প্রবন্ধ

গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার ১০ আমল ও কৌশল

লেখক:মাওলানা উমায়ের কোব্বাদী
৩০ মে, ২০২৪
২৮৮৩৭ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

গোনাহের সবচেয়ে বড় এবং ভয়াবহ ক্ষতি হলো, মানুষ আল্লাহর ইবাদত থেকে মাহরুম হয়ে যায়। আল্লাহর ইবাদত করতে মন চায় না। নেক কাজের প্রতি কোনো আকর্ষণ থাকে না। যদিও হাতে অনেক সময় থাকে, কিন্তু আল্লাহর হুকুম মানার মতো তাওফিক হয় না।
যেমন আজানের শব্দ কানে আসে কিন্তু মসজিদে যেয়ে নামাজ আদায় করার মতো তাওফিক হয় না। দোকানে বসে আড্ডা দিবে, অযথা সময় নষ্ট করবে, অথচ মসজিদ একদম নিকটে তারপরেও মসজিদে যাবে না। হেলাফেলায় সময় নষ্ট করবে। আল্লাহর হুকুম পালন করার মতো সময় হবে না। পারিবারিক সমস্যার কারণে অথবা অসুস্থতার কারণে দিনের পর দিন দোকান বন্ধ রাখতে পারে, অথচ নামাজের জন্য দশ মিনিট দোকানটা বন্ধ রাখতে পারবে না। মোবাইলে সময় দেওয়ার টাইম আছে। ফেসবুক, ইউটিউব দেখার সময় হয় কিন্তু নামাজের সময় হয় না। এগুলো হয় গোনাহের কারণে।



اَلْحَمْدُ لِلّهِ وَكَفَى وَسَلَامٌ عَلَى عِبَادِهِ الَّذِيْن َاصْطَفَى اَمَّا بَعْدُ! فَاَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ. بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ. وَذَرُواْ ظَاهِرَ الإِثْمِ وَبَاطِنَهُ إِنَّ الَّذِينَ يَكْسِبُونَ الإِثْمَ سَيُجْزَوْنَ بِمَا كَانُواْ يَقْتَرِفُونَ
بَارَكَ اللهُ لِيْ وَلَكُمْ فِي الْقُرْآنِ الْعَظِيْمِ، وَنَفَعَنِيْ وَإِيَّاكُمْ بِمَا فِيْهِ مِنَ اْلآيَاتِ وَالذِّكْرِ الْحَكِيْمِ. وجعلني وإياكم مِنَ الصَّالِحِينَ. أَقُوْلُ قَوْلِيْ هَذَا أَسْتَغْفِرُ اللهَ لِيْ وَلَكُمْ وَلِسَائِرِ الْمُسْلِمِيْنَ. فَاسْتَغْفِرُوْهُ، إِنَّهُ هُوَ الْغَفُوْرُ الرَّحِيْمُ .اَللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّعَلَى آلِ سَيِّدِنَا مُحَمَّدٍ وَّبَارِكْ وَسَلِّمْ

হামদ ও সালাতের পর!
গোনাহ ছেড়ে দাও
মুহতারাম হাজিরীন! বাস্তবতা হল এই যে, আমরা সকলেই রোগী। আমি দেহের রোগের কথা বলছি না; বরং সবচেয়ে বড় রোগ গোনাহের কথা বলছি। অথচ তেলাওয়াতকৃত আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন

وَذَرُواْ ظَاهِرَ الإِثْمِ وَبَاطِنَهُ إِنَّ الَّذِينَ يَكْسِبُونَ الإِثْمَ سَيُجْزَوْنَ بِمَا كَانُواْ يَقْتَرِفُونَ

তোমরা প্রকাশ্য ও গোপন সকল গোনাহ ছেড়ে দাও। যারা গোনাহ করে, শীঘ্রই তাদেরকে তাদের কৃত গোনাহের কারণে শাস্তি দেওয়া হবে।  (সূরা আনআম : ১২০)
নবীজী ﷺ বলেন

اتَّقِ المَحَارِمَ تَكُنْ أَعْبَدَ النَّاسِ

গোনাহ থেকে বেঁচে থাকো, সবচেয়ে বড় আল্লাহর অলি হতে পারবে। (তিরমিযী ২৩০৫)

গোনাহ থেকে বেঁচে থাকা জরুরি কেন?
মুহতারাম হাজিরীন! প্রতিটি কাজের দুটি দিক থাকে বিধানগত দিক এবং প্রভাবগত দিক। গোনাহের বিধানগত দিক হল, তাওবা—ইস্তিগফারের মাধ্যমে গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। কিন্তু তাওবা-ইস্তিগফারের মাধ্যমে গোনাহের প্রভাবগত বিষয়টি দূর করে দেওয়ার ওয়াদা নেই। আল্লাহ তাআলা তাঁর একান্ত দয়া ও মেহেরবানীতে তার প্রভাবও দূর করে দিতে পারেন। তবে সে বিষয়ে তিনি কোনো ঘোষণা বা ওয়াদা দেননি।
সুতরাং কোনো ব্যক্তি যদি কোনো গোনাহ করে, এরপর তাওবা করে, তখন সেই তাওবা কবুল হলে গোনাহটি থেকে সে ক্ষমা পেয়ে যাবে। তবে গোনাহের প্রভাব ও ক্ষতিকর বিষয় থেকে মুক্তি পাবে কি না; বলা যায় না। সেজন্য আমাদের উচিত, সাধ্যের সবটুকু শক্তি ব্যয় করে গোনাহ থেকে বেঁচে থাকা। এরপরও কোনো গোনাহ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তাওবা করা এবং ভবিষ্যতে গোনাহ করার মানসিকতা পরিত্যাগ করা।

গোনাহ ক্যান্সারের মত
কে এটা বলতে পারবে যে, গোনাহ ত্যাগ করা ছাড়া কিংবা মাফ করিয়ে নেওয়া ছাড়া জাহান্নাম থেকে বাঁচতে পারবে এবং জান্নাতে যেতে পারবে! কেউই বলতে পারবে না। সুতরাং আমাদের করণীয় কী? একটাই করণীয় গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা এবং এরপরেও গোনাহ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তাওবা করে নেওয়া।
গোনাহ তো ক্যান্সারের মত। ক্যান্সার থেকে সতর্ক থাকা যেমন জরুরি, গোনাহ থেকেও সতর্ক থাকা জরুরি। ক্যান্সার হলে যেমন কেটে ফেলতে হয় গোনাহ হয়ে গেলেও তাওবা করে নিতে হয়।

গোনাহ গোনাহকে টানে
হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী রহ. বলতেন, গোনাহের একটা তাসির বা প্রভাব আছে। আর তাহল, গোনাহ গোনাহকে টানে। এক গোনাহ আরেক গোনাহকে জন্ম দেয়। তাওবা করলে গোনাহ মাফ হয়ে গেলেও এর তাসির থেকে যায়।

গোনাহের সবচেয়ে বড় ক্ষতি
গোনাহের সবচেয়ে বড় এবং ভয়াবহ ক্ষতি হলো, মানুষ আল্লাহর ইবাদত থেকে মাহরুম হয়ে যায়। আল্লাহর ইবাদত করতে মন চায় না। নেক কাজের প্রতি কোনো আকর্ষণ থাকে না। যদিও হাতে অনেক সময় থাকে, কিন্তু আল্লাহর হুকুম মানার মতো তাওফিক হয় না।
যেমন আজানের শব্দ কানে আসে কিন্তু মসজিদে যেয়ে নামাজ আদায় করার মতো তাওফিক হয় না। দোকানে বসে আড্ডা দিবে, অযথা সময় নষ্ট করবে, অথচ মসজিদ একদম নিকটে তারপরেও মসজিদে যাবে না। হেলাফেলায় সময় নষ্ট করবে। আল্লাহর হুকুম পালন করার মতো সময় হবে না। পারিবারিক সমস্যার কারণে অথবা অসুস্থতার কারণে দিনের পর দিন দোকান বন্ধ রাখতে পারে, অথচ নামাজের জন্য দশ মিনিট দোকানটা বন্ধ রাখতে পারবে না। মোবাইলে সময় দেওয়ার টাইম আছে। ফেসবুক, ইউটিউব দেখার সময় হয় কিন্তু নামাজের সময় হয় না। এগুলো হয় গোনাহের কারণে।

দীনের পথে পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ
ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন

أجمع العارفون بالله ان ذنوب الخلوات هي أصل الانتكاسات

সকল আওলিয়ায়ে কেরাম একমত যে, বান্দার গোপন গোনাহ দীনের পথে তার পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ। (মাউকিউ দুরারিস সুন্নিয়্যা : ১/২৪৩)

সেফ জোনে (Safe Zone) থাকুন
সুতরাং সতর্কতা হল, সেফ জোনে (Safe Zone) ) থাকা। আর এটাই হল মূল। কেননা, রোগের চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ করা ভালো।
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযি. বলতেন

لَا أَعْدِلُ بِالسَّلَامَةِ شَيْئًا

গোনাহ থেকে নিরাপদ থাকার মত সমকক্ষ আমল আমি কোনোটিকে মনে করি না। (আদাবুদদুনয়া ওয়াদদীন : ১/৯৮)

সুতরাং সবার উচিত গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার পথ-পন্থা অবলম্বন করা। আজকের মজলিসে এমন ১০টি কৌশল পেশ করা হচ্ছে, যেগুলো মেনে চলতে পারলে যে-কোনো গোনাহ থেকে বেঁচে থাকা সহজ হয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ। দোয়া চাই, আল্লাহ তাআলা যেন আমাকেও আমল করার তাওফীক দান করেন আমীন।

গোনাহের ফাঁদ থেকে বেঁচে থাকার ১০ টি কার্যকরী পরামর্শ

১. নিয়ত করুন, গোনাহের সুযোগ পেলেও গোনাহ করবো না
মনে রাখতে হবে, গোনাহকালীন সময়ের আনন্দ ক্ষণস্থায়ী কিন্তু তার ক্ষতি ও করুণ পরিণতি দীর্ঘস্থায়ী। গোনাহের উন্মাদনা সাময়িক কিন্তু তার অনুতাপ হবে দীর্ঘ মেয়াদি। সুতরাং আজ থেকে নিয়ত করুন; গোনাহের চিন্তা আসলেও গোনাহ করবো না, গোনাহের সুযোগ পেলেও গোনাহ করবো না। বিষয়টি সম্পূর্ণ একটি মাইন্ড সেটআপ-এর বিষয়। এই মাইন্ড সেটআপ গোনাহ বর্জনের ক্ষেত্রে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারবে, ইনশাআল্লাহ। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন

ومَن هَمَّ بسَيِّئَةٍ فَلَمْ يَعْمَلْها، كَتَبَها اللَّهُ له عِنْدَهُ حَسَنَةً كامِلَةً

আর যে ব্যক্তি কোনো গোনাহ করার সংকল্প করে; কিন্তু তা কর্মে বাস্তবায়িত করে না তাহলে আল্লাহ তাআলা তাঁর কাছে একটি পূর্ণ নেকি লিপিবদ্ধ করে দেন। (মুসলিম : ১৩১)

সর্বোত্তম নিয়ত
আমাদের মাশায়েখ বলেন, নিয়ত তিন ধরণের হয়।
১. নেক আমল করার নিয়ত। যেমন এই নিয়ত করা যে, প্রতি সোম বারে সুন্নাহ—রোজা রাখবো, প্রতি দিন ইশরাকের নামায আদায় করবো, তাবলীগের চিল্লায় যাবো, এত টাকা সাদকা করবো ইত্যাদি। যেহেতু এ ধরণের নিয়ত সকল মুমিন জীবনের কোনো না কোনো সময় সাধারণত করে থাকে, সুতরাং এটিকে আমরা বলতে পারি সাধারণ নিয়ত।
২. গোনাহ না করার নিয়ত। যেহেতু উত্তম আমল হল, গোনাহ ছেড়ে দেওয়া, সুতরাং এটিকে আমরা বলতে পারি উত্তম নিয়ত।
৩. গোনাহ করার সুযোগ পেলেও গোনাহ না করার নিয়ত। নি:সন্দেহে এটি সর্বোত্তম নিয়ত।

শক্তিশালী মুমিন
এজাতীয় নিয়ত যারা করে হাদীসের ভাষ্য মতে এরা শক্তিশালী মুমিন। এরা আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয়। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন

الْمُؤْمِنُ الْقَوِيُّ خَيْرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنَ الْمُؤْمِنِ الضَّعِيفِ

আল্লাহর কাছে শক্তিশালী মুমিন দুর্বল মুমিন থেকে অধিক উত্তম ও প্রিয়।

একজন কবি খুব চমৎকার বলেছেন

وہ مرد نہیں جو ڈر جائیں حالات کے خونی منظر سے
جس دور میں جینا مشکل ہو اس دور میں جینا لازم ہے

সে তো মর্দে মুমিন নয় যে, যামানার রক্তচক্ষু দেখে ঘাবড়ে যায়। মর্দে মুমিন তো সে—ই যে গোনাহের সামনে সীসাঢালা প্রাচীরের মত এই বলে দাঁড়িয়ে যায় যায়, গোনাহের চিন্তা ও পরিবেশের প্রতি যামানা আমাকে যতই আহ্বান করুক না কেন; আমি আমার মালিকের সন্তুষ্টি পাওয়ার জন্য গোনাহ করবোনা। গোনাহ করে আমি আমার মালিককে অসন্তুষ্ট করতে পারবো না।

নিয়ত-গুণে আমলের গুণ পাল্টে যায়
আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারক রহ. বলেন

رُبَّ عَمَلٍ صَغِيْرٍ تُكَثِّرُهُ النِّيَّةُ، وَرُبَّ عَمَلٍ كَثِيْرٍ تُصَغِّرُهُ النِّيَّةُ

নিয়ত-গুণে অনেক ছোট আমলও প্রচুর আমলে পরিণত হয়; আবার অনেক প্রচুর আমলও ছোট আমলে পরিণত হয়। (সিয়ার : ১১২)
মুবাহ কাজের মাধ্যমে গোনাহের কাজের নিয়ত করলে, সেই কাজ গোনাহে পরিণত হয়। ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ রহ. বলেন

المباحُ بالنيةِ الحسنةِ يكون خيرًا، وبالنيةِ السيئةِ يكون شرًّا

নেকীর নিয়ত করলে মুবাহ কাজ নেক আমলে পরিণত হয়, আর গোনাহের নিয়ত করলে  গোনাহে পরিণত হয়। (মাজমুউল ফাতাওয়া : ৭/৪৩)

২. সর্বদা অযু অবস্থায় থাকার চেষ্টা করুন
কেননা, সবসময় অযু অবস্থায় থাকলে মন পবিত্র থাকে এবং গেনাহের চিন্তা কম আসে। তাছাড়া অযু গোনাহ থেকে ক্ষমাপ্রাপ্তির শক্তিশালী মাধ্যম। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন

مَنْ تَوَضَّأَ فَأَحْسَنَ الْوُضُوءَ خَرَجَتْ خَطَايَاهُ مِنْ جَسَدِهِ حَتَّى تَخْرُجَ مِنْ تَحْتِ أَظْفَارِهِ

যে-ব্যক্তি অযু করে এবং তা উত্তমরূপে করে, তার দেহ থেকে সমস্ত গুনাহ ঝরে যায়, এমনকি তার নখের ভিতর থেকেও গুনাহ বের হয়ে যায়। (মুসলিম : ২৪৫)
আলোচ্য হাদীসে যে বলা হয়েছে, উত্তমরূপে অযু করলে নখের ভিতর থেকেও গুনাহ বের হয়ে যায়। বর্তমানে হাদীসের এই অংশ বোঝা আগের তুলনায় অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। কেননা, এই আঙ্গুলের আগা দিয়ে টাচ মোবাইল ও কম্পিউটারের কী-বোর্ডের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত আমরা কত গোনাহ করি! উত্তমরূপে অযু করলে আশা করা যায়, আল্লাহ তাআলা এই গোনাহগুলোও মাফ করে দিবেন।

অযু করে ঘুমানোর বিস্ময়কর ফজিলত
নামায কিংবা তেলাওয়াতের উদ্দেশ্যে অযুর ফজিলত আপনার শুনেছেন। আজ আরেকটি ফজিলতময় অযুর সন্ধান দিচ্ছি। তাহলো, ঘুমানোর পূর্বে অযু। অযু করে ঘুমানো মানে নিশ্চিত দোয়া কবুলের সময়ের মধ্য দিয়ে রাত যাপন করা। রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, কোনো মুসলিম যদি অযু অবস্থায় ঘুমায়, এরপর রাতে কোনো সময় হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে যায় এবং সে ওই অবস্থায় শুয়ে শুয়ে আল্লাহর কাছে তার জাগতিক বা পরলৌকিক কোনো কল্যাণ কামনা করে দোয়া করে إِلَّا آتَاهُ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ إِيَّاهُ তাহলে আল্লাহ তাকে তার প্রার্থিত বস্তু দিবেনই। (নাসায়ি, আস সুনানুল কুবরা : ৬/২০২)
দেখুন, রাতে ওঠে তাহাজ্জুদ আদায় করা তো دَأْبُ الصَّالِحينَ তথা আল্লাহর অলীদের আমল। অমারা ওই স্তরের নই। কিন্তু রাতের বেলা আচমকা ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া কার না হয়। ঘরে ইঁদুর-বিড়ালের দৌড়াদৌড়ির কারণে, ইস্তেঞ্জা ইত্যাদির প্রয়োজনে আচমকা ঘুম ভেঙ্গে গেলে তখন যে কোনো দোয়া করে নিন। আল্লাহ তাআলা অবশ্যই কবুল করে নিবেন।

রাতের অযু আপনাকে গোনাহ থেকে সতর্ক করবে
বর্তমানে গোনাহর সবচেয়ে বড় মাধ্যমের নাম হল ইন্টারনেট। বর্তমানে আমরা সবচেয়ে বেশি করি ভার্চুয়াল গোনাহ। রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মোবাইল চালানো যেন আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। স্বামীর হাতে মোবাইল, স্ত্রীর হাতেও মোবাইল। মোবাইল সময় কেড়ে নিচ্ছে। বলুন, সংসারের সুখ-দুঃখ ও স্বামী-স্ত্রীর সুসম্পর্ক তৈরির এ সময়টি যদি মোবাইলের পেছনে চলে যায়, তাহলে দাম্পত্যজীবনে সুখ আসবে কীভাবে! উপরন্তু রাত যত গভীর হয়, ভার্চুয়াল জগতে অশ্লীলতার চর্চাও তত বাড়তে থাকে।
এজন্যই রাতে বিছানায় যাওয়ার আগে অযু করে নিবেন। এর মাধ্যমে ঈমানী-শক্তির সঞ্চয় হবে। গোনাহের চিন্তা মাথায় আসলেও আপনার অযু আপনাকে সতর্ক করে দিবে যে, তুমি অযু করে এসে কী করছো! আর এভাবে তখন গোনাহ থেকে বেঁচে থাকাটা সহজ হয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ।

আল্লাহওয়ালারা নিজেদের সঙ্গে অযুর পাত্র রাখতেন
আলহামদুলিল্লাহ, এখন তো সব জায়গায় অযু করার সহজ ব্যবস্থা আছে। সালাফের যুগে এটি ছিলনা। তাই আমরা যেমন মোবাইল সঙ্গে রাখি, তারা সব সময় সঙ্গে অযুর পাত্র রাখতেন। হাসান বসরী রহ. বলেন, অনেক আল্লাহওয়ালাদের অবস্থা এমন ছিল যে, তারা নিজেদের সঙ্গে পানির একটি ছোট পাত্র রাখতেন। যাতে করে কোথাও ইস্তেঞ্জার প্রয়োজন দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে যেন অযু করে নিতে পারেন। কেননা, এমন যেন না হয় ইস্তেঞ্জার পর পানির সন্ধান করতে করতে মৃত্যুর ডাক এসে পড়ে। (ইবনু আবিদ্দুনয়া, ক্বাসরুল আমল : ৪৩)

আমি যে আমার মহান মালিকের সামনে দাঁড়াতে যাচ্ছি
আতা আসসুলাইমী রহ. অযু করছিলেন। এমন সময় এক ঝাঁকুনি দিয়ে তার সারা শরীর কেঁপে উঠে। তিনি খুব উচ্চস্বরে কান্না শুরু করেন। আশপাশের মানুষজন ব্যাকুল হয়ে পড়ে। এ কী হল। তিনি হঠাৎ কাঁদছেন কেন? ভয়ে তার চেহারা বিবর্ণ হয়ে যায়। তার চেহারায় রক্ত শূন্যতা দেখা দেয়। সাথীরা ভেবে পায় না। এ কী হল। তাকে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করা হল, আপনিতো অযু করছিলেন। এর মধ্যে কী হল যে, আপনি এমন ভাবে কান্না করছেন? আতা রহ. জবাব দিলেন

إِنِّي أُرِيدُ أَنْ أَتَقَدَّمَ عَلَى أَمْرٍ عَظِيمٍ ، إِنِّي أُرِيدُ أَنْ أَقُومَ بَيْنَ يَدَيِ اللَّهِ

আমি এখন এক বিরাট কাজের দিকে যাচ্ছি। আমি যে আমার মহান মালিকের সামনে দাঁড়াতে যাচ্ছি। (ইবনু আবিদ্দুনয়া, আররিক্কাতু ওয়াল-বুকা : ১৪৭)

৩. অধিকহারে ইস্তেগফার করুন
ইস্তেগফার মানে আল্লাহ তাআলাকে ংড়ৎৎু বলা। নবীজী ﷺ আল্লাহ তাআলাকে ংড়ৎৎু বলার ভাষা আমাদেরকে শিখিয়ে দিয়েছেন যে, أسْتَغْفِرُ اللهَ অথবা أسْتَغْفِرُ اللهَ وَأتُوبُ إلَيهِ অথবা اللَّهُمَّ اغْفِرْ لي বলবে। সুতরাং প্রয়োজনে এর জন্য প্রত্যেক নামাজের পর একটা নিয়ম করে নিন। যেমন, প্রত্যেক নামাজের পর ৫০/১০০/২০০ বার أسْتَغْفِرُ اللهَ অথবা أسْتَغْفِرُ اللهَ وَأتُوبُ إلَيهِ অথবা اللَّهُمَّ اغْفِرْ لي পড়ার নিয়ম করে নিতে পারেন। কেননা, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন

مَا أَصَرَّ مَنِ اسْتَغْفَرَ وَإِنْ عَادَ فِي الْيَوْمِ سَبْعِينَ مَرَّةً

যে ব্যক্তি দিনে সত্তরবার করে একই গোনাহ করার পরও আল্লাহর কাছে গোনাহের জন্য ক্ষমা চাইবে, (ইস্তেগফার করবে) সে যেন প্রকৃতপক্ষে গুনাহ বার বার করে নি। (তিরমিযী : ৩৫৫৯)

ইস্তেগফার করছে এমন কাউকে আল্লাহ আযাব দিবেন না
হাসান বসরী রহ. বলেন, ইস্তেগফার করছে এমন কাউকে আল্লাহ আযাব দিবেন বলে আমি মনে করি না।
এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, তাকে শাস্তি দেওয়ার ইচ্ছা থাকলে কীভাবে আল্লাহ তাআলা তার মনে ইস্তেগফারের প্রেরণা দিতে পারেন? আল্লাহ তাআলা তো বলেই দিয়েছেন

وَمَا كَانَ اللَّهُ مُعَذِّبَهُمْ وَهُمْ يَسْتَغْفِرُونَ

আল্লাহ এমন নন যে, তারা ক্ষমা প্রার্থনা করবে অথচ তিনি তাদেরকে শাস্তি দেবেন। (সূরা আনফাল : ৩৩)

৪. পরিবেশ পাল্টান
মানুষের ওপর পরিবেশের প্রভাব পড়ে। যেমন এখানে কোথাও কি এটা লেখা আছে যে, ধূমপান নিষেধ? লেখা নেই। বিড়ি-সিগারেটের অভ্যাস আছে, এমন কেউ কি এখানে নেই? আছে। তবুও কেউ কি এখানে ধূমপান করে? করে না। কেন করে না? পরিবেশের কারণে করে না। অথচ অনেক জায়গায় লেখা থাকে এখানে ধূমপান করা যাবে না। কিন্তু মানুষ মানে না; বরং ওখানেই ধূমপান করে। এরও কারণ হল পরিবেশ।
অনুরূপভাবে কেউ মসজিদে গেলে তার অন্তরে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ভালোবাসা বাড়ে। কবরস্থানে গেলে মৃত্যুর কথা স্মরণ হয়। হাসপাতালে গেলে অসুস্থতার কথা মনে পড়ে। আবার কোথায় আড্ডা দিতে গেলে এসব ভুলে যায়, তখন ফুর্তিতে মেতে ওঠে। সুতরাং কোনো জায়গায় গোনাহের পরিবেশ থাকলে সেই স্থান ত্যাগ করে ভালো পরিবেশে যাওয়া উচিত।

এটা নবীগণের একটি তরিকা
গোনাহের পরিবেশ থেকে নিজেকে দূরে রাখা এটা নবীগণের একটি তরিকা। দেখুন, হযরত ইউসুফ আ. জুলাইখার কাছে ছিলেন। জুলাইখা তাঁকে গোনাহের প্রতি আহবান করেছিল। গোপন গোনাহের পরিবেশও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ইউসুফ আ. এই পরিবেশকে পছন্দ করলেন না। তিনি গোনাহের পরিবেশÑ যদিও তা ছিল আরাম—আয়েশেরÑ বর্জন করে জেলখানার পরিবেশ বেছে নিলেন। তবুও গোনাহের পরিবেশে থাকাটাকে তিনি পসন্দ করেন নি। বরং তিনি আল্লাহর কাছে এই দোয়া করেছিলেন

رَبِّ السِّجْنُ أَحَبُّ إِلَيَّ مِمَّا يَدْعُونَنِي إِلَيْهِ

হে আমার রব! তারা আমাকে যে কাজের দিকে আহবান করে, তার চাইতে আমি কারাগারই পছন্দ করি। (সূরা ইউসুফ : ৩৩)
সুতরাং আমরাও এটা করব। গোনাহের পরিবেশ থেকে নিজেকে দূরে রাখব।

বাসায় আমলের পরিবেশ গড়ে তুলুন
বাসায় টিভি ভিসিআরের পরিবেশ পাল্টিয়ে সেখানে তা’লিমের পরিবেশ, আমলের পরিবেশ, তেলাওয়াতের পরিবেশ, জিকির-মুরাকাবা, দোয়ার পরিবেশ গড়ে তুলব। শুক্রবারে সূর্য ডোবার আগে দোয়া কবুল হয়, সুতরাং এই সময় দোয়া করার একটা পরিবেশ পরিবারে গড়ে তুলুন। প্রতিদিন পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও বাসায় তা’লিমের ব্যবস্থা করুন। এভাবে গোনাহের পরিবেশ কমিয়ে নেক আমলের পরিবেশ গড়ে তুলুন। দেখবেন, গোনাহ থেকে বেঁচে থাকাটা সহজ হয়ে যাচ্ছে। বাসায় গোনাহের পরিবেশ ষোলকলায় পূর্ণ থাকবে, আর ওই বাসায় নেক সন্তান বেড়ে ওঠবে; এটা কী করে হবে!
এর কারণে দুনিয়ার কিছু মজা তো ছাড়তে হবে। কিন্তু ছাড়বেন কার জন্য? আল্লাহর জন্য। আল্লাহর জন্য গুনাহর মজা ছাড়তে পারলে এর পরিবর্তে তিনি ঈমানের মজা দান করবেন। আর ঈমানের মজা তো এমন মজা যার জন্য কত মানুষ তাদের জানও দিয়ে দিয়েছে। সাহাবায়ে কেরামের ইতিহাসে যার প্রমাণ হাজার হাজার আছে। হাদীসে কুদসিতে এসেছে, আল্লাহ তাআলা বলেন

مَنْ تَرَكَهَا مِنْ مَخَافَتِىْ اَبْدَلْتُهُ إِيْمَاناً يَجِدُ حَلَاوَتَه فِىْ قَلْبِه

যে আমার ভয়ে এগুলো ত্যাগ করবে, আমি তার অন্তরে এমন ঈমান সৃষ্টি করব যে, সে তার স্বাদ পাবে। (আততারগীব ওয়াততারহীব : ২/৩৭)

৫. কাজের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলার অভ্যাস করুন
কারণ, আল্লাহর নামে কাজ শুরুর অভ্যাস আপনাকে এ কথা ভাবতে বাধ্য করবে যে, আসলেই কি এই কাজ শুরুর পূর্বে আল্লাহর নাম নেওয়া সমীচীন!? যেমন বিসমিল্লাহ বলে কি টেলিভিশনের রিমোট হাতে নেয়া যাবে!? বিসমিল্লাহ কি সুদ নেয়া যাবে!? বিবেক কি বাঁধা দিবে না!?

ইন্টারনেট ব্যবহারের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলা
বর্তমানের গোনাহের সবচেয়ে বড় উপকরণের নাম ইন্টারনেট। এই ইন্টারনেটের মাধ্যমে অন্যায় বা গোনাহের অনেকগুলো পথ খুলে গিয়েছে। এটি প্রয়োজনের কথা বলে আসে, তারপর শুরু হয় গোনাহের উদ্দাম চর্চা। যদি আপনার আসলেই ইন্টারনেটের প্রয়োজন পড়ে, তাহলে যখন ব্যবহার করবেন তখন বিসমিল্লাহ বলে শুরু করুন। দেখবেন, অশ্লীল কোনো কিছু সামনে চলে আসলে আপনার বিসমিল্লাহ আপনাকে রিমাইন্ডার দিবে যে, আল্লাহর নামে শুরু করে তুমি এখন কী করছো! এভাবে আপনার ঈমানী বিবেক আপনাকে গোনাহ থেকে বাঁধা দিবে।

ঘর থেকে বের হওয়ার সময় বিসমিল্লাহ বলা
বিশেষ করে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় বিসমিল্লাহ বলুন। কেননা, হাদীসে এসেছে, আনাস ইবনু মালেক রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন যদি কেউ ঘর থেকে বের হওয়ার সময় বলে

بِسْمِ اللهِ تَوَكَّلْتُ عَلَى اللهِ، لَا حَوْلَ وَلَا قُوَّةَ إِلَّا بِاللهِ

অর্থ : আল্লাহর নামে, আল্লাহ তাআলার ওপরই নির্ভর করলাম, আল্লাহ তাআলার সাহায্য ছাড়া বিরত থাকা ও মঙ্গল লাভ করার শক্তি কারো নেই।
তবে তাকে বলা হয়, আল্লাহ তাআলাই তোমার জন্য যথেষ্ট, তুমি অনিষ্ট থেকে হেফাজত অবলম্বন করেছ। আর এতে শয়তান তার থেকে দূরে সরে যায়। (তিরমিযী : ৩৪২৬)
কাজের শুরুতে কেন বিসমিল্লাহ?
রাত-দিন মোট ২৪ ঘণ্টা। পাঁচ ঘণ্টার জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামায আর অবশিষ্ট ১৯ ঘণ্টার জন্য ১৯ টি হরফ দান করা হয়েছে। যেন ১৯ ঘণ্টার প্রতিটি মুহূর্ত; কাজ ও ব্যস্ততা ১৯ টি হরফের বরকতে ইবাদতের মধ্যে গণ্য হয়। অর্থাৎ بسم الله الرحمن الرحيم এর বরকতে ১৯ ঘণ্টাও ইবাদতরূপে বিবেচিত হয়। (তাফসিরে আজীজী : ০১/ ১৬)


বিসমিল্লাহ বলে কাজ শুরু করার তিন ফায়দা
কোনো কাজ বিসমিল্লাহ বলে শুরু করলে কমপক্ষে তিনটি ফায়দা পাওয়া যায়Ñ
প্রথমত, বহু গোনাহ থেকে বাঁচা যায়। যেমন একটু আগে বলেছিলাম যে, অল্লাহর নামে কাজ শুরুর অভ্যাস তাকে এ কথা ভাবতে বাধ্য করবে যে, আসলেই কি এই কাজ শুরুর পূর্বে আল্লাহর নাম নেওয়া সমীচীন?
দ্বিতীয়ত, জায়েয ও নেক কাজ শুরুর পূর্বে আল্লাহর নাম নিলে মানুষের মস্তিষ্ক যথার্থ সিদ্ধান্তে উপনীত হবে এবং সব সময় সঠিকরূপে নিজের কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করতে পারবে।
তৃতীয়ত, সবচেয়ে বড় ফায়দা হলো, যখন সে আল্লাহর নামে নিজের কাজ শুরু করবে তখন আল্লাহর সাহায্য ও সন্তুষ্টি তার সাথে থাকবে। তার কর্মতৎপরতায় বরকত নাযিল হবে। তাকে শয়তানের কুমন্ত্রণা ও চক্রান্ত থেকে রক্ষা করা হবে। আল্লাহর স্বভাব হলো, বান্দা যখন তাঁর প্রতি মনোনিবেশ করে তখন তিনিও তাঁর প্রতি কুদরতিভাবে মনোনিবেশ করেন।

বিশর হাফী রহ.
বিশর হাফী রহ. প্রথম জীবনে ছিলেন একজন শরাবখোর, সারাদিন শরাবখানায় মাতাল হয়ে থাকতেন, আজেবাজে কাজ করতেন।
একদিন তিনি কোথাও যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে বিসমিল্লাহ লিখিত একটি কাগজ মাটিতে পড়ে থাকতে দেখলেন। তিনি সেটি উঠিয়ে নিলেন। এ সময় তার কাছে দুই দিরহাম ছাড়া আর কিছু ছিলো না। তিনি তা দিয়ে সুগন্ধি কিনে ঐ কাগজকে সুগন্ধিময় করলেন। এর ফলশ্রুতিতে স্বপ্নে আল্লাহ তাআলার দিদার নসীব হয়। আল্লাহ তাআলা তাকে লক্ষ্য করে বললেন

يا بشر، طيَّبتَ اسمي لأُطيِّبنَّ اسمك فِي الدنيا والآخرة.

হে বিশর! তুমি আমার নাম সুগন্ধিময় করেছ, আমি তোমার নাম দুনিয়া ও আখেরাতে সুগন্ধিময় করবো। (তাফসিরে কাবীর : ১/১৭৩)
দেখুন, বিসমিল্লাহর বরকতে একজন শরাবখোর হয়ে গেলেন আল্লাহর অলি!

৬. জিকরে-কালবী তথা মনে মনে জিকির করার অভ্যাস গড়ে তুলুন
আল্লাহ তাআলা বলেন

اِنَّ الذِّيْنَ اتَّقَوْا اِذَا مَسَّهُمْ طَائِفٌ مِّنَ الشَّيْطَانِ تَذَكَّرُوْا فَاِذَا هُمْ مُّبْصِرُوْنَ

নিশ্চয় যারা আল্লাহ তাআলাকে ভয় করে যখন তাদেরকে শয়তানের কোনো দল ঘিরে ধরে তখন তারা আল্লাহর জিকির করে। সুতরাং তাদের অনুভূতি ফিরে আসে। (সূরা আ’রাফ : ২০১)
আয়াতটিতে এ রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে যে, যখনই শয়তান আক্রমন করবে, অন্তরে কুমন্ত্রণা ঢেলে দিবে তখনই জিকিরের অস্ত্র ব্যবহার করে তা প্রতিহত করবে। এজন্য রাস্তাঘাটে চলাফেরার সময় মনে মনে জিকির করার প্রতি গুরুত্ব দিন। জিকিরের আলো অন্তরে অপার্থিব প্রশান্তির জন্ম দেয়। তখন নিষিদ্ধ স্থানে চোখও তুলতে মন চায় না।

আল্লাহর স্মরণে রত থাকা
তাবেয়ী আবু উবাইদাহ ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ বলেন

مادام قلب الرجل يذكر الله فهو في الصلاة وإن كان في السوق، فإن يحرك به شفتيه فهو أعظم

যতক্ষণ পর্যন্ত ব্যক্তির অন্তর আল্লাহর স্মরণে রত থাকে, ততক্ষণ মূলত সালাতের মধ্যেই থাকেÑযদিও সে সে বাজারে থাকে। যদি এর সঙ্গে তার জিহ্বা ও দুই ঠোঁট নড়াচড়া করে অর্থাৎ, মনের স্মরণের সঙ্গে যদি মুখেও উচ্চারণ করে তাহলে তা হবে খুবই ভালো, বেশি কল্যাণময়। (বায়হাকী, শু’আবুল ঈমান : ১/৪৫৩)

অন্তরের জিকিরের কিছু চমৎকার দৃষ্টান্ত
আমাদের শায়েখ ও মুরশিদ মাহবুবুল ওলামা পীর যুলফিকার আহমদ নকশবন্দী দা. বা. এর চমৎকার দৃষ্টান্ত দেন। তিনি বলেন, মা তার সন্তানকে মাদ্রাসায় বা স্কুলে পাঠায়। সারাক্ষণ মনে পড়ে কখন সন্তান বাসায় আসবে। কিন্তু তার ঘরের কাজও চলতে থাকে ।
আরেকটি দৃষ্টান্ত, ড্রাইভার যখন ড্রাইভ করে তখন তার দৃষ্টি থাকে সামনের দিকে। কিন্তু সে পাশের লোকের সঙ্গেও কথা বলে। মোবাইলেও কথা বলে।
ঠিক একইভাবে আমাদের মনোযোগ থাকবে আল্লাহর দিকে, সঙ্গে অন্যান্য কাজও চলবে।

دست بکار دل بیار

হাত থাকবে কাজে, দিল বন্ধুর সাথে।
সামনের দিক থেকে এক মুহূর্তের জন্য দৃষ্টি সরালে এক্সিডেন্ট হতে পারে। অনুরূপভাবে এক মুহূর্তের জন্য আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল থাকলে শয়তান ধোঁকায় ফেলে দিতে পারে।

অন্তরের কঠিনতা থেকে বাঁচতে হলে
একজন লোক হাসান বসরী রহ.-কে জিজ্ঞেস করলেন

يا أبا سعيد، أشكو إليك قسوة قلبي

হে আবু সাঈদ! আপনার নিকট অন্তর কঠিন হওয়ার অভিযোগ করছি।
তিনি বললেন

أذبه بالذكر

তুমি অন্তরের কঠিনতা থেকে বাঁচতে জিকির করবে। (ইবনুল জাওযী, যাম্মুল হাওয়া : ৬৯)

৭. সময়ের মূল্য দিন
শাইখুল ইসলাম মুফতি তাকী উসমানী দা. বা. বলেন, সময়কে গুনাহর মধ্য দিয়ে কাটানোর ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। কখনও অবসর সময় কাটাবে না। যখনই নির্জনে থাকবে, অবসর থাকবে তখনই নিজেকে কোনো কাজে ব্যস্ত করে নিবে। কাজটি দুনিয়ার বৈধ কাজ হলেও অসুবিধা নেই। তবুও আল্লাহর নাফরমানির ভেতর সময় নষ্ট করো না। আর যদি কাজটি হয় ভাল বই পড়া, জিকির—মোরাকাবা করা, তেলাওয়াত করা তাহলে তো সবচে’ ভাল।
তিনি বলেন, আমাদের শায়েখ ও মুর্শিদ ডা. আব্দুল হাই আরেফী রহ. বলতেন, ‘কাজের ভেতরে কাজ ঢুকিয়ে দাও। অবসর আছো তো কোনো কাজের প্রোগ্রাম করে নাও। হাতে একটি কাজ আছে তো আরেকটি কাজের প্রোগ্রাম বানিয়ে নাও।’
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন

نِعْمَتَانِ مَغْبُونٌ فِيهِمَا كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ الصِّحَّةُ وَالْفَرَاغُ

দুটো নিয়ামত এমন যে দুটোর বিষয়ে বহু লোক ধোঁকায় নিপতিতÑ স্বাস্থ্য এবং অবসর। (তিরমিযী : ২৩০৭)
জীবনের দৃষ্টান্ত
ইমাম গাযালী রহ. একবার একটা গল্প বলেছিলেন।
এক ব্যক্তি জঙ্গলে হাঁটছিল। হঠাৎ দেখল এক সিংহ তার পিছু নিয়েছে। সে প্রাণভয়ে দৌড়াতে লাগল। কিছু দূর গিয়ে একটি পানিবিহীন কুয়া দেখতে পেল। সে চোখ বন্ধ করে তাতে দিল ঝাঁপ। পড়তে পড়তে সে একটি ঝুলন্ত দড়ি দেখে তা খপ করে ধরে ফেলল এবং ওই অবস্থায় ঝুলে রইল। উপরে চেয়ে দেখল কুয়ার মুখে সিংহটি তাকে খাওয়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। নিচে চেয়ে দেখল বিশাল এক সাপ তার নিচে নামার অপেক্ষায় চেয়ে আছে। বিপদের উপর আরো বিপদ হিসেবে দেখতে পেল একটি সাদা আর একটি কালো ইঁদুর তার দড়িটি কামড়ে ছিড়ে ফেলতে চাইছে। এমন হিমশিম অবস্থায় কী করবেÑ যখন সে বুঝতে পারছিল না, তখন হঠাৎ তার সামনে কুয়ার সঙ্গে লাগোয়া গাছে একটা মৌচাক দেখতে পেল। সে কী মনে করে সেই মৌচাকের মধুতে আঙ্গুল ডুবিয়ে তা চেটে দেখল। সেই মধুর মিষ্টতা এতই বেশি ছিল যে, সে কিছু মুহূর্তের জন্য উপরের গর্জনরত সিংহ, নিচের হাঁ করে থাকা সাপ, আর দড়ি কাঁটা ইঁদুরদের কথা ভুলে গেলেন। ফলে তার বিপদ অবিশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ালো।
ইমাম গাযালী রহ. এই গল্পের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন,
এই সিংহটি হচ্ছে আমাদের মৃত্যু, যে সর্বক্ষণ আমাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
সেই সাপটি হচ্ছে কবর। যা আমাদের অপেক্ষায় আছে।
দড়িটি হচ্ছে আমাদের জীবন, যাকে আশ্রয় করেই বেঁচে থাকা।
সাদা ইঁদুর হল দিন, আর কালো ইঁদুর হল রাত, যারা প্রতিনিয়ত ধীরে ধীরে আমাদের জীবনের আয়ু কমিয়ে দিয়ে আমাদের মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
আর সেই মৌচাক হল দুনিয়া। যার সামান্য মিষ্টতার পেছনে পড়ে আমরা এই চতুর্মুখি ভয়ানক বিপদের কথা ভুলে বসে আছি।

তুমি কে?
হাসান বসরী রহ. বলেন

يا ابن آدم إنما أنت أيام كلما ذهب يوم ذهب بعضك

তুমি আসলে কতগুলো দিনের সমষ্টি ছাড়া আর কিছুই না। যখন একটি দিন পার হয়ে যায়, তখন তোমার একটি অংশ ক্ষয় হয়ে যায়। (ইবনু আবিদদুনয়া; কিতাবুযযুহদ : ১৮৭)

৮. পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের গুরুত্ব দিন
নামায এমন ইবাদত, যার সুফল ও সুপ্রভাব নামাযীর জীবনের সর্বত্র অনুভূত হয়। আর এটাই বাস্তবতা। যার নামায সুন্দর, তার সবকিছু সুন্দর। তার জন্য গুনাহের পথ সংকীর্ণ এবং নেকির পথ সুগম হয়।
আল্লাহ তাআলা বলেন

إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَىٰ عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنكَرِ

নিশ্চয়ই নামায অশ্লীল ও মন্দকর্ম থেকে বিরত রাখে। (সূরা আনকাবুত : ৪৫)
নামাযের প্রতি উদাসীনতা সৃষ্টির মাধ্যমে শয়তান মানুষের অন্তরে স্থান করে নেয়। আস্তে আস্তে অন্যদিকে তার কুমন্ত্রণার ঢালপালা ছড়ায়। এটা অনেকটা ডিম পাড়ার মতো। নামাযে অমনোযোগী করে, সে মানুষের মনে গুনাহের ‘ডিম’ পাড়ে। ক্রমে ক্রমে সে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটে!

যারা নামায নষ্ট করে
ওমর রাযি.-কে ফজরের নামাযের ইমামতিকালে ছুরিকাঘাত করা হয়, তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। জ্ঞান ফিরলে তিনি জানতে চান, ‘লোকজন নামায আদায় করেছে কি?’
উত্তর দেয়া হলো, ‘জি¦। আদায় করেছে।’
ওমর রাযি. বললেন

ولا حَظَّ في الإسلامِ لمن تركَ الصلاةَ

জেনে রেখো, যারা নামায নষ্ট করে ইসলামে তাদের কোনো হিসসা নেই। (মুয়াত্তা ইমাম মালিক রহ. : ৯৮)

দু’টি বিষয় ঠিক; বাকি সব ঠিক
প্রখ্যাত তাবিয়ী ইউনুস ইবন উবাইদ রহ. বলেন

خصلتانِ إذا صلَحتا من العبد، صلَح ما سواهما: صلاتُه ولسانه

মানুষের দু'টি বিষয় ঠিক হয়ে গেলে বাকি সব ঠিক হয়ে যায়। ১. নামায ২. যবান। (হিলয়াতুল আউলিয়া : ৩/১৫)

ফজরের নামাযের বিশেষ গুরুত্ব দিন
বিশেষ করে ফজরের নামাযের গুরুত্ব দিবেন। গোনাহের যত বড় আসক্তিই হোক; যদি এই নামাযের গুরুত্ব দেন ইনশাআল্লাহ আসক্তি থেকে বের হতে পারবেন। কেননা, হাদীস শরিফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, তোমাদের কেউ যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন শয়তান তার ঘাড়ের পিছনের দিকে তিনটি গিঠ দেয়। প্রতি গিঠে সে এ বলে চাপড়ায়, তোমার সামনে রয়েছে দীর্ঘ রাত, অতএব তুমি শুয়ে থাক। তারপর সে যদি জাগ্রত হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে একটি গিঠ খুলে যায়, পরে অজু করলে আর একটি গিঠ খুলে যায়, এরপর ফজর নামায আদায় করলে আর একটি গিঠ খুলে যায়। তখন তার সকাল বেলাটা হয়, উৎফুল্ল মনে ও অনাবিল চিত্তে। এরপর রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন

وَإِلاَّ أَصْبَحَ خَبِيثَ النَّفْسِ كَسْلاَنَ ‏

অন্যথায় সে যখন সকালে উঠে তখন অন্তরটা হয় খবিস অন্তর। (সহীহ বুখারী : ১১৪২)
যার ফলে সারাদিন গোনাহের চিন্তায় মাথা কিলবিল করতে থাকবে।

৯. আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্যের মুরাকাবা করুন
সব সময় সর্বাবস্থায় ‘আল্লাহ আমার সঙ্গে আছেন’ এই কল্পনা ধরে রাখার চেষ্টা করুন।
প্রত্যেক নামাযের পর দৈনিক অন্তত পাঁচ বার কিছু সময়ের জন্য; দুই থেকে পাঁচ মিনিটের জন্য আল্লাহর সান্নিধ্যের মোরাকাবা করলে এই অনুভূতি তৈরি হয়।
মোরাকাবা এভাবে করবেন : চোখ বন্ধ করবেন। তারপর ভাববেন, ‘আমি যেখানেই থাকি না কেন; আল্লাহ আমার সঙ্গে আছেন।’

অথবা এই আয়াতের বিষয়বস্তু নিয়ে চিন্তা করবেন

هُوَ مَعَكُمْ اَيْنَمَا كُنْتُمْ

‘তোমরা যেখানেই থাকো না কেন; তিনি তোমাদের সঙ্গে আছেন।’
এভাবে নিয়মিত কিছুদিন করতে পারলে ধীরে ধীরে আল্লাহর সান্নিধ্যের সার্বক্ষণিক অনুভূতি অন্তরে বসে যাবে এবং গুনাহ থেকে চব্বিশ ঘণ্টার বাকি সময়গুলোতেও বেঁচে থাকতে পারবেন ইনশাআল্লাহ।

چوريا ں آنكهو ں كى اور سينو ں كى راز
جانتا ہے سب كو توا ے بے نياز

চোখের চুরি আর অন্তরের ভেদ,
হে অমুখাপেক্ষী আল্লাহ! তুমি জান সবকিছু।

তাহলে আল্লাহ কোথায় আছেন
বিখ্যাত সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনং ওমর রাযি. মদীনা থেকে মক্কায় যাচ্ছিলেন। পথে একটি পাহাড়ের পাশে তাঁর যাত্রা—বিরতি হল। পাহাড় থেকে একজন লোক নেমে এল। ইবনু ওমর জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি রাখাল? সে বলল, জী হাঁ। ইবনু ওমর রাযি. বললেন, আমার কাছে একটি ছাগল বিক্রি করবে? সে বলল, আমি একজন গোলাম মাত্র। ছাগলের মালিক এখানে নেই। এবার ইবনু ওমর রাযি. তাকে পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে বললেন, তোমার মালিককে বলবে, বাঘে খেয়ে ফেলেছে। এ কথা শোনামাত্র রাখালটি ফিরে গেল এবং যেতে যেতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলল

فأين الله عزوجل؟

‘তাহলে আল্লাহ কোথায় আছেন?!’
ইবনু ওমর রাযি. তার কথায় বিগলিত হলেন এবং বাক্যটির পুনরাবৃত্তি করতে লাগলেন

فأين الله عزوجل؟

এরপর মদীনায় পৌঁছা পর্যন্ত তিনি এ কথার পুনরাবৃত্তি করতে লাগলেন

قال الراعي: فأين الله؟

(রাখাল বলেছে, তাহলে আল্লাহ কোথায় আছেন?!)
মদীনায় ফিরে তিনি ওই রাখালটির মালিকের খোঁজ করলেন এবং তাকে কিনে আযাদ করে দিলেন এবং তার জন্য ছাগলের পাল কিনে দিলেন। (সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা : ৩/২১৬)

প্রতিমুহূর্তে আল্লাহ তাআলা আমাকে দেখছেন
শাইখুল ইসলাম মুফতী তাকী উসমানী দা. বা. বলেন, কয়েক বছর আগে এক সফরে আমেরিকার টেক্সাস প্রদেশের প্রসিদ্ধ শহর হিউস্টনে (houston) গিয়েছিলাম। ‘নাসা’র (NASA) সবচেয়ে বড় কেন্দ্র সেখানেই অবস্থিত। আমার মেজবান আমাকে তা পরিদর্শন করানোর জন্য নিয়ে গেলেন। এটা ‘নাইন-ইলেভেন’—এর আগের কথা। এখন কী অবস্থা জানি না। এক পর্যায়ে আমরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর অংশে প্রবেশ করলাম, যেখান থেকে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সবার জন্য সেখানে প্রবেশের অনুমতি নেই। প্রবেশ করেই দেখতে পেলাম, দেয়ালে একটি বোর্ড লাগানো রয়েছে। তাতে স্পষ্ট অক্ষরে লেখাÔYou are being watched ‘আপনার প্রতি লক্ষ রাখা হচ্ছে’ বা সর্বক্ষণ আপনি আমাদের নজরে রয়েছেন। ব্যাস, এটুকুই! কোনো সিকিউরিটি গার্ড নেই, পুলিশ নেই। শুধু এটুকু লেখা যে, আপনাকে নজরদারি করা হচ্ছে। প্রবেশকারী বোর্ডের লেখা পড়েই বুঝতে পারে যে, গোপন ক্যামেরার সাহায্যে তার প্রতিটি কার্যকলাপ লক্ষ রাখা হচ্ছে, ফলে সে তৎক্ষণাৎ সতর্ক হয়ে যায়। এমন কোনো কাজ করে না, যার ফলে তাকে জবাবদিহি বা গ্রেফতারের সম্মুখীন হতে হবে।
লেখাটি পড়ে আমি ভাবলাম, ‘এ বোর্ডের কারণে এখানে প্রবেশকারী সবাই সতর্ক হয়ে চলে। আহা! এ অনুভূতিই তো রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন যে, You are being watched by Allah taala ‘আল্লাহ তাআলা সব সময় তোমাকে দেখছেন।’

إِنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا تَفْعَلُونَ

‘তোমরা যা করছ, সব তিনি জানেন।’
আমাদের সবার মনে যদি এই চেতনা সদাজাগ্রত থাকে যে, প্রতি মুহূর্তে আল্লাহ তাআলা আমাকে দেখছেন তাহলে আমাদের সকল সমস্যা দূর হয়ে যাবে। কেউ কারো ওপর জুলুম করবে না, একে অপরের হক নষ্ট করবে না। আল্লাহ তাআলার কোনো বিধান লঙ্ঘন করবে না। কেবল এই একটি জিনিসই মানুষকে অন্যায়-অপরাধ এবং পাপাচার ও সীমালঙ্ঘন থেকে বিরত রাখতে পারে। এরই নাম তাকওয়া। নবীগণের মেহনত এবং নবী প্রেরিত হওয়া ও কিতাব নাযিল হওয়ার মূল উদ্দেশ্য হল মানুষের অন্তরে তাকওয়া সৃষ্টি করা।

১০. আল্লাহওয়ালাদের সোহবত গ্রহণ করুন
আল্লাহওয়ালাদের চেহারা দেখুন, তাঁদের মজলিসে বসুন, তাঁদের কথা শুনুন এবং উৎসাহ-উদ্দীপনা সঞ্চয় করুন, এতে নফস নিয়ন্ত্রণ করা এবং উপরোক্ত সকল পরামর্শ অনুযায়ী চলা আপনার জন্য সহজ হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ اتَّقُواْ اللّهَ وَكُونُواْ مَعَ الصَّادِقِينَ

হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক। (সূরা আত তাওবা : ১১৯)

সবচেয়ে উত্তম মজলিস
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত

قِيلَ: يَا رَسُولَ اللهِ، أَيُّ جُلَسَائِنَا خَيْرٌ؟ قَالَ: مَنْ ذَكَّرَكُمُ اللهَ رُؤْيَتُهُ، وَزَادَ فِي عِلْمِكُمْ مَنْطِقُهُ، وَذَكَّرَكُمْ بِالْآخِرَةِ عَمَلُهُ

এক ব্যক্তি প্রশ্ন করলো, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমাদের বসার সঙ্গী বা মজলিস হিসেবে কোন্টি সবচেয়ে উত্তম? রাসুলুল্লাহ ﷺ উত্তর দিলেন, যার সাক্ষাৎ তোমাদেরকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যার কথায় তোমাদের ইলম বেড়ে যায় এবং যার আমল তোমাদেরকে আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। (মুসনাদ ইবন আব্বাস রাযি. ৬৩৮)
আমি আপনাকে আশ্বস্ত করছি, নেক মজলিসের প্রভাব আপনি তখনও নিশ্চিত অনুভব করবেন, যখন রাতের অন্ধকারে স্মার্ট ফোনটা হাতে নিবেন। ব্রাউজিং করার সময় গুনাহর চিন্তা যখন আপনাকে তাড়িত করবে, তখন এই নেক সোহবতের নূর আপনি অনুভব করবেন।

উস্তায জিগর মুরাদাবাদী
উস্তায জিগর মুরাদাবাদী। সমকালে প্রসিদ্ধ ও প্রথিতযশা কবি ছিলেন। শুরুর দিকে তিনি কেবল নেশা পানকারী ছিলেন না; বরং পান ছাড়া তাঁর চলত না। কল্পনার জগতে সব সময় ডুবে থাকতেন। কবিতার জগতে এতটাই দক্ষ ছিলেন যে, মনে হত, বিষয়বস্তুর নক্ষত্রগুলো আকাশ থেকে পেড়ে নামাতেন।
একবারের ঘটনা। কোনো এক মজলিসে উস্তায জিগরের সঙ্গে খাজা আজিজুল হাসান মাজযুব রহ.-এর সাক্ষাত হয়। মাজযুব রহ.-এর কথাবার্তা শুনে জিগর সাহেব দারুণ প্রভাবিত হন যে, একজন ইংরেজি শিক্ষিত, উচ্চপদস্থ ব্যক্তি অথচ তাঁর হৃদয়পাতালে ইশকে ইলাহীর ঝড় চলছে। কথাবার্তার এক পর্যায়ে তিনি হযরত মাজযুবকে মজা করে জিজ্ঞেস করেন, ‘জনাব! আপনার ‘টার’ কিভাবে ‘মিস’ হয়ে গেল?’ অর্থাৎ মিস্টারের ‘টার’ কিভাবে মিস হল?
হযরত মাজযুব রহ. উত্তর দিলেন, ‘হাকিমুল উম্মত থানভী রহ.-এর আলোকিত দৃষ্টির উসিলায় আমার মিস্টারের ‘টার’ পড়ে গেছে।’
উস্তায জিগর বললেন, ‘আচ্ছা, খুব ভালো।’
মাজযুব রহ. বললেন, ‘আপনি যদি হাকিমুল উম্মতের সাথে সাক্ষাত করতে চান তাহলে আমি ব্যবস্থা করে দিতে পারি।’
উস্তায জিগর উত্তর দিলেন, ‘আমি রাজি আছি তবে সেখানে গিয়েও আমি পান করব। কারণ, পান করা ছাড়া তো এক মূহূর্তও আমার চলে না।’
যাই হোক হযরত মাজযুব রহ. বিষয়টি থানভী রহ.-এর কাছে উত্থাপন করলেন। থানভী রহ. উত্তর দিলেন, ‘খানকাহ তো সকলের জন্য। সুতরাং এখানে পান করার প্রশ্নই ওঠে না। তবে আমি জিগর সাহেবকে নিজের মেহমান হিসেবে রাখতে পারি। তিনি সেখানে একা থাকবেন। তারপর তাঁর যা করার ইচ্ছা করবেন, এতে আমি কী করতে পারি।’
অবশেষে হযরত মাজযুব উস্তায জিগরকে থানভী রহ.-এর দরবারে একদিন নিয়ে গেলেন। একজন কামিল অলির অল্প কিছুক্ষণের সোহবতে উস্তায জিগরের হৃদয়জগত পাল্টে গেল। শেষ পর্যন্ত তিনি তো পান করলেনই না, বরং থানভী রহ.-কে দিয়ে নিজের জন্য তিনটি দোয়া করালেন। প্রথম দোয়া—আমি মদপান ছেড়ে দিলাম। দোয়া করবেন যেন মদ ছাড়তে পারি। দ্বিতীয় দোয়া— সুন্নাতে-রাসূল ﷺ দাঁড়ি দ্বারা আমি আমার চেহারা সজ্জিত করব। দোয়া করবেন। তৃতীয় দোয়া—আমি হজ্জ করব। দোয়া করবেন।
তারপর উস্তায জিগর মুরাদাবাদী থানভী রহ.-এর দরবার থেকে চলে আসলেন। মানুষ তাঁর জীবনের এই পরিবর্তন দেখে বিস্মিত হল। তাঁকে দেখার জন্য লোকজন আসত। তখন উস্তায জিগর নিজের সম্পর্কে একটি ছন্দ তৈরি করেছিলেন

چلو دیکھ آئیں تماشا جگر کا
سنا ہے وہ کافر مسلماں ہوا ہے

‘চলো একটু দেখে আসি তামাশা জিগরের
শুনলাম, বনেছে মুসলিম ওই কাফের।’
মদপান পুরোপুরি ছেড়ে দেওয়ার কারণে উস্তায জিগর খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ডাক্তাররা পরামর্শ দিল, একবারে না ছেড়ে ধীরে ধীরে ছাড়লে ভালো হত। তিনি উত্তর দিলেন, ‘ছেড়েছি তো ছেড়েছি। নিয়ত পাল্টাবো না—ইনশাআল্লাহ। যদি মৃত্যু এসে যায় তবে তো আল্লাহ চাহে তো তাওবা কবুল হয়ে যাবে। আখেরাত সুন্দর হয়ে যাবে।’
এভাবে উস্তায জিগরের জীবনের মোড় অন্ধকার থেকে আলোর দিকে ঘুরে গেল। এটা কেন হয়েছিল? একজন আল্লাহর অলির সঙ্গে আন্তরিক বন্ধন তৈরির উসিলাতেই হয়েছিল।

সংক্ষেপে আলোচ্য দশটি আমল ও কৌশল
মুহতারাম হাজিরীন! আলোচনা শেষ করে দিচ্ছি। পরিশেষে গোনাহ থেকে বাঁচার আলোচ্য দশটি আমল ও কৌশল পয়েন্ট আকারে আবার বলে দিচ্ছি, যেন সকলের জন্য মুখস্থ রাখা ও আমল করা সহজ হয়।
১. নিয়ত করুন, গোনাহের সুযোগ পেলেও গোনাহ করবো না
২. সর্বদা অযু অবস্থায় থাকার চেষ্টা করুন
৩. অধিকহারে ইস্তেগফার করুন
৪. পরিবেশ পাল্টান
৫. কাজের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলার অভ্যাস করুন
৬. জিকরে-কালবী তথা মনে মনে জিকির করার অভ্যাস গড়ে তুলুন
৭. সময়ের মূল্য দিন
৮. পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের গুরুত্ব দিন
৯. আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্যের মুরাকাবা করুন
১০. আল্লাহওয়ালাদের সোহবত গ্রহণ করুন

আল্লাহর বিশেষ রহমত
মনে রাখবেন, আল্লাহ তাআলার বিশেষ রহমত হল, গোনাহে লিপ্ত থাকা অবস্থায় মরণ না আসা এবং গোনাহের পর তাওবার তাওফিক হওয়া। আর আমাদের সকলকে এই তাওফিক দান করুন, আমীন।

وَآخِرُ دَعْوَانَا اَنِ الْحَمْدُ لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ

ইসলাহী বয়ান অবলম্বনে।

মন্তব্য (...)

এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ

গোনাহের ক্ষতি - ১ম পর্ব

...

মাওলানা আতাউল্লাহ আব্দুল জলীল
১০ নভেম্বর, ২০২৪
২৭৫৪ বার দেখা হয়েছে

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →