প্রবন্ধ

বিপদ-আপদ-মুসীবতে অনুযোগ নয়; প্রত্যাবর্তন ও অনুতাপই শেষ কথা

লেখক:মাসিক আলকাউসার
২৭ আগস্ট, ২০২৪
৩৩৬২ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

যেকোনো মানুষের জীবনে বিপদ-আপদদুভোর্গ হঠাৎ নেমে এলে কিংবা চলতে থাকলে মানুষের স্বাভাবিক জীবনে ছন্দপতন ঘটেস্বাচ্ছন্দ্য ও প্রশান্তি ব্যাহত হয়এটা সবাই  অনুভব করি। অনেক সময় ঘটিত বিপদ বা সংকটের সঙ্গে বিপদগ্রস্ত ও সংকটগ্রস্ত ব্যক্তির বিশেষ কোনো দায়দায়িত্বগত সম্পর্কও থাকে না। তারপরও বিপদআপদ আসেদুর্ঘটনাও ঘটে। এতে মানুষ মর্মাহত হয়বিষন্ন ও পেরেশান হয়। কোনো বিপদ ও সংকট আসলে এ পর্যন্ত প্রতিক্রিয়া হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু তারপরও আরও কিছু ঘটে মানুষের অন্তরে ও বোধে। যদি মানুষটি আল্লাহভীরু হনতাকওয়া অবলম্বনকারী হননিজের আমল ও কৃতকর্ম সম্পর্কে সুবিবেচক হন তাহলে তিনি ধৈর্য ধরেন এবং আল্লাহর তায়ালার দরবারে সাহায্যপ্রার্থীর হাত তুলে ধরেন  ও অনুতপ্ত হন। অনুশোচনা ও অন্তরশুদ্ধির চেষ্টায় নিয়োজিত হন । পক্ষান্তরে যারা তাকওয়াহীন জীবন ও মন লালন করেনজীবনের শেষ গন্তব্য ও পরিণতি সম্পর্কে গভীরভাবে ভাবতে অনীহ থাকেন তারা ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন। অভিযোগ-অনুযোগের তুফান ছুটিয়ে দেন। অন্য কাউকে না ধরে বিপদ ও সংকট তার মতো নিদোর্ষ মানুষকে কেন ধরল এনিয়ে অন্তহীন জিজ্ঞাসা ও আফসোসের পাঁকে ক্রমাগত হারিয়ে যেতে থাকেন। আর এটি যে কেবল কিছু প্রকাশ্য গোনাহগার কিংবা ফাসেক ফাজেরের বেলাতেই ঘটে এমন নয়। দুঃখজনক হলেও বাস্তব যেদ্বীনদার হিসেবে গণ্য মুসলমানকেও বিপদ-আপদে অভিযোগঅনুযোগআফসোস ও জিজ্ঞাসার  ধ্বংসাত্মক ভ্রান্তিতে ডুবে যেতে দেখা যায়। শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে এটা এক মারাত্মক ক্ষতিকর মনোভাব ও আচরণ। কোনো মুসীবতকোনো বিপদআপদ আসলে অভিযোগপ্রবণ মানসিকতার সৃষ্টি হওয়ানিজের  নিভুর্লতা ও নির্দোষিতা ব্যক্ত করতে থাকানিজের সম্পর্কে  উঁচুমন্যতায় ভোগা শরীয়তের চোখে এক সর্বনাশা গোনাহ। এই অনুভূতি ও আচরণ মানুষকে আরও বহু ক্ষতিকর চিন্তা ও পরিণতির শিকার বানিয়ে থাকে। সেজন্যই এ বিষয়ে শরীয়তের দৃষ্টিকোণ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত একটি ধারণা থাকা সঙ্গত।

মুসলমানের স্থায়ী আবাস হচ্ছে পরকালে। এই দুনিয়ার জীবন অতিবাহিত করেই তাকে পরকালের জীবনে যেতে হয়। দুনিয়ায় মুসলমানের জীবনে কখনো কখনো নেমে আসা বিপদদুর্যোগ ও দুর্ঘটনাকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। এক. কখনো কখনো বিপদ নেমে আসে মন্দ কৃতকর্মের শাস্তি  হিসেবে। যেমন কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে,

ظَهَرَ الْفَسَادُ فِی الْبَرِّ وَ الْبَحْرِ بِمَا كَسَبَتْ اَیْدِی النَّاسِ.

জলে-স্থলে বিপর্যয় প্রকাশিত হয়েছে মানুষের কৃতকর্মের কারণে।রূম ৪১

দুই. কখনো এই বিপদ-আপদ ও সংকটের কারণ হয় মানুষকে পরীক্ষা করা। যেমন: কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে,

وَ لَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَیْءٍ مِّنَ الْخَوْفِ وَ الْجُوْعِ وَ نَقْصٍ مِّنَ الْاَمْوَالِ.

এবং আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা  করব ভীতি ও ক্ষুধা দিয়ে এবং ধন-সম্পদের হ্রাস ঘটিয়ে ।বাকারা ১৫৫

তিন. কখনো কখনো মুসলমানের সম্মানমর্যাদা  বা দারাজাত বুলন্দ করার উদ্দেশ্যে আল্লাহ তাআলার ইচ্ছায় এসব ঘটনা ঘটে থাকে। যেমন মুসলিম শরীফের একটি হাদীসে রয়েছে, ....মুমিনের সব কর্মকাণ্ডই উত্তম। যদি কোনো আনন্দ তাকে স্পর্শ করে তবে সে কৃতজ্ঞ হয়। তখন সেটা তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর যদি কোনো বিপদ-আপদ তাকে স্পর্শ করে তবে সে ধৈর্য ধরে। তখন সেটাও তার জন্য কল্যাণকর হয়।

বিপদ-আপদদুর্ঘটনাদুর্যোগ সহজ কথায় মুসীবত আসার প্রধান এই তিনটি কারণ আমরা শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে পাই-কৃতকর্মের শাস্তিপরীক্ষা ও মর্যাদা বৃদ্ধি। কৃতকর্মের শাস্তি বাবদ মুসীবত আসলে তওবা ও অনুশোচনা প্রকাশ করে ক্ষমার যোগ্য হওয়ার চেষ্টাটাই সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত। পরীক্ষার অর্থ হচ্ছে কৃতকার্য ও অকৃতকার্য হওয়ার দ্বিবিধ খোলা দরজার মধ্য থেকে কৃতকার্য হওয়ার দরজাটি বেছে নেওয়া। বিপদ ও মুসীবতে যখন বান্দার করণীয় কিছু থাকে নাতখন হাহুতাশধৈর্যহীনতা ও অনুযোগ প্রকাশ না করে ধৈর্য ধারণ করা এবং ইস্তেগফার ও দুআর মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য  চাইলেই পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। এখানে তো পরীক্ষাটাই হয় ধৈর্য ও অধৈর্যের। অনুতাপঅনুযোগের। এ পরীক্ষায় ধৈর্য ও অনুতাপ দিয়েই তাই কৃতকার্য হওয়া সম্ভব।

মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য যে মুসীবত আসে সেখানেও তো বান্দার জন্য সঙ্গত ও উপযোগী অনুভূতি ও আচরণ প্রকাশ পেলে বান্দার মযার্দা বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। সেটাও তো ধৈর্য ও অনুতাপ অবলম্বন করেই সম্ভব। মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য মুসীবত আসবে আর বান্দা তার মর্যাদার গায়ে ধৈর্যহীনতা ও অনুযোগের দাগ লাগিয়ে দেবে তারপরও বান্দার মর্যাদা বাড়বে এটা তো হতে পারে না।

আসলে যার মাঝে যতটুকু তাকওয়া ও খোদাভীতির প্রাচুর্য বিদ্যমানবিপদ-আপদসংকটে তিনি তত বেশি অনুতাপের পথ বেছে নিয়ে থাকেন। নিজের গুনাহর অনুভূতি তার অন্তরে জেগে উঠে। গুনাহ থেকে মুক্তির জন্য ইস্তেগফার করতে তিনি অস্থির হয়ে ওঠেন। আল্লাহর  বান্দা হিসেবে সবচেয়ে বড় ও শ্রেষ্ঠ মুমিন ছিলেন হযরত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামঅন্যান্য নবী রাসুলগণ এবং পরবতীর্তে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ। তাঁদের জীবনে বিপদ-আপদসংকট আসলে তারা আল্লাহ তায়ালার দিকে রুজু হতেন। তাদের অন্তরে নিজেদের সম্পর্কে ভয়  সক্রিয় হয়ে উঠত। তারা মনে করতেনতাদের কৃত আমলের ত্রট্টটির কারণেই এমন ঘটেছে। অথচ গুনাহর মধ্যে নিমজ্জিত মানুষ হয়ে আজ আমরা শেকায়েত করি। অভিযোগ অনুযোগ করি। অন্যের সঙ্গে তুলনা দিয়ে বলি আমি তো এরকম করি নাআমি তো এই কাজ করি নাতাহলে আমার উপর এই বিপদ কেন আসলআমি যে কত রকম গুনাহ কত শত-হাজার বার করেছি ও করে চলেছি সেগুলো আমার সামনে আসে নাবিপদের সময় সেগুলো মনেও পড়ে না। এ কথা সত্য যেযেসব বিপদ ও মুসীবত ঘটানোর ক্ষেত্রে অন্য কোনো বান্দার ইচ্ছাকৃত হস্তক্ষেপ থাকে সেসব মুসীবতের ক্ষেত্রে একদিকে তাদের বিরুদ্ধে বিচার দাবি ও ক্ষতিপূরণ আদায়ের বিষয়ে যাওয়া যেতে পারে। এটা বাহ্যিক কার্যকারণ থেকে করা যায়। শরীয়ত এ ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। কিন্তু বাহ্যিকভাবে মানুষের ইচ্ছাকৃত আচরণেই হোক যেমন মারপিটডাকাতি ইত্যাদি আর মানুষের ইচ্ছাবহিভুর্তই হোক যেমনঝড়বন্যা,গাছচাপা পড়া ইত্যাদি যেকোনো মুসীবত আসলে মুমিনের কাজ হচ্ছে আল্লাহর ভয় ও অনুতাপ নিজের অন্তরে জাগ্রত করানিজের শুদ্ধতা ও দোষমুক্ততার সাফাই গাওয়া  নয়।

বিপদে-আপদে মানুষের অনুযোগ ও নিজের নির্দোষতা প্রকাশের ক্ষতি বহুমাত্রিক। যদি ধরেও নেওয়া হয় যেবিপদগ্রস্ত মানুষের কোনো দোষ ও গুনাহ্  নেই বা ছিল নাতবুও তার নিজের অন্তরে গুনাহ্র ভয় না থাকামুসীবতের কারণে মনে ও যবানে শেকায়াত ও অনুযোগ প্রকাশ করা হল  কবীরা গুনাহ্। এ গুনাহটি এমন যেএর সঙ্গে আরও বহু গুনাহর ধারাবাহিকতা চলে আসে। এ গুনাহটির কারণে অন্তরে গুনাহ সম্পর্কে গাফিলতি চলে আসে। এর দ্বারা অহংকার তীব্র হয়ে উঠতে থাকে। এভাবে আল্লাহর যেকোনো ফয়সালার ব্যাপারে প্রশ্ন উত্থাপনের মেজাজ গড়ে ওঠে। এরকম আরও ভয়ঙ্কর সব গুনাহ ও ক্ষতির কপাট খুলে যায়। এজন্যই কেবল বিপদের  সময়েই নয়সবসময়ই মুমিনের জন্য অনিবার্য অনুভূতি ও করণীয় হলআল্লাহ তায়ালার দিকে প্রত্যাবর্তন। এ প্রত্যাবর্তন কখনো কৃতজ্ঞতার ভাষায়কখনো ধৈর্য্য ধারণ ও সাহায্য প্রার্থনার ভাষায়কখনো তওবা ও ইস্তেগফারের ভাষায় প্রকাশিত হতে পারে। মুমিনের জীবনে যখনই কোনো মুসীবত নেমে আসেতখন সেটাকে উপদেশদাতা ও সতর্ককারীরূপে গ্রহণ করে অনুতাপ ও প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হওয়াই মুমিনের কামিয়াবী। বড়ই বদকিসমতীর কারণ হবে যদি এই উপদেশদাতা ও সতর্ককারীর বার্তা  না বুঝে উল্টো পথের যাত্রী হয়ে যাই। দুনিয়ার  একটি বিপদ বা মুসীবত যেন দুনিয়া ও আখেরাতের সহস্র মুসীবতের কারণে পরিণত না হয়এ সম্পর্কে আমাদের সবার সজাগ থাকা কর্তব্য। 

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →