প্রবন্ধ
কুরআনের ভাষায় মানবহত্যার ভয়াবহতা
যে যত দুনিয়ামুখী হয়, শয়তান তাকে তত সহজে অন্যায়-অপরাধ ও পাপাচারে লিপ্ত করে ফেলতে পারে। কেউ কেউ জাগতিক পদ-পদবী ও ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য মানুষের ওপর অবিচার, জুলুম, শোষণ, নিপীড়নের পথ বেছে নেয়। আফসোসের বিষয় হল, কিছু কিছু মুসলিমের মাঝেও এ ন্যক্কারজনক চরিত্র ব্যাপক হয়ে উঠছে। মুসলিম হয়ে অপর মুসলিমকে হত্যা করা, রক্তপাত, খুন-খারাবীর মতো ভয়াবহ অপরাধ ঘটাতে তারা সামান্যতম দ্বিধা করে না। গত জুলাই-আগস্টে (২০২৪) ঘটে যাওয়া ভয়াবহতম নারকীয় হত্যাযজ্ঞ এর একটি ঘৃণ্য উদাহরণ। তখনকার ফ্যাসিবাদী শাসকগোষ্ঠীর হিংস্রতা থেকে নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতা, নিষ্পাপ শিশুসহ রক্ষা পায়নি কেউই। তারা শত শত তাজা প্রাণ নির্মমভাবে হত্যা করেছে। আহত করেছে অজস্র মানুষকে। অথচ অন্যায়ভাবে কোনো মুসলমানকে আঘাত করা, রক্তপাত ও খুন-খারাবী করা ইসলামে ভয়াবহ রকমের অপরাধ ও গুনাহ।
বনী আদমের কী মূল্য এবং কী তার মর্যাদা- তা আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে এভাবে ইরশাদ করেছেন-
وَ لَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِيْۤ اٰدَمَ وَ حَمَلْنٰهُمْ فِي الْبَرِّ وَ الْبَحْرِ وَ رَزَقْنٰهُمْ مِّنَ الطَّيِّبٰتِ وَ فَضَّلْنٰهُمْ عَلٰي كَثِيْرٍ مِّمَّنْ خَلَقْنَا تَفْضِيْلًا.
আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি এবং স্থলে ও জলে তাদের জন্য বাহনের ব্যবস্থা করেছি, তাদেরকে উত্তম রিযিক দান করেছি এবং আমার বহু মাখলুকের ওপর তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি। -সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ৭০
প্রতিটি আদম সন্তানের মর্যাদা ও তার প্রাণের মূল্য -সামাজিক বিচারে তার অবস্থান যা-ই হোক না কেন- আল্লাহর নিকট অপরিসীম। এজন্য তিনি অন্যায় রক্তপাত ও নরহত্যাকে ভয়াবহ অপরাধ সাব্যস্ত করেছেন।
ইসলামে যেসব অপরাধের সাজা মৃত্যুদণ্ড, সেসব অপরাধ সাব্যস্ত হওয়া ছাড়া কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করা সম্পূর্ণ হারাম। একজন ব্যক্তি কখন এবং কী কারণে হত্যার উপযুক্ত হয়- এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট বিবরণ রয়েছে কুরআন-সুন্নাহ্য়। ইসলামী ফিকহ শাস্ত্রে রয়েছে এর বিশদ আলোচনা ও বিশ্লেষণ। আল্লাহর বিধানের বাইরে গিয়ে অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করার বিন্দুমাত্র অধিকার কারো নেই।
মৃত্যুদণ্ডের অপরাধ ছাড়া একজন ব্যক্তিকে হত্যা করা সম্পর্কে কুরআন কারীমে রয়েছে কঠিন সাবধানবাণী! শক্তি ও ক্ষমতার দাপটে কোনো পাপিষ্ঠ হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধ করলে সে দুনিয়াতেও লাঞ্ছনার শিকার হবে আর আখেরাতে তার জন্য রয়েছে জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তি।
এ সম্পর্কে আগামীতে 'কুরআনের ভাষায় মানবহত্যার শাস্তি' বিষয়ে লেখার ইচ্ছা রইল।
কোনো মুমিন ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে হত্যা করতেই পারে না
পার্থিব জীবনে মানুষ জেনে না জেনে নানা অপরাধ ও পাপকর্ম করে বসে। এমনকি কবীরা গুনাহ পর্যন্ত করে বসে। কিন্তু শত অপরাধের মাঝেও কিছু কিছু অপরাধ এতটাই জঘন্য ও ভয়াবহ যে, কোনো মুমিন থেকে তা ঘটাই অবিশ্বাস্য। অন্যায়ভাবে মানবহত্যা তেমনই একটি অপরাধ। কোনো মুমিন থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে তা ঘটতেই পারে না।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَ مَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ اَنْ يَّقْتُلَ مُؤْمِنًا اِلَّا خَطَـًٔا.
এটা কোনো মুমিনের কাজ হতে পারে না যে, সে (ইচ্ছাকৃত) কোনো মুমিনকে হত্যা করবে। ভুলবশত এরূপ হয়ে গেলে সেটা ভিন্ন কথা। -সূরা নিসা (০৪) : ৯২
উক্ত আয়াত থেকে এটা স্পষ্ট যে, কোনো মুমিন ইচ্ছাকৃত অপর মুমিনের প্রাণহানী করতে পারে না। ভুলবশত কখনো এ দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। যেমন কোনো শিকারকে লক্ষ্য করে তির ছুড়ল, কিন্তু নিশানা ভুল করে কোনো ব্যক্তির গায়ে তা আঘাত হানল। তবে এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা যে একেবারেই বিরল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কিন্তু বাস্তবতা হল, মুসলিম সমাজে এখন ইচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ডের মতো জঘন্য পাপকর্মটি হরহামেশাই ঘটছে, তাও তুচ্ছ ও অতি নগণ্য কারণে। অথচ আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে অন্যায় রক্তপাত ও হত্যাকাণ্ডকে ভয়াবহ গুনাহ বলেছেন।
অন্যায় হত্যাকাণ্ড হারাম ও কুফরতুল্য গুনাহ
কুরআন কারীমে অন্যায় হত্যাকাণ্ডকে সুস্পষ্ট হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَ لَا تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِيْ حَرَّمَ اللهُ اِلَّا بِالْحَقِّ.
আর তোমরা সেই প্রাণকে হত্যা করো না, যার হত্যা আল্লাহ হারাম করেছেন, তবে (শরীয়ত অনুযায়ী) তোমরা তার অধিকার লাভ করলে ভিন্ন বিষয়। -সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ৩৩
সূরা ফুরকান-এ আল্লাহর সঙ্গে শিরকের নিষেধাজ্ঞার পরই অন্যায়ভাবে হত্যাকে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ الَّذِيْنَ لَا يَدْعُوْنَ مَعَ اللهِ اِلٰهًا اٰخَرَ وَ لَا يَقْتُلُوْنَ النَّفْسَ الَّتِيْ حَرَّمَ اللهُ اِلَّا بِالْحَقِّ وَ لَا يَزْنُوْنَ وَ مَنْ يَّفْعَلْ ذٰلِكَ يَلْقَ اَثَامًا، يُّضٰعَفْ لَهُ الْعَذَابُ يَوْمَ الْقِيٰمَةِ وَ يَخْلُدْ فِيْهٖ مُهَانًا.
এবং (আল্লাহর প্রিয় বান্দাগণ হল,) যারা আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোনো মাবুদের ইবাদত করে না এবং আল্লাহ যে প্রাণকে (হত্যা করা) হারাম করেছেন, তাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে না এবং তারা ব্যভিচার করে না। আর যে ব্যক্তিই এরূপ (অপরাধ) করবে, তাকে তার গুনাহের (শাস্তির) সম্মুখীন হতে হবে। কিয়ামতের দিন তার শাস্তি বৃদ্ধি করে দ্বিগুণ করা হবে এবং সে লাঞ্ছিত অবস্থায় তাতে সদা-সর্বদা থাকবে। -সূরা ফুরকান (২৫) : ৬৮-৬৯
উল্লিখিত আয়াতদ্বয়ে হত্যাকাণ্ডকে সুস্পষ্ট হারাম বলা হয়েছে। আর এর শাস্তি যে কত ভয়াবহ তাও স্পষ্টভাবে উল্লেখ হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম কোনো মুসলিমের সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত হওয়াকে কুফর আখ্যা দিয়ে ইরশাদ করেছেন-
سِبَابُ المُسْلِمِ فُسُوقٌ، وَقِتَالُه كُفْرٌ.
মুসলমানকে গালি দেওয়া পাপাচার, আর তার সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত হওয়া কুফর। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৮
এক মুসলিমের সাথে শুধু লড়াই বা বিবাদে লিপ্ত হওয়াই যদি কুফর হয়, তাহলে তাকে হত্যা করা যে কত কঠিন গুনাহের কাজ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
হত্যা : সবচেয়ে ভয়াবহ কবীরা গুনাহের একটি
আনাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
أَكْبَرُ الكَبَائِرِ: الإِشْرَاكُ بِاللهِ، وَقَتْلُ النَّفْسِ، وَعُقُوقُ الوَالِدَيْنِ، وَقَوْلُ الزُّورِ أَوْ قَالَ: وَشَهَادَةُ الزُّورِ.
কবীরা গুনাহের মাঝে সবচেয়ে ভয়াবহ চারটি :
১. আল্লাহর সাথে শরীক করা।
২. কোনো ব্যক্তিকে (অন্যায়ভাবে) হত্যা করা।
৩. পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া।
৪. মিথ্যা বলা।
বর্ণনাকারী বলেন, অথবা বলেছেন মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৮৭১
অন্যায়ভাবে একজন মানুষকে হত্যা করা গোটা মানবজাতিকে হত্যা করার সমতুল্য
অন্যায় হত্যাকাণ্ড আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট অত্যন্ত ভয়াবহ অপরাধ। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
...كَتَبْنَا عَلٰي بَنِيْۤ اِسْرَآءِيْلَ اَنَّهٗ مَنْ قَتَلَ نَفْسًۢا بِغَيْرِ نَفْسٍ اَوْ فَسَادٍ فِي الْاَرْضِ فَكَاَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيْعًا، وَ مَنْ اَحْيَاهَا فَكَاَنَّمَاۤ اَحْيَا النَّاسَ جَمِيْعًا.
...আমি বনী ইসরাঈলের প্রতি বিধান দিয়েছিলাম, কেউ যদি হত্যা অথবা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টির অপরাধ ছাড়া কাউকে হত্যা করে, তবে সে যেন গোটা মানবজাতিকে হত্যা করল। আর যে ব্যক্তি কারো প্রাণ রক্ষা করে, সে যেন গোটা মানবজাতির প্রাণ রক্ষা করল। -সূরা মায়িদা (৫) : ৩২
একজন মানুষকে হত্যা করা সংখ্যার বিবেচনায় তো মাত্র একটিই প্রাণহানী; কিন্তু আল্লাহ তাআলার নিকট এই একটি হত্যার অপরাধ গোটা মানবজাতিকে হত্যা করার সমতুল্য।
একজন মানুষকে হত্যা করা সম্পর্কে কুরআন কারীমের যখন এই ভাষ্য, তাহলে শিশু-নারী নির্বিশেষে গণহত্যা চালানো কতটা ভয়াবহ- তা কি বলার অপেক্ষা রাখে?
আল্লাহ তাআলার নিকট একজন মুমিনকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা কতটা ভয়াবহ ব্যাপার তা নিম্নের হাদীস থেকেও অনুমেয়।
আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
قَتْلُ الْمُؤْمِنِ أَعْظَمُ عِنْدَ اللهِ مِنْ زَوَالِ الدُّنْيَا.
মুমিনকে হত্যা করা আল্লাহর নিকট গোটা পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার চেয়ে গুরুতর। -সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৩৯৮৮
হত্যা এমন অপরাধ, যা তওবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে দেয়
হত্যা কতটা ভয়াবহ অপরাধ, তা নিম্নের হাদীস থেকে পরিষ্কার হয়ে ওঠে। আবুদ দারদা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি-
كُلُّ ذَنْبٍ عَسَى اللهُ أَنْ يَغْفِرَه، إِلّا مَنْ مَاتَ مُشْرِكًا، أَوْ مُؤْمِنٌ قَتَلَ مُؤْمِنًا مُتَعَمِّدًا.
আল্লাহ (চাইলে) সব গুনাহই ক্ষমা করবেন; কিন্তু মুশরিক অবস্থায় কেউ মারা গেলে অথবা ঈমানদার ব্যক্তি অপর কোনো ঈমানদারকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করলে (তা ক্ষমা করবেন না)। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪২৭০; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৩৯৮৪
অপর হাদীসে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
يَجِيءُ المَقْتُولُ بِالقَاتِلِ يَوْمَ القِيَامَةِ نَاصِيَتُه وَرَأْسُه بِيَدِه وَأَوْدَاجُه تَشْخَبُ دَمًا، يَقُولُ : يَا رَبِّ! قَتَلَنِي هذَا، حَتّى يُدْنِيَه مِنَ العَرْشِ، قَالَ: فَذَكَرُوا لِابْنِ عَبَّاسٍ التّوْبَةَ، فَتَلَا هذِهِ الْآيَةَ: وَ مَنْ يَّقْتُلْ مُؤْمِنًا مُّتَعَمِّدًا قَالَ: مَا نُسِخَتْ هذِه الْآيَةُ، وَلَا بُدِّلَتْ، وَأَنّى لَهُ التّوْبَةُ
খুন হওয়া ব্যক্তি খুনীকে সঙ্গে করে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলার সামনে উপস্থিত হবে। নিহত ব্যক্তির মাথা তার হাতেই থাকবে। শিরাগুলো থেকে রক্ত ঝরতে থাকবে। সে বলবে, হে আমার প্রভু! এ ব্যক্তি আমাকে হত্যা করেছে। এভাবে সে হত্যাকারীকে আরশের অতি নিকটে নিয়ে যাবে। বর্ণনাকারী বলেন, লোকেরা হত্যাকারীর তওবা সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-কে প্রশ্ন করলে তিনি সূরা নিসার আয়াত-
وَ مَنْ يَّقْتُلْ مُؤْمِنًا مُّتَعَمِّدًا... .
[যে ব্যক্তি কোনো মুমিনকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করবে... -সূরা নিসা (৪) : ৯৩]
-পাঠ করলেন এবং বললেন, উক্ত আয়াত রহিত হয়নি, পরিবর্তনও হয়নি। তিনি বলেন, তার তওবার সুযোগ কোথায়? -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩০২৯; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪৮৬৬
একজন ব্যক্তির পক্ষ থেকে গুনাহ থেকে পরিত্রাণ পাবার সর্বশেষ সুযোগ হল, আল্লাহর কাছে অন্তর থেকে মাফ চাওয়া, তওবা করা। মুমিন যত বড় অন্যায় ও পাপকর্মই করুক না কেন, অন্তর থেকে তওবা করলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেবেন। কিন্তু হত্যার ভয়াবহতা এতটাই জঘন্য যে, হত্যাকারী সেই মহা নিআমত তওবা থেকেই বঞ্চিত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। এত বড় হুমকির পরও কি কোনো মুমিনের পক্ষে সম্ভব অন্য কোনো মুমিন-মুসলিমকে হত্যা করা?
তাছাড়া অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা তো বান্দার হক। যথানিয়মে হক আদায় করা বা বান্দা মাফ করা ছাড়া আল্লাহ কিছুতেই বান্দার হক মাফ করবেন না।
হত্যার সমকালীন একটি রূপ
জাহেলী যুগসহ সবযুগেই একশ্রেণির পাষণ্ড মানুষের স্বভাব ছিল, অর্থাভাব ও দারিদ্রের ভয়ে সন্তানকে হত্যা করা। এমনকি জাহেলি যুগে কলঙ্ক থেকে বাঁচার জন্য নিজের কন্যা সন্তানকে হত্যা করাও স্বাভাবিক চোখেই দেখা হত।
আল্লাহ তাআলা এহেন জঘন্য কাজ থেকে তাদেরকে এবং সমস্ত মানুকে সাবধান করে দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে-
وَ لَا تَقْتُلُوْۤا اَوْلَادَكُمْ خَشْيَةَ اِمْلَاقٍ نَحْنُ نَرْزُقُهُمْ وَ اِيَّاكُمْ اِنَّ قَتْلَهُمْ كَانَ خِطْاً كَبِيْرًا.
দারিদ্র্যের ভয়ে নিজ সন্তানদেরকে হত্যা করো না। আমি তাদেরকেও রিযিক দেই এবং তোমাদেরকেও। নিশ্চয়ই তাদেরকে হত্যা করা গুরুতর অপরাধ। -সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ৩১
বর্তমানে আমাদের সমাজে জাহেলী যুগের মতো সন্তান জন্মের পর দারিদ্র্যের ভয়ে বা কন্যাসন্তান হওয়ার কারণে হত্যা করে ফেলার ঘটনা হয়তো খুব কম; কিন্তু মেয়ে হওয়ার কারণে অথবা একটি বা দুটির বেশি সন্তান হওয়াকে অপছন্দ করার কারণে গর্ভাবস্থায় জীবন্ত সন্তানকে মেরে ফেলার ঘটনা প্রায়শই ঘটে থাকে। অথচ গর্ভের শিশুর প্রাণ এসে যাওয়ার পর তাকে ঔষধের মাধ্যমে বা অন্য কোনো উপায়ে মেরে ফেলা সুস্পষ্ট হত্যার শামিল। জন্মলাভের পর হত্যা করা আর গর্ভের জীবন্ত শিশুকে হত্যা করা একই রকম ঘৃণ্য অপরাধ।
এই হত্যা করে ফেলা শিশুদের সম্পর্কে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা জিজ্ঞাসা করবেন।
بِاَيِّ ذَنْۢبٍ قُتِلَتْ.
তাকে কী অপরাধে হত্যা করা হয়েছিল? -সূরা তাকবীর (৮১) : ৯
অর্থাৎ পরকালে এই সন্তানদেরকে হাজির করে জিজ্ঞেস করা হবে, তাদেরকে কী অপরাধে হত্যা করা হয়েছিল? এর দ্বারা উদ্দেশ্য হবে সেই জালেমদেরকে শাস্তি দেওয়া, যারা তাদের প্রতি এরূপ পাশবিক আচরণ করেছিল।
মুসলমানের জান-মালে যে কোনো ধরনের অন্যায় হস্তক্ষেপই হারাম
বিদায় হজে¦র ভাষণে প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত জোরালো কণ্ঠে বলেন-
فَإِنّ دِمَاءَكُمْ، وَأَمْوَالَكُمْ، وَأَعْرَاضَكُمْ بَيْنَكُمْ حَرَامٌ، كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هذَا، فِي شَهْرِكُمْ هذَا، فِي بَلَدِكُمْ هذَا.
তোমাদের রক্ত, তোমাদের ধন-সম্পদ, তোমাদের সম্মান তোমাদের পরস্পরের জন্য হারাম ও মর্যাদাপূর্ণ, যেমন তোমাদের এ দিন, তোমাদের এ মাস, তোমাদের এ শহর হারাম মর্যাদাসম্পন্ন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৭
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পবিত্র মুক্কা মুকাররমায় যিলহজ্ব মাসে আরাফার দিন এ খুতবা দেন। মক্কা মুকাররমা, যিলহজ্ব মাস এবং আরাফার দিনের কী সম্মান ও মর্যাদা- তা সকলেরই জানা আছে। এগুলোর যে কোনো ধরনের অমর্যাদা করা হারাম। এর সঙ্গে তুলনা করে রাসূলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক মুমিন-মুসলিমের জীবন, সম্মান ও সম্পদের যে কোনো ধরনের ক্ষতি করাকে সকলের জন্যই হারাম করেছেন। মক্কা মুকাররমা, যিলহজ্ব মাস এবং আরাফার দিনের মর্যাদা রক্ষা করা যেমন সকলের জন্য ফরয, ঠিক তেমনি যে কোনো মুসলমানের জান-মাল-ইয্যতের মর্যাদা রক্ষা করা এবং অনিষ্ট সাধন না করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য আবশ্যক। তাঁর এ শাশ্বত বাণী কিয়ামত পর্যন্ত আগত সকল এলাকার সব মুমিনের জন্যই বিধান হিসেবে সমানভাবে প্রযোজ্য।
ইসলাম প্রত্যেকেরই জান-মাল-ইয্যতের সমান নিরাপত্তা বিধান করেছে। যেন কারো দ্বারা অন্য কারো জীবন, সম্মান ও সম্পদের সামান্যতম ক্ষতি না হয়। অতএব যারা কোনো মুসলমানের প্রাণের সামান্যতম ক্ষতিও করবে, আখেরাতে তাদের ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে। কুরআন কারীমের উল্লিখিত আয়াতসমূহে এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসংখ্য হাদীসে সে বার্তা ও বিধানই দেওয়া হয়েছে।
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
পর্দা নারীর আভিজাত্য ও মর্যাদার প্রতীক
দু'টি চিত্র লক্ষ্য করুন। প্রথমটি ইসলামের স্বর্ণযুগের। আর দ্বিতীয়টি তথাকথিত প্রগতি-যুগের। চিত্র-১ খলী...
হাদীসের পাঠ : নাজাতের পথ
الحمد لله رب العالمين، والصلاة والسلام على سيد الأنبياء والمرسلين سيدنا ومولانا محمد وعلى آله وأصحاب...
মহিলাদের দীনী শিক্ষার গুরুত্ব ও পদ্ধতি
আল্লাহ তা'আলা মানুষকে ঈমান ও আমলের দায়িত্ব দিয়েছেন। ঈমান ও আমল বিষয়ে জানতে হলে ইলমে দীন হাসিল করা...
দ্বীনী রচনাবলী পাঠ : শৈথিল্য ও সীমালংঘন
...