প্রবন্ধ

অধীনস্তদের অধিকার ও বর্তমান সমাজ

লেখক:মুফতী মীযানুর রহমান কাসেমী
১২ মার্চ, ২০১৬
৪২৪৫ বার দেখা হয়েছে
মন্তব্য

আল-কুরআনুল কারীমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুমিনদেরকে সম্বোধন করে বলেছেন, 'তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ কর এবং তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না।' (সূরা বাকারা- ২০৮) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় উলামায়ে কেরাম বলেন, পরিপূর্ণ ইসলাম হল পাঁচটি জিনিসের নাম। কেউ যদি পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করতে চায় তাহলে তাকে এ পাঁচটি বিষয় পুরোপুরি মেনে চলতে হবে। পাঁচটি বিষয় হল ঈমানিয়াত, ইবাদাত, মু'আমালাত, মু'আশারাত এবং আখলাকিয়াত। অর্থাৎ আকীদা-বিশ্বাস দুরস্ত করার মাধ্যমে ঈমান ঠিক করা, সুন্নাত তরীকায় ইবাদত-বন্দেগী করা, রিযিক হালাল রাখা, কার কী হক তা জেনে সেগুলো আদায় করা আর অন্তরের দশটি রোগ দূর করে দশটি গুণ পয়দা করা।

হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদুল মিল্লাত হযরত আশরাফ আলী থানবী রহ. বলেন, আমরা যারা নিজেদেরকে মুসলমান বলে দাবী করি তাদের মধ্যে প্রথম দু'টি জিনিস মোটামুটিভাবে বিদ্যমান থাকলেও অবশিষ্ট তিনটি জিনিস সাধারণ মুসলমান তো দূরের কথা, অনেক উলামায়ে কেরামের মধ্যেও পুরোপুরি নেই।

ঈমানিয়াত অর্থাৎ সঠিক আকীদা- বিশ্বাসের ভিত্তিতে ঈমান অনেকেরই দুরস্ত আছে। ইবাদাত অর্থাৎ নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত, দান-সদকা আদায়ের প্রতিও আমরা সকলে মোটামুটি সচেষ্ট থাকি। কিন্তু বাকি তিনটি জিনিস যথা, মু'আমালাত অর্থাৎ আয়-রোযগার, লেনদেন, ব্যবসা- বাণিজ্য,

চাকুরী-বাকুরী, ক্ষেত-খামার হালালভাবে খুব কম লোকেরই হয়ে থাকে। বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায় অনেক আলেম-উলামাও মু'আমালাতের ক্ষেত্রে শরয়ী বিধান থেকে অনেক দূরে।

মু'আশারাত অর্থাৎ সমাজে কার কী হক পিতা-মাতা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, উস্তাদ-ছাত্র, কর্মচারী- মালিক, শ্রমিক-মজদুর এমনকি পশু- পাখি, গরু-ছাগল এদেরও কী হক সে সম্পর্কে আমরা একেবারে উদাসীন। হক আদায় করা তো দূরের কথা আমরা এটা জানারও চেষ্টা করি না যে, কার কী হক? কার কী প্রাপ্য? অথচ হক নষ্ট করা এমন বিষয় যে, কিয়ামতের দিন এর বিনিময়ে নিজের সমস্ত আমল হকদারকে দিয়ে দিতে হবে।

হযরত আবূ হুরাইরা রাযি. বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি জান প্রকৃত নিঃস্ব কে? সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আমরা তো নিঃস্ব বলতে ঐ ব্যক্তিকে বুঝি যার কোন টাকা-পয়সা বা সহায়-সম্পত্তি নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, প্রকৃত নিঃস্ব ঐ ব্যক্তি, যে কিয়ামতের দিন নামায, রোযা, হজ্জ যাকাত ইত্যাদি নিয়ে উপস্থিত হবে; সাথে সাথে এটাও নিয়ে আসবে যে, দুনিয়াতে কাউকে গালি দিয়েছিল, কাউকে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিল, কারো সম্পদ আত্মসাৎ করেছিল, কাউকে হত্যা করেছিল এবং কাউকে প্রহার করেছিল। অতঃপর তার নেকি থেকে কিছু একজনকে, কিছু অন্যজনকে দেয়া হবে। হকদারদের দাবী শেষ হওয়ার আগেই যদি তার নেকি শেষ হয়ে যায় তাহলে তাকে হকদারদের সোপর্দ করা হবে। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (সহীহ মুসলিম: হাদীস নং: ৬৩৪৩) 

মু'আশারাত তথা হক আদায়ে শিথিলতা থাকলে তার পরিণতি কি রকম ভয়াবহ হবে তা এ হাদীস দ্বারা স্পষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু বর্তমানে দেখা যায় অনেক ভালো ভালো মানুষ যারা নিজেদেরকে দীনদার মনে করে, দীনের উপর চলার দাবী করে, অপরের হক আদায়ের ব্যাপারে তারাও অত্যন্ত উদাসীন। বিশেষ করে যারা অধীনস্ত তাদের হক আদায়ের ব্যাপারে শিথিলতা আরো বেশি। কাজের লোক, গাড়ির ড্রাইভার, দোকানের কর্মচারী, কারখানার শ্রমিক যারা আমাদের অধীনস্ত তাদের থেকে আমরা কাজটা কি পরিমাণ বুঝে নেই আর তাদের হক আমরা কতটুকু আদায় করি, তা অত্যন্ত গভীরভাবে বিশ্লেষণের দাবী রাখে। এ পর্যায়ে আমরা কয়েকটি হক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

১. সন্তানের হক।

২. ছাত্রের হক।

৩. কর্মচারীর হক।

৪. প্রজাদের হক। 


সন্তানের হক

পিতা-মাতার উপর সন্তানের হক অনেক বেশি। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হক হল, সন্তানকে চরিত্রবান ও আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা এবং তাদেরকে দীনী ইলম শিক্ষা দেয়া। অনেক পিতা-মাতা সন্তানকে দীনী শিক্ষায় শিক্ষিত না করে ভোগ- বিলাসিতায় আকণ্ঠ ডুবিয়ে রাখেন। খুব মনে রাখবেন, শৈশবে সন্তানের আখলাক-চরিত্র ভালো না হলে এবং তাকে দীন শিক্ষা না দেয়া হলে পরবর্তীতে তার পরিণাম খুবই খারাপ হয়। যখন কুরআনে পাকের আয়াত يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا) অবতীর্ণ হল, তখন হযরত উমর রাযি. জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! নিজেদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর বিষয়টি তো বুঝে আসে যে, আমরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকব এবং আল্লাহ তা'আলার আদেশ নিষেধ মেনে চলব। কিন্তু পরিবার-পরিজনকে কীভাবে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করব? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এর উপায় হল, আল্লাহ তা'আলা তোমাদেরকে যেসব কাজ করতে নিষেধ করেছেন, তোমরা তাদেরকে সেসব কাজ করতে নিষেধ করবে এবং যেসব কাজ করতে আদেশ দিয়েছেন তোমরা পরিবার-পরিজনকেও সেগুলো করার আদেশ দিবে। এভাবে করলে তোমরা তাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করতে পারবে। (তাফসীরে রুহুল মা'আনী ১৪/১৫৬)

একটি হাদীসে এর পদ্ধতি এভাবে শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে, সন্তানের বয়স সাত বছর হলে তোমরা তাদেরকে নামায পড়ার নির্দেশ দাও আর দশ বছর বয়স হলে প্রয়োজনে শাসনের জন্য প্রহার করে হলেও নামায পড়াও। (সুনানে আবূ দাউদ; হা.নং ৪৯৫)

হযরত আলী রাযি. বলেছেন, তোমরা নিজেদেরকে এবং স্ত্রী-সন্তানদেরকে দীন শেখাও এবং তাদের আখলাক-চরিত্র গঠন কর।


সন্তানের ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার 

সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার যেমন অধিকার আছে তেমনি পিতা-মাতার প্রতিও সন্তানের অনেক অধিকার রয়েছে। এমনকি সন্তানের এ অধিকারগুলো পিতা-মাতার অধিকারের উপর অগ্রগণ্য। যে পিতা-মাতা এ অধিকারগুলো সুন্দরভাবে আদায় করবে কেবল তারাই সন্তানের নিকট থেকে নিজেদের অধিকার আদায়ের নৈতিক শক্তি লাভ করবে। যারা সন্তানের অধিকার আদায় করে না তাদের জন্য সন্তানের নিকট থেকে অধিকার আদায়ের কোন হক নেই। প্রতিটি সন্তান পিতা- মাতার নিকট কয়েকটি ন্যায্য দাবী রাখে। এগুলোকে সন্তানের হক বা অধিকার বলে। পিতা-মাতার জন্য জরুরী হল, সন্তানের এ দাবীগুলো যথার্থভাবে আদায় করা।

এ পর্যায়ে সন্তানের ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে।

(১) প্রতিটি সন্তানের প্রথম দাবী ও অধিকার হল, তার 'মা' নেককার হওয়া। যাতে করে দীনদার মায়ের গর্ভে একজন নেক সন্তান জন্মগ্রহণ করতে পারে। তাই পিতার দায়িত্ব হল নেককার, দীনদার, চরিত্রবান মেয়েকে বিবাহ করা। যাতে সন্তানও নেককার হয়।

(২) সন্তানকে শৈশব থেকেই স্নেহ, মায়া, মমতাসহ লালন-পালন করা। সন্তানকে ভালোবাসার ফযীলত অনেক। বিশেষত কন্যা সন্তানের জন্ম ও লালন- পালনে অন্তরে কোন প্রকারের সঙ্কীর্ণতা ও অনীহা না থাকা। মেয়েদের লালন- পালনের বিশেষ ফযীলত রয়েছে। মোটকথা, সন্তান ছেলে হোক বা মেয়ে প্রত্যেকের একটি গুরুত্বপূর্ণ হক হল, পিতা-মাতার পরিপূর্ণ ভালোবাসা পাওয়া।

(৩) প্রয়োজনে অন্য মহিলার দুধ পান করাতে হলে দীনদার ও চরিত্রবান মহিলা নির্বাচন করা। কেননা বাচ্চার রুচি, চরিত্র, আদর্শ, বিশ্বাস ও অভ্যাসে দুধের প্রভাব অনেক বেশি। অর্থাৎ বাচ্চার আদব-আখলাক ও মন-মানসিকতা তার মতই হয় যার দুধ সে পান করে।

(৪) সন্তানকে দীনী ইলম ও আদব- আখলাক শিক্ষা দেয়া।

(৫) বিবাহের উপযুক্ত হয়ে গেলে বিবাহ দেয়া। বিনা কারণে বিলম্ব না করা। এতে অনেক সময় তাদের চরিত্র বিগড়ে যেতে দেখা যায়।

(৬) মেয়েকে বিয়ে দেয়ার পরে তার স্বামী মারা গেলে দ্বিতীয় বিয়ে হওয়া পর্যন্ত নিজের বাড়িতে তাকে অত্যন্ত যত্ন ও আরামের সাথে রাখা এবং তার জরুরী ভরণ-পোষণসহ অন্যান্য প্রয়োজন পুরা করা।


একটি শিক্ষণীয় ঘটনা

হযরত উমর ফারুক রাযি. এর খিলাফতকালে জনৈক বৃদ্ধ ব্যক্তি হযরত উমরের নিকটে এ মর্মে অভিযোগ করল যে, তার ছেলে তার হক আদায় করে না। হযরত উমর রাযি. ছেলেকে ডেকে তার বিরুদ্ধে পিতার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলেন। ছেলে বলল, আমীরুল মুমিনীন! অভিযোগ সম্পর্কে উত্তর দেয়ার আগে আপনার নিকট আমার একটি প্রশ্ন আছে। সেটা হল, ইসলামে কি শুধু সন্তানের প্রতি পিতার অধিকার সাব্যস্ত আছে, নাকি পিতার উপর সন্তানেরও কিছু অধিকার আছে? হযরত উমর রাযি. বললেন, পিতার উপর সন্তানেরও কিছু অধিকার আছে। ছেলেটি বলল, আমি আপনার মুখে সেই অধিকারগুলোর কথা শুনতে চাই। হযরত উমর রাযি. বললেন, পিতার উপর সন্তানের অন্যতম তিনটি হক হল, 

(১) সন্তান লাভের জন্য দীনদার স্ত্রী নির্বাচন করা। 

(২) সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তার একটি অর্থবহ সুন্দর ইসলামী নাম রাখা।

(৩) সন্তানের জ্ঞান-বুদ্ধি হলে তাকে আদব-আখলাক এবং দীনী ইলম শিক্ষা দেয়া।

একথা শুনে ছেলেটি বলল, আমার পিতা আমার এই তিনটি হকের একটিও আদায় করেননি। তিনি দীনদার মহিলার পরিবর্তে একজন বাজারী মহিলাকে বিয়ে করেছেন, জন্মের পরে আমার ভালো কোন নাম রাখেননি, আর দীনের কোন বিষয়ও আমাকে শিক্ষা দেননি।

ছেলের বক্তব্য শুনে হযরত উমর রাযি. তার পিতার প্রতি খুব রাগান্বিত হলেন এবং তাকে ভৎর্সনা করলেন। অতঃপর একথা বলে অভিযোগ খারিজ করে দিলেন যে, যাও সন্তানের হক আদায় না করে তার প্রতি যে অবিচার করেছো আগে তার ক্ষতিপূরণ কর এরপর ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ কর।


সন্তানকে দীন শিক্ষা না দেয়ার ভয়াবহ পরিণতি

পিতা-মাতা সাধারণত সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যত কামনা করে থাকে। এর জন্য তারা বিভিন্নভাবে দৌড়ঝাঁপও করে। সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যত সুনিশ্চিত করতে তাকে কোথায় পড়াবে, কী পড়াবে এ নিয়ে বেশ টেনশনে থাকে। পরে খোঁজ-খবর ও যাচাই শেষে নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করতে সচেষ্ট হয়। সন্তানের জন্য পিতা-মাতার এই উদ্বেগ ও প্রচেষ্টা অবশ্যই কাম্য এবং ভালো। কিন্তু কথা হল, সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যত কামনায় আমরা যা কিছু করি এবং তাদের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে তাদের পেছনে যেভাবে অর্থ-সময় ব্যয় করি, শ্রম দিয়ে প্রতিপালন করি তা মূলত কসাইয়ের গরু পালনের মত। কসাই গরু কিনে খুব যত্নের সাথে তাকে লালন-পালন করে। প্রচুর ঘাস-পানি খাওয়ায়। ফলে অতি অল্প সময়েই গরু মোটাতাজা হয়ে যায়। কিন্তু এর একমাত্র উদ্দেশ্য থাকে তার গলায় ছুরি চালানো। আমাদের অভিভাবকদের দশাও তাই। সন্তান দুনিয়াতে কিভাবে ভালো লেখাপড়া শিখে বড় চাকুরী করতে পারবে, বড় পদে অধিষ্ঠিত হতে পারবে, অনেক বেশি অর্থ-সম্পদের মালিক হতে পারবে এটাই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। দীন শিক্ষা না দেয়ার কারণে এভাবে তাদেরকে জাহান্নামের ইন্ধনরূপে গড়ে তোলা হয়। কসাই তো গরু পালন করে একসময় জবাই করে তা দ্বারা পার্থিব উপকার হাসিল করে। কিন্তু এসব পিতা- মাতারা কি করলেন? দু'দিনের সুখ- শান্তির স্বপ্ন দেখিয়ে অনন্তকালের জাহান্নামে ঠেলে দিলেন! এই যদি হয় পিতা-মাতার অবস্থা তাহলে সন্তানের জন্য তাদের মায়াকান্নার কি স্বার্থকতা থাকতে পারে!

অনেক পিতা-মাতা সন্তানের অধিকার বলতে শুধু তাদের ভরণ-পোষণ আর বৈষয়িক শিক্ষা বুঝে থাকে। যদি তারা লেখাপড়া আর আয়-রোজগারে মনোনিবেশ করে এবং পিতা-মাতা নামায-রোযা করে তাহলে একথা ভেবে তারা চরম আত্মতৃপ্তি লাভ করে যে, আমরা সফলকাম, জান্নাত এক প্রকার নিশ্চিত হয়ে গেছে। অথচ তাদের খবরও নেই যে, সন্তান নামায-রোযা ইত্যাদি না করার কারণে যখন জাহান্নামে যাবে তখন সাথে করে এই নামাযী পিতা- মাতাকেও জাহান্নামে নিয়ে যাবে। কেননা তারা সন্তানকে দীনী ইলম শিক্ষা দেয়নি। সৃষ্টিকর্তার সাথে তাদের সম্পর্ক স্থাপন করায়নি।


সন্তানকে নেককার বানানোর উপায় 

কিতাব-পত্র থেকে নেককার হওয়ার নিয়ম পড়ার দ্বারা নেককার হওয়া যায় না। বরং প্রকৃত সৎগুণ অর্জিত হয় কোন আল্লাহওয়ালা নেককার লোকের সান্নিধ্যে থাকার দ্বারা। সুতরাং সন্তানকে নেককার বানাতে হলে কোন বুযুর্গের সান্নিধ্যে কিছুদিন রাখতে হবে। কমপক্ষে মহল্লার মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে নিয়ে যাওয়া, তার থেকে দু'আ নেয়া, তার মজলিসে কিছুক্ষণ বসানোর অভ্যাস করার দ্বারাও এই গুণ অর্জিত হতে পারে। একান্ত সম্ভব না হলে বিভিন্ন ছুটির সময় কোন আল্লাহওয়ালার 

সান্নিধ্যে রাখা অবশ্যই জরুরী। ছুটির সময়গুলো বাচ্চারা খামাখা নষ্ট করে। পিতামাতা উক্ত সময়কে সন্তানের আখেরাত গড়ার কাজে লাগাতে পারেন। কাজেই সন্তানের আত্মিক পরিশুদ্ধি ও আদব-আখলাক শেখার অপূর্ব সুযোগ মনে করে এ সময় তাকে কোন নেককার বুযুর্গের সোহবতে পাঠিয়ে দিন। 


ছাত্রের হক

ছাত্ররা শিক্ষকদের অধীনস্ত। ছাত্ররা লেখাপড়ার পাশাপাশি নৈতিকতা, শিষ্টাচার, আদব-আখলাক ইত্যাদি গুণে গুণান্বিত হতে পারল কিনা সেদিকে খেয়াল রাখা শিক্ষকের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। বিশেষ করে কওমী মাদরাসার ছাত্র, যারা সার্বক্ষণিক মাদরাসায় অবস্থান করে এবং পিতা-মাতারা এই সন্তানদেরকে মাদরাসা কর্তৃপক্ষের উপর বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করে তাদের সোপর্দ করে দিয়েছে। সুতরাং এসব ছাত্রদের সময় ও জান উস্তাদের হাতে আমানত। ছাত্ররা লেখাপড়ার পাশাপাশি উত্তম আমল-আখলাক এবং সুন্নাতের প্রতি মনোযোগী কিনা সে বিষয়টি দেখার দায়িত্ব উস্তাদের। ছাত্রদেরকে শুধু পড়িয়ে দেয়াই যথেষ্ট নয়। অনেক মাদরাসায় দেখা যায় উস্তাদগণ শুধু কোন রকমে দরস দিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করেন। এরপরে ছাত্ররা কোথায় গেল, কার সাথে মিশল, মোবাইল ঘাটাঘাটি করে কী সব দেখল এসব বিষয়ে খোঁজ নেয়ার প্রয়োজন মনে করেন না। ফলে দেখা যায় এসব ছাত্র আট/দশ বছর কুরআন হাদীস পড়ার পরেও তার নামায সহীহ হয় না, অন্যান্য আমল সুন্নাত অনুযায়ী হয় না। পিতা-মাতা যে আশা নিয়ে সন্তানকে মাদরাসায় দিয়েছিল সে আশা আর পুরা হয় না। এজন্য উস্তাদদেরকে দায়ী থাকতে হবে। শুধু মাদরাসা খুলে বসলেই হবে না। পরিতাপের বষয় হল, মাদরাসার দরসের পরে আর কোন উস্তাদকে খুঁজে পাওয়া যায় না। ছাত্ররা এতীমের মত এদিক সেদিক ঘুরাফেরা করতে থাকে। অনেক মাদরাসায় আযান-ইকামত সহীহ তরীকায় হয় না। ছাত্রদের লেবাস-পোশাক সুন্নাত মত হয় না। ইংরেজি শিক্ষিতদের মত মাথার চুল বড় বড় থাকে। মাদরাসা কর্তৃপক্ষ এদিকে কোন দৃষ্টি দেয় না। এভাবে ছাত্রদের হক নষ্ট করার কারণে মাদরাসা কর্তৃপক্ষকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। সুতরাং কোন রকমে একটা মাদরাসা চালু করলেই হবে না। প্রথমে

নিয়ত সহীহ করতে হবে যে, কী জন্য আমি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করছি কিংবা মাদরাসায় পড়াচ্ছি।


কর্মচারীর হক

সহীহ বুখারীর হাদীসে ইরশাদ হয়েছে, كلكم راع وكلكم مسئول عن رعيته অর্থ: তোমাদের প্রত্যেকেই তত্ত্বাবধায়ক আর যার তত্ত্বাবধানে যারা আছে তাদের ব্যাপারে তাকে জবাবদিহী করতে হবে। (হা.নং ৫২০০)

এ হাদীস দ্বারা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, যার অধীনে যারা আছে তাদেরকে দীনদার বানানো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির যিম্মাদারী। একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, দাসী- বাঁদীকে দীনী কথা শিক্ষা দেয়াও সওয়াবের কাজ। একজন দোকানের মালিক যার অধীনে দুই/একজন কর্মচারী কাজ করে তাদেরকে দীন শেখানো মালিকের যিম্মাদারী। যিনি কারখানার মালিক, গার্মেন্টসের মালিক তার দায়িত্ব সমস্ত কর্মচারীকে দীন শেখানো, নামাযী বানানো। যিনি নেতা তার দায়িত্ব সমস্ত কর্মীকে দীনদার বানানো। এই দায়িত্ব পালন না করলে কিয়ামতের দিন তারা পাকড়াও হবে। অনুরূপভাবে শ্রমিক, মজদুর, কর্মচারীর বেতন, ভাতা, বোনাস যৌক্তিক পরিমাণে এবং সময়মত আদায় করাও মালিকের অন্যতম যিম্মাদারী। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তার পারিশ্রমিক পরিশোধ কর। আমরা যদি এই হাদীসের উপর আমল করতাম তাহলে দাবীতে শ্রমিকদের রাজপথে নামতে হত না। আমরা শ্রমিকদের নিকট থেকে আমাদের পাওনা পুরোপুরি বুঝে নিতে চাই কিন্তু তাদের পাওনা বুঝিয়ে দিতে আমাদের খুব কষ্ট হয়। 

বেতন-ভাতার অনেক তথাকথিত শিক্ষিত লোকদেরকে দেখা যায়, ঘরের কাজের লোক অর্থাৎ গৃহপরিচারকের সাথে খারাপ আচরণ করে। তাকে বাসি-পঁচা, এঁটো-ঝুটা ইত্যাদি খেতে দেয়। নিজেরা পালঙ্কে শুয়ে তাকে মেঝেতে শুতে দেয়। নিজেরা মশারীতে শুয়ে তাকে মশার হাতে সোপর্দ করে দেয়। সামান্য সামান্য কারণে অমানবিক আচরণ করে। মারপিট করে, গরম খুন্তি দিয়ে ছ্যাকা দেয়। আরো অনেক অত্যাচার নির্যাতন করে। যেগুলো শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে একেবারে হারাম। কাজের লোকের উপর এভাবে যুলুম-নির্যাতন করলে নামায- কালাম, ইবাদত-বন্দেগী কোন কাজে আসবে না। 


প্রজাদের হক

আমরা অনেকে ক্ষমতা পাওয়ার জন্য লালায়িত। গদি পাওয়ার জন্য সবকিছু করতে রাজি। কিন্তু এটা যে কত বড় বোঝা তা উপলব্ধি করলে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নির্বাচন করা তো দূরের কথা, জোর করে কেউ ক্ষমতায় বসিয়ে দিলেও নেয়ার জন্য রাজি হতাম না। সহীহ বুখারীর হাদীসে এসেছে, فالإمام الذي على الناس راع وهو مسئول عن رعيته.অর্থ: যিনি আমীর তথা রাষ্ট্রপ্রধান তিনি রাষ্ট্রের সকলের তত্ত্বাবধায়ক। জনগণ সম্পর্কে তাকে জবাবদিহী করতে হবে। (হা.নং ৭১৩৮)

এই হাদীস দ্বারা বুঝা গেল, রাষ্ট্রপ্রধানকে জনগণের জান-মালের নিরাপত্তার ব্যাপারে জবাবদিহী করতে হবে। তার অধীনস্ত কোন মানুষ না খেয়ে মারা গেলে তারও কৈফিয়ত দিতে হবে। অধীনস্তদেরকে দীনের উপর চালানোর জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে কিনা সে ব্যাপারেও জবাবদিহী করতে হবে। বোঝা গেল, পদ যত বড় হবে তার দায়িত্বও তত বেশি হবে। পদ কোন হালকা বিষয় নয়। হযরত উমর ফারূক রাযি. খলীফাতুল মুসলিমীন ছিলেন। দায়িত্বের চিন্তায় তার ঘুম আসত না। মানুষের আসল অবস্থা জানার জন্য রাতের অন্ধকারে ঘুরে ঘুরে জনগণের প্রকৃত অবস্থা জানার চেষ্টা করতেন। তিনি বলতেন, আমার রাষ্ট্রের অধীনে, আমার সীমানার মধ্যে একটা কুকুরও যদি না খেয়ে মারা যায় তাহলে সে ব্যাপারেও আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। বোঝা গেল, পদ এত সহজ বিষয় নয়। মানুষ পদের দায়িত্বের দিকে খেয়াল করে না। বরং পদকে নিজের দুনিয়া গোছানোর সুযোগ হিসেবে দেখে থাকে। তাই সামান্য একটা চেয়ারম্যান আর মেম্বরের পদের জন্যও মানুষ কোটি কোটি টাকা অবলীলায় খরচ করতে দ্বিধাবোধ করে না। আগের যুগে বুযুর্গানে দীনের এমন অবস্থা ছিল যে, তাদেরকে পদ নেয়ার জন্য চাবকানো হত, অত্যাচার করা হত, তবুও তারা পদ গ্রহণ করতেন না। ইমাম আযম আবূ হানীফা রহ.কে দেশের প্রধান বিচারপতি হওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি তাতে রাজি হননি। তাকে কারাগারে বন্দী করা হয়েছে, জল্লাদ দিয়ে প্রহার করা হয়েছে, তারপরও তিনি পদ গ্রহণ করেননি। 

সবচেয়ে বেশি হাদীস বর্ণনাকারী হযরত আবূ হুরাইরা রাযি.কে মদীনার গভর্ণর হওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। তিনি রাজি হননি। অনেক চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে, তাতেও রাজি হননি। শেষ পর্যন্ত বলেছেন, আমার একটা শর্ত মেনে নিলে আমি এই দায়িত্ব নিতে পারি। জিজ্ঞাসা করা হল, কি সেই

শর্ত? তিনি বললেন, আমি যে মসজিদে নববীতে আযান দিচ্ছি এই পদে আমাকে বহাল রাখতে হবে। তার একথা শুনে লোকেরা আশ্চর্য হয়ে গেল। বোঝা গেল, চাপের মুখে মানুষের স্বার্থের কথা চিন্তা করে তিনি গভর্ণর হতে রাজি হয়েছেন, কিন্তু এই পদের প্রতি তার কোন মোহ ছিল না। কেননা প্রজারা যত গুনাহ করবে রাষ্ট্রপ্রধান তা বন্ধ করার উপযুক্ত ব্যবস্থা না নিলে সব রাষ্ট্রপ্রধানের আমলনামায়ও জমা হবে। আমি অফিসের বস, তাহলে অফিসে যারা আমার অধীনস্ত তাদের ব্যাপারে আমাকে জবাবদিহী করতে হবে। এই জবাবদিহীতা থেকে বাঁচার জন্য অধীনস্ত লোকদেরকে নামাযের কথা বলতে হবে, দীনের উপর চলার কথা বলতে হবে। পদের দায়িত্ববোধ, দীনী জযবা ও আন্তরিক মমতা দিয়ে তাদেরকে বোঝাতে হবে। এরপরেও যদি তারা না মানে তার জন্য আমি দায়ী হব না। যিনি কোন এলাকার এম.পি বা চেয়ারম্যান তাকে তার এলাকার লোকজনের ব্যাপারে জবাবদিহী করতে হবে। যিনি কোন এলাকার মেম্বার বা কমিশনার তাকে এলাকার লোকের ব্যাপারে জবাবদিহী করতে হবে। মোটকথা, যার ক্ষমতা এবং কর্তৃত্বের পরিধি যতটুকু তাকে সেই পরিমাণে জবাবদিহী করতে হবে। এভাবে সকলে যখন সকলের হক আদায় করবে তখন সমাজে কোন অস্থিরতা, যুলুম-নির্যাতন থাকবে না। আমরা আবার ফিরে পাবো ইসলামের সোনালী যুগ।

মন্তব্য (...)

লেখকবৃন্দ

সকল লেখক →

মুফতী আবুল হাসান শামসাবাদী

শাইখুল ইসলাম আল্লামা যাহেদ কাউছারী রহঃ

মুফতী আব্দুল হান্নান হাবীব

মুফতী সালমান মানসুরপুরী

শাইখুল হাদীস আল্লামা আব্দুল কুদ্দুস দাঃ

আল্লামা আহমাদ মায়মূন

মাওলানা আতাউল্লাহ আব্দুল জলীল

আল্লামা রফী উসমানী রহঃ

মুফতী রশীদ আহমদ লুধিয়ানভী রহ.

মাওলানা নূর আলম খলীল আমিনী

হযরত মাওলানা আবদুল হাই পাহাড়পুরী রহঃ

হযরতজী মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভি রহঃ

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রহমান

মাওলানা মুহাম্মাদ ইমরান হুসাইন

মাওলানা শাহাদাত সাকিব

আল্লামা ইসহাক ওবায়দী রহঃ

মাওলানা ওমর পালনপুরী

মুফতী আবুল কাসেম নোমানী

হাকীমুল উম্মত হযরত আশরাফ আলী থানভী (রহ)

আল্লামা মানাযির আহসান গিলানী রহঃ