প্রবন্ধ
ইসলামে শ্রমিকের অধিকার
ইসলাম একটি কালজয়ী অনবদ্য জীবন বিধান। বিশ্বসৃষ্টির শুরু থেকেই মহীয়ান- গরীয়ান ও সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহর নির্দেশিত পথের নাম ইসলাম। আদি পিতা হযরত আদম আ. থেকে এর যাত্রা শুরু এবং সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে সাধিত হয় এর পূর্ণতা। ইসলামই একমাত্র ধর্ম, যা মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সুষ্ঠু, যথার্থ ও অত্যন্ত যৌক্তিক সমাধান দিয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে, ان الدين عند الله الإسلام 'নিঃসন্দেহে ইসলামই মহান আল্লাহর একমাত্র মনোনীত দীন বা ধর্ম।' (সূরা আলে ইমরান- ১৯)
তাই আমরা দেখতে পাই মানুষের ব্যক্তিকেন্দ্রিক, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কিংবা সাংস্কৃতিক সমস্যাবলীসহ এমন কোন সমস্যা নেই যার সুষ্ঠু সমাধান ইসলাম দেয়নি।
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধভাবে মানুষের বসবাস। মানুষে মানুষে কোন শ্রেণী-বিভাগ নেই। সবাই একই উপকরণে একই স্রষ্টার সৃষ্টি। একই পৃথিবীর বাসিন্দা। একই সূর্য আর একই চাঁদের আলো গ্রহণকারী। কিন্তু দুঃখজনক হলেও বাস্তব সত্য যে, মানব-সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় যুগে যুগে মানুষে মানুষে তৈরি হয়েছে বৈষম্যের দুর্লঙ্ঘ প্রাচীর। কালে কালে মানুষের হাতেই মানুষ লাঞ্ছিত ও নিপীড়িত হয়েছে। এমনই একটি শোষিত ও অধিকার বঞ্চিত জনগোষ্ঠী হলো, 'শ্রমিক সম্প্রদায়'।
নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করলে আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে পারি, ইসলামের বিপরীতে কোন তন্ত্র-মন্ত্রই শ্রমিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করেনি। উপরন্তু তার উপর চালিয়েছে নির্যাতনের স্টিমরোলার।
বর্তমান বিশ্বে ইসলামের বিপরীতে দু'টি মতবাদ বহুল প্রচলিত। ক্যাপিটালিজম (Capitalism) বা পুঁজিবাদ আর সোশ্যালিজম (Socialism) বা সমাজবাদ।
ক্যাপিটালিজম বা পুঁজিবাদের মূলমন্ত্রই হলো শ্রমিকশোষণ। শ্রমিক তিলে তিলে গায়ের রক্ত পানি করে, সীমাহীন খাটুনির বিনিময়ে পণ্য উৎপাদন করে দেয়; তার বিনিময়ে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তাকে দেয় সীমাহীন দারিদ্র্য ও অভাব, অমানুষিক লাঞ্ছনা ও গঞ্জনার অবর্ণনীয় মনস্তাপ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাগাতার পরিশ্রমের পরও দু'বেলা আহারের অন্ন শ্রমিকে জোটে না। অথচ এ পুঁজিপতিরাই আরাম-প্রাসাদে বসে ভোগ করে শ্রমিকের শোণিত মিশ্রিত শ্রমের ফসল। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অন্ধভক্ত ও অকুণ্ঠ সমর্থক ইরিসিল লিখেছেন, 'কারখানায় আমাদের মানুষের আর প্রয়োজন নেই। কেননা যন্ত্রগুলো মানুষ থেকে ভালো কাজ দেয়। যন্ত্র আবিষ্কারের ফলে মানবশ্রমের অনেকটা উদ্বৃত্ত থেকে যায়, তার ব্যবহার হয় কম। তাই আমাদেরকে যন্ত্র নয় বরং মানুষ খতম করে দিতে হবে। আমরা ঐ সমস্ত লোকদের খতম করে দিতে চাই যারা কারখানায় কাজ করে অর্থাৎ শ্রমিক। (Money and morals)
বাস্তবিকপক্ষে পুঁজিবাদ মানুষকে এতটাই নিষ্ঠুর করে তোলে যে, হাজারো পণ্যসামগ্রী সে ধ্বংস করে দিলেও লাখো বুভুক্ষু মানুষের হাহাকার তাদের মনে সামান্যতম প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয় না। এদের একমাত্র শঙ্কা হলো, চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি হলে মুনাফার হার কমে যাবে। অধিক মুনাফাখোরীর নেশায় তারা লাখো বনী আদমকে ভুখা-নাঙ্গা রেখে উৎপাদিত পণ্য-সামগ্রী জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিতেও দ্বিধা করে না।
খোদ পুঁজিবাদেরই একজন অন্ধভক্ত স্যার টাউনসেন্ড নির্বিদ্ধ কণ্ঠে বলেছেন, 'ক্ষুধার কষাঘাত এমনই এক মারাত্মক অস্ত্র, যা অবাধ্য, জংলী পশুগুলোকেও শান্ত-সুবোধ বানিয়ে ফেলে। এরই সাহায্যে অবাধ্য হতে অবাধ্যতর মানুষও বাধ্য হয়ে যায়।
তাই তোমরা গরীব শ্রমিকদের থেকে যদি কাজ নিতে চাও তবে এর একমাত্র পন্থা হচ্ছে এদেরকে ভুখা রাখা। ক্ষুধাই এমন এক আশ্চর্য বস্তু, যা গরীব ও সর্বহারাদেরকে যে কোন পরিশ্রমের কাজে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।' (Dissertation on the poor laws)
এ নির্মম পুঁজিবাদী বক্তব্য থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, তাদের কাছে শ্রমিক মজদুরদের কোন সুনির্ধারিত ও সুনিশ্চিত অধিকার নেই। বরং এই বুর্জোয়াবাদ শ্রমিক শোষণবাদের জন্মই হয়েছে পুঁজিপতিদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য। ফলে পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে শ্রমিকদের মনে করা হয় একটি উৎপাদন-যন্ত্র। এখানে শ্রমিকরা নিজেদের প্রাণ ও অন্নের তাগিদে এক চিরন্তন দরকষাকষিতে লিপ্ত হয়। সংগ্রাম ও বিক্ষোভই হয় আদায়ের প্রধান পন্থা।
তাদের অধিকার আধুনিক সভ্যতার দাবিদার ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোতে বিশেষত আমেরিকা-ব্রিটেন, ফ্রান্স প্রভৃতি ধনতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী দেশগুলোতে শ্রমিকদের যে কিছুটা সুযোগ- সুবিধা ভোগ করতে দেখা যায়, তা মূলত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কোন কারামতি বা অন্তর্নিহিত গুণের কারণে নয়; বরং এটা তদীয় অঞ্চলের শ্রমিকগোষ্ঠীর বহুযুগ ও বহুকালের সংগ্রাম ও বিক্ষোভেরই ফসল। নিজেদের সুদ আদায় করতে গিয়ে গরীবের রক্ত পানকারী, শ্রমিকদের শরীরের গোশত ভক্ষণের জঘন্য মনোবৃত্তি লালনকারী পুঁজিবাদের ধ্বজাধারীরা কখনো অন্যের প্রতি দয়ালু ও সহানুভূতিপ্রবণ হতে পারে না। তাদের থেকে এ আশা করা দুরাশা বৈ কিছুই নয়; বরং তাদের কাছ থেকে সহানুভূতির প্রত্যাশা মায়াবী মরীচিকা- ভ্রমের নামান্তর।
এদিকে স্যোশালিজম বা সমাজবাদ শ্রমিকদের অধিকার হরণে পুঁজিবাদের চেয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে। সমাজতন্ত্রী লাল-সাম্রাজ্যবাদীরা অসহায় শ্রমিক শ্রেণীকে বৈষম্যহীন সমাজ কায়েমের রঙিন খোয়াব দেখিয়ে এবং নির্মল স্বাচ্ছন্দ্যময় শ্রমিকরাজ্য প্রতিষ্ঠার গালভরা বুলি আওড়িয়ে শ্রমিক সম্প্রদায়কে ভীষণভাবে প্রতারিত ও প্রবঞ্চিত করেছে। পুঁজিবাদে শ্রমিক সম্প্রদায়ের যৎসামান্য যে অধিকার ও স্বাধীনতা ছিল সমাজবাদ সেটাকেও নির্মমভাবে দলে-পিষে, দুমড়ে-মুচড়ে থেঁতলে দিয়েছে। ধীরে ধীরে শ্রমিক সম্প্রদায়ের মধ্যে জেগে উঠেছে ধূমায়িত অসন্তোষ। সে অসন্তোষের পুঞ্জীভূত বিস্ফোরণে ভেঙ্গে-চূরে খানখান হয়ে গেছে এককালীন সুপার পাওয়ার সোভিয়েত ইউনিয়ন। যার জ্বলন্ত প্রমাণ আজকের সমাজতন্ত্রিক পোল্যান্ড, হাঙ্গেরী, রুমানিয়া, ভিয়েতনাম, উত্তর কোরিয়া প্রভৃতি দেশ। ইতালি ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়া সফর করে মন্তব্য করেছিল, ‘আমরা রাশিয়ার কনকনে শীতের মধ্যে নারী শ্রমিকদেরকে ইটের বোঝা বহন করে ষষ্ঠ তলায়ও পৌঁছতে দেখেছি। এসব কাজের জন্য অন্যান্য দেশে যে সুরক্ষা ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয় তাদের জন্য সেসব কিছুই ছিল না।
(সোভিয়েত ওয়ার্ল্ড)
এভাবে সমাজতন্ত্রের রাক্ষুসে স্টিমরোলারে চাপা পড়ে কত শ্রমিক ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর হিমশীতল কোলে ঢলে পড়ে তাদের যৎসামান্য সংবাদই প্রচারের আলোয় বেরিয়ে আসে।
দেখুন! প্রাপ্য মজুরী চাইতে গিয়েও একজন শ্রমিককে কিভাবে সমাজতন্ত্রীদের হাতে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। এক শ্রমিকের ভাষায়, 'আমাকে ধরে আনা হয় এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা তীব্র ভোল্টেজের বাল্বের দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য করা হয়। আলোর তীব্রতায় আমার চোখ দু'টো যেন গলে যাচ্ছিল। কিন্তু চোখের পানি ফেললে লাথি-ঘুষি বর্ষণ করে আমাকে তার প্রতিদান দেয়া হতো। আর এভাবে টানা ৭২টি ঘণ্টা আমার উপর দিয়ে কেটে যায়!!' তিনি আরো বলেন, 'অনেক সময় আমাকে লবণাক্ত খাদ্য পরিবেশন করা হতো এবং লাগাতার কয়েকদিন পর্যন্ত তৃষ্ণার্ত রাখা হতো। তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাওয়ার উপক্রম হলেও একফোঁটা পানি দেয়া হতো না। শুধু তাই নয়, এরপর হাত পা বেঁধে উল্টো করে ৪০ ঘণ্টা লটকে রাখা হয়। শরীরের পশমগুলো একটা একটা করে এমন নিষ্ঠুরভাবে টেনে উঠানো হতো, যাতে চামড়া পর্যন্ত উঠে যেতো। (ইশতিরাকিয়াত রুশ কী তাজারিবাগাহ মে) মোটকথা, পুঁজিবাদ ও সমাজবাদ হাজারো রঙিন স্বপ্ন দেখিয়ে এবং শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার বাণী শুনিয়েও বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। বস্তুবাদের আবহমানকালের ধারা এটাই। বস্তুতান্ত্রিক কোন ব্যবস্থাই মানবজাতিকে স্বাচ্ছন্দ্যের পথ দেখিয়ে দিতে পারেনি এবং পারবেও না। পক্ষান্তরে ইসলামই একমাত্র ও অদ্বিতীয় এক জীবন বিধান, যেখানে রাজা-প্রজার কোন ব্যবধান নেই, আমীর-গরীবের কোন পার্থক্য নেই, মালিক-শ্রমিক ভেদাভেদ নেই। ইসলামই সেই অতুলনীয় এবং অনবদ্য ধর্ম, যেখানে নেই শ্রেণী-সংগ্রামের রক্তের দাগ কিংবা মানবতার টুটি চেপে ধরা পাশবিকতা।
ইসলামের দৃষ্টিতে শ্রম
ইসলামে শ্রমের মর্যাদা অত্যন্ত উঁচুতে। শ্রমকে ইসলাম ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে না; বরং অত্যন্ত সম্মানের দৃষ্টিতেই দেখে থাকে। আল-কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে, فإذا قضيت الصلاة فانتشروا في الأرض وابتغوا من فضل الله অর্থ : যখন তোমাদের সালাত আদায় হয়ে যায় তখন তোমরা যমীনে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশে ব্যাপৃত হয়ে যাও। (সূরা জুমু'আ- ১০)
হাদীসে পাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,خيرالكسب كسب يد العامل إذا نصح অর্থ : শ্রমজীবির উপার্জনই উৎকৃষ্টতর,যদি সে সৎ উপার্জনশীল হয়। (মুসনাদে আহমাদ; হা. নং ৮৩৯৩)
অপর এক হাদীসে ইরশাদ হচ্ছে, ما أكل أحد طعاما قط خيرا من أن يأكل من عمل يده وإن نبي الله داود عليه السلام كان يأكل من عمل يده অর্থ : যে ব্যক্তি আপন শ্রমের উপর জীবিকা নির্বাহ করে তার চেয়ে উত্তম আহার আর কেউ করে না। জেনে রাখো, আল্লাহর নবী দাউদ আলাইহিস সালাম আপন শ্রমলব্ধ উপার্জন দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতেন। (সহীহ বুখারী হা. নং.২০৭২)
অবশ্য ইসলাম যেমনিভাবে শ্রম ও হালাল উপার্জনের জন্য মানুষকে উৎসাহিত করেছে, ঠিক এর বিপরীতে কোন পরিশ্রম না করে সমাজের গলগ্রহ হয়ে থাকারও কঠোর নিন্দা করেছে। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, যে ব্যক্তি আমার সঙ্গে ওয়াদাবদ্ধ হবে যে, সে কোনদিন ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করবে না তার জান্নাত লাভের দায়িত্ব আমি গ্রহণ করলাম। (সুনানে আবূ দাউদ),
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন, যে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করবে সে মহান আল্লাহর কাছে এমন অবস্থায় হাযির হবে যে তার চেহারায় এক টুকরো গোশতও থাকবে না। (সহীহ বুখারী)
পবিত্র কুরআনের একাধিক আয়াত এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অসংখ্য হাদীসে শ্রমিক অধিকারের বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। আমরা এখানে ইসলাম প্রদত্ত শ্রমিক অধিকারের মৌলিক দিকগুলো তুলে ধরতে চেষ্টা করব।
ক. সামাজিক মর্যাদা
ইসলামই একমাত্র ধর্ম, যা শ্রমিক সম্প্রদায়কে মানবিক ও সামাজিক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্ম কিংবা মতবাদে শ্রমিকদেরকে সামাজিক মর্যাদা দেয়া হয়নি। আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছে إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ. অর্থ : তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে তারাই বেশি মর্যাদাসম্পন্ন যারা বেশি আল্লাহভীরু। (সূরা হুজুরাত- ১৩)
অর্থাৎ আল্লাহর নিকট ধনী-গরীবে কোন বৈষম্য নেই। মালিক-শ্রমিকের ব্যবধান নেই। বরং সে-ই আল্লাহর কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ, যে তাকওয়া অবলম্বন করে। উল্লিখিত আয়াতের বাস্তব নমুনা আমরা দেখতে পাই অগণিত নবী রাসুলের পবিত্র যিন্দেগীতে, খোদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মোবারক জীবনীতে এবং তাঁর প্রাণপ্রিয় সাহাবীদের আদর্শ জীবনে। একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন, দুনিয়াতে আল্লাহ এমন কোন নবী পাঠাননি যিনি বকরী চরাননি। তখন সাহাবীগণ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনিও কি বকরী চরিয়েছেন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন, হ্যাঁ, আমি এক কিরাত, দু'কিরাত পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মক্কাবাসীর বকরী চরিয়েছি। (সহীহ বুখারী)
অপর এক হাদীসে এসেছে, হযরত দাউদ আ. কর্মকার ছিলেন, হযরত আদম আ. কৃষক ছিলেন, হযরত নূহ আ. ছিলেন ছুতার, হযরত ইদরীস আ. ছিলেন দর্জি আর মুসা আ. বকরী চরিয়ে জীবনযাপন করতেন। (মুসনাদে আহমাদ, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া)
এমনিভাবে সাহাবায়ে কেরাম রাযি.-এর মধ্যে হযরত আবু বকর, উমর, উসমান, আলী রাযি. সকলেই আপন শ্রমলব্ধ উপার্জনের ভিত্তিতে জীবিকা নির্বাহ করতেন। শ্রমিকের ভূমিকায় কাজ করতে ইসলামী সমাজে লজ্জার কিছুই ছিলো না। অতএব একথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, ইসলামে শ্রমিকের সামাজিক মর্যাদা অনেক বেশি।
খ. শ্রমিকের পারিশ্রমিক নির্ধারণ
একথা অনস্বীকার্য যে, মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে কাজ করে। তেমনিভাবে শ্রমিকেরা অন্নকষ্ট লাঘবের জন্যই প্রধানত কাজ করে থাকে। তাদের রক্ত পানি করা শ্রমের ফসল ভোগ করে মালিকরা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করে। তাই শ্রমিকদের জীবনধারণের জন্য মজুরী বা পারিশ্রমিক দিতে হয়। এই মজুরী নিয়েই যতসব সংঘাত ও বিবাদের সৃষ্টি। পীড়াদায়ক হলেও অনিবার্য বাস্তবতা এই যে, ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন মতবাদই শ্রমিকের মজুরী সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান দিতে পারেনি- না পুঁজিবাদ, না সমাজবাদ। পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থায় পারিশ্রমিক নির্ধারণের মূল সূত্র হলো, দ্রব্যমূল্য যেমনিভাবে চাহিদা ও যোগানের অনুপাতে নির্ধারিত হয়, শ্রমের মূল্যও তেমনি চাহিদা ও যোগানের অনুপাতে নির্ধারিত হবে। এটা স্পষ্ট যে, এ ব্যবস্থায় শ্রমিকরা দ্রব্যবস্তুর মত প্রাণহীন, নির্জীব এবং অসহায়। আর পারিশ্রমিক নির্ধারণ প্রশ্নে সমাজতন্ত্রের মূল বক্তব্যই হচ্ছে, দক্ষতা ও যোগ্যতানুযায়ী কাজ এবং প্রয়োজন অনুযায়ী পারিশ্রমিক। এ ব্যবস্থায় শ্রমিকরা স্রেফ একটি অনুভূতিহীন রোবট বা যন্ত্রে পরিণত হয়। এখানে তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা- অনিচ্ছার কোন মূল্যই থাকে না।
অথচ একমাত্র ইসলামই দিয়েছে শ্রমিকের পারিশ্রমিক সমস্যার যথার্থ সমাধান। কেননা ইসলামী অর্থনীতিতে ন্যূনতম পারিশ্রমিক প্রত্যেক শ্রমিকের প্রয়োজন অনুসারে নির্ধারিত হয়। অর্থাৎ প্রত্যেক শ্রমিককে কমপক্ষে এমন মজুরী ও পারিশ্রমিক দিতে হয় যাতে সে তার জীবনধারণের স্বাভাবিক চাহিদা পূরণ করতে পারে।
হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, হযরত আবূ সাঈদ খুদরী রাযি, বর্ণনা করেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পারিশ্রমিক নির্ধারণ ব্যতিরেকে শ্রমিক থেকে শ্রম গ্রহণ করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। (মুসনাদে আহমাদ)
অপর এক হাদীসে যথাসময়ে শ্রমিকের পারিশ্রমিক প্রদানে গুরুত্বরোপ করে ইরশাদ হয়েছে,أعطوا الأجير أجره قبل أن يجف عرقه অর্থ : তোমরা শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকানোর পূর্বেই তার পারিশ্রমিক দিয়ে দাও। (সুনানে বাইহাকী)
গ. শ্রমিকের সুস্থতা
ইসলাম কখনো কারো উপর এমন নির্দেশ চাপিয়ে দেয় না যা পালন করা তার জন্য দুঃসাধ্য বা অসম্ভব। বিশ্ববিখ্যাত মুসলিম অর্থনীতিবিদ আল্লামা ইবনে হাযম রহ. বলেছেন, শ্রমিকের কাছ থেকে (মালিকের জন্য) অতটুকুই কাজ নেয়া উচিত যতটুকু সে সহজভাবে, সুষ্ঠুপন্থায় আঞ্জাম দিতে পারে। (আল-মুহাল্লা লি-ইবনিল হাযম) এমনিভাবে ইসলাম শিক্ষা-দীক্ষা ও বাসস্থানের ক্ষেত্রেও শ্রমিকের অধিকার সুনিশ্চিত করেছে।
ঘ. শ্রমের পরিমাণ নির্ধারণ
১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের মে মাস। হঠাৎ করেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে আমেরিকার শিকাগো সিটির রাজপথ। পিচঢালা সড়কে লুটিয়ে পড়ে বেশ কিছু শ্রমিকের লাশ। এখানে শ্রমিকরা প্রতিদিন ১৬ ঘণ্টার পরিবর্তে ৮ ঘণ্টা শ্রমের সময়সীমা নির্ধারণের দাবিতে বিক্ষোভ করছিল। অবশেষে শ্রমিকের রক্তচোষা পুঁজিপতিরা 'আট ঘণ্টা'র দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়। এই সেই ঐতিহাসিক আন্দোলন, যে আন্দোলনের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন ও একাত্মতা ঘোষণার লক্ষ্যে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় আমাদের দেশেও 'মে দিবস' পালন করা হয়। অথচ ইসলাম সুদীর্ঘ চৌদ্দশ বছর পূর্বেই ঘোষণা করেছে,لا يكلف الله نفسا إلا وسعها অর্থ : আল্লাহ কাউকে এমন কোন কাজের দায়িত্ব দেন না যা তার সাধ্যাতীত। (সূরা বাকারা- ২৮৬)
এ মূলনীতির আলোকে ইসলাম কাজের ক্ষমতা, প্রকৃতি ও পরিবেশ অনুযায়ী শ্রমের পরিমাণ ও সময় নির্ধারণের নির্দেশ প্রদান করে।
ঙ. স্থান পরিবর্তনের অধিকার
মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা আছে। এই ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা মানেই যুলুম ও অবিচার। অথচ পুঁজিবাদ ও সমাজবাদ উভয় ব্যবস্থাতেই শ্রমিকের স্থানান্তর গমনের অধিকারকে বাতিল করে তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। (পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় স্থানান্তর গমনের অধিকার পুরোপুরি রহিত করা না হলেও এ ব্যাপারে এমন জটিলতা সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে যে, শ্রমিকগণ এ থেকে সুফল ভোগ করতে পারে না। )
সমাজতন্ত্রের অন্যতম অন্ধভক্ত স্ট্যালিনের আমলে এক সরকারী নির্দেশনামায় বলা হয়েছিল, 'মাসিক অথবা রোজভিত্তিক যে কোন মজুরই হোক না কেন তাকে স্বাধীনভাবে শ্রমের ক্ষেত্র স্থান পরিবর্তনের প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হল। এ নির্দেশ অমান্য করলে ২ থেকে ৪ মাসের কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।
কত অমানুষিক ও বর্বরোচিত কালাকানু! অথচ শান্তির ধর্ম, চিরকল্যাণের ধর্ম ইসলাম শ্রমিকের এই স্বাভাবিক স্বাধীনতা ও অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করে ঘোষণা দিয়েছে, সমস্ত দেশ ও যমীন আল্লাহর, আর সমস্ত মানুষ আল্লাহর বান্দা। তাই যেখানেই তুমি মঙ্গলজনক মনে কর সেখানেই বাস করো।
(মাজমাউয যাওয়াইদ)
চ. লাভের অংশীদারিত্ব
ইসলামই একমাত্র মতবাদ যেখানে শ্রমিকের লভ্যাংশে শরীক হওয়ার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। এক হাদীসে ইরশাদ হয়েছে, শ্রমিকদেরকে তাদের শ্রমার্জিত সম্পদ (লাভ) হতেও অংশ দিও। কারণ আল্লাহর মজুরকে বঞ্চিত করা যায় না। (মুসনাদে আহমাদ)
ছ. দাবি পেশ করার সুযোগ
ইসলাম মানবজীবনের প্রতিটি দিকের এমনকি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়াবলীরও বিস্ময়কর সমাধান দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ইসলামে শ্রমিকের অন্যান্য অধিকারের ন্যায় দাবি-দাওয়া পেশ করারও পূর্ণ স্বাধীনতা ও অধিকার রয়েছে। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সুওয়াল করা বা অন্যের কাছে কিছু প্রার্থনা করা একটি পেষণযন্ত্র; যার দ্বারা মানুষ তার নিজের চেহারাই পিষে ফেলে। কিন্তু কোন মানুষ যদি কর্তৃপক্ষের কাছে দাবী করে বা যা ব্যতীত সে বাঁচতে পারে না এমন জিনিসের দাবী নিয়ে আসে তবে সেটা সুওয়াল ও প্রার্থনা হবে না। (আল- মাসুত)
উল্লিখিত মৌলিক অধিকার ছাড়াও ইসলাম শ্রমিকের চাকুরির নিরাপত্তা, কাজের প্রকৃতি, বাসস্থান, অসুস্থকালীন পেনশন এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে।
উপসংহার
সার্বিক জীবনে ইসলাম যে অনুপম সমাজ ব্যবস্থার পথ বাতলে দেয় এর প্রত্যেকটি যদি স্ব-স্ব স্থানে, পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রতিষ্ঠা করা যায় তবে এমন এক বৈষম্যহীন সামাজিক- রীতির উদ্ভব হবে যাতে রানা প্লাজার 'রানা'র মতো সৃষ্টি হবে না অসংখ্য টাকার কুমির। শত শত শ্রমিক খুন করেও সম্পূর্ণ টাকার জোরে সে জামাই আদরে আছে। গত পাঁচ বছরেও তার কোন শাস্তি হয়নি। হয়তো একসময় বেকসুর খালাসও পেয়ে যেতে পারে!! ইসলামী হুকুমত না থাকার এই হলো আযাব।
অন্যদিকে গজিয়ে উঠবে না লাঞ্ছিত, অধিকার বঞ্চিত ভূখা-নাঙ্গা শ্রেণী। বরং তখন এমন একটি অকল্পনীয় অথচ বৈষম্যহীন অর্থনৈতিক জোয়ার সৃষ্টি হবে যার প্রাচর্য অধিকাংশ মানুষই আস্বাদন করবে।
অতএব আসুন! আজকের এ অশান্ত পৃথিবীতে পুঁজিবাদ ও সমাজবাদের তথা শ্রমিক শোষণবাদের অভিশপ্ত শৃঙ্খল ভেঙে শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার, সাম্য ও মুক্তির একমাত্র মতবাদ ইসলামের সোনালী আইন প্রতিষ্ঠা করি। এতেই প্রতিষ্ঠা হবে শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার। এতেই আসবে বিশ্ব মযলুমানের মুক্তি। সকলেই খুঁজে পাবে শান্তিময় জীবনের সন্ধান।
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
দাওয়াত, হাদিয়া ও উপঢৌকন
হাদিয়া, উপঢৌকন ও দাওয়াত আদান- প্রদান ইসলামী শরীয়তের গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল ও প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু...
দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির ১০ আমল
দুশ্চিন্তা, মানসিক অস্থিরতা আমাদের জীবনের এক অনাকাঙ্ক্ষিত অংশ। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে আযাব হতে পারে ...
সুন্নাতে খাতনা : করণীয়-বর্জনীয়
একটি হাদীসে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, পাঁচটি বিষয় ইসলামের স্বভাবজাত বৈ...
নবীজীর ভালোবাসা ও সুন্নাতী যিন্দেগী
হযরত সালমান মনসুরপুরী রহ. বলেন, নবীজীর মুহাব্বত হৃদয়ের শক্তি, রূহের খোরাক, চোখের শীতলতা, দেহের সজীবত...