্ফূর্ততার প্রতি দৃষ্টি রাখা চাই। স্বেচ্ছায় যেন কাজটি করে সে পন্থা অবলম্বন করা চাই; উৎসাহ দিয়ে বা পুরস্কার দিয়ে।
আরো ভালো হয়, যদি তাকে নির্দেশ করার ধরনটাই পাল্টে দেওয়া হয়। যেমন, এভাবে বলা- বাবু! আমাকে একটু পানি এনে দিতে পারবে? খোকা! সেখান থেকে ঐ জিনিসটা এনে দিলে ভালো হত।
যাইহোক, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশুদের কোনো নির্দেশ পালনে বাধ্য করতেন না। আনাস রা. বলেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন অতি উত্তম আখলাকের অধিকারী। (তিনি বলেন-)
أَرْسَلَنِي يَوْمًا لِحَاجَةٍ، فَقُلْتُ: وَاللهِ لَا أَذْهَبُ، وَفِي نَفْسِي أَنْ أَذْهَبَ لِمَا أَمَرَنِي بِهِ نَبِيّ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ، فَخَرَجْتُ حَتّى أَمُرّ عَلَى صِبْيَانٍ وَهُمْ يَلْعَبُونَ فِي السّوقِ، فَإِذَا رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ قَدْ قَبَضَ بِقَفَايَ مِنْ وَرَائِي، قَالَ: فَنَظَرْتُ إِلَيْهِ وَهُوَ يَضْحَكُ، فَقَالَ: يَا أُنَيْسُ أَذَهَبْتَ حَيْثُ أَمَرْتُكَ؟ قَالَ قُلْتُ: نَعَمْ، أَنَا أَذْهَبُ، يَا رَسُولَ اللهِ!
একদিন তিনি আমাকে কোনো জরুরতে এক জায়গায় পাঠাতে চাইলেন। বললাম, আল্লাহর কসম! আমি যাব না; কিন্তু মনে মনে যাওয়ার নিয়ত ছিল। তো সেখানে যাওয়ার জন্য আমি রওয়ানা হলাম। বাজারে শিশুরা খেলাধুলা করছিল। (আমি খেলা দেখতে লেগে গেলাম) হঠাৎ রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পিছন থেকে আমার ঘাড় ধরলেন! আমি তাঁর দিকে তাকালাম। দেখি তিনি হাসছেন! বললেন, প্রিয় আনাস! তুমি কি সেখানে গিয়েছিলে? বললাম, জী হাঁ, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এক্ষুনি আমি সেখানে যাচ্ছি। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৩১০: সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৭৭৩
শিশুর ভুলভ্রান্তি হলে বিরক্তি প্রকাশ না করা
শিশু। সে বয়সে যেমন শিশু তেমনি বুঝ, জ্ঞান, বুদ্ধি সবকিছুতেই শিশু। তার কাজ শিশুর কাজ। তার কথা শিশুর কথা। শিশুদের কথা, কাজ, চলাফেরা সবকিছুতেই ভুল হওয়া স্বাভাবিক। তাদের ভুল-ভ্রান্তির জন্য ধমক দেওয়া, তিরস্কার করা বা বিরক্তি প্রকাশ করা ঠিক না। হাঁ, কোমল শাসন তো করতেই হবে, যাতে সে সচেতন হয়। তবে তা হতে হবে সস্নেহ শাসন।
সায়্যিদুনা আনাস ইবনে মালেক রা. বলেন, আমি দশ (বা নয়) বছর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমত করেছি-
وَاللهِ مَا قَالَ لِي: أُفّا قَطّ وَمَا قَالَ لِشَيْءٍ صَنَعْتُهُ: لِمَ فَعَلْتَ كَذَا وَكَذَا؟ أَوْ لِشَيْءٍ تَرَكْتُهُ: هَلّا فَعَلْتَ كَذَا وَكَذَا ؟
আল্লাহর কসম! কোনো দিন আমাকে ‘উফ’ বলেননি। আমি (অযাচিত) কোনো কিছু করে ফেললে বলেননি- এটা কেন করলে? তেমনি কোনো কাজ না করলে বলেননি- এটা কেন করলে না? -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৩০৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৭৭৩
আনাস রা. আরো বলেন-
خَدَمْتُ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ عَشْرَ سِنِينَ، فَمَا أَمَرَنِي بِأَمْرٍ فَتَوَانَيْتُ عَنْهُ، أَوْ ضَيّعْتُهُ، فَلَامَنِي، فَإِنْ لَامَنِي أَحَدٌ مِنْ أَهْلِ بَيْتِهِ إِلّا قَالَ: دَعُوهُ، فَلَوْ قُدِّرَ - أَوْ قَالَ: لَوْ قُضِيَ - أَنْ يَكُونَ كَانَ.
আমি দশ বছর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমত করেছি। তিনি কোনো নির্দেশ দিলে যদি অবহেলা করতাম বা জিনিসটা নষ্ট করে ফেলতাম তাহলে তিনি আমাকে তিরষ্কার করতেন না। তার পরিবারের কেউ কিছু বললে তিনি বলতেন, ওকে কিছু বলো না; তাকদীরে যা আছে তা ঘটবেই। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৩৪১৮
শিশুদের খেলাধুলার সুযোগ দেওয়া
শিশুদের মন চঞ্চল। তারা খেলাধুলা করতে ভালবাসে। তাদেরকে খেলাধুলা করে আনন্দ গ্রহণের সুযোগ দেওয়া নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ।
আয়েশা রা.-এর যখন বিবাহ হয় তিনি ছোট ছিলেন। ফলে তিনি বান্ধবীদের সাথে খেলতেন। তিনি বলেন-
كُنْتُ أَلْعَبُ بِالْبَنَاتِ عِنْدَ النّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ، وَكَانَ لِي صَوَاحِبُ يَلْعَبْنَ مَعِي، فَكَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ إِذَا دَخَلَ يَتَقَمّعْنَ مِنْهُ، فَيُسَرِّبُهُنّ إِلَيّ فَيَلْعَبْنَ مَعِي.
আমি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘরে পুতুল দিয়ে খেলা করতাম। আমার (মত ছোট ছোট) কয়েকজন বান্ধবী আমার সাথে খেলত। নবীজী ঘরে এলে তারা লজ্জায় লুকিয়ে যেত। তখন তিনি একজন একজন করে তাদেরকে আমার কাছে পাঠাতেন। তারা আবার আমার সাথে খেলতে শুরু করত। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬১৩০; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৪৪০
শিশুর খেলা সম্পর্কে পূর্বে বর্ণিত হাসান, হুসাইন ও আবু উমায়েরের ঘটনাও স্মরণযোগ্য।
শিশুদের থেকে অপ্রীতিকর কিছু প্রকাশ পেলে উদারচিত্তে বরদাশত করা
শিশুদের সাথে স্নেহ-মমতার আরেকটা দিক হল, তাদের থেকে অপ্রীতিকর কিছু প্রকাশ হলে তা বরদাশত করা। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বলেন- নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট শিশুদের নিয়ে আসা হত। তিনি তাদের জন্য বরকতের দুআ করতেন এবং তাহনীক করতেন। (খেজুর ইত্যাদি ভালো করে চিবিয়ে শিশুর মুখে সামান্য একটু দিতেন।)
إِنّ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ أُتِيَ بِصَبِيٍّ لِيُحَنِّكَهُ، فَأَجْلَسَهُ فِي حَجْرِهِ، فَبَالَ عَلَيْهِ، فَدَعَا بِمَاءٍ، فَأَتْبَعَهُ إِيّاهُ.
একদিন এক শিশুকে তাহনীক করার জন্য তাঁর কাছে আনা হল। তিনি শিশুটিকে কোলে বসালেন। শিশুটি তাঁর কোলে পেশাব করে দিল। তখন নবীজী পানি আনিয়ে কাপড়ে পানি ঢেলে দিলেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২২২, ৬৩৫৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৮৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৪২৫৬
উম্মে কায়স বিনতে মিহসান রা. নিজের ঘটনা শুনিয়েছেন-
... أَتَتْ رَسُولَ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ بِابْنٍ لَهَا لَمْ يَأْكُلِ الطّعَامَ فَوَضَعَتْهُ فِي حَجْرِهِ فَبَالَ، قَالَ: فَلَمْ يَزِدْ عَلَى أَنْ نَضَحَ بِالْمَاءِ.
তিনি নিজের দুগ্ধপোষ্য শিশুকে এনে নবীজীর কোলে দেন। শিশুটি তাঁর কোলে পেশাব করে দেয়। নবীজী তাতে কেবল একটু পানি ঢেলে দিলেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৮৭
চিন্তা করুন, শিশুদের অপ্রীতিকর বিষয়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হৃদয় কত উদার ছিল!
শিশুদের ভীত ও আতঙ্কিত না করা
আবু লায়লা রা. বলেন, আমি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বসা ছিলাম। হাসান বা হুসাইন নবীজীর বুকে বসা। হঠাৎ দেখি সে ফিনকি দিয়ে পেশাব করছে। (তাকে সরানোর জন্য) আমরা উঠলাম। তিনি বললেন-
دَعُوا ابْنِي، لَا تُفْزِعُوهُ حَتّى يَقْضِيَ بَوْلَهُ.
আমার ছেলেকে (নাতিকে) পেশাব শেষ করতে দাও। তাকে আতঙ্কিত করো না; পেশাব শেষ করতে দাও। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৯০৫৯
একটু ভাবুন, শিশুদের প্রতি নবীজীর দিল-মন কত প্রশস্ত ছিল!
শিশুদের জন্য বদ দুআ না করা
শিশুর আকল-বুদ্ধি কম। সে বিরক্তিকর কিছু করলে তার জন্য দুআ করা, যাতে তার মধ্যে সুন্দর বোধ আসে। সন্তানের জন্য পিতা-মাতার দুআ কবুল হয়। পিতা-মাতা আল্লাহর দিকে রুজু হয়ে, তাঁর দরবারে কান্নাকাটি করে সন্তানদের জন্য উত্তম আখলাকের জন্য দুআ করবে। এতে সন্তান ও পিতা-মাতা সকলের মঙ্গল।
তা না করে সন্তান মাতা-পিতার মেযাজ-বিরুদ্ধ কিছু করলে তারা যদি রাগ করে তার জন্য বদ দুআ করেন, আর -আল্লাহ না করুন- তাদের দুআ কবুল হয়ে যায়, তাহলে লাভের কী হল! সন্তান, মাতা-পিতা সবার জন্য-ই তো ক্ষতি ও কষ্টের কারণ হল! রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরমান-
لَا تَدْعُوا عَلَى أَنْفُسِكُمْ، وَلَا تَدْعُوا عَلَى أَوْلَادِكُمْ، وَلَا تَدْعُوا عَلَى أَمْوَالِكُمْ، لَا تُوَافِقُوا مِنَ اللهِ سَاعَةً يُسْأَلُ فِيهَا عَطَاءٌ، فَيَسْتَجِيبَ لَكُمْ.
তোমরা নিজেদের জন্য বদ দুআ করো না। সন্তানদের জন্য বদ দুআ করো না। সম্পদের উপর বদ দুআ করো না। (কারণ) এমন হতে পারে যে, আল্লাহর কাছে দুআ কবুল হওয়ার সময় তোমরা বদ দুআ করলে আর আল্লাহ তা কবুল করে নিলেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩০০৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৫৩২; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৫৭৪২
শিশুদের জন্য নেক দুআ করা
শিশুদের প্রতি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মায়া-মমতা ছিল বর্ণনাতীত। তাদের কল্যাণ কামনা করতেন। তাদের জন্য উন্নতি ও বরকতের দুআ করতেন। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বলেন-
إِنّ رَسُولَ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ كَانَ يُؤْتَى بِالصِّبْيَانِ فَيُبَرِّكُ عَلَيْهِمْ.
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট মদীনার শিশুদের নিয়ে আসা হত। নবীজী তাদের জন্য বরকতের দুআ করতেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৩৫৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৮৬
নারী সাহাবীগণ রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট সন্তানদের নিয়ে আসতেন। নবীজী তাদের জন্য দুআ করতেন। আনাস রা. বলেন, আমার আম্মু আমাকে নিয়ে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসেন এবং বলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আনাসকে আপনার খেদমতের জন্য দিলাম। আপনি তার জন্য দুআ করুন। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
اللّهُمّ أَكْثِرْ مَالَهُ، وَوَلَدَهُ، وَبَارِكْ لَهُ فِيمَا أَعْطَيْتَهُ.
হে আল্লাহ! আনাসের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বাড়িয়ে দিন এবং তাকে যা দান করেন তাতে বরকত দান করুন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৩৪৪, ৬৩৭৮, ৬৩৮০; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৪৮০
পূর্বে উদ্ধৃত হয়েছে যে, আব্দুল্লাহ ইবনে সা‘লাবা রা. ও আব্দুল্লাহ ইবনে জাফর রা.-এর জন্য নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুআ করেছেন। আরো উদ্ধৃত হয়েছে যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনসারদের মহল্লায় গেলে তাদের শিশুরা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আসত। তখন তিনি তাদের মাথায় হাত বুলাতেন এবং তাদের জন্য দুআ করতেন।
শিশুদের সাথে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্দর আচরণের কিছু দিক তুলে ধরা হল। শিশুর প্রতিপালনে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ অনুসরণ করার তাওফীক দান করুন- আমীন।
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
যৌবন : খাহেশাতের শিল্প নয় নেকির সৌন্দর্য
মানুষের জীবনের প্রতিটি ধাপই গুরুত্বপূর্ণ। শৈশব , কৈশোর , যৌবন , পৌঢ়ত্ব বা বার্ধক্য- জীবনের কোনো পর্য...
খাতামুন নাবিয়্যীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শ্রেষ্ঠত্ব ও কিছু বৈশিষ্ট্য
الحمد لله وسلام على عباده الذين اصطفى، وأشهد أن لا إله إلا الله وحده لاشريك له، وأشهد أن محمدا عبده ...
বড়কে মান্য করুন, বৃদ্ধকে সম্মান করুন
اعوذ بالله من الشيطان الرجيم. بسم الله الرحمن الرحيم : كٓهٰیٰعٓصٓ ذِكْرُ رَحْمَتِ رَبِّكَ عَبْدَهٗ ز...