প্রবন্ধ

শাবান ও রমযান মাস ॥ গুরুত্ব ও ফযীলত, করণীয় ও বর্জনীয়

লেখক:মাসিক আলকাউসার
৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫
২৯৩৮৪ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

শাবান ও রমযান উভয়টিই গুরুত্ববহ ও ফযীলতপূর্ণ মাস। রমযানের গুরুত্ব তো প্রায় সকলেই বোঝেন। কিন্তু শাবান মাসের গুরুত্ব সম্পর্কে হয়তো কেউ কেউ যথাযথ ওয়াকিফহাল নন। শাবান মাসকেও নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গুরুত্ব দিতেন। গুরুত্বের সাথে রোযা রাখতেন এবং অন্যান্য আমল করতেন। এ নিবন্ধে শাবান ও রমযান উভয় মাসের গুরুত্বতাৎপর্য ও ফযীলত নিয়ে আলোচনা করা হবে। পাশাপাশি করণীয়-বর্জনীয় বিষয়েও কিঞ্চিৎ আলোকপাত থাকবে ইনশাআল্লাহ।

শাবান মাসের গুরুত্ব

শাবান মাস আল্লাহর দরবারে বান্দাদের আমলনামা পেশ হওয়ার মাস

আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে আছেনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযান ছাড়া শাবান মাসে সর্বাধিক রোযা রাখতেন। আয়েশা রা. বলেন

فَمَا رَأَيْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اسْتَكْمَلَ صِيَامَ شَهْرٍ إِلَّا رَمَضَانَ، وَمَا رَأَيْتُه أَكْثَرَ صِيَامًا مِنْهُ فِي شَعْبَانَ.

আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রমযান ছাড়া অন্য কোনো মাসে পূর্ণ মাস রোযা রাখতে দেখিনি। আর আমি তাঁকে (রমযান ছাড়া) শাবান মাস অপেক্ষা অধিক রোযা রাখতে আর কোনো মাসে দেখিনি। সহীহ বুখারীহাদীস ১৯৬৯

আয়েশা রা. থেকেই বর্ণিত অপর এক হাদীসে আছে

كَانَ أَحَبُّ الشُّهُورِ إِلَى رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَنْ يَصُومَه شَعْبَانَ.

রোযা রাখার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে সর্বাধিক প্রিয় মাস ছিল শাবান মাস। মুসনাদে আহমাদহাদীস ২৫৫৪৮সুনানে আবু দাউদহাদীস ২৪৩১

এ হাদীসদ্বয় বলছেরোযা রাখার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে শাবান মাস সর্বাধিক প্রিয় ছিলতাই তিনি রমযান মাস ব্যতীত এ মাসেই সবচেয়ে বেশি রোযা রাখতেন। কিন্তু কেন তিনি শাবান মাসে এত বেশি রোযা রাখতেন?

এর উত্তর পাওয়া যাবে উসামা বিন যায়েদ রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে। ওই হাদীস থেকে শাবান মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্যের বিষয়টিও পরিষ্কার হয়ে যাবে। উসামা বিন যায়েদ রা. বলেন,

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (রমযান ছাড়া) শাবান মাসে যত রোযা রাখতেন অন্য কোনো মাসেই এত রোযা রাখতেন না।

উসামা বিন যায়েদ রা. বলেনআমি (একবার) বললাম

وَلَمْ أَرَكَ تَصُومُ مِنْ شَهْرٍ مِنَ الشُّهُورِ مَا تَصُومُ مِنْ شَعْبَانَ.

আমি আপনাকে কোনো মাসেই এত রোযা রাখতে দেখিনিশাবান মাসে আপনি যত রোযা রাখেন?

এ প্রশ্নের উত্তরে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন

ذَاكَ شَهْرٌ يَغْفُلُ النَّاسُ عَنْهُ بَيْنَ رَجَبٍ وَرَمَضَانَ، وَهُوَ شَهْرٌ تُرْفَعُ فِيهِ الْأَعْمَالُ إِلَى رَبِّ الْعَالَمِينَ فَأُحِبُّ أَنْ يُرْفَعَ عَمَلِي وَأَنَا صَائِمٌ.

শাবান হল রজব ও রমযানের মধ্যবর্তী মাস। এ মাস সম্পর্কে (অর্থাৎ এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে) মানুষ গাফেল থাকে। শাবান হল এমন মাসযে মাসে রব্বুল আলামীনের কাছে (বান্দার) আমল পেশ করা হয়। আমি চাইরোযাদার অবস্থায় আমার আমল (আল্লাহর দরবারে) পেশ হোক। মুসনাদে আহমাদহাদীস ২১৭৫৩সুনানে নাসায়ীহাদীস ২৩৫৭মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবাহাদীস ৯৮৫৮

শাবান মাসের প্রতি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেন এত গুরুত্বারোপ করতেনএই হাদীসে তিনি তা খুলে বলেছেন। তাঁর কথার মর্ম হলএই মাসে বান্দার আমল আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়। কাজেই এ মাসটি গুরুত্বের দাবিদার। তাছাড়া সামনে রমযান আসছেফযীলতপূর্ণ মাস হিসেবে রমযানকে গুরুত্ব প্রদান করা হয়। শাবান মাসের আগে রজব মাস আছেরজব মাস পবিত্র চার মাসের(১) একটিতাই রজব মাসকেও গুরুত্ব প্রদান করা হয়। মাঝখানে শাবানের ব্যাপারে গাফলতি হয়ে যায়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সতর্ক করলেন যেদেখোএকটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে এই মাসটিও গুরুত্বের দাবিদার। এ মাসে বান্দার গোটা বছরের আমলনামা আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়। তাই শাবান আল্লাহর দরবারে আমলনামা পেশ হওয়ার মাস। কাজেই এই মাসেরও যথাযথ কদর করা চাই। এ কারণেই আমি এ মাসে এত রোযা রাখি(২)

ইমাম ইবনে রজব রাহ. এই হাদীস সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে একটি গভীর বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি বলেছেন, (মর্ম) : এই হাদীসে এই ইঙ্গিত রয়েছে যেকখনো কোনো একটা সময়ব্যক্তি বা  স্থানের ফযীলত প্রসিদ্ধ হয়ে যায়তখন সবাই সেই প্রসিদ্ধ স্থানকালপাত্র নিয়েই ব্যস্ত থাকে। অথচ ভিন্ন বিবেচনায় অন্য কোনো স্থানকালপাত্র সেই প্রসিদ্ধ স্থানকালপাত্রের চেয়েও উত্তম হতে পারে। কিন্ত অনেকে সেদিকে লক্ষ করে না। লাতায়েফুল মাআরিফপৃ. ২৫১

সুতরাং একাধিক ফযীলতের কারণে যেভাবে রমযান মাসকে গুরুত্ব প্রদান করা হয় এবং পবিত্র মাস হিসেবে আশহুরে হুরুম বা পবিত্র চার মাসকে যেভাবে গুরুত্ব প্রদান করা হয়তেমনি সারা বছরের আমলনামা পেশ হওয়ার মাস হিসেবে শাবান মাসকেও যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করা কর্তব্য। আর এই গুরুত্ব প্রদান করার উপায় হলসবধরনের গুনাহ থেকে বেঁচে থেকে নেক আমলের প্রতি যত্নবান হওয়া। শাবান মাসের অধিকাংশ দিন রোযা রেখে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে এই নির্দেশনাই দিয়ে গেছেন।

প্রসঙ্গতএখানে উল্লেখ করে দেওয়া প্রয়োজনসহীহ হাদীসে আছেআল্লাহর দরবারে প্রতিদিন বান্দাদের আমলনামা পেশ করা হয়। দিনের আমলনামা রাতে আর রাতের আমলনামা দিনে পেশ করা হয়। (দ্র. সহীহ মুসলিমহাদীস ১৭৯) এটি হল প্রতিদিনের আমলনামা। অপর একটি সহীহ হাদীসে আছে যেসপ্তাহে সোমবার ও বৃহস্পতিবার আমলনামা পেশ করা হয়। (দ্র. সহীহ মুসলিমহাদীস ২৫৬৫) এটি হল সাপ্তাহিক আমলনামা। আর একবার পেশ করা হয় বাৎসরিকভাবে। সেটা হল শাবান মাসে। এখানে সেটার কথাই বলা হয়েছে। (দ্র. লাতায়েফুল মাআরেফপৃ. ২৪৪)

শাবান মাসের রোযা

উপরিউক্ত বর্ণনাসমূহ থেকে স্পষ্ট যেনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর দরবারে আমলনামা পেশ করা হবেএ বিষয়টির প্রতি গুরুত্বারোপ করে শাবান মাসে সর্বাধিক রোযা রাখতেন। তাই শাবান মাসে অন্যান্য নেক আমলের পাশাপাশি সামর্থ্য অনুযায়ী রোযা রাখার চেষ্টা করা কর্তব্য। কিন্তু রোযা রাখবে শাবান মাসের ২৭ তারিখ পর্যন্ত। হাদীসে রমযানের এক-দুই দিন আগে রোযা রাখতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। (দ্র. সহীহ বুখারীহাদীস ১৯১৪)

লাইলাতুন নিসফি মিন শাবানের ফযীলত

শাবান মাসের একটি ফযীলত হলঅর্ধ-শাবানের রাত। অর্থাৎ চৌদ্দ শাবান দিবাগত রাত। এ রাতের বিশেষ ফযীলতের কথা বর্ণিত হয়েছে। একটি হাদীসে আছেনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন

يَطَّلِعُ اللهُ إِلَى خَلْقِهِ فِي لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِجَمِيعِ خَلْقِهِ إِلَّا لِمُشْرِكٍ أَوْ مُشَاحِنٍ.

আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে  সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেনঅতঃপর তিনি তার সকল সৃষ্টিকে ক্ষমা করে দেনকেবল শিরককারী ও বিদ্বেষপোষণকারী ব্যতীত (এই দুই শ্রেণিকে ক্ষমা করেন না)। সহীহ ইবনে হিব্বানহাদীস ৫৬৬৫শুআবুল ঈমানবাইহাকী ৩/৩৮২হাদীস ৩৮৩৩

قال البيهقيوقد روينا هذا من أوجه، وفي ذلك دلالة على أن للحديث أصلا من حديث مكحول.

এই হাদীসটি নির্ভরযোগ্য ও আমলযোগ্য। ইমাম ইবনে হিব্বানইমাম যাকীউদ্দীন মুনযিরীযাইনুদ্দীন ইরাকী প্রমুখ হাদীস বিশারদ ইমামগণ হাদীসটিকে নির্ভরযোগ্য বলে মতামত দান করেছেন। (দ্র. সহীহ ইবনে হিব্বানহাদীস ৫৬৬৫আততারগীব ওয়াত তারহীব ২/১১৮শরহুল মাওয়াহেব ৭/৪১২)

এই হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী অর্ধ-শাবানের রাতে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে সবার জন্য রহমত ও মাগফিরাতের দ্বার উন্মুক্ত করা হয়। কেবল শিরকে লিপ্ত ব্যক্তি এবং অন্যের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া সবাই এই মাগফিরাত ও রহমত প্রাপ্ত হয়।

কোনো বিশেষ সময়ের ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত ও মাগফিরাতের ঘোষণা আসলে করণীয় হলসেই সময়ে সকল গুনাহ থেকে বিরত থেকে নেক আমলের প্রতি যত্নবান হওয়াযেন আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাতের উপযুক্ত হওয়া যায়।

এ হাদীস ও অন্যান্য হাদীসে মাগফিরাতের ঘোষণা থাকার কারণে বহু আগ থেকেই গুনাহ মুক্তির রাত হিসেবে এ রাতকে শবে বরাত তথা মুক্তির রজনী’ নামে অভিহিত করা হয়। কাজেই এ রাতে গুনাহ মুক্তির জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা কাম্য। পাশাপাশি অধিক নেক আমল ও দুআ-ইস্তিগফারের মাধ্যমে আল্লাহর মাগফিরাত ও রহমত প্রাপ্তির ঐকান্তিক চেষ্টা করাও কর্তব্য।

এ সম্পর্কে আরেকটি হাদীস

হযরত আলা ইবনুল হারিস রাহ. থেকে বর্ণিতআয়েশা রা. বলেনএকবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে নামাযে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সিজদা করেন যেআমার ধারণা হলতিনি হয়তো মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সিজদা থেকে উঠলেন এবং নামায শেষ করলেনআমাকে লক্ষ করে বললেনহে আয়েশা অথবা বলেছেনহে হুমাইরাতোমার কি এই আশঙ্কা যেআল্লাহর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেনআমি উত্তরে বললামনাইয়া রাসূলাল্লাহ। আপনার দীর্ঘ সিজদা থেকে আমার এই আশঙ্কা হয়েছিলআপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না। নবীজী জিজ্ঞেস করলেনতুমি কি জানোএটা কোন্ রাতআমি বললামআল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন ইরশাদ করলেন

এটা হল অর্ধ-শাবানের রাত (শাবানের চৌদ্দ তারিখের দিনগত রাত)। আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে তাঁর বান্দাদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেন এবং ক্ষমপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষপোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই। শুআবুল ঈমানবাইহাকী ৩/৩৮২-৩৮৬

ইমাম বাইহাকী রাহ. এই হাদীসটি বর্ণনার পর এর সনদের ব্যাপারে বলেছেন

هذا مرسل جيد.

শবে বরাতের আমল

উপরোক্ত হাদীসে দীর্ঘ নফল নামাযদীর্ঘতম সময় সিজদা করার কথা আছে।  সুতরাং এ রাতে নফল নামাযসহ অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগীর প্রতি যত্নবান হওয়া কাম্য। যেমন নফল নামাযের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী দুই রাকাত করে যত রাকাত সম্ভব পড়তে থাকাকুরআন কারীম তিলাওয়াত করাদরূদ শরীফ পড়াতওবা-ইস্তেগফার করাদুআ করা এবং কিছুটা ঘুমের প্রয়োজন হলে ঘুমিয়ে নেওয়া। এমন যেন না হয় যেসারা রাতের দীর্ঘ ইবাদতের ক্লান্তিতে ফজরের নামায জামাআতের সাথে পড়া সম্ভব হল না।  খেয়াল রাখতে হবেফরয নামাযে যেন কোনোরূপ শৈথিল্য না হয়। কারণফরয ইবাদতের গুরুত্ব সর্বাবস্থায় নফল ইবাদতের চেয়ে বেশি।

একটি বিষয় মনে রাখতে হবেঅনেক অনির্ভরযোগ্য ওযীফার বই-পুস্তকে এই রাতে নামাযের যে নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন লেখা আছেযেমন এত রাকাত হতে হবেপ্রতি রাকাতে এই সূরা এতবার পড়তে হবে ইত্যাদিএগুলো ঠিক নয়। বরং স্বাভাবিকভাবে যেকোনো সূরা দিয়ে দুই রাকাত করে নফল নামায পড়বে। (দ্রষ্টব্য : আলআছারুল মারফূআআবদুল হাই লাখনোভীপৃ. ৮০-৮৫)

এ রাতের করণীয় সম্পর্কে ইমাম ইবনে রজব রাহ. বলেছেন, (মর্ম) মুমিনের কর্তব্য এই যেএ রাতে খালেস দিলে তওবা করে যিকিরদুআ ও ইস্তেগফারের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে। যত্নের সঙ্গে নফল নামায পড়বে। সওয়াব লাভের আশা নিয়ে পনেরো তারিখের রোযাও রাখবে। কেননা কখন মৃত্যু এসে যায় বলা যায় না। তাই কল্যাণের মওসুম শেষ হওয়ার আগেই তার মূল্য দেওয়া কর্তব্য। তবে অত্যন্ত জরুরি বিষয় হলওইসব গুনাহ থেকে বেঁচে থাকাযেগুলো এ রাতের সাধারণ ক্ষমা ও দুআ কবুল হওয়া থেকে মানুষকে বঞ্চিত করে দেয়। যথা : শিরকহত্যাবিদ্বেষ। এগুলো সবই কবীরা গুনাহ। আর বিদ্বেষ তো এতই গর্হিত বিষয় যেএটা অধিকাংশ সময়ই মানুষকে আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।

যেকোনো মুসলমান সম্পর্কেই বিদ্বেষ পোষণ করা অত্যন্ত মন্দ প্রবণতা। তবে সাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে সালেহীন সম্পর্কে অন্তরে বিদ্বেষ বিদ্যমান থাকা অত্যন্ত ভয়াবহ ও গর্হিত অপরাধ। এজন্য মুসলমানদের কর্তব্য হলসর্বদা অন্তরকে পরিষ্কার রাখা এবং হিংসা-বিদ্বেষ থেকে পাক-পবিত্র রাখা। বিশেষত উম্মাহ্র পূর্বসূরি ব্যক্তিদের সম্পর্কে অন্তর পুরোপুরি পরিষ্কার থাকা অপরিহার্যযাতে রহমত ও মাগফিরাতের সাধারণ সময়গুলোতে বঞ্চিত না হতে হয়।’ লাতাইফুল মাআরিফপৃ. ২৬৫

এ রাতের নফল আমলসমূহ সম্মিলিত নয়ব্যক্তিগত

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলএ রাতের নফল আমলসমূহবিশুদ্ধ মতানুসারে একাকীভাবে করণীয়। ফরয নামায তো অবশ্যই মসজিদে আদায় করতে হবে। এরপর যতটুকু নফল পড়ার তা নিজ নিজ ঘরে একাকী পড়বে। এসব নফল আমলের জন্য দলে দলে মসজিদে এসে সমবেত হওয়ার কোনো প্রমাণ হাদীস শরীফেও নেই আর সাহাবায়ে কেরামের যুগেও এর রেওয়াজ ছিল না। (দ্র. ইক্তিযাউস সিরাতিল মুসতাকীম ২/৬৩১-৬৪১মারাকিল ফালাহপৃ. ২১৯)

তবে কোনো আহ্বান ও ঘোষণা ছাড়া এমনিই কিছু লোক যদি মসজিদে এসে যায়তাহলে প্রত্যেকে নিজ নিজ আমলে মশগুল থাকবেএকে অন্যের আমলের ব্যাঘাত সৃষ্টির কারণ হবে না।

কোনো কোনো জায়গায় এই রেওয়াজ আছে যেএ রাতে মাগরিব বা এশার পর থেকেই ওয়াজ-নসীহত আরম্ভ হয়। আবার কোথাও ওয়াজের পর মিলাদ-মাহফিলের অনুষ্ঠান হয়। কোথাও তো সারা রাত খতমে-শবীনা হতে থাকে। উপরন্তু এ সবকিছুই করা হয় মাইকে এবং বাইরের মাইকও ছেড়ে দেওয়া হয়।

মনে রাখতে হবেএ সবকিছুই ভুল রেওয়াজ। এ রাতে মাইক ছেড়ে দিয়ে বক্তৃতা-ওয়াজের আয়োজন করা ঠিক নয়। এতে না ইবাদতে আগ্রহী মানুষের পক্ষে ঘরে বসে একাগ্রতার সাথে ইবাদত করা সম্ভব হয়আর না মসজিদে। অসুস্থ ব্যক্তিদের বিশ্রামেও মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে। আল্লাহ আমাদের এসব ভুল কাজকর্ম পরিহার করার তাওফীক দিন।

এ রাতের আপত্তিকর কাজকর্ম

এছাড়া এ রাতে বেশ কিছু আপত্তিকর কাজকর্মও দেখা যায়। যেমনমসজিদঘর-বাড়ি বা দোকানপাটে আলোকসজ্জা করাপটকা ফুটানোআতশবাজিকবরস্থান ও মাযারে ভিড় করাকবরস্থান ও মাযারে আলোকসজ্জা করামহিলাদের বিনাপ্রয়োজনে ঘরের বাইরে যাওয়াবিশেষত বেপর্দা হয়ে দোকানপাটমাযার ইত্যাদিতে ভিড় করাতরুণ ও যুবক ছেলেদের সারারাত শহরের অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়ানোহৈ-হুল্লোড় করাএসব কিছুই আপত্তিকর কাজ। শায়েখ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহ. বলেনএই রাতের নিকৃষ্ট বেদআতসমূহের মাঝে নিচের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্তঘর-বাড়িদোকানপাট আলোকসজ্জা করাহৈ চৈ ও আতশবাজির উদ্দেশ্যে সমবেত হওয়া ইত্যাদি। এগুলো সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং এগুলোর স্বপক্ষে কোনো জাল রেওয়ায়েতও পাওয়া যায় না। সম্ভবত হিন্দুদের দেওয়ালী’ প্রথা থেকে তা গ্রহণ করা হয়েছে। মা ছাবাতা বিস সুন্নাহপৃ. ৩৫৩-৩৬৩

শবে বরাতে কৃত কিছু কাজ তো অন্য সময়েও হারাম। আর কিছু কাজ আছেযা অন্য সময় করা জায়েযকিন্তু শবে বরাতে সেগুলোর পেছনে পড়ে শবে বরাতের আমল থেকে বঞ্চিত হওয়া কিছুতেই ঠিক নয়। যেমন খিচুড়ি বা হালুয়া-রুটি রান্না করে নিজেরা খাওয়া বা গরিবদের খাওয়ানো। সাধারণ সময়ে এগুলো করা জায়েয। কিন্তু শবে বরাতে এগুলোর পেছনে পড়ে শবে বরাতের মূল কাজ তওবা-ইস্তেগফারনফল ইবাদত প্রভৃতি থেকে বঞ্চিত থাকা একেবারেই ঠিক নয়। বস্তুত এগুলোও শয়তানের এক প্রকারের ধোঁকামানুষকে মূল কাজ থেকে বিরত রাখার জন্য শয়তান এসব কাজকর্মে মানুষকে ব্যস্ত করে দেয়।

শবে বরাতের পরের দিন শাবান মাসের ১৫ তারিখের রোযা

শবে বরাতের পরের দিন শাবান মাসের ১৫ তারিখ। এ দিন অনেকে রোযা রেখে থাকেন। এ সম্পর্কে একটি বিষয় জেনে রাখা প্রয়োজন। প্রতি চান্দ্র মাসে তিন দিন রোযা রাখা সুন্নত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও প্রতি মাসে তিন দিন রোযা রাখতেনসাহাবীগণকেও মাসে তিন দিন রোযা রাখতে বলতেন। (দ্র. জামে তিরমিযীহাদীস ৭৬০৭৬৩)

সে হিসেবে মাসে তিন দিন রোযা রাখা সুন্নাত। এই তিন দিন মাসের শুরুতেও হতে পারেমাঝেও হতে পারেআবার শেষেও হতে পারে। কিন্তু কিছু কিছু হাদীসে স্পষ্ট আছে যেনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরকে বিশেষভাবে মাসের ১৩১৪১৫ তারিখ (যাকে আইয়ামে বীয বলা হয়) রোযা রাখতে বলেছেন। (দ্র. জামে তিরমিযীহাদীস ৭৬১সুনানে আবু দাউদহাদীস ২৪৪৯ফাতহুল বারী১৯৮১ নং হাদীসের আলোচনা)

এই হাদীসগুলোর ওপর ভিত্তি করে হাফেয ইবনে হাজার রাহ. বলেছেনযে তিন দিনের কথা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে গেছেনসেই তিন দিন রোযা রাখাই সর্বোত্তম। (দ্র. ফাতহুল বারী১৯৮১ নং হাদীসের আলোচনা)

সে হিসেবে প্রতি মাসের আইয়ামে বীযে রোযা রাখা সুন্নত। শাবান মাসও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই শাবান মাসের আইয়ামে বীযে (১৩১৪১৫) রোযা রাখাও সুন্নত। ১৫ তারিখ আইয়ামে বীযের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে ১৫ তারিখ রোযা রাখাও সুন্নত।

বাকি থাকল একটি বর্ণনায় বিশেষভাবে ও পৃথকভাবে ১৫ শাবান রোযা রাখার কথা বর্ণিত হয়েছে। (দ্রষ্টব্য : সুনানে ইবনে মাজাহবর্ণনা ১৩৮৪) কিন্তু বর্ণনাটি শাস্ত্রীয় বিচারে দুর্বল। শাস্ত্রীয় বিচারে দুর্বল হওয়ার কারণে কেবল এই বর্ণনার ওপর ভিত্তি করে ১৫ শাবানের রোযাকে পৃথকভাবে সুন্নত কিংবা মুস্তাহাব মনে করা সঠিক নয় বলে মতামত দিয়েছেন মুহাক্কিক আলেমগণ।

তবেযেমনটি পূর্বে বলা হল১৫ তারিখ আইয়ামে বীযের অন্তর্ভুক্তএ হিসেবে এই দিনের রোযাকে (১৩ ও ১৪ তারিখের রোযাসহ) নিঃসন্দেহে সুন্নত মনে করা যাবে।

মোটকথাসর্বাবস্থায় শাবান মাসের ১৫ তারিখে রোযা রাখা যাবে। পূর্বের দুই দিন তথা ১৩ ও ১৪ তারিখের সঙ্গে মিলিয়ে একসঙ্গে তিন দিন রোযা রাখা যেমন যাবেতেমনি পৃথকভাবে কেবল ১৫ তারিখও রোযা রাখা যাবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তিন দিন রাখাই উত্তম।

এমনিভাবে ১৫ তারিখ আইয়ামে বীযের একটি দিন হিসেবে ১৫ তারিখের রোযাকে সুন্নতও মনে করা যাবে। কিন্তু পৃথকভাবে শাবান মাসের ১৫ তারিখ বিশেষ একটি দিনসে হিসেবে পৃথকভাবে এ দিনে রোযা রাখা সুন্নতএমন ধারণা রাখা যাবে না।

এ প্রসঙ্গে শাইখুল ইসলাম মুফতী মুহাম্মাদ তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম বলেন, ‘আরো একটি বিষয় হচ্ছেশবে বরাত-পরবর্তী দিনে অর্থাৎ শাবানের পনেরো তারিখে রোযা রাখা। গভীরভাবে বিষয়টি উপলব্ধি করা প্রয়োজন। হাদীসে রাসূলের বিশাল ভাণ্ডার হতে একটি মাত্র হাদীস এর সমর্থনে পাওয়া যায়। তাতে বলা হয়েছে, ‘শবে বরাতের পরবর্তী দিনটিতে রোযা রাখ। সনদ ও বর্ণনার সূত্রের দিক থেকে হাদীসটি দুর্বল। তাই এ দিনের রোযাকে এই একটি মাত্র দুর্বল হাদীসের দিকে তাকিয়ে সুন্নত বা মুস্তাহাব বলে দেওয়া অনেক আলেমের দৃষ্টিতেই অনুচিত। তবে হাঁশাবানের গোটা মাসে রোযা রাখার কথা বহু হাদীসে পাওয়া যায়। অর্থাৎ ১ শাবান থেকে ২৭ শাবান পর্যন্ত রোযা রাখার যথেষ্ট ফযীলত রয়েছে। কিন্তু ২৮ ও ২৯ তারিখে রোযা রাখতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই বারণ করেছেন। ইরশাদ করেন, ‘রমযানের দু-একদিন পূর্বে রোযা রেখো না।’ যাতে রমযানের  জন্য পূর্ণ স্বস্তির সাথে স্বতঃর্স্ফূভাবে প্রস্তুতি নেওয়া যায়। কিন্তু ২৭ তারিখ পর্যন্ত প্রতিদিনের রোযাই অত্যন্ত বরকতপূর্ণ।

একটি লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছেশাবানের এই ১৫ তারিখ তো আইয়ামে বীয’ এর অন্তর্ভুক্ত। আর নবীজী প্রতি মাসের আইয়ামে বীয এ রোযা রাখতেন। সুতরাং যদি কোনো ব্যক্তি এই দুই বিষয়কে সামনে রেখে শাবানের ১৫ তারিখের দিনে রোযা রাখে যা আইয়ামে বীয’ এর অন্তর্ভুক্তপাশাপাশি শাবানেরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিনতবে ইনশাআল্লাহ নিশ্চয়ই সে সওয়াব পাবে। তবে শুধু ১৫ শাবানের কারণে এ রোযাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে সুন্নত বলে দেওয়া অনেক আলেমের মতেই সঠিক নয়। আর সে কারণেই অধিকাংশ ফুকাহায়ে কেরাম মুস্তাহাব রোযার তালিকায় মুহাররমের ১০ তারিখ ও ইয়াওমে আরাফা (যিলহজ্জের ৯ তারিখ) এর কথা উল্লেখ করেছেন। অথচ শাবানের ১৫ তারিখের কথা পৃথকভাবে কেউই উল্লেখ করেননি। বরং তারা বলেছেনশাবানের যেকোনো দিনই রোযা রাখা উত্তম। সুতরাং এ সকল বিষয়ের দিকে দৃষ্টি রেখে যদি কেউ রোযা রাখেইনশাআল্লাহ সে সওয়াব পাবে। তবে মনে রাখতে হবে যেরোযা রাখার ব্যাপারে এ মাসের নির্দিষ্ট কোনো দিনের পৃথক কোনো বৈশিষ্ট্য নেই।’ ইসলাহী খুতুবাত ৪/২৬৭-২৬৮

শবে বরাতের ফযীলত শবে কদরের সমান নয়

অনেকে মনে করেন শবে বরাতের ফযীলত শবে কদরের মতো। এ ধারণা সঠিক নয়। শবে বরাতের ফযীলত আপন জায়গায় স্বীকৃততবে তার ফযীলত শবে কদরের মতো নয়। কুরআন-হাদীসে শবে কদরের যত ফযীলত এসেছে শবে বরাত সম্পর্কে আসেনি। বিশেষত শবে কদরে কুরআন মজীদ নাযিল হওয়ার মতো বরকতময় ঘটনা ঘটেছে। এ ফযীলত অন্য কোনো রজনীর নেই।

আবার অনেকে মনে করেন কুরআন মজীদের সূরা দুখানে লাইলাতুম মুবারাকাহ’ বলে শবে বরাত উদ্দেশ্য। এ ধরাণাও সঠিক নয়। লাইলাতুম মুবারাকাহ’ বলে শবে কদর উদ্দেশ্যসূরা কদরে বিষয়টি স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছেতাই ভিন্ন কোনো ধারণা পোষণ করার সুযোগ নেই। (দ্রষ্টব্য : লাতায়েফুল মাআরেফপৃ. ২৬৮মাকালাতুল কাওছারীপৃ. ৪৯-৫০

 

রমযানুল মুবারক

রমযান সিয়ামের মাস। কুরআন নাযিলের মাস। খায়ের ও বরকতের মাস। তাকওয়া অর্জনের মাস। আমলে অগ্রগামী হওয়ার মাস। নেকী হাছিলের মাস। তারাবীতাহাজ্জুদ ও কুরআন তিলাওয়াতের মাস। ইতিকাফের মাস। শবে কদরের মাস। গুনাহ তরক করার মাস। ক্ষমা লাভের মাস। প্রবৃত্তির লাগাম টেনে ধরার মাস। সংযম সাধনার মাস। ভ্রাতৃত্ব চর্চার মাস। ক্ষমাউদারতা ও সহানুভূতির মাস।

রোযার ফযীলত

রোযার প্রতিদান স্বয়ং আল্লাহ তাআলা প্রদান করেন

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিতরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনবনী আদমের প্রতিটি আমলের প্রতিদান বহু গুণে বৃদ্ধি হতে থাকে১০ গুণ থেকে ৭০০ গুণএমনকি আল্লাহ চাইলে তার চেয়েও বেশি দেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেনতবে রোযার বিষয়টি ভিন্ন। কেননা রোযা একমাত্র আমার জন্য এবং আমি স্বয়ং এর প্রতিদান দিব। বান্দা একমাত্র আমার জন্য পানাহার ও প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণ থেকে বিরত থাকে। রোযাদারের জন্য দুটি আনন্দ। এক. ইফতারের মুহূর্তে দুই. রবের সঙ্গে সাক্ষাতের মুহূর্তে। আর রোযাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশকের চেয়েও উত্তম। সহীহ মুসলিমহাদীস  ১১৫১

রোযাদারের জন্য ক্ষমার পুরস্কার

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিতরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনযে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রমযানের রোযা রাখবে তার পূর্বের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। সহীহ বুখারীহাদীস ১৯০১

রোযাদার জান্নাতে প্রবেশের জন্য  বিশেষ দরজা

হযরত সাহল ইবনে সাদ রা. থেকে বর্ণিতজান্নাতে রাইয়ান নামে একটি দরজা আছে। এই দরজা দিয়ে শুধু রোযাদাররা প্রবেশ করবে। ঘোষণা করা হবেরোযাদাররা কোথায়তখন তারা উঠে দাঁড়াবে। যখন তাঁরা প্রবেশ করবে তখন ঐ দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং সেই দরজা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ করবে না। সহীহ বুখারীহাদীস  ১৮৯৬সহীহ মুসলিমহাদীস ১১৫২

রোযাদারের দুআ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিতরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনতিন ব্যক্তির দুআ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না :

১. রোযাদারের দুআ ইফতার করা পর্যন্ত।

২. ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ্র দুআ।

৩. মাজলুমের দুআ।

আল্লাহ তাআলা তাদের দুআ মেঘমালার উপরে উঠিয়ে নেন। এর জন্য আসমানের দরজাসমূহ খুলে  দেওয়া হয়। আর আল্লাহ তাআলা বলেনআমার ইজ্জতের কসম! বিলম্বে হলেও আমি অবশ্যই তোমাকে সাহায্য করব। জামে তিরমিযীহাদীস  ৩৫৯৮সহীহ ইবনে হিব্বানহাদীস ৭৩৮৭

রোযা রোযাদারের জন্য সুপারিশ করবে

আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণিতরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনরোযা এবং কুরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোযা বলবেআমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও প্রবৃত্তির চাহিদা মেটানো থেকে বিরত রেখেছিসুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। কুরআন বলবেআমি তাকে রাতের ঘুম থেকে বিরত রেখেছিসুতরাং আমার সুপারিশ কবুল করুন। তখন দুজনের সুপারিশই গ্রহণ করা হবে। মুসনাদে আহমাদহাদীস ৬৬২৬মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৩/১৮১

)ملاحظةومع ما في حُيَي بن عبد الله من ضعف فالخبر صالح للعمل به بلا ريب، فقد جزم الذهبي بأنه حسن الحديث، وقال ابن عدي : وأرجو أنه لا بأس به إذا روى عنه ثقةولولا كثرة مفاريده مما أشار إليها ابن عدي لما كان أي تردد في تحسين حديث(.

প্রতিদিন ইফতারের সময় অনেক জাহান্নামীকে মুক্তি দেওয়া হয়

জাবের রা. থেকে বর্ণিতরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনপ্রতিদিন ইফতারের সময় অনেক জাহান্নামীকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং এটা প্রতি রাতে। সুনানে ইবনে মাজাহহাদীস  ১৬৪৩ (দ্রষ্টব্য : মুসনাদে আহমাদের টীকাহাদীস ৭৪৫০)

قال البوصيري : رجال إسناده ثقات.

রমযানুল মুবারকের শুরুতে শয়তান ও দুষ্ট জিনদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়জাহান্নামের দরজা বন্ধ করা হয়জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া হয়

রমযানুল মুবারকের আরেকটি ফযীলতের কথা এসেছে একটি হাদীসে। আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিততিনি বলেনরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনরমযান মাসের প্রথম রাতে শয়তান ও দুষ্ট জিনদেরকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করা হয় এবং (পুরো রমযান) এর একটি দরজাও আর খোলা হয় নাজান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয় এবং (রমযানে) এর একটি দরজাও আর বন্ধ করা হয় না। (এ মাসে) একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা দিতে থাকেনহে কল্যাণ অন্বেষী! অগ্রসর হও। হে অকল্যাণ অন্বেষী! নিবৃত্ত হওনিয়ন্ত্রিত হও। আর বহু লোককে আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে এ মাসে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। প্রত্যেক রাতেই এরূপ হতে থাকে। জামে তিরমিযীহাদীস ৬৮২

صحيح لغيره، وينظر تعليقة الشيخ شعيب وأصحابه على جامع الترمذي برقم (٦٨٩و(٦٩١(

রমযানুল মুবারকের আমল

পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছেএকটি হাদীসে আছে, ‘রমযানুল মুবারকের শুরুতে একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা দিতে থাকেনহে কল্যাণ অন্বেষী! অগ্রসর হও। হে অকল্যাণ অন্বেষী! নিবৃত্ত হওনিয়ন্ত্রিত হও।’ সেই হাদীসে একথাও আছে যে, ‘রমযানুল মুবারকের শুরুতে শয়তান ও দুষ্ট জিনদেরকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করা হয় এবং জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয়। এ থেকে বোঝা যায়রমযানুল মুবারক ইবাদতের শ্রেষ্ঠ মৌসুম। কাজেই এই সুযোগকে কাজে লাগানো চাই।

নিম্নে রমযানের কিছু মৌলিক আমলের কথা উল্লেখ করা হল। আল্লাহ তাআলা সবাইকে তাওফীক দান করুন।

১. রোযা রাখা ও তাকওয়া অর্জনের চেষ্টা করা

রমযানুল মুবারকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল হলরোযা রাখা। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا كُتِبَ عَلَیْكُمُ الصِّیَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَی الَّذِیْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ .

হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোযা ফরয করা হয়েছেযেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরয করা হয়েছিল। যেন তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পারো। সূরা বাকারা (২) : ১৮৩

রমযানুল মুবারকে তাই সকল মুসলিমের রোযা রাখা ফরয। শরীয়ত স্বীকৃত ওযর ছাড়া কারো জন্য রোযা না রাখার সুযোগ নেই। আফসোসের বিষয় হলরোযা রাখার ব্যাপারে কোনো কোনো পরিবারে শিথিলতা ও অবহেলা দেখা যায়। এই শিথিলতা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। মনে রাখতে হবেরোযা অকাট্য ফরয বিধানএব্যাপারে শিথিলতা করা হলে আখেরাতে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।

উক্ত আয়াতে রোযার মাকসাদ ও উদ্দেশ্যের প্রতি ইশারা করা হয়েছে। আর তা হলতাকওয়া অবলম্বন করা। রোযার মাধ্যমে তাকওয়ার অনুশীলন হয়আল্লাহর ভয়ে স্বাভাবিক সময়ে যা হালাল ছিলরোযা অবস্থায় সেই হালাল থেকেও বিরত থাকা হয়এতে আল্লাহর ভয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা ও অনুচিত কাজকর্ম থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রাখার অনুশীলন হয়। এই অনুশীলনের মাধ্যমে আল্লাহর ভয় মনে বদ্ধমূল করা এবং শরীয়তের দৃষ্টিতে অনুচিত কাজ থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রাখার একটি যোগ্যতা নিজের মাঝে সৃষ্টি করারোযার মাকসাদ। এই মাকসাদ অর্জনে যথাযথ আদব বজায় রেখে সিয়াম পালন করা আবশ্যক। আল্লাহ সবাইকে তাকওয়ার মহা নিআমত দান করুন।

 ২. সেহরী খাওয়া

রমযানুল মুবারকের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল সেহরী খাওয়া। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনসেহরী খাওসেহরীতে বরকত রয়েছে। সহীহ বুখারীহাদীস ১৯২৩সহীহ মুসলিমহাদীস ১০৯৫

অন্য হাদীসে আছেআমাদের রোযা ও আহলে কিতাবীদের রোযার মাঝে পার্থক্য হল সেহরী খাওয়া (আমরা সেহরী খাইতারা খায় না)। সহীহ মুসলিমহাদীস ১০৯৬

শেষ ওয়াক্তে সেহরী খাওয়া সুন্নত। হাদীসে আছেরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সেহরী খাওয়া ও আযানের মাঝে সময়ের ব্যবধান ছিল পঞ্চাশ আয়াত তিলাওয়াত পরিমাণ। সহীহ বুখারীহাদীস ১৯২১সহীহ মুসলিমহাদীস ১০৯৬

৩. ইফতার করা

রমযানুল মুবারকে ইফতার করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করা কর্তব্য। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনআমার উম্মত কল্যাণের মাঝে থাকবেযতদিন তারা সময় হওয়ার সাথে সাথে ইফতার করবে। সহীহ বুখারীহাদীস ১৯৫৭

সহীহ মুসলিমে আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সময় হওয়ার সাথে সাথে ইফতার করার কথা বর্ণিত হয়েছে। (দ্র. সহীহ মুসলিমহাদীস ১০৯৯)

৪. ইফতারের সময় দুআ করা

ইফতারের সময় দুআ করা চাই। হাদীস শরীফে এসেছেইফতারের সময় রোযাদারের দুআ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। ইবনে মাজাহহাদীস ১৭৫৩

এই হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আছ রা. ইফতারের সময় নিম্নোক্ত দুআ পড়তেন

اَللّٰهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ بِرَحْمَتِكَ الَّتِي وَسِعَتْ كُلَّ شَيْءٍ، أَنْ تَغْفِرَ لِي.

অর্থ : হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আপনার ঐ রহমতের ওছিলায় প্রার্থনা করছিযা সবকিছুকে পরিব্যাপ্ত করে রেখেছে। (আমি প্রার্থনা করছি,) আমাকে ক্ষমা করে দিন। সুনানে ইবনে মাজাহহাদীস ১৭৫৩

ইফতারের দুআ

আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে আছেইফতারের পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দুআ পড়েছিলেন

ذَهَبَ الظَّمَأُ، وَابْتَلَّتِ الْعُرُوْقُ، وَثَبَتَ الأَجْرُ إِنْ شَاءَ اللهُ.

পিপাসা নিবারিত হলশিরা উপশিরা সতেজ হল আর সওমের সওয়াবও অবধারিত হয়েছে ইনশাআল্লাহ। সুনানে আবু দাউদহাদীস ২৩৫৭

৫. তারবীহ পড়া

রমযানের অন্যতম একটি আমল হলতারাবীহ নামায। হাদীস শরীফে এসেছেরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনযে ব্যক্তি পূর্ণ বিশ্বাসের সাথে সওয়াবের আশায় রমযানের রাতে (নামাযে) দণ্ডায়মান হয় তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। সহীহ বুখারীহাদীস  ২০০৯

তাই গুনাহ মাফের আশায় সওয়াবের নিয়তে গুরুত্ব ও যত্নের সাথে তারাবীহ নামায পড়া চাই।

তারাবীর ব্যাপারে একটি কথা না বললেই নয়। অনেকে তারাবীর রাকাত সংখ্যা নিয়ে অযাচিত বাহাছ উসকে দেন। এই বাহাছ বিতর্কে না জড়িয়ে আমলে মনোযোগী হওয়া কর্তব্য। এ সম্পর্কে উস্তাযে মুহতারাম মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেব হাফিযাহুল্লাহ আলকাউসার জুলাই-আগস্ট ২০১২ সংখ্যায় বড় দরদ নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। প্রবন্ধের শিরোনাম বরাহে করম! রাকাত সংখ্যা নিয়ে বিবাদ ছাড়ুননিজ নিজ ত্রুটি সংশোধন করুন। তারাবীর রাকাত সংখ্যার ব্যাপারে কেউ যদি অন্য কারো দ্বারা পেরেশানীর শিকার হনতাহলে তার প্রতি এই প্রবন্ধ পড়ার অনুরোধ থাকল। এখানে সেই প্রবন্ধ থেকে শুধু একটি কথা উদ্ধৃত করা হল

‘...এসব মানুষ যদি সঠিক ইলম অর্জন করততাহলে বুঝত যেবিশ রাকাত তারাবীহ খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত। মুহাজির ও আনসার সাহাবীগণের ঐকমত্য (ইজমা) ও খায়রুল কুরূন থেকে অদ্যাবধি উম্মতের অবিচ্ছিন্ন কর্মধারা এবং সর্বসম্মত পথ (সাবীলুল মুমিনীন)-এর মতো অকাট্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত। এর বিপরীতে তারাবীর নামাযকে আট রাকাতে সীমাবদ্ধ করার পক্ষে কোনো দলীল নেই। যদি জোর করে বিনা দলীলে তাহাজ্জুদ ও তারাবীহকে একই নামায দাবি করা হয়তবুও তা আট রাকাতে সীমাবদ্ধ হতে পারে না। কেননা তাহাজ্জুদের নামায আট রাকাতে সীমাবদ্ধ নয়। কওলী হাদীস অনুযায়ী দুই দুই রাকাত করে সুবহে সাদিক পর্যন্ত যত রাকাত ইচ্ছা পড়া যায়। আর ফেলী হাদীস দ্বারাও আট রাকাতের বেশি প্রমাণিত। স্বয়ং আম্মাজান আয়েশা রা. থেকে (যার বর্ণনাকৃতবছরজুড়ে সালাতুল লাইলের আট রাকাত ও বিতিরের ৩ রাকাত মোট এগারো রাকাতের হাদীস দ্বারা এসব বন্ধু তারাবীর দলীল পেশ করে থাকেন) সহীহ সনদে দশ রাকাতের কথা প্রমাণিত। আর অন্য সাহাবী থেকে এর চেয়ে বেশিও প্রমাণিত।

এজন্য যারা তাহাজ্জুদের হাদীস দ্বারা তারাবীর রাকাত-সংখ্যা প্রমাণের অপচেষ্টা করেন তাদের কোনো অধিকারই নেই বিশ রাকাত তারাবীহ আদায়কারীদের ওপর আপত্তি করার। তাদের নিকট সাধারণ নফল নামাযেও জামাত জায়েয। আর তাহাজ্জুদে জামাত হল মুবাহ। সুতরাং তাদের কথা অনুযায়ী যদি ধরা হয়বিশ রাকাত সুন্নতে মুয়াক্কাদা নয়তাহলে তো এ-ই হবে যেতা নফল। আর তাদের নিকট নফল নামায জামাতে আদায় করা জায়েয। এজন্য যারা বিশ রাকাত পড়ছে তারা তো তাদের নীতি অনুযায়ীও কোনো নাজায়েয কাজ করছে না। তাহলে কেন খামোখা বিশ রাকাত আদায়কারীদের বিভ্রান্ত করবেনতাদের বিরুদ্ধে লিফলেট প্রচার করবেনকটূক্তি করবেন এবং তাদের প্রতি বিদআত ও সুন্নাহ বিরোধিতার অপবাদ দেবেন?!’ মাসিক আলকাউসারশাবান-রমযান ১৪৩৩ হি./জুলাই-আগস্ট ২০১২ ঈ.

তারাবীর রাকাত সংখ্যার বিষয়ে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা উচিত। হারামাইনে করোনাকে উপলক্ষ করে তারাবীহ বিশ রাকাতের জায়গায় দশ রাকাত করা হয়েছিল। যদিও তার কোনো প্রয়োজন ছিল কি না তা প্রশ্নসাপেক্ষ। কিন্তু করোনা বিদায় হয়েছে সেই কবেইতার পরও এখনো তারাবীহ বিশ রাকাত পড়ার মুবারক প্রচলনটি এখনো চালু করা হয়নি। এটি আপত্তিকর। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের এদিকে দৃষ্টি দেওয়া কর্তব্য।

৬. তাহাজ্জুদ পড়া

রমযানে সাধারণত সেহরীর জন্য ওঠা হয়তাই একটু আগে উঠে দুই-চার রাকাত তাহাজ্জুদ পড়া তুলনামূলক সহজ। আর যদি এ সুযোগে সব সময়ের জন্য তাহাজ্জুদের অভ্যাস হয়ে যায়তাহলে তো খুবই ভালো। পরিবারের লোকদেরও তাহাজ্জুদে ওঠার জন্য অনুপ্রেরণা দান করা চাই। কারণ তাহাজ্জুদের ফযীলত অনেক। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিততিনি বলেনআমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘ফরয নামাযের পরে সর্বোত্তম নামায হল রাতের নামায (অর্থাৎ তাহাজ্জুদ)। সহীহ মুসলিমহাদীস ১১৬৩

৭. বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা

সূরা বাকারার ১৮৫ নং আয়াতে এসেছেরমযান মাসে কুরআন মাজীদ অবতীর্ণ হয়েছে। তাই এ মাসে কুরআনের প্রতি বেশি মনোযোগী হওয়া কর্তব্য। হাদীসে এসেছেহযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম রমযানের প্রতি রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসতেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে কুরআন তিলাওয়াত করে শোনাতেন। সহীহ বুখারীহাদীস ১৯০২

৮. শবে কদর অন্বেষণ করা

শবে কদর এক মহা ফযীলতপূর্ণ রাত। এ রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে, (তরজমা) নিশ্চয়ই আমি তা (কুরআন) নাযিল করেছি লাইলাতুল কদরে। আপনি কি জানেন লাইলাতুল কদর কীলাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। সূরা কদর (৯৭) : ১-৩

হাদীস শরীফে এসেছেযে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় কদরের রাতে নামাযে দণ্ডায়মান থাকবেতার পূর্ববর্তী সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। সহীহ মুসলিমহাদীস ৭৬০সহীহ বুখারীহাদীস  ২০১৪

সুতরাং শবে কদরের ফযীলত লাভে সচেষ্ট হওয়া কর্তব্য। এ রাতে সাধ্য মোতাবেক নফল ইবাদত করবেতিলাওয়াতযিকিরদুআইস্তেগফারদরূদ প্রভৃতিতে মগ্ন থাকবে। ইবাদতের মাঝে বিশ্রাম নিলেও দিল আল্লাহমুখী রাখবেসম্ভব হলে মনে মনে যিকির করবে। তবে হাঁযদি বেশি বিশ্রামের প্রয়োজন থাকেতাহলে বিশ্রামও করা যেতে পারেকিন্তু গাফলতের ঘুম বা কেবল আরামের ঘুম ঘুমাবে না। আর খেয়াল করে এশা ও ফজর নামায অবশ্যই জামাতের সাথে পড়বে। কারণএক হাদীসে এসেছেযে ব্যক্তি এশা ও ফজর জামাতের সাথে পড়লসে যেন সারারাত দাঁড়িয়ে নামায পড়ল। সহীহ মুসলিমহাদীস ৬৫৬

কিন্তু শবে কদর কবেতা নির্দিষ্ট নেই। শুধু এতটুকু জানানো হয়েছে যেশবে কদর রমযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোর যেকোনো একদিন। তাই শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোর প্রতিদিনই ইবাদত করা কর্তব্য। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনতোমরা শেষ দশকের বেজোড় রাত্রিগুলোতে শবে কদর তালাশ কর। সহীহ বুখারীহাদীস  ২০১৭২০২০

সহীহ বুখারীর অপর বর্ণনায় আছেনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের মাঝের দশ দিন ইতিকাফ করতেন। এক বছর এভাবে ইতিকাফ শেষ করার পর যখন রমযানের একুশতম রাত এল তখন তিনি ঘোষণা করলেনযে ব্যক্তি আমার সাথে ইতিকাফ করেছে সে যেন শেষ দশকে ইতিকাফ করে। কারণ আমাকে শবে কদর সম্পর্কে অবগত করা হয়েছিল (যে তা শেষ দশকের অমুক রাতে)। এরপর তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। ... সুতরাং তোমরা শেষ দশকে শবে কদর খোঁজ কর। সহীহ বুখারীহাদীস  ২০২৭

তাই কেবল সাতাশ রমযানের রাতকে শবে কদর মনে করে শেষ দশকের অন্য রাত্রিগুলোতে শবে কদর অন্বেষণ না করা ঠিক নয়। বরং শেষ দশকের প্রতি রাতেই শবে কদর তালাশ করবে।

আয়েশা রা.-কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শবে কদরে পড়ার জন্য একটি দুআ শিখিয়েছেন। শেষ দশকের রাতে এই দুআ বেশি বেশি পড়া উচিত

اَللّٰهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّيْ.

অর্থ : হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল। ক্ষমা করতে ভালবাসেন। সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দিন। জামে তিরমিযীহাদীস ৩৫১৩

৯. শেষ দশকে ইতিকাফ করা

শেষ দশকে মসজিদে ইতিকাফ করা রমযানের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। (দ্র. সহীহ বুখারীহাদীস ২০২৬)

তাছাড়া শবে কদর লাভের উত্তম উপায় হল ইতিকাফ। ইতিকাফরত অবস্থায় থাকলে শবে কদর লাভের সুযোগ বেশি।

১০. যথাসাধ্য দান করা

রমযান মাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল হলসাধ্য মোতাবেক দান করা। নবী সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম রমযান মাসে অনেক দান করতেন। হাদীস শরীফে এসেছেরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়ার সকল মানুষ অপেক্ষা অধিক দানশীল ছিলেন। রমযানে তাঁর দানের হাত আরো প্রসারিত হত। সহীহ বুখারীহাদীস ১৯০২

১১. গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনরোযা হচ্ছে ঢাল। যখন তোমাদের কেউ রোযা থাকেসে যেন গর্হিত কথা না বলে এবং মূর্খের ন্যায় কাজ না করে। কেউ যদি তাকে গালি দেয় বা ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হয়তাহলে সে যেন বলেআমি রোযাদারআমি রোযাদার। সহীহ বুখারীহাদীস  ১৯০৪সহীহ মুসলিমহাদীস ১১৫১

অন্য হাদীসে আছেযে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও মন্দ কাজ বর্জন করল নাতার (রোযা রেখে) পানাহার বর্জনে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। সহীহ বুখারীহাদীস  ১৯০৩

এ হাদীসদ্বয় থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যেরোযা কেবল পানাহার ত্যাগের নাম নয়। বরং রোযার মর্যাদা রক্ষার জন্য আরো কিছু করণীয় আছে। রোযার মর্যাদা রক্ষার্থে শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে অপছন্দনীয় সকল কাজ থেকে দূরে থাকতে হবে। নতুবা এই রোযা আল্লাহর কাছে মাকবুল রোযা হিসেবে গৃহীত হবে না এবং রোযার কাক্সিক্ষত সুফলও পাওয়া যাবে না। তাই রোযার মর্যাদা রক্ষার্থে সব ধরনের গর্হিত কাজ ও কথাবার্তা থেকে বিরত থাকতে হবে।

আল্লাহ তাআলা সবাইকে শাবান ও রমযানুল মুবারকের খায়ের ও বরকত দান করুনআমীন। 

 টীকা :

(১) কুরআন মজীদের সূরা তাওবায় (৯ : ৩৬) চারটি মাসকে পবিত্র মাস’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তন্মধ্যে রজব একটি। সেদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। সেই চার মাস হলযিলকদযিলহজমহররমরজব। (দ্র. সহীহ বুখারীহাদীস ৩১৯৭)

(শাবান মাসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধিক রোযা রাখার কারণ সম্পর্কে আরো কিছু বক্তব্য রয়েছে। কিন্তু এ মতটিকেই হাফেয ইবনে হাজার রাহ. সর্বাধিক উত্তম মত বলে রায় প্রদান করেছেন। (দ্রষ্টব্য : ফাতহুল বারীহাদীস নং ১৬৯৬আরো দ্রষ্টব্য : লাতায়েফুল মাআরেফ, ইবনে রজবপৃ ২৫৬)

প্রসঙ্গসমূহ:

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

রোযা রাখার বিধান ও উপকারীতা

...

আল্লামা মনযুর নোমানী রহঃ
১০ নভেম্বর, ২০২৪
৬০৬৬ বার দেখা হয়েছে

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →

মুফতী আবুল হাসান শামসাবাদী

শাইখুল ইসলাম আল্লামা যাহেদ কাউছারী রহঃ

মুফতী আব্দুল হান্নান হাবীব

মুফতী সালমান মানসুরপুরী

শাইখুল হাদীস আল্লামা আব্দুল কুদ্দুস দাঃ

আল্লামা আহমাদ মায়মূন

মাওলানা আতাউল্লাহ আব্দুল জলীল

আল্লামা রফী উসমানী রহঃ

মুফতী রশীদ আহমদ লুধিয়ানভী রহ.

মাওলানা নূর আলম খলীল আমিনী

হযরত মাওলানা আবদুল হাই পাহাড়পুরী রহঃ

হযরতজী মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভি রহঃ

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রহমান

মাওলানা মুহাম্মাদ ইমরান হুসাইন

মাওলানা শাহাদাত সাকিব

আল্লামা ইসহাক ওবায়দী রহঃ

মাওলানা ওমর পালনপুরী

মুফতী আবুল কাসেম নোমানী

হাকীমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানভী (রহ)

আল্লামা মানাযির আহসান গিলানী রহঃ