প্রবন্ধ
ইলম থেকে মাহরূমির কারণসমূহ ও প্রতিকার
ইলম আল্লাহ তা'আলার নেয়ামতসমূহের মধ্যে অন্যতম বড় নেয়ামত। হাদীসে এসেছে, 'আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তাকে দীনের বুঝ দান করেন। ' ইলমের নেয়ামত কেবল সৌভাগ্যবানদের নসীবেই জোটে। তালিবে ইলমদের এই নেয়ামতের অনুভূতি থাকা উচিত।
ইলমে দীনের এই অবক্ষয়ের যুগে যখন সকল মানুষ দুনিয়ামুখী গুটিকয়েক মানুষ মাত্র ইলম হাসিলের পথে অগ্রসর হয়। যারা আসে তারা দুনিয়া ছেড়ে আখেরাত লাভের উদ্দেশ্যেই আসে। এটা অনেক বড় কুরবানী। এতবড় কুরবানীর তাকাযা তো ছিল সবাই তাদের মনযিলে মাকসুদে পৌঁছতে সক্ষম হবে, আদর্শ আলেম হবে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে লক্ষ্য করা যায়, বহু তালিবে ইলম এই নেয়ামত পাওয়ার পরও তা থেকে মাহরূম হয়, বঞ্চিত হয়। ফলে দুনিয়ার পাশাপাশি তাদের আখেরাতও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
কিছু তালিবে ইলম এমন আছেন, ভালোভাবে পড়াশোনার একপর্যায়ে বাহ্যিক কোন কারণ ছাড়াই হঠাৎ মাদরাসা ছেড়ে চলে যান। এসব মাহরূমির মূল কারণ হচ্ছে, তারা মাহরূমির আসবাবের ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন না। তাতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তাই তাদের মাহরূমী অনিবার্য ছিল। এজন্য জানা প্রয়োজন কী কী কারণে ইলম থেকে মাহরূম হতে হয়। আমরা এখানে কিছু কারণ নিয়ে আলোচনা করছি। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে ইলম থেকে মাহরূমির এসব আসবাব থেকে হেফাযত করুন।
১. গুনাহ করা
সকল প্রকার গুনাহই ইলম হাসিলের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক। কারণ ইলম হচ্ছে নূর বিশেষ। আর গুনাহ হচ্ছে যুলমাত বা অন্ধকার। ইমাম শাফেয়ী রহ.এর বিখ্যাত ঘটনা। তিনি তার উস্তাদ ওয়াকী' রহ.এর নিকট স্মরণশক্তির দুর্বলতার কথা জানালে তিনি বলেছিলেন, ‘গুনাহ ছেড়ে দাও। কারণ ইলম হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে নূর। আর আল্লাহর নূর কোন গুনাহগারকে দেয়া হয় না।' তাই সব ধরনের গুনাহই বর্জন করা চাই। তবে মাহরূমির অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত কিছু গুনাহ হচ্ছে,
(ক) দৃষ্টির হিফাযত না করা। কুদৃষ্টি একটি মারাত্মক গুনাহ। কারণ النظر سهم من سهام ابليس (দৃষ্টি শয়তানের তীরসমূহের মধ্য থেকে একটি তীর)। মানুষ বিভিন্ন কারণে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে। যেমন- লজ্জিত হওয়ার ভয়ে, সুযোগ না পাওয়ার কারণে কিংবা অর্থ সঙ্কটের কারণে। কিন্তু কুদৃষ্টি এমন এক গুনাহ, যা করতে এ সবের প্রয়োজন হয় না এবং এটা যে গুনাহ এই অনুভূতিও অনেকের থাকে না। দাড়িবিহীন বালকদের প্রতি কুদৃষ্টি দেয়া তো আরো জঘন্য। কতক আহলে কাশফ বুযুর্গের অভিমত হল, 'আল্লাহ যখন কাউকে তার দরবার থেকে বিতাড়িত করতে চান, তখন তাকে সুদর্শন বালকের মহব্বতে লিপ্ত করে দেন'। কুদৃষ্টির কারণে চোখে অন্তরে এমন যুলমাত সৃষ্টি হয় যে, সামান্য অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিও তা অনুভব করতে পারে।
তাছাড়া এই গুনাহ এমন সুপ্ত হয়ে থাকে যে, নিজেকে বুযুর্গ মনে করে এমন অনেকেই মনের অজান্তে এ গুনাহে লিপ্ত থাকেন। তাই তালিবে ইলমদের এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা চাই এবং আল্লাহ না করুন কেউ এতে লিপ্ত হয়ে পড়লে ইসলাহের ফিকির করা চাই।
(খ) ছাত্র যামানায় মোবাইল ব্যবহার করা। এর সর্বনিম্ন ক্ষতি হচ্ছে, একাগ্রতায় বিঘ্ন ঘটা, যা ইলম হাসিলের ক্ষেত্রে অন্তরায়। আর প্রধান প্রধান ক্ষতির কথা তো বলাই বাহুল্য। কারণ ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ার পাশাপাশি প্রযুক্তির উৎকর্ষে মোবাইলে দিন দিন এমন সব ফিচার যুক্ত হচ্ছে, যা গুনাহকে সহজ থেকে সহজতর করে তুলছে। দুনিয়ার সকল খারাবী যেন এই ‘মুঠোফোনে’ আক্ষরিক অর্থেই হাতের মুঠোয় এসে পড়েছে। আরো আশ্চর্যের বিষয় হল, কতক অভিভাবক ভালো ফলাফল করায় কিংবা আব্দার মেটাতে সন্তানের হাতে মোবাইল তুলে দেন। আর আশা করেন, তার সন্তান সামনে থেকে আরো ভালো পড়াশোনা করবে। অথচ তিনিই স্বয়ং তার সন্তানের ইলম থেকে মাহরূম হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ালেন। তাই তালিবে ইলমের যেমন মোবাইলকে বিষতুল্য মনে করে এর থেকে বেঁচে থাকা উচিত; তেমনি অভিভাবকেরও এ ব্যাপারে সতর্ক ও কঠোর ভূমিকা পালন করা উচিত।
(গ) মাদরাসার পরিবেশের বাইরেও গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা। যেমন বাড়িতে গাইরে মাহরাম তথা ভাবি, চাচি, মামি, খালাতো-চাচাতো-মামাতো বোনসহ অন্যান্যদের থেকে পর্দা না করা। গান- বাজনা শোনা, টিভি দেখা ইত্যাদি। যাদেরকে দিয়ে আল্লাহ দীনের হিফাযত করবেন, তারা নিজেরাই যদি দীনকে পয়মাল করে; তবে কীভাবে আশা করা যায় যে, আল্লাহ তাদেরকে উম্মতের রাহনুমা বানাবেন? !
কারো বাড়ির পরিবেশ এমন থাকলে নিজে এসব থেকে পরহেয করা ও এ ব্যাপারে প্রয়োজনে কঠোরতা করা। চাই কেউ তাতে অসন্তুষ্টই হোক না কেন। কারণ খালিককে অসন্তুষ্ট করে মাখলুককে সন্তুষ্ট করা জায়েয নেই।
২. হারাম থেকে না বাঁচা
হারাম খাওয়া পরাও ইলম থেকে মাহরূম হওয়ার কারণ। তালিবে ইলমের খোঁজ রাখা উচিত যে, তার অভিভাবকের উপার্জন হালাল কিনা। এমন গুরুতর বিষয়েও অনেকে উদাসীন থাকেন। কারো অভিভাবক হয়ত ব্যাংকে চাকুরী করেন। কিংবা কোন সূদী লেনদেনে জড়িত। কখনো আত্মীয়-স্বজন বা মুহিব্বীনের উপার্জনের ব্যাপারে না জেনেই তার দাওয়াত রক্ষা করেন। তাই কারো অভিভাবকের উপার্জন যদি হারাম হয়েই থাকে, সেক্ষেত্রে করণীয় হল, যতটুকু না হলেই নয় ততটুকু গ্রহণ করা এবং আল্লাহর কাছে ইস্তিগফার করা। সেই সঙ্গে অভিভাবকের জন্যও দু'আ করা ও তাকে হারাম উপার্জন থেকে ফেরানোর চেষ্টা করতে থাকা। কারণ হারাম দ্বারা গঠিত শরীর দ্বারা ইলম হাসিলের আশা করা দুরাশা বৈ কিছুই নয় ৷
৩. উস্তাদের সঙ্গে বেয়াদবী
এ যুগে ইলমের অধঃপতনের আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে, বর্তমানে উস্তাদের সঙ্গে সম্পর্ক সাময়িক ও প্রয়োজন-নির্ভর হয়ে পড়েছে। অথচ উস্তাদের আদব- ইহতিরাম ও তার দু'আ ছাড়া ইলমের বরকত পাওয়া সম্ভব নয়। আর উস্তাদের সঙ্গে বেয়াদবী করা তো মারাত্মক অন্যায় ও ইলম থেকে মাহরূমির আলামত। হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ. তার ইসলাহে ইনকিলাবে উম্মত গ্রন্থে উস্তাদের হক সম্পর্কিত এমন কিছু ত্রুটি উল্লেখ করেছেন যেগুলো ইলম থেকে মাহরূমির কারণ হয়ে থাকে।
যথা-
ক. উস্তাদের আদব রক্ষা না করা।
খ. দেখা-সাক্ষাতে সালাম না দেয়া।
গ. উস্তাদের দিকে পিঠ দিয়ে বসা।
ঘ. তার সামনে পা ছড়িয়ে বসা।
ঙ. পুরোপুরি আনুগত্য না করা। যেমন, কিছু কথা মানা, কিছু কথা না মানা ।
চ. মহব্বতে কমতি থাকা।
ছ. ধোঁকাবাজী করা।
জ. মিথ্যা বলা।
ঝ. ত্রুটি স্বীকার না করে অপব্যাখ্যা করা।
ঞ. খিদমতে কমতি করা।
তুহফাতুল উলামা গ্রন্থে হযরত থানবী রহ, কর্তৃক বাতলানো উস্তাদের হুকুক ও আদাব গুরুত্বের সাথে পড়ে তদানুযায়ী আমল করা উচিত।
৪. অহঙ্কার করা
অহঙ্কার অত্যন্ত নিকৃষ্ট আত্মার রোগ। হাদীসে এসেছে, আল্লাহ পাক বলেন, 'অহঙ্কার আমার চাদর। বড়ত্ব-মহত্ত্ব আমার ইযার। যে এটা টানবে (অর্থাৎ অহঙ্কার, বড়াইয়ে লিপ্ত হবে) আমি তাকে জাহান্নামে ছুড়ে ফেলব'। আলেমরাই এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। বলা হয়, آفة العلم الخيلاء অর্থ : ইলমের আপদ হচ্ছে অহঙ্কার। হযরত থানবী রহ. বলেন, "অহঙ্কারশূন্য অজ্ঞতা, অহঙ্কারযুক্ত ইলম থেকে উত্তম'। তাই কোন আহলে নিসবত বুযুর্গের কাছে এই রোগের চিকিৎসা করা প্রয়োজন।
উপসংহার
দামী খাবার যেমন সুস্বাদু ও উপকারী হয়, তেমনি নষ্টও দ্রুত হয় এবং এর দুর্গন্ধও তীব্র হয়। তালিবে ইলমের মর্যাদা যেমন বিরাট, তার পদস্খলনও সেই অনুপাতে হয়। সুতরাং তালিবে ইলমির যামানায় কোন বুযুর্গ উস্তাদের পরামর্শে চলা এবং ফারেগ হওয়ার পর কোন আহলে নিসবত বুযুর্গের সাহচর্যে কিছুদিন কাটানো। তাহলেই দীনের প্রকৃত খাদিম হওয়া সম্ভব।
মন্তব্য (...)
এ সম্পর্কিত আরও প্রবন্ধ
থার্টিফাস্ট নাইট উদযাপন: পাশ্চাত্যের নগ্ন অনুকরণ
নববর্ষের সূচনাতে আল্লাহ প্রেমিক মুমিনের অনুভূতি জানুয়ারী-'১ থেকে একটি নতুন সৌরবর্ষের সূচনা হতে যাচ্ছ...
আল্লাহর কাছে ঘৃণিত যারা
আমাদের সমাজে এমন কিছু দুর্ভাগা রয়েছে, যাদের আল্লাহ তাআলা অত্যন্ত ঘৃণা করেন। কিয়ামতের দিন এই হতভাগাদে...
কুরআনের প্রতি জুলুম
মহিউস সুন্নাহ হযরত মাওলানা আবরারুল হক সাহেব হারদুঈ রহ. বলেন, ১. নিজের ঘর বাড়ি, দোকান-পাট, খাওয়া-দাওয়...