প্রবন্ধ
ইয়াওমে আরাফা : গুরুত্ব ও ফযীলত, আরাফার রোযা কখন রাখবে?
এ দিন আল্লাহর কাছে অনেক মহিমান্বিত। এদিনেই আল্লাহ তাআলা এ দ্বীনকে পূর্ণতা দানের ঘোষণা দিয়েছেন এবং বান্দাদের প্রতি তাঁর নিআমতকে পূর্ণ করেছেন। এদিনেই হজ্বের মূল আমল উকূফে আরাফা। কুরআনে কারীমে আল্লাহ এ দিনের কসম করেছেন। এ দিনের দুআ আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠ দুআ। এ দিনের রোযার মাধ্যমে আল্লাহ বান্দার দুই বছরের গুনাহ মাফ করেন। এদিন আল্লাহ সবচেয়ে বেশি পরিমাণ বান্দাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন।
যে আয়াত নাযিল হয়েছে ইয়াওমে আরাফায়
আরাফার দিনেই ঐ আয়াত নাযিল
হয়েছে, যে আয়াতে আল্লাহ তাআলা এ দ্বীনের পূর্ণতাদানের ঘোষণা দিয়েছেন। তারেক ইবনে শিহাব বর্ণনা করেন, এক ইহুদী ওমর ইবনে খাত্তাব রা. কাছে এল এবং বলল-
يَا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ آيَةٌ فِي كِتَابِكُمْ تَقْرَءُونَهَا، لَوْ عَلَيْنَا نَزَلَتْ، مَعْشَر الْيَهُودِ، لَاتّخَذْنَا ذَلِكَ الْيَوْمَ عِيدًا، قَالَ: وَأَيّ آيَةٍ؟ قَالَ: اَلْیَوْمَ اَكْمَلْتُ لَكُمْ دِیْنَكُمْ وَ اَتْمَمْتُ عَلَیْكُمْ نِعْمَتِیْ وَ رَضِیْتُ لَكُمُ الْاِسْلَامَ دِیْنًا .
হে আমীরুল মুমিনীন! আপনাদের কিতাবে (কুরআনে) একটি আয়াত রয়েছে, উক্ত আয়াত যদি আমরা ইহুদীদের উপর নাযিল হত তাহলে আমরা ঐ দিনকে ঈদের দিন হিসেবে গ্রহণ করতাম। ওমর রা. জিজ্ঞেস করলেন, কোন্ আয়াত? সে তখন বলল-
اَلْیَوْمَ اَكْمَلْتُ لَكُمْ دِیْنَكُمْ وَ اَتْمَمْتُ عَلَیْكُمْ نِعْمَتِیْ وَ رَضِیْتُ لَكُمُ الْاِسْلَامَ دِیْنًا .
[আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার নিআমত পরিপূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম। -সূরা মায়েদা (৫) : ৩]
ওমর রা. বলেন-
إِنِّي لَأَعْلَمُ الْيَوْمَ الّذِي نَزَلَتْ فِيهِ، وَالْمَكَانَ الّذِي نَزَلَتْ فِيهِ، نَزَلَتْ عَلَى رَسُولِ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ بِعَرَفَاتٍ فِي يَوْمِ جُمُعَةٍ.
আমি খুব ভালো করে জানি, এ আয়াত কবে নাযিল হয়েছে, কোথায় নাযিল হয়েছে। এ আয়াত নাযিল হয়েছে এক জুমার দিন, আরাফায় (আশিয়্যাতা আরাফা-আরাফার বিকেলে)। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩০১৭; সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৮৮
ইয়াওমে আরাফায় বান্দাকে মুক্তি দেওয়া হয় জাহান্নাম থেকে
আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَا مِنْ يَوْمٍ أَكْثَرَ مِنْ أَنْ يُعْتِقَ اللهُ فِيهِ عَبْدًا مِنَ النّارِ، مِنْ يَوْمِ عَرَفَةَ، وَإِنّهُ لَيَدْنُو، ثُمّ يُبَاهِي بِهِمِ الْمَلَائِكَةَ، فَيَقُولُ: مَا أَرَادَ هَؤُلَاءِ؟
আরাফার দিনের মত আর কোনো দিন এত অধিক পরিমাণে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হয় না। আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার নিকটবর্তী হন এবং বান্দাদের নিয়ে ফিরিশতাদের সাথে গর্ব করেন। আল্লাহ বলেন, কী চায় তারা? -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৩৪৮
জাবের রা. থেকে বর্ণিত আরেক বর্ণনায় রয়েছে-
يَنْزِلُ اللهُ إِلَى السّمَاءِ الدّنْيَا فَيُبَاهِي بِأَهْلِ الْأَرْضِ أَهْلَ السّمَاءِ، فَيَقُولُ: انْظُرُوا إِلَى عبادي شعثا غبرا ضاحين، جاؤوا مِنْ كُلِّ فَجٍّ عَمِيقٍ يَرْجُونَ رَحْمَتِي، وَلَمْ يَرَوْا عَذَابِي، فَلَمْ يُرَ يَوْمٌ أَكْثَرُ عِتْقًا من النار من يوم عرفة.
আল্লাহ তাআলা নিকটতম আসমানে আসেন এবং পৃথিবীবাসীকে নিয়ে আসামেনর অধিবাসী অর্থাৎ ফিরিশতাদের সাথে গর্ব করেন। বলেন, দেখ তোমরা- আমার বান্দারা উস্কোখুস্কো চুলে, ধুলোয় মলিন বদনে, রোদে পুড়ে দূর-দূরান্ত থেকে এখানে সমবেত হয়েছে। তারা আমার রহমতের প্রত্যাশী। অথচ তারা আমার আযাব দেখেনি। ফলে আরাফার দিনের মত আর কোনো দিন এত অধিক পরিমাণে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হয় না। -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৩৮৫৩
আরাফার দুআ শ্রেষ্ঠ দুআ
ইয়াওমে আরাফায় যে দুআ-যিকির করেছেন নবীগণ
যিলহজ্বের দশকের মধ্যে ইয়াওমে আরাফা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ দিনে দুআ-যিকিরের গুরুত্ব আরো বেশি। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও নবীগণ এ দিনে যে দুআ-যিকির করেছেন তা হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
خَيْرُ الدّعَاءِ دُعَاءُ يَوْمِ عَرَفَةَ، وَخَيْرُ مَا قُلْتُ أَنَا وَالنَّبِيُّونَ مِنْ قَبْلِي: لَا إِلَهَ إِلّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ المُلْكُ وَلَهُ الحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ.
শ্রেষ্ঠ দুআ (-যিকির) আরাফার দুআ। এ দিনের দুআ-যিকির হিসেবে সর্বোত্তম হল ঐ দুআ, যা আমি এবং আমার পূর্ববর্তী নবীগণ করেছেন। তা হল-
لَا إِلَهَ إِلّا اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ المُلْكُ وَلَهُ الحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
-জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৫৮৫; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৩৭৭৮
#মাসিক আল কাউসার, জুলাই ২০১৯
আমাদের দেশের চাঁদের হিসেবে যেদিন নয় যিলহজ্ব হবে সেদিনই রোযা রাখা হবে। সৌদি আরবের সাথে মিল রেখে নয়। সেমতে এ বছর নয় যিলহজ্বের রোযা আগামী ৯ জুলাই শনিবার হবে।
নয় যিলহজ্বের রোযার ফযীলত সম্পর্কে আবু কাতাদা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ، أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السّنَةَ الّتِي قَبْلَهُ، وَالسّنَةَ الّتِي بَعْدَهُ.
আরাফার দিনের (নয় যিলহজ্বের) রোযার বিষয়ে আমি আল্লাহর কাছে প্রত্যাশা করি যে, (এর দ্বারা) আগের এক বছরের এবং পরের এক বছরের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দিবেন।-সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬২
প্রকাশ থাকে যে, উক্ত হাদীসে বর্ণিত ইয়াওমে আরাফা দ্বারা যিলহজ্বের নয় তারিখ উদ্দেশ্য। এই তারিখের পারিভাষিক নাম হচ্ছে ইয়াওমে আরাফা। কেননা এই রোযা আরাফার ময়দানের আমল নয় বরং আরাফার দিন তো হাজ্বীদের জন্য রোযা না রাখাই মুস্তাহাব। হাদীস শরীফে এসেছে-
عَنْ أُمِّ الْفَضْلِ بِنْتِ الْحَارِثِ،أَنّ نَاسًا تَمَارَوْا عِنْدَهَا يَوْمَ عَرَفَةَ، فِي صِيَامِ رَسُولِ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ، فَقَالَ بَعْضُهُمْ: هُوَ صَائِمٌ، وَقَالَ بَعْضُهُمْ: لَيْسَ بِصَائِمٍ، فَأَرْسَلْتُ إِلَيْهِ بِقَدَحِ لَبَنٍ، وَهُوَ وَاقِفٌ عَلَى بَعِيرِهِ بِعَرَفَةَ، فَشَرِبَهُ.
উম্মুল ফযল বিনতে হারেছ বলেন, তার নিকট কতক লোক ইয়াওমে আরাফায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রোযার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করছিল। কেউ কেউ বলছিল, তিনি রোযা আছেন। আর কেউ কেউ বলছিল, তিনি রোযা নেই। উম্মুল ফযল একটি পেয়ালাতে দুধ পাঠালেন। নবীজী তখন উটের উপর ছিলেন। তিনি দুধ পান করলেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১২৩
আরাফার দিন আল্লাহর রাসূল রোযা রাখেননি। একারণে ফকীহগণ হাজ্বীদের জন্য আরাফার দিন রোযা না রাখা উত্তম বলেছেন। আবু কাতাদা রা.-এর হাদীস দ্বারা ইয়াওমে আরাফায় রোযা রাখা মুস্তাহাব প্রমাণিত হয়।
সুতরাং বুঝা গেল, আবু কাতাদাহ রা.-এর হাদীসে ‘ইয়াওমে আরাফা’ দ্বারা নয় যিলহজ্ব অর্থাৎ ঈদের আগের দিনই উদ্দেশ্য।
সুতরাং আমাদের দেশের চাঁদের হিসেবে যেদিন নয় তারিখ হয় সেদিনই রোযা রাখা হবে। সৌদির হিসাবে আরাফার দিন অনুযায়ী নয়। উল্লেখ্য, তাকবীরে তাশরীক সংক্রান্ত হাদীসেও ইয়াওমে আরাফা দ্বারা নয় যিলহজ্বই উদ্দেশ্য। কেননা এ আমলও আরাফার সাথে নির্দিষ্ট কোনো আমল নয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, মাসিক আলকাউসার, জানুয়ারি ২০১৩ ঈ. (দুটি প্রশ্ন ও তার উত্তর : ইয়াওমে আরাফার রোযা ও কুরবানীর সাথে আকীকা)
‘ইয়াওমে আরাফা’ অর্থ নয় জিলহজ্ব। এটিই সঠিক ব্যাখ্যা। কারণ এই রোযা আরাফা বা উকুফে আরাফার আমল নয়; তা ঐ তারিখের আমল। ‘ইয়াওমে আরাফা’ হচ্ছে ঐ তারিখের (নয় যিলহজ্বের) পারিভাষিক নাম। যেহেতু ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ রোকন হজ্বের প্রধান রোকন উকুফে আরাফা ঐ স্থানের তারিখ হিসাবে নয় যিলহজ্বে আদায় করা হয় তাই এ তারিখেরই নাম পড়ে গেছে ‘ইয়াওমে আরাফা’। একারণে যেসব আমল আরাফা বা উকূফে আরাফার সাথে বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট নয়; বরং যিলহজ্বের নয় তারিখের সাথে সংশ্লিষ্ট, সেগুলোকেও ‘ইয়াওমে আরাফা’র আমল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। উদ্দেশ্য, নয় তারিখে বা ঈদের আগের দিন আমলটি করতে হবে।
এ প্রয়োগের কারণে (নয় যিলহজ্বকে ‘ইয়াওমে আরাফা’ বলা) আরাফা ও তার নিকটবর্তী অঞ্চলে তো কোনো বিভ্রান্তি হয় না, কিন্তু দূরত্বের কারণে ঐ অঞ্চলের সাথে যেসব অঞ্চলের তারিখের পার্থক্য হয় সেখানে-যারা এই প্রয়োগের সঠিক অর্থ সম্পর্কে অবগত নয় তাদের-বিভ্রান্তি ঘটে। যেমনটা প্রশ্নোক্ত ক্ষেত্রে ঘটেছে।
এ প্রয়োগের (ইয়াওমে আরাফা অর্থ নয় যিলহজ্ব) আরেকটি দৃষ্টান্ত ‘তাকবীরে তাশরীক’। এটি আরাফা বা উকুফে আরাফার বিশেষ আমল নয়। এটি শুরু হয় নয় যিলহজ্ব ফজর থেকে, অথচ যে দলীল দ্বারা নয় তারিখ থেকে তাকবীরে তাশরীক শুরু হওয়া প্রমাণিত তাতেও ‘ইয়াওমে আরাফা’ শব্দই আছে। দলীলের আরবী পাঠ এই-
عن علي رضي الله عنه : أنه كان يكبر بعد صلاة الفجر يوم عرفة، إلى صلاة العصر من آخر أيام التشريق، ويكبر بعد العصر.
رواه ابن أبي شيبة في مصنفه وإسناده صحيح كما في الدراية.
আলমুসান্নাফ, ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ৫৬৭৭, ৫৬৭৮
এখানেও কি ‘ইয়াওমে আরাফা’ অর্থ নয় যিলহজ্ব করা ভুল?
দ্বিতীয়ত, গোটা মুসলিম উম্মাহর ইজমা আছে যে, ইয়াওমে আরাফার পরের দিনটিই ইয়াওমুন নাহর।
এটি প্রমাণ করে, ‘ইয়াওমে আরাফা’ একটি তারিখের নাম, আর তা হচ্ছে নয় যিলহজ্ব, যেমন ‘ইয়াওমুন নাহর’ একটি তারিখের নাম, আর তা হচ্ছে দশ যিলহজ্ব। কোনো অঞ্চলের অধিবাসীরা যদি ঐ অঞ্চলের তারিখ অনুযায়ী ইয়াওমুন নাহরের অর্থ দশ জিলহজ্ব ধরে ইয়াওমে আরাফার এমন কোনো অর্থ করেন, যদ্বারা সেখানের তারিখ হিসেবে তা হয়ে যায় আট যিলহজ্ব, তাহলে সেটা হবে এক উদ্ভট, হাস্যকর ও ইজমা বিরোধী কথা। কারণ ইয়াওমে আরাফা ও ইয়াওমুন নাহরের মাঝে আরেকটি দিন স্বীকার করে নেওয়া ইজমার সরাসরি বিরোধী।
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
হুসনুল খাতিমা বা সুন্দর মৃত্যুর জন্য ১০ আমল
একজন মুমিনের মূল গন্তব্য আখেরাতপানে। দুনিয়ার সময়টা তার জন্য সামুদ্রিক-ভ্রমণের মত। তার সময় কিংবা জ...
ইস্তেগফার : সকল সমস্যার সমাধান
নিজের জীবনেও বহুবার আমি দেখেছি। কোনো বিপদে পড়লে বেশি করে আস্তাগফিরুল্লাহ পড়েছি, আল্লাহ তাআলা এমনভাবে...
তাহাজ্জুদ : আল্লাহ তাআলার প্রিয় হওয়ার আমল
অন্য সময়ের ইবাদতে আমরা আল্লাহ তাআলাকে পাওয়ার চেষ্টা করি, আর রাতের শেষ প্রহরে স্বয়ং আল্লাহ বান্দাক...