মানসিক বা রুহানি
শক্তি বলতে সাধারণত মানুষের আত্মিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক শক্তিকে
বোঝায়, যা
একজন ব্যক্তিকে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন, আত্মা পবিত্র করা এবং মানসিক
শক্তি বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে।
মানবজীবনে রুহানি
শক্তির গুরুত্ব অনেক বেশি। রুহানি শক্তি একজন মানুষকে সঠিক পথে চলতে, পাপ থেকে
দূরে থাকতে এবং সৎ কাজ করার জন্য অনুপ্রাণিত করে। রুহানি শক্তি বা
আধ্যাত্মিক শক্তির মাধ্যমে মানুষ অনেক অস্বাভাবিক কাজ করতে পারে. যা অন্য
সাধারণ ১০ জন মানুষ পারে না।
নিচে কোরআন ও হাদিসের আলোকে মানসিক শক্তি লাভের কিছু
গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি আলোচনা করা হলো—
পাক-পবিত্র
থাকা
পবিত্রতা
রুহানি উন্নতির মূল। নিয়মিত অজু ও গোসলের মাধ্যমে নিজেকে পবিত্র রাখা। তাহারাত
ছাড়া ঈমানের আর যত শাখা-প্রশাখা আছে, যেমন—নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, জিকর, তিলাওয়াত, দান-খয়রাত
ইত্যাদি, তা
মানুষের আত্মাকে
পবিত্র করে। আর তাহারাত দ্বারা পবিত্র হয় মানুষের দেহ। দেহ ও আত্মার সমষ্টিই
হলো মানুষ। তাহলে দেখা যাচ্ছে মানুষের অর্ধাংশ পবিত্র হয়
তাহারাত দ্বারা, আর
বাকি অর্ধেক অন্যান্য ইবাদত দ্বারা। এ জন্য নবীজি (সা.) বলেছেন যে ‘পবিত্রতা
ঈমানের অর্ধেক অংশ।’
(সহিহ মুসলিম, হাদিস
: ২২৩)
আল্লাহর
প্রতি পূর্ণ আস্থা ও তাওয়াক্কুল রাখা
সৃষ্টিকর্তার
প্রতি সর্বাবস্থায় পূর্ণ বিশ্বাস রাখা। আল্লাহর ওপর ভরসা মানসিক অস্থিরতা দূর করে
এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। এ বিষয়টি সহজেই অর্জন হয় না। এর জন্য
আল্লাহ তাআলার পরিচয় জানতে হয়। আল্লাহ কত মহান, তিনি কত
শক্তিশালী, তাঁর
সৃষ্টি কত বিস্তৃত—এসব
বিষয় নিয়ে চিন্তা করা। আর তখনই আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসা জন্মাবে।
কোরআনে বলা হয়েছে
, ‘যে
ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে, তার জন্য তিনিই যথেষ্ট।’ (সুরা : তালাক, আয়াত : ৩)
হাদিসে
এসেছে, রাসুলুল্লাহ
(সা.) বলেছেন, ‘যদি
তোমরা আল্লাহর ওপর যথাযথভাবে তাওয়াক্কুল করো, তবে তিনি তোমাদের সেইভাবে রিজিক দান
করবেন। যেমন—তিনি
পাখিদের রিজিক দান করেন।’
(জামে তিরমিজি, হাদিস
: ২৩৪৪)
নির্জনে
ইবাদত করা
নির্জনে
আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকা। নবীজি (সা.) হেরা গুহায় নির্জনে আল্লাহর জিকির করতেন।
এবং ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। হাদিসে এসেছে, ‘এরপর নির্জনতা
তাঁর কাছে প্রিয় হয়ে উঠল। তিনি হেরা গুহায় চলে যেতেন এবং পরিবার-পরিজনের
কাছে আসার আগে সেখানে একনাগাড়ে কয়েক দিন পর্যন্ত বিশেষ নিয়মে ইবাদত
করতেন।’ (সহিহ
বুখারি, হাদিস
: ৪৯৫৩)
ধৈর্য
ধারণ করা
ধৈর্য একটি
গুরুত্বপূর্ণ গুণ, যা
মানসিক শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক। কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি ধৈর্যশীলদের তাদের
পুরস্কার পরিপূর্ণভাবে দেব,
কোনো হিসাব ছাড়াই।’
(সুরা : জুমার, আয়াত
: ১০)
ধৈর্য ধারণের সুফল
উত্তম ও আলোময় হয়ে থাকে। ধৈর্যের মাধ্যমে সব রকম প্রলোভন সত্ত্বেও
নিজেকে সংযত রাখা হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ধৈর্য হলো আলো।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস :
২২৩)
আল্লাহর
জিকির করা
আল্লাহর স্মরণ
মানসিক প্রশান্তি ও শক্তি প্রদান করে। নীরবে-নিভৃতে আল্লাহ মানুষের মানসিক
শক্তি জোগাতে সহায়তা করেন। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘এরা সেই সব লোক, যারা ঈমান
এনেছে এবং যাদের অন্তর আল্লাহর জিকিরে প্রশান্তি লাভ করে।
স্মরণ রেখো, কেবল
আল্লাহর জিকিরেই অন্তরে প্রশান্তি লাভ হয়।’ (সুরা : রাদ, আয়াত : ২৮)
আবু মুসা
(রা.) বলেন, নবী
(সা.) বলেছেন, ‘যে
ব্যক্তি তার রবের জিকির করে, আর যে ব্যক্তি জিকির করে না, তাদের দুজনের দৃষ্টান্ত হলো জীবিত ও
মৃতের মতো।’ (সহিহ
বুখারি, হাদিস
: ৬৪০৭)
কোরআন
পাঠ এবং তা নিয়ে ভাবা
কোরআন পড়া
এবং তার অর্থ অনুধাবন মানসিক শক্তি বাড়ায়। আল্লাহ বলেন, ‘আমি এই
কোরআনে মুমিনদের জন্য শেফা (আরোগ্য) এবং রহমত নাজিল করেছি।’
(সুরা :
আল-ইসরা, আয়াত
: ৮২)
রাসুলুল্লাহ
(সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের
মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম,
যে কোরআন শেখে এবং অন্যকে শিক্ষা দেয়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস :
৫০২৭)
দোয়ার
মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা
মানসিক
শক্তি লাভের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। রাসুলুল্লাহ (সা.)
প্রায়ই এই দোয়া করতেন,
‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করি শক্তিশালী ঈমান, সত্যিকারের
ধৈর্য ও মনের প্রশান্তি।’
(জামে তিরমিজি, হাদিস
: ৩৪৮৫)
যথাসময়ে
নামাজ আদায় করা
নামাজ
মানসিক অস্থিরতা দূর করে এবং আত্মবিশ্বাস জোগায়। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা ধৈর্য
ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ৪৫)
রাসুলুল্লাহ
(সা.) কঠিন পরিস্থিতিতে নামাজ পড়ার মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য চেয়েছেন। বিশেষত রাত
জেগে নামাজ আদায় করা। ইরশাদ হয়েছে, ‘অবশ্যই রাত্রিকালের জাগরণ এমন, যা কঠিনভাবে
প্রবৃত্তি দলন করে এবং যা কথা বলার পক্ষে উত্তম।’ (সুরা : মুজ্জাম্মিল, আয়াত : ৬)
অর্থাৎ রাতে উঠে
তাহাজ্জুদের নামাজ আদায়ের অভ্যাস নিজ প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণে সহজ হয়। রাতের
শান্ত পরিবেশ, চারদিকে
নীরবতার সময়ে তিলাওয়াত ও দোয়া সুন্দর ও সঠিকভাবে সম্পন্ন করা যায় এবং তাতে
পূর্ণমাত্রায় মনোযোগও দেওয়া যায়।
দুনিয়ার
চিন্তা কমিয়ে আখিরাতের প্রতি মনোযোগ দেওয়া
কোরআনে
আল্লাহ বলেন, ‘এই
দুনিয়ার জীবন তো কেবল খেলা ও মজা, কিন্তু আখিরাতের আবাসই হলো চিরস্থায়ী।’ (সুরা :
আনকাবুত, আয়াত
: ৬৪)
আখিরাতের
প্রতি মনোযোগ দিলে দুনিয়ার পরীক্ষাগুলোকে সাময়িক মনে হয় এবং এই চিন্তা মানসিক
শক্তি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
পাপ
থেকে দূরে থাকা
পাপ মানসিক
অস্থিরতা সৃষ্টি করে এবং আত্মাকে দুর্বল করে। আল্লাহ বলেন, যে ব্যক্তি
আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তার জন্য সংকীর্ণ জীবন নির্ধারিত।’(সুরা :
ত্বহা, আয়াত
: ১২৪)
সৎ
লোকদের সাহচর্য
ভালো সঙ্গ
মানসিক শক্তি বাড়ায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মানুষ তার বন্ধুর ধর্মের ওপর চলে, তাই তুমি
কাদের সঙ্গে মিশছো তা দেখে নাও।’ (জামে তিরমিজি, হাদিস : ২৩৭৮)
রোজা
রাখা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের চর্চা
রোজা ধৈর্য
শেখায় এবং আত্মনিয়ন্ত্রণ বাড়ায়। আল্লাহ বলেন, ‘রোজা তোমাদের জন্য ফরজ করা হয়েছে, যাতে তোমরা
তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’
(সুরা : বাকারাহ,
আয়াত : ১৮৩)