প্রবন্ধ

নতুন বৎসরের আগমণ মানুষ হিসেবে মনে আনন্দ আসলেও মুমিন হিসেবে আসে না।

লেখক:মুফতী শাহাদাত হুসাইন ফরায়েজী
২৮ জুন, ২০২৫
৩৮৩৮০ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

নতুন বৎসরের আগমণ মানুষ হিসেবে মনে আনন্দ আসলেও মুমিন হিসেবে আনন্দ আসে না।

কেন? এর সবচেয়ে বড় কারণ হলো, একজন মুমিন তার যাবতীয় কাজে আল্লাহর বিধি-বিধান অনুসরণ করেন। তিনি কি চান? এ বিষয়ে তাঁর মর্জি কী? এসব বিষয় যদি খেয়াল করা হয়, তাহলে মুমিন কখনো নতুন বছরের আগমনে খুশি উদযাপন করতে পারে না। খুশি প্রকাশের উদ্দেশ্যে কাউকে নতুন খ্রিস্টীয় বছরের শুভেচ্ছা জানিয়ে 'Happy New Year' বলতে/ এফবিতে স্ট্যাটাস দিতে  / মেসেজ পাঠাতে পারে না।


যেহেতু এটা স্পষ্ট যে মুসলমানদের জন্য হিজরি সন নির্ধারিত, যা মহররম মাস থেকে শুরু হয়

এবং তা আমাদের পরিচয় প্রকাশ করে। অন্যদিকে, খ্রিস্টীয় সনের আগমনে অমুসলিমরা আনন্দ-উল্লাস করে থাকে, যা তাদের সাথে সাদৃশ্য রাখতে আমাদের নিষেধ করা হয়েছে। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: "যে ব্যক্তি কোনো জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করবে, সে তাদের মধ্যেই গণ্য হবে" (সুনান আবু দাউদ, হাদিস নম্বর: ৪০৩১)। 

অর্থাৎ এমন অনুসরণ ও অনুকরণ করা, যাতে কাফির ও মুসলমানের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না। এমতাবস্থায় সে ব্যক্তি তাদের দলভুক্ত হিসাবে পরিগণিত হবে যাদের সে অনুসরণ করবে। যেমন বর্তমানে অনেক ফ্যাসান–পূজারীদের দেখা যায়, যারা দাঁড়ি লম্বা–লম্বা গোঁফ রাখে; যার ফলে তারা কাফির, মুশরিকদের পর্যায়ভুক্ত হয়ে যায়। অনেকে হিন্দু, ইয়াহুদী ও খ্রিস্টানদের মত কাপড়ও পরিধান করে, যা তাদের অনুকরণের ফলশ্রুতি। নবী (ﷺ) এরূপ করতে নিষেধ করেছেন – 


হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,


عَنْ أَبِي سَعِيدٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: «لَتَتَّبِعُنَّ سَنَنَ مَنْ قَبْلَكُمْ شِبْرًا بِشِبْرٍ، وَذِرَاعًا بِذِرَاعٍ، حَتَّى لَوْ سَلَكُوا جُحْرَ ضَبٍّ لَسَلَكْتُمُوهُ» ، قُلْنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ: اليَهُودَ، وَالنَّصَارَى قَالَ: «فَمَنْ»


আবু সাঈদ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (ﷺ) বলেছেন, তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তীদের তরীকাহ পুরোপুরি অনুসরণ করবে, প্রতি বিঘতে বিঘতে এবং প্রতি গজে গজে। এমনকি তারা যদি গো সাপের গর্তেও প্রবেশ করে থাকে তবে তোমরাও তাতে প্রবেশ করবে। আমরা বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কি ইয়াহুদী ও নাসারার কথা বলছেন? নবী (ﷺ) বললেন, তবে আর কার কথা? সহীহুল বুখারী আন্তর্জাতিক নং: ৩৪৫৬


তাই এই উপলক্ষে "Happy New Year" বলা থেকে বিরত থাকা উচিত।


এই সময়ে আমাদের মুসলমানদের বিশেষভাবে দুটি কাজ করা উচিত:

(১) অতীতের মূল্যায়ন করা।(যদি নাফরমানীর/নারাজেগীর পরিমাণ বেশি হয়ে থাকে তার জন্য অনুতপ্ত হয়ে কায়োমানবাক্যে তাওবাহ ও কান্নাকাটি করা। এবং বিগত আমলের কমতি গুলো ভবিষ্যত জীবনে শুধরানোর নিয়ত করা। 

(২) ভবিষ্যতের জন্য (আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের যাবতীয় মাধ্যম ও তারঁ নাফরমানীমুক্ত  জীবনের পরিকল্পনা করা।


আল্লাহ তা‘আলা বলেন,


اِعۡلَمُوۡۤا اَنَّمَا الۡحَیٰوۃُ الدُّنۡیَا لَعِبٌ وَّلَہۡوٌ وَّزِیۡنَۃٌ وَّتَفَاخُرٌۢ بَیۡنَکُمۡ وَتَکَاثُرٌ فِی الۡاَمۡوَالِ وَالۡاَوۡلَادِ ؕ کَمَثَلِ غَیۡثٍ اَعۡجَبَ الۡکُفَّارَ نَبَاتُہٗ ثُمَّ یَہِیۡجُ فَتَرٰىہُ مُصۡفَرًّا ثُمَّ یَکُوۡنُ حُطَامًا ؕ وَفِی الۡاٰخِرَۃِ عَذَابٌ شَدِیۡدٌ ۙ وَّمَغۡفِرَۃٌ مِّنَ اللّٰہِ وَرِضۡوَانٌ ؕ وَمَا الۡحَیٰوۃُ الدُّنۡیَاۤ اِلَّا مَتَاعُ الۡغُرُوۡرِ


জেনে রেখ, পার্থিব জীবন তো কেবল খেলাধুলা, বাহ্যিক সাজসজ্জা, তোমাদের পারস্পরিক অহংকার প্রদর্শন এবং ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে একে অন্যের উপরে থাকার প্রতিযোগিতারই নাম। (১৮)তার উপমা হল বৃষ্টি, যা দ্বারা উদগত ফসল কৃষকদেরকে মুগ্ধ করে দেয়, তারপর তা তেজস্বী হয়ে ওঠে। তারপর তুমি দেখতে পাও তা হলুদ বর্ণ হয়ে গেছে। অবশেষে তা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। আর আখেরাতে (এক তো) আছে কঠিন শাস্তি এবং (আরেক আছে) আল্লাহর পক্ষ হতে ক্ষমা ও সন্তুষ্টি। পার্থিব জীবন প্রতারণার উপকরণ ছাড়া কিছুই নয়।

সূরা হাদীদ ২০ নং আয়াত।


তাফসীরঃ

১৮. এখানে আল্লাহ তাআলা মানুষের বিভিন্ন চিত্তাকর্ষক জিনিসের উল্লেখ করেছেন। মানুষ তার জীবনের একেক পর্যায়ে একেকটির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে, যেমন শৈশবে তার আকর্ষণ থাকে খেলাধুলার দিকে, যৌবনকালে সাজসজ্জা, বেশভূষার প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হয় এবং সেই সাজসজ্জা ও পার্থিব অন্যান্য সাজ-সরঞ্জামে একে অন্যের উপর চলে যাওয়ার ও তা নিয়ে অহমিকা দেখানোর আগ্রহ দেখা দেয়। তারপর আসে বার্ধক্য। তখন মানুষের যাবতীয় চিন্তা-ভাবনা আবর্তিত হয় সম্পদ ও সন্তানকে কেন্দ্র করে। তখনকার চেষ্টা একটাই কিভাবে সম্পদে অন্যকে ছাড়িয়ে যাবে এবং সন্তানের দিক থেকেও অন্যের উপরে থাকবে। প্রতিটি স্তরে মানুষ যে জিনিসকে তার আকর্ষণ ও চাহিদার সর্বোচ্চ শিখর মনে করে, পরবর্তী স্তরে সেটাই তার কাছে বিলকুল মূল্যহীন হয়ে যায়। বরং অনেক সময় মানুষ এই ভেবে মনে মনে হাসে যে, আমি কোন জিনিসকে জীবনের লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছিলাম! অবশেষে যখন আখেরাত আসবে, তখন মানুষ উপলব্ধি করবে, আসলে দুনিয়ার আকর্ষণীয় সবকিছুই ছিল মূল্যহীন। প্রকৃত অর্জনীয় জিনিস তো ছিল এই আখেরাতের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যই। (তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন। উক্ত আয়াত দ্র.।


হাদীসে এসেছে,


عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، قَالَ: أَخَذَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِمَنْكِبِي، فَقَالَ: «كُنْ فِي الدُّنْيَا كَأَنَّكَ غَرِيبٌ أَوْ عَابِرُ سَبِيلٍ» وَكَانَ ابْنُ عُمَرَ، يَقُولُ: «إِذَا أَمْسَيْتَ فَلاَ تَنْتَظِرِ الصَّبَاحَ، وَإِذَا أَصْبَحْتَ فَلاَ تَنْتَظِرِ المَسَاءَ، وَخُذْ مِنْ صِحَّتِكَ لِمَرَضِكَ، وَمِنْ حَيَاتِكَ لِمَوْتِكَ»


আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একদা আমার উভয় কাঁধ ধরে বললেনঃ তুমি এ দুনিয়াতে একজন মুসাফির অথবা পথযাত্রীর মত থাক। আর ইবনে উমর (রাযিঃ) বলতেন, তুমি সন্ধ্যায় উপনীত হলে আর ভোরের অপেক্ষা করো না এবং ভোরে উপনীত হলে সন্ধ্যার অপেক্ষা করো না। তোমার সুস্থতার অবকাশে পীড়িত অবস্থার জন্য সঞ্চয় করে রেখো। আর জীবিত অবস্থায় তোমার মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিও।

সহীহুল বুখারী আন্তর্জাতিক নং: ৬৪১৬


প্রিয় পাঠক! প্রত্যেক নতুন বছর একজন ঈমানদারের মনে আনন্দের পরিবর্তে অস্থিরতা সৃষ্টি করে, কারণ তার মনে হয় যে তার জীবন আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে এবং বরফের মতো গলে যাচ্ছে। সে কীসের জন্য আনন্দ করবে? বরং এর আগে যে জীবনের সূর্য চিরতরে অস্ত যায়, সে পরকালের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের তীব্র ইচ্ছা অনুভব করে। তার সামনে সময় কম এবং কাজ অনেক বেশি। সুতরাং মুসলমানদের জন্য নতুন বছর কোনো সাময়িক আনন্দ বা উদযাপনের উপলক্ষ নয়, বরং অতিক্রান্ত সময়ের মূল্যায়ন করে আসন্ন জীবনের মুহূর্তগুলোর যথাযথ ব্যবহার করার সংকল্প গ্রহণের একটি সুযোগ।


আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে দ্বীনের সহীহ সমজ দান করুক। আমীন।


মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

ইংরেজি পড়ব কি পড়ব না

...

আল্লামা ইসহাক ওবায়দী রহঃ
১০ নভেম্বর, ২০২৪
২৩৪০ বার দেখা হয়েছে

সুন্নী নামধারী বক্তাদের ভন্ডামী বিধর্মীদের ইসলাম গ্রহণে প্রধান বাঁধা!

...

মুফতী লুৎফুর রহমান ফরায়েজী হাফি.
৮ নভেম্বর, ২০২৪
১৩৯২ বার দেখা হয়েছে

সোশ্যাল মিডিয়া, নাস্তিক্যবাদ ও আমাদের করণীয়

...

শাঈখুল ইসলাম মুফতি তাকী উসমানী
১০ নভেম্বর, ২০২৪
২৮৮০ বার দেখা হয়েছে

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →

বিবিধ

মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ দাঃ

শাইখ মুহাম্মাদ আওয়ামা

মাওলানা ইমদাদুল হক

আল্লামা সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ.

মাওলানা মুহাম্মদ গিয়াসুদ্দীন হুসামী

আল্লামা মনযুর নোমানী রহঃ

মাওলানা শিব্বীর আহমদ

মাওলানা মাহমুদ বিন ইমরান

আল্লামা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম দাঃ

মাওলানা ইনআমুল হাসান রহ.

মাওলানা যাইনুল আবিদীন

আবদুল্লাহ আল মাসউদ

শাইখুল ইসলাম আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রহ.

মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

আল্লামা ইকবাল

হযরত মাওলানা মুহিউদ্দীন খান

মাওলানা আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী

শাইখ আলী তানতাভী

মাওলানা আতাউল কারীম মাকসুদ