প্রবন্ধ

বড়কে মান্য করুন, বৃদ্ধকে সম্মান করুন

লেখক:মাসিক আলকাউসার
২৭ মে, ২০২৫
১০৬৪১ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

اعوذ بالله من الشيطان الرجيم. بسم الله الرحمن الرحيم : كٓهٰیٰعٓصٓ  ذِكْرُ رَحْمَتِ رَبِّكَ عَبْدَهٗ زَكَرِیَّا  اِذْ نَادٰی رَبَّهٗ نِدَآءً خَفِیًّا قَالَ رَبِّ اِنِّیْ وَهَنَ الْعَظْمُ مِنِّیْ وَ اشْتَعَلَ الرَّاْسُ شَیْبًا وَّ لَمْ اَكُنْۢ بِدُعَآىِٕكَ رَبِّ شَقِیًّا

আল্লাহ পাক আমাদেরকে ঈমান ও ইসলাম নসীব করেছেনতাঁর বন্দেগীর সুযোগ ও তাওফীক দান করেছেন- এ তাঁর অনেক বড় দান। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবায়ে কেরাম আল্লাহ পাকের এই দান সম্পর্কে সচেতন ছিলেন এবং তাঁরা এই দানের শোকরগুযারি করতেন।

হাদীসের কিতাবে আছেরাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার সাহাবায়ে কেরামের এক মজলিসে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেনতোমরা কী করছসাহাবায়ে কেরাম বললেন :

نحمد الله على ما هدانا للاسلام

আল্লাহ পাক যে আমাদের ইসলামের পথ দেখিয়েছেনসে জন্য তাঁর শোকরগোযারি করছি। -সহীহ মুসলিমহাদীস ২৭০১

সাহাবায়ে কেরাম যেহেতু কষ্ট করেপ্রতিকল পরিবেশে ইসলামকে পেয়েছিলেনকষ্ট করে ইসলামকে রক্ষা করেছিলেনইসলামের জন্য ত্যাগ ও কুরবানী করেছিলেন এবং রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট থেকে ইসলামের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেনএজন্য তাঁদের কাছে ইসলামের মর্যাদা ছিল। তাঁরা প্রয়োজন মনে করেছেন আল্লাহ পাকের শোকরগোযারি করারঈমান ও ইসলামরূপী এই মহাসম্পদের জন্য তাঁর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করার। তাঁরা আল্লাহ পাকের শোকরগুযারি করেছেন যেতিনি তাদের কুফর থেকের্শিক থেকে রক্ষা করেছেনফিস্ক থেকেনাফরমানী থেকে রক্ষা করেছেনএবং একটি নির্মল আদর্শ একটি পবিত্র জীবন দান করেছেন।

আমরা যারা মুসলিমইসলাম সম্পর্কে আমাদের জানা প্রয়োজন। ইসলামের সৌন্দর্য ও যথার্থতা সম্পর্কে এই পরিমাণ জ্ঞান ও প্রজ্ঞা থাকা প্রয়োজনযার দ্বারা অন্তর প্রশান্ত হয়মনে আত্মবিশ্বাস জন্মে এবং আল্লাহ পাকের শোকরগোযারির উৎসাহ জাগে। এই দ্বীন সম্পর্কে যদি সঠিক সূত্র থেকে সঠিক ধারণা অর্জন করা যায় তাহলে অবশ্যই একজন মুসলিমের অন্তর থেকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের হামদ ও শোকর উৎসারিত হবে।

ইসলাম তো আল্লাহর দ্বীনআল্লাহ পাকের তরফ থেকে আসা নূর ও আলোহেদায়েত ও পথনির্দেশইসলামের শিক্ষা ও নির্দেশনাগুলো ইনসাফের সাথে লক্ষ্য করা হলে এর মাহাত্ম্য,যথার্থতা ও ন্যায়সঙ্গতা অবশ্যই বুঝে আসবে। এটুকু জ্ঞান ও উপলব্ধি একজন মুমিনের অর্জন করা জরুরি।

একটি উদাহরণ

আমি উদাহরণ হিসেবে একটি বিখ্যাত হাদীস তুলে ধরছি। হযরত আবু হুরায়রা রা. রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজন বিখ্যাত সাহাবীআল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন :

من لم يرحم صغيرنا ولم يعرف حق كبيرنا فليس منا

যে আমাদের ছোটকে দয়া করে নাআমাদের বড়র হক আদায় করে না সে আমাদের নয়। -সুনানে আবু দাউদহাদীস ৪৯৪৩আল আদাবুল মুফরাদহাদীস ৩৫৩

তো মুমিনের বৈশিষ্ট্যছোটকে দয়া করা এবং বড়র হক আদায় করা।

দুনিয়াতে আল্লাহ পাকের যে নেযাম ও ব্যবস্থাবড় এবং ছোট সেই ব্যবস্থারই অংশ। একে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আল্লাহ পাক সকল মানুষকে সবদিক থেকে এক-সমান করেননি। একেক মানুষকে একেক বৈশিষ্ট্য দান করেছেন। এই বৈশিষ্ট্যের কারণে কেউ বড়কেউ ছোট।

বড় ও ছোটর অনেক দিক আছে। সবচেয়ে প্রকাশ্য দিকবয়সের দিক থেকে বড়-ছোট। আল্লাহ পাক পৃথিবীতে কাউকে আগে পাঠানকাউকে পরে। তাই বয়সের দিক থেকে কেউ বড়কেউ ছোট। আবার শক্তি-সামর্থ্যের দিক থেকে কেউ বড়কেউ ছোট। জ্ঞান-প্রজ্ঞার দিক থেকে কেউ বড়কেউ ছোট। পদ ও ক্ষমতার দিক থেকে কেউ বড়কেউ ছোট। এখন পৃথিবীতে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে হলে কার সাথে কী আচরণ সুন্দর ও যথার্থ তা জানা থাকা দরকার।

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীمن لم يرحم صغيرنا  (যে আমাদের ছোটকে দয়া করে না...) থেকে বোঝা গেলছোটর সাথে আচরণ হবে দয়াপূর্ণমমতাপূর্ণ। ছোটর সাথে আচরণের মূল ভিত্তি হবে আর রাহমাহ দয়া ও মমতা। দয়া-মায়ার আচরণের দ্বারাই ছোটর হক আদায় করা সম্ভব হবে।

ছোটর প্রতি দয়া শিরোনামে অনেক কিছু আসে। ছোটর ভুল ক্ষমা করাতার শিক্ষা-দীক্ষাউন্নতির চেষ্টা করাতার সাথে কোমল আচরণ করাতার বিভিন্ন প্রয়োজন পূরণ করাএই সব কিছু দয়া ও মমতার একেকটি দিকএকেকটি প্রকাশ।

সমাজের যারা সহায়-সম্বলহীন মানুষতারাও একদিক থেকে ছোটতাদের সাথে আচরণের মানদণ্ড এই হাদীসে পাওয়া গেল। আর তা হচ্ছেআর রাহমাহদয়া ও মমতা।

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

والله في عون العبد ما كان العبد في عون أخيه

আল্লাহ পাক বান্দার সহযোগিতায় ততক্ষণ থাকেন যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সহযোগিতায় থাকে। -সহীহ মুসলিমহাদীস ২৬৯৯

দেখুনদুনিয়াতে যত দিক থেকে যত বড় আছেসবার চেয়ে বড় একজন আছেন। তিনি আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। আল্লাহু আকবার। অনেক প্রকারের বড় দুনিয়াতে আছে। কিন্তু আল্লাহ আমাদের শিখিয়েছেন যেসবার চেয়ে সবদিক থেকে বড় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। এই জন্য দৈনিক পাঁচবার আযানে আমরা শুনিআল্লাহু আকবারআল্লাহু আকবার। নামাযে বারবার বলি আল্লাহু আকবার। অর্থআল্লাহ সবার বড়সবকিছুর চেয়ে বড়।

এই ছোট ছোট বড় অর্থাৎ বান্দাদের মধ্যে যারা বড় তারা যখন বড়র দায়িত্ব পালন করেছোটর সাথে দয়া ও মমতার আচরণ করে তখন সবচেয়ে যিনি বড় সেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের উপর রহম করেন।

হাদীস শরীফের ঘোষণা :

ارحموا من في الأرض يرحمكم من في السماء

তোমরা দুনিয়াওয়ালাদের উপর রহম কর  আসমানওয়ালা তোমাদের উপর রহম

করবেন। -মুসনাদে আহমদহাদীস ৬৪৯৪জামে তিরমিযীহাদীস ১৯২৪

প্রসঙ্গতএকটি বিষয় পরিষ্কার করিকিছুদিন আগে পাকিস্তানে যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেলস্কুলের ছাত্রদের উপর গুলি চালানো হলআমরা আল্লাহর কাছে পানাহ চাইএর নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই। এটা যদি ইসলামের নামে হয়ে থাকে তাহলে এ কাজ তারাই করতে পারে যারা ইসলামের নাদান দোস্ত। তারা হয়ত মনে করছেএভাবেই ইসলাম প্রতিষ্ঠা হয়ে যাবে। এভাবেই ইসলামের শক্তি-সামর্থ্যরে প্রমাণ দেওয়া যাবে। কিন্তু এ এক ভ্রান্ত ধারণা। এগুলো ইসলামের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। একারণে পাকিস্তানের বিজ্ঞ আলিমগণপ্রসিদ্ধ কওমী মাদরাসাগুলোর উলামায়ে কেরাম এ ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন। তাফসীরে মাআরিফুল কুরআনের লেখক মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ.-এর প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত কওমী মাদরাসা দারুল উলূম করাচীর বর্তমান মুহতামিম (প্রিন্সিপাল) যাঁকে এখন পাকিস্তানের মুফতীয়ে আজম বলা হয়মুফতী মুহাম্মাদ রাফী উসমানী (দা. বা.) এ আক্রমণের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছেন। আর এখন তো পরবর্তী ঘটনা-প্রবাহ থেকে মোটামুটি পরিষ্কার যেএটি পরিকল্পিতভাবে ঘটানো হয়েছে। তো এটা কোনো ইসলামী কাজ নয়। অন্যায়কারীর বিচার হতে পারেকিন্তু অপরাধ করবে একজন আর জুলুম করা হবে অন্য আরেকজনের উপর এটা ইসলামের নীতি নয়।

হাদীসের দ্বিতীয় অংশ,

 ولم يعرف حق كبيرنا  (এবং যে আমাদের বড়র হক আদায় করে না)। বড় বিভিন্নভাবে হতে পারে। বয়সে বড়জ্ঞান-প্রজ্ঞায় বড়অর্থ-বিত্ত-সামাজিক সম্মানের দিক থেকে বড়পদ-মর্যাদা ও কর্তৃত্বের দিক থেকে বড়যে কোনো দিক থেকে যিনি বড়তার হক আদায় করা ঈমান ও ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। যে সেই হক আদায় করে না সে فليس منا আমাদের নয়

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস শরীফ পড়ে দেখুনবয়সের দিক থেকে যে বড় তার বিষয়ে কত গুরুত্ব দিয়েছেন।

এক হাদীসে আছেকয়েকজন লোক একটি হত্যা-ঘটনা নিয়ে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসেছেন। নিহতের সন্তানদের মধ্যে যে ছোট সে এ বিষয়ে কথা বলতে আরম্ভ করেছেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে থামিয়ে দিয়ে বড় ভাইকে কথা বলার আদেশ করেছেন। -সুনানে আবু দাউদহাদীস ৬১৪২৬১৪৩

হাদীসের কিতাবে এরকম ইনসাফেরনীতি ও শৃঙ্খলার অনেক উদাহরণ আছে।

বয়সের দিক থেকে যিনি বড়তাকে সম্মান করা কর্তব্য। জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দিক থেকে যিনি বড়তাকে সম্মান করা কর্তব্য। অর্থ-বিত্ত-সামাজিক সম্মানের দিক থেকে যিনি বড় তার হক আদায় করা কর্তব্য। তবে হ্যাঁএই সবকিছুই হবে শরীয়তের ঐ অকাট্য মূলনীতির আলোকে-

لا طاعة لمخلوق في معصية الله عز وجل

অর্থাৎ আল্লাহ পাকের নাফরমানী করে কারো আনুগত্য করা যাবে না। এটা শরীয়তের এক অকাট্য মূলনীতি। কারণ সকল বড়র বড় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। তাঁর হক সবার আগে। তাই তাঁর নাফরমানী করে কারো আনুগত্য করা যাবে না। এই মূলনীতির সীমার ভেতরে থেকেই সকল বড়র হক আদায় করতে হবে। 

যে পর্যন্ত আল্লাহ পাকের নাফরমানী না হয় ঐ পর্যন্ত তাদের আনুগত্য করা যাবে। যখনই আল্লাহ পাকের নাফরমানী এসে যাবে তখন কোনো বড়র আনুগত্য করার অবকাশ নেই। এমনকি পিতা-মাতারও না। সন্তানের উপর তো সবচেয়ে বেশি হক পিতা-মাতারই। পিতা-মাতা যদি মুশরিক হনপিতা-মাতা যদি সন্তানকে র্শিকে লিপ্ত হতে বলেনতাহলে কুরআন মাজীদের ঘোষণাএই ক্ষেত্রে তাঁদের আনুগত্য করা যাবে না। -সূরা লুকমান : ১৫ কারণ এখানে পিতা-মাতার আদেশ আর আল্লাহর আদেশএই দুই আদেশের মাঝে সংঘর্ষ হয়েছে। আর সংঘর্ষের ক্ষেত্রে আল্লাহ পাকের আদেশই অগ্রগণ্য করতে হবে। কারণ আল্লাহ তাআলা পিতা-মাতার চেয়েও বড়। আল্লাহ সবচেয়ে বড়।

ইসলামী শরীয়তের এই যে মূলনীতিপ্রত্যেকের সাথে যথার্থ আচরণ করাছোটর সাথে দয়া ও মমতার আচরণ আর বড়র সাথে সম্মান ও মর্যাদার আচরণইসলামের এই শিক্ষার অনুশীলন যদি করা যায় তাহলে একটি সুস্থ সুন্দর সুশৃঙ্খল সমাজ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। পক্ষান্তরে এই শিক্ষার ব্যতিক্রম করা হলেপরিবারিকসামাজিক শৃঙ্খলার সূত্রগুলো ছিন্ন করা হলেবড়র প্রতি শ্রদ্ধা ও মান্যতাছোটর প্রতি দয়া ও কল্যাণকামিতা তুলে দেওয়া হলেসেই সমাজ পরিণত হবে এক উশৃঙ্খল সমাজেএক শান্তিহীন সমাজে।

দেখুনপ্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে চেইন অব কমান্ড বলে একটা কথা আছে। এটা রক্ষা করা অতি জরুরি মনে করা হয়। এটা ভেঙ্গে পড়লে গোটা প্রতিষ্ঠানই ভেঙ্গে পড়ে। তো জীবন ও সমাজের সকল ক্ষেত্রেক্ষুদ্র সমাজবৃহৎ সমাজ সবক্ষেত্রেই একটি অদৃশ্য ধারা আছেসেই ধারা রক্ষা করা প্রয়োজন। নতুবা সমাজ ভেঙ্গে পড়েপরিবার ভেঙ্গে পড়ে। ছোটর প্রতি দয়া ও মমতা আর বড়র প্রতি সম্মান ও মান্যতা সেই অদৃশ্য ধারার মূলকথা।

বড়র প্রতি মান্যতার একটি দিক

বড়র প্রতি মান্যতার বিভিন্ন দিক ও ক্ষেত্র আছে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস শরীফে ঐসকল বিষয়ে দিকনির্দেশনা আছে। শুধু একটি দিক সম্পর্কে কিছু কথা বলি।

হাদীস শরীফে অতি গুরুত্বের সাথে বৃদ্ধ মুসলিমের মর্যাদা রক্ষার কথা বলা হয়েছে। যিনি বৃদ্ধপ্রবীণতাঁকে সম্মান করা ইসলামের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি শিক্ষা।

আমি শুরুতে সূরা মারইয়ামের কিছু আয়াত তিলাওয়াত করেছি। যাতে আল্লাহর নবী হযরত যাকারিয়া আলাইহিস সালামের একটি দুআ বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-

ذِكْرُ رَحْمَةِ رَبِّكَ عَبْدَهُ زَكَرِيَّا ، إِذْ نَادَى رَبَّهُ نِدَاءً خَفِيًّا ، قَالَ رَبِّ إِنِّي وَهَنَ الْعَظْمُ مِنِّي وَاشْتَعَلَ الرَّأْسُ شَيْبًا وَلَمْ أَكُنْ بِدُعَائِكَ رَبِّ شَقِيًّا

অর্থাৎএ হচ্ছে আপনার রবের দয়ার বৃত্তান্ত নিজ বান্দা যাকারিয়ার প্রতি। যখন তিনি তার রবকে ডাকলেন চুপে চুপে। তিনি বললেনপরওয়ারদেগার! আমার অস্থিসমূহ দুর্বল হয়ে পড়েছেআমার মাথায় বার্ধক্য ছড়িয়ে পড়েছে এবং আমি তো কখনোই আপনার নিকট প্রার্থনা করেহে পরওয়ারদেগার! ব্যর্থ হইনি। -সূরা মারইয়াম :২-৪

আরবীতে اشتعل মানে প্রজ্বলিত হওয়া। কুরআন বলছে-  وَاشْتَعَلَ الرَّأْسُ شَيْبًا আমার মাথায় বার্ধক্য প্রজ্বলিত হয়েছে। অর্থাৎ মাথার চুল সাদা হয়ে গিয়েছে। তো আল্লাহর নবী প্রার্থনার শুরুতে নিজ দুর্বলতা উপস্থাপন করছেন। আল্লাহর রহম-করম আকর্ষণ করার জন্য নিজ বার্ধক্য আল্লাহ পাকের দরবারে তুলে ধরেছেন। তাহলে বার্ধক্য এমন বিষয় যা দয়ার্দ্রতা দাবী করে। এর আরেকটি উদাহরণ দেখুন।

কুরআন মাজীদে আল্লাহ পাক পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করতে বলেছেন এবং পিতা-মাতার সাথে বিনীত আচরণের আদেশ দিয়েছেন। অথচ পিতা-মাতা হলেন বৃদ্ধসন্তান হল যুবক। পিতা-মাতার শক্তি নেইসন্তানের শক্তি আছে। বিনয়ী তো হয় দুর্বল শক্তিমানের সামনে! এখানে সন্তান শক্তিশালীপিতা-মাতা দুর্বল। তারপরও দুর্বল পিতা-মাতার সামনে যুবক সন্তান কেন বিনয়ী হবেআল্লাহ পাক বলেন-

واحفض لهما جناح الذل من الرحمة

অর্থাৎ দয়ার্দ্রতার কারণে বিনয়ী হবে। -সূরা বনী ইসরাঈল : ২৪

এক মানুষ আরেক মানুষের সামনে বিনীত হয় দুই কারণে : ভয়ের কারণে ও দয়ার কারণে। দুর্বল শক্তিমানের সামনে বিনীত হয় ভয়ের কারণে। সে ভাবেএ তো শক্তিশালীপ্রভাবশালী। তার সামনে উদ্ধত হলে সে আমার ক্ষতি করবে। তার ক্ষতি থেকে আত্মরক্ষার জন্য বিনয়ী হয়। এটা হল ভয়ের কারণে বিনয়ী হওয়া। এতে তেমন মাহাত্ম্য নেই। পক্ষান্তরে দয়ার্দ্রতার  কারণে যে বিনয়ীশক্তিসামর্থ্যঅর্থ-বিত্তকোনোকিছুতেই তার কোনো কমতি নেইকিন্তু দয়ার্দ্রতার কারণে সে বিনয়ী হয়এই ব্যক্তিই প্রকৃত বিনয়ী। এই বিনয় মাহাত্ম্যপূর্ণ। সুতরাং হে সন্তান! পিতা-মাতার প্রতি তুমি যে বিনয়ী হবে এটা মিনার রাহমাহ অন্তরের দয়ার্দ্রতা থেকে বিনয়ী হবে। তোমার অন্তর পিতা-মাতার প্রতি দয়ার্দ্র থাকা উচিত। তোমার মনে এই ভাব থাকা উচিতআহা! আমার আব্বা বৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন। আমার আম্মা বৃদ্ধা হয়ে পড়েছেন। তাঁরা কত সবল ছিলেনকত শক্তিশালী ছিলেনএখন কত দুর্বল হয়ে পড়েছেনজরাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। তো বিনয়ী হওয়ার একটি দিকদয়ার্দ্রতার কারণে বিনয়ী হওয়া।

বৃদ্ধ মুসলিমযার চুল দাড়ি সাদা হয়ে গেছে তার সামনে একজন যুবক বিনয়ী হবে তার ক্ষতির ভয়ে নয়দয়ার্দ্রতার কারণে। আর এ তো এক সাধারণ কথা। স্বভাবের কথা। দয়া-মায়া তো এক সাধারণ মানবীয় বৃত্তি। এ-ই যদি না থাকে তাহলে মানবে আর পশুতে পার্থক্য কী থাকেইসলাম মানুষের সুকুমারবৃত্তিসমূহের উৎকর্ষ সাধন করে।

তো বৃদ্ধকে সম্মান করা মানবিকতা। শুধু তা-ই নয়ইসলামের বার্ধক্য মহিমান্বিত। এক হাদীসে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

من شاب في الاسلام شيبة كانت له نورا يوم القيامة

যে ব্যক্তি ইসলামের মাঝে বাধর্ক্যে উপনীত হয়তার বার্ধক্য কিয়ামতের দিন তার জন্য নূর হবে। অন্য রেওয়ায়েতে  في الاسلام  -এর জায়গায় আছে في سبيل الله  আল্লাহর রাস্তায়। -জামে তিরমিযীহাদীস ১৬৩৪

একজন মুসলিম ঈমানের হালতে যখন বার্ধক্যে উপনীত হন তখন আল্লাহ পাকের কাছে এটা অতি মর্যাদার বিষয়। এই বার্ধক্যের মর্যাদা রক্ষা করা জরুরি।

আরেক হাদীসে আছেহযরত আবু মুসা আশআরী রা. আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন,

إن من إجلال الله عز وجل إكرام ذي الشيبة المسلم

আল্লাহ পাককে সম্মান করার একটি দাবীবৃদ্ধ মুসলিমকে সম্মান করা। -সুনানে আবূ দাউদহাদীস ৪৮৪৩

কোনো কোনো ধর্মে প্রাচীনত্বকে উপাস্যের মর্যাদা দেওয়া হয়। যে কোনো প্রাচীন স্থানপ্রাচীন বৃক্ষপ্রাচীন জলাশয়ঐ সকল ধর্মের অনুসারীদের মনে পূজা-অর্চনার প্রেরণা জাগ্রত করে এবং পূজা-অর্চনায় লিপ্ত করে। ইসলামে এ কুসংস্কারের স্থান নেই। ইসলামে উপাসনা একমাত্র আল্লাহর। আল্লাহ ছাড়া আর কারো উপাসনা নয়। অন্যদিকে কোনো কোনো মতবাদের আরেক প্রান্তিকতাঔদ্ধত্য-অশ্রদ্ধা। ইসলামে এরও স্থান নেই। ইসলামের শিক্ষা গুরুজন মান্যতারস্বাভাবিক বিনয়-নম্রতারসম্মান-শ্রদ্ধার।

তো একজন ব্যক্তি যখন ইসলামের হালতে দীর্ঘ জীবন অতিবাহিত করেন তখন তার আমলনামা অনেক সমৃদ্ধ। তাঁর জীবনে অনেক বরকতময় মুহূর্ত অতিবাহিত হয়েছে। অনেক বরকতপূর্ণ আমলের সৌভাগ্য তাঁর হয়েছে। আল্লাহ পাকের কাছে এর অনেক মূল্য।

হাদীসের কিতাবে একটি ঘটনা আছে। দুই সাহাবী ইন্তিকাল করেছেন। একজন শহীদ হয়েছেন। অপরজন এক বছর পর স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছেন। সাহাবায়ে কেরাম কোনো প্রসঙ্গে বললেনযিনি শহীদ হয়েছেন তাঁর মর্যাদা বেশি। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা শুনে বললেনতার এক বছরের নামাযরোযানেক-আমলদান-খয়রাতের কোনো হিসাবই তোমরা করলে না! -সুনানে আবু দাউদহাদীস ২৫২৪

এ হাদীসে একটি সূ² বিষয় পাওয়া যায়। আর তা হচ্ছেমানুষের আমলের মূল্য হয় দুইভাবে। এক. তার মানে। দুই. পরিমানে। যার আমল যত ইখলাসপূর্ণযত সুন্নাহসম্মতআল্লাহ পাকের দরবারে তার আমলের মূল্য তত বেশি। এটা আমলের মান। কিন্তু কারো আমলের মান বিচার করার সামর্থ্য কি মানুষের আছেকেউ কি জানেকার অন্তরের ইখলাস কতটুকুএটা জানার ক্ষমতা তো মানুষের নেই। হাঁমানুষ আমলের পরিমাণ ও বাইরের দিক বিচার করতে পারে। পরিমাণের দিক থেকে কার আমল বেশি কখনো কখনো এ ফায়সালা করতে পারে। তো হাদীস শরীফ যেন এদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছে যেতোমাদের বক্তব্য তো মানের ক্ষেত্রে হতে পারে না। তোমরা যে একজনের উপর অন্যজনকে প্রাধান্য দিচ্ছএকজনের চেয়ে অপরজনকে শ্রেষ্ঠ বলছএটা তো মানের দিক থেকে সম্ভব নয়। কারণ মানের দিক থেকে আল্লাহ পাকের দরবারে কার আমল বেশি মকবুল এটা তো কেউ বলতে পারে না। তোমাদের বক্তব্যটা হতে পারে পরিমাণের দিক থেকে। তাহলে যে এক বছর সময় বেশি পেয়েছেতার নামাযরোযাতার দান-খয়রাততার নেক আমলগুলো কেন হিসাব করা হবে না?

সুতরাং একজন ব্যক্তি ঈমানের হালতে বার্ধক্যে উপনীত হলে জীবনের দীর্ঘ সময় তাঁর আল্লাহ পাকের বন্দেগীতে কেটেছে। ইসলামের হালতেঈমানের হালতে অতিবাহিত হয়েছে। সুতরাং যার অন্তরে আল্লাহর ভয় আছেসে একজন বৃদ্ধ মুসলিমকে অসম্মান করতে পারে না।

তো ইসলাম বড়কে সম্মান করতে শেখায়ছোটকে দয়া ও মমতা করতে শেখায়। এ শিক্ষার অনুসরণ করে একটি সমাজ শান্তিপূর্ণ ও শৃঙ্খলাপূর্ণ হতে পারে। কিন্তু আমাদের চারপাশের বিভিন্ন অবস্থাআমাদের শিল্প-সংস্কৃতিআমাদের সাহিত্য-সাংবাদিকতা ইত্যাদির আহ্বান অনেক ক্ষেত্রেই এই স্বাভাবিক শিক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত। বিশেষত ইসলাম-সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলোতে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় বৃদ্ধ মুসলিমের প্রতি অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যের প্রবণতা এবং এর আহ্বান। এর অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। একটি খুব ছোট উদাহরণ দেখুন। একটি বহুল প্রচারিত দৈনিক পত্রিকায় নিয়মিত একটি কার্টুন আসে। হাস্য-রসের বিভিন্ন টুকরো ঘটনা নিয়ে সাধারণত কার্টুনটি প্রস্তুত হয়। ঐ কার্টুনে প্রায়ই একজন বৃদ্ধ মুসলিমের চরিত্র উপস্থাপন করা হয়যে কিনা বিভ্রান্তস্মৃতিলোপপ্রাপ্তনানা অসংলগ্ন আচরণের কারণে শিশু-কিশোরদের কাছেও হাস্যস্পদ। আর অবশ্যই তাঁর আছে শুভ্র দাড়িমাথায় টুপি!

প্রশ্ন হচ্ছেআমাদের সমাজের অধিকাংশ বৃদ্ধ মুসলিমই কি এরকমআমরা যখন ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে বৃদ্ধ মুসলিম কথাটি উচ্চারণ করি তখন তো আমাদের স্মৃতিতে ড. মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহর চেহারা ভেসে উঠেসৈয়দ আলী আহসানসৈয়দ আলী আশরাফের চেহারা ভেসে উঠে। ড. কাজী দ্বীন মুহাম্মাদের চেহারা ভেসে উঠে। এরকম আরো কত বিজ্ঞ ও জ্ঞানবৃদ্ধ ব্যক্তির চেহারা আমাদের স্মৃতিতে ভেসে উঠে। শ্মশ্রুমণ্ডিতটুপি পরিহিত বৃদ্ধমাত্রই কি মতিচ্ছন্নবুদ্ধি লোপপ্রাপ্ত?

নিঃসন্দেহে কার্টুন এ সময়ের এক বহুলব্যবহৃত বিনোদন-অনুষঙ্গ। কিন্তু কেউ যদি মনে করেনএটা নিছক বিনোদনএর কোনো বার্তা নেইআহ্বান নেইএর কোনো লক্ষ্য নেইউদ্দেশ্য নেইএর কোনো প্রভাব নেইপ্রতিক্রিয়া নেইতাহলে তিনি একজন সরল মানুষবরং অতি সরল মানুষ!

আমাদের সমাজে এভাবেই কিন্তু শৃঙ্খলার সূত্রগুলো ছিন্ন করা হচ্ছে। এভাবেই অল্পে অল্পে আমাদের মূল্যবোধগুলো ধ্বংস করা হচ্ছে। আমাদের খুব সাবধানতা প্রয়োজনসচেতনতা প্রয়োজন। চারপাশের আহ্বানগুলোকে খুব সতর্কভাবে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।

আল্লাহ পাক আমাদেরকে বোঝার ও আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →