প্রবন্ধ

কুরআনের ভাষায় মানবহত্যার ভয়াবহতা

লেখক:মাসিক আলকাউসার
১০ নভেম্বর, ২০২৪
৭৩১৮ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

যে যত দুনিয়ামুখী হয়শয়তান তাকে তত সহজে অন্যায়-অপরাধ ও পাপাচারে লিপ্ত করে ফেলতে পারে। কেউ কেউ জাগতিক পদ-পদবী ও ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য মানুষের ওপর অবিচারজুলুমশোষণনিপীড়নের পথ বেছে নেয়। আফসোসের বিষয় হলকিছু কিছু মুসলিমের মাঝেও এ ন্যক্কারজনক চরিত্র ব্যাপক হয়ে উঠছে। মুসলিম হয়ে অপর মুসলিমকে হত্যা করারক্তপাতখুন-খারাবীর মতো ভয়াবহ অপরাধ ঘটাতে তারা সামান্যতম দ্বিধা করে না। গত জুলাই-আগস্টে (২০২৪) ঘটে যাওয়া ভয়াবহতম নারকীয় হত্যাযজ্ঞ এর একটি ঘৃণ্য উদাহরণ। তখনকার ফ্যাসিবাদী শাসকগোষ্ঠীর হিংস্রতা থেকে নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতানিষ্পাপ শিশুসহ রক্ষা পায়নি কেউই। তারা শত শত তাজা প্রাণ নির্মমভাবে হত্যা করেছে। আহত করেছে অজস্র মানুষকে। অথচ অন্যায়ভাবে কোনো মুসলমানকে আঘাত করারক্তপাত ও খুন-খারাবী করা ইসলামে ভয়াবহ রকমের অপরাধ ও গুনাহ।

বনী আদমের কী মূল্য এবং কী তার মর্যাদা- তা আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে এভাবে ইরশাদ করেছেন-

وَ لَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِيْۤ اٰدَمَ وَ حَمَلْنٰهُمْ فِي الْبَرِّ وَ الْبَحْرِ وَ رَزَقْنٰهُمْ مِّنَ الطَّيِّبٰتِ وَ فَضَّلْنٰهُمْ عَلٰي كَثِيْرٍ مِّمَّنْ خَلَقْنَا تَفْضِيْلًا.

আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি এবং স্থলে ও জলে তাদের জন্য বাহনের ব্যবস্থা করেছিতাদেরকে উত্তম রিযিক দান করেছি এবং আমার বহু মাখলুকের ওপর তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি। -সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ৭০

প্রতিটি আদম সন্তানের মর্যাদা ও তার প্রাণের মূল্য -সামাজিক বিচারে তার অবস্থান যা-ই হোক না কেন- আল্লাহর নিকট অপরিসীম। এজন্য তিনি অন্যায় রক্তপাত ও নরহত্যাকে ভয়াবহ অপরাধ সাব্যস্ত করেছেন।

ইসলামে যেসব অপরাধের সাজা মৃত্যুদণ্ডসেসব অপরাধ সাব্যস্ত হওয়া ছাড়া কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করা সম্পূর্ণ হারাম। একজন ব্যক্তি কখন এবং কী কারণে হত্যার উপযুক্ত হয়- এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট বিবরণ রয়েছে কুরআন-সুন্নাহ্য়। ইসলামী ফিকহ শাস্ত্রে রয়েছে এর বিশদ আলোচনা ও বিশ্লেষণ। আল্লাহর বিধানের বাইরে গিয়ে অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করার বিন্দুমাত্র অধিকার কারো নেই।

মৃত্যুদণ্ডের অপরাধ ছাড়া একজন ব্যক্তিকে হত্যা করা সম্পর্কে কুরআন কারীমে রয়েছে কঠিন সাবধানবাণী! শক্তি ও ক্ষমতার দাপটে কোনো পাপিষ্ঠ হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধ করলে সে দুনিয়াতেও লাঞ্ছনার শিকার হবে আর আখেরাতে তার জন্য রয়েছে জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তি।

এ সম্পর্কে আগামীতে 'কুরআনের ভাষায় মানবহত্যার শাস্তিবিষয়ে লেখার ইচ্ছা রইল।

কোনো মুমিন ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে হত্যা করতেই পারে না

পার্থিব জীবনে মানুষ জেনে না জেনে নানা অপরাধ ও পাপকর্ম করে বসে। এমনকি কবীরা গুনাহ পর্যন্ত করে বসে। কিন্তু শত অপরাধের মাঝেও কিছু কিছু অপরাধ এতটাই জঘন্য ও ভয়াবহ যেকোনো মুমিন থেকে তা ঘটাই অবিশ্বাস্য। অন্যায়ভাবে মানবহত্যা তেমনই একটি অপরাধ। কোনো মুমিন থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে তা ঘটতেই পারে না।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

وَ مَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ اَنْ يَّقْتُلَ مُؤْمِنًا اِلَّا خَطَـًٔا.

এটা কোনো মুমিনের কাজ হতে পারে না যেসে (ইচ্ছাকৃত) কোনো মুমিনকে হত্যা করবে। ভুলবশত এরূপ হয়ে গেলে সেটা ভিন্ন কথা। -সূরা নিসা (০৪) : ৯২

উক্ত আয়াত থেকে এটা স্পষ্ট যেকোনো মুমিন ইচ্ছাকৃত অপর মুমিনের প্রাণহানী করতে পারে না। ভুলবশত কখনো এ দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। যেমন কোনো শিকারকে লক্ষ্য করে তির ছুড়লকিন্তু নিশানা ভুল করে কোনো ব্যক্তির গায়ে তা আঘাত হানল। তবে এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা যে একেবারেই বিরল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

কিন্তু বাস্তবতা হলমুসলিম সমাজে এখন ইচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ডের মতো জঘন্য পাপকর্মটি হরহামেশাই ঘটছেতাও তুচ্ছ ও অতি নগণ্য কারণে। অথচ আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে অন্যায় রক্তপাত ও হত্যাকাণ্ডকে ভয়াবহ গুনাহ বলেছেন।

অন্যায় হত্যাকাণ্ড হারাম ও কুফরতুল্য গুনাহ

কুরআন কারীমে অন্যায় হত্যাকাণ্ডকে সুস্পষ্ট হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

وَ لَا تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِيْ حَرَّمَ اللهُ اِلَّا بِالْحَقِّ.

আর তোমরা সেই প্রাণকে হত্যা করো নাযার হত্যা আল্লাহ হারাম করেছেনতবে (শরীয়ত অনুযায়ী) তোমরা তার অধিকার লাভ করলে ভিন্ন বিষয়। -সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ৩৩

সূরা ফুরকান-এ আল্লাহর সঙ্গে শিরকের নিষেধাজ্ঞার পরই অন্যায়ভাবে হত্যাকে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَ الَّذِيْنَ لَا يَدْعُوْنَ مَعَ اللهِ اِلٰهًا اٰخَرَ وَ لَا يَقْتُلُوْنَ النَّفْسَ الَّتِيْ حَرَّمَ اللهُ اِلَّا بِالْحَقِّ وَ لَا يَزْنُوْنَ وَ مَنْ يَّفْعَلْ ذٰلِكَ يَلْقَ اَثَامًا، يُّضٰعَفْ لَهُ الْعَذَابُ يَوْمَ الْقِيٰمَةِ وَ يَخْلُدْ فِيْهٖ مُهَانًا.

এবং (আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ হল,) যারা আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোনো মাবুদের ইবাদত করে না এবং আল্লাহ যে প্রাণকে (হত্যা করা) হারাম করেছেনতাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে না এবং তারা ব্যভিচার করে না। আর যে ব্যক্তিই এরূপ (অপরাধ) করবেতাকে তার গুনাহের (শাস্তির) সম্মুখীন হতে হবে। কিয়ামতের দিন তার শাস্তি বৃদ্ধি করে দ্বিগুণ করা হবে এবং সে লাঞ্ছিত অবস্থায় তাতে সদা-সর্বদা থাকবে। -সূরা ফুরকান (২৫) : ৬৮-৬৯

উল্লিখিত আয়াতদ্বয়ে হত্যাকাণ্ডকে সুস্পষ্ট হারাম বলা হয়েছে। আর এর শাস্তি যে কত ভয়াবহ তাও স্পষ্টভাবে উল্লেখ হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম কোনো মুসলিমের সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত হওয়াকে কুফর আখ্যা দিয়ে ইরশাদ করেছেন-

سِبَابُ المُسْلِمِ فُسُوقٌ، وَقِتَالُه كُفْرٌ.

মুসলমানকে গালি দেওয়া পাপাচারআর তার সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত হওয়া কুফর। -সহীহ বুখারীহাদীস ৪৮

এক মুসলিমের সাথে শুধু লড়াই বা বিবাদে লিপ্ত হওয়াই যদি কুফর হয়তাহলে তাকে হত্যা করা যে কত কঠিন গুনাহের কাজ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

হত্যা : সবচেয়ে ভয়াবহ কবীরা গুনাহের একটি

আনাস রা. থেকে বর্ণিততিনি বলেননবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

أَكْبَرُ الكَبَائِرِالإِشْرَاكُ بِاللهِ، وَقَتْلُ النَّفْسِ، وَعُقُوقُ الوَالِدَيْنِ، وَقَوْلُ الزُّورِ أَوْ قَالَوَشَهَادَةُ الزُّورِ.

কবীরা গুনাহের মাঝে সবচেয়ে ভয়াবহ চারটি :

১. আল্লাহর সাথে শরীক করা।

২. কোনো ব্যক্তিকে (অন্যায়ভাবে) হত্যা করা।

৩. পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া।

৪. মিথ্যা বলা।

বর্ণনাকারী বলেনঅথবা বলেছেন মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া। -সহীহ বুখারীহাদীস ৬৮৭১

অন্যায়ভাবে একজন মানুষকে হত্যা করা গোটা মানবজাতিকে হত্যা করার সমতুল্য

অন্যায় হত্যাকাণ্ড আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট অত্যন্ত ভয়াবহ অপরাধ। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

...كَتَبْنَا عَلٰي بَنِيْۤ اِسْرَآءِيْلَ اَنَّهٗ مَنْ قَتَلَ نَفْسًۢا بِغَيْرِ نَفْسٍ اَوْ فَسَادٍ فِي الْاَرْضِ فَكَاَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيْعًا، وَ مَنْ اَحْيَاهَا فَكَاَنَّمَاۤ اَحْيَا النَّاسَ جَمِيْعًا.

...আমি বনী ইসরাঈলের প্রতি বিধান দিয়েছিলামকেউ যদি হত্যা অথবা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টির অপরাধ ছাড়া কাউকে হত্যা করেতবে সে যেন গোটা মানবজাতিকে হত্যা করল। আর যে ব্যক্তি কারো প্রাণ রক্ষা করেসে যেন গোটা মানবজাতির প্রাণ রক্ষা করল। -সূরা মায়িদা (৫) : ৩২

একজন মানুষকে হত্যা করা সংখ্যার বিবেচনায় তো মাত্র একটিই প্রাণহানীকিন্তু আল্লাহ তাআলার নিকট এই একটি হত্যার অপরাধ গোটা মানবজাতিকে হত্যা করার সমতুল্য।

একজন মানুষকে হত্যা করা সম্পর্কে কুরআন কারীমের যখন এই ভাষ্যতাহলে শিশু-নারী নির্বিশেষে গণহত্যা চালানো কতটা ভয়াবহ- তা কি বলার অপেক্ষা রাখে?

আল্লাহ তাআলার নিকট একজন মুমিনকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা কতটা ভয়াবহ ব্যাপার তা নিম্নের হাদীস থেকেও অনুমেয়।

আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণিততিনি বলেন-

قَتْلُ الْمُؤْمِنِ أَعْظَمُ عِنْدَ اللهِ مِنْ زَوَالِ الدُّنْيَا.

মুমিনকে হত্যা করা আল্লাহর নিকট গোটা পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার চেয়ে গুরুতর। -সুনানে নাসায়ীহাদীস ৩৯৮৮

হত্যা এমন অপরাধযা তওবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে দেয়

হত্যা কতটা ভয়াবহ অপরাধতা নিম্নের হাদীস থেকে পরিষ্কার হয়ে ওঠে। আবুদ দারদা রা. থেকে বর্ণিততিনি বলেনআমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি-

كُلُّ ذَنْبٍ عَسَى اللهُ أَنْ يَغْفِرَه، إِلّا مَنْ مَاتَ مُشْرِكًا، أَوْ مُؤْمِنٌ قَتَلَ مُؤْمِنًا مُتَعَمِّدًا.

আল্লাহ (চাইলে) সব গুনাহই ক্ষমা করবেনকিন্তু মুশরিক অবস্থায় কেউ মারা গেলে অথবা ঈমানদার ব্যক্তি অপর কোনো ঈমানদারকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করলে (তা ক্ষমা করবেন না)। -সুনানে আবু দাউদহাদীস ৪২৭০সুনানে নাসায়ীহাদীস ৩৯৮৪

অপর হাদীসে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিততিনি বলেননবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

 يَجِيءُ المَقْتُولُ بِالقَاتِلِ يَوْمَ القِيَامَةِ نَاصِيَتُه وَرَأْسُه بِيَدِه وَأَوْدَاجُه تَشْخَبُ دَمًا، يَقُولُ : يَا رَبِّقَتَلَنِي هذَا، حَتّى يُدْنِيَه مِنَ العَرْشِ، قَالَفَذَكَرُوا لِابْنِ عَبَّاسٍ التّوْبَةَ، فَتَلَا هذِهِ الْآيَةَوَ مَنْ يَّقْتُلْ مُؤْمِنًا مُّتَعَمِّدًا قَالَمَا نُسِخَتْ هذِه الْآيَةُ، وَلَا بُدِّلَتْ، وَأَنّى لَهُ التّوْبَةُ

খুন হওয়া ব্যক্তি খুনীকে সঙ্গে করে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলার সামনে উপস্থিত হবে। নিহত ব্যক্তির মাথা তার হাতেই থাকবে। শিরাগুলো থেকে রক্ত ঝরতে থাকবে। সে বলবেহে আমার প্রভু! এ ব্যক্তি আমাকে হত্যা করেছে। এভাবে সে হত্যাকারীকে আরশের অতি নিকটে নিয়ে যাবে। বর্ণনাকারী বলেনলোকেরা হত্যাকারীর তওবা সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-কে প্রশ্ন করলে তিনি সূরা নিসার আয়াত-

وَ مَنْ يَّقْتُلْ مُؤْمِنًا مُّتَعَمِّدًا... .

[যে ব্যক্তি কোনো মুমিনকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করবে... -সূরা নিসা (৪) : ৯৩]

-পাঠ করলেন এবং বললেনউক্ত আয়াত রহিত হয়নিপরিবর্তনও হয়নি। তিনি বলেনতার তওবার সুযোগ কোথায়-জামে তিরমিযীহাদীস ৩০২৯সুনানে নাসায়ীহাদীস ৪৮৬৬

একজন ব্যক্তির পক্ষ থেকে গুনাহ থেকে পরিত্রাণ পাবার সর্বশেষ সুযোগ হলআল্লাহর কাছে অন্তর থেকে মাফ চাওয়াতওবা করা। মুমিন যত বড় অন্যায় ও পাপকর্মই করুক না কেনঅন্তর থেকে তওবা করলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেবেন। কিন্তু হত্যার ভয়াবহতা এতটাই জঘন্য যেহত্যাকারী সেই মহা নিআমত তওবা থেকেই বঞ্চিত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। এত বড় হুমকির পরও কি কোনো মুমিনের পক্ষে সম্ভব অন্য কোনো মুমিন-মুসলিমকে হত্যা করা?

তাছাড়া অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা তো বান্দার হক। যথানিয়মে হক আদায় করা বা বান্দা মাফ করা ছাড়া আল্লাহ কিছুতেই বান্দার হক মাফ করবেন না।

হত্যার সমকালীন একটি রূপ

জাহেলী যুগসহ সবযুগেই একশ্রেণির পাষণ্ড মানুষের স্বভাব ছিলঅর্থাভাব ও দারিদ্রের ভয়ে সন্তানকে হত্যা করা। এমনকি জাহেলি যুগে কলঙ্ক থেকে বাঁচার জন্য নিজের কন্যা সন্তানকে হত্যা করাও স্বাভাবিক চোখেই দেখা হত।

আল্লাহ তাআলা এহেন জঘন্য কাজ থেকে তাদেরকে এবং সমস্ত মানুকে সাবধান করে দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে-

وَ لَا تَقْتُلُوْۤا اَوْلَادَكُمْ خَشْيَةَ اِمْلَاقٍ نَحْنُ نَرْزُقُهُمْ وَ اِيَّاكُمْ اِنَّ قَتْلَهُمْ كَانَ خِطْاً كَبِيْرًا.

দারিদ্র্যের ভয়ে নিজ সন্তানদেরকে হত্যা করো না। আমি তাদেরকেও রিযিক দেই এবং তোমাদেরকেও। নিশ্চয়ই তাদেরকে হত্যা করা গুরুতর অপরাধ। -সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ৩১

বর্তমানে আমাদের সমাজে জাহেলী যুগের মতো সন্তান জন্মের পর দারিদ্র্যের ভয়ে বা কন্যাসন্তান হওয়ার কারণে হত্যা করে ফেলার ঘটনা হয়তো খুব কমকিন্তু মেয়ে হওয়ার কারণে অথবা একটি বা দুটির বেশি সন্তান হওয়াকে অপছন্দ করার কারণে গর্ভাবস্থায় জীবন্ত সন্তানকে মেরে ফেলার ঘটনা প্রায়শই ঘটে থাকে। অথচ গর্ভের শিশুর প্রাণ এসে যাওয়ার পর তাকে ঔষধের মাধ্যমে বা অন্য কোনো উপায়ে মেরে ফেলা সুস্পষ্ট হত্যার শামিল। জন্মলাভের পর হত্যা করা আর গর্ভের জীবন্ত শিশুকে হত্যা করা একই রকম ঘৃণ্য অপরাধ।

এই হত্যা করে ফেলা শিশুদের সম্পর্কে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা জিজ্ঞাসা করবেন।

بِاَيِّ ذَنْۢبٍ قُتِلَتْ.

তাকে কী অপরাধে হত্যা করা হয়েছিল-সূরা তাকবীর (৮১) : ৯

অর্থাৎ পরকালে এই সন্তানদেরকে হাজির করে জিজ্ঞেস করা হবেতাদেরকে কী অপরাধে হত্যা করা হয়েছিলএর দ্বারা উদ্দেশ্য হবে সেই জালেমদেরকে শাস্তি দেওয়াযারা তাদের প্রতি এরূপ পাশবিক আচরণ করেছিল।

মুসলমানের জান-মালে যে কোনো ধরনের অন্যায় হস্তক্ষেপই হারাম

বিদায় হজে¦র ভাষণে প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত জোরালো কণ্ঠে বলেন-

فَإِنّ دِمَاءَكُمْ، وَأَمْوَالَكُمْ، وَأَعْرَاضَكُمْ بَيْنَكُمْ حَرَامٌ، كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هذَا، فِي شَهْرِكُمْ هذَا، فِي بَلَدِكُمْ هذَا.

তোমাদের রক্ততোমাদের ধন-সম্পদতোমাদের সম্মান তোমাদের পরস্পরের জন্য হারাম ও মর্যাদাপূর্ণযেমন তোমাদের এ দিনতোমাদের এ মাসতোমাদের এ শহর হারাম মর্যাদাসম্পন্ন। -সহীহ বুখারীহাদীস ৬৭

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পবিত্র মুক্কা মুকাররমায় যিলহজ্ব মাসে আরাফার দিন এ খুতবা দেন। মক্কা মুকাররমাযিলহজ্ব মাস এবং আরাফার দিনের কী সম্মান ও মর্যাদা- তা সকলেরই জানা আছে। এগুলোর যে কোনো ধরনের অমর্যাদা করা হারাম। এর সঙ্গে তুলনা করে রাসূলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক মুমিন-মুসলিমের জীবনসম্মান ও সম্পদের যে কোনো ধরনের ক্ষতি করাকে সকলের জন্যই হারাম করেছেন। মক্কা মুকাররমাযিলহজ্ব মাস এবং আরাফার দিনের মর্যাদা রক্ষা করা যেমন সকলের জন্য ফরযঠিক তেমনি যে কোনো মুসলমানের জান-মাল-ইয্যতের মর্যাদা রক্ষা করা এবং অনিষ্ট সাধন না করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য আবশ্যক। তাঁর এ শাশ্বত বাণী কিয়ামত পর্যন্ত আগত সকল এলাকার সব মুমিনের জন্যই বিধান হিসেবে সমানভাবে প্রযোজ্য।

ইসলাম প্রত্যেকেরই জান-মাল-ইয্যতের সমান নিরাপত্তা বিধান করেছে। যেন কারো দ্বারা অন্য কারো জীবনসম্মান ও সম্পদের সামান্যতম ক্ষতি না হয়। অতএব যারা কোনো মুসলমানের প্রাণের সামান্যতম ক্ষতিও করবেআখেরাতে তাদের ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে। কুরআন কারীমের উল্লিখিত আয়াতসমূহে এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসংখ্য হাদীসে সে বার্তা ও বিধানই দেওয়া হয়েছে। 

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

আপনি কি দ্বীনের খাদিম হতে চান?

...

মাওলানা আবু আহমাদ
১০ নভেম্বর, ২০২৪
১০৫৩ বার দেখা হয়েছে

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →