প্রবন্ধ
একটি সুন্নাহকে বাঁচাবো বলে (৭৮তম পর্ব) – জুমাবারীয় অফার
জুমাবার সপ্তাহের সেরা দিন। কুরআন কারীমেও এই দিনের নাম আছে। (يوم الجمعة) জুমু‘আর দিন। বলা হয়ে থাকে জুমাবার হল, গরীবের ঈদের দিন। আল্লাহর কাছে বান্দার ফিরে আসার দিন। প্রিয় রবের সাথে নতুন করে সম্পর্ক গড়ার দিন। দুনিয়ার বিশেষ বিশেষ দিনে, সরকারের পক্ষ থেকে, বিভিন্ন কোম্পানীর পক্ষ থেকে অনেক অফার থাকে। ধামাকা অফার, ধুমধাম অফার। বৈশাখী অফার। ঈদের অফার। আল্লাহ তা‘আলা বিশেষ দিনগুলোতে বান্দাকে বাড়তি কিছু সুযোগ দিয়ে থাকেন। অন্য দিনের তুলনায়, জুমাবারে কিছু অতিরিক্ত সুন্নাহ আছে। আমল আছে। জুমাবারে আল্লাহ তা‘আলা বান্দার জন্যে বাড়তি প্রাপ্তির ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন। নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলে গেছেন,
خَيْرُ يَوْمٍ طَلَعَتْ عَلَيْهِ الشَّمْسُ يَوْمُ الْجُمُعَةِ، فِيهِ خُلِقَ آدَمُ، وَفِيهِ أُدْخِلَ الْجَنَّةَ، وَفِيهِ أُخْرِجَ مِنْهَا
জুমাবার সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ দিন। এই দিনে আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এই দিনই তাকে জান্নাতে দাখিল করা হয়েছে। এই দিনই তাকে জান্নাত থেকে বের করা হয়েছে।
(আবু হুরায়রা রা., মুসলিম)
জুমাবারের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো, এদিনে বিশেষ একটা মুহূর্ত আছে, তখন বান্দা তার রবের কাছে যা-ই চায়, প্রিয় রব দিয়ে দেন। বান্দাকে বিশেষ মুহূর্তটা উপহার দিয়ে, রাব্বে কারীম হয়তো চেয়েছেন, এই দিন বান্দা বেশি বেশি তার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করুক। বেশি বেশি ইবাদত করার চেষ্টা করুক। পুরো সপ্তাহে ইবাদত-বন্দেগীতে যা ঘাটতি হয়েছে, তা এদিনে এসে পুষিয়ে নিক। তার কলবকে সাফসুতরো করে নিক। বাড়তি সুন্নাহ-নফল-ওয়াজিব-ফরজ আদায় করে নিজেকে রবের কাছে আরও বেশি প্রিয় করে তুলুক। তার আমলনামার পুঁজি বাড়িয়ে নিক। গুনাহের ভার কমিয়ে আনুক। পেয়ারা নবীজি জুমার দিনের কথা আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন,
فِيهِ سَاعَةٌ، لاَ يُوَافِقُهَا عَبْدٌ مُسْلِمٌ، وَهُوَ قَائِمٌ يُصَلِّي، يَسْأَلُ اللَّهَ تَعَالَى شَيْئًا، إِلاَّ أَعْطَاهُ إِيَّاهُ
এদিনে একটা সময় আছে, মুসলিম বান্দা একাগ্র হয়ে নাছোড়বান্দার মতো, আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ করতে থাকলে, তিনি তাকে দিয়েই দেন।
নবীজি একথা বলার পর, হাত দিয়ে ইশারা দিয়ে বুঝিয়েছেন, দু‘আ কবুলের সেই সময়টা খুব দীর্ঘ নয়। স্বল্পমেয়াদী।
(আবু হুরায়রা রা., বুখারি)
তাহলে সময়টা কখন? এ-ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামেরও কৌতূহল ছিল। বড় বড় সাহাবী এর অনুসন্ধান করেছেন। হাদীসে কয়েকটা সময় উল্লেখিত হয়েছে।
প্রথম সময়:
ইবনে উমার রা.-এর সাথে দেখা হল আবু বুরদার সাথে। জানতে চাইলেন,
-আপনার আব্বু (আবু মুসা আশআরী রা.)-কে জুমার দিনের বিশেষ সময় সম্পর্কে কিছু বলতে শুনেছেন?
-জি¦, শুনেছি। আব্বু বলেছেন, ‘আমি আল্লাহর রাসূলের কাছে শুনেছি,
هِيَ مَا بَيْنَ أَنْ يَجْلِسَ الإِمَامُ إِلَى أَنْ تُقْضَى الصَّلاَةُ
সে সময়টা হল, ইমাম মিম্বরে বসার পর থেকে সালাত সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত (মুসলিম ৮৫৩)।
দ্বিতীয় সময়:
জুমার দিনের শেষ সময়।
يَوْمُ الجُمُعة ثِنْتَا عَشْرَةَ سَاعَةً ، لاَ يُوجَد فِيهَا عَبْدٌ مُسْلِمٌ يَسْأَلُ الله شَيْئاً إِلاَّ آتَاهُ إِيَّاهُ ، فَالْتَمِسُوهَا آخِرَ سَاعَةٍ بَعْدَ العَصْر
জুমার দিন বারো ঘণ্টা। (তার মধ্যে এমন বিশেষ এক ঘণ্টা বা মুহূর্ত আছে) তাতে কোনও মুসলিম বান্দা দু‘আ করলে, আল্লাহ তা‘আলা তা কবুল করেই নেন। তোমরা সে বিশেষ মুহূর্তকে, আসরের পরে (মাগরিবের আগে) শেষ সময়টাতে অনুসন্ধান করো (জাবের বিন আবদুল্লাহ রা.। আবু দাউদ ১০৪৮)
আরেক হাদীসে সময়টা আসরের পর থেকে সূর্যডুবি পর্যন্ত বলা হয়েছে।
কিছু কথা:
(এক) প্রথম সময়টা জুমার আযানের পর থেকে সালাত শেষ হওয়া পর্যন্ত ধরা যেতে পারে।
(দুই) উভয় সময়ই সালাতের সাথে সম্পৃক্ত। জুমা বা আসর। সালাতের আগে ও পরে দু‘আ করলে, এমনিতেই কবুল করা হয়। বিশেষ করে জুমার সময়টা। তখন অনেক মানুষের জমায়েত হয়। সবার এক সালাত। এক ইমাম। আরাফাতের ময়দানের মতো। এ সময় দু‘আর বাড়তি কিছু উপলক্ষ্যও থাকে। আযানের দু‘আ। আযান ও খুতবার মধ্যবর্তীয় দু‘আ। দুই খুতবার মধ্যবর্তী দু‘আ।
(তিন) খুতবা শুরু করার পর আর কোনও দু‘আ নেই। সালাম-কালাম নেই। তখন খুতবা শোনা ওয়াজিব।
(চার) প্রথম হাদীসে আছে (وَهُوَ قَائِمٌ يُصَلِّي) সে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করা অবস্থায়। প্রশ্ন হল, সময়টা যদি আসরের পর হয়, তখন তো সালাত নেই?
ক. সালাত অর্থ দু‘আ করা। কিয়াম অর্থ গুরুত্বের সাথে লেগে থাকা।
খ. (يُصَلِّي) সালাত আদায় করতে থাকা মানে, সালাতের অপেক্ষায় থাকা। হাদীসে আছে, সালাতের অপেক্ষায় থাকাও সালাত।
لَا يَزَالُ أَحَدُكُمْ فِي صَلَاةٍ مَا دَامَتْ الصَّلَاةُ تَحْبِسُهُ لَا يَمْنَعُهُ أَنْ يَنْقَلِبَ إِلَى أَهْلِهِ إِلَّا الصَّلَاةُ
তোমাদের কেউ ঘরে না গিয়ে সালাতের অপেক্ষায় থাকলে, সে মূলত সালাতেই সময় কাটাল (আবু হুরায়রা রা. মুসলিম)।
(পাঁচ) সায়ীদ ইবনু জুবায়ের রহ. জুমার দিন আসরের পর বাসায় যেতেন না। বিশেষ মুহূর্তের সন্ধানে মসজিদে অবস্থান করতেন। সূর্যডুবি পর্যন্ত কারো সাথে কথা বলতেন না।
(ছয়) দীর্ঘ সময় সম্ভব না হলেও অন্তত মাগরিবের আযানের একটু আগে হলেও মসজিদে যাওয়ার চেষ্টা করা। দু‘আর সৌভাগ্য অর্জন করতে।
(সাত) দু‘আর জন্যে মসজিদেই যেতে হবে, এমনটা নয়। মসজিদে যাওয়ার সুযোগ না থাকলে, নিজের অবস্থানে থেকেও দু‘আ করা যায়।
(আট) একভাই আসরের পর সিজদার আয়াত সম্বলিত সূরা তিলাওয়াত করেন। সিজদার আয়াত পড়েই সিজদায় লুটিয়ে পড়েন। দীর্ঘ সময় ধরে দু‘আ করতে থাকেন। তার বক্তব্য হল,
-আসরের পর কোনও সালাত নেই। কিন্তু তিলাওয়াতে সিজদা আছে। আর সিজদার দু‘আতেই বেশি আনুগত্য থাকে বলে মনে হয়। কারণ,
أقرب ما يكون العبد من ربه وهو ساجد ، فأكثروا الدعاء
বান্দা সিজদা অবস্থাতেই তার রবের বেশি নিকটবর্তী থাকে। সুতরাং তোমরা বেশি বেশি দু‘আ করো (আবু হুরায়রা রা. মুসলিম)।
মা-বোনেরা কি এই মহাসৌভাগ্যের ছোঁয়া পেতে পারেন?
-অবশ্যই পারেন। তারা জুমার সময়টা ধরতে না পারলেও, আসরের পরেরটা অনায়াসে ধরতে পারেন। আসরের আগেই কাজকর্ম গুছিয়ে জায়নামাজে বসে যেতে পারেন।
আমার নানা সমস্যা? আমি বিপদে আছি? পরিবারের কেউ গুরুতর অসুস্থ? আর্থিক অনটন প্রকট? সামাজিক বা রাজনৈতিক শত্রুরা কষ্ট দিচ্ছে? বিশেষ কোনও চাওয়া আছে? চাকুরি-বিয়ে-সন্তান?
-জুমাবারে বসে যাই না! জুমার সময়? আসরের পর?
রাব্বে কারীম তো আমাকে দেয়ার জন্যে ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন। আমি চাইতে দেরি।
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
ইস্তিগফারের অফুরন্ত ফযীলত
[প্রদত্ত বয়ান থেকে সংগৃহীত] হামদ ও সালাতের পর... রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের...
ঈমান-আমল সুরক্ষিত রাখতে হক্কানী উলামায়ে কেরামের সঙ্গে থাকুন, অন্যদের সঙ্গ ছাড়ুন
[প্রদত্ত বয়ান থেকে সংগৃহীত] হামদ ও সালাতের পর... قال الله تعالى: يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتّ...
ইসলামে শ্রমিকের অধিকার
ইসলাম একটি কালজয়ী অনবদ্য জীবন বিধান। বিশ্বসৃষ্টির শুরু থেকেই মহীয়ান- গরীয়ান ও সর্বশক্তিমান মহান আ...
যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশকের ফজিলত ও আমল
জিলহজ্জের প্রথম দশদিন ইবাদতের মহান মৌসুম। আল্লাহ তাআলা বছরের অন্যসব দিনের উপর এ দিনগুলোকে মর্যাদা দি...